কোড নেম প্রমিথিউস

“ওর বাড়িতে বলে রাজি করাতে হবে। তোর সাথে একা ছাড়বে বলে তো মনে হয় না।“ আমি হাসতে হাসতে বললাম। জানতাম, এই ডেলিভারিটা সামলানো ওর পক্ষে শক্ত হবে। হলও তাই।

“ও হ্যাঁ। তাও তো বটে… আরে, সেইজন্য তো তুই আছিস। একটু ম্যানেজ করিয়ে দে না বাবা।“ সমুদ্র কাতর অনুরোধ করা শুরু করল। “কাকু আর ওর বাবা তো এক অফিসে চাকরি করে, দেখনা বলে যদি রাজি করানো যায়।“

আমি মনে মনে মুচকি হাসলাম। পরে এই বাবদ সমুদ্রের ঘাড় ভেঙে বেশ কয়েকটা সিনেমা দেখার সুযোগ মিলবে, বুঝে গেলাম।

তারপরের দুই সপ্তাহের বর্ণনা আর দিলাম না, বললে মহাভারত হয়ে যাবে। শেষমেশ কালকে বেরিয়ে তিনজনে ট্যাক্সি ধরে হাজির হলাম দমদমে। কাতার এয়ারওয়েজের সাদার ওপর লালে লেখা প্লেনটা যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। বলা বাহুল্য, স্যার আমাদের প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর আমাদের পাসপোর্ট ছিলই আগে থেকে। তাই ভিসাতেও সেরকম ঝামেলা হল না, স্পেশাল পারমিশনের জন্য।

প্লেনটা দাঁড়িয়েছিল মাঝখানে হামাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। একটাই স্টপ মাঝখানে। তারপর প্লেনটা যখন গ্রিসের কাছাকাছি চলে এসেছে, আকাশে থেকেই দেখছিলাম, গ্রিসের সৌন্দর্যটা। রীতিমত অপূর্ব দ্বীপরাষ্ট্র একটা। তিন হাজারের ওপরে দ্বীপ শুধু। মাঝখানে ইজিয়ান সাগর। অপূর্ব। মুখ থেকে শুধু এই একটা কথাই বেরিয়ে আসে।

আলাদা একটা রোমাঞ্চ লাগছিল। প্রথম আধুনিক সভ্যতার জন্ম বোধ করি গ্রিস আর রোম থেকেই। আর সেদেশেই আমরা চলেছি, একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে।

যাই হোক, লাউঞ্জে ঢুকতেই দেখি, এক সোনালি চুল, অলিভ রঙের এক দীর্ঘদেহী সুদর্শন যুবক আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন হাতে লেখা লাল প্ল্যাকার্ড হাতে, “সমুদ্র বিশ্বাস” বলে। বুঝলাম, উনিই আমাদের রিসিভ করতে এসেছেন। সমুদ্র হাতটা বাড়াল করমর্দনের জন্য। যুবক প্রত্যুত্তরে পাল্টা করমর্দন করল। তারপর স্পষ্ট ইংরাজিতে জিজ্ঞাসা করল, “আপনারাই কি সমুদ্র বিশ্বাস এবং তাদের বন্ধু?”

“হ্যাঁ।“ সমুদ্র উত্তর দেয়। “এনারা আমার বন্ধু, অয়ন চৌধুরী, আর বর্ণালী ব্যানার্জি।“

“আসুন। মিঃ সেন আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন। এখান থেকে মোটামুটি চল্লিশ কিলোমিটার দূরে ওনার বাগান বাড়ি, ওখানেই আপনাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আপনাদের আর কষ্ট করে হোটেলে যেতে হবে না।“ যুবক হেসে বলে, “আমার নাম ক্রিস্টোফার, আপনারা আমাকে ক্রিস বলেও ডাকতে পারেন।“

আমি হেসে জিজ্ঞাসা করি, “আচ্ছা ক্রিস, কিছু মনে কর না, তোমার বয়স কত?”

ক্রিস পাল্টা হেসে উত্তর দেয়, “এবছর তেইশে পড়ব।“

বুঝলাম, ক্রিস আমাদেরই সমবয়সী। আমি তখন অন্য প্রসঙ্গে গেলাম, “আচ্ছা ক্রিস, মিঃ সেনের তুমি কি কাজ কর?”

ক্রিস উত্তর দেয়, “বলতে পারেন, আমি ওনার হেল্পিং হ্যান্ড। আসলে, বাবাই মিঃ সেনের সেক্রেটারি ছিলেন, কিন্তু গত বছর থেকে পার্কিনসন রোগ ধরা পড়ার পর একদম কাজ করতে পারেন না। ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়েছি, বাবাই আমার সব বলতে পারেন। তাই আমিই এখন ঐ কাজটা করি। এমনিতে আমি আর্টসে গ্র্যাজুয়েট। পার্টটাইম গাইডের কাজও করি এখানে ওখানে।“

ক্রিসের কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, যাক, এই ভিনদেশে অন্তত রাস্তা হারানোর ভয়টা আর থাকল না আমাদের। কিন্তু, স্যারের এখানে বাগানবাড়ি আছে? স্যার তাহলে এখানে কতদিন হল বাস করছেন?

বর্ণালীই প্রশ্নটা করল, “আচ্ছা ক্রিস, মিঃ সেন কি বরাবরই এখানে থাকতেন?”

ক্রিস খানিক ভেবে বলল, “না। আসলে বাবার মুখে শুনেছি, এখানে মিঃ সেন এককালে একটা বাগানবাড়ি কিনেছিলেন। তখন এখানেই উনি পড়াতেন ইউনিভার্সিটিতে। বাগানবাড়ীটা থাকা আর গবেষণার জন্যই কেনা। তারপর উনি বিয়ে করেন। একটি মেয়েও হয়। কিন্তু, তারপরই ওনার জীবনে একটা বড় ট্র্যাজেডি নেমে আসে।“

ক্রিস থেমে যায়। আমরা সমস্বরে জিজ্ঞেস করি, “কি ট্র্যাজেডি, ক্রিস?”

ক্রিস খানিকটা দ্বিধায় পড়েছে, সেটা ওর মুখচোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হয়ত ঘরের কথা বাইরের তিনজনকে বলে ফেলেছে বলেই তার এই অস্বস্তি।  তাই সমুদ্র ক্রিসের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, “খুব গোপন কথা কি? তাহলে বলার দরকার নেই।“

ক্রিস তাড়াতাড়ি বলে , “না না, গোপন করার কিছু নয়। আসলে বাবার মুখে শুনেছি, ওনার মেয়ের যখন দুইমাস বয়স, তখন কি এক অ্যাকসিডেন্টে মেয়েটা মারা যায়। ওনার স্ত্রী এই আঘাত সহ্য করতে পারেননি। উনিও মাসখানেকের মধ্যেই মারা যান। তারপর মিঃ সেন একজন মেয়েকে দত্তক নেন। বছর ছয়েক এখানে মেয়ের সাথে ছিলেনও। কিন্তু, এখানকার স্মৃতি বোধহয় ওনাকে খুব কষ্ট দিত। তাই বছরে একবারই আসতেন এখানে। আমার বাবা তখন এই বাড়ি পাহারা দিত, কেয়ারটেকারের কাজ করত। আর যে মেয়েটাকে উনি দত্তক নিয়েছিলেন, সে এখানে বোর্ডিং স্কুলে পড়ত। এখন তার বয়স ২০। কিন্তু…“ ক্রিস একবার আমাদের সবার মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নেয়, “আপনারা কি সেই ব্যাপারেই এসেছেন?”

আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। স্যার একটা বিপদে পড়েছেন বলেছিলেন, কিন্তু কি সেই বিপদ, সেটা আর খুলে বলেননি। আমিই তাই শেষমেশ বললাম, “না তো ক্রিস, এব্যাপারে স্যার আমাদের কিছু বলেননি। কেন, কিছু হয়েছে? স্যারের মেয়ে কি এখন ওনার সাথে থাকে না?”

“সেটা নয়, মিঃ চৌধুরী।“ ক্রিস বিষণ্ণ হয়ে জবাব দেয়, “আসলে মিঃ সেনের মেয়ে গত দু সপ্তাহ ধরেই নিখোঁজ। আরও ভাল করে বললে, কিডন্যাপড।“

ধাক্কাটা জোরে লাগে। স্যারের মেয়ে নিখোঁজ?

“নিখোঁজ? মানে সিরিয়াসলি খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না?” সমুদ্র জিজ্ঞেস করে।

“হ্যাঁ, সত্যিই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।“ ক্রিস মাথা নাড়তে নাড়তে বলে। আমরা ততক্ষণে পার্কিং লটে ঢুকছি। সামনেই একটা কালো রঙের সেডান দাঁড়িয়ে। ক্রিস পকেট থেকে চাবিটা বার করে ইলেকট্রনিক কি টিপতেই দুবার আলো জ্বলল ইনডিকেটরের। তারপরই গাড়ির দরজা খুলে গেল।

“কতদিন হয়েছে এটা বললে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

ক্রিস গাড়িতে স্টার্ট দিল। গাড়িটা বার করে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে বেরোল রাস্তায়। তারপর মুখ খুলল, “পনেরো দিন, সঠিক ভাবে বললে। সেদিন মিস সেন বাড়িতেই ছিলেন, কি একটা কারনে আর্টস কলেজে ক্লাস হয়নি বলে। তারপর বিকেলের দিকে একটা কল আসে বাড়িতে। মিঃ সেন তখন কি একটা কাজে গিয়েছিলেন সি বিচের দিকে। মিস সেন কলটা ধরেন। ওপাশ থেকে ওনাকে কেউ বলেছিল, যে মিঃ সেনের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে উনি বেরিয়ে যান, আর আমাকে লোকাল পুলিশে ইনফর্ম করতে বলেন। আমি লোকাল পুলিশে জানিয়ে গাড়িটা নিয়ে ওনার খোঁজে বেরব ভাবছি, দেখি মিঃ সেন অক্ষত বাড়ি ঢুকছেন, অথচ মিস সেন নেই। পরে ওনার ফোনে অনেকবার কল করা হয়েছে, বারবারই সুইচ অফ আসছে। পরে কলটা ট্রেস করতে গিয়ে জানা যায়, লোকাল এসটিডি বুথ থেকে করা কল। ট্রেস করা যায়নি, কে কলটা করেছিল, এমনিও যা ভিড়ের সময় এখন, এত ভিড়ে মানুষের মুখ মনে রাখাও দুষ্কর।“ ক্রিস স্বগতোক্তি করে।

গাড়িটা ততক্ষণে শহরের ব্যস্ত রাস্তা ছাপিয়ে এগোচ্ছে ক্রমশ বিচের দিকে, কারন সমুদ্রের নোনা হাওয়া নাকে আসছিল। চারদিকে মাইলের পর মাইল সবুজ জমি, আর দূরে পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে সময়ের দ্বাররক্ষক হয়ে।

সমুদ্র তখন জিজ্ঞেস করে, “ পুলিশ এনকোয়ারি হয়েছিল?”

 

~ কোড নেম: প্রমিথিউস ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১)
Next articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ৩)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments