১৯৭০ সাল। ওড়িশার এক নির্জন জঙ্গলঘেরা জায়গায় ছবির মতো সুন্দর এক বাংলো। সেই বাংলোর সযত্নলালিত বাগানে বসে সকালের চা খেতে খেতে প্রভাতীদেবী ছেলের সঙ্গে গল্প করছিলেন।
“বিয়েটা এবার করে ফেল খোকা। আমি আর কত দিন তোর বাবাকে ছেড়ে এসে তোর সংসার সামলাবো বল?”
মায়ের কথা শুনে সুশীল হেসে ফেললো। মায়ের মাথায় ওই এক চিন্তা। ছেলের বিয়ে। কিন্তু সুশীল বেশ আছে। সে তার জঙ্গল আর জন্তুজানোয়ারদের নিয়ে বেশ সুখেই আছে। ইন্ডিয়ান ফরেষ্ট সার্ভিসের পরীক্ষায় ভালো ফল করে সুশীল এখন প্রথম শ্রেণীর ফরেষ্ট অফিসার। অফিস থেকে সে সবই পেয়েছে – মোটা মাইনের চাকরী, বাগানঘেরা মস্ত বাংলো, জীপ, চাকর, বাবুর্চি, মালী। শুধু বউটাই পায়নি। তাই সে ব্যাপারে প্রভাতীদেবীর চিন্তার অন্ত নেই। অবশ্য তাঁকে দোষ দেওয়াও যায়না। সুশীলের বাবা হার্টের রোগী। তাঁকে কলকাতার বাড়িতে কাজের লোকের ভরসায় বেশিদিন ফেলে রাখা যায় না। এদিকে সুশীলও কোনোদিন বাড়ি ছেড়ে একা কোথাও থাকেনি। তাই প্রভাতীদেবীর হচ্ছে উভয় সমস্যা। এইবার সুশীলের বিয়ে হলে তাঁর সব সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু মেয়ে দেখার ব্যাপারে তো তার কোনো উৎসাহই দেখা যাচ্ছে না। তবে কি সে বিয়ে করতেই চায় না?
সুশীল কিন্তু আসলে বিয়ের ব্যাপারে মোটেই উদাসীন নয়। আর মেয়ে তো তার পছন্দ করাই আছে। দীপা, তার কলেজের সহপাঠিনী। ভারী মিষ্টি মেয়ে। দারুণ গান করে, ছবি আঁকে। তার ধারণা দীপাও তাকে মনে মনে পছন্দ করে। কিন্তু কেউ কোনোদিন পরস্পরের কাছে নিজেদের মনের কথা বলেনি। দুজনেই ‘বলবো বলবো’ করে শেষ পর্যন্ত আর বলে উঠতে পারেনি।
এখন সুশীল ভালো চাকরি করছে, তার মায়ের কাছে দীপার কথা বলতেই পারে। কিন্তু সেখানেও তার ভয়। দীপাকে যদি মায়ের পছন্দ না হয়। তাই বহু ভেবেচিন্তে সে তার কলেজের বন্ধু সুখেনকে ফোন করে সব বললো।
সুখেন চালাকচতুর ছেলে। সে প্রথমে দীপার সঙ্গে কথা বলে তার মন জেনে নিলো। দীপার আপত্তি নেই বুঝে সে প্রভাতীদেবীর কাছে দীপার ছবিসহ বিয়ের সম্বন্ধের প্রস্তাব পাঠিয়ে দিলো। ছবি দেখে প্রভাতীদেবীর দীপাকে ভারী পছন্দ হলো। তিনি ছেলেকেও ছবিটা দেখালেন। সুশীল প্রথমে একটু আপত্তির ভান করে তারপর বিয়েতে মত দিলো। এর পর একটা শুভ দিন দেখে ধুমধাম করে দুজনের বিয়ে হয়ে গেল। প্রভাতীদেবীও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
বিয়ের পর দীপা কলকাতা শহর ছেড়ে ওড়িশার এক জঙ্গলে স্বামীর ঘর করতে এলো। সে প্রকৃতিপ্রেমিক। সুতরাং জঙ্গল তার খারাপ লাগার কথা নয়। তার ওপর অত বড় বাগান পেয়ে সে ভারী খুশি হলো। সারাদিন ধরে মালীর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সে বাগানের পরিচর্যা করতো। সন্ধ্যেবেলা সুশীল অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর স্বামী স্ত্রী বাগানে বসে ফুলের শোভা দেখতে দেখতে চা জলখাবার খেতো আর গল্প করতো। ছুটির দিনে তারা লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়তো। এইভাবে বেশ হানিমুন মোডে কেটে গেল কয়েকটা বছর।
বিয়ের দু বছর পর দীপা যমজ মেয়ের জন্ম দিলো- জোজো আর শিবা। তাদের জীবনে আনন্দ আর ব্যস্ততা দুটোই অনেক বেড়ে গেল। এইভাবে সুখে দুঃখে দেখতে দেখতে আটটা বছর কেটে গেল।
সেদিন ছিল ক্রিসমাস ইভ। সকালে জোজো আর শিবার স্কুলে ক্রিসমাস প্রোগ্রাম ছিল। দীপা তার দুই মেয়েকে নিয়ে সকাল সকাল স্কুলে চলে গেলো। ‘স্লীপিং বিউটি’ নাটকে জোজো আর শিবা দুজনেই পরী সেজেছে। ফ্রিল দেওয়া সাদা গাউন, সাদা নেটের ডানা আর মাথায় ঝলমলে টায়রা পরে ওদের কি ভালো যে লাগছিলো! দীপা অনেক ছবি তুললো। এইসব স্মৃতি সারাজীবন রয়ে যায়। প্রোগ্রাম শেষ হবার পর ওরা বাড়ি ফিরে সন্ধ্যের পার্টির আয়োজন করতে লাগলো। দীপা রান্নাঘরে ঢুকলো আর মেয়েরা বাড়ি সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
সেদিন সন্ধ্যায় সুশীলের অফিসের কয়েকজন কলিগ ও তাদের পরিবারের সঙ্গে পার্টি ভালোই জমলো। শহর থেকে দূরে জঙ্গলের নির্জন পরিবেশে থাকা এইসব পরিবারগুলি মাঝে মধ্যেই নিজেদের বাড়িতে পার্টি দিয়ে থাকে। বহুরাত অবধি নাচা-গানা-খানা-পিনা করে জীবনের রসদ জোগাড় করে। সেদিনও পার্টি শেষ হতে হতে মাঝরাত হয়ে গেলো। জোজো আর শিবাকে বহু আগেই তাদের ঘরে শুতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। শেষ অতিথি চলে যাবার পর সুশীল আর দীপাও ক্লান্ত শরীরে নিজেদের বেডরুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
রাত তখন প্রায় আড়াইটা হবে। ঢাকের দ্রিম দ্রিম শব্দে দীপার ঘুম ভেঙে গেলো। সে ঘুম চোখে উঠে জল খেলো। তারপর নিঃশব্দে দরজা খুলে বারান্দায় এলো। শব্দটা কিন্তু খুব দূর থেকে আসছে না। ঢাকের শব্দের সঙ্গে ক্যানেস্তারা পেটানোর আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে। আট বছর জঙ্গলে বাস করার সুবাদে এই শব্দগুলো দীপার খুবই চেনা। নির্ঘাত কোথাও বাঘ বেরিয়েছে। তাই জংলী উপজাতিরা ঢাক বাজিয়ে আর ক্যানেস্তারা পিটিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছে।
চিন্তিত মুখে দীপা ঘরে ফিরে এলো। একবার ভাবলো সুশীলকে সব জানাবে, কিন্তু ঘুমন্ত মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে করলো না। সে চুপচাপ স্বামীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
সবে ঘুমটা এসেছে, এমন সময় তীব্র শব্দে কলিং বেল বেজে উঠলো। দীপা ধড়মড় করে উঠে বসলো। এত রাতে কে এলো? কলিং বেলের শব্দে সুশীলেরও ঘুম ভেঙে গেছে। সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই কয়েকজন জংলী উপজাতির লোক হাঁউমাউ করে উঠলো।
“বাঁচান সাহেব। বাঘে আমাদের গ্রামের একটা ছেলে বুধুয়াকে নিয়ে গেছে। ওটাকে মারুন সাহেব, নইলে আমরা কেউ প্রাণে বাঁচবো না!”
সুশীল দরজা খুলে দিতে তারা হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো। তাদের প্রশ্ন করে জানা গেলো যে গত এক মাস ধরে একটি পুরুষ বাঘ মাঝেমধ্যেই গ্রামে হানা দিচ্ছে। এতদিন সে গরু ছাগল শিকার করেই সন্তুষ্ট ছিলো। কিন্তু আজ সে মানুষ শিকার করেছে। গ্রামের কয়েকটি ছেলে সন্ধ্যের আগে ক্ষেত থেকে বাড়ি ফিরছিল। বুধুয়া তাদেরই একজন। তাকেই বাঘটা নিয়ে গেছে। এখন বাঘটাকে না মারলে আরো বহু মানুষের প্রাণ যাবে। মানুষের রক্তের স্বাদ যে বাঘ একবার পায় সে মানুষ ছাড়া আর কিছু খেতে চায় না।
শিকারী হিসেবে সুশীলের বরাবরই সুনাম আছে। কলেজে পড়ার সময়েই সে একটা শ্যুটিং ক্লাবের মেম্বার হয়েছিলো। তখন থেকেই তার কাছে ফায়ার আর্মস রাখার লাইসেন্স আছে। আর এখন ফরেষ্ট অফিসার হবার সুবাদে তার কাছে রাইফেল ও পিস্তল দুটোই আছে। সে রাইফেলটাকে সঙ্গে নিয়ে লোকগুলোর সঙ্গে জিপে করে বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে দীপাকে ডেকে বললো, “বাংলোর সব দরজা জানালা বন্ধ করে থাকবে। জোজো আর শিবা যেন কোনোমতেই বাগানে খেলতে না যায়। আমি না ফেরা অবধি কাজের লোকেরা যেন বাড়ির বাইরে না যায়।”
দীপা সারারাত কাঠ হয়ে বাইরের ঘরে বসে রইলো। কাপের পর কাপ ব্ল্যাক কফি খেয়ে সে জেগে রইলো। সকাল ছটার সময় সে গ্যারেজের গেট খুলে জিপে ঢোকার আওয়াজ পেলো। তার বুকে যেন বল ফিরে এলো। দৌড়ে গিয়ে সে দরজাটা খুলে দিলো। একটু পরে ক্লান্ত সুশীল ভেতরে এলো।
চা জলখাবার খেতে খেতে সুশীল যা শোনালো তা সত্যিই ভীতিপ্রদ। বাঘটাকে তারা খুঁজে পেয়েছিলো। জঙ্গলের মধ্যে একটা ঝোপের ধারে সে ঘাপটি মেরে বসেছিল। তার সামনে ছিল বুধুয়ার অর্ধভুক্ত শরীর। সুশীল তাকে দেখতে পেয়েই গুলি চালায়। গুলিটা তার গায়েও লাগে। আহত বাঘটা হুঙ্কার দিয়ে লাফ মেরে পালিয়ে যায়। অন্ধকারের মধ্যে তাকে ধাওয়া করা যাবে না বুঝে সুশীল ও তার সঙ্গীরা বাকি রাতটুকু জীপের মধ্যেই কাটালো। ভোরের আলো ফুটলে তারা বাঘের পায়ের ছাপ আর রক্তের দাগ দেখে বুঝলো যে বাঘটার পেছনের একটা পায়ে গুলিটা লেগেছে। আশপাশ খুঁজে তারা তাকে দেখতে পায়নি। বাঘটা সম্ভবত জঙ্গলের মাঝখানে (কোর ফরেষ্ট) কোথাও লুকিয়ে আছে। এতবড় জঙ্গলে তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব বুঝে ওরা বুধুয়ার দেহ নিয়ে ফিরে এসেছে। সুতরাং বিপদ আরো বেড়েছে। আহত মানুষখেকো বাঘ শয়তানের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর।
সুশীলের বাংলোর বাগানের পাঁচিল নিচু না হলেও খুব একটা উঁচুও নয়। জোজো আর শিবার একা একা বাগানে গিয়ে খেলা করা বন্ধ হয়ে গেল। কারণ বাঘটা যেখান থেকে বুধুয়াকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেই জায়গাটা সুশীলের বাংলো থেকে বড় জোর এক মাইল হবে। একটা পূর্নবয়স্ক বাঘের কাছে ওই জায়গাটা পেরিয়ে আসাটা কোনো ব্যাপারই নয়। মালীসহ অন্যান্য কাজের লোকেদের চারিদিকে নজর রাখতে ও সাবধানে চলাফেরা করতে বলা হলো।
পরের কয়েকটা মাস সমস্ত গ্রামবাসী আর সুশীলের অফিস কলিগরা বাঘের ভয়ে কাঁটা হয়ে রইলো। কিন্তু ব্যাঘ্রপ্রবর আর দেখা দিলেন না। এটাও বেশ আশ্চর্যের যে মানুষখেকো বাঘ একেবারের পর আর মানুষ খেলো না। কিছুদিন ধরে নানারকম গুজব আর আলোচনা শোনা যেতে লাগলো। সুশীল তো তার অফিসের হিরোই হয়ে উঠল। সবাই তার সাহস আর শিকারদক্ষতার প্রশংসা করতে লাগলো।
“সুশীলের মোক্ষম গুলি খেয়ে বাঘটা নির্ঘাত মরে গিয়েছে।”
“সে তো বটেই। তক্ষুনি যদি নাও বা মরে থাকে তাহলে পরে গুলি খাওয়া ঘা বিষিয়ে অক্কা পেয়েছে।”
“সত্যি, সুশীলের সাহসের জবাব নেই। কয়েকটা জংলীকে সঙ্গে করে বাঘ মারতে যাওয়ার হিম্মত সকলের থাকে না হে!”
জীবন আবার চেনা ছন্দে ফিরে আসতে শুরু করলো। সবাই ধরেই নিলো যে বাঘটা মরে গেছে। শুধু দীপার মনের অস্বস্তি রয়েই গেল। সুশীলের কাছে সে শুনেছে যে বনবিভাগ বহু খোঁজা সত্ত্বেও বাঘটার কোনো হদিস মেলেনি। এমনকি তার মৃত শরীরের কোনো অংশও পাওয়া যায়নি। তাহলে সে গেল কোথায়? অত বড়ো একটা রয়্যাল বেঙ্গল তো আর হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না।
প্রায় দু বছর এইভাবেই কেটে গেল। বুধুয়ার বিধবা মা ছাড়া মানুষখেকো বাঘটার কথা প্রায় সবাই ভুলে গেল। এমনকি দীপাও বিশ্বাস করে নিলো যে বাঘটা মরে গেছে।
সেদিন ছিল রবিবার। সুশীলের ছুটির দিন। সাধারণত এই দিনগুলো সে হয় মহা আলস্যে কাটায় নয়তো দীপা আর মেয়েদের লং ড্রাইভে নিয়ে যায়। কিন্তু সেই রবিবার সকাল থেকেই তার ভারী ব্যস্ততা। কারণ সেদিন সে তার বহু বছরের বন্ধু জিমিকে এয়ারপোর্ট থেকে আনতে যাবে। রবিবার তার ড্রাইভারের ছুটি থাকে। কিছু বাড়তি টাকা পেলে হয়তো সে ডিউটি করে দিতো, কিন্তু ইচ্ছে করেই সুশীল তাকে আর কিছু বলেনি। বন্ধুকে সে একাই আনতে যাবে।
জিম উইলিয়াম স্মিথের সঙ্গে সুশীলের বন্ধুত্ব সেই স্কুল জীবন থেকে। প্রথমে দুজন কলমবন্ধু বা পেনফ্রেন্ড ছিল। সুশীল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতো কখন সেই সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে জিমির চিঠি আসবে। জিমিও তার ভারতীয় বন্ধুর চিঠির আশায় পথ চেয়ে থাকতো। এইভাবে কয়েক বছর কাটার পর জিমি প্রথম সুশীলকে ফোন করলো।
সেদিন ছিল সুশীলের জন্মদিন। সক্কাল সক্কাল টেলিফোনে অচেনা গলায় ‘হ্যাপি বার্থডে’ শুনে সে তো অবাক। তারপর জিমি যখন নিজের পরিচয় দিলো তখন দুজনের আনন্দ দেখে কে! তার পর থেকে মাসে অন্তত একবার দুজনে ফোনে কথা বলে। শুধু কি তাই, সুশীলের বিয়ের সময় জিমি সেই সুদূর সিডনী থেকে উড়ে এসেছিল। সেটাই ছিল দুজনের প্রথম দেখা। সেই জিমি আবার ভারতে এসেছে, তবে এবার এসেছে তার অফিসের কাজে। একটা বিখ্যাত নেচার ম্যাগাজিনে সে চিত্র সাংবাদিক হিসেবে কাজ করে। ইন্ডিয়ার ফরেষ্ট লাইফ নিয়ে একটা ফটো শুট করার উদ্দেশ্যে সে সুশীলের কাছে আসছে। তিনদিন সে সুশীলের বাংলোতে তার অতিথি হয়ে থাকবে। তাকে জঙ্গল দেখাবে বলে সুশীল দুদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে।
জিমি এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনোর পরই দুই বন্ধু পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলো। প্রায় দশ বছর পর দুজনের দেখা। কথা কি আর শেষ হয়! এয়ারপোর্টের কাছেই একটা রেস্তোরাঁয় বসে দুজনে লাঞ্চ সেরে নিলো। দীর্ঘ পথ আবার ফিরতে হবে। সেই পথের বেশির ভাগটাই গেছে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। তাই লাঞ্চটা আগেই করে নিলো তারা।
সুশীলের হুডখোলা doorless Wrangler জীপটা দেখে জিমি আনন্দে উচ্ছ্বসিত উঠলো। এই জীপটা সুশীল সম্প্রতি শখ করে কিনেছে।
“আরে তোমার SUV টা দারুন তো? আমি রাস্তায় যেতে যেতে অনেক ছবি তুলতে পারবো। জীপ থেকে নামতেও হবে না।”
“আরে তোমার কথা ভেবেই তো এই জীপটা নিয়ে এলাম।”
“ইউ আর এ ডার্লিং!”
জীপে বসতে গিয়ে সুশীলের নতুন রাইফেলটা দেখে জিমি আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো।
“আরে বাঃ! একদম লেটেস্ট মডেলের রাইফেল দেখছি। একটু হাতে নিয়ে দেখতে পারি?”
ছোট ছোট ব্যাপারে জিমির আনন্দের বহিঃপ্রকাশ দেখে সুশীল হেসে ফেললো। জিমির মধ্যে কোনো নকল অহংকার নেই। রাইফেলটা তার হাতে দিয়ে সুশীল বললো,
“এই নাও। এটা এখন তোমার জিম্মাতেই থাক। রাস্তায় যেতে যেতে যত ইচ্ছে নাড়াচাড়া করো। তবে সাবধান। লোডেড আছে কিন্তু।”
পিছনের সিটে লাগেজ রেখে জিমি সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে রাইফেলটাকে কোলে নিয়ে বসলো। কলেজ জীবনে জিমি রাইফেল শ্যুটিংয়ে স্টেট চ্যাম্পিয়ন ছিল। এখনো শ্যুটিংটাই তার হবি। সুতরাং রাইফেলের প্রতি তার আকর্ষণ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
পথে যেতে যেতে দুই বন্ধুর মধ্যে অনেক দিনের জমে থাকা গল্প হলো। কিন্তু জঙ্গলের পথে জীপ যখন ঢুকলো তখন ওরা চুপ করে গেল। কারণ দুজনেই জানে যে জঙ্গল হলো বন্য পশুপক্ষীদের বাসস্থান। এখানে কেউ জোরে শব্দ করলে, উগ্র রঙের পোশাক পরলে বা তীব্র আলো জ্বালালে ওরা খুব বিরক্ত হয়। তাই যত শান্ত, নির্বাক হয়ে এই পথে যাওয়া যায় ততই ভালো।
জিমির কথা বলা বন্ধ হলেও তার নিকন ক্যামেরার শাটার কিন্তু বন্ধ হয়নি। মৃদু ক্লিক ক্লিক শব্দে সমানে সে নিজের কাজ করে চলেছে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ জিমি একটা ভারী অদ্ভুত প্রশ্ন করলো।
“আচ্ছা সুশীল, এই জঙ্গলের পশুপাখিগুলো সব কোথায় গেলো বলো তো? কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না।”
জঙ্গলের পথে একটা ধারালো বাঁক সামলে সুশীল বললো, “হয়তো জীপের শব্দে সব পালিয়েছে।”
“কি বলছো! তোমার জীপের তো কোনো শব্দই পাওয়া যায় না। আর একটু আগেও তো হরিণের পাল, গাছভর্তি টিয়া আর বাঁদরের ছবি তুললাম। এখন তাহলে সব এত চুপচাপ কেন?”
সুশীল বুঝলো না এই সামান্য ব্যাপারে জিমি এত উতলা হচ্ছে কেন। আসলে কোনোদিন জঙ্গলের পরিবেশে থাকেনি তো, তাই বোধ হয় ভয় পাচ্ছে। সে একটু হেসে ব্যাপারটাকে হালকা করতে চাইল।
“জিমি, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে যে তোমার ক্যামেরার ভয়েই ওরা লুকিয়ে পড়েছে। বিনা মেকআপে কে আর ছবি তুলতে চায় বলো!”
সুশীলের পরিহাস মাঠে মারা গেলো। জিমি একটুও না হেসে বললো,
“সুশীল, তোমার জীপের হুডটা কি গাড়িতেই আছে? ওটা লাগিয়ে নেওয়া যায়?”
জিমির কথা শুনে সুশীল মনে মনে হাসলো। বেচারা সত্যিই ভয় পেয়েছে। নয়তো কেউ জঙ্গলের মধ্যে জীপ থামিয়ে হুড লাগানোর কথা ভাবে? সুশীল জীপের স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে আর একটা বাঁক সামলে নিয়ে বললো,
“কাম অন জিমি। শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ। একটু পরেই আমরা হাইওয়েতে উঠে যাবো। তখন আর তোমার ভয় করবে না।”
জিমি তার ক্যামেরাটা চামড়ার খাপের মধ্যে ঢুকিয়ে ড্যাসবোর্ডের ওপর রেখে দিল। তারপর সুশীলের রাইফেলটা হাতে তুলে নিয়ে বললো,
“সুশীল, তুমি তোমার ডান পা-টা সিটের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে বসবে প্লীজ?”
সুশীল এমন অদ্ভুত অনুরোধের কারণ বুঝতে পারলো না। কিন্তু সে তর্ক না করে তার ডান পা-টা সিটের ভেতরের দিকে টেনে নিলো। এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলো। জিমি রাইফেলের সেফটি ক্যাচ সরিয়ে সেটাকে শক্ত হাতে ধরে রইলো। মাঝে মাঝেই সে পেছন ফিরে দেখছে। তার মুখচোখ থমথম করছে। হঠাৎ সে ফ্যাঁসফ্যাসে গলায় বললো,
“আমার দিকে আরো সরে এসে বসো সুশীল। আর রাস্তায় বাঁক নেবার সময় জীপের স্পীড অত কমিয়ে দিও না।”
ভয় ব্যাপারটা বড় সংক্রামক। জিমির মনের ভয় ধীরে ধীরে সুশীলের মনকেও গ্রাস করতে শুরু করলো। সত্যিই তো, জঙ্গলে একটাও জন্তু বা পাখি ডাকছে না কেন? এমনটা তো হবার কথা নয়। জঙ্গলের এক নিজস্ব সঙ্গীত আছে, ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যাকোফোনি। সেটাও আজ একদমই শোনা যাচ্ছে না কেন? তবে কি…
এইসব ভাবতে ভাবতেই পরবর্তী বাঁক এসে পড়লো। সুশীল সামান্য স্পীড কমিয়ে যেই বাঁকটা নিতে গেছে অমনি তার হাত ধরে এক ঝটকায় জিমি তাকে নিজের দিকে সরিয়ে নিয়ে এলো। আর তার পরমুহূর্তেই যেটা ঘটলো সেটার কথা ভাবলে আজও সুশীলের গায়ে ভয়ে কাঁটা দেয়। জিমি সুশীলকে হাত ধরে টেনে সরিয়ে আনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিশাল বাঘের থাবা এসে পড়ল তার সিটে, যেখানে কয়েক মুহূর্ত আগেও সে বসে ছিল। সুশীল স্পষ্ট অনুভব করলো যে সিটের একাংশ তার শরীরের নীচ থেকে কেউ টেনে নিলো। নিশ্চিত শিকার ফসকে যাওয়ায় বাঘটা হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। আর তার পরমুহূর্তেই গর্জে উঠলো জিমির হাতের রাইফেল। গুলি খেয়ে বাঘটা একটা প্রকাণ্ড লাফ দিলো। পরমুহূর্তেই তার প্রাণহীন দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। গুলিটা বাঘের মাথায় গিয়ে বিঁধেছে।
এক গুলিতেই বাঘ শেষ। জিমি আর সুশীল যখন মৃত বাঘটাকে জীপের ডিকিতে তুলছিল তখন তারা আশপাশের গাছ থেকে পাখির কলকাকলি শুনতে পেল। একটু পরেই তার সঙ্গে যোগ হলো বাঁদর, শেয়াল আর অন্যান্য জীবজন্তুর মিলিত কোরাস। সুশীলের মনে হলো, এ যেন অত্যাচারী রাজার মৃত্যুর পর তার প্রজাদের আনন্দ কলতান।
হাইওয়েতে পড়ার পর জিমি রাইফেলটাকে সযত্নে পেছনের সিটে শুইয়ে দিলো। এ যাত্রায় ওটার আর দরকার হবে বলে মনে হয় না। তারপর শুরু হলো দুই বন্ধুর কথোপকথন। সুশীলের মুখ এখনো ভয়ে সাদা হয়ে আছে দেখে জিমি তার পিঠ চাপড়ে বললো,
“বন্ধু, আজ তোমার পুনর্জীবনলাভ হলো। চলো, সেই উপলক্ষে কোনো বিয়ার পাবে বসে সেলিব্রেট করা যাক।”
জিমি আরো বললো যে প্রতিবার জঙ্গলের রাস্তায় যখন জীপটা বাঁক নিচ্ছিলো তখন সে একটা মৃদু খসখস শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। যেন কেউ শুকনো পাতা মাড়িয়ে হালকা পায়ে এগিয়ে আসছে। ওই শব্দটা শুনেই প্রথম তার সন্দেহ হয়। ওই একই শব্দ সে ব্রাজিলের রেইন ফরেস্টেও শুনেছিল। সেখানে ছিল ব্রাজিলের কালো বাঘ, আর এখানে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।
রাস্তাতেই একটা ছোট্ট বিয়ার পাব খুঁজে পাওয়া গেলো। সেখানে বসে সফেন বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে জিমি বললো,
“একটা জিনিস লক্ষ্য করেছো? বাঘটার পেছনের একটা পায়ে…সম্ভবত বাঁ পায়েই হবে…একটা পুরোনো ক্ষত আছে। সেই কারণে ও বেশি জোরে দৌড়োতে পারছিলো না। নইলে আমাদের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে বহু আগেই ও তোমাকে নিয়ে যেতে পারতো। আমি কিছুই করতে পারতাম না।”
সুশীল খুব লক্ষ্য করেছে। ক্ষতটা বাঘটার পেছনের বাঁ পায়েই আছে। ওই ক্ষতটা কবে, কি ভাবে হয়েছিল তাও সে জানে। প্রায় দু বছর আগে বাঘটা বাঁ পায়ে বন্দুকের গুলি খেয়েছিল। সেই যেদিন ও সাধারণ বাঘ থেকে নরখাদকে পরিণত হয়েছিল।
সুশীল আজও বলতে পারেনা কার বন্দুকের গুলি তার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। জিমির, নাকি দুবছর আগে তার নিজের বন্দুক থেকে ছোঁড়া গুলি? নাকি দুটোই?
(এই গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বন করে লেখা। নরখাদক বাঘটি দু বছর ধরে কোথায় লুকিয়ে ছিল কেউ তা বলতে পারেনা। সম্ভবত সে তার শিকারের ভূমি বা hunting grounds বদলে ফেলেছিল। কিন্তু সুশীলকে দেখামাত্র সে চিনতে পেরেছিল। কারণ দুবছর আগে সুশীল তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে গুলি করেছিলো। তাই সে জিমিকে আক্রমণ না করে তার শত্রু সুশীলকেই আক্রমণ করেছিলো।)

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleবিসর্জন
Next articleশিব-সিংহ দর্শন – গুজরাটে কয়েকদিন
Rini Basu
Author, singer, photographer, English teacher, nature lover. Published 5 books so far. Winner of Literati 2019 award for South Asian micro fiction.
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments