আবার সেই অপেক্ষা অমৃতা কিছুক্ষনের মধ্যেই এসে পড়বে অনেক দিন পর দুজনে মিলে ভ্রমণে বেরোবে সামনেই বইয়ের দোকান যেমন স্বভাব কন্যার যেখানেই যাক না কেন, আর যতই না থাক বাড়িতে বই- একটা বই সে কিনবেই তাই তো অপেক্ষা করাটা কন্যার কাছে একটা আনন্দl
অমৃতা কে জানিয়ে দিলো, চার নম্বর প্লাটফর্মের মুখে বইয়ের দোকানের সামনেই ঢিপি তে বসে আছেl উত্তর ও এসে গেলো- ” উফফ তোর বই কেনাতেই তো ওদের সংসারটা চলে !”
কলকাতার ট্রাফিক থেকে মুক্তি পেতে প্রায় সবাই একটু তাড়াতাড়ি আসে, কিন্তু কন্যা এসেছে দেড় ঘন্টা আগে , বই পড়বে, লোকজনদের ভালোভাবে দেখবে আর গরমে ঘামবে বলে – এটা কন্যার সব বন্ধুরাই জানে বই তা হাতে নিয়ে বসতে যাবে, হটাৎ একজন প্রচন্ড মোটা ভদ্রমহিলা ধপ করে এসে বসে পড়লেন I তারপর নিজেকে কোনোরকমে টেনে নিয়ে খাম্বাটাই হেলান দিলেন I কন্যার দিকে হেসে বললেন, ” বসো না …I দাঁড়িয়ে আছো কেন ?”
হাতে তার তিনটি ব্যাগ , একটাও মাটিতে রাখবেন না অথচ ধরে রাখতে পারছেন না I একটা ব্যাগ খুলে চেনাচুরের প্যাকেট বার করলেনIকন্যার দিকে এগিয়ে বললেন, “খাও…”
“আরে না না ….আমি এই লাঞ্চ করলাম, ধন্যবাদ I”
“একটুও খাবে না? নতুন প্যাকেট I কিচ্ছু মেশানো নেই…..” বলে হাসতে হাসতে নিজেই খেতে শুরু করেদিলেন I
ভিড়ের মধ্যে বই পড়তে কন্যার খুব ভালো লাগে, সব কিছু এড়িয়ে নিজের ধৈর্য্য আর কন্সেন্ট্রেশন এর এক পরীক্ষা , পাস করতে পারলে সে এক অন্য রোখোমের আনন্দ I বই তা মুখের কাছে টেনে নিয়ে পড়তে গেলো…কিন্তু আজ তার মন নেই l
কিছুক্ষন চেষ্টা করার পর মাথা তুলে চারিদিক দেখতে শুরু করল..Iএই ভিড়ে একজন মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকা যাই না, সবাই কে দেখতে ভালো লাগে, যেন একটা তুলনামুলক বাতাবরণ l এই এখানে আনন্দ, তো ওই ওখানে দুক্ষ , এক দিকে হতাশা অন্য দিকে চেঁচামিচি l এ যেন আর এক গল্প, শুধু বইয়ের পাতায় উঠতে বাকি আর কি…I দূরে কিছু যুবক যখন উত্তেজনার সঙ্গে আলোচনা করছে ঠিক সেই মুহূর্তে এক বৃদ্ধা মহিলা হতাশ হয়ে ব্যাগ এর দিকে তাকিয়ে আছেন I এক পরিবার যখন কোল্ড ড্রিঙ্কস এর গুনতী করছে তখন অন্য দিকে আরেক পরিবার প্রচুর ব্যাগ নিয়ে ভিড় ঠেলে হাটছে l কোথাও ছোট বাচ্চা গুলো গরম অবহেলা করে খেলছে, আবার কোথাও ছোট বাচ্চা ভয়ে ভয়ে বাবার কোল থেকে মাকে একবার দেখে নিচ্ছে……চারিদিকে যেন গল্প হেটে বেড়াচ্ছে l
মাথা এক দিক থেকে আরেক দিক ঘোরাতে ঘোরাতে কখন যে একজন ভদ্রলোক ওই নোনতা খাবারবালা ভদ্রমহিলার পাশে এসে বসেছেন , কন্যা লক্ষ্যই করেনি l এবার যেন কন্যার চোখটা তাঁর ওপর আটকে গেলো l একি এ তো মামা … , ঠিক সেই বাড়িতে রাখা ফোটোটার মতন l ফর্সা , শার্প নাক আর নাকের ওপর কপালের নিচে একটা কাটা-ভরা দাগ l মামার সেই গঙ্গার ঘাটে পড়ে যাওয়ার দাগটা না ? চুলটাও একরকম , কিন্তু কলপ করেছে কি ? মামার তো এখন চুল পেকে যাওয়ার কথা l
হাইট্টাও এক , এমন কি প্যান্টের স্টাইলও ….আচ্ছা মামা কি আমায় চিনতে পারবে ? অনেক বছর আগে দেখা হয়েছিল শেষ বারের মতন , সব পরিবারেই একটা না একটা কাহানি থাকে , তাদের ও ছিল l সব কিছূ পাল্টে গেছিলো l তা মামা স্টেশনে বসে কি করছে ? কোথায় যাচ্ছে ? এটা তো সাউথ যাবার প্লাটফর্ম l এতো না ভেবে …একবার ডাকবো ? নাহ, নিজের মামা কে চিনতে পারবো না …মামা আমায় চিনতে পারবে না ….এটা কি করে সম্ভব ? কিন্তু না জিজ্ঞেস করলে যে কন্যার মাথা ঠান্ডা হবে না l
হটাৎ পাশের নোনতা খাবারোলা ভদ্রমহিলা কন্যার দিকে কত মোট করে তাকালেন ….যেন এবার গিলে ফেলবেন ….
কন্যা আবার অন্য দিকে তাকিয়ে আড় ছোখে সেই “হয়তো মামার ” দিকে তাকালো ….পান পরাগ খাচ্ছেন , মামা কি খেত ? দাদু তো পান খেতেন …আর মামা বোধয় সিগারেট , পান পরাগ তো আমি খেতাম ছোটবেলায় … নাহ আজে বাজে ভাবছি …কি করে যে জিজ্ঞেস করি ? এই ভদ্রমহিলা এতো মোটা আর এতো ভিড়ে-আওয়াজে আমার কথাটা শুনতেই পাবেনা, আর ইনি আমার দিকে আবার বাজে ভাবে তাকাবেন l
প্লাটফর্মে এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে , ট্রেন দিচ্ছে ….আচ্ছা উনি কি আমার ট্রেনেই উঠবেন ? ট্রেন এনাউন্স হইয়াই ভদ্রমহিলা নড়ে বসলেন , বোধয় এগোবেন …..ভালোই হলো ….l
পাঁচ মিন , দশ মিন , এই মহিলা উঠছেন না কেন ? দূর থেকে একটা মেয়ে ছুটে এলো , “মা – চলো ট্রেন দিয়েছে” ….এবার তিনি উঠলেন , ফিরে তাকালেন কন্যার দিকে, খুব খারাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন ….আজকাল কার মেয়ে গুলো ছেলেদেড় বাড়া …আগে ছেলে গুলো হা করে তাকিয়ে থাকতো ….এখন মেয়ে গুলো তাকিয়ে থাকে ….উফফ !!!
বেপাত্তা করে এবার কন্যা ‘ হয়তো ‘ মামার দিকে তাকালো ….কিন্তু উনি ফোন এ বেশতো … এসএমএস করছেন l আবার এনাউন্সমেন্ট হলো , এবার উনিও নড়ে বসলেন …. l
কন্যার ধৈর্যের সীমা এবার তুঙ্গে উঠেছে, এবার জিজ্ঞেস না করতে পারলে ……..হটাৎ ভদ্রলোক কন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন … “ আমি সুরেন্দ্র মল্লিক , আপনি কি আমায় চেনেন? অনেক্ষন থেকে মনে হচ্ছে আপনি কিচ্ছু বলতে চান l”
কন্যা একটু দোমে গেলো , “আপনি তাহলে অরূপ ব্যানার্জী নন …উনি আমার মামা , আপনার মতো দেখতে l ” ভদ্রলোক অবাক না হয়ে বললেন , “আমরা সব সময় যা ভাবি সেটা সামনে আসতে থাকে ….আজ একরোখম মুখ দেখলেন , এর পর হয়তো মামাকেই দেখবেন ….কিন্তু এতো সংকোচ করবেন না , সময় কম হতে পারে l”
এবার তিনি ব্যাগ নিয়ে প্লাটফর্ম চার এর দিকে এগোলেন …..পাশ থেকে অমৃতা এসে কন্যা কে এক ধাক্কা দিয়ে বললো “কিরে ….আবার সাততাড়াতাড়ি এসেছিস ? চল একটু এসির হাওয়া খাবি ….ট্রেন তো দিয়ে দিয়েছে ….প্লাটফর্ম ছয় তো ওদিকটায় , উঠবি তো ?”
কন্যা ফিরে তাকালো…Iপ্লাটফর্ম চারে শতাব্দী , বেশি ভিড় নেই …কিন্তু সেই হয়তো মামারও দেখা নেই …..কে ছিলেন উনি – আবার অপেক্ষা করতে হবে ?
নাহ, এবার মামার সঙ্গে দেখা করতেই হবে, নিজের সমস্ত কংটাক্টগুলো কাজে লাগিয়ে মামাকে খুঁজে নেবো ! ট্রেনের কামরায় পা দিতেই কন্যার আত্মবিশ্বাস তাকে হাত বাড়িয়ে টেনে নিলো …I এবার যাত্রা শুরু …আসল !!!
– তানিয়া চৌধুরী
সকালে ইঞ্জিনিয়ার- বিকালে শখের লেখিকা