শিশু এক দু:স্থ অতি নাহি কোন পিতৃস্মৃতি
হারায়েছে জনকে অকালে,
পঞ্চমবর্ষীয় যবে কেমনে গেহেতে রবে
পড়িল সে গুরু পদতলে।
অবয়ব শীর্ণকায় আননটি মায়াময়
ধর্মাচার্য্য আপ্লুত করুণায়,
আলিঙ্গন করি’ বক্ষে অশ্রুসজল চক্ষে
জানিতে চাহেন পরিচয়।
“শূদ্র বংশজাত ক্ষমা মাগি পুণ্যতাত
অপরাধ করিয়াছি হেথা,
অশুচি অস্পৃশ্যজনে দণ্ড প্রাপ্য এইক্ষণে”
কহিলেন শিশুটির মাতা।
“শাস্তি মোরে দিন আশু অবুঝ অবোধ শিশু
করুন তাহারে প্রভু ক্ষমা,”
হেরিলেন উপাধ্যায় পথিমধ্যে ভুলুণ্ঠায়
জীর্ণবাসিনী কোন রমা।
দেবতার সন্তান সবে আসিয়াছি মোরা ভবে
ভেদাভেদ করে শুধু বিশ্ব,
যাও তব গেহে মাতা তুমি ত’ শুচিস্মিতা
নহ তুমি নি:স্ব অস্পৃশ্য।
সুতস্নেহে তব পুত্রে পালিব আপন গোত্রে
করিলাম আজি অঙ্গীকার,
আসুক বিপত্তি পথে জানিবে তাহার হিতে
করিব সকলি সংহার।
তীব্র ধিক্কার রব আচার্য প্রতি ক্ষোভ
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় সর্বজনে,
গুরুগৃহ শূন্য ক্রমে দিবসেও মধ্যযামে
স্তম্ভিত গুরু তনুমনে।
তথাপি তাঁহার হিয়া জ্বালায় অমল দীয়া
সমাজের বাধা সেথা তুচ্ছ,
নীরবে করেন সহন অন্তরে যতেক দহন
চেতনায় অমলিন স্বচ্ছ।
আপনারে নি:স্ব করি’ শূদ্র শিষ্যে বক্ষে ধরি’
গুরুদেব করেন লালন,
বিছায়ে স্নেহাঞ্চল গুরুমাতা অবিরল
পুত্রবৎ করেন পালন।
সন্দেশ অকস্মাৎ বিনা মেঘে বজ্রাঘাত
মাতৃহারা হায় সেই শিষ্য,
আননে মিলায় হাসি অশ্রুতে বাণভাসি
কম্পিত বুঝি সারা বিশ্ব।
জড়ায়ে আপন ক্রোড়ে ভাগ্যহীন শিশুটিরে
স্নিগ্ধ পরশখানি মাথে,
স্নেহশীলা গুরুজায়া তাঁহার শীতল ছায়া
নিত্য রহে দু:খার্ত সাথে।
পিতৃমাতৃহীন অনাথ আতুর দীন
কিন্তু সে নহে অসহায়,
গুরুদেব, গুরুমাতা অরিন্দম, অরিজিতা,
নির্ভীক, উদার হৃদয়।
সমাজপতিরা রুষ্ট আখ্যা দিল ‘ধর্মভ্রষ্ট’
তথাপি আচার্য্য অবিচল,
নৃপতি সকাশে শেষে অভিযোগ পত্র আসে
ধর্মাচার্য্য ভণ্ড তথা ছল।
একদা ঊষসী কালে গুরুদেব পদতলে
উপনীত বসুমিত্র নৃপতি,
শ্রবণি’ সকলি কথা নৃপেরও হৃদয়ে ব্যথা,
মাগিলেন আচার্য সম্মতি।
“আমি দেব অপুত্রক কে হইবে রক্ষক
বিশাল সাম্রাজ্য অধিপতি !
লইব দত্তক পুত্রে মোর সম্পর্ক সুত্রে
সে–ই হইবে এ রাজ্যের রথী।”
“ক্ষাত্র ধর্মে লভে দীক্ষা আপনার সনে শিক্ষা
ভরতমিত্রে রবে পরিচয়,”
রাজ বাক্যে ধর্মাচার্য্য নাহি মোটে অত্যাশ্চর্য্য
কহিলেন – “ রাজনের জয়”।
“শিশুর ললাটে আমি হেরিয়াছি ভূস্বামী
রাজটীকা হিরণ্য চিহ্ণ,
ললাটের বিধিলিপি সবলে কি চুপিচুপি
কেহ কি করিতে পারে ছিন্ন !”
“প্রতিটি শিশুর দেহে মানব শোণিত বহে
তাহাই ত’ পরম সত্য,
শিশুটি ত’ নিষ্পাপ তবে কেন অভিশাপ
বহন করিবে সে নিত্য !”
প্রচারিত দেশব্যপী রাজার অনুজ্ঞা লিপি
দত্তক লইবেন তিনি,
শুদ্ধসত্ব শিশুপ্রাণ স্বয়ং দিবেন মান
আচার্য্য সনে নৃপ ঋণী।
ক্ষুব্ধ সমাজপতি তথাপি স্বীকারে নতি
রাজদ্রোহে নাহি দুর্মতি,
বালকটি কালক্রমে ভরতমিত্র নামে
হইল সার্বভৌম নৃপতি।
সুশাসক, মহাবীর বুদ্ধিমান, ধীরস্থির
প্রজাপ্রিয় মিত্র সর্বজনে,
প্রবল প্রতাপান্বিত তথাপি সমর্পিত
সততই ধর্মাচার্য্য সনে।
সম্পর্কে গুরু শিষ্য জানিত বহির্বিশ্ব
কিন্তু দোঁহে যেন পিতাপুত্র,
বিষ্মৃত নহে কভু গুরুই প্রকৃত প্রভু
তাহার জীবনে যোগসূত্র।
ভরতের নামে বুঝি মোদের দেশটি আজি
ভারতবর্ষ নামে প্রসিদ্ধ,
ললাট লিখন যাহা অমোঘ জানিবে তাহা
খণ্ডাইবে কাহার সাধ্য !
কথামালা কল্পিত নীতিবাক্য সমন্বিত
মানবতা সর্বোচ্চ সত্য,
জাতপাত,ভেদাভেদ তাহাতে কেবল খেদ
জীবন সতত অনিত্য।