মায়ের সাথে অনেকটা পথ হেঁটে আমাকে স্কুলে যেতে হত আর যাবার পথে মায়ের আঙুল ধরে গাড়ীঘোড়া লোকজন দেখতাম আর তিড়িং পিড়িং করে আনন্দে লাফাতাম। “মা, এটা কি গাড়ী, ওর মাথায় পাগড়ী কেন্? ওই লোকটা কপালে কি লাগিয়েছে মা? ওরা গাছের নিচে থাকে কেন? এসব প্রশ্ন করে মাকে বেশ বিব্রত করতাম্। মা কিন্তু কোনদিন বিরক্ত হতেন না, বেশ সুন্দর করে আমাকে সব বুঝিয়ে দিতেন। একদিন একটা প্রশ্ন করে মাকে যে বেশ বিব্রত করে দিয়েছিলাম আজ পুর্নবয়্ষ্ক হয়ে সেটা উপলব্ধি করতে পারি “মা, তুমি কেন অনির্বানের মায়ের মত সুন্দর সুন্দর শাড়ী পর না?
আমার বাবা ছিলেন কোন এক প্রাইভেট কোম্পানির টাইপিষ্ট্, মাইনে খুব একটা বেশি পেতেন না। আমার পড়াশুনার খরচা যোগানোর জন্য কোথাও একটা পার্ট টাইম জব ও করতেন, সেজন্য বাড়ী ফিরতে তার অনেক রাত হয়ে যেত। মাও বাড়ীর সব কাজ একা হাতে করতেন, বাবার প্রতি তার কোন অনুযোগ ছিল না। আমি হয়্ত পড়াশুনায় ভালোই ছিলাম কিন্তু এখন বুঝতে পারি বাবা মায়ের দুখঃ কষ্ট্, ইচ্ছা বোঝার মত মস্তিষ্ক ভগবান আমাকে দেননি। সেই ছোটবেলা থেকে কেমন জানি বেশ জেদি আর স্বার্থপর ছিলাম আমি। মা মাঝে মাঝে আমাকে বকাঝকা করলে বাবা-ই মাকে শান্ত করত ” তুমিও পার রমা! ও এখনো অনেক ছোট, বড় হলে নিজের ভুল ও নিজেই বুঝতে পারবে” আমি বুঝেছিলাম কিন্তু অনেক দিন্, অনেক বছর পরে, তবে আমার মস্তিষ্ক দিয়ে নয়্, পানুর মস্তিষ্ক দিয়ে। অনেক মহান সে, কত অভাব, কষ্ট সহ্য করে কিভাবে যে সে বড় হয়েছে তার অনেক কিছুরই সাক্ষী আমি। আমি এক্প্রকার ঘৃণা-ই করতাম তাকে, তার মাকে। তবে স্কুলে যাওয়া আসার পথে তাদের দিনলিপির অনেকটাই প্রত্যক্ষ করতাম আমি।
আমার স্কুলের পথে একটা নোংরা ফেলার জায়্গা ছিল। সেখানে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বাস করত একটা পরিবার্। সব সময় ঝগড়া লেগেই থাকত তাদের্। পরিবার প্রধান সম্ভবত বেশ নেশাখোর লোক ছিল। এক মহিলাকে প্রায়ই দেখ্তাম তার দুই ছেলেকে গালাগাল দিতে আর ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে কান্নাকাটি করতে। তাদের আয়ের উৎস বা ঝগড়ার কারণ কোনদিনই আমি অনুধাবন করতে পারিনি, কারণ সে মস্তিষ্ক আমার ছিল না। মাকে তো এক্দিন বলেই ফেলেছিলাম “মা, ওরা ছোটলোক্, তাই না?” মা আমাকে সেদিন বেশ করে বকা দিয়েছিলেন, সেদিন কেঁদে ফেলেছিলাম কিন্তু মায়ের বকা দেবার কারণ বুঝতে পারিনি। আজ আমি বেশ বুঝি “কোন মানুষ পরিবেশগত ভাবে বা বংশ পরিচয় নিয়ে ছোটলোক হয় না, মন ছোট হলে সে ছোটলোক হয়্”
আমি যাখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি, একদিন দেখলাম কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে একটা শবদেহ আর সেই মহিলার আকূল কান্না। বুঝলাম সেই মাতাল লোকটা পরলোকের টিকিট কেটে ফেলেছে। এর ঠিক মাস দুয়েক বাদে ক্লাস ইলেভেনের ফাইনাল পরিক্ষা, আমি আমার বইয়ের জগতে ডুব দিয়েছি। একদিন বিকেলে বেরিয়ে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে একটু দাড়িয়েই পড়লাম্। ময়্লা ফেলার জায়গাটা আছে, সেই দূর্গন্ধ ও আছে, শুধু ছাউনিটা নেই। সেই মহিলা বা তার পরিবারের কোন সদস্যেরও দেখা নেই। অনেক প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে উঁকি দিল বটে কিন্তু তারা আমার ভদ্রলোক হবার অহংকার্, ভালো স্কুলের মেধাবী ছাত্র হবার অহংকারকে হারাতে পারল না। ওরা যে ছোটলোক।
ক্লাস টুয়েল্ভে উঠেছি তৃতীয় হয়ে। স্কুলের টিচার বলেছে আর কয়েকটা মাষ্টারের কাছে পড়লে আমি আরো ভাল ফল করতে পারতাম। আমার তো অহংকারে মাটিতে পা ই পড়তে চায় না। অনেক চাপ দিয়ে আরেকটা অঙ্কের মাষ্টার আর একটা রেসিং সাইকেল বাবার থেকে আদায় করলাম্।আমি তো তখন প্রায় বুদ্ধিজীবি হয়ে উঠেছি, কোথা থেকে টাকা আসছে, আর কিভাবেই বা এই বাড়তি খরচা সংসার খরচ থেকে মেক আপ করা যাবে – এসব আমি ভাবতে যাবি কেন! তোমরা আমাকে জন্ম দিয়েছ, তোমাদের দায়েত্ব এসব। বাবা মায়ের পেটে থাবা বসাল আর্থিক সমস্যা। আধাপেটা থেকে তারা তাদের একমাত্র ছেলের চাহিদা পূরণ করতে থাকল। বাবার শরীর ভাঙতে থাকল। মা আরো বেশী করে ঘুঁটে দিয়ে, ঠোঙা বানিয়ে ভাঙনে বাঁধ দিতে গিয়ে, ভাঙনে সাথী হতে থাকলো। আমি তো স্মার্ট্, শিক্ষিত, সাধারন লোকেদের এসব সাধারন বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে ডাক্তার-ইনজিনিয়ার হবার স্বপ্নে মশ্গুল্। ডানা আমার আগেই গজিয়েছিল ফলে ডানা ঝাপটে একটু চিত্রগ্রীব তো হয়ে উঠতেই হয়্। এক্টা গার্লফ্রেন্ড ছেড়ে দ্বিতীয়টার সাথে বেশ মাখোমাখো অবস্থা।
টেষ্ট হয়ে গেছে। জোরকদমে পাড়াশুনা চলছে তবে বিকেলে একটু ডানা ঝাপটাতে না পারলে, মনতা কেমন উড়ু উড়ু করে। সেদিন বাড়ী ফিরতে একটু দেরি ই করে ফেললাম কারণ চোখে পড়ে গেল কৃষ্ণচূড়া গাছ্টার নিচে কিছু পরিবর্ত্ত্ন। নতুন কেউ এলো? নাকি তারাই আবার ফিরে এসেছে? এসব আমার ভাবার বিষয় নয় কিন্তু তবুও দাড়িয়ে পড়লাম কৌতুহল মেটানোর জন্য্। এবারকার ছাউনিটা একটু নীচু আর ঢাকা নীল রংয়ের একটা পুরানো পলিথিন সীট দিয়ে।ভেতরে হাল্কা আলোর ভাব, সম্ভবত কূপীর আলো। একটা বছর পাঁচ ছয়ের ছেলে সেখান থেকে বেরিয়ে খিল খিল করে হাসতে হাসতে আমার সাইকেলে আরেকটু হলেই ধাক্কা খেত। সে ছেলে রীতিমত সাইকেলের সামনে ব্রেক কসিয়ে “সরি দাদা” বলেই আবার ঘরের পেছনে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম সে….ই মহিলা “ও পানু আয় বাবা, অন্ধকার হযে গেছে, ভূত আসবে কিন্তু” সাথে সাথে সে দুরন্ত ছেলে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল “মা কাছে থাকলে ভুতে আমার কিচ্ছু করতে পারবে না”। তাদের এই সামান্য কথোপকথোনের মধ্যে আমার হয়তো অনেক কিছুই সেখার ছিল। কিন্তু আমি শিখব কেন? আমি ভদ্রলোক না! ছোটলোকেদের কাছে শেখার আছেই বা কি? আমার মন জুড়ে এদের সম্পর্কের কাটাছেঁড়া চলছে। এই মহিলার এত ছোট একটা ছেলে! অসম্ভব্! তাহলে এতদিন আমার চোখে ঠিক পড়তো। তাহলে কি কোন গোপন সম্পর্কের ইঙ্গিত্! ছোট মন – ছোট চিন্তা ভাবনা।
দিন দুয়েক পর আবার আমার নজরে এল সেই ছোট্ট ছেলেটা, ছাউনির বাইরে গাছতলায় বসে কোন একটা বই পড়ছে, একটু পরে বইটা পাশে সরিয়ে রেখে একটা পূরানো খবরের কাগজ খুব মন দিয়ে পড়ছে। আমি ভেবেই নিলাম যে সে হয়তো কোন ছবিটবি দেখ্ছে। একে বাচ্চা তারপর থাকে তো এই নোংরা জায়গায়, ওরা আবার কি পড়াশুনা করবে! কিন্তু যতই আমার মনে ওদের প্রতি অবজ্ঞা আর অবহেলা থাক, ওদের কাজকর্ম আর ছাউনিটা আমার চোখে ঠিক ধরা দেয়্। এর বেশ কিছুদিন পর একদিন দেখলাম পানু মায়ের হাত ধরে তিড়িং পিড়িং করে লাফাতে লাফাতে মনে হল স্কুলেই যাচ্ছে। পিঠে একটা পূরানো স্কুল ব্যাগ্, গায়ে একটা পূরানো কিন্তু পরিষ্কার স্কুল ইউনিফর্ম্।পানুর মাকে এতদিন ধরে দেখছি কিন্তু আজ্কের মত এত উজ্বল আনন্দিত মুখ আমি দেখিনি। আমার পাপী মন, অন্য লোকের আনন্দে আমি তো আনন্দিত হতে পারিনা, মুখ বিকৃত করে রইলাম “এই বুড়ী বয়সে এত ছোটো একটা ছেলে নিয়ে যেন রাজ্য জয় করতে চলেছে”।
উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষা শেষ হয়েছে, রেজাল্ট বেরতে এখনো মাস দেড়েক দেরি। সেদিন বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে মারতে আমার চোখে পানু ধরা পড়ল। সে গাছতলায় বসে একমনে অঙ্ক করছে। তার মা তাকে কিছু খাওয়াতে চাইছে, আর সে কিছুতেই খাবে না। বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে, একটু দুরে দাড়িয়ে তাদের কার্যকলাপ আমি লক্ষ করতে লাগলাম “বলছি তো খাব না, এই অঙ্কটা না করতে পারলে আজ আমি কিছুই খাব না” পানুর কথা শোনামাত্র তার মা খাতায় করা অঙ্কটা দেখে হেসে ছেলের মাথায় একটা চাঁটি মারলেন “কি করে মিলবে রে তোর অঙ্কটা, হাতের দুইটা কি উড়ে গেল নাকি!” পানু এবার নিজের মাথায় নিজেই চাঁটি মারল “তুমি ঠিকই বলেছ মা, আমার মাথায় গোবর ভরা” ” ধ্যাৎ! তুই তো আমার সোনা ছেলে- নে খেয়ে নে” মা এবার ছেলের মুখে রুটি আর গুড় দিতে লাগল। সে খেতে খেতে মায়ের মুখে কয়েকটা রুটির টুকরো ঢুকিয়ে একগাল হাসল “তুমিও খাও মা” বিষয়টা বেশ স্পর্শ করল আমাকে। কিন্তু ওই যে অহমবোধ আর বুদ্ধিজীবি ভাব, বিষয়টাকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিল। কাউ কে জ্ঞান দিতে, তাদের বিষয়ে উল্টপাল্টা ভাবতে বাধা নেই কিন্তু ঘরে ঢুকলেই শুধু আমার আমি, নিজের জন্মদায়িনির কথাও মাথায় আসে না।
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে জয়েন্টে ভাল রেঙ্ক ও করলাম আর আমার পাঁচ নম্বর গার্লফ্রেন্ডের বাবার বদান্যতায় ডাক্তারিতে ভর্তি ও হয়ে গেলাম। আমার উন্নতি আর উজ্ব্ল ভবিষ্যত দেখে মা কিন্তু খুব কেঁদেছিল। বাড়ীতে মাসে হয়্ত মাসে একবার আসতাম কিন্থু মা-বাবার ওই অসুস্থ শরীর আর ওই অস্বাস্থকর ঘরগুলি আমার সমস্ত বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়াত। এত মেরুদন্ডহীন অপদার্থ ছিলাম আমি যে মায়ের তৈরি লুচী তরকারি ফেলে আমি অপর্ণার সাথে চাইনিজ খাওয়াটাকে আমি আমার জীবন বানিয়ে ফেলেছিলাম। বাবা মায়ের সাথে দুটো ভাল করে কথাও বলতাম না। ডাক্তারির দ্বিতীয় বর্ষে অনেক কষ্ট পেয়ে, রোগে ভুগে বাবা মারা গেলেন। সেই সময় মায়ের লড়াই দেখে অনেক কিছু শিখতে পারতাম, মায়ের পাশে থেকে তার দুখঃ ভাগ করে নিতে পারতাম কিন্তু সেসব ভাবার বা করার মত মনই আমার ছিল না। বাড়ীতে এসে বাবার শ্রাদ্ধ-শান্তি করতে করতে মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল “মরার আর সময় পেল না! কত প্রগ্রাম ছিল আমার্” মায়ের চোখের জল, তার একাকিত্ব কোন দাগই কাটল না আমার মনে। সে মনের লক্ষ তো অনেক বড় শুন্যের দিকে।
একসময় ডাক্তারি পাশ করে ডক্টর গৌতম সেন হয়ে গেলাম আর তারপর এমডি করে কার্ডিওলজিস্ট ও হয়ে গেলাম্। গুছিয়ে চেম্বার খুলে বসলাম। সবাইকে গর্ব করে বলতে লাগলাম কিরকম পরিস্থিতি থেকে আমি আজ এ জায়গায় উঠে এসেছি, জীবনের কষ্ট আর পরিশ্রমের ফল এটা। ডাক্তারকূল আমাকে বাহবায় ভাসিয়ে দিল। আমিও সেই স্রোতে ভাসতে ভাসতে কখন যে স্বার্থের ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে গেছি, বুঝতেই পারলাম না। অবশ্য সেভাবে বোঝার চেষ্টাও করিনি কারণ ততদিনে আমি অর্থের সাগরে ভাসতে শুরু করে দিয়েছি। ভালই পসার আমার্, অপর্ণাকে বিয়ে করে ফেলেছি। তবে কোন ভালবাসার বিয়ে নয়, বলা যায় কনট্রাক্ট ম্যারেজ্। শ্বশুরের পয়সায় ডাক্তারি পড়েছি, এমডি করেছি, তার মেয়েকে বিয়ে তো করতেই হবে। অপর্ণা অবশ্য একটু অন্য ধারার মেয়ে, সেও এমডি করেছে, চেম্বারও খুলেছে কিন্তু অনেকের থেকেই সে ফিস নেয় না, ফিজিশিয়ান স্যাম্পেল সে দান করে দেয় আর সেইমত প্রেস্ক্রিপশন করে। কোন প্যাথোলজিকাল সেন্টার বা ওষুধের দোকানের সাথে তার টাই আপ হয়ে ওঠেনি। আমার সাথে এ বিষয়ে তার ঢের মতান্তর্। সে মাঝে মাঝে মায়ের কথা তোলে আর আমার পরিষ্কার কথা “তার জন্য আমি ভাবতে যাব কেন, কি করেছে তারা আমার জন্য্” কোন মনন অনূভুতি, কোন সন্তান সূলভ মনই আমার ছিল না। শারিরীক চাহিদা মেটানোর জন্য আমি অপর্ণার কাছে যেতাম কিন্তু গর্ভবতী হবার পর সে আমাকে তার কাছেই ঘেঁসতে দিত না। আমার অবশ্য এর জন্য খুব একটা ফারাক পড়ত না, বিকল্প ব্যাবস্থা আমার অনেক ছিল। পয়্সার অভাব আমার ছিল না, ছিল শুধু মনুষ্যত্বের অভাব, তাই এক সন্তানের পিতা হয়েও পিতৃত্ব বা পতিত্ব কোনটির অনূভুতি আমার জন্মায় নি আর সেজন্য উপভোগ ও করা হয়ে ওঠেনি।
আমার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স যত বাড়্তে লাগল, আমার লোভের পারদও চড় চড় করে উপরে উঠতে থাকল। তিন তিনটে নার্সিংহোমের সাথে আমার চুক্তি হল, আর পীড়িতের রক্ত চুষতে চুষতে আমি এক হৃদয়্হীন ড্রাকুলা হয়ে উঠলাম্। সেদিন যাচ্ছিলাম সারা সপ্তাহের জমা করা ফিজিশিয়ান স্যাম্পেল বিক্রী করতে, হাজার পনেরো আমদানি আছে। কার্ডিওলজিস্ট হবার পর এ আয়টা আমার বেশ বেড়েছে। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না, নিজেই গাড়ীতে করে পাল মেডিকেলের স্টোরে মাল দিযে আসি, টাকা ট্রান্সফার হযে যায় আমার একাউন্টে।সেদিন বাধা পেলাম্, হঠাৎ এক সুদর্শন যুবক দুহাত মেলে আমার গাড়ী আটকাল। চরম বিরক্তিতে তাকে বেশ কিছু অশ্রাব্য ইংরেজি গালাগালি দিয়ে দিলাম্। লক্ষই করলাম না তার আকূতিভরা চোখের জল “ডাক্তারবাবু, আমার মায়ের বুকে প্রচন্ড ব্যাথা, প্লীজ স্যার্, মাকে একটু দেখুন” সে আমার পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছিল। আমার ড্রাইভারও হাত জোড় করে ছেলেটির মাকে দেখার জন্য বলল। আমি একপ্রকার বাধ্য হয়েই ছেলেটির সাথে চললাম, আশ্চর্য হয়ে গেলাম দেখে যে আমি চলে এসেছি ঠিক সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচের সেই ছাউনিতে। এখন একটু গোছানো, বেশ ঘর ঘর ভাব, ভেতরে একটা ল্যাম্প জ্বল্ছে – সৌর ল্যাম্প। আমি বুঝে গেলাম পানুই আমাকে এখানে এনেছে, তার মা-ই অসুস্থ। ল্যাম্পের পাশে দ্বাদশ শ্রেনীর পদার্থবিদ্যা আর অঙ্কের বই। “পানু সায়েন্স পড়ছে!” আমি জীবনে এই প্রথমবার বিনেপয়সায় চিকিৎসা করলাম্। ভালো করে সেই মহিলাকে চেক করলাম আর পানু না চাইতেও আমার স্টক থেকে পাঁচদিনের ওষুধ দিয়ে দিলাম্। মনটা কেন জানিনা আজ বেশ ভাল লাগছিল, অপর্ণার কথা মনে পড়ছিল। মা কেমন আছে কে জানে!। গাড়ীতে বসে বেশ আশ্চর্য লাগ্ছিল আমার, সেই ছোট্ট পানু এই ছাউনি তে থেকে দ্বাদশ শ্রেনিতে পড়ছে, তাও সায়েন্স নিয়ে!।
আমি যে জগতে আনাগোনা শুরু করেছিলাম সেখানে মানুষ অনেকই ছিল, শুধু আমার মানবিক প্রবৃত্তিগুলো নষ্ট হয়ে গেছিল। পানুর মায়ের অসুস্থতা মাঝে মনে একটা দাগ কেটেছিল কিন্তু সেটা মিলিয়ে যেতেই আবার আমি সেই মনুষ্যদেহধারি ড্রাকুলা – কোন মায়া-মমতা, বাৎসল্য্, শ্রদ্ধা সে অমানবীয় শরীরকে নাড়া দেয় না। অপর্ণার সাথে সম্পর্ক প্রায় শেষের দিকে। মাঝে মাঝে দেখি মাসখানেকের জন্য ছেলেকে নিয়ে সে উধাও, চেম্বারে তালাবন্ধ, হরিদাও কিছু বলতে পারে না। আমার পাপী মন বলে – সে নিশ্চয় অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে। অপর্ণা কোনদিনই আমার পয়সার প্রত্যাশী ছিল না আর মহিলা সঙ্গের আমার যা রেকর্ড তাতে সে যদি তেমন কিছু করেই থাকে আমার তো কিছুই বলার থাকে না। আমার ছেলে যে এক নামি কনভেন্ট স্কুলে পড়ে তাও তো আমি জানতাম না, যদি না বিখ্যাত ডাক্তার গৌতম সেন কে সেই স্কুল তাদের এনুয়াল ফাংশনে চিফ গেষ্ট করে সন্মানিত হতে চাইত। যে স্কুলের ছাত্রের মা বাবারা তাদের ছেলেরা ভাল বাংলা জানে না বলে গর্বিত বোধ করে সেখানে আমার ছেলে শুদ্ধ বাংলায় আবৃতি করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিল। চিফ গেষ্ট হয়েও আমি যেন কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম্। অমন কঠিন কবিতা কেমন সাবলীল ভাবে, দৃঢ়কন্ঠে আবৃতি করে চলেছে আমার ছেলে, অয়ন “বল বীর্, বল উন্নত মম শির, শির নেহারি ওই শিখর হিমাদ্রীর্……….. ” কে শেখাল ওকে এই কবিতা! নিশ্চয় অপর্ণা! কিন্তু আমি এতই হতভাগা যে আমার চিন্তাতে বিন্দুমাত্র এলোনা যে ছোটবেলায় মা আমাকে এসব সবই শিখিয়েছিল। আমার বাংলা, ইংরেজি, অঙ্কের গোড়া যে শক্ত হয়েছিল সে সবই আমার মায়ের দান।
এভাবে আরো কিছু বছর কেটে গেল। মেডিকেল কলেজের্ ভিজিটিং ফ্যাকালটির কাজটি আমার না পছন্দ হলেও নিতে হল। অন্য প্রফেসরদের কাছে একটা নাম অনেকবার শুনতে শুনতে ফাইনাল ইয়ারের সে ছেলেটিকে একদিন ডেকে পাঠালাম। সে এসেই আমাকে প্রনাম করল, মুখে তার অদ্ভুত হাসি “আমাকে চিন্তে পারছেন স্যার্?” আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম “পানু! তুমি! তোমার নামই প্রনবেশ দাস্? ” হ্যা স্যার আমি ই প্রনবেশ দাস, পানু। জানেন স্যার্, অনেকদিন আপনাকে খুঁজেছিলাম, আমার বিশ্বাস ছিল আপনি ই আমার মাকে বাঁচাতে পারবেন্, আপনার বাড়ীতেও গেছিলাম, অপর্ণাদির কাছে শুনলাম আপনি কি একটা সরকারি মিশনে আমেরিকা গেছেন্। অপর্ণাদি অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু আমার মা বাঁচলেন না। মা দেখেই যেতে পারলেন না যে তার পানু ডাক্তার হয়েছে” পানু আর কিছু বলতেই পারল না ঝর ঝর করে তার দুচোখ বেয়ে অবদমিত অশ্রুবন্যা বইতে লাগল। আমার পশু মনটাও কেমন ভারি হয়ে উঠল। আরো অনেক প্রশ্ন আমার মনে ভীড় করে এলেও পানুর বর্ত্ত্মান পরিস্থিতি আঁচ করে প্রশ্ন প্রশ্নই রয়ে গেল, শুধু উঠে দাড়িয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম ” তুই অনেক বড় ডাক্তার হবি পানু”|
আমার চ্যালাচামুন্ডা মারফৎ একদিন হঠাৎই আমাকে কানে এল যে মা আমাদের ভাগের বাড়ীটি বিক্রী করে গ্রামের বাড়ী চলে গেছেন। আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল, আমাকে না জানিয়ে আমার ভাগ না দিয়ে চলে গেলেই হল! আমিও ছাড়ব না। একদিন চেম্বার না করে, নিজে গাড়ী চালিয়ে সোজা চলে গেলাম সেই গ্রামে। বাড়ী চিনতে অসুবিধা হলেও “রমা সেন্” নামটা বলতেই সকলে আমাকে সেখানে পৌছানোর নির্দেশ দিয়ে দিল। আমি বেশ অবাকই হয়ে গেলাম – আমার দু দুটো হাজার স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে, লেটার বক্সে বেশ গোটা গোটা করে লেখা ডক্টর গৌতম সেন্, এমডি, কার্ডিওলজিষ্ট্, আরো কটা বিদেশি ডিগ্রী তবুও এলাকার অনেক লোকই আমাকে চেনে না। আমার অহংকারকে ধূলিষ্যাত করে দিল একটা চায়ের দোকানের ছেলে।কাছাকাছি পৌছে, একটা মোড় এল ডাইনে না বাঁয়ে যাব বুঝতে না পেরে চায়ের দোকানের ছেলেটির কাছে জানতে চাইতেই সে দু হাত জোড় করে আমার মায়ের উদ্দেশ্যে প্রণাম করল “রমা দিদিমনির কথা বলছেন তো!” তার ভাবভঙ্গি আমার মুখে একরাশ বিরক্তি এনে দিল। আমি রীতিমত ঝাঁঝিয়ে উঠলাম “তোদের ওই দিদিমনি-ফনির কথা আমি জানিনা, রমা সেন, তার ছেলে অনেক বড় ডাক্তার, আমি সেই ডাক্তার” সেও সমান ঝাঁঝিয়ে উঠল “দেখুন তিনি ভগবান মানুষ্, তার সম্ব্ন্ধে অসন্মানিয় কথা বলবেন না, তিনি মানুষ তৈরি করেন। আপনি তার ছেলে হতেই পারেন না। তার ছেলেকে এই গাঁয়ের সক্কলে চেনে, সে আপনি নন” আর দাড়িয়ে দাড়িয়ে অপমান হজম করার কোন মানেই হয় না। আমি গাড়ী নিয়ে এগোলাম। ছেলেটার কথাগুলি আমার মোটেও হজম হচ্ছিল না। মা আমাকে ছেলে হিসাবে মানেনই না, সে না হয় ঠিক, ছেলের কোন কাজই সে করে নি কিন্তু মা কাকে ছেলে বলে মানে!
অবশেষে পৌছে গেলাম মায়ের ঠিকানায়্। একটা আটচালা ঘর ঘিরে অনেকটা জমি, চারিদিকে ফল ও সব্জীর খেত। সেখানে কলা, সবেদা, নারকেল গাছ যেমন আছে, শাকসব্জীও ভরন্ত। কয়েকজন অল্পবয়সী ছেলে খেতের পরিচর্যা করছিল, লোহার বড় গেট ঠেলে আমি যেই ভেতরে প্রবেশ করলাম, দু তিনটি ছেলে দুদ্দাড় করে ছুটে এল “মায়ের ক্লাস চল্ছে এখন, ভেতরে যেতে পারবেন না” আমার গা রীতিমত জ্বলে গেল – কুড়ি হাজার টাকা রোজগার জলানজলি দিয়ে এলাম তার সাথে দেখা করতে, কতরকম নিয়ম আর বাঁধা, যেন মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে এসেছি। বরঞ্চ মুখ্যমন্ত্রীই তাকে বেশি পছন্দ করেন। “তাকে বল গিয়ে তার ছেলে ডক্টর গৌতম সেন এসেছে” ছেলেগুলো কেমন যেন ভুত দেখার মত করে আমাকে দেখতে লাগল, তারপর একটা গুটিগুটি পায়ে ভেতরে গেল। আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে সেখানে অপেক্ষা করতে লাগলাম্। মিনিট দুয়েক পর ছেলেটি বেরিয়ে আমার মুখোমুখি “মা বলেছেন মিনিট পনের অপেক্ষা করতে হবে। ক্লাস শেষ হলে তিনি ই বাইরে আসবেন, আপনার ভেতরে যাবার দরকার নেই” আমার ইচ্ছা করছিল দৌড়ে গিয়ে বেশ কিছু গালাগালি দিয়ে আসি, মনে হচ্ছিল অনেক হয়েছে, দেখা করার কোন দরকার নেই, ফিরেই যাই। হঠাৎ একটা ছেলে জিজ্ঞাসা করে বসল “আপনি কি ডাক্তার্! আমাদের ছোটু ডাক্তারের দাদা?।
সেদিন মায়ের সাথে দেখা করলাম ঠিকই কিন্তু তার মধ্যে কোন মাতৃসুলভ অভিব্যাক্তি আমি খুঁজেই পেলাম না। তবে তিনি এখন সে দুঃখী আর পরমুখাপেক্ষী মা আমার আর নেই। তিনি এখন অনেক স্বনির্ভর্, আত্মবিশ্বাসী এবং ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন। কোন এক ছোটুর নাম নিয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত, গর্বিত। তিনি পরিষ্কার করে একটা কথা আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন, আমার থেকে তিনি কিচ্ছু প্রত্যাশা করেন না আর আমার পৈতৃকবাড়ী বিক্রীর অর্ধেক টাকা আমার নামেই ব্যাঙ্কে রাখা আছে, দরকার হলে আমি সেদিনই নিয়ে নিতে পারি। আমার মনে যে প্রশ্নটা উঁকি মারছিল সেটা প্রশ্নই রয়ে গেল, শুধু জান্লাম যে ছোটু একজন ডাক্তার যাকে গোটা গ্রাম মায়ের ছেলে হিসাবেই জানে। এ জমি বাড়ী স্কুল সব ছোটুই করে দিয়েছে। সপ্তাহে তিনদিন এসে এখানেই থাকে, মায়ের স্কুলে পড়ায়, বিনে পয়্সায় সকলের চিকিৎসা করে আর ঔষধও বিনেপয়্সায় দেয়। আমাদের ডাক্তার কূলের কলঙ্ক, কে এই ছোটু ডাক্তার্! পয়সায় সে আমাকে সে কোনদিন ই হারাতে পারবে না কিন্তু নাম যশে সে আমার থেকে অনেক এগিয়ে গেছে। বিষয়টি আমার অহংকারি মনকে এক নতুন প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিল। আমার পরিচিত মহলে সেই ছোটু ডাক্তারটি কে এবিষয়ে অনেক খোঁজখবর লাগালাম কিন্তু কিছুই জানতে পারলাম না আর যখন তার কার্যকলাপের বিবরন সবার কাছে উপস্থিত করলাম, তার তো হেসেই আর দম ফেলতে পারে না ” কে সে মেন্টাল্!”
বছর দুয়েক কেটে গেলেও ছোটু ডাক্তার নামটা আমার মস্তিষ্কের ধূষর কোষে কেমন যেন ফেভিকলের মত সেঁটে গেছিল। সরকারি নমিনেশনে ছয় মাসের জন্যআমাকে কানাডা যেতে হবে তাই ভাবলাম যাবার আগে অপর্ণার সাথে একবার দেখা করে যাই। তার চেম্বারে পেশেন্ট ছিল না, আমি পেছনে দাড়িয়ে আছি আর সে বেহুঁশ হয়ে কার সাথে বেশ হেসে হেসে কথা বলেই চলেছিল। আমি অপেক্ষা করছিলাম তার কথা শেষ হবার কিন্তু হঠাৎ অপর্ণার মুখে ছোটু নামটা শুনে আগ্রহী হয়ে কান খাড়া করে তার কথা শুনতে লাগলাম ” সত্যি ছোটু, তোর উপর আমার হিংসে হয়্, এই বয়সে এমডিও করে ফেললি!” এবার আমি আমার সব রাগ, সন্দেহ, ছোটুর প্রতি বিদ্বেষ নিয়ে অপর্ণার উপর ঝাপিয়ে পড়লাম “ও এবার বুঝতে পেরেছি, মাঝে মাঝে কোথায় উধাও হযে যাও! ওই ছোটুকে তোমার জালে ফাঁসিয়েছ? ছেলেটাও কি ছোটুর নাকি? আমার নামে চালাচ্ছ!” অপর্ণা ফোনটা রেখে কঠিন চোখে আমার দিকে তাকাল, চোখে আমার প্রতি তার ঘৃণা উপছে পড়ছিল “তোমার সাথে ঝগড়া করার প্রবৃত্তি বা ইচ্ছা কোনটি ই আমার নেই। আমি কালই ডিভোর্স ফাইল করছি। যদি মিউচুয়াল সেপারেশনের ইচ্ছা থাকে, সই করে দিও নাহলে কোর্টেই দেখা হবে। ছোটুর নখের যোগ্য যদি তুমি হতে তাহলে সবাইকে গর্ব করে বলতাম গৌতম সেন আমার স্বামী। আমার থেকে সাত আট বছরের ছোটো সে, তার মত হতে পারলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতাম্, তুমি অনেক নাম করতে পার, অনেক ডিগ্রী অর্জ্জন করতে পার কিন্তু ছোটুর মত মানুষ তুমি কখনো হতে পারবে না। এক্ষুনি বেরিয়ে যাও এখান থেকে, নহলে দারোয়ান ডাকতে বাধ্য হব” চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে আমি নিজেকেই দুষতে লাগলাম্। একটা ক্লু পেয়েও ছোটুর পরিচয় আমি যোগাড় করে উঠতে পারলাম না। ডিভোর্সের প্রস্তুতি আমিও মনে মনে নিয়ে ফেললাম আর উকিলের সাথে প্রাথমিক কথাবার্তা সেরে আমি কানাডার বিমানে উঠে পড়লাম্। আমার অনুরাগী ড্রাকুলা ভক্তবৃন্দ আমাকে বিমানবন্দরে সি-অফ করতে এল কিন্তু মা, স্ত্রী, ছেলে থাকতেও কেউ নেই আমার পাশে, কেমন যেন এই প্রথমবার নিজেকে নিঃসঙ্গ লাগছিল।
প্লেনে বসে আমার মনের মধ্যে কেমন এক অদ্ভুত লড়াই চলছিল। আমি কিছুই এর বুঝতে পার্ছিলাম না, আমার মত রসকসহীন রক্তলোলুপ ড্রাকুলার যে একটা মন আছে সেটাই তো ভুলে গেছিলাম। কানাডার ছয় মাস এবার আমার জেলখানায় বন্দী অবস্থার মত লাগলে লাগল। বাধ্য হয়েই আমাকে থাকতে হল এ্যাসাইনমেন্ট রুপী জেলখানায়। তবে বেশ কিছুটা সময় পেয়ে গেলাম একা একা নিজেকে নিয়ে ভাবার্, জীবনের দেনা পাওনার হিসাব মেলানোর জন্য প্রচুর সময় এখন আমার হাতে। সবথেকে অবাক হলাম নিজেই নিজের পরিবর্ত্তন দেখে, এই বিদেশে নারীসঙ্গ আমাকে আর লালায়িত করছে না।বাবার মুখটা বার বার ভেসে উঠতে লাগল। কানাডা পর্ব শেষ করে আমি বেশ কিছু উপলব্ধি নিয়ে বিমানে চাপলাম। আমার মায়ের মত মা পেতে গেলে তপস্যা করতে হয়, তপস্যা না করে পেয়েছিলাম বলে হেলায় হারিয়েছি। অপর্ণা আমার মত স্বার্থপর আর ভোগবিলাসী বা লোভী নয়। ছোটু যেই হোক্, এত লোক তাকে ভালবাসে যখন সে নিশ্চয় কোন মহান ব্যাক্তি। আমি চোখ বুজে সে সব লোকের খোঁজ করতে গেলাম যারা আমাকে চায়্, আমাকে ভালবাসে, কিন্তু কোন মুখ আমার ব্রেনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল না। আমি বেশ বুঝে গেলাম যে ডাক্তার হিসাবে পয়সাওয়ালা পেশেন্টদের কাছে আমি হয়্ত গ্রহনযোগ্য কিন্তু ব্যাক্তি হিসাবে আমি এক বিগ জিরো।
বিমানবন্দর থেকে অমি সোজা গেলাম অপর্ণার বাড়ীতে। সেটা বিক্রী হয়ে গেছে, সে যে কোথায় গেছে কেউ বলতে পারল না। আমার ফ্ল্যাটের দরজার নীচে গোঁজা রয়েছে অনেক খবরের কাগজ আর উকিলের নোটিশ। সেগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে খবরের কাগজের একটা হেড্লাইন আমার দৃষ্টি আকর্ষন করল “ক্রোড়পতি বাঙালী ডাক্তার্, প্রনবেশ দাস” “আমাদের পানু!” নিজের অজান্তে “আমাদের” শব্দটা মুখ থেকে বেরিয়ে এল। এই প্রথম আমার মনে কোন হিংসা এলো না, বেশ আনন্দ হল পানুর জন্য “পারবিরে পানু, তুই সব পারবি” সে কেমন নির্দ্বিধায় জানিয়েছে “আমি জীবনে যা পেয়েছি বা যা আজ পেলাম সব তার মায়ের আশীর্বাদ, আমার যা আছে আর এই পুরষ্কারের অর্থ সব আমি মায়ের স্বপ্ন পূরনের জন্য ব্যায় করব” আর পড়্লাম না “সাবাস পানু, তুই সঠিক ডাক্তার্, তুই সঠিক মানুষ, যা বলেছিস সত্যি করে দেখাস, আমার মত সব ভুলে যাস না”
খবরটা পাবার পর থেকেই খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল পানুকে। বেশ বুঝ্তে পারছিলাম আমার তীখ্ন দাঁত্, নখ আর অহংকারের রোমগুলি ঝরে পড়ছে, নিজেকে বেশ মানুষ মানুষ মনে হচ্ছে। গায়ের চামড়া মনে হচ্ছে অনূভুতি সম্পন্ন। উকীল আমার আর দরকার নেই,অপর্ণার কাছে এখন মাথা নিচু করে সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে নিতে পারি, ক্ষমা চাইতে পারি। ক্ষমা যদি নাও পাই, পানুর কাছে ভাল মানুষ হবার ট্রেনিং নেব। আমার সেই ছোট্ট ছেলেটার কাছেও আমার ক্ষমা চাইতে হবে, তার বাবা হয়েও বাবার মত কোন কাজ তো করিনি, তাই হয়তো বাবা ডাক শোনারও সৌভাগ্য হয় নি। অপর্ণার খোঁজা কোথায় পাব জানি না, কিন্তু পানুকে একটা ধন্যবাদ জানাতে হবে। সে কৃষ্ণচূড়া গাছটা-ই হয়্তো পানুর কোন খোঁজ দিতে পারবে। আমার মনে হল, পানু সে জায়্গা কখনো ছাড়বে না।
সেদিন আমি গাড়ী ছাড়াই হেঁটে হেঁটে আমার ছতবেলার স্মৃতিবিজড়িত জায়্গায় পৌছে গেলাম্। সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটা এখনো রয়েছে কিন্তু তার ঠিক পেছনে সেই ময়্লা ফেলার জায়গায় এক বিশাল বিল্ডিং, ঢোকার পথে বিশাল এক লোহার গেট আর তার উপরে বড় বড় স্বর্ণাক্ষরে লেখা “মাতৃসদন্”। ফুটপাথ সুন্দর করে বাঁধানো, কৃষ্ণচূড়া গাছটার চতুর্দিক সুন্দর করে শ্বেত পাথর দিয়ে বাঁধানো আর প্রতিটি পাথরে লেখা “মা”। বিল্ডিংটার মধ্যে ঢুকব কি ঢুকব না ভাবতে ভাবতে ঢুকেই পড়লাম্। একপাশে অনেকখানি জায়গা জুড়ে হোটেল কিন্তু খাবার জায়্গা সব বাইরে। সমস্ত কাউন্টারে সব বয়ষ্ক মহিলা, তারাই পরিবেশন করছে। অন্য পাশে মেয়েদের জামাকাপড়ের দোকান সেখানেও সবই বয়ষ্ক মহিলা। কাকে পানুর কথা জিজ্ঞাসা করব ভাবতে ভাবতে একটা হোটেলের চেয়ারে বসে পড়লাম। একজন মা-ভাবের মহিলা এগিয়ে এল “কি খাবে বাবা?” খুব ভাল লাগল তার এই আন্তরিক ভাব, এসবের অভ্যেস তো আমার হারিয়েই গেছিল। এদিকে খিদেও পেয়েছিল “যা আছে তাই দিন” তিনি হেসে বললেন “আজকের মেনু – ডাল্, আলুভাজা, ইচড়ের ডাল্না আর পারশে মাছের ঝোল্” আমার মনে হয় এই প্রথমবার কোন মহিলার দিকে মাতৃজ্ঞানে চাইলাম “হ্যা, দিন না” । অনেক নামি দামি হোটেলের দেশী, কন্টিনেন্টাল খেয়েছি আমি এখানে দু তিন গ্রাস মুখে দিয়ে আমার চোখে জল চলে এল, মায়ের কথা খুব মনে পড়তে লাগল। কত আদর করে মা আমাকে খাওয়াতেন্!।
আমি তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বেরোচ্ছি, পানুর সাথে দেখা। সে আমাকে সেখানেই প্রণাম করে বসল, আমি বেশ অপ্রস্তুত বোধ করলাম কারন মনে আমার ঢের সংশয় তার প্রনাম পাবার যোগ্যতা আমার আছে কিনা। “স্যার্, আপনি এখানে? আমি জানালাম যে তার খোঁজেই আমি আজ এখানে এসেছি। সে একগাল নিষ্পাপ হাসি হাসল “আগে ভেতরে চলুন, তারপর সব কথা হবে। কানাডা থেকে কবে ফিরলেন স্যার, আমার খোঁজ কেন করছেন্” “আজই আমি ফিরেছি আর কাগজে তোমার ইন্টার্ভিউ পড়ে এত ভাল লেগেছে যে তোমাকে দেখার ইচ্ছাটা কিছুতেই দমন করতে পারলাম না” পানু মনে হয় লজ্জা পেয়ে গেল ” কি যে বলেন স্যার্, আমি সামান্য এক মানুষ্” তাদের কথার মাঝে বাধা এল ” হ্যারে বাবা, সেই কখন তোর রুগী দেখা হয়ে গেছে, যা এখনই হাত পা ধুয়ে আয়্, খেতে বসবি” তারপর আমার দিকে ফিরে বলল “তোমার বাবা একটু বসতে হবে, এই হতভাগাটার খাওয়া হয়ে যাক তারপর আবার কথা হবে” পানু আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল “কিছু মনে করবেন না স্যার্, একটু বসতেই হবে আপনাকে নাহলে আমার মায়েরা সব খেপে উঠবে আর হেড ওফিসে বড়মার কাছে খবর চলে গেলে সে এক মহা কেলেঙ্কারি হবে”।
পানু খেতে চলে গেল। আমার মাথায় ঘুরতে লাগল অনেক প্রশ্ন। ওর মা তো মারা গেছেন তবে যাদের ও মা ডাকছে এরা কারা? আর বড়মাই বা কে? আগের গৌতম সেন হলে আমি নিজের মত করে একটা ব্যাখ্যা করে নিতাম কিন্তু এখন এই রেখে যাওয়া প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি হচ্ছিল না। বিল্ডিং এর এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে বুঝ্লাম বাইরেটা হোটেল আর দোকান হলেও বাকী অংশটা প্রায় হাসপাতাল্। সেখানে ওটি আছে আইসীউ আছে, প্যাথোলজিকাল সেন্টার আছে আবার বড় একটা ওষুধের দোকান ও আছে – সব ঝকঝকে পরিষ্কার্। একজন বয়ষ্ক মহিলা আর দুজন যুবতী মেয়ে তখনো কিছু পেশেন্টকে ওষুধ দিচ্ছিল। তার প্রেসক্রিপশন দেখে একজনের থেকে টাকা নিল কিন্তু অন্যজনের থেকে কিছু নিল না। আমি সঠিক করে কিছু বুঝে উঠতে পার্ছিলাম না কিন্তু একটা বিষয় জলের মত পরিষ্কার আমার কাছে – পানু আমার মত শুধু ডিগ্রীধারি ডাক্তার নয়, সে প্রকৃত ডাক্তার্। ওর পক্ষে একা তো এত কিছু সামলানো সম্ভব নয়, আর কে আছে ওর সাথে! উপরে অনেকগুলি ঘর রয়েছে, মনে হচ্ছে অনেক লোক থাকে, কারা থাকে এখানে? আমার আর তর সইছিল না, বাইরে গেলাম পানুকে খুঁজতে।সে মুখ ধুচ্ছিল, মুখ ধোওয়া শেষ হতেই আরেকজন মহিলে তার হাত মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিল। পানু আমার দিকে তাকিয়ে হাসল ” কি যে কর মা, রোজ এভাবে আমার হাত মুখ মুছিয়ে দাও, ওই দেখ, স্যার দেখছেন্” সেই মহিলা তার গাল টিপে দিল আর হি হি করে হাসল “দেখুক গিয়ে, তুই যত বড় ডাক্তার ই হোস না কেন, আমার ছেলেই থাকবি, তোর বৌ এলেও তোকে ছাড়বো নাকি!
আমি তো নিশ্চিত জানি যে ইনি পানুর মা নন তবুও কত আন্তরিকতা আর প্রীতি পানুর আর আমার নিজের মায়ের কোন খবরই আমি রাখি না, তার সুখ দুখঃ, ভাল মন্দ কোন কিছুরই আমি শরিক হইনি। আমার মত হতভাগা মনে হয় সারা পৃথিবীতে আর কেউ নেই। আবার আমার পাথর হৃদয় নিংড়ে কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে এল। এরপর পানুর থেকে জান্লাম তার জীবনের কথা – সে একদিন স্টেশনে পরিত্যক্ত হয়ে বসে বসে কাঁদছিল, তার বয়স তখন সবে পাঁচ। মা তাকে সাথে করে নিয়ে এই কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচের ছাউনিতে নিয়ে আসেন। পানু এই মায়ের কাছেই তার কাঙ্খিত ভালবাসা আর ভরসা পায়। লোকের বাড়ীতে বাসন মেজে, ঘর পরিষ্কার করেও সদা হাসিমুখ তার। বাড়ী ফিরে ভাত ডাল রান্না করে নিজে হাতে করে তাকে খাইয়ে দিতেন আর তাকে জড়িএ ধরে ঘুমও পাড়িএ দিতেন্। ছেলের পড়াশুনায় আগ্রহ দেখে প্রথম প্রথম কাজের বাড়ী থেকে বই এনে দিতেন্। প্রাথমিক অঙ্ক্, ইংরাজি সব তিনি ই দেখিয়ে দিতেন। তারপর কোন এক নেতার হাতে পায়ে ধরে সরকারি স্কুলে ভর্ত্তি করিয়ে দিলেন্। শুধুমাত্র মায়ের ভালবাসা আর আশীর্বাদ সম্বল করে পরিচয়হীন একটি ছেলে আজ্কের প্রনবেশ দাস, পানু। মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকে সে দুর্দান্ত ফল করলে তার মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে একটা কথাই বার বার বলতেন “বাবা পানু, আমি জানি তুই ভাল ফল কর্বি, খুব বড় হ বাবা, মানুষের মত মানুষ হ। তুই আমার সেই ছেলে যেমন আমি চেয়ে এসেছি” বাকি কথা পানুর থেকে আর শোনা হয়ে ওঠেনি, চোখের জল তার দৃষ্টি ঝাপ্সা করে দিয়েছিল। মায়ের প্রতি গভীর ভালবাসা, অনুরাগ্, অন্তরের অন্তস্থল থেকে দলা দলা কান্না এনে তার শব্দ যন্ত্রকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। পানুর মুখ থেকে যেটুকু শুনতে পেরেছিলাম তাতেই আমার হৃদয়ের পশুপ্রবৃতির মৃত্যু ঘটেছিল আর বেশ উপলব্ধি করতে পারছিলাম যে নতুন পৃথিবীর মাতৃ জঠরে একটা মন ধীরে ধীরে মানবিয় মনের আকার নিচ্ছে।
আমাদের দুজনের বাঁধনহারা কান্না দেখে পানুর মায়েরা এসে তার চখের জল মুছিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে তাকে থামাতে থামাতে তারাও বিহ্বল্, দুজনে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল ” থাক বাবা, কেঁদো না, আমাদের ছোটুটা এই রকমই” ছোটু নামটা শোনামাত্র আমি চোখের জল মুছে ফেললাম “পানু, তুই তাহলে মায়ের ছোটু ডাক্তার্!” “হ্যা স্যার্, বড়মা আমাকে ওই নামেই ডাকে, কিন্তু বড়মাকে আপনি কি করে চিনলেন্?” পানুর প্রশ্নের জবাব তো আমার কাছে ছিল না, কি জবাব দেব! আমার গর্ভধারনী মা, পানু তাকে মা মানে আর আমি তার ছেলের মত কোন কাজ তো করিনি উল্টে সারাজীবন তার অবমাননাই করে এসেছি। সে কেমন আছে, কি চায় কোনদিন ভেবেও দেখিনি। তিনি কত কষ্ট করে আমাকে মানুষ বানাতে চেয়েছিলেন। নিজের সমস্ত সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে আমাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন্। আমি ডাক্তার তো হয়ে গেছি কিন্তু মানুষ হয়ে ওঠা হয় নি। আজ এই প্রথমবার বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট বোধ হতে থাকল। নিজের শরীরের তোয়াক্কা না করে, ওই সামান্য আয় দিয়ে আমাকে যুগপোযোগী শিক্ষা দিয়েছেন, আমার খরচ যোগাতে যোগাতে তিনি মাত্র পয়তাল্লিশ বছর বয়সে বিভিন্ন রোগে ভুগে প্রায় বিনাচিকিৎসায় তিনি মারা গেলেন। অনেক ধার ও হয়েছিল তার, সে চিন্তাও ছিল তার মাথায়্। আমি এতই পাষন্ড, তাদের জন্য কিছুই করিনি, কিছুই ভাবিনি। পানুর মন্দির থেকে আমি দৌড়ে চলে গেলাম এক্টা পুকুর পাড়ে, একটা নারকেল গাছের তলায় বসে কাঁদ্তে লাগ্লাম্। আজ আমি অনেক কাঁদতে চাই, আমার চোখের জল দিয়ে আমার সমস্ত অর্জিত পাপ, অহংকার আজই আমি ধুয়ে মুছে সাফ করতে চাই।
অনেকক্ষন কাঁদার পর আমার বেশ হাল্কা বোধ হচ্ছিল, আর মনে মনে ভেবে নিচ্ছিলাম আমাকে কি কি করতে হবে। মাথায় কে যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, তাতে আমার কান্না আবার ফিরে এল ফোঁপানির আকারে “এত বড় একজন ডাক্তার তার এমন কান্না!” আমি বুঝে গেলাম এ অপর্ণা। আমি তার কোলে মুখ গুঁজে দিয়ে আমি শুধু বলতে পারলাম “অপর্ণা আমাকে ক্ষমা কর, তোমার স্বামী বা ডাক্তার হবার আমার কোন যোগ্যতা-ই নেই, তবুও আমাকে ক্ষমা কর অপর্ণা” সে হয়তো অনেক কথাই বলে যাচ্ছিল কিন্তু আমার কানে কিছুই ঢুকছিল না, শুধু আমার মনে ছিল অদ্ভুত প্রশান্তি আর মানবিক উপলব্ধি। আমি আজ আর একা নই, আমার আছে, অপর্ণা আছে, পানু আছে। চোখ তুলে চাইতেই দেখি স্কুল ইউনিফর্ম পরা আমার ছেলে, তথাগত, তুতু – আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলাম “আমাকে ক্ষমা করে দে বাবা, আমি তোর খুব খারাপ বাবা” অপর্ণার চোখে জল। সে আমার হাত ধরে বলল “বাড়ী চলো”
অপর্ণা আমাকে যেখানে নিয়ে গেল সেটা পানুর মাতৃসদন্, সেই কৃষ্ণচূড়া গাছ। আমি আবার ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লাম। তুতু দেখলাম বেশ খুশী, আমার আঙুলই ছাড়ছিল না, সে হয়তো এমন অনুভূতি সম্পন্ন বাবা-ই খুঁজে বেড়িয়েছে এতদিন্। অনেকদিন বাদে অপর্ণার মুখে হাসি দেখে খুব ভাল লাগল “খুব অবাক হয়েছ তো, তোমাকে এখানে আনলাম বলে! এটাই আমাদের বর্ত্তমান আবাস। পানুটা তো পুরো পাগল, এক সৃষ্টিছাড়া ডাক্তার, যা দেখছো সব ওই পাগলের কান্ড, আচ্ছা ঘরে চলো এখন্। এই পানু, এই দেখ্, মনে হয় তর পাগলদলে একটা বড় পাগল পেয়ে গেলি” অপর্ণার কথার ধরনে আমার বেশ হাসি পেল। দেশে ফিরে এই প্রথম আমি হাসলাম্, পানু আমাদের যোগ দিতেই আমি তার হাত আমার দুহাতে নিয়ে নিলাম ” পানু আমাকে তোর দলে নিবি? আমার কিচ্ছু চাই না, নাম্, য্শ্, অর্থে আর আমার লোভ নেই। শুধু ডাক্তার হতে চাই তোর মত, অপর্ণার মত, পাশে তোদের আর মাকে চাই” কানাডা থেকে ফেরা অবধি যে কাঁদন রোগে ধরেছে আবার আমাকে জাকড়ে ধরল। পানু হো হো করে হেসে উঠল “ডাক্তার মহলে আমি তো উন্মাদ আর অপর্ণাদি অর্ধউন্মাদ হিসাবে পরিচিত। আমাদের শত্রু অনেক কিন্তু ভালবাসার লোকেরও অভাব নেই, মায়েরা এখানে আছেন্, বড়মা আছে, অপর্ণাদি আর গোটা শান্তিপল্লী আমাদের সাথে আছে। আমাদের পাগলদলে একটা বড় পাগলের খুব দরকার স্যার্” কিছুক্ষন থেমে থেকে পানু একটু উদাস হয়ে গেল। কেমন যেন আনমনে বলতে থাকল “জানেন স্যার্, মা মারা যাবার মত অসুস্থ ছিলেন না, কিন্তু আমি তাকে বাঁচাতে পারলাম না, আপ্নি থাকলে হয়তো তাকে বাঁচাতে পারতাম্। অপর্ণাদি অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মা আমাকে আবার অনাথ করে চলে গেলেন্”
এরপর বাকি যা শুনেছি সব অপর্ণার কাছ থেকে। মা মারা যাবার পর পানু ডাক্তারি পড়া ছেড়েই দিয়েছিল। ফাইনাল ইয়ারের অমন এক দুর্ধর্ষ ছাত্র পড়া ছেড়ে দিচ্ছে জেনে অপর্ণা মায়ের পায়ে গিয়ে পড়ল তাকে বোঝানোর জন্য্। অপর্ণা আর পানুর বড়মার পরম সাহচর্যে, আন্তরিকতায় আর ভালবাসায় সে ছেলের মতি ফিরল। ডাক্তারিতে প্রথম হয়ে, স্কলারশিপ নিয়ে এমডি আর সার্জেন ও হয়ে গেল। তারপর ঘর্-বিতাড়িত পরিত্যক্ত মায়েদের খুঁজে বের করে তাদের মর্যাদা আর পুনর্বাসন দিল ওইটুকু ছেলে, সবার মধ্যে সে মা খুঁজে ফেরে। নিজের প্র্যাক্টিস্, আর সরকারি হাস্পাতালের পুরো পয়সা এদের পেছনেই ব্যায় করত সে। তারপর “কোন বনেগা ক্রোরপতির প্রাইজটা পেতেই সে তার পরিকল্পনার কথা তার বড়মা আর দিদিকে জানাল। অনেক মন্ত্রি সান্ত্রীর পায়ে ধরে এই জমিটা সে পেল তবে জমির টাকাটা বড়মা-ই পানুকে দিয়েছে নিজের বাড়ী বিক্রী করে।যতদিন এ বিল্ডিং তৈরি হচ্ছিল সে এই গাছের নীচে মায়ের স্মৃতি আঁকড়েই পড়েছিল। সবটাকা খরচ করে বিল্ডিং তৈরি হল, বড়মার স্বপ্নের আশ্রম তৈরি হল আর সব মায়েদের জন্য আলাদা দোকান করে দিল, যে যেকাজে পটু তাকে তেমনটাই করে দিল সে। সে যেমন বাচ্চাদের পড়ায়্, চেম্বার করে আবার অপারেশন ও করে। ইদানিং আবার মায়ের আশ্রম কে অরগানিক আশ্রম বানানোর পেছনে লেগে রয়েছে। তার সকল পাগলামিকে প্রশ্রয় দেয় তার বড়মা আর দিদি। অপর্ণা তার অত বড় বাড়ী জমি সব বিক্রী করে মাতৃসদনে একটা ওষুধের দোকান আর প্যাথোলজিকাল সেন্টার বানিয়ে দিয়েছে, অপর্ণার বাকি টাকা দিয়ে পানুর বিনেপয়সার চিকিৎসা হয়্। তবে অনেকের থেকে ভিজিট ও ওষুধের দাম ও নেওয়া হয়্। মায়েদের দোকান থেকেও ভাল আয় হয় তার সব তাদের মেয়ের্, অপর্ণার হাতে তুলে দেয়। তারা সব গর্ব বোধ করে পানু আর অপর্ণা কে ছেলে মেয়ে জ্ঞান করে। তুতুটাও স্কুল থেকে ফিরে ঠাম্মা, দিদাদের সাথে মহাখুশী থাকে। বড়মা সপ্তাহে একদিন এখানে আসে আর পানু দুদিন ও অপর্ণা তিনদিন শান্তিপল্লীতে সারাদিন থাকে।
এতকিছু জানার পর একটা জিনিষ আমার কাছে পরিষ্কার যে অপর্ণার সাথে মায়ের যোগাযোগ বরাবর ছিল। আমার উন্নাসিকতা আর অহংবোধকে সে মায়ের মতই ঘৃণা করত কিন্তু আমার মায়ের চিন্তাধারা আর মানসিকতার সে ছিল ভক্ত। সে যে তার ছেলের বৌ সে কথাও সে অনেক পরে মাকে জানিয়েছিল। অপর্ণা অতীত ভুলে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে এ আমার কাছে অনেক বড় পাওনা। ডাক্তার সোমের নার্সিংহোম বা মমতা সান্যালের স্পেশালিষ্ট কর্নার আর আমাকে টানছে না। আমার মুখে কোন ভাবান্তর নেই কিন্তু দুচোখে অশ্রুধারা। অপর্নার হাত ধরে বললাম ” আমার ফ্ল্যাট দুতোর দাম কমকরে আশি নব্বই লাখ হবে, ব্যাঙ্কেও ওরকম আছে, সব তুমি নাও অপর্ণা আর পানুর যেটাতে সাহায্য হয় কর” অপর্ণার চোখেও জল্, সে কেমন ফ্যাল্ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। এধারার গৌতম সেনকে তো সে চেনেনা। আমি থাম্লাম না “অপর্ণা আমি কথা দিচ্ছি আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তোমাদের মত মানুষ হতে, তুতু যেন গর্ব করে বলতে পারে ডক্টর গৌতম সেন তার বাবা। আমি সব থেকে বেশী অপরাধী আমার মায়ের কাছে, আমার সাহস নেই মায়ের মুখোমুখি হবার্, আমাকে নিয়ে যাবে মায়ের কাছে? তার ক্ষমা পাবার মত কোন কাজই আমি করিনি, তবুও তার অভাব আজ আমি প্রতিপদে অনুভব করছি। কিভাবে যে প্রায়শ্চিত্ত করব বুঝেই উঠতে পারছি না। আমাকে সাহায্য কর অপর্ণা” অপর্ণার চোখের অবিশ্রান্ত ধারা দেখে বেশ বুঝতে পারছি আমার পূনর্জন্মের সাক্ষী হয়ে সে বেশ বিহ্বল্। পানু কাছে আস্তেই আমি তাকে জড়িএ ধরে কাঁদ্তে থাকলাম “তুই আমার গুরু পানু, মা যে কি অনূভুতি, কি প্রাণের আকূতি তোর থেকেই শিখলাম্। ধন্য তোর মা, ধন্য তার মাতৃত্ব্। আমাকে তোর শিষ্য করে নে পানু। ধিক্কার আমার ডিগ্রীকে, ধিক্কার আমার মেকি জগৎকে। আমাকে মানুষ করে নে পানু” পানুর মায়েরা আর তুতু সজল চক্ষে প্রত্যক্ষ করতে লাগল তিনটি মানুষের এই অদ্ভুত মেলবন্ধন্। আজ আমার কোন লজ্জা নেই, কোন বাঁধন নেই। কান্নার স্বাধীনতা, মানুষ হবার স্বাধীনতা পেয়েছি আমি। হয়্ত পুনর্জন্মের আনন্দই এইরকম্।
পানুই গাড়ী চালিয়ে আমাকে নিযে চলল মায়ের আশ্রমে “দিদি, আজ বড়মা সবথেকে আনন্দিত হবে” তার কথায় আমি আরো বেশি করে অপর্ণাকে জড়িয়ে ধরলাম্। তুতু মায়ের পাশে বসে বেশ অবাক হয়েই করছিল যে তার বাবা এতদিন পর এসে কান্নাকাটি করছে, আর সে বোঝার চেষ্টা করছিল এত বড় একটা লোক ছোটোদের মত আচরন করছে কেন! এবার কিন্তু আশ্রমের গেট খুলে গেল। পানু মনে হয় গেটের ছেলেদুটোর সাথে কি একটা কথা বলল ” ও নিয়ে তোমার চিন্তা করার দরকার নেই ছোটুদা, দুদিনের মধ্যে হয়ে যাবে। আমি এবার উঠে বসলাম আর দেখলাম ছোটুর গলার আওয়াজ শুনেই দরজা খুলে তিনি বেরিয়ে এলেন্। শান্তি, সততা আর পবিত্রতার প্রতিমূর্ত্তি যেন এক মহিলার রূপ ধরে বেরিয়ে এলেন। পাপী মনে এ রুপ দেখা যায় না তাই আগে এসে এই উপলব্ধি আসেনি।”কি ব্যাপার রে বাবা, হঠাৎ এলি যে, কোনো বিশেষ ব্যাপার বুঝি! আরে অপর্ণা আর দাদুভাই ও এসেছে! তুতু দৌড়ে গিয়ে “আম্মা…….” বলে তাকে জড়িয়ে ধরল আর কানে কানে কিছু বলতেই তার মুখে বেশ বিরক্তির ভাব দেখলাম্। নিশ্চয় আমার কথাই বলেছে। আমিও তুতুর মত দৌড়ে মায়ের দু পা জড়িএ ধরে, তার পদযুগল চোখের জলে ভিজিয়ে দিয়ে শুধু একটা কথাই বলতে পারলাম “মা আমাকে ক্ষমা করে দাও”। কেউ বিশ্বাসই করতে পারবে না, বিশাল নাম করা কারডিওলজিষ্ট্, গৌতম সেন এতগুলো লোকের মাঝে, তাদের নজরকে তোয়াক্কা না করে তার জন্মদায়িনির পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইছে। আমি আমার জগৎ চিনে গেছি, কে কি ভাবল সে নিয়ে আমার আর কোন চিন্তা নেই “তোমার সত্যিকারের ছেলে হতে চাই মা, মানুষ হতে চাই মা, আমাকে ক্ষমা করে দাও মা” মা আশ্রমের সিঁড়ির উপরে বসে পড়্লেন্, আমার মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন্। হয়তো মার চোখেও জল এসে গেছিল। আমি মায়ের কোলে মাথা গুঁজে দিযে বলতে পারলাম “কিচ্ছু চাই না মা, যেন সারাজীবন তোমার হাত আমার মাথার উপর থাকে। পুর্বজন্মে স্বেছায় মাতৃহারা হয়েছিলাম কিন্তু এ জন্মে আর তোমাকে হারাতে চাই না” মা আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অস্ফুট কন্ঠে বললেন “তুই ঘরে ফিরেছিস্, এতেই আমার সুখ, এতেই আমার আনন্দ” আর আমার সীমাহীন আনন্দ – পূনর্জন্মের আনন্দ, মায়ের স্নেহের আনন্দ।