লঙ্কাবাটা গোটা দুবাটি ঘষো বিধবার অঙ্গে,

একমুঠো তারে খাইয়ে দিতেও ভুলো নাকো সেইসঙ্গে

রাজদ্রোহী হবার সাজাটি পাবে ঠিক হাতেনাতে,

কত ধানে কত চাল হয় নারী বুঝবে আজকে রাতে।

কারাকুঠুরীর গহীন আঁধারে সে কি বিভৎস জ্বালা,

মুখ বুজে সেই ভীষণ যাতন সহেন স্ত্রী ননীবালা।

এগার বছরে বিয়ের পিঁড়িতেবিধবা ষোলোয় এসে,

বিপ্লবের মহামন্ত্রে দীক্ষা দেশকেই ভালোবেসে।

কখনো জননী,কখনো বা জায়া,কখনো স্নেহের ভগিনী,

বৃটিশের চোখে ব্যানার্জি ননী ছিলেন ধূর্ত ঠগিনী।

বিধবার সিঁথি সিঁদুরে রঙিনপিস্তল করে খোঁজ,

পুলিশেরই কোন কর্তার গেহে চলে তাঁর ভুরিভোজ।

বিপ্লবী সনে সাহসিনী ননী ছিলেন পরম সহায়,

তাঁর প্রতি এই স্বাধীন দেশের ছিল না কি কোন দায় !

বন্য কুকুর বৃটিশ পুলিশ যেন হয়েছিল হন্যে,

কতই বা তাঁর বয়স তখনবিশ বর্ষীয়া কন্যে।

সাহসিকা বালা অচেনা এক পুরুষের হাত ধরি’,

দেশ মাতৃকা মুক্তির রণে হলেন দেশান্তরী।

স্বামিহীনা এক বাঙালিনী যিনি সমাজের চোখে বিধবা,

অভাবিত তাঁর এহেন সাহস, সীমাহীন দেশসেবা !

পেশোয়ারে তিনি পলাতক বটেপুলিশকে দিয়ে ধুলো,

উনিশশষোলো জানুয়ারী মাসতারিখটা ছিল ষোলো।

তবে শেষরক্ষা হলো না ননীর পেশোয়ারে গ্রেপ্তার,

কলেরায় বুঝি বেঁহুশ তনুটিঅন্তরে হাহাকার।

সুস্থ হলেই ঠিকানা বদলবারাণসী কারাগার,

অসভ্য গালি আর সেই সাথে অসহ অত্যাচার।

ডেপুটি পুলিশ সুপার বাঙালীকালো চামড়াটি দেহে,

বৃটিশের পদলেহনেই তাঁর উন্নতিসবে কহে।

নামটি জিতেনব্যানার্জি তিনিব্রাহ্মণ সন্তান,

বাল্যবিধবা ব্রাহ্মণী সনে চরম অসম্মান।

কাশী কারাগারে লঙ্কাবাটার অত্যাচারের কাহিনী,

আজও যেন হায় কেঁদে কেঁদে ফেরেস্তব্ধ কেবল ননী।

কঠোরতম পুলিশের জেরাসকলই যদিও বিফল,

ব্যর্থ জিতেন আর তার যত নিষ্ঠুর দলবল।

ঠিকানা বদল আবার ননীরকোলকাতা প্রেসিডেন্সী,

নির্দয় আরো বৃটিশ পুলিশবর্বর বিধ্বংসী।

বীরাঙ্গনা ননীবালা দেবী তবুও অটল অনড়,

স্পেশাল সুপার গোল্ডির গালে কষে এক থাপ্পড়।

বিপ্লবীদের হাল হকিকত সবই রয় অজ্ঞাত,

অসহ যাতন সহনে তবুও ননীবালা নন ভীত।

মা সারদার প্রতি অপমানে রোষকষায়িত ননী,

কারাগার মাঝে অনশনরতা তিন সপ্তাহ তিনি।

অস্ত্র আইনে বন্দিনী সেথা মাসীমা দুকড়িবালা,

বরাদ্দ ছিল অর্ধ আহারসাথে শ্রম দুইবেলা।

রক্ষা তাঁরেই করেন রমণীদৃঢ়চেতা বন্দিনী,

মাসীমার পাকে অনশন শেষে ভঙ্গ করেন ননী।

একই কক্ষে দুজনার ঠাঁইদুকড়ি ননীর পাচিকা,

ইতিহাসে যত পাতা ওল্টাও পাবে না এঁদের দেখা।

বৃটিশ রাজের ঘুম কেড়ে নেওয়া বাংলার দুই কন্যা,

মানসিক বলে বলীয়ান দোঁহে অনন্যা,অসামান্যা।

সিউড়িবাসিনী দুকড়ির সাথে বালীর বীরাঙ্গনা,

বঙ্গের বালা নয় দুর্বলাতাঁরাই তাঁদের তুলনা।

উনিশশো বিশে শৃঙ্খলহীনা রাজবন্দিনী বালা,

কিন্তু সমাজ তাঁর সাথে করে এবার নিঠুর খেলা।

গিরিবালা তাঁর গর্ভধারিণীসুর্যকান্ত পিতা,

ননীবালা দেবী সতী অনসূয়াকলিযুগে তিনি সীতা।

তদ্যপি সেই সতীরও ভাগ্য সীতার মতই ম্লান,

সমাজটি তাঁরে দেয় নি কখনো দেশভক্তির মান।

মিলল না তাঁর পিতৃগৃহেতে সোহাগ মাখানো সুখ,

স্বজন যতেক সকলেই হায় ফিরিয়ে নিলেন মুখ।

কারাকক্ষের পরিবর্তনে ঠিকানা এবার বস্তী,

শোকতাপ,ক্রোধ আর অপমানে হারালেন দেবী স্বস্তি।

দেশপ্রেমের কি এমনতরোই মূল্য লভেন শেষে !

বিস্মৃত আজ ননীবালা হায় এহেন পোড়ার দেশে।

পৈতা তৈরী,রান্নার কাজপ্রায়শ অর্ধাহারে,

হৃদয়ভরা অভিমানে ননী ছিলেন অনেক দূরে।

লঙ্কাবাটার অত্যাচারের অসহ্য সেই ক্লেশ,

কেমন করে অনুভব হায় করবে মোদের দেশ !

নিকষিত হেম ননীবালা দেবী সমাজের সনে অচেনা,

তাঁর কাছে আজো ভারতবাসীর রয়ে গেছে বহু দেনা। জানিনা কিমতে শুধবো আমরা বিপুল ঋণের বোঝা !

দেবীর চরণে প্রণতি কবিরহৃদয় অশ্রুভেজা।

যে দেশমুক্তির জন্যই ছিল ননীর অসম লড়াই,

স্বাধীন ভারতকথায় কথায় নেতা নেত্রীর বড়াই,

সেই স্বাধীন দেশেই দিন কাটত জননীর অনাহারে,

ইতিহাসও আজি রেখেছে দেবীরে অতল অন্ধকারে।

বাঙালীরা তাঁকে বিস্মৃত আজিএমনই স্বার্থপর !

আপন গেহের লক্ষ্মীর সনে বন্ধ তাদের সদর।

অনাদর আর অবজ্ঞাতেই লক্ষ্মী রাখেন দেহ,

তাঁর আত্মত্যাগের অমর কাহিনী মনে কি রেখেছি কেহ !

পঞ্চান্নটি বর্ষ অতীতদেবী নাই ধরাধামে,

বহুদিন আগে ছায়াছবি একবিয়াল্লিশএর নামে,

একঝলকই মাত্র সেথায় তাঁর ভূমিকার দৃশ্য,

বাকী সবই আজ ঝরা পাতা হায়বাঙালী জাতিটি নিঃস্ব।

উনিশ শতকে এমন কতই ছিলেন অগ্নিকন্যা,

যাঁদের কথায় কপোলে কেবল অশ্রুধারার বন্যা।

নারীরা যবে পর্দানশীনসেই সময়ের কথা,

আপন শ্রমেই রপ্ত ছিল গর পাতা।

দেবীসমা এই মানবী বালার এহেন উপাখ্যান,

সবার সনে তুলে ধরে আজ ধন্য কবির প্রাণ।

ননীবালা দেবী এই বাংলার বালীর লক্ষ্মীবাঈ,

শৌর্য্যে ধৈর্য্যে তিনি অনুপমাএকশ ছিলেন একাই।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleমোমবাতি
Next articleদক্ষিণের ছড়া
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments