কোড নেম প্রমিথিউস

“হ্যাঁ, পুলিশ খানিকটা জোর করেই শুরু করেছিল। আসলে মিঃ সেন প্রথমটা চাইছিলেন না পুলিশ তদন্ত হোক। উনি বলছিলেন, হয়ত মেয়েটা প্র্যাঙ্ক করছে, কোনও বন্ধুর বাড়িতে গিয়েই বসে আছে। এক দুদিন কাটিয়েই বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু, পুলিশ তো ওসব শুনবে না, তাই তারা নিজেরাই তদন্ত শুরু করে। আমরাও অবাক হয়েছিলাম, ওনার এই প্রথমে না না করা নিয়ে। পরে ভাবলাম, হয়ত, মানসিক সুস্থিতি ছিল না বলেই হয়ত ওরকম করছিলেন।“

“আর এখন? এখন উনি কেমন আছেন?”

“খুব ভাল নেই। সম্প্রতি হাইপারটেনশন ধরেছে ওনাকে, তাই আমরাও খানিকটা চিন্তিত। এই বয়সে এত বেশি চিন্তা, ওনার শরীরের পক্ষে খারাপই।“ ক্রিস ভ্রূ কুঁচকে কথাটা বলে।

অ্যাথেন্সের হাইওয়েগুলো চমৎকার, তা বলতেই হয়। গাড়ি আশির ওপর স্পিডে চলছে, তবু কোথাও কোনও অ্যাকসিডেন্ট হবার ভয় নেই। আমাদের দেশে সাইড নেবার বা ওভারটেক করার জন্য ড্রাইভারগুলো যে অকারনে হর্ন বাজিয়ে সময়টা নষ্ট করে, এখানে তার বিন্দুমাত্রও চোখে পড়ল না। সবাই নিঃশব্দে গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়িতে আসতে আসতে ভাবছিলাম যে দেশে এসেছি, তার কথা, গ্রিসের কথা।

বর্তমান গ্রিকদের পূর্বপুরুষ হচ্ছে এক সময়ের পৃথিবী বিজয়ী প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা, বাইজানটাইন সাম্রাজ্য এবং প্রায় ৪ শতাব্দীর অটোমান সাম্রাজ্য। গ্রিস সেই দেশ, যা প্রথম বিশ্বের সমস্ত জ্ঞানবিজ্ঞানের আঁতুড়ঘর এবং প্রথম গণতন্ত্রের সূচনাও এখানে। গ্রিসের কম অবদান নেই, আজকের এই মানবসভ্যতা গড়ে তোলার জন্য।  দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাসচর্চা, নাটক, অলিম্পিক গেমস, গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, রাজনীতি এবং জিওমেট্রি… কি দেয়নি গ্রিস? অ্যারিস্টটল, সক্রেটিস, প্লেটো, হেরোডোটাসের গ্রিস… সেই গ্রিসের মাটিতে আজ দাঁড়িয়ে আমরা। ভাবতে ভাবতে মশগুলও হয়ে গিয়েছিলাম।

মিনিট ত্রিশের বেশি লাগল না, গাড়ি এসে দাঁড়াল স্যারের বাগানবাড়ির সামনে।

সুন্দর সুন্দর লাল, হলুদ ফুলের বাগানে ভর্তি চারদিক। মাঝে মধ্যেই বড় বড় সাইপ্রাস আর সিডার গাছ। যেহেতু পার্বত্য এলাকা, তাই মাটিটা অল্প পাথুরে। মৃদুমন্দ বাতাসে গাছের পাতাগুলো সরসর করে নড়ছে।

দুপুরের এই মৃদু বাতাস বেশ ভালই লাগত, যদি না এই খারাপ খবরগুলো আগে শুনতাম। সত্যি তো, আমরা স্যার স্যার করে পাগল, অথচ একটিবারের জন্যও স্যার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে কি বিশাল ঝড় লুকিয়ে রেখে আমাদের সামনে হাসতেন, সেটা জানার চেষ্টা করিনি। সত্যি, নিজের ওপর তখন খুব রাগ হচ্ছিল। কত কষ্ট, দুঃখ পেলে মানুষ এত সুন্দর, এত মনোরম একটা জায়গাকে ফেলে চলে আসতে পারে, সেটা বুঝতে পারছিলাম।

আমরা গাড়ি থেকে নামতে নামতেই দেখলাম, স্যার নিজেই চলে এসেছেন গাড়ির সামনে। আমরা ওনাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করতেই আমাদেরকে জড়িয়ে ধরলেন।

কালের নিয়মে সময় হয়ত অনেক বয়ে গিয়েছে, কিন্তু স্যার একই থেকে গিয়েছেন। কালো মোটা ফ্রেমের চশমার পেছন থেকে উজ্জ্বল চোখদুটো ওনার বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয় দিচ্ছিল। চুলে অল্প পাক ধরেছে রগের কাছে, মুখে অল্প বলিরেখা এসেছে, তবু সেই হাসিটা অমলিন এখনও। আমাদেরকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, “ওয়েলকাম টু গ্রিস। আসতে কোনও কষ্ট হয়নি তো?”

আমরা সমস্বরে “না, স্যার।“ বলতেই স্যার হাসলেন। তারপর বললেন, “যেটা দেখছ, সেটা আসলে আমার টেম্পোরারি এমব্যাসি এই দেশে। ক্রিসের বাবা জুলিয়াসই প্রথম এই বাড়িটার খোঁজ দিয়েছিল। আজ থেকে বিশ একুশ বছর আগে তখন বাড়ীটা জলের দরে কিনে নিয়েছিলাম। সুন্দর, তাই না? এখান থেকে ঢিল ছুঁড়লেই বোধহয় ইজিয়ান সাগরে গিয়ে পড়বে।“

আমরা চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। চারদিকে পাহাড়ের সারি, সবুজ আর বাদামিতে ঢেকে রয়েছে সেইগুলো। আকাশে মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলো হয়ে।

স্যার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, “এই দেখ, আমারই দোষ। তোমরা এত লম্বা একটা ট্রিপ দিয়ে এলে এই দেশে, আর কিনা আমি তোমাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছি গেটে। এস এস, আগে রেস্ট নাও। তারপরের কাজ তারপর। ঝিনুককে পরেও খুঁজে বের করা যাবে। তোমরা আগে রেস্ট নাও।“

সত্যিই তখন পা চলছিল না। ভদ্রতার খাতিরে সমুদ্র না, না করার একটা চেষ্টা করেছিল, কিন্তু স্যার শুনলেনই না। একরকম জোর করেই নিয়ে গেলেন আমাদের। বাগানবাড়ির পাশেই আউটহাউসটাতে আমাদের জায়গা হল। আমি আর সমুদ্র একটা ঘরে, বর্ণালী পাশের ঘরটায়।  আউটহাউসটা আকারে এতটাই বড়, যে ওতে স্বচ্ছন্দে দশ-পনেরোজন মানুষের জায়গা হয়ে যাবে হেসে খেলে।

নরম বিছানায় মাথা পড়তেই আর কোনও চিন্তা মাথায় এল না। সারাদিনের প্লেন জার্নির সমস্ত ক্লান্তি একসাথে নেমে এল চোখে।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম, ঠিক ছিল না, কিন্তু হঠাৎ করেই কানের কাছে একটা খোঁচা খেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। দেখি, সমুদ্র টোকা মেরে মুচকি মুচকি হাসছে।

“কি রে, কি হয়েছে? দুম করে ঘুম ভাঙ্গালি কেন?” আমি রেগে গিয়েই জানতে চাইলাম।

“ভাঙ্গাব না? কি করতে এদেশে এসেছিস? কটা বাজে, খেয়াল আছে?”

“কেন? কটা বাজে?” আমি ঘুমচোখেই জানতে চাইলাম।

“প্লেন ধরেছিস দুপুর দুটোয়, এখানে পৌঁছেছিস সকাল সাড়ে আটটায়। এখন ভারতীয় সময় অনুযায়ী বিকেল পাঁচটা পনেরো। গ্রিসের সময় অনুযায়ী কত হিসাব করতে হবে।“ সমুদ্র আঙুল গুনতে গুনতে বলল।“ কিরে কুম্ভকর্ণ, ঘর থেকে বেরোবি না নাকি? নাকি ক্রিসকে ডেকে আনতে হবে তোকে তোলার জন্য?”

মাথাটা ধরে গিয়েছিল অল্প। উঠে বসলাম একটা হাই তুলে। সত্যি এই জেটল্যাগ একটা বড় সমস্যা।

এসব ভাবতে না ভাবতেই সামনে ক্রিসের লম্বা চেহারাটা এসে দাঁড়াল। ক্রিস? ক্রিস এল কোথা থেকে এর মধ্যে?

আমার মুখ দেখেই হয়ত সে আমার প্রশ্নটা বুঝতে পেরেছিল, তাই সে হেসে বলল, “গুড আফটারনুন, মিঃ চৌধুরী। আশা করি জেটল্যাগ কেটে গিয়েছে। আমি আসলে এই করিডর বরাবর গেলে তিন নম্বর ঘর যেটা আছে, ওখানেই থাকি। বাবা আর আমি এই আউটহাউসেই থাকি।“

দেখলাম, ক্রিসের হাতে, দু প্লেট খাবার। আলুভাজার মত দেখতে, সাথে সস। জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, ক্রিস, এটা কি আজকের লাঞ্চ?”

ক্রিস মাথা নেড়ে বলল। “গ্রিসের স্পেশাল ডিশ। ফ্রায়েড জুকিনি আর অ্যাভিওলি সস। এইমাত্র বানিয়ে আনলাম। খেয়ে দেখুন, দুর্দান্ত লাগবে। সাথে মুসাকাও আনছি, দাঁড়ান। মিস ব্যানার্জি এলে আমাকে একবার বলবেন, সার্ভ করে দেব। আপাতত আপনারা খান।“

আমি আর সমুদ্র মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। মুসাকা? সেটা কি? যতদূর জানতাম, কলার বিজ্ঞানসম্মত নাম মুসাকা। তবে কি ও কলা আনতে যাচ্ছে?

জিজ্ঞেস করতে ক্রিস হেসেই ফেলল। তারপর বলল, “সত্যি, আপনারা পারেনও বটে। না, এটা কলা নয়। মুসাকা আসলে একটা মাটির হাঁড়িতে বেকড করে বানানো একটা ডিশ। ভেতরে কুচো করে মাংস, আলু আর জুকিনি দেওয়া। ওপরে মোটা চিজ দেওয়া। খেয়েই দেখুন না।“

ক্রিসের কথায় খেয়ে দেখলাম। জুকিনিটা খানিকটা ঝিঙের মত লাগল খেতে। আর অ্যাভিওলি সসটা পুরো মেয়োনিজের মত খেতে লাগল। তবে সবথেকে ভাল লাগল মুসাকা। সত্যি, অপূর্ব খেতে।

খেতে ঝেতেই সমুদ্র কি একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ক্রিস, তুমি বলছিলে, তোমার বাবা এখানেই, মানে আউটহাউসে থাকেন। তো, ওনার সাথে কি এখন দেখা করা যাবে?”

ক্রিস উৎফুল্ল হয়ে বলল, “হ্যাঁ, কেন নয়। আসুন না। আচ্ছা, ভাল কথা, মিস ব্যানার্জির পার্সটা নিয়ে এখনও কোন খবর পাইনি। পেলে নিশ্চয়ই জানিয়ে দেব। মিঃ সেনের সাথে পুলিশের ভালই যোগাযোগ আছে, কাজেই আশা করি সেটা পেতে খুব অসুবিধা হবে না।“

 

~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ৩) ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ২)
Next articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ৪)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments