হ্যালো !! কাঁপা গলায়ে বলে উঠল হৈমন্তী।

টেলিফোনের ওপার থেকে কিছুটা বিরক্তিভরা এক রাশভারী কণ্ঠস্বর অসম্ভব ঠাণ্ডা গলায়ে উত্তর দিল,

‘আবার ফোন কেন করেছিস? আমাদের সব কথা ফুরিয়ে গেছে।’

‘একটা গোটা বছরে কত টুকু হয়েছে আমাদের কথা?

কত স্বপ্ন একসাথে দেখেছি,তার বাস্তবায়নে একটা ইঁটও গাঁথা হয়েনি আমাদের রাজীব’।

‘ভুল করার আগে ভাবতে হত,খেয়াল রাখতে হত,’ রাজীবের কণ্ঠে তিক্ততা ঝোরে পড়লো।

‘এখনও সময়ে আছে’ আকস্মিক নরম হল রাজীবের সুর।

কথাটা শুনে হৈমন্তীর গাল ধরে নেমে এলো তার চোখের জল।

বাইরের প্যান্ডেলের আলোর রোশনাই জানলার ফাঁক দিয়ে তার মুখে পরে রূপোর মত চিকচিক করতে লাগলো তার চোখের জল।
বাইরের বিজয়ার উলুধ্বনি হৈমন্তীর বিষণ্ণতা বারিয়ে,হারিয়ে দিল তাকে পুরনো স্মৃতিতে,
রাজীবের টেলিফোনের ওপার থেকে আবিরাম কথাও ম্লান হয়ে এলো হৈমন্তীর কান।

. . . . . . . . . . 

সপ্তমীর সন্ধ্যে হৈমন্তী পরনে বাসন্তী শাড়ি মণ্ডপের আলোকসজ্জায়ে আরও বেশী উজ্জ্বল করছে তাঁকে।হৈমন্তীর কাঁচাসোনার রঙ আর তার অদ্ভূত মায়া মেশানো চোখ মণ্ডপে আসা সকলের কম বেশী নজর কাড়ছিল।হৈমন্তী তা ভাল বুঝছিল এবং বলাই বাহুল্য সে তা বেশ উপভোগ করছিলো।সবে স্কুলের গণ্ডী পেরিয়েছে সে, যৌবনের সব কিছুই উচ্ছাসিত তার শরীর ও মনে।প্রনয় নিবেদন পেয়েছে বেশ কয়েকবার এর মাঝে।কিন্তু,হৈমন্তীর মনে লাগেনি কাউকে।

’ওই হেমু,আমার দাদা রাজীব,’ নিধিই সেই দিন পরিচয় করায়ে রাজীবদার সাথে।

হ্যাঁ!তখনও রাজীব “দা” ছিল। গেরুয়া পাঞ্জাবীতে এক মুখ চাপ দারি, চশমার নীচে দুটি বুদ্ধিদীপ্ত দুটো ছোট চোখ। কলেজ শেষ করে এখন চাকরির সুযোগের অপেক্ষা,যাদবপুর এর ছাত্রনেতা এবং নিধির পিসির ছেলে।

পূজার কটা দিন রাজীবদার বেশ কাছাকাছি চলে আসে হৈমন্তী,একসাথে অষ্টমীর অঞ্জলি থেকে নবমীর ভোগ খওয়াদয়াও,দশমীয়ের বিদায় বেলায়ে রাজীবদা বিদায় নিল সুধু যাওয়ার আগে হল ফোন নাম্বারএর আদলবদল।

তারপর ফোনে চলল রাজীবদার সাথে আফুরন্ত অযস্র গল্প।কত রাত জেগে জেগে কথা বলে ভোর হল,

অজান্তেই রাজীব দা হল রাজীব,দিনের সব কিছু রাজিবের সাথে বলা চাই হৈমন্তীর,

কথা কম হলে না হলে মন খারপ হৈমন্তীর,তার দরুন রাগ-অভিমান,মান ভাঙ্গাবে রাজীব।

হঠাৎ এক দিন রাজীব বলে বসলো ভালবাসি তোকে হৈমন্তী।

এলোমেলো হয়ে গেল হৈমন্তীর সবকিছু,মনে হল ছুটে গিয়ে রাজীব কে সে জড়িয়ে ধরে।তারপর,আজানা লজ্জাই কুঁকড়ে গেল,কোন উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিল।

রাজীবের ফোন এলো তৎক্ষণাৎ,

কি হল?রাগ করলি হৈমন্তী!

কিছু বল,

আমি !!আমি সে ভাবে…

ক্ষমা করে দে,…কথা বল

দোহাই…

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো রাজীব।

‘আমিও বাসি তোমাকে।’অত্যন্ত নিচু স্বরে কথা গুলো বলে আবার রেখে দিল ফোন হৈমন্তী।তার শরীর এক আজানা উত্তেজনা আর খুশীতে নেচে উঠল,সে রাত জেগেই কাটল হৈমন্তীর।

তারপর সবটা প্রেমের গল্প।

কলেজএর ফাঁকে কত্ত ঘুরতে যাওয়া
কত স্বপ্ন দেখা,
হাতেহাত রেখে কত কথা দেওয়া,

একটা বছর ঘুরতে চলল আর এক সুন্দর স্বপ্নের মত কেটে গেলো হৈমন্তীর রাজীবের সাথে।

তারপর একদিন রাজীব ফোন করে বলল বাড়ি আসিস আজ আমার কলেজএর পর মা তোকে দেখতে চাইছে।
হৈমন্তী মনে মনে খুশী হল তার সাথে এই ভেবে বুক কেঁপে উঠল তার,যদি তাঁকে ভালো না লাগে রাজীবের মা এর,  যদি তাদের সম্পর্ক না মানে রাজীবের মা

তবে?

তখন কি মেনে নেবে রাজীব তাঁকে?

নাকি ভুলে যাবে তাঁকে? এমন আজানা অনেক প্রশ্ন নিয়ে দুপুরে হাজির হল সে রাজীবের বাড়ি।

তার প্রিয় মানুষটি গেট খুলে হাসি মুখে তাঁকে ঘরে ডাকল,
বস!মা আসছে এখনি, একটু বেরিয়েছে।
পাশাপাশি একটা বর মাপের সোফাতে বসলো ওরা দুজন।
হৈমন্তীর মাথায়ে হাজার চিন্তার সমাবেশ,জানে না কতক্ষণ হারিয়েছিল সেসবে;

স্তম্ভিত ফিরল কাঁধের কাছে গরম নিশ্বাসে,ছিটকে কিছুটা সরে গেলো হৈমন্তী।
সারা গায়ে তার কাঁটা দিয়ে উঠেছে এতো কাছে কোন পুরুষ তার আসেনি আগে কখনো।

রাজীব হৈমন্তীর হাতটা ধরে আলত করে নিজের দিকে টানতে,হৈমন্তী পুতুলের মত ঢোলে পড়লো রাজীবের কলে।বাকি সবকিছু আবছা ছিল হৈমন্তীর কাছে,সুধু ডুবে যাছিল সুখময় এক সাগরে।

যখন হৈমন্তীর ঘোর কাটল তখন সে রাজীবের বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে,

কিছু ভুল হল না তো রাজীব?

বিশ্বাস রাখ আমার উপর।

তোমার বাড়িতে মানবে রাজীব আমাদের?

বিশ্বাস কর!!

সেই দিন রাজীবের মার সাথে দেখা হইনি হৈমন্তীর,আস্তে দেরি হবে তাই রাজীব তাঁকে বাড়ি চলে যেতে বলে।

দিন পনেরো পর সকাল থেকে বড্ড শরীর খারপ লাগছিলো হৈমন্তীর,মাথা ঘুরছিল বমিও হল বার কয়েক কলেজ যাওয়াও হল না, সবটাই জানল রাজীবকে।
রাজীব বড্ড উত্তেজিত হয়ে বসলো,হৈমন্তী তার এই বাকুলতার কারন বুঝতে পারল না।

আজ বিকালই ডাক্তার এর কাছে চল।

আরে না,এমন তো হয়েই থাকে আর কটা দিন দেখি।

না,তুই আজ যাবি,আমি নিয়ে যাব তোকে।

আরে…

না আজ মানে আজ!

যেতেই হল হৈমন্তীকে বাধ্য হয়ে,রাজীবই নিয়ে গেলো।

ডাক্তার বেশ কিছু টেস্ট দিল,তাও রাজীব সাথে সাথে করালও হৈমন্তীর না করা সত্তেও। সত্যি কত ভালবাসে রাজীব তাকে,তার স্বাস্থ্য নিয়ে কত ভাবে রাজীব এই সব ভাবতে ভাবতে সেই রাত ঘুমিয়ে যায়ে হৈমন্তী।

পরদিন সকালে উঠে আরও ক্লান্তি অনুভব করে হৈমন্তী।
১০বারের ও বেশী ফোন করেছে রাজীব তাঁকে দ্যাখে,ব্যস্ত হয়ে ফোন করে হৈমন্তী রাজীবকে।

কি হল এত বার ফোন কেন করেছ?

দ্যাখা কর, আমি আসছি।

রাজীব আজ এসো না,আমি বিষণ ক্লান্ত।

বেরো জলদি!

ফোনটা কেটে দিল রাজীব, তার শেষের কথা গুলো খুব রূঢ় লাগলো হৈমন্তীর।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে বেরালও হৈমন্তী অগত্যা।
রাজীবের মুখটা অত্যন্ত শুঁকনো আর ফ্যাঁকাসে লাগছিলো,কাঁপা হাতে একটা কাগজ এগিয়ে দিল হৈমন্তীর দিকে।

হৈমন্তী প্রেগন্যান্ট ।। টেস্ট রিপোর্ট তাই বলছে।

‘এইটা কি ভুল করলি তুই?কেন বাঁধা দিলি না আমাকে??’

‘আমার ভুল?’ অবাক দৃষ্টিতে অচেনা রাজীব কে দেখল হৈমন্তী।

চল আমার সাথে সব ঠিক করে আসি,এখন কিছু হয়ে নি।

বিয়ে করবে?তোমার বাড়িতে বলবে?

না ভুল টাকে নষ্ট করব,তারপর তুই আমি কেউ কাউকে চিনি না। আমরা আলাদা।

সেই দিন পালিয়ে আসে হৈমন্তী দৌরে এই সব কথা শুনে,তারপর থেকে ঘরে সুধু কেঁদেছে রাজীব কে বুঝাতে চেষ্টা করেছে
রাজীবের দিক থেকে সুধু এসেছে আবহেলা, এখন ফোনও ধরে না হৈমন্তীর সে।

আজ আবার তাই…

হৈমন্তী…
হৈমন্তী……
হ্যালো।। হ্যালো।।
শুনছিস?

স্তম্ভিত ফিরল হৈমন্তীর,

‘আমাকে আর ফোন করলে ভালো হবে না’ শক্ত চোয়ালে কথা গুলো বলল রাজীব।

আজ শেষবারের মত দ্যাখা করবে?বাবুঘাট? হৈমন্তী বলে উঠল।

একটু ভেবে রাজীব বলল ‘শেষবার।

বাবুঘাট দশমীতে জনজোয়ারে ভাসছে,লাল পার শাড়ীতে হৈমন্তী সাক্ষাৎ উমা,তার চোখে বিসর্জনের দুঃখে ভরা।
রাজীব এসে দাঁড়ালো পাশে,
রাজীবকে মন ভরে দেখল হৈমন্তী।
জড়িয়ে ধরল তাকে।

“বল দুর্গা মাইকি জয়।
       জয় !! জয় !!
আসছে বছর আবার হবে।।”

বিসর্জন আর দেবীর জয়ধ্বনিতে মুখর হয়ে বাবুঘাট চত্তর।

দেবী পক্ষের সমাপ্তি হল বিসর্জনের সাথে সাথে।

. . . . . . . .

পরদিন দেবীর কাঠামো নদী থেকে বার করতে গিয়ে জোর সোরগোল পরে গেলো,
এক যুবকের মৃৎদেহ পাওয়া পাওয়া গেছে,বুকে ছুরিকা বসানো এখনও।
পাওয়া গেছে এক যুবতীর দেহ,আত্মহত্যা বলে অনুমান করা হছে।

বিসর্জন শুধু দেবীর হয়ে না,
 অসুররের ও হয় তার সাথে।।
Print Friendly, PDF & Email
Previous articleপরিযায়ী
Next articleবাঘের খপ্পরে
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments