গপ্পোর শুরুটা
এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষন আগে হঠাৎ করে। রোদের আর তেজ নেই, মৃদুমন্দ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। বিকেলে আমি বকুল-দির সাথে আমাদের বাড়ির বারান্দাতে দিদির জন্য অপেক্ষা করে করে অধৈর্য হয়ে পড়েছি। দিদিটা যে কী করছে না ভিতরে, কে জানে!
“দিদি আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে, একটু পরেই শিয়ালদহ থেকে ট্রেন এসে যাবে। আমরা যদি এখনই স্টেশনে পৌঁছতে না পারি, আমাদের ট্রেনে চড়ার মজাটাই হবে না। বকুল-দি এসে গেছে কখন, আর কেউ আসবে বলে মনে হয়না।”
পিছনের উঠোনে কাপড় কেচে শুকোতে দেয়া হয়েছিল দড়ির উপর। বৃষ্টি আসার আগে মা কাপড়গুলো তুলে আনে, দিদি বোধহয় মাকে সাহায্য করছে কাপড়গুলো ভাজ করে গুছিয়ে রাখার জন্য।
দিদির আওয়াজ শুনতে পাই ভিতর থেকে, “ভাই, আজকে আমরা আর ট্রেনে চড়বো না। মনে আছে কালকে রতন কাকু আমাদেরকে ট্রেনে চড়তে না করেছে, বাবাকে বলে দেবে বলেছে যদি আমরা আবার ট্রেনে চড়ি। এখন কিছুদিন আমরা ট্রেনে চড়তে পারবো না। কিন্তু আজকে আমি তোকে একটা অন্য জায়গায় নিয়ে যাবো। তুইতো এখনো সব জায়গা দেখিসনি, একটু অপেক্ষা কর বকুল-দির সাথে।”
“জলি, কোথায় যাবি আজকে? বেশিদূরে যাস না, আবার বৃষ্টি আসতে পারে।” মায়ের গলা শুনতে পাই।
“না, না – আমরা বেশিদূর যাবো না। বড় বাজারটা ছাড়িয়ে কালীবাড়ির পিছনের রাস্তা ধরে আমরা ধানক্ষেত দেখে আসবো। পলাশ সবে এসেছে, ওকে একটু ঘুরিয়ে দেখিয়ে দি, আজ পল্লবকে নেবো না।”
আমি শৈশবে বারাসাতে আমার দাদুভাই, ঠাম্মা, দুই কাকা এবং দুই পিসিদের সাথে থাকতাম। যখন আনুমানিক চার বৎসর বয়স আমার, গেদেতে আমার বাবার কিছুদিনের জন্য বদলি হয়। গেদে ভারত-পূর্ব পাকিস্তানের (এখন বাংলাদেশ) শেষ বর্ডার স্টেশন। ঐসময় আমি কয়েক মাসের জন্য গেদেতে গিয়ে থাকি। আমার যতদূর মনে পড়ে – মা-বাবা-দিদি এবং ছোটভাই পল্লব এদের সাথে আমার জীবনের প্রথম সুদীর্ঘ জীবনযাপন গেদেতে একসঙ্গে, আমার জন্মের পর।
গেদে একটা ছোট্ট গ্রামঘেঁষা মফস্বল টাউন। খুব অল্প লোকের বাস। আমরা রেল কোয়ার্টারে থাকতাম, স্টেশন থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্ত্বে। আমার খুব পছন্দ ছিল এই রেল কলোনিটা – শান্ত, নিরিবিলি। দালান-কোঠা নেই বটে, কিন্তু ভারী গ্রাম্য ভারী আপন একটা ভাব ছিল। বেশ একখানা সবুজ মাঠ আছে পিছন দিকে, তার চারধারে মেলা গাছগাছালি। ভারী ঠান্ডা আর গভীর একটা মমতায় মাখানো যেন। বাজারের পাশে একটা কালীবাড়ি আর মনসাবাড়ি আছে, সাথে একটা বড় বটগাছ, তার নিচে একটা বাঁধানো গোল বসার জায়গা।
আমি যদিও খুব ছোট ছিলাম তখন, কিন্তু আমার স্মৃতিতে ছোট ছোট টুকরো অনেক ঘটনা গেঁথে আছে। মায়ের পাশে শুয়ে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া, রোববারে বাবার সাথে গিয়ে মাংস কেনা, দিদির সাথে গেদের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানো (যেমন পথের পাঁচালীতে দূর্গা আর অপু নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের অজানা অদেখা জায়গাগুলোতে চষে বেড়াতো), আমার একজন প্রিয় মানুষ আমাদের বড়মামীকে আবিষ্কার করা, আরোও কত টুকরো টুকরো স্মৃতি।
ছয় সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ এর প্রাক্কালে, তখন দুটো ট্রেন শিয়ালদহ থেকে গেদের উপর দিয়ে ইস্ট পাকিস্তান যেত। ইস্ট বেঙ্গল এক্সপ্রেস যেত গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত, আর ইস্ট বেঙ্গল মেইল পার্বতীপুর পর্যন্ত। গোয়ালন্দ ঘাট থেকে স্টিমারে করে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে ঢাকা যাওয়া যেত, আর পার্বতীপুর থেকে ট্রেন পাওয়া যেত ঢাকা যাওয়ার জন্য। তখন গেদে স্টেশনে কাস্টম কাগজপত্তর চেক হতো, আর ইস্ট পাকিস্তানের তরফে দর্শনা স্টেশনে। আর একটি ট্রেন বরিশাল এক্সপ্রেস চলতো তখন শিয়ালদহ থেকে খুলনা পর্যন্ত। এরপর এই ট্রেন গুলি বন্ধ হয়ে যায়, যখন ‘বাংলাদেশ’ আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে দাবির জন্য আন্দোলন শুরু হয়।
চৌদ্দ এপ্রিল (বাংলা নববর্ষর দিন) ২০০৮ সালে প্রায় ৪৪ বছর পরে আবার মাইত্রী (ফ্রেন্ডশিপ) এক্সপ্রেস চালু হয় কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত গেদের উপর দিয়ে।
ঐসময় রোজ বিকেলে একটা ট্রেন শিয়ালদহ থেকে গেদেতে আসতো, আর কয়েক ঘন্টা পর আবার শিয়ালদহ অভিমুখে যাত্রা করতো এবং তারজন্য ইঞ্জিনটা ট্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করে আবার উল্টোদিকে লাগানো হতো। প্রত্যেকদিন বিকালে দিদি, বকুল-দি, মানিক-দা এবং আরো অনেকে মিলে আমরা একসঙ্গে ঐসময় স্টেশনে যেতাম এবং যখন ইঞ্জিনটা ট্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হতো – আমরা লাস্ট কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়তাম। যখন ইঞ্জিনটা উল্টো দিকে লাগানো হতো ট্রেনের সাথে, একটা-দুটো-তিনটে ধাক্কা দিয়ে – আমাদের যে কি আনন্দ হতো, মুখগুলো সব আমাদের ঝলমল করে উঠতো। ছোটবেলার এই অনাবিল আনন্দ ট্রেনে চড়ার, লিখে বোঝাতে পারবো না। মাঝে মাঝে আমরা ধরা পড়ে যেতাম রতন কাকুর (স্টেশন মাস্টার) কাছে এবং ভয় দেখাতেন বাবাকে বোলে দেবেন বলে। আমরা কি আর ওনার কথা শুনতাম, দু-তিন দিন পর আবার আমরা লুকিয়ে ট্রেনে চড়তাম। কী করে আমরা আমাদের এই আনন্দ বিসর্জন দেবো !
মূল গপ্পো-টা
সেদিন বিকালে যখন আমি দিদি আর বকুল-দির সাথে বড়ো বাজারটা ছাড়িয়ে বড়ো রাস্তা ধরে তারপর একটা ছোট রাস্তা দিয়ে রেল লাইনে পৌঁছালাম, আমি একদম মুগ্ধ হয়ে চারিদিক দেখছি চোখ বড়োবড়ো করে। দিদিতো আগে আমাকে এখানে কোনোদিন নিয়ে আসেনি! রেল লাইনের দুধারে নারকেল, সুপারি, কলা আর নাম নাজানা কত যে গাছ। দিদির দিকে প্রশ্নভরা চোখে তাকাতে জানালো, এই রেল লাইনটা ইস্ট পাকিস্তান বর্ডার ফেন্সের দিকে গেছে, একটু পড়ে ফেন্স দেখা যাবে। কিন্তু মা তো আমাদেরকে মানা করেছে বর্ডার ফেন্সের দিকে যেতে। কিন্তু দিদি তো আছে সাথে, ভয় কী ! আমি যেমন অভিভূত হয়ে দুদিকের সৌন্দর্য দেখছি রেল লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দিদির হাত ধরে; আবার আকাশ জুড়ে ছাড়া ছাড়া মেঘ, সূর্যের দেখা নেই, একটু ভয় ভয় ও করছে, কিন্তু এ আনন্দ কী ছাড়া যায় !
প্রায় অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি, কিন্তু এখনোতো ফেন্স নজরে আসছে না। দিদিকে এবার বলেই ফেললাম, “দিদি, এবার ফিরে যাই। বাবা জানতে পারলে আমাদেরকে আর বাইরে ঘুরতে দেবে না।”
বকুল-দি বলে, “পলাশ, আর একটু পরেই আমরা ফেন্সের কাছে পৌঁছে যাবো। আমরা আমাদের বাড়ীতে কাউকে জানাবো না যে আমরা এদিকে এসেছিলাম।”
(পরে বড়ো হয়ে আমি জানতে পারি, ভারত-ইস্ট পাকিস্তান বর্ডার লাইনে বিতর্ক আর নানা ঘটনা বন্ধ করার জন্য বারো সেপ্টেম্বর ১৯৫৮-এ একটা নেহেরু-নুন এগ্রিমেন্ট হয় এবং ১৯৬০ সাল থেকে সমস্ত বর্ডার লাইনে কাঁটা তারের ফেন্স লাগানো চালু করা হয়। তাই গেদে থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে রেল লাইন বরাবর একটা কাঁটাতারের ফেন্স লাগানো হয়েছিল, পরে ১৯৬৫ সাল থেকে সমস্ত বর্ডার ফেন্সে আমাদের বিএসএফ মোতায়েন করা হয়। আমি যখনকার কথা বলছি ১৯৬৩ সালের, তখন ফেন্স লাগানো হয়েছিল কিন্তু ছিল অসম্পূর্ণ আর অরক্ষিত।)
কিছুক্ষন পরে যখন একটা ছেঁড়া কাঁটাতারের বেড়া প্রায় আমাদের নজরে আসছিলো, তখন একজন লোককে আমরা দেখতে পাই ঐদিক থেকে আসতে, হাতে মনে হলো একটা ব্যাগ জাতীয় কিছু। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনেই অন্যদিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করি। তখনিই শুনতে পাই, “এই, দাঁড়াও দাঁড়াও, যাইবা না।”
বুঝতে পারলাম আমরা ধরা পরে গিয়েছি, আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু দিদি তখনি বকুল-দিকে বললো, “আমার মনে হয় ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছে, দেখলি না ‘যাইবা’ বললো।”
আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমি তখনও ভয়ে দিদির হাত ধরে চোখ নিচু করে দিদির গায়ে সিঁটিয়ে আছি। শুনতে পেলাম লোকটা বলছে, “মা-জননীরা, তোমরা কী গেদে থিইক্যা আসতাছো?”
আমি তখন চোখ তুলে লোকটাকে দেখি, রোগ-পাতলা একজন মুখে দাড়িভর্তি, একটা নোংরা জামা আর ধুতি পরনে, হাতে একটা ছোট টিনের সুটকেস। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
দিদি বেশ স্মার্ট ছিলো আমার কাছে, বলে, “কাকু, আমরা গেদে থেকে এখানে ভাইকে ঘোরাতে নিয়ে এসেছিলাম। আমরা যখন ফেরত যাওয়ার জন্য তৈরি, তখন তুমি আমাদের দেখতে পাও। তোমার নাম কী, কাকু? তুমি কোথা থেকে আসছো?”
“আমি হইলাম বাবলু মন্ডল। রাজশাহী থিইক্যা আসতাছি। রানাঘাটে যামু। ভাইবলাম দর্শনা ইস্টিশানে রাইত পইর্যন্ত অপেক্ষা কইরা কী হইবো টেরেনের জইন্যা, তাই হাঁইটা আসতাছি , গেদে থিইক্যা টেরেন ধরবো বলিয়া।”
“কিন্তু কাকু, দর্শনা স্টেশন তো অনেক দূরে। তুমি সেখান থেকে হেঁটে আসছো।”
“তিন ঘন্টা থিইক্যা হাঁটতাছি।”
“একটু আমরা জোরে হাঁটলে, আমার মনে হয় তুমি ট্রেনটা ধরতে পারবে কাকু। কিন্তু তুমি রানাঘাট কেন যাচ্ছ, আমি ভাবলাম তুমি রাজশাহীতে থাকো তোমার পরিবার নিয়ে,” দিদি বলে।
“না মা-জননী, আমি আগে থাইকতাম নাটোরে – রাজশাহী থিইক্যা ২২/২৩ কিলোমিটার দূরে। মা, বৌ আর তিন বৎসরের পোলাকে লইয়া। রাজশাহী ইষ্টিশানের কাছে আমার একটা মাছ-ভাতের হোটেল আছিলো, ৪/৫ জন কর্মচারী সহ। আমার একটা নিজস্ব বাড়ি আছিলো, চার কামরা, রান্নাঘর, গোয়াল ঘরও আছিলো, এছাড়া একটা ছোট পুকুর, মাছ-ভাতের অভাব ছিলো না।”
“তাহলে কী হলো?” বকুল-দির প্রশ্ন।
“একটা লম্বা ঘটনা। আমি সব হারাইয়া ফেলিলাম দ্যাশ ভাগের সময়। তোমরা ছোট্ট পোলাপান, তোমাদের মন খারাপ কইরা দিতে চাই না।”
তখন দিদি বাবলু কাকুকে অনুরোধ করতে থাকে, “আমরা জানতে চাই বাবলু কাকু। আমার বাবাও ওনার বাবা, মা, ভাই-বোনদের সাথে কুমিল্লাতে ছিলেন, দেশ ভাগের এক বছর আগে আমাদের দাদুভাই এদেশে চলে আসেন বারাসাতে পোস্টিং নিয়ে, উনি পুলিশের দারোগা ছিলেন। জায়গা-জমি জলের দরে বেঁচে দাদুভাই ধীরে ধীরে বারাসাতে চলে আসেন সবাইকে এক এক করে নিয়ে এসে। আমাদের মায়ের বাবা, সুন্দরদাদু, ওনার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যশোরে থাকতেন ওনার ভাই এবং দাদার সাথে। বিরাট বড়ো বাড়ী ছিলো, জমি-জায়গা সমেত। একরাতে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ওনারা সব পালিয়ে আসেন বারাসাতে। এখনো আমার সুন্দরদাদু, দাদুমনি সবাই ভাড়া বাড়ীতে থাকেন। আমি এই দুঃখের ঘটনাগুলো বাবা, মা, দাদুদের থেকে শুনেছি। আমার ভাই যদিও ছোট্ট এসব বোঝার জন্য, কিন্তু তুমি তোমার দুঃখের ঘটনা আমাদেরকে বলতে পারো, আমি ভাইকে পরে বুঝিয়ে দেবো।”
আমি ছোট্ট বলে যদি বাবলু কাকু বলতে না চায় ওনার ঘটনা, তাহলে তো গল্পটা শোনা হবে না। আমি তখনি তাড়াতাড়ি বলি, “না দিদি, আমাকে দাদুভাই কিছু কিছু ঘটনা বলেছে যখন আমি ওনার সাথে সকালে বেড়াতে যেতাম। আমি সব বুঝতে পারি। বাবলু কাকু, তুমি বোলো।”
আমরা নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছি রেল লাইন ধরে, বাবলু কাকু কিছু বলছে না। আমি ভাবছি গল্পটা শোনা হবেতো, আর কিছুক্ষন পরে আমরা গেদে স্টেশনে পৌঁছে যাবো। আমি অস্থির হচ্ছি দেখে দিদি আমার হাত টিপে দিলো, যেন কিছু না বলি বাবলু কাকুকে।
একটু পরে বাবলু কাকু ভেজা ভেজা গলায় শুরু করলো বলতে, “দ্যাশ ভাগ ঘোষণা হইলো, তার কিছুদিন পরেই দেখতে পাইলাম অনেকেই একেএকে নাটোর ছাইড়া পশ্চিমবঙ্গের দিকে যাইতা শুরু করতাছে। বাড়ী, জমি পয়সাওয়ালা মুসলমানদের বিক্রি কইরা দিয়া ন্যায্য দামের থেইক্যা অনেক কমে। আমার হোটেল তখন চলতাছে রাজশাহীতে। আমি ভাইবলাম আমার হোটেলে সবই মুসলমান কর্মচারী, আমি পোলাপান থিইক্যা এইখানে বড়ো হইছি, আমার কইতো মুসলমান বন্ধু, আমার কী ভয়। কিন্তু কিছুদিন পর আইশ্চর্য্য হইয়া দেখি – কয়েকজন গোয়ারগোবিন্দ, কতিপয় আশাবাদী ও জনাকয়েক নিরুপায় লোক ছাইড়্যা সব্বাই একেএকে পশ্চিমবঙ্গের দিকে ছুটতাছে, তখন আমি ভয় পাইলাম। কী কইরবো ভাইব্যা কুল পাই না, একদিন সন্ধ্যায় আমার হোটেলের এক কর্মচারী রহিম শেখ আইস্যা আমাদিগো বইলো আইজ রাইতেই রাজশাহী ছাইড়্যা যাইতে হইবো। তাড়াতাড়ি কইরা কিছু সোনা, টাকা কোমরে গুঁজিয়া লইয়া, কয়েকটা কাপড়ের পুটুলি বাঁইধা লইয়া – মা, বৌটাকে বোরখা পড়াইয়া, নিজে এবং পোলাটাকে মুসলমান পোশাক পড়াইয়া আমরা রহিম শেখের লগে গভীর রাইতে পলাইলাম রাজশাহী অভিমুখে হাঁইটা। ভোর রাইতে রাজশাহী পৌঁছাইয়া একটি প্যাসেঞ্জার টেরেনে চড়িয়া বইসলাম। টেরেন যখন ছাড়ে তখন জানালা দিয়া দেখি আমাগোর হোটেলটা আগুনে জ্বলতাছে, দুই চক্ষুতে পানি আইস্যা গেলো। আমার মা, বৌ আর পোলাটাকে একজন মুসলমান পরিবারের কাছে লুকাইয়া রাখি; ওদের বলি নাই আমার হোটেলটার কথা। ভয়ে ভয়ে যশোহরে আসিয়া শুনি টেরেন আর যাইব না। হাঁটিয়া বেনাপোল চেক পোস্ট দিয়া বর্ডার ক্যাম্পে আইসা উঠি। দুদিন পর জানাইলো আমাদিগো বেলিয়াঘাটা রিফুউজি ক্যাম্পে যাইতে হইবো। ছিলাম ওখানে কয়েক মাইস, কী কষ্ট বইল্যা বোঝাইতে পারুম না। মা, পোলাটার পেট খারাপ হইয়া গেল। ক্যাম্পের বাইরে একদিন একজনের সাইত্থে পরিচয় হইলো, রানাঘাটে ওনার বন্ধুর একটা হোটেল আছে ইস্টিশানের পাশে, গিয়া দেখা করিলাম। শুরুতে যোগালির কাইজ, এখন ম্যানেজার কইরা দিছে, আমিই হোটেলটা সামলাই এখন। আইজ প্রায় পনেরো বৎসর হইয়া গেলো রানাঘাটে। মা আজ আর বাঁইচা নাই। পোলাটা এখন ইস্কুল পাশ দিয়া কলেজে ভরতি হইবো।”
আমি যদিও সব কথা বুঝতে পারছিলাম না, দেখলাম দিদি আর বকুল-দির মুখ বেদনায় ভরা। আমি ভাবছি বকুল কাকু তো এখন রানাঘাটে হোটেলে কাজ করছে, ছেলে পড়াশোনা করছে, তাহলে তো এতো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কাকুর ভিতরের কষ্ট না বুঝেই আমি প্রশ্ন করি, “তোমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে কেন কাকু? হ্যা তোমার মা নেই বুঝতে পারছি, কিন্তু তুমি এখন হোটেলে কাজ করছো, রানাঘাটে আছো; তাহলে কিসের কষ্ট এখন।”
“বাবাজীবন, আমাগো নিজস্ব বাড়ি আছিলো, হোটেল আছিলো; এখন আমাগো কিছু নাই। এইসব কিছু বিনা দোষে পরিত্যাগ কইরা আমি চইলা আসতে বাধ্য হইলাম, ক্যান? আমাগো এখানে ‘বাঙাল’ বলিয়া এখনো ডাকে। এই দ্যাশ ভাগের কারণে আমরা হারাইয়াছি আমাগো দ্যাশ, এপারে আমাগো পরিচয় বাঙাল-রিফুউজি-বহিরাগত। আমাগো মতো রিফুউজিদের জোর কইরা দন্ডকের জঙ্গলে পাঠাইতাছে, এটা কী ঠিক হইতাছে? আমাগো যাইতে হইবো দণ্ডকারণে, ক্যান? আইজ দ্যাশ স্বাধীন হইয়াছে, কিন্তু আমরা দ্যাশ হারাইয়াছি। এই অদ্ভুত ঘটনাটাই আইজ আমাগোর বর্তমান ভবিষৎ ঠিক কইরা দিতাছে। বাবাজীবন তুমি এখন পোলাপান, এখন আমাগো কষ্ট বুইঝতা পারিবা না, বড় হও সব বুঝিবা।”
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। চুপ করে থাকা ঠিক হবে মনে হলো, দিদির থেকে পরে বুঝে নেবো।
কিছুক্ষন পরে বাবলু কাকু আবার বলা শুরে করে, “আমি আগে কয়েকবার রাজশাহী গেছিলাম, আমাগো বাড়িতে রহিম শেখ পরিবার লইয়া ছিল। রহিম শেখ জানায়, যদি কোনোদিন ফিরতা পারি বাড়ি আমারি থাইকবো। কিন্তু এইবার গিয়া অবাক হইয়া দেখি আমাগো বাড়ি আইয়ুব খানের লোক দখল কইরা লইছে। রহিম শেখ জানাইলো জোর কইরা আইয়ুব খানের সেনারা বাড়ি দখল কইরা লয় একদিন হটাৎ করিয়া। দৌড়াদৌড়ি কইরা কোনো লাভ হইলো না। বাড়ির সব কাগজপত্তর সেনারা নষ্ট কইরা ফেলাইয়াছে। আমার এক বোন আছিলো, বিয়া দিছিলাম চাপাই নবাবগঞ্জে। ভূষিমাল আর মাছের আড়তের ব্যবসা আছিলো। জানিনা বোন কোথায়, বাঁইচা আছে কিনা তাও জানি না। গিয়া খোঁজ নিছিলাম, বাড়ি পুড়াইয়া দিয়াছে, কেউ কিছু কইতে পারে না, সব রিফুউজি ক্যাম্পে খোঁজ লইলাম, শিয়ালদহ ইস্টিশানে গিয়া খুঁইজ্লাম, সব বৃথা।”
আমি দেখি, বাবলু কাকুর চোখ থেকে জল পড়ছে। একটু একটু বুঝতে পারলাম ওনার দুঃক্ষ, কষ্ট। আমরা ততক্ষনে গেদে স্টেশনে পৌঁছে গেছি। ট্রেনের ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। আকাশে তখন বেশ কালো করে মেঘ করেছে, বৃষ্টি এলো বলে। বিদায় নেয়ার সময়, কাকু আমাদেরকে বলে, “তোমরা খুব ভালো, কষ্ট পাইও না আমার কথায়। ভালো কইরা মানুষ হইবা, মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করিবা। আমি আশীর্বাদ করতাছি। বাবাজীবন আমি জানি তুমি এখন কিছু বোঝো নাই, কিন্তু আমি জানি তুমি বড় হইয়া আজকের দিনটা মনে করবা একদিন।”
আমি আর আমার চোখের জল আটকে রাখতে পারি না। কাকু তখন আমাকে জড়িয়ে বুকে তুলে নেয়। তখন বৃষ্টির দু-এক ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। কাকু তাড়াতাড়ি আমাকে কোল থেকে নামিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলে। আমরা একেএকে কাকুকে প্রণাম করে বিদায় নি।
আমরা বাড়ির দিকে দৌড়তে শুরু করি, বৃষ্টি জোরে শুরু হয়ে গেছে। বাড়ি যখন পৌঁছাই, জামাকাপড় পুরো ভিজে গেছে, অন্ধকার হয়ে গেছে, জানি আজকে কপালে অনেক বকা আছে। এরমধ্যে দিদি আমাকে বারবার বলে দিয়েছে আমি যেন মাকে কিছু না জানাই, যা বলার দিদি বলবে। দেখি দরজায় হাত দিয়ে মা দাঁড়িয়ে আছে একরাশ চিন্তা নিয়ে মুখে। আমি দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ি জামাকাপড় ছাড়ার জন্য। ভাসা ভাসা শুনতে পাই, দিদি মাকে বোঝাচ্ছে – আমরা বুঝতে পারিনি এতো দেরী হয়ে যাবে ধানক্ষেত দেখতে গিয়ে, আর কোনোদিন এরকম দেরী হবে না। বুঝলাম দিদি কিছু মিথ্যে কথা বলে মাকে ম্যানেজ করে নিয়েছে। আমাদের ভাগ্য ভালো, বাবা তখনও অফিস থেকে ফেরেনি। না জানি, তাহলে কী হতো, দিদিকে আরো কষ্ট করতে হতো বাবাকে বোঝানোর জন্য।
শেষটুকু
সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবার্ষিকেতে যখন টিভিতে ‘পথের পাঁচালি’ পুনঃপ্রদর্শিত হয়, সিনেমাটা আবার দেখতে দেখতে নিজেকে যেন ফিরে পাই গেদেতে – আমরা দুই ভাইবোন হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলেছি রেল লাইন ধরে, একরাশ বিস্ময় ভরা দুই চোখ নিয়ে। কয়েক মাস আগে ‘পথের পাঁচালি’ এবং ‘অপরাজিত’ আবার পড়লেও – সিনেমাটা দেখার পর পুনরায় ইচ্ছা করে ‘পথের পাঁচালি’ পড়ার, বাধ্য করে বারবার একটা অনুচ্ছেদ পড়তে।
দূর্গা অপুকে বলে – চল, আমরা আজকে রেল লাইন দেখে আসি। কিন্তু দুর্গাও জানে না কতদূর রেল লাইন, শুধু জানে নবাবগঞ্জের বড় রাস্তা পেরিয়ে গেলে নিশ্চয় রেল লাইনের দেখা পাবে। দূর্গার বহুদিনের ইচ্ছা রেল লাইন দেখার। দুজনে নবাবগঞ্জের সড়কে উঠে চেয়ে দেখলো সামনে, অপুর দিদি বলে – বড্ডো অনেক দূর, না? যাওয়া যাবে না। অতদূর গেলে ফেরত আসবো কী করে? হঠাৎ দূর্গা মরীয়া ভাবে বলে – চল, দেখে আসি অপু – কতদূর আর হবে? মাকে বলবো বাছুর খুঁজতে দেরী হয়ে গেলো ——-
দুই ভাই-বোনে মাঠ বিল জলা ভেঙে ছুটলো। দৌড়, দৌড়, দৌড় – পিছনে তাকিয়ে দেখলো নবাবগঞ্জের রাস্তা অনেক পিছনে। আবার দৌড়, দৌড়, দৌড় – জীবনে এই প্রথম বাধাহীন, গন্ডিহীন, মুক্তির উল্লাসে তাদের কচি মন মেতে উঠেছিল – পরে কী হবে, তা ভাবার অবসর কোথায়?
(‘পথের পাঁচালি’-র এই অংশটা পড়লেই কেন জানি না মন চনমন করে ওঠে, যেন শৈশবে ফিরে যেতে চায়)
কিন্তু কিছুদূর গিয়ে দূর্গা পথ হারিয়ে ফেলে। বহু কষ্টে নানা জায়গা ঘুরে কোনোরকমে তারা আবার বড় রাস্তায় এসে উঠলো। কিন্তু দূর্গার আর রেল লাইন দেখার ইচ্ছেটা অতৃপ্তই থেকে গেলো।
(যদিও সত্যজিৎ রায় ওনার ছবিতে দূর্গার এই ইচ্ছেটা পূর্ণ কোরে দিয়েছেন)
বাড়ি এসে অপুর দিদি ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথা বোলে তবে তার নিজের ও অপুর পিঠ বাঁচায়।
আমি যখন উক্ত বাক্যটি পড়ি, আমার মনে পড়ে যায় আমাদের সেই অভিযান দিদির সাথে গেদেতে রেল লাইন ধরে বর্ডার ফেন্স দেখতে যাওয়া – দিদির বারবার বারণ মাকে যেন কিছু না জানাই আমি – বাড়ি ফিরে দিদির মাকে কিছু মিথ্যা কথা বোলে মায়ের বকুনি এড়ানো।
ভাবতে থাকি এতদিন ধরে লুকিয়ে রেখেছিলাম আমার হৃদয়ে, একটা না চাইতেই পাওয়ার আনন্দ – যেমন একটা মুক্তোদানা লুকিয়ে থাকে ঝিনুকের মধ্যে।
ফটো : গুগুলের সৌজন্যে
‘শেষটুকু’ র কয়েকটা লাইন বিভূতিভূষণ মহাশয়ের ‘পথের পাঁচালি’ থেকে নেওয়া
আমি ‘বাঙাল’ ভাষা জানি না। চেষ্টা করেছি, ভুলত্রুটি গুলো মার্জনা করে দেবেন।