কয়েকটা দিন যেন ঝড় বয়ে গেল শরীরের উপর দিয়ে।

স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল অনিমেষ। হস্টেলের পাঁচিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। এক হাতে আলগোছে ধরা সিগারেট। সেটায় প্রাণ ভরে একটা টান দিয়ে নিল।

বিজয় একমনে বিকেলের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বিশেষ কিছু বলছে না। শুধু মাঝে মধ্যে মন দিয়ে টান দিচ্ছে সিগারেটে। শুধুমাত্র সেই সময়টুকুই সে চোখ সরাচ্ছে আকাশ থেকে।

তার মুখ থেকে শুধু একটা সম্মতিসূচক ‘হু’ বেরুল।

ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। আজকে পেডিয়াট্রিক্স এর ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা ছিল। অন্যদিনের তুলনায় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে। সকলেই খুব ক্লান্ত পরীক্ষা দিয়ে। কিন্তু কারুরই ঘুম আসছে না।

অনিমেষ একবার ঝুঁকে নিচে দেখল।

দশ বারোজনের একটা দল ক্রিকেট খেলছে। হস্টেলের সামনে চাতালে। তিনটে ছেলে বেশ সাজগোজ করে বেরোল হস্টেল থেকে।

-সব সিনেমা দেখতে যাচ্ছে।

সে জানাল।

বিজয় তাকাল না সেদিকে। কয়েকটা পাখি লালচে সূর্যের উপর দিয়ে উড়ে গেল। সেদিকে চেয়ে আছে সে।

অনিমেষ সিগারেটের ছাই ঝেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে বলল, ভয় লাগছে, মেডিসিনটায় না ফেল করিয়ে দেয়।

বিজয় আনমনেই বলল, চাপ নিস না।

-না তুই জানিস না। এইচ ও ডি আমার উপর খুব খচে আছে।

বিজয় কারণ জানতে চায় না। কিন্তু অনিমেষ বলতে চায়।

-ওর ক্লাসে যাইনি তো। ঠিক লক্ষ্য করেছে। একজ্যামের সময় বলল, ক্লাসে তো দেখা পাই না তোমার! থাক কোথায়!

বিজয় চোখ নামায় আকাশের দিক থেকে। সূর্য বড় তেঁতুল গাছটার পিছনে লুকিয়ে পড়েছে। এতক্ষণে মুখ খোলে সে।

-সব মোটামুটি বলে দিলে কিচ্ছু করতে পারবে না।

-বলা যায় না ভাই-

অনিমেষ কোন কারণে নিশ্চিন্ত হতে পারে না। তারপর নিজেই বিজয়কে জিজ্ঞেস করে, তোর সব পরীক্ষা ঠিকঠাক হল?

-মেডিসিনের থিয়োরিটা নিয়ে খুব চাপে আছি।

তারপর সত্যিই আতঙ্কিত গলায় সে বলল, ফেল করে গেলে খুব চাপ হয়ে যাবে।

বলেই সে তাড়াতাড়ি সিগারেটটা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। যেন ভয়টা হঠাৎ করেই তাকে ঘিরে ফেলেছে এবং সে একটু দম ফেলার ফুরসৎ চায়।

অনিমেষ তার চলে যাওয়ার পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার নিচে মনোনিবেশ করল।

সেই তিনটে ছেলে দুটো মেয়েকে নিয়ে একটা টোটোয় উঠল।

-সালা মেয়েবাজগুলো-বলে আধপোড়া সিগারেটটা সেদিকে নিক্ষেপ করে সে চট করে সরে এল পাঁচিলের কাছ থেকে। অস্ফুটে কয়েকটা গালি কি জানি কার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়ে নিচের দিকে নামতে লাগল দ্রুত পায়।

হস্টেলের ঘরটায় ফিরে দ্রুত দরজা এঁটে দিল বিজয়। অন্ধকার নেমে এসছে। সবকিছু আবছা দেখাচ্ছে। এই সময়টাকে সে কোনদিনই পছন্দ করত না। এই সন্ধ্যেটা। তুমি ঘুম থেকে উঠে দেখছ, অন্ধকার হয়ে গেছে, লাইট জ্বালানো হয়নি; তোমার গলা শুকিয়ে গেছে, অথচ জলের বোতলটা খুঁজে হাতে নিতে ইচ্ছে করছে না। তোমার মনে পড়ল অনেকটা পড়া বাকি। বই খোলা পড়ে আছে। চারপাশে কোন আওয়াজ নেই। শুধু ঝিঁঝিঁ ডাকছে বাইরে। জানলার ফাঁক দিয়ে ত্রিকোণাকার হলুদ আলোর টুকরো এসে পড়ে আছে দেওয়ালে। হ্যালোজেনের আলো। মৃত মানুষের চোখের মত।

পুরনো স্মৃতিতে চমকে উঠে তাড়াতাড়ি লাইট জ্বালিয়ে দিল বিজয়। ল্যাপটপটা অন করে একটা সিনেমা চালিয়ে দিল, কানে হেডফোন গুঁজে সাউন্ড বাড়িয়ে দিল একশোয়। আর বাইরে থেকে কোন আওয়াজ এসে ঢুকবে না।

কানে হেডফোন লাগিয়ে সে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। ছাদের দিকে তাকাল। ফ্যানটা ঘুরছে একঘেয়ে গতিতে।

যেভাবে পৃথিবী ঘোরে। সকলের অলক্ষ্যে। কেউ চেয়েও দেখে না। কারণ সেই ঘোরাটাই দস্তুর। আর সেভাবেই, সবার অলক্ষ্যে, দিনগুলো কেটে যায়। চোখের পলকে।

সাড়ে চারটে বছর সে এখানে আছে। কত কিছুই না দেখেছে, কত কিছুই দেখেছে। ডাক্তারি শাস্ত্রটা জেনেছে। কিন্তু সেটা নগণ্য। জীবনের নিয়ম লেখা যে বইটা কেউ কোনদিন ছাপেনি, যার ভাষা প্রত্যেকের কাছে পৃথক, সেটাই সে হাতে পেয়েছে এখানে, পাতার পর পাতা উলটে পড়ে গেছে। অপ্রকাশিত, অগ্রন্থিত ফর্মুলা গুলো জেনেছে, গেঁথে নিয়েছে মাথায় আর মনে।

প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ে। যখন মালদায় প্রথম এসেছিল সে। সদর হাসপাতাল তখন সবে রূপান্তরিত হয়েছে মেডিক্যাল কলেজে। তবে সেটা নেহাৎই খাতায় কলমে। বাস্তবে তখন মালদা মেডিক্যাল কলেজ কয়েকটা পুরনো বিল্ডিং আর ইট-বালি-লোহা-লক্কড়ের কয়েকটা স্তূপ।

হস্টেল দেখে চোখে জল চলে এসেছিল। পেশেন্টের খাট কয়েকটা এনে রাখা হয়েছিল হস্টেলে। এক একটা ঘরে চার থেকে পাঁচজন থাকতে হত। করিডরের শেষে কমন বাথরুম। তার সবগুলোর দরজা আটকায় না। সামনে চব্বিশ ঘণ্টা জল জমে থাকে।

তার প্রথম রুমমেট। একজন নয়, তিনজন। তবে একজনকে বেশি করে মনে পড়ে। অরিজিত।

তাকে যদি কোন নাম দিতে বলা হত অরিজিতের, বিজয় বলত, “গৃহস্থ”।

জুতো পড়ে রুমের ভিতর?

না।

কলেজের প্যান্ট পড়ে খাটের উপর?

না!

জোরে সাউন্ড সিস্টেম বাজানো?

না।

একদিন স্নান বাদ দেওয়া, প্রবল শীতের মধ্যে?

দুঃখিত, না!

ঘরে তালা না মেরে দু’ মিনিটের জন্য পাশের ঘরে যাওয়া?

না, তুই কি পাগল নাকি!

বিজয়ের মনে হত, অরিজিত এই রুমে সবার বাবা। ওর ধমকের জ্বালায় দৈনন্দিন জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছিল “চল নিয়ম মতে”।

তবে সেটা যে সবসময় খারাপ ছিল তা নয়। বিজয় প্রথম দিকে রীতিমত অগোছালো ছিল।প্রতিদিনই কিছু না কিছু হারিয়ে ফেলত। অরিজিত ঠিক খুঁজে রাখত সেগুলো; দিনের শেষে ফিরিস্তি দিত, এটা পেয়েছি খাটের তলা থেকে, এটা ডাস্টবিন থেকে, এটা করিডরে গড়াগড়ি খাচ্ছিল।

ব্যাজার মুখে সেগুলো হাতে নিত বিজয়। কিছু বলারও ছিল না। আড়চোখে দেখতে পেত অরিজিতের মুখে “কেমন বলেছিলাম তো?” গোছের হাসি। গা জ্বলে যেত তার। কিন্তু অনস্বীকার্যভাবে মনে মনে হাজার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে ধন্যবাদ জানাত অরিজিতকে।

কাগজগুলো হারিয়ে গেলে সর্বনাশ হত।

জানলার ধারের খাটটায় থাকত প্রত্যুষ। ছোটখাটো রোগা চেহারা। মাথাভর্তি ঢেউ খেলানো চুল। একটু অলস প্রকৃতির। ক্লাস থেকে ফিরে জামা কাপড় পাল্টাতে ইচ্ছে করত না তার। মোজা পরেই উঠে পড়ত খাটে।

তৎক্ষণাৎ তীব্রকন্ঠে প্রতিবাদ জানাত অরিজিত, “মোজাটা তো খোল!”

বিশেষ পাত্তা না দিয়ে প্রত্যুষ তার অ্যানাটমি বইটা খুলে বসত।

আবার প্রতিবাদ।

“আরে হাত মুখ তো ধুয়ে আয়!”

বিজয়দের ঘরের সর্বসম্মত বাবা চেঁচিয়ে উঠত।

“উফফ, ছাড় না বাবা”

বিরক্তস্বরে বলত প্রত্যুষ।

“গন্ধ ছাড়ছে তোর মোজা!” গর্জে ওঠে অরিজিত।

“পারব না আমি খুলতে”- একগুঁয়ে ছেলের মত পাল্টা গর্জায় প্রত্যুষ।

“তবে রে শালা…!”

অরিজিত বাঘের মত ছুটে গেল প্রত্যুষের দিকে। খপ করে টেনে ধরল একটা পা। কুমির যেভাবে তৃষ্ণার্ত বাইসনকে টেনে নামায় নদীতে, সেভাবে সে চেপে ধরেছে প্রত্যুষকে। প্রত্যুষও প্রাণপণ চেপে ধরে আছে খাটের কিনারা। আর অন্য পা-টা অরিজিতের নাকের সামনে ধরে আছে, “শোঁক শালা! শোঁক শোঁক!”

অরিজিতের দম ফুরিয়ে আসছিল। একবার শ্বাস নিলেই নির্ঘাত পতন সে জানে। শেষ দমটুকু নিয়ে সে সাহায্য প্রার্থনা করে-

“বিজয়! বিজয় ধর ওর অন্য পা-টা চেপে!”

প্রত্যুষও ছেড়ে দেয় না, “বিজয়! এই বুনো মোষটাকে থামা তো! ওর বাবাগিরি বের করে দে!”

বিজয় দু পক্ষের কথাই শোনে মন দিয়ে। তারপর বিছানায় উঠে বসে। বালিশটাকে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রেখে বেশ আরাম করে গুছিয়ে বসে। একটা পা তুলে দেয় অন্যটার উপর। সেটাকে অল্প অল্প নাড়াতে নাড়াতে চানাচুরের কৌটো থেকে একমুঠো চানাচুর হাতে ঢেলে খেতে থাকে; একমনে উপভোগ করে যুদ্ধটা। মাঝে মাঝে অ্যাম্ফিথিয়েটারের সিজারের মত হাত নেড়ে বলত খালি- “থামলি কেন, চালিয়ে যা, চালিয়ে যা”

এরকম প্রায় প্রতিদিনই হত। সবসময় যে খুব হাস্যকর পর্যায়ে আটকে থাকত তা নয়। মাঝে মধ্যেই এই যুদ্ধে অনুপ্রবেশ ঘটত একটা গম্ভীর গলার। সেই গলা শুনলেই তিনজনে একসাথে ফ্রিজ হয়ে যেত।

“এই তোদের কি ঘর থেকে বের করে দিতে হবে?”

বিজয় সঙ্গে সঙ্গে ‘স্কোয়াড সাবধান’ শুনে বাধ্য ছেলের মত পিঠ ঘাড় টানটান করে পড়তে বসে যেত। অরিজিত সুড়সুড় করে নিজের খাটে ফিরে আসত। প্রত্যুষ পড়িমরি করে মোজা দুটো খুলে হাত-পা ধুয়ে এসে বসে পড়ত বইয়ের সামনে।

এই গম্ভীর হাড়হিম করা গলার অধিকারীর নাম স্বপন।

তার চরিত্রের যাবতীয় কাব্য ওই নামটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাদবাকি সবটাই তার গদ্যের রুক্ষতায় ভরা। ভুরু কুঁচকে তাকানোটাই ছিল ওর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, একটু বক্রোক্তি না করে কথা বলতে অসুবিধে হত, আর ঘনঘন পিলে-চমকানো অট্টহাসি ছিল তার ট্রেডমার্ক।

ওকে সবাই একটু সমঝে চলত।

তা তো চলবেই। যে ছেলে হাসলে মনে হয় স্বয়ং মেফিস্টফেলিসের দর্শন পেলাম, এইবারে তেলে ফেলে ভাজবে, তাকে তো সমঝে চলতে হবেই।

বিজয়ের ছেলেটাকে অদ্ভূত লাগত। মনে হত ও যেন অকারণে রুক্ষ। রূঢ় কথা বলতেও মানুষের তো একটা কারণ লাগে। ওর লাগত না। কাউকে আঘাত করেই যেন ও আনন্দ পেত। কারুর অপদস্থ হওয়ার খবর শুনলে তার হস্টেল-কাঁপানো হাসিটা ভারি শ্রুতিকটুর ছিল।

প্রত্যুষেরও বোধহয় অস্বাভাবিক লাগত এটা। বিজয়কে সে বলেওছিল, “ওর এই রুক্ষতাটা যেন ওর নিজের দুর্বলতা, ব্যথা ইত্যাদিকে আড়াল করার একটা প্রচেষ্টা। দেখবি ওর সমস্ত রুক্ষতাই কেমন যেন আরটিফিশিয়াল লাগে। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া”

বিজয়েরও খানিকটা তাই মনে হত।

অরিজিত একদিন প্রকাশ্যে ঘোষণা করল, “স্বপনকে আমি আমার বন্ধু বানিয়ে ছাড়ব, নইলে আমার নামে কুকুর পুষিস”

বিজয় বলেছিল, “আমার কুকুরের নাম তো অলরেডি অরিজিত”

অরিজিত তার দিকে একটা অগ্নিদৃষ্টি হেনে বলেছিল, “তাহলে শুয়োর পুষিস”

“আছে তো শুয়োর একটা আমার পোষা, এই ঘরেই আছে, তার নাম তো অরিজিত-ই!”

অরিজিত এবার তাকে উপেক্ষা করে বলে চলল, “আমি সবাইকে আমার বন্ধু বানাতে পারি। তোরা দেখে নিস”

এর পর থেকেই তার দৈনন্দিন প্রচেষ্টা শুরু হয়ে গেল।

এবং তার ফলশ্রুতি হল ভয়ঙ্কর।

একদিন অরিজিত ঘরের সবাইকে লজেন্স বিতরণ করছিল। প্রত্যুষ আর বিজয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা নির্বিঘ্নেই মিটল। তারপরে স্বপনের পালা।

স্বপন মশারির ভিতরে থেকে চশমার উপর দিয়ে পুরো ঘটনাবলী লক্ষ্য করছিল। ব্ল্যাক প্যান্থার যেমন খাঁচার ভেতর থেকে দর্শকদের দিকে সতর্ক কিন্তু হিংস্র দৃষ্টি হানে তার চাহনিটাও ছিল অবিকল সেইরকম। এমনকি মাঝে মাঝে সে নাক দিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ বার করছিল, যেটাকে প্যান্থারের চাপা গর্জনের সাথে তুলনা করলে বোধহয় ভুল হবে না।

বিজয় স্পষ্ট দেখল অরিজিত ঢোক গিলল।

তারপর আস্তে আস্তে স্বপনের মশারির দিকে এগোতে শুরু করল। হাতটা সামনের দিকে বাড়ানো। তাতে একটা লজেন্স।

স্বপন একটাও কথা না বলে আগাগোড়া ওর ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।

বিজয় লজেন্সের র‍্যাপার খুলেই চলেছে। চোখ স্বপনের দিকে। প্রত্যুষ ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের অর্ধেক নখ খেয়েই ফেলল বোধহয়!

ওদের মধ্যে দূরত্ব কমে আসছে।

দম আটকানোর যোগাড়।

তখনি প্যান্থার ফ্যাস করে উঠল।

খসখসে গলায় বিদ্রূপ মিশিয়ে স্বপন বলল অরিজিতকে, “শিকার করতে আসছিস? নিজেই শিকার হয়ে যাবি!”

উফফ কি হিমশীতল হুমকি! ব্ল্যাক প্যান্থারের গর্জন এর কাছে নস্যি।

অরিজিত একটা অ্যাবাউট টার্ন নিয়ে নিজের বিছানার দিকে ছুট লাগাল। বিজয় বুঝতে পারছিল ওর মাথার মধ্যে এখন একটা মস্ত লাল বাতি জ্বলছে আর তারস্বরে “মিশন অ্যাবোরট” অ্যালার্ম বাজছে।

স্বপন সব দেখে তখন হস্টেল কাঁপিয়ে অট্টহাসি দিচ্ছে।

অথচ পরে কিন্তু এই স্বপনের সাথেই অদ্ভূত ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল ওদের তিনজনেরই। কোন বিশেষ ঘটনার মধ্যে দিয়ে নয়, কোন সাহায্যের ফলে নয়, এমনি এমনিই। বিজয় ক্রমশ জেনেছে, যে বন্ধুত্ব অকারণে তৈরী হয়, সেই বন্ধুত্বই টেঁকে বহুদিন। কারণ সব দরকারই কোন না কোনদিন শেষ হয়, কিন্তু ‘অদরকার’ এবং ‘অকারণ’ চিরকালই বজায় থাকে।

স্বপন নিজেই আস্তে আস্তে ওর কষ্টকর খোলস ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছিল।

নিজের অজান্তেই। অরিজিতের সাথেই প্রথম স্বাভাবিক কথা বার্তা বলতে শুরু করেছিল সে। সেও এক গল্প।

কলেজের প্রথম দিন থেকেই অরিজিতের একটি মেয়ের প্রতি দুর্বলতা ছিল। ওই যাকে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বলে আর কি। তার নাম অনসূয়া।

ওদের প্রথম দেখা হয়েছিল অ্যানাটমি ডিসেকশন হলে। সন্দেহাতীতভাবে খুব রোম্যান্টিক জায়গা। সামনে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে ক্যাডাভার, মানে সংরক্ষিত শবদেহ আর কি। ঢাউস পেট তার হাঁ করে কাটা- লিভার, স্টম্যাক, ইন্টেস্টাইন, আর শিরা-ধমনীর ভিড়।

একটাই ক্যাডাভার। পঞ্চাশজন ছাত্র-ছাত্রী। এ ওর ঘাড়ে উঠে দেখছে। মাঝে মাঝে অনেকের ওই উদরগহ্বরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। সবাই হই হই করে উঠছে। কয়েক মিনিট অন্তর শোনা যাচ্ছে “এই আমার পাএর উপর থেকে নাম”, “আরে বাবা আর কত চাপ দিবি! কাঁধটা ভেঙে যাবে এবার!”, “ব্যাগটা রেখে আয় না! এটা কি ক্যানিং লোকাল?”, “এই একটু দেখতে দে না, এতক্ষণ তো দেখলি!” ইত্যাদি।

সেইখানেই অনসূয়া কাঁদো কাঁদো স্বরে অচেনা অজানা ভালমানুষ চেহারার অরিজিতকে বলেছিল, “কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না রে! প্লিজ একটু জায়গা করে দে না!”

ব্যস ওইটুকুই যথেষ্ট। অরিজিত ক্লিন বোল্ড। তার কানের পাশে বেজে উঠেছে তখন “তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা তুমি আমার সাধের সাধনা…”

তার শক্ত সমর্থ হাতের চাপে সে প্রবল ভিড়ের মধ্যেও তৈরী করল একটা শূন্যস্থান। আর অনসূয়াকে ‘স্থাপন’ করল সেখানে।

সেই শুরু। তারপর থেকে অরিজিতের জীবনে অনসূয়া ছাড়া আর কেউ নেই। অনসূয়ার যা দরকার পড়ে, অরিজিতের কর্ণকুহরেই সবার আগে তা প্রবিষ্ট হয়, এবং কোন বাসনাই, বলা বাহুল্য, অপূর্ণ থাকে না।

স্বপন এই সবই দেখত। চশমার উপর দিয়ে। অনবরত অনসূয়ার ফোন আসা, আর সেই নাম্বারটা দেখলেই বিছানার উপর অরিজিতের তড়াক করে লাফিয়ে ওঠা, ফোন নিয়ে করিডরে চলে যাওয়া- সবই পর্যবেক্ষণে রাখে স্বপন।

সব জমিয়ে রেখে একদিন বিস্ফোরণ ঘটায় সে। একেবারে তথ্যপ্রমাণ সমেত।

“আর কত ছুটবি ওই মেয়েটার পিছনে?”

দাঁতগুলো বের করে একটা শয়তানি হাসি হেসে বলল স্বপন। লক্ষ্য অরিজিত।

উত্তর দেবে কি। সকলে তো স্তম্ভিত! যে স্বপন তাদের সঙ্গে মেশা তো দূরের কথা, কথাই বলত না দরকার না পড়লে সে হঠাৎ এরকম বিষয়ে মুখ খুলবে?

ওরা শুধু মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।

স্বপন আবার দাঁত বের করল-

“তোকে নাচাচ্ছে, তুইও নাচছিস। ওরকম মেয়ের ঠিক বয়ফ্রেন্ড আছে। তুই শুধু প্রয়োজনের উপকরণ”

বলেই সে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তার চিরপরিচিত অট্টহাসি শুরু করে দিল।

অরিজিতের মুখ এতটুকু হয়ে গেল। বিজয় আর প্রত্যুষ তখনো বাকক্ষমতা ফিরে পায়নি। তারা ভাবছিল এর উত্তরে কি বলা যায়। স্বপনের বিরোধিতা করা? অরিজিতকে সান্ত্বনা দেওয়া? নাকি-

প্রত্যুষ এই নাকিটাই আগে করে ফেলল;

“আমারও কেন জানি না এটাই মনে হয়”

নিঃশর্ত সমর্থন করে ফেলল সে স্বপনকে।

আরেক দফা অট্টহাস্য। এবার সঙ্গে হাততালি।

অরিজিত রোষকষায়িত চোখে একবার প্রত্যুষের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

হস্টেলে কারুর প্রাণে দুঃখ হলে তারা সকলের থেকে অনেক দূরে চলে যেত কিছুক্ষণ একা থাকার জন্য।

মানে, ছাদে যেত।

ঘুরে বেড়াত। আকাশ-পাতাল ভাবত। দু একটা নুড়ি পাথরে লাথি মারত। পাশের নার্সিং হস্টেলের ছাদে ভ্রাম্যমাণ মাঝারি সুন্দরীদের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকত। দু একটা গান ও গাইতে পারত। এরপরেই সন্ধ্যে নেমে আসলে এবং মশা কামড়াতে শুরু করলে মনের দুঃখ দ্রুত কমে যেত এবং বাধ্য ছেলের মত নিচে নেমে আসতে হত।

অরিজিত ছাদে চলে গিয়েছিল সেদিন। নেমেছিল বেশ কিছুক্ষণ পর। কিন্তু নেমেও রক্ষা পায়নি। স্বপন ফের শুরু করে দিয়েছিল খোঁচানো।

“তুই কি ভাবিস ও তোকে পছন্দ করে? কাঁচকলা! তোকে দিয়ে সব কিছু করিয়ে নিয়ে তারপরে মিষ্টি করে টাটা গুডবাই করে দেবে! সাবধান! সাবধান বলছি!”

প্রথমে হেসে হেসে শুরু করত ও। কিন্তু শেষের দিকটায় গম্ভীর হয়ে যেত। যেন গুরু বলছে তার ছাত্রকে।

একদিন বলে ফেলল, “আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি!”

বিজয়রা সেই সুযোগ ছাড়ল না। ওর কাছে ঘেঁষে এল, অতি সাবধানে অবশ্য। মানে বাঘের খাঁচা থেকে মানুষ যে দূরত্ব বজায় রেখে বাঘ দেখার মজা নেয়।

কিন্তু সেদিন স্বপন ‘গল্প’ মোডে ছিল। নিজেই বেশ স্মৃতি রোমন্থনের মত বলে গেল মেয়ে জাতির ব্যাপারে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা। সে সব কথা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। মোটামুটি সকলেরই জীবনে এরকম একটা পূর্ব ইতিহাস থাকেই। বাঙালি মাত্রেই দাগা খাওয়া। কে এক উঠতি গায়ক বলেছিল।

কিন্তু সেই ঘটনার মাধ্যমে স্বপনের সাথে ওদের জমে গেল। তার মানে এই নয় যে স্বপনের রুক্ষতা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। মাঝে মধ্যেই তার হুঙ্কার শোনা যেত।

“এই এত রাতে সিনেমা দেখে কান্নাকাটি করলে পোঁদে লাথি মেরে বের করে দেব”

বা, “মেয়েবাজি করতে হয় বাইরে গিয়ে করবি এখানে ফোনে গদগদ গলা শুনলে হাতুড়ি মেরে খোপরি ভেঙে দেব” ইত্যাদি ছিল তার প্রাত্যহিক গর্জনের অনেক ভদ্রস্থ ও ‘সেন্সরড’ প্রতিবেদন। মানে নানাবিধ চার-অক্ষর ও দু-অক্ষর সম্বলিত অপভাষা বাদ দিলে যা দাঁড়ায় আর কি।

অরিজিতকেই স্বপন বকত সবথেকে বেশি। তার কিছুটা অতিরিক্ত নরম স্বভাবের জন্য, কিছুটা ওই অনসূয়ার প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্যের জন্য। কিন্তু তার সখ্যটাও বেশি ছিল অরিজিতের সাথেই।

ফার্স্ট ইয়ারের একটা সেমেস্টারের কথা খুব মনে পড়ে। অন্য কোন সেমেস্টার এভাবে আলাদা করে মনে নেই বিজয়ের।

অ্যানাটমি পরীক্ষার আগের দিন রাত।ঘরে চারজনেই একদৃষ্টে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। অস্থি মাংস স্নায়ু রক্তবাহ ইত্যাদির বাহুল্যে মস্তিষ্কে জট লেগে যাচ্ছে। প্রত্যুষ দুদিন ধরে জামা কাপড় ছাড়ে নি। এখন সে একটা অদ্ভূত ভঙ্গিতে আধশোয়া হয়ে পড়ছে। বিজয় দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে দেওয়ালের দিকে চেয়ে এইমাত্র পড়া জিনিসগুলো ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোন অজানা কারণে তার চোখের সামনে খালি সাকিরার ওয়াকা ওয়াকা ভেসে উঠছে। অরিজিত যখন পড়ে তখন পাথর হয়ে যায়। এমনকি মশা কামড়ালে সেদিকেও সে নজর দিতে পারে না। অনেকখন পরে যখন মনে পড়ে ‘কিছু একটা কামড়াচ্ছিল’ তখন শূন্যে দু একটা অপ্রয়োজনীয় চাপড় মারে। স্বপন নিজের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে পড়ছে। মাঝে মধ্যে চশমার উপর দিয়ে বাকি সকলের দিকে চাইছে। বুঝে নিতে চাইছে বাকিদের অবস্থা কিরকম।

সকলেরই অবস্থা একইরকম। কিছুই মনে পড়ছে না, নতুন কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কিন্তু কেউই সেটা সাহস করে বলতে পারছে না। পাছে বাকিরা বলে ‘কই আমার তো ভালোই মনে থাকছে’।

প্রত্যুষই লাফিয়ে উঠল প্রথমে। সব বইটইয়ের গাদার মধ্যে সোজা দাঁড়িয়ে উঠল আর বুক ভরে গভীর শ্বাস নিল একটা।

চিৎকার করে বলল, “আর পারছি না ভাই! চুলোয় যাক পরীক্ষা! মাথাটাই ফেটে যাবে এবার!”

বিজয় লাফিয়ে উঠল ওর দেখাদেখি। সশব্দে বইটা বন্ধ করে বলল, “ঠিক! ঠিক! ঠিক!”

অরিজিতও উচ্চিংড়ের মত লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার ভয় স্বপন না আবার গালাগালি করে। তাই সে আধশোয়া হয়ে পড়ে রইল বিছানার উপর।

স্বপনের অন্তর্ভেদী চাহনি এতক্ষণ সবার ভিতরটা এক্স রে করছিল।

এবার সে নিজে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

আড়মোড়া ভাঙল। তারপর বুক ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল “চুলোয় যা হতভাগার দল!”

বলেই সে তার অ্যানাটমি বই বন্ধ করে ছুঁড়ে দিল খাটের উপর। এবার অরিজিত ও লাফিয়ে উঠল।

ব্যস।

চা বানানোর ডেকচি হল ড্রাম। প্রত্যুষের হাতে কাল্পনিক গীটার। বিজয় ভোকালিস্ট। স্বপন থালা বাজাচ্ছে। অল্পক্ষনের মধ্যেই বালিশ ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হয়ে গেল। সঙ্গে চেঁচিয়ে গান। আর তারস্বরে গালাগাল। কার উদ্দেশ্যে কে জানে। এই সিলেবাস যারা প্রণয়ন করেছে, না যারা একরাতের মধ্যে সেগুলো ওদের মাথায় গাদার ব্যবস্থা করেছে, না যারা এক কালে তাদের মেডিক্যাল পড়তে ওদের উতসাহিত করেছিল তাদের উদ্দেশ্যে! যার প্রতিই হোক, গালাগাল দিয়ে ওদের মনটা হাল্কা হচ্ছিল। দুশ্চিন্তা গুলো কেটে যাচ্ছিল।

স্বপন সব থেকে উগ্র হয়ে উঠেছিল। সারা ঘর সে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। আলমারির পাল্লায় লাথি মেরে, প্রত্যুষের খাট ধরে উন্মত্ত ভাবে ঝাঁকিয়ে, রুপম ইসলামের অনুকরণে মাথা নাড়িয়ে ‘আসলে সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ গেয়ে হোস্টেল মাথায় তুলেছিল।

কিছুক্ষণ পরেই আশে পাশের ঘর থেকে উঁকি ঝুঁকি মারতে শুরু করেছিল বন্ধুরা। ডাকাত পড়ল কিনা দেখতে এসেছিল ওরা। দু একজন অনুযোগ করল, তাদের পড়ায় অসুবিধে হচ্ছে। সেটা ঝামেলার রূপ নিতে পারত, কিন্তু ব্ল্যাক প্যান্থার হুঙ্কার ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ খুব পড়ে ফাটিয়ে দিচ্ছিস শালা, পাঁচ মিনিটে তোদের পড়ায় ডিস্টার্ব হয়ে গেল? যা ভাগ সবাই!”

গজগজ করতে করতে ওরা ভিড় আলগা করে যে যার ঘরে ফিরে গেল। বিজয়রাও আবার পড়তে বসল। ওদের মাথাটা হাল্কা লাগছিল এখন। আবার পড়তে ইচ্ছে করছিল। স্বপনের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার বিজয়। স্বপন চশমার উপর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর ঘর কাঁপিয়ে অট্টহাস্য জুড়ে দিল, একেবারে দক্ষিণী সিনেমার ভিলেনের স্টাইলে।

এভাবেও পরীক্ষার আগের দিন একেবারে ভেঙে পড়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হয়েছে ওদের। ওরা বুঝেছে, কি ভয়াবহ একটা জগতে এসে পড়েছে ওরা। কিন্তু এটাও বোঝা গেছে, যে যত ভয়ঙ্করই হোক, সে পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সাধ্যও ওদের মধ্যেই নিহিত আছে। খালি প্রয়োজন বন্ধ দরজার কড়াটা সজোরে নাড়ার। সে সাহস ক্রমশ অর্জন করছে ওরা।

এর দুদিন পরেই সেই আতঙ্কের রাতটি এসেছিল।

বায়োকেমিস্ট্রি পরীক্ষার আগের দিন রাত। সবাই একমনে পড়ছে। ঠান্ডা পড়েছে বেশ। অরিজিত লেপের তলায়। প্রত্যুষ সোয়েটার মোজা সমেত জড়সড় হয়ে পড়ছে। স্বপনও গায়ে একটা শাল জড়িয়েছে।

রাত বারোটা নাগাদ স্বপনের ফোন এসেছিল।

ও ফোন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এল।

ওকে বিধ্বস্ত লাগছিল। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। চশমাটা খুলে হাতে নিল। তারপর, কতকটা আত্মগতভাবেই বলে উঠল,

“আমার আর পরীক্ষাটা দেওয়া হল না রে”

সবাই শুনল। কিন্তু কিছু বলল না। কারণ ব্যাপারটা পরিষ্কার হচ্ছিল না তখনো।

“আমার বাবা মারা গেছেন রে”

ঘরের মধ্যে একটা নিঃশব্দ ব্জ্রপাত হল যেন।

যে যেভাবে ছিল সেভাবেই ফিরে তাকাল ওর দিকে। এবং সেভাবেই তাকিয়ে রইল। যদি ও আর কিছু বলে। বিজয়ের বুকটা ধড়ফড় করছিল। ছেলেটা কাঁদছে না, চেঁচাচ্ছে না, সবাইকে ডাকাডাকি করছে না।

শোকে পাথর হয়ে গেছে নাকি।

পরে জেনেছিল ওরা, স্বপনের বাবা বহুদিন ধরে মৃত্যুশয্যায়। কিডনির কঠিন অসুখে ভুগছেন।

স্বপন ওদের কাউকে বলেনি।

প্রত্যুষ বলেছিল স্বপন যেন নিজের দুর্বলতাগুলো আড়াল করে রাখে!

তাই সত্যি বোধহয়। এখন অল্পক্ষণের জন্য হলেও, ওর সেই আব্রু খসে পড়েছে। ওর দগদগে ক্ষতগুলো বেরিয়ে এসছে। বেরিয়ে এসছে ক্রমাগত রক্তক্ষরণের অবিশ্বাস্য বীভৎসা। তবু ছেলেটা চুপ করে বসে আছে। একটু নুয়ে পড়েছে সামনে। যেন একটু হলেও ও দুর্বল, ওর কাঁধের উপর চেপে বসে থাকা দুশ্চিন্তা, আতঙ্কের দুর্বিষহ ভারে।

সে এক ভয়ঙ্কর রাত।

ওর মত ছেলেকে কে সান্ত্বনা দেবে। কি ভাষায় দেবে। পিতৃহারা একটি ছেলেকে কিভাবে শান্ত করা যায়, ওরা জানে না। কিন্তু ও তো শান্তই। আর সেটাই অসহ্য। ওর নীরবতাই যেন সবার উপরে চাপিয়ে দিয়েছে পর্বতপ্রমাণ অস্বস্তির পাথর।

বাইরে একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে। মাঝে মাঝে শিশিরের ঝরে পড়ার মৃদু শব্দ। তার সামনে ওর ন্যুব্জ দেহটা যেন মহাকালের পদতলে ক্ষুদ্র মানুষের অসহায় নতজানু মূর্তি।

একটা পরাজিত কঙ্কাল।

সেই রাতে প্রত্যুষ নির্ভয়ে ওর মাথায় ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছে। অরিজিত ওকে জড়িয়ে ধরে কত কিছু বলেছে। বিজয় ওকে সঙ্গে করে নিজের পরীক্ষা শিকেয় তুলে গিয়েছে ওর বাড়িতে। পৌঁছে দিয়ে এসছে।

ওদের সকলের মধ্যে যে দূরত্বটা এতদিন তাও বজায় ছিল, যার উৎস হয়ত ছিল ওকে মানুষ বলে চিনতে না পারার অস্বস্তি, তা ওইদিন অতিক্রান্ত হল। ওরা দেখার সুযোগ পেল লৌহযবনিকার ওপারে। দেখতে পেল রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ডটা ওর।

শেষ অব্ধি সকলে বন্ধু হল।

বিজয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ধড়মড় করে উঠে দেখল প্রায় মাঝরাত। একটু খিদে পেয়েছে।

খাবার আনা নেই।

গায়ে জামা চড়িয়ে ও বেরিয়ে পড়ল। হাসপাতালের সামনে একটা দোকান সারারাত খোলা থাকে। সেদিকে হেঁটে গেল সে। বহুদিনের পরিচিত কুকুরগুলো ওকে এগিয়ে দিয়ে এল।

দোকানে বসতেই মাঝবয়েসী কর্মচারী জিজ্ঞেস করল, “কি খাবেন ডাক্তারবাবু?”

ও একটু হাসল। ডাক্তার হওয়ার আগে থেকেই এই সম্ভাষণের সম্মান উপভোগ করছে ওরা। এই গরীব বোকাসোকা মানুষগুলোকে বোঝানোর উপায় নেই, কে ডাক্তার, কে ইন্টার্ন, কে ছাত্র। ওদের কাছে সবাই ডাক্তার।

যেমন শিব, দুর্গা, বিশ্বকর্মা, কার্ত্তিক- সবাই ঠাকুর, সবাই ভগবান।

এদেরকে পিছনে ফেলে রেখে বিজয়রা ক্রমশ উঠে যাবে কোন অস্পৃশ্য উচ্চতায়। সেখান থেকে নিচে তাকালে এই নগণ্য মানুষগুলোকে আর দেখতে পাবে কি?

এরা যখন খদ্দের হয়ে ওর কাছে আসবে, ও কি তাকে মিষ্টি হেসে বসাবে? জিজ্ঞেস করবে ওর রোগা মেয়েটা কত বড় হয়েছে? বা কেমন চলছে ওর ব্যবসা?

“একটা ডিম টোস্ট, একটা চা আর একটা নেভি কাট সিগারেট। চা আর সিগারেটটা এখন দিয়ে দাও, ডিমটা ভাজতে ভাজতে”

লোকটা ‘ঠিক আছে’ বলে চলে গেল। চা-সিগারেট এসে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই।

সিগারেটটা ধরিয়ে একমনে নিষ্ক্রান্ত ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে রইল বিজয়। একটা দিনের কথা মনে পড়ছে খুব।

তখনও ফাইন্যাল পরীক্ষা শুরু হয়নি ওদের। ওদের সিনিয়র ব্যাচের ইন্টার্নশিপ চলছে। একদিন বিকেলের দিকে হঠাৎ খবর পাওয়া গেল, হাসপাতালে ঝামেলা হচ্ছে। একজন ইন্টার্ন ডাক্তার আক্রান্ত পেশেন্ট পার্টির হাতে।

বিজয় আর অরিজিত একসাথেই ছিল তখন। দুজনেই ছুটে গেল তৎক্ষণাৎ। যতজনকে সম্ভব খবর দিল যাওয়ার পথে। ওরা যখন পৌঁছল, একটা হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে। ওদের চোখের সামনেই দেখতে পেল, একদল লোক ঘিরে ধরে মারছে একজনকে, তাকে ঠিক চেনা গেল না। ওদের কলেজের কেউ নয়। সে ক্রমাগত চেঁচাচ্ছে, আমি কি করেছি, আমি কি করলাম! কিন্তু তার আর্তস্বরে কান দেওয়ার সময় নেই মারমুখী জনতার। দেখতে দেখতে লোকটার জামা ছিঁড়ে ফর্দাফাই হয়ে গেল। তবুও চলছে বেপরোয়া ঘুষি, চড়- ওর মুখে, পেটে- নির্বিচারে।

পরে বিজয় জেনেছিল, ওই লোকটা হাসপাতালের কেউ নয়। সে একটি নার্সিং হোমের কর্মী। তার কাজ যে সমস্ত রোগীর রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা এই ‘কল্পতরু’ সরকারি হাসপাতালে নেই, তাদের রক্ত টেনে নিয়ে গিয়ে নার্সিং হোমের ল্যাবে পৌঁছে দেওয়া। এটাই এদের রোজগারের উপায়।

ওইদিন দুর্ভাগ্যবশত, একটি মুমূর্ষু পেশেন্টের রক্ত টানার সময়েই পেশেন্টটি মারা যায়। ব্যস।

আর যায় কোথা।

উন্মত্ত জনতা হাতের সামনে তাকে পেয়ে তাকেই মারতে শুরু করেছে।

লোকটা পড়ে গেল মাটিতে। জনতা ওকে ছেড়ে সোজা ঢুকে পড়ল এমারজেন্সি রুমে। একটি মেয়ে ইন্টার্ন ছিল সেখানে। সে প্রাণভয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল, ওরা দেখতে পায়নি। তান্ডব শুরু হয়ে গেল। বেঞ্চ, ট্রলি, ডাক্তারের টেবিল, চেয়ার ভাঙতে শুরু করে দিল ওরা অকাতরে।

ততক্ষণে কিছু আরো ছেলে এসে পড়েছে। মূলত ইন্টার্ন ব্যাচের। বিজয়দের ব্যাচ আর তার জুনিয়র ব্যাচের ছেলেরাও আসছে আস্তে আস্তে। কিন্তু তবু ওরা সংখ্যায় কম।

মারমুখী লোকগুলো এবার এমারজেন্সি রুম থেকে বেরিয়ে ছুটেছে ডাক্তারদের রেস্ট রুমের দিকে। একটা আধলা ইঁটের ঘায়ে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল ঘরের কাচ। ভিতরে সন্ত্রস্ত ডাক্তাররা দরজা চেপে ধরায় ওরা ঢুকতে পারল না। অপারেশন থিয়েটারের সামনের দরজাটাও ওরা ভাঙল।

কিন্তু আর এগোতে পারল না।

কারণ ততক্ষণে রুখে দাঁড়িয়েছে কলেজের ছাত্র আর জুনিয়র ডাক্তাররা। বিজয় দেখতে পেল ঝড়ের বেগে ঢুকল প্রত্যুষ। তার পিছনেই অনিমেষ, সুবর্ণ। কলেজে তখনো কিছু বিল্ডিঙের কাজ চলছে। সেখান থেকেই ওরা যোগাড় করে ফেলল বাঁশ, রড।

ছাত্রদের মারমুখী মূর্তি দেখে বীরপুঙ্গবেরা হাসপাতালের বাইরে গিয়ে আস্ফালন করতে লাগল।

কিন্তু পরিস্থিতি অত সহজে স্বাভাবিক হওয়ার নয়।

বিজয় একবার প্রত্যুষকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছিল ব্যাপারটা।

প্রত্যুষ কোনরকমে বলল, একটা পেশেন্ট ভরপেট কীটনাশক খেয়ে ভর্তি হয়েছিল। প্রায় মরণাপন্ন অবস্থায়। অ্যাট্রোপিন আর প্র্যালিডক্সিম ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। চার ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছিল বলে আর রাইলস টিউব করা হয়নি।

পেশেন্ট মারা যায়। একটা অ্যাট্রোপিন ইঞ্জেকশন শটে পাওয়ার অব্যবহিত পরেই।

ব্যস। পেশেন্ট পার্টির কেউ চেঁচিয়ে উঠল, ভুল ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলল আমার পেশেন্টটাকে।

তাতেই আশপাশ থেকে মাস্তান মার্কা কয়েকটি লোক এই হুলুস্থুল শুরু করে দিয়েছে।

বলতে বলতে কলেজের ছেলেরা লাঠিসোঁটা হাতে তাড়া করল ওই লোকগুলিকে।

মুহূর্তে রণক্ষেত্রের চেহারা নিল হাসপাতাল চত্বর।

যারা এতক্ষণ ঝামেলা করছিল তারা উসেইন বোল্টোচিত গতিতে পালাল। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা হাতের সামনে যাকেই পেল হাত খুলে পিটাল। কতগুলো নির্দোষ লোকের মাথা ফাটল।

মূল ঘটনার সময়ে যে রিপোর্টারদের দেখতে পাওয়া যায়নি, তারা এসে পৌঁছেছে এখন। ক্যামেরা চালু করে শুরু হল খবর রান্না।

তারা স্বভাবতই ছাড় পেল না। একজনের মাথা ফাটল, দাঁত নড়ল। আরেকজন খেল নির্বিচার কিল চড়। ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলা হল।

এতসব কিছু হয়ে যাওয়ার পর এল পুলিশ। তারাও প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ল ছাত্রদের।

তারও পরে এসে থামল জেলার এক মন্ত্রীর গাড়ি। এই কলেজের বিষয়গুলিতে বরাবরই তাঁর ভীষণ আগ্রহ। মাঝে মাঝে ছাত্রদের মনে হত প্রিন্সিপাল, এম এস ভি পি বা জেলার সি এম ও এইচ কেউ না। এই কলেজ এই মন্ত্রীটির বাপ-ঠাকুরদার সম্পত্তির মধ্যে পড়ে বোধহয়।

এদিনও এসেই উদ্ধত ভঙ্গিতে তিনি সবাইকে ভিড় আলগা করতে বললেন।

“আমি এসে গেছি। এখন আর এখানে কারুর থাকার দরকার নেই। ফাঁকা করে দিন। যান, যান সবাই এখান থেকে”

ছাত্ররা সরল না। ওরা একগুঁয়ে হয়ে উঠেছে। ইন্টার্ন ডাক্তারদের গায়ে হাত ওঠা, হাসপাতাল ভাংচুর হওয়া এই প্রথম না। বারবার হয়েই চলেছে। কাউকে জানিয়ে কোন লাভ হয়নি। কাজেই সরে গিয়ে এই রাজনৈতিক নেতাকে স্বস্তির বাতাবরণ উপহার দেওয়ার ইচ্ছে ওদের কারুরই ছিল না।

কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে পারছে না। মন্ত্রী বলে কথা। আর তাছাড়া এরা এখানে পড়তে এসছে দূরদূরান্ত থেকে, আর মন্ত্রী তো স্থানীয় লোক…

কিন্তু বিজয় দেখতে পেল প্রত্যুষ ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল। অরিজিত একবার ওর হাত ধরে থামানোর চেষ্টা করল বোধহয়, কিন্তু প্রত্যুষ শুনল না। সে এগিয়ে গেল ভিড়টার একদম সামনে।

মন্ত্রী তখন দ্বিতীয়বার বলছেন, “কি হল, সরে যান সবাই!”

তীব্র কর্কশ স্বরে গর্জে উঠল রোগা পটকা প্রত্যুষের গলা।

“না, আমরা সরব না!”

স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মন্ত্রী। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন ওর দিকে। দেহরক্ষী দুজনও বুঝে পায় না কি করবে; একবার মন্ত্রীর মুখের দিকে, একবার প্রত্যুষের মুখের দিকে তাকাচ্ছে।

“এটা কি আপনার কলেজ?”

ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞেস করেন পোড় খাওয়া মন্ত্রী।

একটুও না দমে প্রত্যুষ মুখের উপর জবাব দেয়, “না, তবে এটা আমাদের কলেজ”

“সরে যান বলছি”

“যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন এবং বলছেন কি কি ব্যবস্থা নেবেন আমাদের সুরক্ষার জন্য, ততক্ষণ আমি ও আমরা এখানেই এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকব”

বিজয় ভেবে পাচ্ছিল না প্রত্যুষ কথার উপর কথা বাড়িয়ে চলেছে কেন। ছেলেটা কি উন্মাদ? ও জানে এটা ওই মন্ত্রীর খাস তালুক? ওর মুখের কথা পড়তেই পাঁচজন এসে ওকে মেরে শেষ করে দিতে পারে?

কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার হইচই শুরু হল। এবার অন্য ছাত্ররা, ইন্টার্নরাও বলতে শুরু করেছে। মন্ত্রী মাঝে মধ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় হুঙ্কার দিচ্ছেন। কিন্তু তাতে ভিড় হাল্কা হচ্ছে না, বরং কলেবরে বাড়ছে।

“এই তোমার নাম কি?…নাম কি তোমার?”

প্রত্যুষকে জিজ্ঞেস করলেন মন্ত্রী। প্রত্যুষ নাম বলল বোধহয়। বেশ কিছুটা পিছনে থাকার দরুন বিজয় ভালো শুনতে পাচ্ছিল না। পরে শুনেছিল মন্ত্রী হুমকি দিচ্ছিলেন যে ওর নাম আইএমএ-এর সেক্রেটারির কাছে বলে ওর জীবন ‘difficult’ করে তুলবেন। প্রত্যুষ আবার হেসে কি বলতে যাচ্ছিল। কিন্ত এমএসভিপি ওকে থামান।

প্রত্যুষটা পাগল।

ওর নামে এফ আই আর পর্যন্ত হয়েছিল ওই ঘটনার পর। হয়েছিল কলেজের বেশ কিছু ছেলের নামেই।

কিন্তু ও ছিল নির্বিকার।

তবু বিজয় জানে, প্রত্যুষের এটা কোন খামখেয়ালিপনা নয়। এটাই ওর স্বাভাবিকত্ব। সে জানে, কারণ একটা সময় প্রত্যুষ তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ছিল।

ওর অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেগুলো গাড়ি-বাড়ি-পয়সা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ত নতুন সমাজ, নতুন দিনের কাহিনি সম্বলিত কোন রূপকথার দেশে। সে নিজেই বলত, রূপকথাও তো সত্যি হয়। কল্পবিজ্ঞানও একদিন বিজ্ঞান হয়। আর ওর এই স্বপনের দাসত্ব করত ও। তা নিয়ে বিন্দুমাত্র লজ্জা ছিল না ওর। বলত, ক্রীতদাসই যদি হতে হয়, নিজের স্বপ্নের ক্রীতদাস হওয়াই ভালো।

এই স্বপ্নের দৌলতেই ওর চরিত্রে বাসা বেঁধেছিল ভয়াবহ একগুঁয়েমি।

তার জন্য কি না সইতে হয়েছে ছেলেটাকে।

ফার্স্ট ইয়ার থেকে সে এইরকম না-সমোঝ।

বাম ঘেঁষা ছিল বলে প্রথম থেকেই কিছু ছেলের চক্ষুশূল হয়ে উঠল সে। ধর্ম মানত না বলে একটা অংশ ওকে অপছন্দ করত। কলেজের প্রথম দিন থেকেই সে ভালোবাসার থেকে ঘৃণাই বেশি অর্জন করেছে ছেলেদের।

সময়টা তখন একেবারেই প্রত্যুষকে সাথ দেয় নি। লাল রঙের প্যাম্ফলেট বই পড়ত সে। কারুর সাবধানবাণীর ধার ধারত না। কি ওর অত দায় পড়েছিল কে জানে, কলেজে সে বলে বেড়াত মার্ক্সবাদ, কমিউনিজম, সমাজতান্ত্রিক সমাজ নিয়ে নানারকম কথা। রাখঢাক না করে দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে উগরে দিত ক্ষোভ।

ফলও পেয়েছে হাতেনাতে।

ফার্স্ট ইয়ারে কলেজের দাদারা ওকে ঘিরে ধরল। প্রথমে মৌখিক শাসানি দিয়ে শুরু করে তারপর কলার ধরে চড়থাপ্পড়। সবটাই আবার আলাদা করে ডেকে অন্ধকারের মধ্যে ডেকে নিয়ে গিয়ে। শেষে ছাড়া হল এই বলে, যে, এইসব ছেড়ে দে, নইলে রেল লাইনের ধারে লাশ ফেলে দেব।

প্রত্যুষ বলেছিল, ও ভাবতে পারেনি মেডিক্যাল কলেজে পড়া শিক্ষিত ছেলেরা এরকম ভাষায় কথা বলতে পারে। ওরা নাকি ওর মা বাবা বোনকে নিয়েও কুৎসিত ইঙ্গিত করেছিল।

কিন্তু প্রত্যুষ থামেনি। ওর পিতৃদত্ত প্রাণ বরং ও ছেড়ে দিতে পারে অক্লেশে, কিন্তু ‘এইসব’ সে ছাড়তে পারবে না।

কে না বুঝিয়েছে ওকে। হস্টেলের ক্যান্টিনের ম্যানেজার থেকে কলেজের প্রিন্সিপাল। কিন্তু সকলেই ডাহা ফেল। প্রত্যুষ গুপ্তর মস্তিষ্কে সে সব উপদেশ এক সেকেন্ডের জন্যও ছাপ ফেলে নি।

সে আবার ঝামেলায় জড়িয়েছে। একবারের কথা তো বিশেষ করে মনে আছে।

ক্যান্টিনের টাকা বাকি রয়ে গিয়েছিল একটি ছেলের। ছেলেটা আর্থিকভাবে একটু সমস্যার মধ্যে ছিল।  হস্টেলের অখাদ্য খাবাড় নিয়েও সে কিছু মন্তব্য করে থাকবে।

সেই অপরাধে রাতের অন্ধকারে ত্রাকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে পিটল একদল মদ্যপ লোক। তারা আবার নাকি ক্যান্টিনের কর্মচারী।

ছাত্ররা খেপে গেল। আর তাদের সামনে দাঁড়াল আবার প্রত্যুষ।

এখানেও আগমন ঘটেছিল সেই মন্ত্রীর। ক্যান্টিনের অধিকর্তা তাঁর খাস পেয়ারের লোক।

আবার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়।

প্রত্যুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল এবার আরো একদল গোঁয়ার ছেলে।

সেবারের ঘটনা অনেকদূর গড়িয়েছিল। সারা জীবনের মত কারুর দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে থাকতে পারে ওই রাতটা।

দুটো জিপে করে একগাদা লোক হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছিল একেবারে হস্টেলের মধ্যে। তাদের কোমরে উদ্ধতভাবে গোঁজা পিস্তল। জুনিয়র ছেলেদের মধ্যে বিতনু কথা ব্লছিল বেশি। তাকে মাথার চুল ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল ওরা। বেদম মারধর করল। বাকিদের কারুর জুটল কিল, কারুর লাথি, কারুর নির্ভেজাল প্রাণহানির হুমকি।

পুলিশ ও মন্ত্রী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল।

যে রাজ্যে একটা সময়ে কুকুর মরলেও হেডলাইন হত, সেখানেও এত বড় ঘটনার পরদিন সমস্ত বড় ও ছোট সংবাদপত্র এ বিষয়ে রইল সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। গোপনে বসে মন্ত্রীর ভেট গুনল খবরের কাগজের স্থানীয় সংবাদদাতারা।

এই সমস্ত ঘটনায় জড়িয়ে পড়ল প্রত্যুষ। আর সেখান থেকেই বিজয়ের সাথে দূরত্ব বাড়ার শুরু।

একদিন ও এসে বলেছিল, শাসক বিরোধী ছাত্রদের সংগঠিত করছে ওরা। বিজয়কে ও চায় নিজের পাশে।

পাগল নাকি!

বিজয় জানত এই রাজনৈতিক রেষারেষির দৌলতে কি পরিমাণ ভুগতে হয়েছে প্রত্যুষকে। অ্যানাটমি পরীক্ষার দুদিন আগে চুরি হয়ে গেছে ওর Bone set। রেজাল্টের মান সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে গেছে অতল খাদে।

ও বোঝানোর চেষ্টা কম করেনি।

“দেখ আমরা পড়াশুনো করতে এসেছি, পড়ে বেরিয়ে যাব। এইসব ঝুট ঝামেলায় যেচে জড়িয়ে কি লাভ! ওসব ভুলে যা!”

প্রত্যুষ তা পারবে না।

তখন বিজয় সরাসরি বলে দিয়েছিল, “আমি পারব না ভাই এসবের মধ্যে থাকতে। তুই যা খুশি কর”

রেগে গিয়েছিল প্রত্যুষ। কথা কাটাকাটি হয়েছিল চরম পর্যায়ের। ওকে সুবিধাবাদী ভীতু বলতেও ছাড়েনি প্রত্যুষ। ও পাল্টা বলেছিল প্রত্যুষ ঝামেলাবাজ, ঝগড়ুটে।

সবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল প্রত্যুষ।

বিজয়ের খারাপ লেগেছিল। প্রত্যুষ নিজের ভালোটা বুঝছে না। বিজয় বোঝাতেও পারছে না। অন্য সবকিছুতেই প্রত্যুষ বেশ নমনীয়। প্রায় প্রত্যেকটা অনুরোধ সে হাসিমুখে শুনত, এবং কোন কাজে কখনো না বলেছে বলে মনে পড়ে না। কিন্তু এই রাজনীতির ব্যাপার উঠলেই ও একেবারে ইস্পাতকঠিন। শীতল। মনে হয় যেন প্রানহীন নির্দয় যন্ত্র একটা।

বিজয়ের পড়াশুনা ছিল, নিজের জীবনটা ছিল। এই বিরোধী দলের বিপদজনক রাজনীতি করা একেবারেই ‘বুদ্ধিমান’এর কাজ হবে না। য পলায়তি স জীবতি।

তাছাড়া ততদিনে বিজয়ের জীবনে এসেছে সুপর্ণা।

ওর ফর্সা গায়ের রং, কুচকুচে কালো আজানুলম্বিত চুল, আর কাজলটানা চোখ দেখে বিজয়ের মনে হয়েছিল, রাজকুমারী।

একদম রূপকথা থেকে উঠে এসছে।

দূর থেকেই প্রথম প্রথম দেখত বিজয়। তারপর একদিন লাইব্রেরীতে কথা বলার সুযোগ হল।

কলেজের লাইব্রেরী ঘরটা খুব মনোরম। বাইরে থেকে রোদ এসে পড়ত কাচ ভেদ করে, তাতে তাপ থাকত না, কিন্তু হলদে মোলায়েম আভাটা খুব উপভোগ্য ছিল। এরকম রোদ মন ভালো করে দেয়।

এসি চলছিল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে ছাত্রছাত্রীরা, বিজয় বসেছিল জানলার ধারে। বইটা     সামনে খুলে একটু অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়েছিল বাইরে।

সুপর্ণা এসে ওর সামনের চেয়ারটায় বসল।

ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, কি যে হবে, কমিউনিটি মেডিসিন কিচ্ছু পড়া হয়নি আমার! এদিকে থার্ড প্রফ এসে গেল প্রায়!

বিজয়ের অবস্থাটাও মোটামুটি একরকম ছিল। কিন্তু তার গুণ হল, সে সহজে প্যানিক করে না।

সে বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়েই সুপর্ণাকে আশ্বস্ত করেছিল, সে আমারো অনেকখানি বাকি পড়া, কিন্তু এটা manageable, করে ফেলা যাবে।

কিভাবে? জিজ্ঞেস করেছিল সুপর্ণা।

বিজয় হঠাৎ ব্যাপারটা যেন উপলব্ধি করল। তার টেবিলের উল্টোদিকে বসে আছে সেই মেয়েটা যার মুখ চোখের গড়ন তার প্রতিদিনের নিরীক্ষণের বিষয়, যার জন্ম নিয়ে সে ভাবে হয়ত তা রূপকথার যুগে, যার কণ্ঠস্বর ওর দুর্বল হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়িয়ে দেয় বিপদজনকভাবে!

আর সেই ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যে’ তাকে জিজ্ঞেস করছে ‘কিভাবে’?

তাকে!

বাইরের রোদটা আরও কয়েকগুণ মনোরম হয়ে উঠল। ও চেয়ারটা টেনে নিয়ে গেল সুপর্ণার পাশে। পার্কের বইটা খুলে সে দেখাতে লাগল কোথায় কোথায় দাগ দিয়ে রেখেছে, কোন অংশটা থেকে প্রফে প্রশ্ন হবে।

সুপর্ণার অখন্ড মনোযোগ অবশ্যই বইয়ের পাতায় ছিল (যদিও বলা যায় না), কিন্তু বিজয়ের অবস্থা তখন শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মাঝখানে পড়ে যাওয়া একটা ছোট্ট অসহায় কম্পাসের মত।

ওর কাঁধ সুপর্ণার কাঁধে স্পর্শ করে আছে। ওর নাকে আসছে সুপর্ণার চুলের মিষ্টি গন্ধ। চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। বুকে রীতিমত প্যালপিটেশন শুরু হয়ে গেছে। অজ্ঞান হয়ে যাবে নাকি!

এইভাবেই শুরু হয়েছিল ব্যাপারটা। যেভাবে যে কোন মেডিক্যাল কলেজে শুরু হয় এই ধরণের গল্প। প্রয়োজনের ভিত্তিতে। সবথেকে ভালো এবং গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা মানুষ মেডিক্যাল কলেজে এসে শেখে, তা হল, অপ্রয়োজনে কাহারও সহিত কদাচ সময় নষ্ট করিও না। পরবর্তীকালে শিরঃপীড়ার কারণ হইতে পারে।

এই অলিখিত নিয়মের অন্যথা করে কাউকে ভালো থাকতে দেখেনি বিজয়।

অরিজিতের কথাই ধরা যাক। ছেলেটা জগতের ঘোরপ্যাঁচ ভালো করে বুঝে আসেনি। অনসূয়া তাকে কি চোখে দেখত সে যাচাই করে নেওয়ার কথাও ভাবেনি। জগতের আর পাঁচটা নভিসের মত তার মনেও বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল, সে কাউকে যে নজরে দেখবে, সেই ব্যাক্তিও তাকে একই নজরে দেখবে।

মুখে সে কখনো কিছু না বললেও তার সরল মনের কোণে কোথাও একটা আশ্বাস ছিল, যে অনসূয়া এত ঘনিষ্ঠভাবে তার সাথে কথা বলছে যখন, সব কাজেই তাকেই আগে অনুরোধ করছে যখন, তখন নিশ্চয় তার প্রতি অনসূয়ার একটা আলাদা নির্ভরশীলতার জায়গা রয়েছে।

এটা সে খুব ঘনিষ্ঠ মহলে বলতও। স্বপনের কাছে, বা বিজয়ের কাছে। প্রত্যুষ ততদিনে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন- গোটা জগত থেকেই। তার কাছে কিছু বলার প্রশ্নই ওঠে না। স্বপন আর বিজয় অরিজিতকে আঘাত করতে চায়নি, কিন্তু তার অতিসরলীকৃত ব্যাখ্যাটা মেনে নিয়ে ওকে ভুল পথে চালিত করতেও ইচ্ছে করেনি ওদের। আকারে ইঙ্গিতে বিজয় এবং স্বপন রুঢ় পরিষ্কার ভাষায় ওকে বুঝিয়েছে, ভাই এতটা জড়িয়ে পড়িস না, এতটা আশাও করিস না। শেষ অব্ধি তুই যেভাবে ভাবছিস ব্যাপারটা সেভাবে শেষ না-ও হতে পারে।

অরিজিত মুখে বলত, না না আমি কি আশা করব, কোন আশাই করি না।

কিন্তু ওর স্বপ্নালু চোখের মধ্যে স্পষ্ট দেখা যেত কোন কাল্পনিক ভবিষ্যতের ছবি, একটা পরিচিত হাতকে মুঠোয় ধরার স্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা, একটা শূন্য মনকে পছন্দের সামগ্রীতে সাজিয়ে তোলার অদম্য বাসনা।

সেটা দেখেই ভয় পেত ওরা।

স্বপন তো রীতিমত গালাগালি দিয়েও ওকে বোঝাতে পারল না। অরিজিত গম্ভীর মুখে উঠে ছাদে চলে যেত। নিজের মনে গজগজ করত পোড়খাওয়া স্বপন।

“মরল; মরল ছেলেটা”

সেই দিনটা সত্যিই এল শেষে।

সেদিন বিকেলটা ছিল ভারি সুন্দর। সারাদিনের গরমে হাঁপিয়ে উঠে শেষে বিকেলটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ছে মৃদুমন্দ হাওয়ায়, সূর্যের কঠোর রোদ ম্লান হয়ে মৃদু হাসির মত এলিয়ে পড়ে আছে রাস্তায়; ঝিমিয়ে পড়েছে ঘূর্ণি ধুলো। জ্বলাপোড়া গাছগুলো অল্প অল্প মাথা নেড়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। পাখিরা দলে দলে শ্রান্ত শরীরটা টেনে বাসায় ফিরছে; তাদের কাকলিতে মুখরিত হয়ে আছে হস্টেলের সামনের শান্ত রাস্তাটা।

অরিজিতের ফোন বেজে উঠল। অনসূয়া।

এমন সুন্দর বিকেলে এর থেকে বেশি কাম্য আর কিই বা হতে পারে।

ফাইন্যাল ইয়ার শেষ হয়ে এসছে তখন।

অনসূয়ার প্রতিটা ফোনেই অরিজিত আশা করত, এবার হয়ত কোন দরকারে নয়, শুধুমাত্র ওর মুখটা একবার দেখার জন্য, বা ওর কথা শোনার জন্য ডাকছে অনসূয়া। কিন্তু আজ অব্ধি ওর সেই আশার বাস্তবায়ন হয়নি।

আজও কিন্তু আশা করতে ভুলল না সে।

আর অবাক কান্ড।

অনসূয়া আজ ওকে বলল না কোন নোটস নিয়ে আসতে, বা কোন বইয়ের পাতা জেরক্স করাতে। সে খালি বলল, এমনি ফোন করেছি। হোস্টেলের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। পারলে আয়।

অরিজিতের বুকে তখন হৃৎপিণ্ডটা যেন দামামা পিটছে।

আজই কি সেই পরম আকাঙ্খিত দিন?

একটা ভালো জামা গলিয়ে নিয়ে, চুলে চটপট একটু জল লাগিয়ে বেয়াড়া চুলগুলোকে বসিয়ে নিয়ে একঝলক আয়নাটা দেখেই নিচে নেমে গেল অরিজিত।

ফিরে এল মিনিট পনেরো পরেই।

কিছু বলছে না মুখে।

এসেই বিছানার উপর বসে পড়ল। কিছুক্ষণ মেঝের দিকে চেয়ে রইল। বিজয় একটু অধৈর্য হয়ে পড়ছিল, কিন্তু স্বপন হাতের ইঙ্গিতে ওকে চুপ থাকতে বলল। ওরা ভাবছিল, ব্যাপারটা নিশ্চয় ঠিকঠাক পথে যায় নি। কিন্তু কি হয়েছে আন্দাজ করা মুশকিল…

তবে ওদেরকে কিছু বলতে হল না। অরিজিত নিজেই মুখ খুলল। মেঝের দিকে চেয়েই সে বলতে শুরু করল হঠাৎ-

“অনসূয়া নিচে ডেকেছিল। ওর বন্ধুর সাথে আলাপ করিয়ে দেবে বলে। বন্ধু মানে ঠিক বন্ধু নয়। ওদের বাড়ির কাছে থাকে, অনেকদিন ধরে চেনে, ওর থেকে সিনিয়ার এইসব আমতা আমতা করে বলে শেষে আসল কথাটা বলল, ছেলেটি ওর ‘more than friend’ কিন্তু আরো স্পষ্ট কথাটা ওই ছেলেটাই বলে দিল, ‘আরে বাবা এত লজ্জা কিসের, বলো না তোমার হবু বর’, তো সেই শুনে লজ্জায় লাল হয়েটয়ে ধ্যাত ট্যাত বলে তাও শেষে মেনেই নিল, বলল, ‘হ্যাঁ রে, ঠিকই। তো ও এসেছিল আমায় দেখতে, বহুদিন দেখেনি তো, ভাবলাম আমার এত close friend আছে অরিজিত, ওর সাথে দেখা না করিয়ে দিলে অন্যায় হবে, তাই নিয়ে এসেছি…”

একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে থামল অরিজিত। মেঝে থেকে চোখ না তুলেই। হয়ত চোখের জল লূকাচ্ছে। ওরা ওকে সময় দিল ধাতস্থ হওয়ার।

অরিজিত আবার মুখ খুলল। এবার ওর স্বরে তীব্র ব্যঙ্গ।

“close friend! এতদিনে নিজের যোগ্য designation টা পেলাম, বুঝলি!”

আবার চুপ।

ওরা পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এটা প্রত্যাশিতই ছিল, কিন্তু এরকম নির্লজ্জ বেশরম একটা পথে তা হবে ওরা ভাবতে পারেনি। ওকে কি সান্ত্বনা দেওয়া উচিত, নাকি…

ওদের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে হঠাৎই হোস্টেল কাঁপিয়ে হেসে উঠল অরিজিত। প্রাণ খুলে। স্বপনের পিলে চমকে গেল। বিজয়ের হাত থেকে পেন পড়ে গেল মাটিতে। অরিজিত হেসেই চলেছে। সারা দুনিয়া কাঁপছে।

বিজয় যেটা বুঝতে পেরেছিল সেদিন, ওই অমানুষিক হাসিটা দরকার ছিল, ওটাই দরকার ছিল, কারণ, অরিজিতের যাবতীয় স্বপ্নের তাসের ঘর ভেঙে ফেলার দরকার ছিল একটা জোরালো ভূমিকম্পে- অরিজিত নিজের হাতেই সেই প্রলয় সৃষ্টি করেছিল। তার হাসির প্রতিটা ধাক্কা ব্যাঙ্গের তীক্ষ্ণ বল্লম হয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল শিশুসুলভ স্বপ্নবিলাসের অপ্রয়োজনীয় মিথ্যে প্রবোধগুলিকে।

অরিজিত একদিনে অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছিল সেদিন।

বিজয়ের ক্ষেত্রে কিন্তু এরকম হয়নি। ও বাস্তবতাটাকে এক মুহূর্তের জন্যও অস্বীকার করেনি। স্বপ্ন ও-ও দেখেছে, কিন্তু সেটা যে স্বপ্নই, বাস্তবের কোন বাধ্যবাধকতা নেই তার পথেই চলার, সেটাও সে মাথায় রেখেছে।

সুপর্ণা অগোছালো। বিজয় অত্যন্ত organized স্বভাবের। ও সুপর্ণাকে বলে দিত ঠিক কিভাবে পড়লে অল্প সময়ের মধ্যে সবটা শেষ করা যায়। তার জন্য সুপর্ণা যথেষ্ট কৃতজ্ঞ ছিল ওর প্রতি।

একসাথে পড়া থেকে শুরু হয়ে একসাথে ঘোরার পর্যায় পেরিয়ে ওরা যখন একসাথে খেতে বেরনোর পর্যায়ে পৌঁছল, যাকে পোশাকি নামে ডাকা হয় dating, তখন এসে প্রথম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল বিজয়। এর আগে অবধি একটা মুহূর্তের জন্যও সে নিজের স্বপ্ন ও বাস্তবকে মিশে যেতে দেয়নি, কড়া শাসনে রেখেছে, ক্রমাগত বলেছে, এর মেয়াদ প্রয়োজন ফুরানো পর্যন্ত। তার পরে নাও থাকতে পারে।

কিন্তু পরিচয়টা প্রয়োজনের ভিত্তিতে হলেও মেয়েটা ওকে কিন্তু আঁকড়ে ধরল সারা জীবনের জন্যই। কোন এক পড়ন্ত বিকেলে তার সুগন্ধি চুলগুলো যখন অবাধ্য হয়ে উড়ে আসছিল ওর সুন্দর মুখটার উপরে, কারণ হাওয়াটাও ছিল অপার্থিব, আর কি যেন একটা অদ্ভূত অনুভূতি, সব মিলিয়ে সুপর্ণার মাথাটা প্রায় স্বয়ংক্রিয় ভাবে হেলে পড়েছিল বিজয়ের কাঁধে।

একটাও অদরকারি কথা উচ্চারিত হয়নি, অথচ সমস্ত বোঝাপড়া হয়ে গেছে।

বিজয় জানে না এটাকেই ভালোবাসা বলে কিনা, তবে সে জানে, এই সুখানুভূতিটার নেশা অপূর্ব;

সে নিজেকে এখন ভাগ্যবান মনে করে।

এই সুপর্ণাই একদিন তাকে বুঝিয়েছিল। সেই যখন সে একটু দ্বিধান্বিত, প্রত্যুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নামবে কিনা।

বলেছিল, “তুই তো স্টুডেন্ট। দুদিন পর ইন্টার্ন হবি।  তোর এখন দেওয়ার মত কিছুই নেই। কিন্তু চাওয়ার অনেক কিছু আছে। তুই যদি এখন প্রত্যুষের সাথে যাস, তোর যা আছে, সব কিছু হারানোর ঝুঁকি তোর চিরসঙ্গী হবে, আর যা যা চেয়ে পাওয়ার ন্যূনতম আশাও এখন আছে, তখন আর তা থাকবে না”

আরও বলেছিল, “এই সময়ে যদি তাও তোর মনে হয়, you want to make a difference, তোর উচিত যেদিকে জোর বেশি, যেদিকে লোক বেশি, সেদিকে যাওয়া। রাজনীতি যদি করতে হয়, ruling partyএর হয়ে কর। হারানোর কিছু নেই। কিন্তু জীবনটা গড়ে নেওয়ার একটা অন্তত helpline হাতের সামনে থাকবে বিপদের সময়ে”

বিজয়ের ভুরু কুঁচকে গেল। প্রত্যুষের রুক্ষ স্বরটা মনে পড়ে গেল-

‘ভীতু, কাপুরুষ, সুবিধেবাদী’

পরক্ষণেই কিন্তু একটা অনেক মিষ্টি আর মার্জিত স্বর অনুনয়ের সুরে ওকে বলল, “এই বিপদজনক পথে তুই যদি যাস, আমার কি হবে, আমায় কে দেখবে? বল? আমি কি কেউ না?”

সব দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, বিবেক-টিবেকের ঝুট ঝামেলা মিটে গেল মুহূর্তে।

উফফ, মানবিক সম্পর্ক কি অসাধারণ সব miracleই না ঘটাতে পারে!

এর পরের কয়েকটা দিন কি দ্রুতই না কেটে গেল। অনিমেষ, কলেজের রাজনৈতিক দাদাদের পয়লা নম্বর ডানহাত এসে বিজয়কে বলল, কোনরকম রাখঢাক না করে-

“ভাই তোকে আমাদের দরকার। তোর যথেষ্ট popularity আছে। তোকে শুধু কয়েকটা মিটিঙে যেতে হবে, কয়েকজনের সাথে দেঁতো হেসে কথা বলতে হবে, আর একটু তলে তলে, ছেলেদের একটু করে যাকে বলে manipulate করে রাখতে হবে। বুঝলি?”

পাকা খেলুড়ের মত পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল বিজয়, “এতে আমার লাভ?”

হেসে ওকে জড়িয়ে ধরেছিল অনিমেষ। এখানেও অদরকারী কোন কথা উচ্চারিত হয়নি। সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলিটাই একটা অতি গোপনীয় ভাষা। তার ব্যখ্যা নিষ্প্রয়োজন শুধু নয়, অবাঞ্ছনীয়ও।

একদিন প্রত্যুষ ওকে দেখে ফেলেছিল। একটা মিটিং থেকে ফেরার সময়ে, অনিমেষের সাথে। দূর থেকে দেখেই অন্যদিকে চলে গেল। যাওয়ার আগে একটা অদ্ভূত হাসি হেসে গেল। কি যে হাসিটার মানে, বিজয় বোঝেনি। কিন্তু ভঙ্গিটা যেন সজোরে এসে ধাক্কা মেরেছিল ওর বুকে।

অনিমেষ প্রত্যুষকে দেখেছিল। দুটো নোংরা গালাগালি দিয়ে বলেছিল, “ওই হারামজাদার সাথে এখনও কথা হয় তোর?”

“না” মাথা নেড়ে বলেছিল বিজয়। বলতে ভালো লাগছিল না ওর।

“ভালো” একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “ছেলেটা সুবিধের নয়। ওর থেকে দূরে থাকিস। খবর পেয়েছি ও ঘরে ঘরে গিয়ে কিছু জুনিয়রকে বোঝাচ্ছে। তারা কেউ ওসব ফালতু কথা শোনেনি অবশ্য। দুএকজন তো ওকে একেবারে দূর করে দিয়েছে”

শুনে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল বিজয়ের, এই অবস্থা হয়েছে প্রত্যুষের? ওকে ঘরে ঘরে যেতে হচ্ছে তাও কেউ দাঁড়াচ্ছে না ওর সাথে? সত্যিই শেষে একঘরে হয়ে গেল ও? নিজেকেই যেন কিছুটা অপরাধী লাগে।

শেষ ও শুনেছিল প্রত্যুষেরও একটা মেয়ের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। কিন্তু সেটাও বেশিদূর এগোয়নি। ওর এই একগুঁয়েমির জন্য। সহজেই অনুমেয়, মেয়েটি চায়নি প্রত্যুষ এভাবে নিজেকে বিপদের মুখে ফেলুক। কিন্ত প্রত্যুষ শোনেনি। বিজয় সুপর্ণার অনুরোধ রেখেছিল। প্রত্যুষ রাখতে পারেনি।

প্রত্যুষের একাকীত্বের দায় যেন ক্রমশই চেপে বসছে বিজয়ের বুকে।

চা সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল। ডিম টোস্টটা খেয়ে উঠে পড়ল বিজয়। টাকা চুকিয়ে হাঁটতে লাগল হোস্টেলের দিকে। পথে একটা মাঠ পড়ে। এখানে কত খেলেছে ওরা। ক্রিকেট টুর্নামেন্ট পর্যন্ত হয়েছে। এখন কেমন একটা ভুতুড়ে পরিত্যক্ত চেহারা হয়েছে মাঠটার। তারা চলে যাওয়ার পরও কতজন খেলবে এখানে। ওদের স্মৃতির ছায়ামূর্তিগুলো বসে দেখবে সেই খেলা।

মনটা একটুও ভালো লাগছে না বিজয়ের।

দেখতে দেখতে কেটে গেল মেডিক্যাল কলেজের বছরগুলো। কোথা দিয়ে কোথায় ছিটকে পড়ল পুরনো দিনের বন্ধুরা। তাদের আশা, আকাঙ্খা, স্বপ্নগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে রইল ফেলে আসা পথের উপরে। কেউ আর তার কাছে ফিরে গিয়ে জানতে চাইল না তারা কেমন আছে। ওদের উপর এখন কেবল একাকী শিশিরের প্রলেপ পড়ে, ধূলো ওদের মৃতদেহ ঢেকে দেয়। ক্রমশ ওগুলো মিশে যাবে মাটিতে, যেভাবে মিশে গেছে আরও কতশত স্বপ্ন। আর সেই ছেলেমানুষি বাসনা গুলোর বীজে জন্মাবে নিষ্পাপ সবুজ গাছ, দুলবে নিঃশব্দে। তাদের কত কিই বলার থাকবে। কিন্তু সে ভাষা আর এই উচ্চশিক্ষিত ফিটফাট মস্তিষ্কে ঢুকবে না। কেঁদে কেঁদে ফিরবে প্রবল গ্রীষ্মের দুপুরের তৃষ্ণার্ত শুকনো বাতাসের ঘূর্ণির মত; অতৃপ্ত প্রেতের ছদ্মবেশে।

ডাক্তারি শিখতে এসেছিল তারা।

শিখেছে বইকি।  প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় তাদের চেতনা পুড়ে পরিণত হয়েছে।

হাসপাতালের ভিতরের অজানা আতঙ্কের বার্তাবাহী গজ-ওষুধ-রক্তের গন্ধটা এখন হয়ে গেছে বাবা-মা এর গায়ের গন্ধর মত চেনাপরিচিত।

ডাক্তারি অভিজ্ঞতাও কি কম হয়েছে?

ঘরে পৌঁছেছে বিজয়। আর কিছু নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে না তার। খুব ক্লান্ত লাগছে। লাইট নিভিয়ে দিল সে। ফাইন্যাল ইয়ারে তারা নতুন হোস্টেল পাওয়ার পর থেকে একলা রুমে থাকার সুযোগ পেয়েছে, একটা সুবিধে যে কোন সময়ে লাইট নিভিয়ে দেওয়া যায়, রুমমেটের কথা ভাবতে হয় না।

লাইট নিভিয়েও ঘুম আসছিল না তার।

ছাদের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেল, এই মেডিক্যাল কলেজে সুপর্ণাই তার একমাত্র প্রেম নয়।

এখানেই সে মেডিসিনের প্রেমে পড়েছে। কিভাবে! সেও এক গল্প।

প্রত্যুষ বলত, এই সাড়ে চার বছরের পড়াশুনোর সঙ্গে গুঁতোগুঁতি না করে বন্ধুত্ব পাতিয়ে নেওয়াই ভালো। কাউকে ভালোভাবে জানতে গেলে আগে তার ভালো বন্ধু হতে হয়। প্রত্যুষের এই কথাটা বোধহয় ভুল ছিল না।

মেডিসিনের সাথে বন্ধুত্ত্ব পাতাতেই গিয়েছিল বিজয়। খানিকটা পরীক্ষামূলকভাবেই। সেটাই যে শেষ অবধি পর্যবসিত হবে প্রেমে, কে জানত।

বেশ মনে আছে, একদিন ক্লাসের পরে মেডিসিন ওয়ার্ডেই থেকে গিয়েছিল বিজয়। একজন ইন্টার্ন দাদা ছিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর যিনি ডিউটিতে ছিলেন, তিনি বসে ছিলেন নিচে, এমারজেন্সি রুমে। সমস্ত পেশেন্ট যারা ভর্তি হচ্ছিল, একেবারে দেখে পাঠাচ্ছিলেন।

একটা পেশেন্টকে উপরে আনা হল ট্রলিতে। পেশেন্ট আচ্ছন্ন, ভালো করে কথা বলতে পারছে না। ইন্টার্ন ছিল রাবিউলদা। সে বারবার জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে, পেশেন্টের বাড়ির লোক খালি জানায় তারা কিছুই জানে না, ভালোই ছিল হঠাৎ এরকম হয়ে গেল। রাবিউলদা বিজয়কে বলল, দেখ, স্ট্রোক বোধহয়। বয়সটাও সেরকম।

টর্চ বের করে মণিরন্ধ্র দেখতে গেল রাবিউলদা। চোখের পাতা আর খুলতে পারে না রোগী। যেটুকু দেখা গেল, অস্বাভাবিকত্ব কিছু নেই লাইট রিফ্লেক্সে। পকেট থেকে চাবি বের করে প্ল্যান্টার রিফ্লেক্স দেখতে যাবে, হঠাৎ চোখ পড়ল বেড হেড টিকেটে, স্যারের হাতের লেখা, ডায়াগনোসিস লেখা আছে ‘স্নেক বাইট’, নিচে ‘?নিউরোটক্সিক’। তারপর সেই অনুযায়ী ওষুধ লেখা।

রাবিউলদা রোগীর বাড়ির লোককে জিজ্ঞেস করল, “সাপে কেটেছিল?”

তারা তো আকাশ থেকে পড়ল।

কই না তো ডাক্তারবাবু!

বারবার একই প্রশ্ন করে গেল রাবিউলদা; উত্তরও পালটাল না।

“তো এখানে সাপে কাটা রোগী লেখা আছে কেন?”

রোগীর সঙ্গে থাকা একটা মুশকো লোক তো আস্তিন গোটাতে শুরু করেছে!

কি চিকিৎসা করবে ডাক্তার? ভুলভাল লিখে পাঠিয়েছে?

রাবিউলদা একদিকে ওদের ঠান্ডা করছে, অন্যদিকে স্যারকে ফোন করছে।

স্যার কিন্তু ফোন পাওয়া মাত্র ছুটে এলেন।

ওদের নিয়ে কেবিনের মধ্যে ঢুকে পেশেন্টকে ঢুকিয়ে বাড়ির লোককে বের করে দিলেন।

তারপর রাবিউলদার দিকে তাকিয়ে বললেন, “patient did not give any history of snake bite!”

রাবিউলদার তো বিষম খাওয়ার যোগাড়। তবে কি স্যার ভুল করে লিখলেন?

“কিন্তু স্যার BHTতে তো আপনি…”

“আমি জানি আমি কি লিখেছি”

শান্তভাবে বললেন স্যার।

“এদিকে এসো”

স্যার সযত্নে পেশেন্টের একজ্যামিনেশন শুরু করলেন।

“পেশেন্ট semiconscious, বয়স দেখে তুমি ভাবছ cerebral stroke, বেশ, দাঁড়াও… pupilary reflex normal, uniform on both sides, নিচে যাও, planter দেখো। কি? Flexor… ঠিক কিনা? বিজয়, pressure মাপো। কত? 136/90, অর্থাৎ বয়স অনুপাতে স্বাভাবিক। হম। stroke হওয়ার সম্ভাবনা কম, কি বল? Diabetic coma? CBG কর। তাড়াতাড়ি। কত এল? 112 mg/dL, আবার স্বাভাবিক, কি তাই তো! দাঁড়াও, আচ্ছা তুমি পেশেন্টের general survey করেছ? নজর করেছ ওর চোখের পাতা কেমন ঢুলুঢুলু? Ptosis? কেন? হম, মনে রাখো। আচ্ছা, এটা তো syncope হতে পারে, একবার chestটা auscultate কর তো! কি? কি শুনলে? Heart normal, কিন্তু rhonchi আছে, কেন? আচ্ছা রোগী তো পুরো অজ্ঞান নয়, ওকে বল তো ১ থেকে ২০ গুনতে। পারবে? দেখোই না! কি? কি দেখলে? কত অবধি? মাত্র ৫? হুম। এটাকে single breath count test বলে, মনে পড়ছে? ওর respiratory muscle paralyzed হয়ে আসছে। কেন? চল তো পাটা আরেকবার খুঁটিয়ে দেখি। নাহ, কোন oedema নেই। ওই পা? না, no oedema, আরে অত তাড়া কিসের? এটা কি? এটা দেখতে পেলে না?

ওরা ঝুঁকে পড়ল স্যরের দেখানো ছোট্ট বিন্দুটার উপর।

খুবই ছোট, কিন্তু তাও বোঝা যাচ্ছে, দুটো দাঁতের স্পষ্ট দাগ।

“অনেক সাপের কামড় রোগী বুঝতেই পারে না। ব্যথা, ফোলা ভীষণ অল্প হয়। ওর pulse দেখো। একটু slow, তাই না? বিষ acetyl cholinesterase এর উপর কাজ করছে, পরাসমবেদী বা parasympathetic neurotransmitter acetyl choline কে ভাঙতে দিচ্ছে না, তাই parasympathetic overdrive হচ্ছে। কি? বুঝলে আমি কি লিখেছি আর কেন লিখেছি? এবার এসো”

ওরা আবার বাইরে এল। উৎকণ্ঠিত পেশেন্ট পার্টির লোককে স্যার আবার জিজ্ঞেস করলেন, “সাপ-টাপ কামড়েছিল? বা নিদেনপক্ষে কোন পোকা কামড়ানোর কথাও কি বলছিল?”

“না কতবার বলব, না!”

স্যার কিন্তু রাগলেন না। আবার জিজ্ঞেস করলেন।

“একদম ঠিকঠাক ছিল, তাই না? আচ্ছা, বাথরুম করতে গিয়েছিল? সেখান থেকে ফিরে এসেই এরকম শুরু হল হঠাৎ, তাই না?”

ওদের মুখচোখ পালটে গেল। এ ওর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর একজন বিস্মিত কন্ঠে বলল, “একদম তাই ডাক্তারবাবু, আপনি কিভাবে…?”

স্যার রাবিউলদার দিকে ফিরলেন এবার “মেডিসিনটা শুধু বই নয়, বুঝলে? বইয়ে কিছু theory লেখা থাকে। সেটা তো লাগবেই। কিন্তু তার সাথে তোমাকে মিশিয়ে নিতে হবে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। কেউ সেটা তোমায় শিখিয়ে দেবে না, নিজেকেই অর্জন করতে হবে। তুমি যে জায়গায় কাজ করছ সেখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবন, তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা, তাদের সংস্কৃতি, সবই তোমার জানা থাকতে হবে, তবেই তুমি একজন exceptional physician হয়ে উঠবে। এদের ঘরের মধ্যে attached bathroom থাকে না। খাটা পায়খানা, বা এমনকি sanitary latrine হলেও সেটা থাকে ঘর থেকে দূরে। পেশেন্ট বাথরুম থেকে ফেরার পথে ঘেসো জমিতে সম্ভবত সাপের কামড় খায়, বুঝতেও পারেনি। ওর যা যা sign symptoms দেখলে, bilateral drooping of eyelids, respiratory distress, poor performance in single breath count test সবই নির্দেশ করছে ওই একটাই diagnosisএর দিকে। neurotoxic snake bite।সবসময়ে পেশেন্টের chief complaint এর উপর, বা এই অল্প শিক্ষিত গরীব লোকগুলোর দেওয়া history এর উপর নির্ভর করা যাবে না। নিজের ঘিলুটাকে একটু খাটাতে হবে, ঠিক কিনা? ওর 20 minutes Whole blood clotting time দেখ। কিন্তু তার আগেই fluid দাও, oxygen লাগাও, 10 vials AVS চালু কর, আধ ঘণ্টা অন্তর neostigmine 0.5mg ইঞ্জেকশন দাও, প্রতি তিনটে ইঞ্জেকশনের পর শটে Atropine ইঞ্জেকশন। পার্টিকে বলে রাখো, mechanical ventilation আর dialysis দরকার হতে পারে, ওরা যেন CCUতে কথা বলে রাখে”

স্যার বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার পথে মুশকো গুন্ডার গোটানো আস্তিনের দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মাথা উঁচু করে চলে গেলেন। গুন্ডা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

বিজয়ের মনে হল, সে সাক্ষাৎ ভগবান দেখতে পেল চোখের সামনে। আর সেই ছবিটা আরও উজ্জ্বল হল যখন ওর চোখের সামনে দেখতে পেল আধঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরও জমাট বাঁধল না রোগীর রক্ত।

স্যারের কথা ওরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। নার্স দিদিরা সারা রাত জেগে ওষুধ দিয়ে গেছিলেন আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর। পরের দিন যখন সকাল বেলা উঠে বসে পেশেন্ট একটু জল খেতে চাইল, রোগীর বাড়ির লোক চিৎকার করে আল্লাকে ধন্যবাদ জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাবিউলদা বা বিজয় কেউই ঘরে যায়নি। রাবিউলদা ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আল্লাকে অনেক ধন্যবাদ জানানোর সুযোগ পাবে, যে ডাক্তারবাবু তোমার পেশেন্টকে বাঁচালেন তিনি আর আধ ঘন্টা পর বেরিয়ে যাবেন”

তৎক্ষণাৎ ওরা ছুটল নিচে ডক্টরস রেস্ট রুমের দিকে। যেখানেই পাবে স্যারের পায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। মুশকো ছুটলো সবার আগে।

বিজয় এই প্রথম বুঝল, কি ভয়ানক সম্মান ও প্রতিপত্তির একটা আসন পেতে চলেছে তারা। আর তার যোগ্য করে তুলতে হবে তাকে নিজেকে। নইলে, আর যাই হোক, এই দিনের পর আর নিজেকে সম্মান করতে পারবে না সে, তা সে যত ডিগ্রীই হাসিল করুক।

আরেকদিনের কথা। এরকমই মরণাপণ্ণ একটি রোগীকে নিয়ে আসা হয়েছে। capillary blood glucose  মাত্র 11 মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার।

এখুনি ২৫% ডেক্সট্রোজ চালাতে হবে।

সে না হয় হল। কিন্তু শিরায় চ্যানেল করা যাচ্ছে না।

স্যার এলেন। র‍্যাঙ্কে তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। এসব কাজ দেখে তাঁর নাক কুঁচকানোর কথা।

কিন্তু তিনি তা করলেন না। হাতে চেষ্টা করলেন, হল না। পায়ে, না হল না। ভেনেসেকশন করতে হবে। কিন্তু তাতে সময় যাবে, সার্জনকে ডাকতে হবে। তাই আরেকটা শেষ চেষ্টা তিনি করলেন।

পেশেন্টের কাপড়টা নামিয়ে কুঁচকিতে inguinal ligament খুঁজে বের করলেন। তারপর দুটি হাড়ের মাঝে mid-inguinal point বের করলেন। তার সামান্য নিচে যেতেই তাঁর হাতে ঠেকল femoral arteryএর স্পন্দন। এবার একটু শুধু medially সরে আসা। ইন্টার্ন সত্যজিতদা একবার স্যারকে একটু সাবধান করার চেষ্টা করল, পদ্ধতিটা blind এবং বিপদজনক এবং এক্ষেত্রে indicatedও নয়, সেটাই বলার চেষ্টা করছিল সে, কিন্তু স্যারের তখন হুঁশ নেই।

সবুজ রঙের আই ভি চ্যানেলটা নিয়ে তিনি নিপুণ হাতে ঢুকিয়ে দিলেন অচৈতন্য পেশেন্টের ওই নির্দিষ্ট অংশে।

রক্ত বেরিয়ে এল চ্যানেলের অপর প্রান্তে।

স্যার অদ্ভূত ক্ষিপ্রতার সাথে ডেক্সট্রোজটা নিয়ে ‘attach’ করে দিলেন চ্যানেলের সাথে। লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে ‘fix’ করে দিলেন।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে কোমাচ্ছন্ন রোগীটি জেগে উঠল। স্যারের সামনেই। আর তার বাড়ির লোকের চোখে কৃতজ্ঞতার যে আলো বিজয় দেখতে পেয়েছিল তার ঔজ্জ্বল্য সূর্যকেও ম্লান করে দেয়।

আঃ… ঘুম আসছে, চারিদিকের অন্ধকারকে আরো অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে ঘুম গিলে ফেলল অবসন্ন বিজয়কে।

মাসখানেক পরের কথা।

রেজাল্ট বেরিয়েছে।

বেশিরভাগ ছেলেই পাশ করে গেছে। সারা হস্টেল জুড়ে খুশির বাতাবরণ। হই হুল্লোড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

ক্যান্টিনে পার্টি হবে। মদের বোতল এসেছে। সাউন্ড বক্স এসেছে। এসেছে খাবারদাবার।

বিজয় বিকেলে সুপর্ণার সাথে বেরিয়েছিল। সারাটাক্ষণ সুপর্ণা ওর হাত ধরে ছিল। আর মাত্র একটা বছর। তারপরেই তো একটা বিচ্ছেদ বিচ্ছেদ আবহ। সুপর্ণার হাতের মুঠিটা তাই মাঝে মাঝে খুব শক্ত হয়ে উঠছিল। ফিরে হোস্টেলে ঢোকার মুখে সুপর্ণা একবার চকিতে চারদিকটা দেখে নিয়ে বিজয়ের গালে একটা চুমু খেয়ে ওকে শক্ত করে একবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়েই টুপ করে পালিয়ে গেল।

হোস্টেলের নিচটায় তখন খুব সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। বিজয়ের ঘরে যেতে ইচ্ছে করছিল না, কি সুন্দর একটা বিকেল। একটা সিগারেট ধরিয়ে সে হাঁটতে লাগল, হোস্টেল বিল্ডিং ছাড়িয়ে, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং বাঁয়ে রেখে, ডানদিকে হাসপাতালের দিকে; তারপর হাসপাতাল ছাড়িয়ে ওদের খেলার মাঠ, পুরনো হোস্টেল। সব কত পালটে গেছে। আরো পালটে যাবে সময়ের সাথে সাথে। সে নিজেই কি কম পাল্টেছে? পালটে যাওয়াটাই তো দস্তুর, সময়ের সাথে সাথে নিজেকে পরিপার্শ্বের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া, সেভাবেই তো মানুষ এত বড় হয়েছে, তাই নয়?

তবু ওর মনটা একটু খারাপ লাগছিল। অনেক পুরনো বন্ধু, অনেক বিশ্বাস, অনেক নৈতিকতাকে সে এই বড় হওয়ার পথে নির্মম ভাবে পথে ছেড়ে এসছে। তার কুঞ্চিত বিবেকের গলায় এখনও প্রয়োজনের আঙুলের মারক ছাপ।

উফফ তার মাথাটা খারাপ হয়ে গেল নাকি! নাকি সে ওই ‘হারামজাদা’ প্রত্যুষের কথা ভেবে ভেবে ওর মতই hopeless হয়ে গেল?

দ্রুত পায়ে হস্টেলে ফিরল সে।

সেখানে তখন পার্টি শুরু হয়ে গেছে।

অরিজিত একটা বিশাল হাসি মুখে নিয়ে ওকে অভিবাদন জানাল। সে আজ মস্ত একটা কাজ করেছে। স্বপনও ওর কাজে যার পর নাই সন্তুষ্ট। অনসূয়া এসেছিল আবার ওর ‘হবু বর’কে নিয়ে হোস্টেলের নিচে। ফোন করে ন্যাকামার্কা গলায় বলেছিল, “সব তো শেষ হয়ে গেল, ক্লাসে তো আর দেখা হবে না, ডিউটি আদৌ দেখা হয় কি না কে জানে, প্লিজ একটু নিচে আয় না, আমি আর ‘ও’ এসেছি…”

অরিজিত দোতলার জানলার কাছে এসে নিচে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে দিয়েছে, “না আসতে পারছি না sorry ভীষণ হাগু পেয়েছে” বলেই সপাটে ওদের মুখের উপর জানালা বন্ধ করে দিয়ে চলে এসেছে।

হেসে ফেলল বিজয়। অরিজিতের পিঠ না চাপড়ে পারল না।

পার্টি চলেই চলেছে। উদ্দাম নাচ, সাথে গান, মদের ফোয়ারা। বিজয় সুপর্ণাকে দেখল গ্লাসের পর গ্লাস মুখে তুলছে। দাঁড়াতে পারছে না, অনিমেষের গায়ের উপর ঢলে পড়ল। স্বপন তো জামা খুলে ক্যান্টিনের টেবিলের উপর উঠে পড়েছে, ওদের আর হুঁশ নেই।

প্রত্যুষকে দেখতে পেল না। কোথায় গেল?

অনিমেষকে জিজ্ঞেস করতেই খেঁকিয়ে উঠল, “ও শালার কথা আর বলিস না। শালাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে সবাই। কেউ ওকে দেখতে চায় না। শালা আবার এসে বলে এইভাবে মদ খেয়ে নাচা নাকি ডাক্তারদের মানায় না! কে আমার যুধিষ্ঠির এলেন রে! মাল খেতে দেখি নি ওকে শালা”

সুপর্ণা প্রায় অনিমেষের গায়ের উপরেই পড়ে ছিল, সে এক হাতে বিজয়কে ডাকতে গেল, কিন্তু পারল না, এতটাই বেহেড হয়ে গেছে, খালি মুখে বলল, “ডার্লিং এসো না…”

বিজয়ের হঠাৎ করে বমি পেয়ে গেল।

সে ছুটে বেরিয়ে এল ভয়ঙ্কর আওয়াজ আর আলোর ঝলকানির মধ্যে থেকে। তাড়াতাড়ি লিফটে উঠে টিপে দিল টপ ফ্লোরের বোতাম।

একটু খোলা হাওয়া চাই তার।

ছাদে পৌঁছে একটু স্বস্তি পেল।

একটা সিগারেট ধরাল। বড্ড জোরে হাওয়া দিচ্ছে, একটু শীত শীতও লাগছে। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ।

হঠাৎ নিচে চোখ পড়ল ওর।

ওটা কে যাচ্ছে?

শার্টটা ভীষণ চেনা। ব্যাগটাও।

প্রত্যুষ না?

নির্ঘাত সেই।

গলা ফাটিয়ে ডাকল বিজয়।

“প্রত্যুষ! প্রত্যুষ!”

সে শুনতে পেল না। ক্রমশই আরো দূরে সরে যাচ্ছিল সে, ক্ষুদ্রতর হচ্ছিল ওর রোগা প্যাংলা দেহটা।

রেলিঙের উপর বেপরোয়া ভাবে ঝুঁকে পড়ে আবার ডাকল বিজয়।

“প্রত্যুষ! প্রত্যুষ! দাঁড়া! একটু দাঁড়া!”

প্রত্যুষ শুনতে পেল না। অচিরেই ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তার অবয়ব।

সেই মুহূর্তেই একটা হাড় হিম করা ভয় একটা শীতল স্রোতের মত নেমে এল ওর শিরদাঁড়া বেয়ে। সে পড়ে যাবে! সে পড়ে যাবে!

বড্ড বেশি কিনারায় এসে পড়েছে সে! টাল সামলাতে পারছে না। মদের ফোঁটাগুলো মাথায় দোলা লাগিয়েছে।

একটা হ্যাঁচকা টানে নিজেকে রেলিং থেকে সরিয়ে আনল সে। সিগারেটটা হাত থেকে পড়ে গেছে অনেক নিচে, এখান থেকে আর দেখা যায় না।

ও প্রচন্ড ঘামছে।

সে পড়ে যাচ্ছিল!

প্রত্যুষ চলে গেল!

সবাই যখন আনন্দে মত্ত, একসাথে, প্রত্যুষ একা একা উধাও হয়ে গেল, সবার অলক্ষ্যে।

ওটা কি প্রত্যুষই ছিল?

বিজয়ের মনে হল যেন সে বুঝতে পারছে।

হয়ত রক্তমাংসের প্রত্যুষই ওটা। কিন্তু আসলে সে শুধু একটা রূপক।

ওর সাথে সাথেই ওই গভীর অন্ধকারে মিলিয়ে গেল আজকে, চিরকালের জন্য, বিজয়ের অতীতের সমস্ত ‘ছেলেমানুষি’ আকাঙ্খা, স্বপ্ন, নৈতিকতা, বিবেচনাবোধ। সবকিছুরই একটা মেয়াদ আছে।

তারপরে সেই জিনিস অচল।

যেমন প্রত্যুষ নিজের যে চেহারাটা জোর করে ধরে রেখেছে, সেটা আজ অচল।

সচল শুধু তারাই, যারা মানিয়ে নিতে জানে।

যেমন বিজয়, যেমন অনিমেষ।

বিজয় বুঝতে পারল, আজ সে বড় হল, সত্যি করে। আর একই মুহূর্তে সে বুঝল, একাকীত্বের পথের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সে।

আবার একটা সিগারেট বের করে ধরাল সে।

নাহ, এখন একটু ভালো লাগছে। নিজের কাছে জবাবদিহি করার পর।

সে শুধু একটা জিনিসই ভাবছিল, ওই দূর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে-

ওই যে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল প্রত্যুষ, তার ওপাশে কি আছে?

রাতের ওপাশে তো ভোর থাকে?

কিরকম সে ভোর? অন্যরকম? কে জানে, সেখানে হয়ত এই নোংরা খেলার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হয় না-

যেরকমই হোক, প্রত্যুষ যেন সেখানে শান্তি পায়।

ওর মনটা একটা অদ্ভূত প্রশান্তিতে ভরে গেল। অস্ফুটে সে একবার বলল, “সবাই খুশি থাক”

তারপরে সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে মিশে তার মন সপ্তর্ষি মন্ডলের উপর দিয়ে উড়ে গেল রাতপাখি হয়ে, হয়ত অনেক ফেলে আসা ভোরের খবর নিয়ে আসতে,

একবার জিজ্ঞেস করে আসতে,

“সবাই ভালো আছিস?”

সমাপ্ত

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleমনমর্জিয়াঁ ও রামমন্দির
Next articleজয়-পরাজয়
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments