।পাঁচ।
এর পরের ব্যাপারগুলো কিন্তু বেশ তাড়াতাড়িই ঘটলো। পরের সপ্তাহেই কুরিয়ারে ওর কনট্র্যাক্ট লেটার এসে গেল। ইম্পিরিয়াল কলেজের ছাপ্পা দেওয়া প্যাডে খুব ক্লিয়ারলি ইনস্টিটিউটের রুলগুলো বলা আছে … কতদিনের কনট্র্যাক্ট, কি ধরনের কাজ, সপ্তাহে কত ঘন্টা কাজ করতে হবে, বছরে কটা দিন ছুটি পাওয়া যাবে, হেলথ ইন্সিওরেন্স পলিসি ইত্যাদি। সৌগত একবার তার স্যারের সাথে ডকুমেন্টটা পরে নিয়ে সই করে ফেললো, তারপর নিজের কপিটা রেখে একটা কপি স্পীড পোস্ট করে দিল। তার নিজের পাসপোর্ট তো আছেই … বছর খানেক আগে এই খড়গপুর থেকেই করা। কাজেই এখন শুধু ওয়ার্ক পারমীট কবে আসবে তার আশায় বসে থাকা।
এটা একদিক থেকে মন্দ না, মানসিক ভাবে সে এখন সম্পূর্ন ফ্রী, ভীষণ একটা চাপমুক্ত সময় … সকালে ব্রেক ফাস্ট খেয়ে কোনদিন ডিপার্টমেন্টে যায় আর জুনিয়ারদের কিছু সাহায্য করে আবার কোনদিন ইচ্ছা না হোলে নিজের ঘরে গিয়ে একটা গল্পের বই নিয়ে খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে, শুধু বই পড়ে তা নয়, নানান রকম স্বপ্নের মধ্যে থাকে … লন্ডনের ওপর কত মুভি দেখেছে … হিচককের সাসপেন্স, বিগবেন, টেমস নদী, হাউস অফ কমন্স, মাডাম টুসোড ওয়াক্স মিউসিয়াম, ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউসিয়াম, ব্রিটিশ মিউসিয়াম … আরো কত কিছু সেখানে দেখবার।
সে কল্পনার মধ্যে দিয়ে লন্ডনের রাস্তায় হাঁটতে থাকে। এর মধ্যে সে আবার কয়েকবার কোলকাতাতেও গেল … শপিং। নতুন জায়গায় যাচ্ছে … কিছু ভালো জামা প্যান্ট, একটা ভালো জ্যাকেট, একটা ভালো উডল্যান্ডসের জুতো … এগুলো তো কিনতেই হয়। মা ও বাবা সৌগতকে ভীষণ সাবধানে ইংল্যন্ডের জন্য তৈরি করছেন। এতোদিন পরে মা বাবার খুশী ভরা মুখগুলো দেখে সৌগতরও কেমন একটা হ্যাপী ফিলিংস হচ্ছিল … মিডিল ক্লাস ফ্যামিলী থেকে চার সাড়ে চার বছর ধরে শুধু ইনস্টিটিউট স্কলারশিপে পি.এইচ.ডি. করা লাইফে বেশ বড় একটা ফাইট।
কিন্তু ওয়ার্ক পারমিট বার হতেও বিশেষ সময় লাগলো না। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহেই আবার একটা কুরিয়ার এসে হাজির। এবার সেই রঙিন একটা কাগজ, ওয়ার্ক পারমিট ডিপার্টমেন্ট অফ লেবার থেকে ইস্যু করেছে। ব্যাস সৌগতর শেষ কাজ এবার কলকাতার ব্রিটিশ কস্যুলেটে গিয়ে ভিসার ব্যাবস্থাটা করে ফেলা। সে আর দেরি না করে দু একজন প্রফেসর যারা আগে ইংল্যান্ডে গেছেন তাদের সাথে কথা বলে সোজা কলকাতায় চলে এলো।
ভিসার ব্যাপারটাও সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই মিটে গেলো। ব্রিটিশ কস্যুলেটের নিয়ম অনুযায়ী সমস্ত পেপারস রেডি থাকলে আর কয়েক হাজার টাকা কাউন্টারে জমা দিলে ভিসা পেতে খুব দেরি হয় না, যদিও সমস্ত ভিসাই দিল্লির ব্রিটিশ এমব্যাসী থেকে ইস্যু হয় কাজেই দিন চার পাঁচ সময় লাগে। এই সব ব্যাপার মিটিয়ে খড়গপুর থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে প্রোফেসর পাত্রের আশীর্বাদ আর পরামর্শ নিয়ে একদিন সৌগত বাবা মার সাথে কলকাতা বিমান বন্দরে এসে ট্যাক্সি থেকে নামলো।
এই সব সময় যা হয় আর কি … মার সাবধান বানী … খোকা, বাইরে যাচ্ছিস, খুব সাবধানে থাকবি। লোকের সাথে সাবধানে মিশবি, সব লোক ভালো হয় না। নিজের শরীরের ওপর নজর রাখবে, খাওয়া দাওয়া ঠিক ঠাক করবে, ঠান্ডার সময় জ্যাকেটটা পরতে ভুলো না আর গলায় মাফলার দেবে। প্রতি সপ্তাহে দুবার করে ফোন করবে। বাবা ওকে সু বলে ডাকেন, উনি শুধু বললেন – সু, এই রকম চান্স বার বার আসে না। নিজের ক্যারিয়ারের প্রতি নজর রাখবে, আর যাই কর কাজের প্রতি অবহেলা কোর না। যার সাথেই কাজ কর তাঁর কথা শুনে চলবে … লোককে সম্মান করবে। নিজের সম্মানও রাখার চেস্টা করবে, নিজেকে বিক্রি করে দিও না। তারপর যা হবার হবে, শুধু অনেস্টলি নিজে চেস্টা করে যাবে, তারপর মাথার ওপর ভগবান আছেন।
কথা বার্তা শেষ হোল, প্লেনের সিকিউরিটি চেকিং শুরু হয়ে গেছে। সৌগত প্রনাম করে “গিয়েই ফোন করবো” বলে ট্রলিটা ঠেলতে ঠেলতে ভিতরে চলে গেল। মাঝখানের বাপারগুলো মিটিয়ে ঘন্টা দেড়েক পরে সে সোজা এমিরেট্সের বোয়িং সেভেন ফরটি সেভেন বিমানের মধ্যে।
এমিরেট্সের রীতি অনুযায়ি কয়েক ঘণ্টার জন্য দুবাই এয়ারপোর্টে হল্ট করে সৌগত হিথরো বিমানবন্দরে এসে নামলো। সে খাওয়া দাওয়ার পর সটান ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ কিসের একটা ঝাঁকুনিতে ঘুমটা ভেঙে গেল, তখন কেবিনের আলো সব আবার জ্বলে উঠেছে আর কোন ফিমেল ভয়েসে একটা অ্যানাউন্সমেন্ট শোনা যাচ্ছে – উই উইল বি ল্যান্ডিং অ্যাট দি হিথরো এয়ারপোর্ট সর্টলি।
**********
ব্যাস, যাত্রা শেষ। ঘুম চোখটা একটু কছলে নিয়ে সৌগত সোজা হয়ে বসলো, নামার সময় আসন্ন। হিথরো একটা বিশাল এয়ারপোর্ট, প্রথম কেউ এসে নামলে চোখ ধাঁধিয়ে যাবেই … বেশ সাজান গোছান এবং চারিদিকে ভীষণ ভিড়, মানে প্রচন্ড বিজি এয়ারপোর্ট। নানা দিক থেকে মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে, কোনটা যে কোন ফ্লাইটের তা ভালো করে না শুনলে বোঝাই মুশকিল। চারিদিকে অটোম্যাটিক বন্দুক হাতে প্রচুর ব্রিটিশ সিকিউরিটি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সৌগত তার লাগেজটা কালেক্ট করে খানিকটা খুঁজে নন-ইউরোপীয়ান ইমিগ্রেশান কাউন্টারে এসে দাঁড়াল, বেশ লম্বা লাইন এবং প্রচুর আরাবিক মুসলীমদের ভিড়, অবশ্য বেশ কিছু ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানি অরিজিনের মানুষও লাইনে আছে। সৌগত এই রকম একটা বিশাল লাইনের একদম পিছনে এসে দাঁড়াল … লাইনটা এঁকেবেঁকে এসে একটা জায়গায় থেমে আছে। তার সামনে চার পাঁচটা কাউন্টার, যখনই কোন কাউন্টার ফাঁকা হচ্ছে একজন করে গিয়ে সেই কাউন্টারে দাঁড়িয়ে পড়ছে।
খুব একটা দেরী হোল না, সৌগতর টার্ন প্রায় মিনিট কুড়ির মধ্যেই এসে গেল। খুবই সামান্য কিছু প্রশ্ন আর একটা ইমিগ্রেশান ফর্ম ফিল-আপের পর নিজের পাশপোর্টে একটা বেশ বড় চৌকো ছাপ্পা সহ সৌগত তার ট্রলি নিয়ে গেট দিয়ে বার হয়ে বাইরের বড় চৌহদ্দির মধ্যে এসে পরলো। একটা বিশাল বড় লাউঞ্জ, সেখানে বেশ বড় বড় করে কোন দিকে রেল স্টেশান, কোন দিকে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড তার ডায়রেকশান দেওয়া, নানা স্ট্যান্ডে লন্ডনের টিউবের ম্যাপ ফ্রি সাজান রয়েছে এবং যারাই আসছে সবাই একটা করে ম্যাপ পকেটে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। ফুরিয়ে যাবার আগে সৌগতও একটা টিউবের ম্যাপ নিজের জামার পকেটে ঢুকিয়ে নিল। সৌগতর জন্য একটা ঘর একটা স্টুডেন্ট হোস্টেলে প্রথম দু সপ্তাহের জন্য বুক করা ছিল এবং তার ঠিকানা এবং অন্যান্য খুটিনাটি প্রিন্ট করা ছিল। কাজেই আর দেরি না করে সৌগত ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে পা বারাল।
।ছয়।
পরের দিন সকাল নটা থেকে সৌগতর ইম্পিরিয়াল কলেজের চাকরি জীবন শুরু হোল। মোটামুটি সবই সেই একই রকম, মানে সেই খড়গপুরের জীবনটাই অন্য এক শহরে শুরু হোল। এই শহরটা অনেকটা সাজান গোছান, নানান ঐতিহাসিক জায়গা রয়েছে, আছে মিউজিয়াম আর আর্ট গ্যালারী, যারা ক্রীকেট ভালোবাসে তাদের জন্য আছে লর্ডস আর ওভাল … সেই দিক থেকে এখানে মানসিক ভাবে নেতিয়ে পড়ার কোন চান্স নেই, সেই সঙ্গে আছে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ক্যামেরা হাতে শহরটাকে এক্সপ্লোর করার সুযোগ।
প্রথম কয়েক সপ্তাহ সৌগতর একটু ভয় ভয় করতো … নতুন জায়গা, এতো নামি ইউনিভার্সিটি, নতুন বস, … কি জানি কেমন মানুষ হবেন। কিন্তু কয়েকবার দেখা হওয়ার পর সে ভয় কেটে গেল … মানুষটা বেশ ভালো, অনেক দিন ধরে নানা ছাত্রকে পি.এইচ.ডি. করিয়েছেন, কাজেই ওনার অভিজ্ঞতা অনেক এবং ওনার সামনে মন খুলে কথা বলা যায় এবং প্রশ্ন করা যায়। মাস খানেক পরে ইম্পিরিয়াল কলেজকে বেশ ভালো লাগতে শুরু করলো … এখানে কাজের ফ্রীডম আছে … ফেসিলিটি চমৎকার আর লাইব্রেরীটা অসাধারণ।
এই সব কাজের ফাঁকেই সৌগত লন্ডনকে চিনতে শুরু করলো। ব্রিটিশ মিউসিয়াম, টেমস নদীর ধার, ট্র্যাফালগার স্কোয়ার, লেস্টার স্কোয়ার, পিকাডিলি সার্কাস, ন্যাশানাল পোর্টেট গ্যালারী, টেট মডার্ন আর্ট গ্যালারী, মাদাম ট্যুসোঁ … ইত্যাদি যায়গাগুলো ঘোরা হোল। সব যায়গাতেই দেখবার মতো জিনিস আছে কিন্তু টেমস নদীর ধারটাই তার সব থেকে ভালো লেগে গেল। নদীর দুই ধারেই বাঁধান হাঁটার জায়গা, কিছুদূর অন্তর বসার বাঁধান চেয়ার রয়েছে … বিকেলের দিকে বহু লোক সেখানে জগিং করে, কেউ বসে আড্ডা দেয়, কেউ বা আবার রোলার স্কেটিং করে আনন্দ পায়। ওই নদীর ধারেই সে বার বার যেত, মাঝে মাঝেই সন্ধ্যা ছটার পর কলেজ থেকে বার হয়ে টিউব করে সোজা ওয়েস্ট মিনিস্টার স্টেশান, তারপর সোজা হাঁটা নদীর ধার দিয়ে। এই নদীর ধারেই তার সাথে মোনালিসা চ্যাটার্জীর দেখা।
*********
সেদিনটা ছিল একটা শনিবার। সৌগত খানিক্ষণ ডিপার্টমেন্টে কাজ করে বিকেল চারটে নাগাদ বেরিয়ে সোজা বি.এফ.আই. এর কাছে। এই সপ্তাহে কি মুভি আছে সেটা একবার দেখে নিয়ে ও বেরিয়ে এলো। কোথায় যাবে এটা ভাবার খুব একটা দরকার নেই কারণ তখনও অনেকটা দিনের আলো আছে আর সামনে টেমস নদীর ধার দিয়ে চমৎকার বাঁধানো হাঁটার জায়গা। অসংখ্য লোক সেখানে ঘুরে বেরাচ্ছে, কেউ রেলিঙের ধারে চেয়ারে বসে আছে, অল্প বয়সী ছেলেরা স্কেটিং করছে। প্রচুর প্রেমিক প্রেমিকারা হাতে হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। ঐ ভিড়ের মধ্যেই সৌগত কেমন যেন আনমনে নিজের খেয়ালে হেঁটে যাচ্ছিল … চমৎকার একটা হাল্কা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে তাতে একটা সামান্য শীতল অনুভূতি কিন্তু ঠিক ঠান্ডা নয়।
সৌগত বেশ উপভোগ করছিল কিন্তু হঠাৎ তার মনে হোল এত তাড়াতাড়ি বাড়ীর দিকে যাবার কোন মানেই হয় না কারণ এখন ফিরে বাড়ীতে কোন কাজ নেই টিভি দেখা ছাড়া। তার চেয়ে কোথাও ফাঁকা দেখে বসা যাক। সে এদিক ওদিক তাকাতেই একটা খালি কাঠের চেয়ার পেয়ে গেল। টেমসের দিকে মুখ করে সৌগত সেই চেয়ারে বেশ জমিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে পরলো। কতক্ষণ বসে ছিল খেয়াল নেই, হঠাৎ পাশ থেকে একটা সুন্দর মেয়েলি কন্ঠ ভেষে এলো …
মোনালিসা। Excuse me, are you Indian?
সৌগত পাশ ফিরে তাকাল, একজন মহিলা কখন পাশে এসে বসেছে সে টেরও পায়নি। ভদ্রমহিলার চোখে কালো গগলস, মাথা কান সব একটা রুমাল দিয়ে বাঁধা, পড়নে একটা ফুল হাতা হাল্কা সবুজ টপ আর ডিপ নীল রঙের জিনস।
সৌগত। Yes, and you?
মোনালিসা খানিকটা ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দিল – Ya…I am Monalisa.
সৌগত মোনালিসার হাতটা ধরে বললো – I am Sougata, nice to meet you.
মোনালিসা একটু দোনামোনা করে ফিসফিস করে জিঞ্জাসা করলো – By any chance, are you Bengali?
সৌগত একটু হেঁসে জবাব দিল – হ্যাঁ হ্যাঁ … খাঁটি বাঙালী।
শুনে মোনালিসা খুব স্বস্তিতে একটু হাসলো – উফ … খুব বাঁচালেন। আমিও না লন্ডনে নতুন। তাও অবশ্য মাস সাত আট হয়ে গেছে, কিন্তু সেরকম ফ্রেন্ডস সারকেল তৈরী করে উঠতে পারিনি। আপনি যখন একা বসে আছেন, আপনিও নিশ্চয়ই নতুন এখানে?
সৌগত। আমিও প্রায় দের মাস মতো এসেছি। ইম্পিরিয়াল কলেজে একটা রিসার্চের কাজ করি … কাজেই লোকের সাথে মেশার সময় একটু কম। আর আমি খুব একটা মিশুকে ছেলেও নই। মানে ক্লোস ফ্রেন্ডস হতে বেশ সময় লাগে।
মোনালিসা। ও সব ঠিক আছে … আমি সব ঠিক করে নেব। আপনার সময় নেই আর আমার এতো সময় যে কাটতে চায় না। এখন ঝট করে মোবাইলের নাম্বারটা দিন তো।
মোনালিসা তার নিজের ছোট্ট একটা হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা সুন্দর ছোট প্যাড আর একটা দামি ডট পেন বার করে এগিয়ে দিল। সৌগত কেমন হকচকিয়ে গেল … কি রে ভাই, এ আবার কেমন ব্যাপার। ভদ্রমহিলার সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলতে না বলতেই মোবাইলের নাম্বার চাইছে যে। মোনালিসা তার লম্বা লম্বা সুন্দর হাত দিয়ে প্যাডটা ধরে তাকিয়ে ছিল … সৌগতর বোকার মতো তাকিয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো …
মোনালিসা। কি হলো … ঘাবরে গেলেন নাকি? ফ্রড ট্রড নই রে বাবা। ঝট করে লিখে ফেলুন তো।
তারপর কি মনে করে প্যাডটা আবার ব্যাগের মধ্যে পুরে একটা মোবাইল বার করে আনলো – নিন, নাম্বারটা মুখেই বলে ফেলুন, এখনই সেভ করে নি।
সৌগত এবার আর ইতস্থত করলো না, সটান নাম্বারটা বলেই দিল। মোনালিসা তার অভ্যস্ত আঙুল দিয়ে বেশ পটুতার সাথে নাম্বারটা সেভ করলো, তারপর একটা বোতাম টিপলো … সৌগতর ফোনটা পকেটে ছিল, টুং টাং শব্দে বেজে উঠলো। মোনালিসা একটু হাসলো, তারপর বললো …
মোনালিসা। এখনই সেভ করে নিন কিন্তু, আমার নাম দিয়ে। এর পরে মাঝে ফোন পাবেন আর কার না কার মনে করে কেটে দেবেন না যেন।
সৌগত মনে মনে কেমন যেন একটা ভরসা পাচ্ছিল। ভদ্রমহিলার মধ্যে কেমন একটা ন্যাচার্যাল আন্তরিকতার ব্যাপার আছে, বেশ সফেসটিকেটেড মনে হয়, এমন মহিলা ফ্রড না হওয়াই সম্ভব। সে নাম্বারটা সেভ করে নিল মোনালিসার নামে। লন্ডন বিশাল বড় শহর, এখানে দু একজন ভালো বন্ধু থাকা ভালো কথা। আর সত্যি কথা বলতে গেলে, মাঝে মাঝে সৌগতর বেশ একাই লাগে। খড়গপুরের হোস্টেলে তার অনেক বন্ধু ছিল, তাদের সাথে কথায় বা ফুটবল ক্রিকেট খেলার মধ্যে দিয়ে সময় বেরিয়ে যেত, একা লাগার প্রশ্নই নেই। কিন্তু এখানে কাজের বাইরে তার খুব একটা চেনা জানা নেই, কাজেই মাঝে মাঝে কারুর সাথে কথা বললে বা দেখা হলে মন্দ কি।
এছাড়াও আছে, সৌগত স্বভাব প্রেমিক নয়, কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে স্বাতীলেখাকে তার বেশ ভালো লাগতো। স্বাতীলেখার মধ্যে কেমন একটা বেশ গর্বী কিন্তু ডিপলী ইনটেলিজেন্ট মেয়ের মিশ্রন আছে যাকে সৌগতর ভালো লাগতো কিন্তু ব্যাপারটা গোপন ছিল … এবং গোপনই থাকবে কারণ এখন আর সে ভালোলাগার কোন দাম নেই। লন্ডনে এসে সে এদিক সেদিক একাই ঘুরে বেড়াত, কিন্তু যদি একটা বান্ধবী মিলেই যায়, তাহলে তো ভালো কথাই। মোনালিসা দেখতে চমৎকার, হয়তো কিছুটা বুদ্ধিও থাকবে মাথায়। শনি বা রবিবার গুলো যদি কোথাও দেখা করা যায় বা অন্তত ফোনে কথাও বলা যায় তাহলে মোনালিসার কিরকম লাগবে জানা নেই কিন্তু সৌগতর বেশ ভালোই লাগবে, তার একাকিত্বের মধ্যে নতুন একটা রঙ লাগবে।
।সাত।
সৌগত উইকএন্ডের কথাই ভেবেছিল কিন্তু মোনালিসার সেরকম কোন ব্যাপার নেই, তার কাছে যে কোন দিনই ছুটির দিন।
সোমবার দিন প্রায় পাঁচটা চল্লিশ মতো বাজে, সৌগত বসে বসে ভাবছিল প্রোগ্রামটা আর একবার ডিবাগ করে দেখবে নাকি কি এরার আসছে, ঠিক এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো … মোনালিসা। সৌগত ফোন তুললো …
সৌগত। হ্যাঁ … হ্যালো, কি খবর বলুন।
মোনালিসা। কি ব্যাপার, এখন ল্যাবে পড়ে আছেন আর সারা লন্ডন রাস্তায় বেরিয়ে কত মজা করছে।
সৌগত। আরে আমরা ফরেন এমপ্লয়ি, আমাদের অত আনন্দ করতে নেই। তার ওপর একেই তো টেম্পোরারি চাকরী … ।
মোনালিসা ঝাঁঝিয়ে উঠলো – আরে রাখুন টেম্পোরারি এমপ্লয়ি। সপ্তাহে তো সেই আটত্রিশ ঘন্টার ডিউটি। বেশী কাজ করলে বেশী মাইনে তো দেবে না। কি… ঠিক বলছি?
সৌগত একটু থিতিয়ে গেলো – সেটা ঠিকই কিন্তু ইম্প্রেশান বলে একটা কথা আছে তো। আর আমি তো সবে ঢুকেছি, এখন দু মাস হয়নি।
মোনালিসা দু কথায় উড়িয়ে দিল – ঠিক আছে ঠিক আছে। বুঝেছি ভয় পাচ্ছেন। ভালো কথা, কালকে আর ডাকবো না কিন্তু আমি বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়েছি … আর দশ মিনিটের মধ্যে লন্ডন আইয়ের কাছে পৌছচ্ছি, আপনার এখানে আসতে কতো সময় লাগবে?
সৌগত ঘড়ি দেখলো, প্রায় ছটা, তার মানে এমন কিছু তাড়াতাড়ি নয়। তাছাড়া ইংল্যন্ডের নিয়ম অনুযায়ি ইম্পিরিয়ালের অ্যারোস্পেস এখন প্রায় ফাঁকা, প্রফেসররা প্রায় সবাই চলে গেছেন, সামান্য কিছু রিসার্চ স্কলার হয়তো রয়ে গেছে। সৌগত একটু হিসাব করে বললো …
সৌগত। সাইথ কেন্সিংটন টিউব স্টেশানে পৌছাতে একটু হাটতে হয় … তাহলেও ধরুন মিনিট পঁচিশেক, ম্যাক্স আধ ঘন্টা … চলবে?
মোনালিসা। কি আর করা … চলবে। কিন্তু ঠিক লন্ডন আইয়ের পাশে আসবেন, ওখানেই আমি থাকবো।
সৌগত। ok, আধ ঘন্টা বাদে দেখা হচ্ছে।
সৌগত হুড়মুড় করে কমপিউটার সাট ডাউন করলো তারপর ঘরটা লক করে হন হন করে হেঁটে ইম্পিরিয়ালের নীল কাঁচে মোড়া অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংটা পার হয়ে মেকানীক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিঙের বাড়ীর পাশ দিয়ে হেঁটে টানেলে ঢুকলো। এই বিরাট টানেলটা পার হতেই তো মিনিট বার চোদ্দ লাগবে। কি করে যে আধ ঘন্টায় লন্ডন আই পৌঁছান যাবে জানা নেই। সে যাই হোক, সৌগত প্রায় দৌড়তে লাগলো, এই সময় টানেলে সেরকম কোন ভিড় নেই, এই যা সান্তনা।
***********
লন্ডন আই পৌঁছতে মিনিট চল্লিশেক লাগলো। যখন সৌগত হাঁফাতে হাঁফাতে লন্ডন আইয়ের পাশে পৌঁছল তখন মোনালিসা ধৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকে আবার একটা গোলাপি সালোয়ার আর ম্যাচিং হাল্কা নীল রঙের টপ পড়েছে, গলার ওপর দিয়ে কাঁধের ওপর জড়ান একটা নানা রঙের বর্নালী স্কার্ফ। বেশ চমতকারই দেখাচ্ছে ওকে। ওকে দেখে মোনালিসা এগিয়ে এলো …
মোনালিসা। ওঃ … প্রায় ঠিক সময়ই এসেছেন। চলুন কোথাও বসে একটু কথা বলি।
একটু এগিয়েই একটা বসার জায়গা পাওয়া গেল … সৌগতকে বসতে বলে নিজের ব্যাগটা সিটের ওপর রেখে মোনালিসা চট করে একটু এগিয়ে গেল। সৌগত একটু আনমনা ভাবে টেমসের দিকে তাকিয়ে ছিল, পিছন থেকে মোনালিসা এসে পিঠে খোঁচা দিল …
মোনালিসা। নিন … আইসক্রিম খেতে খেতে কথা শুরু করা যাক।
মোনালিসার হাতে দুটো আইসক্রিম, সৌগত নির্দিধায় একটা হাতে নিয়ে মোনালিসার পাশে বসলো। বেশ সুন্দর ভ্যানিলা কর্নেট, কোনের একটু কামড়ে সৌগত বললো …
সৌগত। বেশ চমৎকার একটা আইসক্রিম খাওয়ালেন … থ্যাঙ্ক ইউ, এবার কি বলবেন বলুন।
মোনালিসাও বেশ কুড়মুড় করে খাচ্ছিল, খেতে খেতেই একটু সময় নিয়ে বললো – আমার আবার কি কথা, আপনি সারা সপ্তাহ কি করলেন বলুন। রিসার্চ করে পৃথিবীতে কি তোলপাড় করলেন সেটাই জানতে চাইছি।
সৌগত আনমনে খানিক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বললো – দেখুন আমরা পৃথিবী কাঁপিয়ে দেবার মতো রিসার্চ করতে পারি না। যতটুকু পারি করি, কাজটাকে ভালোবেসে করি।
মোনালিসা ওর পিঠে একটা আলতো চাপড় মারলো – আরে আমার কথায় দুঃখ্য পেলেন নাকি। আমি তো মজা করার জন্য বললাম। আপনি তো খুব বাচ্চা টাইপের। ঠিক আছে, আমার যখন দোষ, আমি আপনাকে পড়ের উইক এন্ডে আমার বাড়ীতে খাইয়ে দোষটা কাটাতে চাই। কবে আসবেন বলুন, শনিবার না রবিবার…।
সৌগত একটু লাজুক হাসি হাসলো – আরে আমি কিছুই মনে করিনি। কিন্তু সত্যি কথাটা বলছিলাম। ইউনিভার্সিটির অনেকেই নিজেদের খুব বড় সায়েন্টিস্ট বলে মনে করে কিন্তু পৃথিবী কাঁপিয়ে দেবার মতো কাজ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্সে খুব কম লোকই করে।
মোনালিসা আইসক্রিমের শেষ অংশটায় একটা ছোট্ট কামড় বসিয়ে বললো – থ্যাঙ্কস। সত্যি কথাটা অ্যাপ্রিসিয়েট করলাম কিন্তু ইনভাইটেশানটা থাকছে। কবে আসবেন বলুন।
সৌগত একটু অস্বস্তিতে পরে বললো – আরে এই তো সেদিন আলাপ হোল এর মধ্যেই আবার ইনভাইটেশান কেন। আর একটু আলাপ হোক তারপর না হয় একদিন …।
মোনালিসা আইসক্রিমের শেষ টুকু মুখে পুরে দিয়ে বললো – ওসব ওজর আমার ভালো লাগে না। যা আলাপ হয়েছে যথেষ্ট। খামোখা আবার মাস খানেক ওয়েট করে নতুন কি বন্ধুত্ব বাড়বে? ভাবছি মাংসের কিমার রোল করবো, সঙ্গে রায়তা আর খেজুর আমস্ত্বের চাটনি। কবে আসছেন বলুন।
সৌগত কিছু একটা ভাবছিল, এমনিতে সে রবিবার কোথাও বেরুতে চায় না। ওই একটা দিন সে সারাদিন আলস্যে কাটায়। সকালে উঠে ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর কফি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে কোন খবরের কাগজ নিয়ে চেয়ারে বসে পরে। আর লন্ডনে তো ফ্রি ট্যাবলয়েড অনেক আছে, ও এখন লন্ডন লাইট-টাই পড়ে কারণ ওটা ওর ফ্ল্যাটের কাছেই একটা দোকানে ফ্রি পাওয়া যায়। ও একটু দ্বিধা করে বলেই দিল …
সৌগত। তাহলে শনিবারই আসি যদি অবশ্য আপনার আপত্তি না থাকে।
।আট।
মোনালিসা ওর মোবাইলে কি একটা সেভ করে বললো – নো প্রবলেম, শনিবার লাঞ্চ টাইমে মানে বারোটার একটু আগেই আসুন। খানিক্ষণ কথা টথা বলে তারপর খাওয়া যাবে। আর একটা ব্যাপার, হাতে করে সারপ্রাইস কিছু নিয়ে আসবেন না প্লিজ, কারণ এটা একটা সাধারণ নেমন্তন্য, কোন অকেশান নেই। জাস্ট একজন বন্ধু আর একজন বন্ধুকে খেতে ডাকছে, ব্যাস।
সৌগত মাথা নারলো, মোনালিসা বুদ্ধিমান আছে, আগেই ফর্মালিটি ব্যাপারটা কাটিয়ে দিল। ওরা পাশাপাশি বসে আরো মিনিট কুড়ি কথা বার্তা বললো নানা ব্যাপারে। বোঝাই যায় যে মোনালিসা রোজ খুটিয়ে খবরের কাগজ পড়ে। এর মধ্যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। টেমসের জলে নানা ধরনের আলো দিয়ে সাজান ফেরি যাতায়াত করছে, কিছু দ্রুতগামী স্টীমারও চলছে। টেমসের ওপারে বড় বড় অফিস বিল্ডিং গুলো সুন্দর ভাবে আলো দিয়ে সাজান। এই সব দেখতে দেখতেই মোনালিসা একসম্য বলে উঠলো …
মোনালিসা। কি … নতুন গ্রুপ কেমন লাগছে?
সৌগত। বেশ ভালো, তবে আমি এখনও নতুন, সবার সাথে তেমন ভালো করে ফ্রেন্ডশিপ হয়নি।
মোনালিসা একটু ঝাঁঝিয়ে বললো – আর কতদিন নতুন থাকবেন, প্রায় দুমাস তো হোল। শুনুন, একদিন সবাইকে বাড়ীতে ডেকে একটা পার্টি দিয়ে দিন।
সৌগত মুখটা একটু বেঁকাল – আরে আমি থাকি একা … তার ওপর আবার একটাই রুম, কমন টয়লেট। সেখানে কাকে ডাকবো, তার ওপর সবাইকে ডাকলে দশ বার জনের রান্না কি আমি একা রাঁধতে পারি… দূর ও আমার দ্বারা হবে না, তবে হয়তো একদিন সবাইকে কোন রেস্তরাঁতে খাইয়ে দিতে পারি, সেটা ভেবে দেখবো।
মোনালিসা। বেশি ভাবা ভাবির মধ্যে যাবেন না। যা করার একটু তাড়াতাড়ি করে ফেলুন, কাজে দেবে। গ্রুপ মেম্বাররা ফ্রেন্ডলি তো?
সৌগত। হ্যাঁ হ্যাঁ … দে আর ভেরি গুড। কিন্তু ওরা সবাই হয় ব্রিটিশ না হয় ইউরোপীয়ান, এখানে ওরা এক্সট্রিমলি ওয়েল কানেকটেড, ওদের সময় খুব কম। সন্ধ্যের সময় ওরা ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে হাঁ হাঁ করে দৌড়য় নিজের গ্রুপের সাথে আড্ডা দেবার জন্য অথবা নিজের গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে।
মোনালিসা। সে এখানে সবাই। এখানে রুল হচ্ছে যে কোন গ্রুপে জোর করে ঢুকে পড়া, এখানে কেউ ডেকে ফ্রেন্ডশিপ করে না, নিজেকে এগিয়ে যেতে হয়। গ্রুপে মেয়ে টেয়ে কেমন আছে?
এবার সৌগত হেঁসে ফেললো – এই … এইবার আপনি আপনার ঠিক ফর্মায় এসে গেছেন। ঘুরে ফিরে সেই মেয়ের ব্যাপার।
মোনালিসা। আসবোই তো … আপনি একটা ব্যাচেলর ছেলে, একলা হ্যা হ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন টেমসের ধারে আর চারিদিকে লোকে কত মজা লুটছে। শুনুন, লন্ডন প্রেমের শহর, এখানে যেখানে সেখানে প্রেমিকা পাওয়া যায় কিন্তু লাজুক হলে চলবে না, একটু বোল্ডলি অ্যাপ্রোচ করতে হবে। আপনি কোন মেয়েকে দেরিতে অ্যাপ্রোচ করলে আর একজন জিতে নিয়ে যাবে, আপনি ফক্কা। যাক, বলুন দেখি গ্রুপে মেয়ে টেয়ে কেমন আছে …?
সৌগত একটু অন্য দিকে তাকিয়ে বললো – আছে বেশ কয়েকজন, কিন্তু তারা ব্যাপক বিজি। যখনই দেখি করিডোরে বা কফি রুমে, কানে মোবাইল দিয়ে বসে আছে, সারাক্ষণ কারোর না কারোর সাথে কথা বলছে। আর সন্ধ্যে সাড়ে পাঁচটা বা পৌনে ছটা বাজলে আর রক্ষে নেই, বাঁ হাতে কানের কাছে মোবাইল ধরে ডান হাতে বাই জানিয়ে হাওয়া। ওরা কেউ ফাঁকা নেই মনে হয়।
মোনালিসা এবার একটু হাসলো – আগে থেকেই এতো হতাশ হবেন না। মডার্ন মেয়েরা এখানে এই রকমই, সন্ধ্যায় ওদের আড্ডা দেবার জন্য পাব নির্দিস্ট থাকে … সেখানেই ওদের বন্ধু বান্ধবরা জড় হয় একসাথে আড্ডা দেবার জন্য। ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে সোসালাইজিং একটা মারাত্মক ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার, এটা ঠিক আমাদের মতো নয়, একটু অন্য রকম। এখানে সবাই বিজি মানে এই নয় যে ওরা সবাই এনগেজড। এগুলো একটু মিশে বুঝতে হয়।
সৌগত এবার মোনালিসার হাতের পাতায় একটা চাপর মারলো – ঠিক আছে, ঠিক আছে, এটা আমার প্রথম বছর, তাই ঠিক এখনই এগুলো করা যাচ্ছে না। আগে ভালো ভাবে কাজটা এগুক, একটু ইম্প্রেশান ভালো হোক … তারপর আস্তে আস্তে এমনিতেই সব জানতে পারবো। প্রথমেই মেয়েদের দিকে বেশি নজর দিলে ডিপার্টমেন্টে একটা বাজে নাম হয়ে যেতে পারে।
মোনালিসা একটু হাসলো – মনে রাখবেন মেয়েদের ব্যাপারে অনেক খবর কিন্তু আপনার মেল কলীগরাই দিতে পারবে। যারা একটু পুরান, তাদের একটু হাতে রাখবেন আর সময় মতো জিঞ্জাসা করবেন।
সৌগত ঘার ঘুরিয়ে এবার মোনালিসার দিকে তাকাল – বাবা, আপনি তো ভয়ঙ্কর ধরিবাজ দেখছি। এতো কথা জানলেন কোথায়?
মোনালিসা। আরে আমরাও কলেজে পড়েছি, হোস্টেলে থেকেছি … এগুলো খুব কমন ব্যাপার। আর আমার বহু আত্মীয় বহু বড় বড় জায়গায় চাকরী করে, অফিসে প্রত্যেক লোকই তার কলীগের ব্যাপারে অনেক খবর রাখে। তাছাড়া অফিস পলিটিক্স বলে একটা কথা আছে। ইউনিভার্সিটিতে তো ছেলে মেয়েদের মধ্যে অনেক সময়েই প্রেম ট্রেমও হয়, কাজেই অনেকেই অনেকের খবর রাখে।
সৌগত শুধু বললো – অ্যাবসলিউটলি অন দি ডট।
এর মধ্যে সন্ধ্যার আঁধার আরো গাঢ় হয়েছে। টেমসের আসে পাশে এখন আলোর বন্যা। ওরা যেদিকে বসে আছে সেদিকে নানা রেস্তোরাঁ আলোয়া ঝলমল করছে আর লোকে উপছে পড়ছে। ওপারে অনেক দূরে উঁচু উঁচু বাড়ীগুলোর জানলা গুলো যেন অসংখ্য টুনি বাল্বের মতো জ্বলজ্বল করছে। আরো দূরে কোন অসমাপ্ত বাড়ীর ওপর একটা দুটো ক্রেন একটু বেঁকে যেন পোজ দিয়ে অন্ধকার আকাশকে ব্যাক গ্রাউন্ডে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের রঙটা এতো আলোয় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে ঘন বেগুনী। লন্ডনের এতো আলোর মধ্যে দু একটা তারা কেমন লাজুক ভাবে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারছে। সৌগত সব ভুলে সেই দিকেই তাকিয়ে ছিল …।
এই রাতের অন্ধকারেও অনেক ওপর দিয়ে দু একটা পাখী কোথায় উড়ে যাচ্ছে … একলা … হয়তো দলছুট হয়ে আর বাসা খুজে পাচ্ছে না। সৌগতর কেমন একটা অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছিল, এই তো মাস দুই আগেই সে খড়গপুরে ঘুরে বেড়াত … সেই টিক্কা আর স্বদেশের দোকান, সেই মেস আর মাছ ডাল ভাত, সেই মেন বিল্ডিং আর অ্যারোস্পেস ডিপার্টমেন্ট। আর আজ সে লন্ডনে টেমসের ধারে বসে আছে … খড়গপুর কত দূর এখন। এর মধ্যেই ইমেলের কন্ট্যাক্টও কমে আসছে। এর মধ্যে তার দু একজন বন্ধু নানা জায়গায় চাকরী পেয়ে গেছে, তারা নতুন জবে বিজি, ইমেল করার সময় কম। স্যার প্রশান্ত পাত্র অবশ্য ইমেল করলেই জবাব দেন।
এই সব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে খানিকটা সময় কাটছিল, দুজনাই চুপচাপ। মোনালিসা এক সময় সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল …
মোনালিসা। চলুন, আজকে আপনাকে খানিকটা লিফট দিয়ে ফিরে যাব। আপনাকে আর আজ টিউব ধরতে হবে না, আর এখন তো বেশ ভিড়ও হবে, অফিস আওয়ার্স তো শেষ হয়ে গেছে।
সৌগত না বললো না, মোনালিসার সঙ্গে থাকতে তার বেশ ভালো লাগে। একদম পরিচ্ছন্ন মানসিকতার বুদ্ধিমান একজন মহিলা যার প্রতিটি আচরণে কালচারের ছাপ স্পষ্ট।
ওরা দুজনে হেঁটে পার্কিং লটে এলো। সেখানে অনেক গাড়ীর ভিড়ে মোনালিসার জেড ব্ল্যাক টয়োটা দাঁড়িয়ে। ওরা দুজনে উঠে পড়তেই মোনালিসা দক্ষতার সাথে পার্কিং লট থেকে বের হয়ে এলো, তারপর সন্ধ্যায় লন্ডনের রাস্তায় পড়ে অসংখ্য গাড়ীর মধ্যে মাছের মতো ড্রিবল করতে করতে এগিয়ে চললো।
… to be continued