০৪/০৩/২০১৭

প্রায় রাত ৯ টা বাজতে চলল … অন্যান্য দিনের মত আজও কালিপুরের মোড়ে যানজটের অন্যথা হয় নি। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় এই ব্যাপারটাই ভাবাচ্ছিল। এমনিতে রাত ৯ টার পর কলকাতার রাস্তায় লরি চলাচল শুরু হয়ে যায়, তাই যত সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল মনের মধ্যে উৎকণ্ঠা তত বাড়ছিল। দুবছর দুমাস পর আজ বেরনোর সুযোগ হয়েছে … লক্ষ্য শ্বেতশুভ্র বরফের শীতলতা অনুভব করা … গন্তব্য সিকিম। রাত ১১:১৫ তে শিয়ালদহ – নিউ জলপাইগুড়ি পদাতিক এক্সপ্রেসে টিকিট। এমনিতে শিয়ালদহ -এর থেকে হাওড়া স্টেশনেই আমি একটু বেশি স্বচ্ছল, সেই কারনেই হয়ত হাতে সময় থাকা সত্বেও অস্বস্তি টা একটু বেশিই হচ্ছে।

সব সমস্যা পেরিয়ে যখন শিয়ালদহ পৌছালাম তখন ঘড়িতে রাত ১০:৪০, ভাগ্যক্রমে রাস্তাতে লরি বেশি ছিল না। যাইহোক তাড়াতাড়ি ৯বি প্ল্যাটফর্মে গিয়ে ট্রেনে উঠলাম। যথাসময়ে ট্রেন ছাড়ল, রাত বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ যাত্রীই ঘুমনোর চেষ্টায় লেগে পড়ল … একা হয়ত আমিই বেড়াতে যাওয়ার নেশায় পাগল ছিলাম, ঘুম আমায় ধরা দিতে চাইছিল না। ইঞ্জিনের ‘ধক ধক’ হ্‌ৎস্পন্দন রাতের অন্ধকার চিরে ছুটে চলার প্রবল ইচ্ছার জানান দিচ্ছিল যা আমার মনের অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলছিল।

০৫/০৩/২০১৭

রাতে ট্রেনে পাহাড়চূড়ার মাথায় জীবনে প্রথমবার বরফ দেখার অনুভতি কেমন হতে পারে সেটা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভাঙল যখন তখন ট্রেন মালদা টাউন পেরিয়ে গিয়েছে। সকাল ১০ টায় আধঘণ্টা দেরিতে ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি পৌছাল। প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে সুমো বুক করে রওনা দিলাম গ্যাংটকের উদ্দ্যেশে। গ্যাংটক … ভারতীয় রাজ্য সিকিমের রাজধানী  ও বৃহত্তম শহর। শিবালিক হিমালয়ের ১৪৩৭ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত গ্যাংটক শহরের জনসংখ্যা প্রায় ত্রিশ হাজার। বাসিন্দারা প্রধানত নেপালি, লেপচা ও ভুটিয়া। হিমালয় পর্বতমালার সুউচ্চ শিখরগুলির মাঝখানে মনোরম পরিবেশে গ্যাংটকের অবস্থান এই অঞ্চলের জলবায়ুকে সারা বছরই মোটামুটি আরামদায়ক রাখে যার কারণে গ্যাংটক সিকিমের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র। ১৮৪০ সালে এনচে মঠ নির্মাণের পর থেকেই বৌদ্ধ তীর্থস্থান হিসেবে গ্যাংটকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ১৮৯৪ সালে তৎকালীন সিকিম চোগিয়াল থুতোব নামগিয়াল গ্যাংটকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তিব্বতের লাসা ও ব্রিটিশ ভারতের কলকাতার মধ্যে বাণিজ্যপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্রামস্থলে পরিণত হয় গ্যাংটক। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর সিকিম ভারতে যোগ না দিয়ে স্বাধীন রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসত্ত্বা বেছে নেয়। এই সময় গ্যাংটক ছিল দেশটির রাজধানী। ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে যোগ দিলে গ্যাংটক ভারতের বাইশতম রাজধানীতে পরিণত হয়। গ্যাংটক নামটির সঠিক অর্থ জানা যায় না। যদিও নামটির জনপ্রিয়তম অর্থ হল পাহাড় চূড়া যার প্রধান কারন হয়ত গ্যাংটক শহর থেকে দেখতে পাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘার নৈশর্গিক দৃশ্যের জন্য। বর্তমানে গ্যাংটক তিব্বতি বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও শিক্ষার একটি কেন্দ্র। এখানে একাধিক বৌদ্ধ মঠ, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তিব্বততত্ত্ব কেন্দ্র রয়েছে।

আমাদের গাড়ি জাতীয় সড়ক ১০ ধরে এগতে এগতে সেবক ব্রিজে উঠতেই তিস্তার বিস্তীর্ণ অববাহিকা দেখা গেল। তিস্তা একাধারে যেমন উত্তরবঙ্গের গর্ব তেমনি উত্তরবঙ্গের দুঃখও বটে, প্রতিবছর তিস্তার বিধবংসী বন্যা উত্তরবঙ্গবাসীর রাতের ঘুম ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এই তিস্তাই এখন সিংথাম পর্যন্ত এ পথের সফরসঙ্গী। সিংথামের পর তিস্তা চলে যায় বামদিকে আর জাতীয় সড়ক চলে ডানদিকে রানিখোলা নদীর পাশে পাশে। যতদূর মনে হয় ‘খোলা’ বলতে সিকিমে খালকে বোঝায় … যদিও রানিখোলাকে দেখে খাল মনে হওয়ার পেছনে কোন যুক্তি খুঁজে পাই না, তিস্তার মত না হলেও ধারে ভারে রানিখোলাও কিছু কম যায় না। আমাদের গাড়ি কালিঝোরা, রম্বি বাজার পেরিয়ে তিস্তা বাজারের দিকে এগিয়ে চলে। এই রাস্তায় তিস্তা বাজারের গুরুত্ব অপরিসীম কারন এখানেই দার্জিলিং ও কালিম্পং থেকে রাস্তা এসে মিশেছে। এখানে জাতীয় সড়ক তিস্তাকে অতিক্রম করে ডানদিকের পাহাড়ে আবার চড়াই উঠতে শুরু করে। সময়ের সাথে সাথে আমরা গ্যাংটকের দিকে এগিয়ে চলি। ক্রমে আমরা রংপো পুলিশ চেকপোস্টে পৌঁছাই … এখানে পশ্চিমবঙ্গের শেষ আর সিকিমের শুরু, তাই এখানে পরিচয়পত্র দেখিয়ে সিকিমে প্রবেশের অনুমতি নিতে হয়। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো কেউ যদি সিকিম ঘুরতে আসেন অবশ্যই সাথে সচিত্র পরিচয়পত্রের আসল এবং কিছু ফটোকপি এবং সাথে ৮ থেকে ১০ টা পাসপোর্ট মাপের রঙিন ছবি রাখবেন, যদি না থাকে হতে পারে আপনাকে রংপো থেকেই ফেরার রাস্তা ধরতে হল।

বিকাল ৩ টা নাগাদ গ্যাংটক পৌঁছালাম। শিলিগুড়ি ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের কাছে আমাদের গাড়ি থেমে গেল … এর আগে পশ্চিমবঙ্গের গাড়ি যেতে পারবে না, আমাদের এরপর সিকিম নাম্বারের চার আসনবিশিষ্ট ট্যাক্সিতে বাকি পথ যেতে হবে। গ্যাংটকে আমাদের প্রাথমিক গন্তব্য সেন্টার-পয়েন্ট লজ। পাহাড়ি রাস্তায় ৪-৫ ঘণ্টার যাত্রাতে আমরা প্রত্যেকেই খুব ক্লান্ত, অগত্যা সময় নষ্ট না করে ট্যাক্সি বুক করে রওনা দিলাম। দূরত্ব বেশী ছিল না, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রাঁকা-রুমটেক ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছালাম। উল্টোদিকেই আমাদের হোটেল।

দরজা খুলে ব্যালকনিতে পা রাখতেই যে দৃশ্য দেখতে পেলাম তা ভাষায় বর্ননা করা একপ্রকার অসম্ভব, সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিস্তীর্ণ পর্বতমালা, অস্তগামী সূর্যের আলোর ছটা মেঘের মধ্যে দিয়ে উঁকি দিচ্ছে … এ যেন পৃথিবীরই বুকে এক অপার্থিব সৌন্দর্য। গ্যাংটকে প্রথম দিনেই প্রকৃতির এই উষ্ণ অভ্যর্থনা যেন বলতে চাইছিল … এখানেই শেষ নয়।

আমাদের হোটেলের পেছনেই এম. জি. মার্গ মার্কেট। এম. জি. মার্গ মার্কেটকে কলকাতার নিউ মার্কেটের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা চলে … ভারতীয় এবং বিদেশী দুধরণের পর্যটকই চোখে পড়ল, যে যার মত কেনাকাটায় ব্যস্ত, তো কেউ আবার এখনও এম. জি. মার্গের সৌন্দর্যের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারে নি। প্রথম দেখায় মনে হতেই পারে বিদেশের কোন শহরে পা রেখেছেন, সত্যি বলতে কি মার্বেল পাথরে বাঁধানো এম. জি. মার্গ যেন ‘গরীবের বিলেত’।

রাত ৯ টা থেকে ১০ টার মধ্যে গ্যাংটক শহর মোটামুটি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আমিও স্রোতে গা ভাসালাম।

০৬/০৩/২০১৭

তখনও ভালো করে সকালের আলো ফোটেনি, ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। দূরের পাহাড়গুলো কুয়াশাচ্ছন্ন … যেন পাহাড়, মেঘ আর সূর্যের মধ্যে আলোআঁধারি খেলা চলছে। সকাল সকাল স্নান করে নিলাম। আজ আমাদের লক্ষ্য উত্তর সিকিমের লাচুং উপত্যকা। ইয়ুম্থাং ও কাটাও এর প্রবেশপথ লাচুং গ্রাম ২৯০০ মিটার উচ্চতায় লাচুং নদীর তীরে অবস্থিত। সেখানেই আজ রাত্রিবাস। সিকিমের নিয়ম হল সকাল ৭ টার পর বড় গাড়ি শহরের মধ্যের রাস্তায় প্রবেশ করতে পারবে না। তাই ৭ টার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে নইলে বাড়তি ট্যাক্সিভাড়া গুনতে হবে।

সকাল ১০ টায় দিক্‌চু পৌঁছালাম। রাস্তায় আসার পথে বাক্‌থাং ঝরনা এবং বাটারফ্লাই ঝরনা দেখলাম। খুব একটা কিছু আহামরি নয়, তবে পাহাড়ি পথে ফার্ন – পাইনের মাঝে খারাপ ও লাগে না। দিক্‌চুতে এসে হারানো তিস্তাকে ফিরে পেলাম, তবে এখানে তিস্তার নাম দিক্‌চু। দিক্‌চু থুরি তিস্তা এখান থেকে এল. মাংসিলা পর্যন্ত রাস্তার পাশে পাশে চলে, আবার হারিয়ে যায় নিজের আপন খেয়ালে … আমরাও এগিয়ে চলি।

যত এগতে থাকি তত হিমালয়ের বিস্তার বাড়তে থাকে … মানগাঁও, তুং হয়ে চুংথাং পৌঁছাতেই দূরের পাহাড় চূড়ায় বরফের আভাস দেখতে পেলাম। ব্যাপারটা অনেকটা মূল সিনেমা শুরুর আগে ট্রেলার দেখানোর মত, যদিও এরপর এ গিয়ে আদৌ বরফ দেখতে পাবো কিনা সেটা ভাগ্যের ওপরই ছেড়ে দিলাম। এর পর থেকে আমরা যেন ক্রমশ মেঘের রাজত্বে প্রবেশ করছিলাম, গাড়ির কাঁচ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল বারবার। তারমাঝেই উত্‌রাই বেয়ে লাচুং উপত্যকায় নামতে শুরু করলাম।

বিকাল ৪ টার দিকে লাচুং পৌঁছালাম। উপত্যকা হওয়ায় এখানে সূর্যাস্ত হয় তাড়াতাড়ি। উত্তর সিকিমের হিমালয় হল ‘গ্রোয়িং মাউন্টেন’ মানে এখনও এর উচ্চতা বাড়ছে, তাই এখানকার মাটি আলগা এবং অল্প বৃষ্টিতেই বা কখনও বৃষ্টি না হলেও ধস্‌ নামে। এই কারনে গ্যাংটক থেকে লাচুং এর রাস্তা জায়গায় জায়গায় খুবই খারাপ বা বেশীরভাগ জায়গাতেই রাস্তা সারাই এর কাজ চলছে। এই অংশের রাস্তার দায়িত্ব বর্ডার রোডস্‌ অর্গানাইজেশনের। বর্ডার রোডস্‌ অর্গানাইজেশন মূলত ভারতীয় সেনার অফিসার এবং ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে গঠিত ভারত সরকারের একটি সংস্থা যা বর্ডার এর কাছের রাস্তাগুলির রক্ষনাবেক্ষন করে। এখানেও বর্ডার রোডস্‌ অর্গানাইজেশন খুবই সক্রিয়।

০৭/০৩/২০১৭

গতকাল সারারাত ঘুম হয়নি, বলা বাহুল্য কারণটা প্রচন্ড ঠান্ডা। গতকাল বিকালে যখন লাচুং এ এসে পৌঁছেছি তখন থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছিল, রাতে হোটেলের কেয়ারটেকারের কাছে শুনলাম ওপরে বরফ পড়ছে। পরে জেনেছিলাম রাতে তাপমাত্রা ছিল -১ ডিগ্রী সেলসিয়াস। রাতে ঠান্ডা ছাড়াও ঘুম না হওয়ার আর একটা কারন হয়ত ছিল উত্তেজনা … যদি কেয়ারটেকারের কথা সত্যি হয় তাহলে আমার স্বপ্ন সত্যি হবে যেটার জন্য মূলত সিকিম আসা। সকালের আলো ফুটতেই ঘরের জানলা খুলে বাইরে তাকালাম … যা দেখলাম তা জন্মজন্মান্তরেও ভুলব না। সামনের পাহাড়টা বরফে ঢেকে গিয়েছে, যেন কেউ আকাশ থেকে নুন ছড়িয়ে দিয়েছে পাহাড়ের গায়ে আর সকালের সূর্যের আলো পড়ে পাহাড়চূড়া সোনালী হয়ে গেছে।

সকাল ৭ টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম কাটাও এর পথে। কাটাও ইন্দো-চীন সীমারেখার কাছে অবস্থিত একটি গ্রাম যা মূলত বিখ্যাত এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য। এছাড়া এখান থেকে চীনের সীমানা দর্শন করার জন্যও পর্যটকরা ভিড় জমায়। রাস্তায় লাচুং মনাস্ট্রি অতিক্রম করে কিছুদূর চড়াই উঠতেই কিছু পতাকা মত জিনিস চোখে পড়ল … পতাকাও ঠিক বলা চলে না, লম্বা সাদা কাপড় বাঁশের গায়ে বাঁধা যা হাওয়ায় উড়ছে। এ জিনিস এই প্রথম না, গ্যাংটকে এর আগেও দেখেছি, গাড়ির চালকের মুখে জানলাম এটা ধর্মীয় রীতি যা মৃত মানুষের আত্মার শান্তিকামনার উদ্দ্যেশ্যে করা হয়।

এরপর ক্রমে এল সেই মুহুর্ত, আমাদের আশেপাশের রুক্ষ-সবুজ ঝোপঝাড় ঢাকতে লাগল সাদা রঙে। যেদিকে চোখ যাচ্ছিল শুধু সাদা আর সাদা। শান্তির প্রতীক সাদা যে মনকে কতটা উত্তেজিত করে তুলতে পারে সেদিন অভিজ্ঞতা হল।

প্রচণ্ড পরিমাণে বরফ পড়ে থাকায় কাটাও এর রাস্তা বন্ধ … অগত্যা কাটাও এর ৯ কি. মি. আগে থেমে যেতে হল।  বাইরে যেদিকে চোখ যাচ্ছে সেদিকেই শুধু বরফ আর বরফ। গাড়ির দরজা খুলে মাটিতে পা দিতেই মনে হল এ যেন অন্য কোন গ্রহে পৌঁছে গেছি। কিছুক্ষনের জন্য মাথা থেকে সব চিন্তাভাবনা মুছে গেল, নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না। বুঝতে পারলাম মিথ্যে নয়, বাস্তবিকই আমার স্বপ্নপূরণ হয়েছে … সিকিম আসা আমার সার্থক।

জীবনে প্রথম বার বরফ দেখার অভিজ্ঞতা কাটাও ঘুরতে না পারার দুঃখ অনেকটাই প্রশমিত করে দিতে পারলেও একটা বিষন্নতা রয়েই গেল। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল ইয়ুম্থাং এবং জিরো পয়েন্ট। পুনরায় হোটেল ফিরে এসে রওনা দিলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর বরফাবৃত পর্বতশৃঙ্গ চোখে পড়ল। কাটাও এর রাস্তায় বরফে মোড়া পাহাড় দেখলেও এই জিনিস দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সূর্যের আলো বরফে প্রতিফলিত হয়ে এক অনন্য শোভার সৃষ্টি করেছে। পাহাড়ি পথের বাঁক থেকে বাঁকে সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, খুঁজে নিতে বেশী কষ্টও করতে হয় না … প্রকৃতি নিজেই ধরা দেয়।

শিংবা রডোড্রেনডন স্যাংচুয়ারি পৌঁছাতেই দেখলাম সামনের রাস্তা বরফ পড়ে বন্ধ। ইয়ুম্থাং এখনও ১৫ কি. মি.। বুঝলাম … শিংবা রডোড্রেনডন স্যাংচুয়ারি পাহাড়ের ওপর কিছুটা সমতল একটা জায়গা, চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের রুক্ষতা, গাছের সবুজ আর সাদা বরফ দিয়ে সাজানো শিংবা রডোড্রেনডন স্যাংচুয়ারিকে ‘মিনি সুইজারল্যান্ড’ বলা যেতেই পারে।

গ্যাংটকে ফিরে এসে ঠাণ্ডা লাগছেই না, কারন অবশ্যই উত্তর সিকিম। লাচুং এর ঠাণ্ডার সাথে গ্যাংটকের ঠাণ্ডার কোন অংশেই তুলনা হয় না। কাটাও, ইয়ুম্থাং কোথাও পৌঁছাতে পারা যায়নি রাস্তা বরফে আটকে যাওয়ার জন্য … জিরো পয়েন্ট এর কথা তো বলা বাহুল্য কারন জিরো পয়েন্ট ইয়ুম্থাং থেকে আরও ২৫ কি. মি. আগে ইয়ুমসাডং এর আর এক নাম … সারা বছর বরফাবৃত থাকার কারনে সমগ্র এলাকায় কোন গাছগাছালির ছোঁয়া নেই, জিরো পয়েন্ট নামের এটাই কারন। এই রাস্তায় এখানেই জনপদ শেষ … এর আগে শুধুই হিমালয়। ১৫,৩০০ ফিট উচ্চতায় স্বাভাবিকভাবেই বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্ব কমে আসে, অনেকেরই জিরো পয়েন্ট এ শ্বাসকষ্ট হয়। অনেকটা রাস্তা গাড়িতে আসায় শরীর ক্লান্ত, তাড়াতাড়ি ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম। মনের মধ্যে একটা বিষন্নতা কাজ করছিল কাটাও, ইয়ুম্থাং, জিরো পয়েন্ট না পৌঁছাতে পারার জন্য … কিন্তু স্বপ্ন পূরনের আনন্দের কাছে সবই ফিকে হয়ে যায়। জীবনে প্রথম বরফের ছোঁয়া তাই বিষন্নতার অ্যান্টিবডি হিসাবে কাজ করছিল।

০৮/০৩/২০১৭

আজ সেন্টার পয়েন্ট লজ থেকে চেক আউট করে স্থানীয় কিছু জায়গা ঘুরে দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। বানঝাকরি ওয়াটার ফল্‌স, তাসী ভিউ পয়েন্ট, হ্যান্ডক্র্যাফ্‌ট প্রদর্শনী, নাম নাম ভিউ পয়েন্ট ও পালজোর ফুটবল স্টেডিয়াম দেখে পৌঁছালাম রিড্‌জ পার্কে ফুলের প্রদর্শনী দেখতে। বিভিন্ন ফুল ও অর্কিডের সমারোহে রিড্‌জ পার্ক এক অনন্য জায়গা। এরপর এন্‌চে মনাস্ট্রি ঘুরে পৌঁছালাম গণেশ টক। সিকিমে ‘টক’ বলতে মন্দিরকে বোঝায়। গণেশ টক থেকে পুরো গ্যাংটক শহরের একটা প্যানোরমিক ভিউ পাওয়া যায়। এরপর গেলাম হনুমান টক। সূর্য অস্ত যাওয়ায় এবং প্রচণ্ড হাওয়া চলাচলের কারনে হনুমান টকে বেশ শীত করছিল। মন্দিরের মাথায় দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে সামনে শুধুই সবুজ পাহাড় একে অপরকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে আছে।

পিক্‌স অ্যান পাইন গেস্ট হাউস এ এসে উঠেছি। এখান থেকে ছাঙ্গু ট্যাক্সিস্ট্যান্ড কাছে হয়। আগামিকালের গন্তব্য ছাঙ্গু লেক, নাথুলা পাস ও বাবা মন্দির। ফেরার পথে একটা ধাবায় মোমো খেলাম। এমনিতে মোমো আমার খুব প্রিয়, তার ওপর ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে গরম মোমো … মোমো পিয়াসী হলে আশাকরি অভিজ্ঞতাটা অনুভব করতে পেরেছেন।

০৯/০৩/২০১৭

আজকের গন্তব্য ছাঙ্গু লেক … নাথুলা পাস, বাবা মন্দিরের রাস্তা বরফাবৃত, তাই পাস পাওয়া যায়নি। নাথুলা পাস যাওয়ার জন্য ভারতীয় সেনার থেকে অনুমতি করাতে হয়। নাথুলা পাস ও কাটাও, ইয়ুম্থাং এর দলে যুক্ত হল। নাথুলা পাসের প্রধান আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য হল ভারত-চিন বর্ডার। যাইহোক নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো এই বলে মনকে শান্তনা দিয়ে রওনা দিলাম ছাঙ্গু লেকের উদ্দেশ্যে।

ছাঙ্গু লেকে যখন পৌঁছালাম তাপমাত্রা তখন -৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ছাঙ্গু শব্দের অর্থ জলের উৎস। ১২,৩১০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত ছাঙ্গু লেকে বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্ব খুবই কম। প্রচন্ড ঠাণ্ডায় শ্বাসকষ্ট খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ইনহেলার সাথে নিয়ে যাওয়াই ভালো … প্রয়োজনে ব্যবহার করলে কিছুটা সুস্থবোধ করবেন।

ছাঙ্গু লেকের সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার উপক্রম … সাদা পর্বতমালার মাঝে বিশাল এক লেক। যেদিকে চোখ যাচ্ছে শুধু সাদা বরফ আর বরফ। বাতাসে একদমই আর্দ্রতা না থাকায় বরফ জমে শক্ত হয়ে গেছে। লেকের ধার দিয়ে ইয়াক হেঁটে যাচ্ছে … পিঠে সওয়ার মানুষ। নাথুলা পাস যেতে না পারায় সবাই ভিড় জমিয়েছে ছাঙ্গু তে। গ্রীষ্ম ও শরৎ এ লেকের ধারে প্রিমুলা ফুল দেখা যায়, শীতে খুব ঠাণ্ডা পড়লে লেকের জলও বরফ হয়ে যায়।

সন্ধ্যেটা হোটেলে বসেই কেটে গেল। সিকিম দেবতার আশীর্বাদে গরমাগরম সুস্বাদু মোমোও পেটে পড়ল। দুদিন পর ফিরে যাওয়া আবার এক সপ্তাহ পার করার পর বাড়ি ফেরার টান, সাথে আবার মোমো … অনুভূতি আমার বোধের বাইরে। যাইহোক রাত বাড়ার সাথে সাথে ঘুমের মাসির কোলে নিজেকে সঁপে দিলাম।

১০/০৩/২০১৭

প্রথমে ঠিক ছিল গ্যাংটক ঘুরে দার্জিলিং যাবো। কিন্তু গ্যাংটক ঠিক ভাবে ঘুরতেই সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় দার্জিলিং যাওয়া বাতিল করলাম। তাই আজ দিনটা ফাঁকা ছিল। ঠিক করলাম লাম্‌পোখোরি লেক যাবো। সেই মত ট্যাক্সি ঠিক করে রওনা দিলাম।

৪৬০০ ফিট উচ্চতায় পূর্ব সিকিমের আড়িটারে অবস্থিত ১১২০ ফিট লম্বা এবং ২৪০ ফিট চওড়া লাম্‌পোখোরি লেকের আকৃতি বুটজুতোর মত। এটা সিকিমের প্রাচীন প্রাকৃতিক লেকের মধ্যে অন্যতম। গ্যাংটক থেকে রানিপুল, রংপো হয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে নিউ জলপাইগুড়ি, আর একটা রাস্তা রংপো থেকে রংপো নদীর পাশে পাশে চলে রোরথাং, জিয়ানকুঞ্জ হয়ে আড়িটারের পথে। গ্যাংটক থেকে লাম্‌পোখোরি লেকের দূরত্ব ৬৭.৫ কি. মি.।

৩ ঘণ্টার যাত্রায় লাম্‌পোখোরি লেকে পৌঁছে প্রকৃতির অন্য এক রূপের ছোঁয়া পেলাম। কদিন সাদা বরফের পর লাম্‌পোখোরি লেক স্বাগত জানাল স্নিগ্ধ সবুজ দিয়ে। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হল লেকের জলে বোটিং। এছাড়া লেকের ধার বরাবর বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হাঁটতেও বিন্দুমাত্র ক্লান্তি আসে না। চারিপাশে ঘন পাইনবন এলাকার সৌন্দর্য একধাক্কায় অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়।

লেকের চারপাশে একবার ঘুরে বোটিং করব ঠিক করলাম। বোটিং করতে করতে টিপ টিপ পাহাড়ি বৃষ্টি শুরু হল। হঠাৎ মনে হল এর মধ্যে গরম মোমো হলে পুরো ব্যাপারটা জমে যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বোটের মধ্যেই মোমো নিয়ে লেকের একদম মাঝে চলে এলাম। লেকের জলে রঙিন মাছের খেলা, আকাশে টিপ টিপ বৃষ্টি আর সাথে গরম মোমো … অনন্য এই অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকতে হলে আসতে হবে লাম্‌পোখোরি লেক … সাথে একটু ভাগ্যের সাথ দরকার কারন বৃষ্টি হওয়াতো আপনার হাতে নয়, তবুও বলতে পারি লাম্‌পোখোরি লেক আপনাকে নিরাশ করবে না। এখানে থাকার জন্য বিভিন্ন রিসর্টের ব্যবস্থা আছে, আর যদি চান রাতটা একটু রোমাঞ্চকর হোক তাহলে থাকতে পারেন হোমস্টেতে … স্থানীয় লোকেরা তাদের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দেন, সাথে রাতে হালকা টিমটিমে আলোয় দেশী মুরগীর ঝোল – ভাত আর ক্যাম্পফায়ার।

সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে এসে বেরলাম এম. জি. মার্গের টানে … কিছু কেনাকাটা করে নিলাম গ্যাংটকের স্মৃতি হিসাবে। এরপর ফিরে যেতে হবে। সবই স্মৃতি হিসাবে রয়ে যাবে। মন তাই বিষণ্ণ।

১১/০৩/২০১৭

আজ ফিরে যাওয়া। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে রাত ৮ টা ৪৫ মিনিটে টিকিট … আবার সেই পদাতিক এক্সপ্রেস। আজ সকাল থেকেই গ্যাংটকের আকাশ মেঘলা, তার সাথে ঘন কুয়াশা। হঠাৎ ইচ্ছা হল এই আবহাওয়াতে পাহাড়ি পথে একটু হেঁটে আসি … এরপর কবে সুযোগ হবে জানিনা। ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়লাম … হাঁটতে হাঁটতে গেলাম আবার এম. জি. মার্গ। রাস্তাতেই বৃষ্টি শুরু হল … এটাও একটা ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা। দুপুর ১ টার সময় হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম … পাহাড়ে বৃষ্টি শুরু হলে হাতে সময় রেখে বেরোনো উচিত আর এক্ষেত্রে ট্রেন ধরার জন্য ৪ ঘণ্টার রাস্তা অতিক্রম করতে হবে। যেতে হবে শিলিগুড়ি ট্যাক্সিস্ট্যান্ড।

ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি বিশাল ভীড় … রংপো চেকপোস্টে চেকিং এ সব গাড়ি জ্যামে পড়ে গেছে। অবশেষে ৩ টের সময় আমাদের গাড়ি আসতে রওনা দিলাম নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে। রাস্তায় যত এগচ্ছি বৃষ্টি তত বাড়ছে। শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টির নিয়মই এটা … মেঘ পর্বতের প্রতিবাত ঢালে ধাক্কা খেয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায় আর গ্যাংটক-নিউ জলপাইগুড়ি জাতীয় সড়ক শিবালিক হিমালয়ের প্রতিবাত ঢালে অবস্থিত। প্রচন্ড বৃষ্টি তিস্তাকে আজ নতুন জীবন দিয়েছে … নতুন উদ্দ্যমে বয়ে চলা তিস্তা আজ প্রচন্ড খরস্রোতা … যা সামনে বাঁধা হয়ে আসছে তাই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এমনিতেই সময়ের পিছনে ছিলাম … প্রচন্ড বৃষ্টি বারবার চলার পথে বাঁধা হয়ে আসছিল। ট্রেন মিস হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তা নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম।

রাত ৮ টায় নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশনে পৌঁছালাম। সব চিন্তার অবসান। ৮ টা ৩০ মিনিটে পদাতিক এক্সপ্রেস এসে গেল … ট্রেন এ উঠে পড়লাম … শেষ হল একটা সংক্ষিপ্ত অধ্যায়ের।

শেষ হয়েও হল না শেষ

খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল এই এক সপ্তাহ … যা কিছু এই কদিনে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা ভোলা কঠিন আর ভুলতে চাইও না। সিকিম অনেক কিছু দিয়েছে আমাকে … আমার বরফ দেখার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে … প্রকৃতি কতটা আনমনা হতে পারে তা দেখেছি এই এক সপ্তাহে। কিছু বিষণ্ণতাও আছে … একদিনও গ্যাংটক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে পাইনি, কাটাও, ইয়ুম্থাং বা নাথুলা পৌঁছাতে পারিনি … রয়ে গিয়েছে আরও না দেখা কত কিছু। কিন্তু জীবনে সব একসাথে পাওয়া যায় না, তাই যা পেয়েছি তাতেই আমি সমৃদ্ধ। যেটুকু রয়ে গেল থাক … সেই টানেই আবার ছুটে আসব অপরূপ সুন্দর সিকিমের বুকে।

~ বরফের দেশে ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleরোজনামচায় ভালোবাসা
Next articleবেরেক দা চেন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments