ভূতের ভ্যাকেশন
প্রথম অধ্যায়
আজ সকালেই উঠে এলাম কবর থেকে | কতদিন আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে থাকবো বলুন | সেই ১৮৫৭ কৃষ্টাব্দে মারা গেছিলাম সিপাহী বিদ্রোহে | সে এক অপূর্ব গাঁথা , রাজা কুঁয়ার সিংহের নেতৃত্বে ইংরেজে শাসকদের সাথে লড়াই করে যাচ্ছি | মুসলিম , হিন্দু সবাই এক সাথে মিলে সংগ্রাম করছি গোরাদের বিরুদ্ধে | গোরাদের কাছে আছে অঢেল টাকা , অস্ত্র , শস্ত্র | আমাদের কাছে মুষ্টিমেয় কিছু লোকজন আর ঢাল তরোয়াল | মৃত্যু অনিবার্য | তবুও লড়ে যাচ্ছিলাম |
তখন আমি বিহারের আররাহ অঞ্চলে যুদ্ধ করছি | মধ্যে গ্রীষ্মের দুপুর | হঠাৎ আমি গুলিবিদ্ধ হলাম | ও সে কি কষ্ট | হাঁকিয়ে উঠলাম | আমার গগনভেদী আর্তনাদ কেও শুনলনা | মৃত্যুর কোলে শান্তি পেলাম | অনেক নাম না জানা শহীদদের মতোই আমায় লোকজন ভুলে গেছে | তবু একটা কবর দেওয়া হয়েছিল | সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবান , আমার কত সহকর্মীদের তাও জোটেনি কপালে | তাদের দেহ চিলে , শেয়ালে খেয়েছিলো |
দ্বিতীয় অধ্যায়
সময় অনেক এগিয়ে গিয়াছে | কুঁয়ার সিংহ যুদ্ধ হেরেছে | ইংরেজ শাসক কড়া হাতে দমন করেছে সিপাহী বিদ্রোহ | আরো শতবছর শাসন করেছে তারা | ভারতকে কাঙাল করে ছেড়ে গেছে | তারপর ভারত স্বাধীন হইয়েছে | এখন আমাদের দেশ একটি সফল গণতন্ত্র | এখন গরু গাড়ির জায়গা নিয়েছে মোটর গাড়ি | সবই শোনা কথা | আমার পাশের কবরের আলম যখন আগের বছর ভ্যাকেশন নিয়ে গেছিলো তখনই বলেছিলো | আমারো কত ইচ্ছে যে আমার প্রাণের দেশে একটু ঘুরে আসবো |
ভূত হবার অনেক অ্যাডভান্টেজ | আপনি সবাই কে দেখতে পাবেন , কেউ আপনাকে দেখতে পাবেননা | এক মুহূর্তের মধ্যে কাশ্মীর হতে কন্যাকুমারী যাওয়া যায় | কোথাও ঢুকতে পারমিশন লাগেনা | মন্দির , মসজিদ , চার্চ সব জায়গায় যাওয়া যায় | তাই ভাবলাম একবার ঘুরেই আসিনা |
তৃতীয় অধ্যায়
উঠলাম কবর থেকে | ভাবলাম ভারত দর্শন কলকাতা থেকেই শুরু করবো | আমাদের কালের রাজধানী | শুনেছি নাকি উন্নয়নের দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে অনেকটাই | যাকগে , এই সেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল , আমাদের সময় এসব ছিল না | দেখলাম সামনের মাঠের ওপর কত ছেলে মেয়ে বসে প্রেম করছে | আমাদের সময় কি এসব সম্ভব ছিল | আমারও ছোটবেলায় এরকম একজনকে ভালো লেগে গেছিলো | তার চোদ্দ বছরে বিয়ে হয়ে যায় , আশি বছরের এক বামুনের সাথে | যাকগে পুরোনো কাসুন্দি ঘেটে লাভ নেই |
এবার বেরোলাম দিল্লির দিকে | আমাদের সময় বাহাদুর শাহ জাফরের এবং মুঘল রাজ্যের কেন্দ্র ছিল এই দিল্লি | এখন স্বতন্ত্র ভারতের রাজধানী | ঝা চক চকে রাস্তা , শপিং সেন্টার , দ্রুত বেগে ছুটছে মেট্রো আহা এতো স্বর্গ | বিশ্ববিদ্যালয় , হাসপাতাল , বিমানবন্দর , এই ভারতের জন্যই তো প্রাণ দিয়েছিলাম আমরা | গর্বে বুক ভোরে গেলো | ভাবলাম একবার পার্লামেন্ট ঘুরে আসবো | আমাদের সময়ও সভা হতো , রাজা তার মন্ত্রীদের পরামর্শে দেশকে শাসন করতেন | আজকাল আবার গণতন্ত্র এসেছে | এসব আমাদের সময় ভাবাই যেত না | ভাবলাম ,একবার দেখেই আসিনা আজকালকার ছেলে ছোকরারা কিরকম ভাবে দেশ শাসন করে | ঢুকে গেলাম লোক সভাতে | ভূত হওয়ার কারণে কেউ আটকাতে পারলে না |
ও মা এ কিরকম সভা | সভার মাঝখানে এক মহিলা বসে আছেন | তিনি ক্রমাগত বাদবাকিদের শান্ত থাকতে বলেছেন | কিন্তু বাকিরা কেউ তার কথা শুনছে না | সমানে চিৎকার , চেঁচামেচি, গালাগালি | পিছনে ফিরে দেখি একজন লোক এই কোলাহলের মধ্যেই দিব্বি ঘুমোচ্ছে | আরেকজন আবার বেমালুম ফোনে কি সব দেখছে | নাহ , এবার উঠি নইলে কানের বারোটা বেজে যাবে |
শেষ অধ্যায়
বেরিয়ে পড়লাম কাশ্মীরের দিকে | এই জায়গাটি নাকি পৃথিবীর জান্নাত বলে মনে করা হয় | জীবিত কালে কোনোদিন দেখা হয়নি , মরণের পর জান্নাত ও নাসিবে হলো না | তাই ভাবলাম যখন বেরিয়েছি তখন কাশ্মীর দেখে আসতেই হবে |
আমি ভূত | গায়ে ঠান্ডা গরম কিছু লাগেনা | সুন্দর ঘুরে বেড়াচ্ছি | কাশ্মীরের বরফে, গাছের মাঝখানে | মরণের পর মনে হচ্ছে , এই না হলে জীবন | হাঠতে হাঠতে পথ গুলিয়ে কোথায় চলে এসেছি , শ্রীনগরের থেকে অনেক দূর কাঠুয়া গ্রামে | কিভাবে , যে ফিরে যাবো জানিনা | যাকগে দুপুর হয়েছে , একটা আস্তানা পেলেই হলো | সামনেই একটা মন্দির আছে ভাবছি দুপুরটা একটু জিরিয়ে নিয়ে , বিকেলে বেরোবো | মন্দিরেই কিছু ভোগ প্রসাদ পেলে মন্দ হয়না | উনি দেবতা হলে আমি অপদেবতা | যথাযত সম্মানতো পাওয়া উচিত |
মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলাম | দেখলাম মন্দিরের সিংহদ্বার রুধ | এই দরজা বন্ধ করে , মানুষকে বাইরে রাখা যায় কিন্তু ভগবান এবং ভূতকে রাখা যায়না | ঢুকে গেলাম ভেতরে |শুনতে পেলাম একটি শিশুর আর্তনাদ | মন্দিরের এক কোন থেকে আসছে | অচিরেই সেখানে পৌছালাম আমি | দেখলাম একি , চার পাঁচটি নগ্ন পুরুষ ,তার মধ্যে একজন বোধ হয় মন্দিরের পূজারী আর একটি ছোট বালিকা | পেছন থেকে জয় শ্রীরামের জয়োধ্বনি | না থাক বাকিটা আর বললাম না | কবরে ফিরতে হবে |