আজ সকালে সুনীতা ফোন করেছিল। মে মাস থেকে আমাদের আবাসনে বাইরের লোকজন ঢূকতে দেওয়া হবে। ও খবর পেয়েছে। সুতরাং সুনীতাও আসবে। এতদিন কাজে আসতে পারছেনা, একেবারেই ভাল লাগছেনা। হাঁপিয়ে উঠেছে।

আজ থেকে বছর সতের আগে সুনীতা মায়ের সাথে কলকাতা এসেছিল। সেই যখন, সুন্দরবনে ‘মীন’ ধরে ওদের সংসার চালানো দায় হয়ে উঠেছিল , সেই তখন। কলকাতায় আসার প্রথম ক’বছর ওর মা অনিতা বলত “গেরামে কামাই নেই ,তবে শান্তি আছে”। সেসব অনেকদিন আগের কথা। আজ বহুদিনই ওরা বেশ খুশি খুশি হয়ে কলকাতা শহরের গাদাগাদি ঝুপড়িতে ‘কাজের লোক’ হয়ে গেছে। সুনীতা এখন তেইশ কি চব্বিশ। গ্রামের স্কুলে কিছুটা পড়েছিলো। অনেক সাধ্যসাধনাতেও এখানে আর পড়লোনা। শহরে হরেক মজার ভিড়ে যেটুকু শিখেছিল তাও ভুলে গেছে। এখন কোনোক্রমে সই টা করতে পারে। একটা সেলাই স্কুলে যায়। চায়না ফোন হাতে ওর দিনকাল নেহাত মন্দ কাটেনা। প্রচুর জমা কথা আমাকেও শুনতে হয়। জনতা কার্ফুর দিন বিকেল পাঁচটাতে গোটা আকাশ যে ভাইরাসে ছেয়ে গেছি্ল , সে খবর ঐ দিয়েছে। কামাই করেনা মোটেই । শুধু রবিবার সব বাড়ি থেকে ছুটি নিয়ে, মা মেয়ে দুপুরবেলা ব্যানারজি হাটে যায়। হাট থেকে সস্তায় সারা সপ্তাহের বাজার করে, টুকিটাকি সংসারের নানা জিনিষ কেনে। কেনে ছিট কাপড়। যা দিয়ে ভাইপো ভাইঝিদের জামা, ওর কুর্তা, মায়ের ব্লাউজ এসব বানায়। ইদানিং কিছু অর্ডার ও পাচ্ছে। সে সবের জিনিষ ও কেনে। প্রতি সোমবার লাফাতে লাফাতে আসে। আমি শুনি ওর কেনাকাটার গল্প।

প্রথম প্রথম এই করোনায় ও মোটেই ভয় পেতনা। আমাকে ও আশ্বস্ত করত ,আমাদের বিশেষ চিন্তা নেই। ওটা খুব বড়লোক দের অসুখ। মানে আরকি যারা ব্রেকফাস্টটা লন্ডনে, লাঞ্চ টা হনলুলুতে সারেন ,তাদেরই হবে। করোনা অবশ্য সাম্য এনেছে। সুনীতাও এখন ভয় পাচ্ছে। তাই বাড়িতেই আছে।

মাসের প্রথমে বেতন নিতে এসে বলছি্ল , “মামি বেরেক দা চেন হলেই আমি চলে আসব”।

– সেটা কি রে?

-আরে তোমাদের ওই মাস্টারনির বাড়ির দাদাবাবু গেল মাসে ফোনে কাকে যেন বলছিল,’ বেরেক দা চেন করতেই হবে,তাহলেই আর চিন্তা নেই’।

তা বটে । আবার সুনীতা কাজে আসবে, রবিবার হাটে যাবে। কিন্তু সোমবার কি আগের মতই খুশি খুশি হয়ে কেনাকাটার গল্প শোনাতে পারবে? হাটের দোকানি কী আগেরমতো খুশি ওকে করতে পারবে ? ঐ দোকানি কে কী ততটা খুশী করতে পারবে বড়বাজারের হাটের দোকানি ? বড়োবাজারের দোকানি কে হয়তো ততটা খুশি করতে পারেনি শোভাবাজার , হাতিবাগান বা অন্য কোন এলাকার কোন কারিগর। সেই কারিগর কে খুশি করেনি বড়বাজারের হোলসেল দোকানি। তাকে হয়ত খুশি করেনি গুজ্ররাট আমেদাবাদ এলাকার …। আমার মত আদার ব্যপারি আর ভাবতে পারছেনা। কি জানি ততদিনে হয়ত সামনে- পেছনে, ডানে-বাঁয়ে বাজারের সব চেন ই ব্রেক করে যাবে। ততদিনে সম্ভবত দীর্ঘ হবে অন্য এক চেন। অখুশি সুনীতা, তার পেছনে আর এক সুনীতা, আর এক…।

শুনেছি মানুষের গড় ‘ভাল’ থাকা ,’খুশি’ থাকা দিয়ে ‘ভাল’ অর্থনীতি ‘মন্দ’ অর্থনীতি মাপা যায়। অর্থনীতিবিদেরা এ সব নিয়ে ভাববেন। আমি শুধু ভাবছি ‘ভাল’ থাকতে , ’খুশি’ থাকতে সুনীতারা কি জানি, কোন অজানা ঠিকানায় আবার পাড়ি দেবে। কি অপেক্ষা করে আছে সেখানে ওদের জন্য, কে জানে !!

~ বেরেক দা চেন ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleবরফের দেশে
Next articleকরোনায়ে প্রার্থনা
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments