ভোর ঠিক সাড়ে পাঁচটা হয়তো। মুস্কান কখন যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে পড়েছে। পাশে তার মা রয়েছে শুয়ে। মুস্কানের বয়স মাত্র চার বছর। সে যথাক্রমে জিভের আড়ষ্ঠ ভাঙিয়ে তার মাকে ডেকেই চলেছে, ‘আম্মি, উঠিয়ে না….আম্মি, উঠিয়ে না’। কিন্তু আম্মির আর সাড়াশব্দ কোথায় ? তাই মুস্কান নিজেই উঠে দাঁড়ালো। কেন জানা নেই। হয়তো খিদে পেয়েছে, নয়তো বা ভয় লাগছে। চারদিকটাও বেশ ফাঁকা।

কোনোরকমে টলমল করে হাটতে শুরু করলো। ও বেশ ফুটফুটে বাচ্ছা। ধবধবে ফর্সা, ব্রাউন কারলি হেয়ার। তরতর করে হাটতে হাটতে ঢুকেছে কোন যেন একটা ভাঙাচোরা ঘরে। ও, ওটা রান্নাঘর। কিন্তু ব্যর্থতার সাথে ফিরতে হল তাঁকে। কারণ সেখানে তো আর কোনো খাবার নেই। বোধয় তার খিদেই পেয়েছিলো। কিন্তু এখন যে কিছু করার নেই।

     

       দিশেহারা হয়ে মুস্কান তার মাকে ছেড়ে ছুটে চলেছে অন্যদিকে। একটু দূরে যেতেই সে থমকে দাঁড়ায়, মুখে একটা বড়সড় স্মাইল নিয়ে। কিছু একটা পেয়েছে। খাবার নয় খেলনা। সে ওখানেই বসে পরলো মাটিতে খেলতে। ধুলোর আচ্ছাদন সরিয়ে সে তুলে ধরে তার খেলনাটাকে। সর্বনাশ !!!!!!!,ওটা তো AK47….. । ওই দেখো নলাটা আবার মুখে ঢুকিয়েছে। হে ভগবান ! এ কি কান্ড। ট্রিগারটা  চাপলেই তো শেষ। কিন্তু AK47 এলই বা কোথা থেকে। শিগগির কে যেন এসে হাত থেকে বন্দুক তা কেড়েনিলো। উফঃ…..থ্যাংকস টু মেজর হর্ষবর্ধন সিং।

      নাঃ। এটা কোনো স্বপ্ন নয়। কথা বলছি ভারতের শেষ সীমান্তের ‘তুর্তুক’ গ্রামের। জম্মু ও কাশমীরের লেহঃ ডিস্ট্রিক্টের অধীনে, শ্যোক নদীর তীরে এই গ্রাম। এই নদীর আরেক নাম হল ‘ The River of Death’ আর এই গ্রামটাই সিয়াচিন গ্লেসিয়ার-এর গেটওয়ে। ১৯৪৭  সালের পর থেকে গ্রামটা ছিল পাকিস্তানের অধীনে। সেভেন্টি ওয়ানের কার্গিল যুদ্বের পর তা ভারতের অধীনে অসে। ভারতের অন্তর্গত একমাত্র বাল্টিস্তান অঞ্চল এই তুর্তুক গ্রাম। সেভেন্টি ওয়ান বা ফোর্টি সেভেন তো নাম মাত্র। এখানে যুদ্ধ চলে সর্বক্ষণ।শুধু জায়গা দখলের যুদ্ধ নয়। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার যুদ্ধ। স্বাধীনতার যুদ্ধ। শান্তির যুদ্ধ।

        গতকালই যুদ্ধ লেগেছিলো মিলিটান্টস বনাম ইন্ডিয়ান আর্মি। গ্রামের ৪৭টা পরিবারের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রায় ৮টা। কোনো একটি পক্ষের বারুদের তেজেতেই নষ্ট হয়ে যায় মুস্কান এর পরিবার। সে কোনো কারণে প্রাণে বেঁচেছে। মুখে ধুলোবালি মাখা, ভুরু কুঁচকানো, চোখে এখনো ঘুম আছে বোধয়। রাতের অন্ধকারে কি যে ঘটে গেলো সে কিছুই জানেনা। তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে আর্মি ভেহিক্যাল-এ। যাকেই দেখতে পায় শুধুই বলে – ‘ মুঝে আম্মি কে পাস জানা হে ’। তারই গ্রামের এক চেনাশুনো তাকে এসে আবার বলে যায় তার আম্মি নাকি জান্নাত-এ গেছে, একটুপরে আসবে। মুস্কানকে আপাতত নিয়ে আসা  হয়েছে লাদাখ-এর আর্মি বেস ক্যাম্প-এ, টুরিস্ট ও সিভিলিয়ান্সদের মাঝখানে। এবার উদ্দেশ্য জে এন্ড কে অর্ফানেজ। ক্যাম্পের বিশাল আয়তন সমতল পেয়ে মজায় ছোটাছুটি আরম্ভ করেদিয়েছে মুস্কান। বাঁ হাতে একটা কলা আর ডান হাতে পাউরুটি নিয়ে।

           সিগারেটের শেষ কাউন্টারটা টেনেই ধরলাম গপাত করে তার হাতটা।

           জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ কাঁহা যা রাহে হো বেটা ? ‘

           চোখটা ডানদিক বাঁদিক ঘুরিয়ে উত্তর দিলো, ‘ জান্নাত ‘।    

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleজীবনের গান
Next articleকোনজন তুমি
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments