সাদা কালো-পঞ্চম পর্ব – Click Here
।৬।
পদার দৌলতে বাবলুদা একটুর জন্য বেঁচে গেছে। সেদিন যদি আর একটু দেরী হোতো তাহলে হয়ত বাঁচতো না। হাসপাতালে পৌছানোর পর সেদিন এমারজেন্সির ডাক্তার মাধবীকে খুব বকুনি দিয়েছিল। “এতদিন কি করছিলেন? আগে আনতে পারলেন না?” তারপর গলা একটু নরম করে বললেন “এখন কড়া আন্টিবায়টিক দিয়েছি। রাতটা পার না হলে কিছুই বলতে পারছি না। কাল যদি দেখা যায় যে জ্বর কমেনি, তাহলে হয়ত কবজি থেকে হাতটা কেটে বাদ দিতে হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সেটা সফল নাও হতে পারে। ইনফেকশানটা কোনো ভাইটাল অরগানএ ছড়িয়ে পরেছে কিনা বলা খুব কঠিন”। শুনে মাধবী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। “ওনার কোন দোষ নেই। আমারই দোষ,” পদা এগিয়ে এসে বলেছিল। ডাক্তার কি বুঝলেন কে জানে, শুধু ভুরু কুঁচকে পদার দিকে একবার তাকিয়েছিলেন। সেদিন রাতটা পদা হাসপাতালে কাটিয়েছিল। মাধবী আর সে একি বেঞ্ছের দুই প্রান্তে বসে। নিজের জন্য নয়, মাধবীর জন্য ঈশ্বরের কাছে অনেক প্রার্থনা করেছিল পদা। ভোরের দিকে ঘুমে নেতিয়ে পরেছিল। যখন চোখ খুলল, মাধবী তার পাশে নেই। নার্স বলল যে সে বাবলুদার কাছে গেছে। পদা ভয় পেয়ে দৌড় লাগালো। তাহলে কি বাবলুদা শেষ? বাবলুদার বেডের পাশে পৌঁছে দেখলো যে মাধবী বাবলুদার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে। বাবলুদা চোখ খুলে তাকিয়েছে। এখনো কথা বলার শক্তি নেই, কিন্তু পদাকে দেখামাত্র পরিচিতির হাসি দিয়ে তার চোখদুটো যেন বলল “আমি ভাল হয়ে গেছি রে!” “তুমি ঘুমচ্ছিলে বলে আমি আর ডাকিনি,” পদার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মাধবী বলেছিল। পদা মাথা নেরে মৃদু হেসে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছিল। তার কাজ শেষ। হোস্টেলে ফিরে অনেক ঝামেলা পোয়াতে হয়েছিল। পদা রাতে ফেরেনি বলে থানা পুলিশ হয়েছিল। বাবাকে খবর দিয়ে আনানো হয়েছিল। মহারাজ শান্ত হয়ে পুরো ব্যাপারটা শুনলেন। “তোমার উচিত ছিল আমাদের জানিয়ে যাওয়া। কাজটা ভাল করোনি অনীক”। পদা মাথা নিচু করে শোনে। কিছু বলে না। সে খানিকটা অনুতপ্ত সকলকে এত চিন্তার মধ্যে ফেলার জন্য, তবে তার কিছু উপায় ছিল না। মহারাজও বোধহয় সেটা উপলব্ধি করেছেন। পদার বাবা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। মহারাজ তাঁকে মাঝবাক্যে থামিয়ে বললেন “আপনি রাগ করবেন না মিস্টার রায়চৌধুরী। সত্যি কথা বলতে, ওর পরিস্থিতিতে পরলে আপনিও হয়ত একি কাজ করতেন”। কথাটা শুনে বাবা চুপ করে গেল। “আজ অনীক যেটা করেছে সেটাই আমরা আমাদের ছেলেদের বরাবর শেখানোর চেষ্টা করে থাকি। কিন্ত সেটা বাক্যেই থেকে যায়। অনীক আজ সেটাকে কাজে পরিনত করে দেখিয়েছে। এতে আমার খুব গর্ব বোধ হচ্ছে জানেন!” এই কথার ওপর বাবা আর কিছু বলার জোর পায়নি। চলে যাওয়ার আগে শুধু পদাকে আলিঙ্গন করেছিল। বাবার চোখে কি জলের আভাস দেখা দিয়েছিল সেদিন?
বাবলুদা এখন সেরে উঠেছে। ভাল আছে। সে এখন একটা স্টেশেনারী দোকানে কাজ করে। পদার বাবাই চাকরিটা পাইয়ে দিয়েছে। এ কাজে শারীরিক পরিশ্রম অনেক কম। মাধবীও এখন এখজন বয়ষ্ক মহিলার দেখাশোনার কাজ করে। আয় বেড়ে যাওয়াতে ওরা এখন আর বস্তিতে থাকে না। নিজেদের ভাড়া বাড়িতে থাকে। বাগমারি ব্রিজের কাছে। পদা যখন বাড়িতে আসে, মাঝেসাজে দেখা করতে যায়। ওদের সাথে পদার সময় কাটাতে খুব ভাল লাগে। মনে হয় যেন নিজেরই দাদা বৌদি। একদিন বাবলুদা হঠাত বলল “হ্যাঁরে, সোনালি কেমন আছে?” বলে পদার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকালো। পদা বাবলুদার চোখ এড়িয়ে গেল। “সোনালি কে?” মাধবী প্রশ্ন করলো। “বাবলুদাকে জিগ্যাশা করো। ওর পুরনো প্রেমিকা” পদা জবাব দিল। “আমার পুরনো প্রেমিকা না তোর?” বাবলুদা এবারে সোজা হয়ে উঠে বসেছে। পদা কোন জবাব দিচ্ছে না। জবাব সে দিতে চায় না। দিতে গেলেই ধরা পরে যাবে। “তুই কি ভাবিস আমি কিছু লক্ষ্য করিনি? কিছু বুঝিনি? সেদিন জেম সিনেমা থেকে ফেরার পথে তুই যে ভাবে ওর দিকে তাকাচ্ছিলিস, সে তাকানোর একটাই মানে হয়”। পদা দেখলো যে সে কোনঠাসা হয়ে পরেছে। মরিয়া হয়ে বলল “ধ্যাত! কি যে বল!” বাবলুদাও ছাড়বার পাত্র নয়। “সে তুই মানবিনা ঠিক আছে, কিন্তু আমি অত বোকা নই বুঝলি। ওই জন্যই তো ওইদিন তোকে বললাম ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে”। বাবলুদা আবার পদাকে অবাক করলো। মাধবী এতক্ষন মনযোগ দিয়ে সব শুনছিল। খুব মজা পেয়েছে সে। মিষ্টি হেসে বলল “সত্যি অনীক?” পদা আর চেপে রাখতে পারলো না। “ওই একদিনেরই ব্যাপার। তারপর আর কিছু হয়নি। যাকগে, বাদ দাও, ওসব নিয়ে আর ভাবতে চাই না”। শেষ কথাটা বলতে গিয়ে পদার গলার স্বর একটা অন্য রূপ নিলো। বাবলুদা পদাকে খানিক্ষন মাপলো, তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে বলল “জীবনে কিছু কিছু জিনিষ চাইলেও ভোলা যায় না রে”। তারপর গলার স্বর হাল্কা করে বলল “চল আমরা খেয়ে নিই”। পদার সেদিন মনটা খুব হাল্কা লেগেছিল। এই সমস্ত ঘটনার একমাত্র সাক্ষী তো বাবলুদাই। তার কাছে এতদিন এই ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখে সে হাঁপিয়ে উঠেছিল।
পদা এখন ক্লাস টুয়েল্ভএ পড়ে। পূজোর ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। মহাষ্টমীর সন্ধ্যা নেমে আসছে। বাড়িতে সে একা। অভ্যাসবশত সে ছাদে উঠে এসেছে। আকাশের রঙটা আজ সিঁদুরে লাল। তারই মধ্যে বেগুনি রঙের শরতের কয়েকটা ছোট্ট মেঘের টুকরো। তারা যেন মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পরেছে। ছাদ থেকে বাড়ির গলি, ওপাশের রাস্তা সব পরিষ্কার দেখা যায়। এরই মধ্যে অনেকে সেজেগুজে রাস্তায় বেরিয়ে পরেছে। বাচ্চারা এন্তার ক্যাপ ফাটাচ্ছে। পাড়ার প্যান্ডেল থেকে মাইকে কিশোর কুমারের গান ভেসে আসছে “আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো, আমার স্বপ্ন হয়ে কাছে দূরে যেখানেই থাকো…”। আজ পদার মনটা খুব বিষণ্ণ লাগছে। ছাদের হাওয়া আর গানটার সুর মিলেমিশে যেন এক হয়ে গেছে। পদা পায়চারি করতে থাকে। এক সময় হঠাত তার নজরে পড়লো সোনালি নিজের বাড়ি থেকে বেরচ্ছে। দূর থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, তবে অষ্টমীর সাজ সে সাজেনি। তার পরণে সাধারন ঘরোয়া একটা চুরিদার, হাতে একটা শান্তিনিকেতনি ব্যাগ। নিশ্চয়ই দোকানে যাচ্ছে। হয়ত এক্ষুনি ফিরবে আবার। যতক্ষণ না সোনালি দৃষ্টির বাইরে গেল, পদা চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখলো। আবার পায়চারি শুরু করলো। মিনিট খানেক পরে পায়চারি থামিয়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে এল। একটা সুন্দর পাজামা পাঞ্জাবী পরলো। চুলটা পরিপাটি করে আঁচড়ালো। পদাকে ঠিক রাজপুত্তুরের মত দেখাচ্ছে। মুখ না দেখলে বোঝা যায়না যে মাত্র সতেরো বছরের একটা ছেলে। চওড়া কাঁধ, বলিষ্ঠ দেহ। রাস্তায় নেমে সোনালি যেদিকে গেছে, গলির সেদিককার মুখে দাঁড়িয়ে পদা অপেক্ষা করতে লাগলো। সোনালির জন্য অপেক্ষা। কিন্তু কেন সে নিজেই জানে না। মিনিট পনেরো কেটে গেলো। পদা ছটফট করতে লাগলো। ঘনঘন ঘড়ি দেখছে। তাহলে কি সোনালি সে আসার আগেই ফিরে এসে বাড়িতে ঢুকে গেছে? কিম্বা গলির অন্য দিক দিয়ে ঢুকেছে বাড়িতে? এই সব চিন্তায় যখন সে মগ্ন, দেখলো সোনালি ফিরছে। মাথাটা সামান্য এক দিকে হেলানো। চুল খোলা। হাওয়ায় উড়ছে। মুখ ঢেকে যাচ্ছে বারবার। সে বাঁহাত দিয়ে চুল ঠিক করার চেষ্টা করছে। সক্ষম হচ্ছে না। পদা গিয়ে সোনালির পথ আটকে দাঁড়ালো। প্রায় ধাক্কা লেগে যাচ্ছিলো। শেষ মুহূর্তে সোনালি মুখ তুলে চাইলো। পদাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গিয়ে চিনতে পেরে থমকে দাঁড়ালো। “একি অনীক! তুমি বাড়িতে কবে এলে? এখানে দাঁড়িয়ে? কারো জন্য অপেক্ষা করছো?” পদা এক মুহূর্ত সময় নিলো, তারপর সোনালির দিকে সোজা তাকিয়ে বলল “হ্যাঁ তোমার জন্য অপেক্ষা করছি”। “আমার জন্য? কি ব্যাপার বলতো? বাড়িতে কিছু হয়েছে?” সোনালি খুব স্বাভাবিক স্বরে জিগ্যেশ করলো। “না তোমার সাথেই কথা ছিল”। পদার কন্ঠস্বরে হয়ত কিছু একটা ছিল। সোনালি গম্ভীর হোলো। পদার দিকে তাকিয়ে বলল “কি? বলো”। “তুমি আমার সাথে আজ ঠাকুর দেখতে যাবে?” সোনালি এক মুহূর্ত সময় নিল। যেন সে নিজের কানকে বিস্বাসই করতে পারছে না। তারপর মিষ্টি করে হেসে বলল “তা হয়না অনীক!” বলে পদাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পদার যতক্ষণে হুঁশ ফিরলো ততক্ষনে দেখলো সোনালি নিজের বাড়ির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। পদা চোখে অন্ধকার দেখছে। সে হয়ত ভারসাম্য হারিয়ে এক্ষুনি রাস্তায় পরে যাবে। তার কান ঝাঁঝাঁ করছে। এ সে কি করলো! এতদিনেও সে কি করে বুঝতে অক্ষম হোলো কেন রেঠ বাটলার সোনালিকে এত আকর্ষণ করে? রেঠ বাটলার যে নিজেকে মেয়েদের দিকে ছুঁড়ে দেয় না। দৌড়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো পদা। নিজের ঘরে ঢুকে ছিটকিনি আটকে দিল যাতে কেউ বিরক্ত না করতে পারে। বাইরে ঢাক ঢোল পিটিয়ে মহাষ্টমীর পুজো শুরু হয়েছে। পদা ঘরের আলো নিভিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে তার ছফুট দেহটাকে এলিয়ে দিলো বিছানায়। তার সতেরো বছরের নরম মনটা আর সহ্য করতে পারলো না জীবনের এই নিষ্ঠুরতা। পদা কাঁদলো। অনেক্ষন ধরে। যে আশার ছোট্ট পাখিটাকে এতদিন সে যত্ন করে পুষে রেখেছিল, আজ তার মৃত্যু হোলো। পদা কাঁদবে না’ই বা কেন?
To be continued…