শহরজোড়া পুজো আসে। আর তো একটা মাস। অলিতে গলিতে বাঁশ বাঁধা হয়। যানজট বাড়ে। বড়ো রাস্তা জুড়ে বসে অসময়ের দোকানিরা। রাস্তা বন্ধ করে দোকান দেওয়া তখন ওদের সহজাত অধিকার। মাইক নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁকতে হাঁকতে যায় কতো দোকান, ক্লাব, পুজোর নজরকাড়া বিজ্ঞাপন। শরতের মিষ্টি গন্ধটা ভেসে আসে নীল আকাশের তুলোয় মোড়া নরম মেঘগুলোর সাথে। কুমোরটুলি গমগম করে দশভূজার রাজকীয় উপস্থিতিতে। প্রথম কোট, দ্বিতীয় কোট, তৃতীয় কোট পেড়িয়ে তারপর চক্ষুদান – ফাইনাল টাচ। ডাকের সাজ আর জড়ির গয়নার হিসাব শোনা যায় প্রত্যেকটা ঘুপচিতে। তারই মাঝে উদ্যোক্তাদের ফোন চলে। তাড়া দেওয়া চলে। রোদ ঝলমল বিকালে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি দেখে কপালে ভাঁজ পড়াও চলে। গোটা শহর আলোয় মুড়ে যায়। লেক, রাস্তা, গলি, বস্তি সবাই নিজের মতন সাজে। কোথাও কোনো আনন্দের ভাঁটা পড়েনা। এয়ারপোর্ট যাওয়ায় পথে যে রাস্তায় সৌম্যদীপের আক্সিডেন্ট হয়েছিলো, সেও তখন রাঙা আলোয় তিলোত্তমা। অতীতের কোনো জমাট বাঁধা অন্ধকার তখন আর তার মন খারাপ করায়না।
অন্য দিকে ‘নিরালা’র মন খারাপ আর ঠিক হয়না। রেডিও বাজেনা অনেকদিন হলো। পাড়ায় প্যান্ডেল হয়। আলোর মালা সাজে। ‘নিরালা’র ওপর আলো দেওয়ার নিষেধ হয়। অমাবস্যা পেড়িয়ে পূর্ণিমা আসে। পূর্ণিমা পেড়িয়ে আবার অমাবস্যা। মহালয়া। কিন্তু সেই চাঁদের আলো আর জ্যোৎস্নায় ঘরকে ভরিয়ে তোলে না। বরং ওই আলোয় যেন আরো বেশী করে প্রকট হয় শুন্যতা। কামিনী ফুলের উগ্র গন্ধে সুরঙ্গনার মাথা ধরে আসে। ওর অসহ্য লাগে। পেছনে বাগানের বকুল ফুলের গন্ধও ভেসে আসে সন্ধ্যের শান্ত বাতাসে। ওর গন্ধে যেন বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। বারবার মনে হয় সৌম্যদীপ আবার ফিরে আসবে। চোখের জল মুছতে মুছতেই আবারও চোখ ভিজে যায় নতুন জলে। আলমারি থেকে সৌম্য-র সব পারফিউম উজাড় করে বিছানায় ঢেলে দেয় সুরঙ্গনা। ওই গন্ধে যতটা পারে নিজেকে মাখিয়ে নেয় ও। চেষ্টা করে ওই বকুল আর কামিনীর গন্ধকে চিরতরে মুছে দিতে।
দেবীপক্ষ পড়ে যায়। শারদোৎসবের আলো জ্বলে ওঠে। উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্র উৎসবের মেজাজে রাজপথ ঢাকে মানুষের আনন্দে – উল্লাসে। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বোধন হয়। প্রথম ঢাকের আওয়াজ। প্রথম সন্ধ্যারতি। আশ্বিনের সন্ধ্যায় যখন উমার অধিবাস হয় মন্ডপে, মাইকে সেই শব্দ ভেসে আসে ‘নিরালা’য় সুরঙ্গনা সৌম্যদীপের বেডরুমে। ড্রেসিং টেবিলের ওপর সৌম্যদীপের একটা ছবি নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে একাকী সুরঙ্গনার দিকে। নিখিলেশ আসে। চুপ করে বিছানায় বসে ওর পাশে। মাথায় হাত রাখে।
‘ওঠো মা। মায়ের আরতি হচ্ছে। উঠে বসে প্রণাম করো।‘
সুরঙ্গনা আবারও হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে। এটাই তো ওর বিয়ের পর প্রথম পুজো। নিখিলেশ আর সহ্য করতে পারেনা। ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। শুধু মনে মনে ভাবে যে কিছু তো একটা করতে হবে ওই বাচ্ছা মেয়েটাকে একটু ভালো রাখার জন্য।
সপ্তমীতে ঘট আসে। কলাবউ স্নান হয়। অষ্টমীতে সন্ধি পুজো হয়। সন্ধ্যেবেলায় অনুষ্ঠান হয়। এবারে পুজোর কোনো জোগাড় নিখিলেশের বাড়িতে হয়না। নিখিলেশ নিজেই দু’বার মন্ডপে গিয়েও পালিয়ে আসে। প্রতিমার মুখের দিকে তাকালে যেন বারবার সুরঙ্গনার মুখটাই ভেসে ওঠে। ক্রমে নবমীও পেড়িয়ে যায়। চারদিনের উৎসবের শেষে আবার দেবী দুর্গার তার সন্তানদের নিয়ে কৈলাসে ফেরার সময় হয়।
দশমীর সকাল থেকেই ঠাকুর বরণের প্রস্তুতি শুরু হয়। দুপুর বেলায় ঠাকুর নামানো হয় বেদীর ওপর থেকে। মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট চলতে থাকে বরণের। এমন সময় নিখিলেশ সুরঙ্গনার ঘরে প্রবেশ করে। হাতে সাদা শাড়ি – লাল পাড়। আস্তে আস্তে সুরঙ্গনাকে ঘুম থেকে জাগায়। মাথায় হাত বুলিয়ে সস্নেহে বলে, ‘ওঠো মা। তৈরী হয়ে নাও। মা’কে বরণ করতে হবে’।
সুরঙ্গনা বাক্যহীন হয়ে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকে। ওর চোখ দিয়ে জল আসতেই থাকে। সেটা খুশীর না দুঃখের নাকি কৃতজ্ঞতার সেটা বোঝা যায়না। ঊর্মিমালা এসে ওকে শাড়ি পড়িয়ে দেয়। সুদীপ্তা এসে গয়না পড়িয়ে সাজায়। লাল পেড়ে শাড়ি, হার – কানের, চুড়িতে সেজে জা আর শাশুড়ি মা’র সাথে মণ্ডপে দেবীকে বরণ করতে যায় সুরঙ্গনা। ওর কোনো অভিব্যাক্তি প্রকাশ পায়না। চোখ দু’টো শান্ত দেখায়। মুখ স্তিমিত। কোনো ঝড়ের তান্ডবে প্রকৃতি ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার পর যে শান্ত অথচ তছনছ হয়ে যাওয়া চিহ্নগুলো ফুটে ওঠে, ওর মুখেও যেন সেসব চিহ্ন স্পষ্ট।
এতো বছর ধরে চেয়ার পার্সনের স্ত্রী হিসাবে যে বরণডালা নিয়ে ঠাকুরকে বরণ করতো ঊর্মিমালা, আজ সেই কাজেরই ভার পড়ে সুরঙ্গনার ওপর। মণ্ডপভরতি অবাক হয়ে দেখে কেমন এক সদ্য স্বামীহারা স্ত্রী সাদা শাড়ি লাল পাড়ে মা’কে আদর করে বরণ করে, আস্তে আস্তে আগুনের আঁচ ছোঁয়ায় প্রতিমার গালে, তারপর পান দেয়, মিষ্টি খাওয়ায়, সিঁদুর পড়ায়। এক অচেনা মাতৃস্নেহে ঊর্মিমালার মন ভরে আসে। ক্ষীণ হয়ে আসে সন্তানবিয়োগের ব্যাথা। সুদীপ্তারও তখন চোখ ছলছল। তারপর সিঁদুরখেলা হয়। রাঙা আভায় রঙিন হয়ে পড়ে শেষ শরতের প্রহরগুলো। সবার সাথে মিশে তখন সবাই একই সাদা শাড়ি আর লাল সিঁদুরে আবৃত। সুরঙ্গনার সাথে তখন আর অন্যদের কোনো পার্থক্য নেই। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে নিখিলেশ। মনে মনে ভাবে, নিঃশব্দে কিরকম একটা বিপ্লব ঘটে গেলো তার নিজের পুজোয়।
ঠাকুর বেড়োবে এবার। জোড়কদমে ঢাক আর ধুনুচি নাচ চলছে। হঠাৎ এক যুবতী সিঁদুরে রাঙা হয়ে এসে নিখিলেশের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। খানিকটা হকচকিয়ে ভালো করে তাকাতেই নিখিলেশ বুঝতে পারলো, এই তো সুরঙ্গনা। ওর চোখ দিয়ে তখন অঝো্রে জল পড়ছে। সবাই চীৎকার করছে ,’আসছে বছর আবার হবে। বলো দুর্গা মাইকি জয়’। কন্যাস্নেহে ওকে জড়িয়ে ধরে নিখিলেশ। মনে মনে প্রার্থনা করে, ‘আবার এসো মা’। হঠাৎ অনুভব করে সুরঙ্গনাকে ভারী ভারী লাগছে। সোজা করতেই বুঝতে পারে ও অজ্ঞান হয়ে গেছে।
সেদিন রাত্রে অনেকদিন পর আবার বাড়ি ফিরে নিজের সাধের রেডিওটা টিউন করে নিখিলেশ। বাড়িতে ডাক্তার আসে। একটু পরই সুরঙ্গনার হুঁশ ফেরে। ডাক্তার নিজেই সুরঙ্গনাকে খবরটা দেয়, ‘মা, নিজের যত্ন নাও। এবার তো মা হতে হবে’। এক মুহূর্তে যেন ‘নিরালা’ সঞ্জীবনীর স্পর্শ পায়। তখনও সবার মুখে সিঁদুর লেগে। দূরের ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসে বিজয়ার শুভেচ্ছা বয়ে নিয়ে।
রেডিওতে তখনও রবি ঠাকুর, ‘তব ভুবনে তব ভবনে, মোরে আরও আরও আরও দাও স্থান। মোরে আরও আরও আরও দাও প্রান’।
( বিজয়া দশমী, ২০১৭। দক্ষিণ কোলকাতার ত্রিধারা সম্মেলনীর পুজোয় এক বিপ্লব ঘটে। সিঁদুরখেলায় অংশ নেয় স্বামীকে হারানো অজস্র মহিলা, সদ্য-যৌবনা বা বৃদ্ধা, ট্রান্স-জেন্ডার যারা পুরুষ থেকে নারীর শরীরে উত্থিত এবং পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম রেডলাইট এরিয়া সোনাগাছির অসংখ্য কর্মী যারা তাদের সৎ পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে অনেক লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। আন্তরিক অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ ওই সকল মানুষদের যারা নিজেদের ঘেরাটোপের থেকে বেড়িয়ে এসে ওই সিঁদুরখেলাকে আক্ষরিক অর্থেই উদযাপন করে তুলেছিলো এবং সেই সকল মানুষদেরও যারা এই বিশাল কর্মকাণ্ড যা ভাবতেই প্রভূত সাহসের দরকার হয়, তা বাস্তবায়িত করার স্বপ্ন দেখেছিলো। এই ঘটনাই প্রমাণ করে যে এই শহরে এখনও প্রান আছে। এই শহর এখনও ‘সিটি অফ জয়’-র একমাত্র অধিকারী। এই গল্প এই ঘটনার থেকেই অনুপ্রাণিত এবং ওই সমস্ত মানুষদের উদ্দেশ্যেই উৎসর্গীকৃত যারা ওই দুর্গাপুজোকে সত্যই সার্বজনীন করে তুলেছিল।)