তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি, বয়স এই ১৫ হবে। ২০০৫ সালের ১৫ই আগস্ট। একটা ভাড়া করা টাটা সুমো গাড়িতে আমরা ৬ জন ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলেছি। আমি, বাবা, প্রতীকদা, প্রতীকদার বাবা, মা, দাদা, বৌদি। প্রতীকদার জন্য মেয়ে দেখতে যাওয়া হচ্ছে তাই খুব স্বাভাবিকভাবে প্রতীকদা কিছুটা নার্ভাস আর কিছুটা চুপচাপ। তখন কাঁসাই ব্রিজের ওপর দিয়ে গাড়িটা নিয়ে গেলেই গাঁট গুনে ২ টাকা টোল ট্যাক্স দিতে হত। কাঁসাই ব্রিজের ওপর উঠেই বাঁদিক ঘেঁষে গাড়িতে দাঁড়িয়ে গেলো। সামনে অন্তত আরও ১০ টা গাড়ি দাঁড়িয়ে। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বাবা পকেট থেকে একটা ৫ টাকার নোট বার করলেন। রাস্তার দুধারে শুধু ঝাউ আর কাজুগাছের সমারোহ। দুচোখ মিলে আমি সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছি। আমার স্কুলের বন্ধুরা একবার এই ঝাউবনেই পিকনিক করতে এসেছিল কিন্তু বাবা আমায় ছাড়েনি। যত ওই জঙ্গলটার দিকে তাকাচ্ছিলাম ততই মনটা বিষিয়ে উঠছিল। মনে মনে বলছিলাম ‘ইস, এতো সুন্দর একটা জায়গা; সবাই এলো অথচ আমিই আসলাম না’। যদিও মন ভালো করার উপকরন ও ছিল। ব্রিজের ঠিক নীচে একটা ছোট্ট গ্রাম আর সেখান থেকেই উচ্চস্বরে ভেসে আসছে ‘মুকাবিলা, মুকাবিলা, ও লায়লা’। এই গানটা শুনলেই হৃদয়টা কেমন দুলে ওঠে। আমাদের ক্লাসের সৌভিক এই গানটায় এমন নাচ করে যে ওকে পুরো ক্লাস প্রভু দেবা বলে ডাকে। বাবার মুখটা দেখলাম বেশ গম্ভীর, প্রতীকদার বাবাকে গম্ভীরভাবে বললেন ‘কি অবস্থা, স্বাধীনতা দিবসে এই গান। সংস্কৃতি বলে আর কিছুই রইলনা’। আমাদের গাড়িটা একদম টোল ট্যাক্সের জানলা ঘেঁষে দাঁড়াল। বাবা পকেট থেকে ৫ টাকার নোটটা বার করতেই ভেতর থেকে একটা বুড়োমত ভদ্রলোক বলে উঠলেন ‘দাদা, কোনদিকে যাবেন?’। বাবা উত্তর দিলেন ‘আনন্দপুর গ্রাম, কেশপুর থানা’। সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা কৌতুক মেশানো উত্তর ভেসে এলো। ‘টোল ট্যাক্স লাগবেনা’। বাবা তো কিছুটা হতভম্ব হয়েই তাকিয়ে থাকলেন। ‘আরে মশাই, ধরমা পার করার পরই দেখবেন অন্তত ৫ খানা টোল ট্যাক্স। খুচরোটা পকেটেই রাখুন, নয়ত বিপদে পড়ে যাবেন’। আমরা সবাই কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম। একটা ফিচকে হাঁসির সাথে সেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন ‘ওই যে মুকাবিলা, শুনতে পাচ্ছেন তো? আজ যে ১৫ই আগস্ট। ছেলেপুলেরা স্বাধীনতা পুজো করছে’। ‘স্বাধীনতা পুজো!’ কথাটা শুনে বাবাও মুচকি হেঁসে উঠলেন।

কাঁসাই নদীর ওপর দিয়ে আমাদের গাড়িটা এগিয়ে চলছে আর আমিও দুচোখ মেলে দুপাশে তাকিয়ে আছি। ব্রিজের ওপর সার দিয়ে বাঁধা ছোট ছোট জাতীয় পতাকা। হয়ত নদীর জন্যই হবে, আশেপাশের গ্রাম থেকে ৩-৪ টে আলদা আলাদা চালু হিন্দি গান ভেসে এসে নতুন এক সঙ্গীতের জন্ম হয়েছে। কাঁসাই ব্রিজ থেকে কিছুটা নামার পরই ডান দিকে ধরমা। ঠিক ধরমার মোড়টা আসতেই দেখি, রাস্তাটা বাঁশ দিয়ে ঘেরা। প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষিয়ে আমাদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেলো। জানলা দিয়ে মুখটা বাড়িয়ে দেখলাম এক যুবক কিছুটা টলতে টলতে আমাদের গাড়িটার দিকে আসছে। বুঝলাম সে এই মুহূর্তে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। বাবা ততক্ষনে পকেট থেকে রুমালটা বার করে নাকে ঢাকা দিয়েছেন। মনে মনে বললাম ‘ইস আমার কাছে যদি একটা রুমাল থাকতো!’ ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ১০ টাকা দ্যান’। মুহূর্তের মধ্যে একটা নোংরা রোমশ হাত, একটা চাঁদার রসিদ আর দেশী মদের বিষাক্ত গন্ধ জানলা ভেদ করে গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। প্রতীকদা কিছুটা ইয়ার্কির ছলে বলে উঠল ‘কি কি অনুষ্ঠান হবে?’। দেখলাম বাবা কটমট করে প্রতীকদার দিকে তাকালেন, প্রতীকদাও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ঠোঁট টিপে হাঁসতে শুরু করল। ওই আপনভোলা শিব ঠাকুরটির এইসব ছোটখাটো ব্যাপারে নজর দেওয়ার সময় ছিলনা। সে আপন মনেই বিড়বিড় করতে শুরু করল, ‘সন্ধ্যে ৬ টায় পাড়ার মেয়েমানুষদের জন্য মোমবাতি প্রতিযোগিতা, ৭ টায় ফিল্মি নৃত্য…’। দেখলাম বাবা বাঁ হাতটা খুব জোরে নেড়ে সেই আপনভোলা মানুষটিকে চুপ করে যেতে বললেন। ততক্ষনে আমাদের গাড়িটার মধ্যে দেশী তাড়ির সুমিষ্ট গন্ধ ভনভন করতে শুরু করেছে। বাবা ১০ টাকার একটা নোট প্রায় ছুঁড়ে দিলেন বাইরের দিকে আর ড্রাইভারকে গাড়িটা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ইশারা করলেন। হথাত ‘ও পরিতোষ বাবু, পরিতোষ বাবু’ বলে তারস্বরে একটা চিৎকার। ড্রাইভার ও বাবার নামটা জানতেন। আবার ক্যাঁচ করে একটা শব্দ করে আমাদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেলো। আমি আর বাবা দুজনেই জানলার বাইরে মুখটা বাড়িয়ে উঁকি মারলাম। একটা রোগা, ছিপছিপে মানুষ রাস্তার ওপার থেকে প্রায় রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে আমাদের দিকে আসছেন।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবা গাড়ির দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। ‘আরে অসিত কতদিন পর তোমার সাথে দেখা। কেমন আছো? এখন আর খড়গপুরের দিকে যাওয়া হয়না বুঝি’। প্রায় হাফাতে হাফাতে লোকটা উত্তর দিল ‘না, দাদা ওদিকে আর যাওয়া হয়না। সত্যি অনেকদিন পর আপনার সাথে দেখা হোল। কেমন আছেন? কোথায় যাচ্ছেন এখন?’ বাবার দেখাদেখি আমরাও ততক্ষনে গাড়ি থেকে নেমে এসেছি। বাবাই এক এক করে প্রত্যেকের সাথে পরিচয় করালেন। ‘ও মৃন্ময়, আমার ছেলে। প্রতীক, প্রতীকের বাবা, মা, দাদা, বৌদি। আমরা প্রতীকের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। বাড়ি আনন্দপুর গ্রাম। আর ও হোল অসিত। অসিত কর্মকার। পেশায় সাংবাদিক। এছাড়া কিছু সামাজিক কাজের সাথেও যুক্ত। তুমি কোথায় যাচ্ছ অসিত?’। সুমিষ্ট হাঁসির সাথে অসিত কাকু উত্তর দিলেন ‘বিপ্লব ভবন। আপনাকে বলেছিলাম না একবার! এই ছুটির দিন দেখে ওখানে যাই কিছুটা রক্ষনাবেক্ষনের চেষ্টা করি, তবে দাদা, সত্যি একার পক্ষে পেরে ওঠা যায়না’। বাবাও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন ‘এককাজ কর অসিত, গাড়িতে উঠে বস, বিপ্লব ভবন তো যাওয়ার পথেই পড়বে। তোমার সাথে রাস্তায় গল্পও হবে’। অসিত কাকু এককথায় আমাদের সাথে যেতে রাজী হয়ে যায়। আমার আর বাবার মাঝে বসায়, অসিত কাকুর প্রতিটা কথা আমিও খুব ভালোভাবে শুনতে পাচ্ছিলাম।

‘আসল অসুবিধেটা কোন জায়গায়? সরকারের উদাসীনতা নাকি অর্থের অভাব?’। আমার বয়স তখন সবে ১৫ হলেও রাজনীতি, সমাজ, দেশ এইসব নিয়ে অনেককিছুই বাবার থেকে শুনেছিলাম, তাই এগুলো কিছুটা হলেও বুঝতাম। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে অসিত কাকু উত্তর দিলেন ‘আমাদের উদাসীনতা’। মাত্র ৫ মিনিট গাড়িটা চলেছিল, আবার প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রচণ্ড কর্কশ স্বরে ভেসে এলো হিন্দি গানের স্বর। আমার তো বেশ মজাই লাগছিল, জানলা দিয়ে মুখটা বাড়িয়ে দেখলাম আমারই বয়সী ৪-৫ খানা ছেলে রাস্তার ওপর নেচে চলেছে। আমারও ইচ্ছে করছিল ওদের সাথে গিয়ে কোমর মেলাতে। আবার সেই একি প্রতিচ্ছবি; একটি মাতাল, একটি চাঁদার বই, ১০ টাকা ও বাবার মুখে রুমাল। হথাত সবাইকে চমকে দিয়ে অসিত কাকু বাবার বাঁ হাতটা প্রচণ্ড জোরে জাপটে ধরলেন। ১০ টাকার নোটটার একপ্রান্ত বাবার হাতে ও একপ্রান্ত সেই দেশপ্রেমিক মাতালটির হাতে। একটা দৃঢ়প্রত্যয়ী কণ্ঠে অসিত কাকু হুঙ্কার ছাড়লেন ‘এক টাকাও দেওয়া হবেনা’। দেখলাম মাতালটি কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে দুপা পিছিয়ে দাঁড়াল, বাঁশের বেষ্টনীও নিমেষের মধ্যে ভ্যানিশ হয়ে গেলো। আমি একবার অসিত কাকুর দিকে তাকালাম। রোগা, লিকলিকে ওই মানুষটাকে দেখে আমার কেমন যেন অমিতাভ বচ্চনের কথা মনে পড়ে গেলো, ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান লুক’। আসলে বোধহয় আমার শৈশব আর কৈশোরকে ভীষণভাবে বলিউডি চালচলন গ্রাস করেছিল। হ্যাঁ, এটা সত্যি, সেদিন অসিতকাকুর ওই হুঙ্কার আমাকে ‘বিগ বি’র কথাই মনে করিয়েছিল। এরপরও ওই একি দৃশ্যের অন্তত বার ২-৩ পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল; মাতাল দেশপ্রেমিক, বাবার মুখে রুমাল, ১০ টাকা চাঁদা ও অসিতকাকুর হুঙ্কার।

মনেহয় আমরা মিনিট ১৫ এগিয়েছি ধরমা থেকে। দেখলাম অসিতকাকুর একটা হাত আমার বাঁকাঁধটা স্পর্শ করল। আমি অসিতকাকুর দিকে তাকাতেই উনি হাসিমুখে বললেন ‘মৃন্ময়, তাহলে তুমিও মেয়ে দেখতে যাচ্ছ’। লজ্জায় মুখটা নিচু করে নিয়ে আমিও উত্তর দিলাম ‘না, কাকু। আসলে আজ স্কুলে ছুটি পেলাম তাই ভাবলাম ঘুরে আসি’। ‘পরিতোষ বাবু, আমি বলছিলাম মৃন্ময় যদি আমার সাথে যায়। আপনারা মেয়ে দেখুন, কিছুক্ষন পর নাহয় গাড়িটা পাঠিয়ে দেবেন ও আবার আপনাদের কাছেই ফিরে যাবে’। মনে হয় অসিতকাকুর কথাটা বাবার পছন্দই হয়েছিল। বাবা একবার আমার দিকে তাকালেন আর আমিও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের গাড়িটা একটা তিনমাথা মোড়ে এসে দাঁড়াল। বাঁদিকে একটা লাল মোড়মের রাস্তা সোজা চলে গেছে। বুঝলাম এটাই আমার আর অসিতকাকুর গন্তব্য। আমি আর অসিতকাকু গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম, বাবা ভেতর থেকে হাতটা নাড়লেন ও বলে উঠলেন ‘এক ঘণ্টার মধ্যেই আমি গাড়িটা পাঠাচ্ছি’। কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে গেলো। আমার হাতটা আলতো করে ধরে অসিতকাকু আমায় বাঁদিকের রাস্তাটার দিকে নিয়ে গেলেন। ‘এই যে রাস্তাটা দেখছ, এটাই এখন তোমার গন্তব্য। এই রাস্তা তোমায় এক নতুন জীবনদর্শন করাবে’। আমার কেমন একটা অদ্ভুত লাগলো কথাটা। আমি কাকুর সাথে হাঁটতে থাকলাম। চারপাশে ঘন বাঁশের জঙ্গল, এই ভরদুপুরেও এখানে এক চিলতে রোদ্দুর ঢোকেনা। কাঁসাই নদীর মৃদুমন্দ হাওয়ায় গাছের পাতায় কেমন খসখস করে শব্দ হতে শুরু করল। ‘ভূত’ আমি কখনো দেখিনি, কিন্তু ছোট থেকেই ভূতের গল্প প্রচুর পড়েছি। হয় গ্রামের বাঁশবন নয় শহরের পরিত্যক্ত বাড়ি এই হোল ভূতের আস্তানা। আমার গাটা কেমন ছমছম করতে শুরু করল।

এর আগে যা অনুভব করিনি এখন তাই অনুভব করলাম। হয়ত আমার মনের ভুলই ছিল, কিন্তু সত্যিই অসিতকাকুর হাতটা বরফের মত ঠাণ্ডা লাগছিল। একবার আড়চোখে কাকুর দিকে তাকালাম। একবার এক গল্পের বইতে পড়েছিলাম যে ভূতের নাকি ছায়া পড়েনা। বাঁশের ঘন জঙ্গল অতিক্রম করে এক ফোঁটা রোদও ভেতরে প্রবেশ করছিলনা তাই সত্যিই আমার মনের ভুল নাকি অসিত কাকু… তা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিলনা। কাকুই বলে উঠলেন ‘কি মৃন্ময়, ভয় করছে?’ আমি কি উত্তর দেবো তা বুঝে ওঠার আগেই কাকু বলে উঠলেন ‘এই রাস্তায় একবার যে হাঁটে সে ‘ভয়’ নামক শব্দটিকে পরাজিত করে দেয়’। ‘জানো এই রাস্তা কোথায় যাচ্ছে?’ আমি ঘাড়টা নেড়ে ‘না’ বললাম। ‘মৃন্ময়, তোমার বাবার থেকে শুনলাম তুমি ক্লাস নাইনে পড়ো। মৃন্ময় তুমি শহীদ ক্ষুদিরাম বোসের নাম শুনেছ?’ ‘ক্ষুদিরাম’ শব্দটা শুনেই স্কুলের ইতিহাস দিদিমনির কথা মনে পড়ে গেলো। কালই ক্লাসে দিদিমনি মাধ্যমিকের গুরুত্বপূর্ণ ৫ নাম্বারের কিছু টিকা দিয়েছিলেন। তারমধ্যে একটা টপিক ছিল ‘শহীদ ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী’। কাকুর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে উত্তর দিলাম ‘হ্যাঁ শুনেছি। আমাদের দেশের প্রথম শহীদ উনি। আমাদের এই মেদিনীপুর জেলাতেই জন্ম। অত্যাচারী… (ইংরেজ অফিসারের নামটা ভুলে গেছিলাম। আসলে ইতিহাস তো কোনকালেই আমার প্রিয় বিষয় নয়।) মাত্র ১৭ বছর বয়সে উনি শহীদ হয়েছিলেন’। কাকু একটু মুচকি হেঁসে উঠলেন। ‘মৃন্ময়, তুমি যতটা জানো তা আমার জেলার ৯০ ভাগ লোকই জানেন না। তবুও এটা যথেষ্ট নয়। আজ তোমাকে ক্ষুদিরামের সাথে পরিচয় করাবো। তোমারই বয়সী একটা ছেলে কিভাবে দেশের জন্য নিজের প্রান উৎসর্গ করলো তা তুমি নিজের চোখেই দেখে নিও। ওই যে দুরের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছ, ওটাই ক্ষুদিরামের আদি বাড়ি, ওটাকেই ‘বিপ্লব ভবন’ নাম দিয়ে আমি রক্ষনাবেক্ষন করি’।

আমরা বাড়িটার একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। এইখানে বাঁশ জঙ্গলের গভীরতা আরও অনেক বেশী। চারপাশটা একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাটির বাড়ির দেওয়ালে জায়গায় জায়গায় গর্ত। দেখেই মনে হয় ঠিকঠাক রক্ষনাবেক্ষন হয়না। পকেট থেকে একটা জং ধরা চাবি বার করে কাকু তালাটা খুললেন। জোরে একটা ধাক্কা মারতেই দড়াম করে শব্দ করে ভঙ্গুর দরজাটা দুপাশে সরে গেলো। কতগুলো শকুন আর চিল ‘চ্যাঁ চ্যাঁ’ করে শব্দ করতে করতে ভেতর থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি তো ভয়ে ‘ওমা’ করে একটা শব্দ করে কাকুর পেছনে লুকিয়ে গেলাম। ‘হুস হুস যা যা এখান থেকে’ প্রচণ্ড জোরে আওয়াজ করে কাকু পাখীগুলোকে তাড়িয়ে দিলো। এতক্ষন খেয়াল করিনি, এবার করলাম, ভেতর থেকে একটা ইঁদুর মরার মত উগ্র বাজে গন্ধ ভেসে আসছে। আমার দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাকু বললেন, ‘ভেতরটা খুব নোংরা। তুমি ওই চেয়ারটায় বস। আমি তোমার জন্য কতগুলো বই নিয়ে আসছি। তুমি ওগুলো এখন পড়বে’। কথাটা বলেই কাকু ভেতরে ঢুকে গেলেন, আমি দরজা থেকে একটু দুরেই দাঁড়ালাম। কিছুক্ষন পর হাতে কয়েকটা পাতলা বই নিয়ে কাকু হাজির হলেন। পড়াশুনার প্রতি সেই অর্থে কোন ঝোঁক আমার ছিলনা। কিন্তু শহীদ ক্ষুদিরামের ঘরে বসে তারই সম্পর্কে পড়া, এ সত্যিই এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। এছাড়া স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের গল্প করে অনেককিছু বলা যাবে, তাই আমিও লোভটা সামলাতে পারলাম না।

প্রথম যে বইটায় হাত দিলাম তার নাম ‘ক্ষুদিরাম ও বর্তমান যুবসমাজে তার প্রাসঙ্গিকতা’। ইতিহাসের পাঠ্যবইটার কথা মনে পড়ে গেলো। মা খুব ভালো করে লাল কালি দিয়ে দাগ দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই বইটা সম্পূর্ণ আলাদা। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম, এই লাল মোড়মের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে এক বাউল, গলায় সেই অতি পরিচিত গানটি, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। বাড়ির ভেতর থেকে একটা বাচ্চা ছেলে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে ‘দাদু, এর মানে কি?’। লাল ধুতি পরা সেই বাউলের মুখ থেকে আসে সহাস্য উত্তর। ‘খোকা, ফিরিঙ্গীদের দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য এভাবেই যে হাঁসি হাঁসি তোমাদের ফাঁসিতে ঝুলে যেতে হবে। এই মাতৃভূমিকে আবার স্বাধীন করতে যে তোমাদের প্রানের বলিদান দিতে হবে’। আবার সেই পরিচিত গানটি গাইতে গাইতে বাউলটি চলে যায়। সেই বালকের দুই চোখে দেশপ্রেমের বানী জ্বলে ওঠে।

 

Continue to Part 2
Print Friendly, PDF & Email
Previous articleUCWeb Employees Wish Indian Users a Happy Independence Day
Next articleস্বাধীনতার হীনতায়
Subhamoy Chatterjee
I am an M.Tech student of Electronics and Communication Engineering from NIT Rourkela. I am an avid reader. Now, I want to write my own stories.
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments