একদা নারদমুনি বৈকুণ্ঠে হাজির তিনি
কহিলেন– “হে মধুসূদন,
বহু যুগ অভিলাষী সামান্য, নাহিকো রাশি
করিব মহাপ্রসাদ সেবন।”
কহিলেন নারায়ণ “বড়ই কঠিন পণ
করিয়াছ আজি মহামুনি,
মোর প্রসাদে নিত্য পদ্মালয়ার সত্ব
আমি বুঝি পরমাদ গুণি।”
“হে প্রভু বৈকুণ্ঠপতি কি হেতু এহেন রীতি
অন্যেরা কেন রবে ব্রাত্য,
আমি ত’ ভক্ত প্রভু তোমার আশীষে কভু
জীর্ণ ক্লিন্ন হয় নাই চিত্ত ! ”
শ্রবণি’ নারদ বাক্য হাসিলেন শ্রী পদ্মাক্ষ
“তথাপি কেবল মহালক্ষী,
জানিও প্রসাদে মোর দেবীস্বত্ব নিরন্তর
হও না যতেক তুমি দু:খী।”
অনন্তর দেবঋষি অন্তরে ক্লেশরাশি
বিষ্ণুপ্রিয়া–তপস্যায় রত,
দ্বাদশ বর্ষ বীত লক্ষ্মীদেবী অতি প্রীত
বরদানে হইলেন সম্মত।
কহিলেন নারদ – “তবে প্রার্থনা মোর এবে
চরণকমলে তব দেবী,
দেবভোগ কিন্চিৎ না করিও বন্চিৎ
সামান্য প্রসাদ যেন লভি।”
সচকিত বিষ্ণুপ্রিয়া উথালপাথাল হিয়া
তথাপি যে দেবী নিরুপায়,
কহিলেন “তথাস্তু” তিনি “অপেক্ষা কর হে মুনি
পুণ্যলাভ হইবে নিশ্চয়।”
প্রভুর ভোজন অন্তে মিলিল প্রসাদ সন্তে
আত্মহারা দেবর্ষি সুখে,
কণ্ঠে “নারায়ণ” ধ্বনি চলেন নারদ মুনি
কৈলাস পর্বত অভিমুখে।
নারদ চতুর অতি কেবলই দুষ্টমতি
সতত রঙ্গ অভিলাষী,
ভাবিলেন মনে মনে পার্বতী পতি সনে
“চিত্তরঞ্জন করি’ আসি ।”
কৈলাসে পৌঁছায়ে যবে কহিলেন মহাদেবে
তাঁহার খুশীর কি কারণ,
শিবেরও হইল সাধ দেবভোগে আস্বাদ
নীলকণ্ঠে অমৃত ধারণ।
কহেন দেবর্ষি – “স্বামী কি কহিব আজি আমি
প্রসাদ ত’ নাহি অবশিষ্ট,”
শ্রবণি’ কৈলাসপতি দু:খিত চিত্ত অতি
নিঠুর বিষ্ণু মোর ইষ্ট।
অকস্মাৎ ললাটেন্দু হেরিলেন একবিন্দু
দেবভোগ নারদের করে,
অবিলম্বে সেবি তাহা নৃত্য করেন দোঁহা
ত্রিভুবন কম্পিত ভারে।
সহসা এহেন নৃত্যে মেনকা–দুহিতা চিত্তে
শঙ্কার হয় জাগরণ,
শুধান স্বামীরে সতী মহামায়া পার্বতী
“তাণ্ডব নৃত্য কি কারণ !”
“বসুন্ধরার লয় তবে কি সমীপে হায়
না না তাহা অসম্ভবই বটে,
তবে কি ঘটিল আজ নৃত্যরত নটরাজ
দেবর্ষিই আছে সর্বঘটে।”
উত্তরে পিনাকপাণি কহিলেন যাহা শুনি
অভিমানী মাতা শিবাণী, সর্বযজ্ঞেশ্বর প্রসাদ বন্চিত লভিতে স্বাদ
একাকী সেবিলেন শূলপাণি !
অবশেষে পার্বতী হইলেন ধ্যানে ব্রতী
লক্ষ্মীপতির স্তব স্তুতি,
তপে তুষ্ট জনার্দন দুর্গা সনে দরশন
প্রার্থনা কহ সদাগতি ।
“হে দেব অন্তর্যামী তিন ভুবনের স্বামী
তুমি ত’ জ্ঞাত সবই প্রভু,
যাচনা যৎসামান্য তোমার পবিত্র অন্ন
বন্চিত করিও না কভু।”
“তবে এই সংসারে মাতা সবে ডাকে মোরে
মর্ত্যবাসী সন্তান মম,
তাহাদের বিনা আমি সেবিব কিমতে স্বামী
দেবভোগ অমৃত সম !”
হাসেন বৈকুণ্ঠপতি “বিমলা বুদ্ধিমতী
পূরণ করিব অভিলাষ,
কলিযুগে যবে আমি হইব জগন্নাথস্বামী
শ্রীক্ষেত্রে লীলার আবাস।”
“বিলাইব মহাপ্রসাদ সকলে লভিবে স্বাদ
কিন্তু সর্বাগ্রে তব অধিকার,”
ধন্য মাতা মহামায়া দেবাদিদেব জায়া
আর ধন্য পাষাণ–উদ্ধার।
শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে জগন্নাথের নামে
লক্ষ ভক্তের সমাগম,
দেব দেউল পার্শ্বে বিরাজিতা দেবী হর্ষে
দেবভোগে অধিকার প্রথম।
অনন্তর মহাপ্রসাদ আহা কি অপূর্ব স্বাদ
বিতরিত সর্ব ভক্তজনে,
পুরাণ–কথামৃত ছন্দালোকে বিভাসিত
প্রণমি ইষ্টদেবী চরণে।
————————————————————————
স্বপন চক্রবর্তী।