গরিবের কি আর সন্মান আছে?

হঠাৎ ঘুম ভেঙে রঞ্জন দেখল একদল লোক গ্রীলের কড়া নাড়ছে, ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত তিনটে পনের। ওরা তার বাবাকে নিয়ে যেতে এসেছে। কিন্তু কেন? ওরাই বা কারা? একজনের পরনে আবার খাকী পোষাক। একজন বলল, “চিরু বাগ কে আছে? আমরা তাকে নিয়ে যেতে এসেছি।” রঞ্জনদের মনে তখন আশান্তির নিঃশ্বাস ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন কি করেছে আমার বাবা? কেনই বা তাকে নিয়ে যাচ্ছেন?” জবাব আসল “তোর বাবা চুরি করেছে, তাকে আমরা থানাতে নিয়ে যাব।” মা নির্বাক, বোন কান্নায় ভেঙে পড়েছে, সে ভাবছে কাঁদব না কি করব। কিছু মুহুর্তের জন্য নির্বাক থাকার পর হঠাৎ যেন গোঙানোর স্বর তার কণ্ঠ হতে বাইরে বেরিয়ে এল। কি নিষ্ঠুর, কি ভয়ানক, এই সমাজ। দুর্বল, দরিদ্র, অসহায়ের উপর সবল, অর্থশালীর এই পেষণ যুগে যুগে, কালে কালে চলে এসেছে। এ যেন সভ্যতারূপ বিশাল ইমারতের একটি পীলাররূপে আজও অব্যাহত।

কয়েকদিন আগের কথা বলি, কয়েকদিন ধরে তার বাবার ইমিটেশনের কাজবাজ ভালো চলছিল না, সেকারণে বিষণ্ণতার সাথে দিন কাটছিল সকলের। একদিন কলকাতা থেকে ফোন আসে এক ভদ্রমহিলার। একটা ছোটোখা

গরিবের কি আর সন্মান আছে?

টো ওর্ডার পেয়ে যান তিনি। কাজ শেষ করে সুন্দর সুন্দর নতুন ডিজাইনের অলঙ্কারগুলো ভদ্রমহিলাকে দিয়ে আসেন তিনি। জিনিসগুলি পেয়ে খুব খুশি হন ভদ্রমহিলা। এর পাঁচদিন পর একদিন ফোন করে গর্জন করে ভদ্রমহিলা বলেছিলেন, “আপনি আমার সোনা চুরি করেছেন। সোনা দিয়ে যান নয়তো আপনার বাড়ি পুলিশ পাঠাব।” রঞ্জনের বাবা নির্বাক হয়ে কথাগুলো শু

নেছিল তারপর বলেছিল, “কোন সোনা? কোথাকার সোনা? আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে ম্যাডাম। যে জিনিসটা চোখে দেখলামই না আপনি তারই চুরির অপবাদ দিচ্ছেন?” ততক্ষণে বাড়ির সকলে একজায়গায় জড় হয়ে গেছিল। মা বোন তারা ততক্ষণে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিল। সে বুঝতে পারছিল না যে, তার এখন কি করনীয়। এরমধ্যে কখন ভদ্রমহিলা ফোনটা রেখে দিয়েছেন সে তার কিচ্ছুটি টের পায়নি।

মা বলল, “রঞ্জন তোর বাবা তো কিছুই জানে না। তাহলে মহিলা অমন উচ্চবাচ্য করে কুৎসিৎ ব্যবহার করলেন কেন?” রঞ্জন শুধু বলল, “চিন্তা কর না সব ঠিক হয়ে যাবে।” পরে তিনি আবার ফোন করেন। তখন ফোনটা রিসিভ করে রঞ্জন। শুনতে পায়, “সোনা দিয়ে যাও নয়তো কপালে খুব কষ্ট আছে।” সে বলল, “দেখুন ম্যাডাম আপনি কোথাও রেখে দিয়েছেন, ভাল করে খুঁজুন, বেকার বেকার নিরীহ মানুষকে অপবাদ দেবেন না। আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু চোর নই।” তিনি বললেন, “অতসত জানি নে বাবা। আমার সোনা চাই নয়তো একশো গ্রাম সোনার দাম হিসাবে দুলক্ষ টাকা দিয়ে দাও সব নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নেব।” প্রচণ্ড ক্ষোভ ও মিথ্যা অপবাদের জ্জ্বালায় আবেগের বশে সে বলে দেয়, “আপনি যা পারবেন করুন, আমার বাবা চুরি করিনি তাই দায়ও আমার বাবার না।” তারপর তিনি ফোনটা রেখে দিয়েছিলেন। উটকো ঝামেলার দাপটে সকাল থেকে রান্না বন্ধ, কারো গলা দিয়ে কিছু নামছিল না। সবই যেন অপ্রত্যাশিত আতঙ্কে শিহরিত ও যথেষ্ঠ শঙ্কিত ছিল।

সকালে মহিলা নিজেই আবার ফোন করে বলেন, “আজ পাঁচটাই পুলিশ যাবে তুলে নিয়ে আসবে। তখন দেখবো কত ধানে কত চাল” বলেই হাওয়া। সকাল থেকে সকলে কেঁদে যাচ্ছে, রান্না পূর্বের দিনের মত সেদিনও বন্ধ। কিন্তু কি অদ্ভুত দু দিন ধরে কারো খিদেই পায়নি। তারা বেশ দিব্যি জল খেয়েই কাটিয়ে দিইয়েছিল। সেদিন দুপুরে যখন সবাই একজায়গায় বসে ছিল তখন এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। সেই শব্দহীন সময় যেন কত কিছুই ইঙ্গিত করে চলছিল। সবাই যেন অজানা এক ঝড়ের আভাসের বার্তা পেয়ে গেছিল। হঠাৎ মা বলে উঠেছিল, “রঞ্জন একটু ছাতু করে দিই খা, আমদের খিদে নেই।” খেতে মন না চাইলেও মা যখন ছাতুর গ্লাস সামনে ধরল, তখন খিদেটা যেন হুট করে চলে এসেছিল তার। এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিয়েছিল সে। তবুও কারো দুঃশ্চিন্তা কমেনি। মামাকে ফোন করে বলতে মামা আশ্বস্ত করে বলেছিল, ভয় পাবার কিছু নেই। সকলের চক্ষু দেওয়াল ঘড়িতেই আটকে ছিল। সেদিন আর টিউশন্‌ পড়াতে গেল না কেউ। সন্ধে গড়িয়ে রাত ঘনিয়ে এল কিন্তু কিছুই হয় নি। মনটা একটু হালকা হয়ে গেছিল সবার।

কথায় আছে গরিবের বিপদ কি আর বলে কয়ে আসে, দুদিন পর মাঝরাতে রঞ্জনের বাবাকে ধরে নিয়ে গেছিল ওরা। মনে হয়েছিল যেন ওরা শুধু তার বাবাকেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে না, এ যেন সকল নিষ্পাপ, নিরপরাধ মানুষের দুর্বলতার সুযোগে শাসকের জয়ধ্বজার প্রতীক, রঞ্জনের বাবা কেবল উপলক্ষ মাত্র। বাড়িতে প্রচণ্ড এক শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। সকলে ভাবছিল লোক জিজ্ঞেস করলে কি জবাব দেবে তারা। পু-লিশওয়ালাদের মধ্যে একজন আবার বলে গিয়েছিল যে “চিন্তার কোন কারণ নেই। আমরা ইনভেস্টিগেশন করতে নিয়ে যাচ্ছি, কালই ছেড়ে দেব।”

পরদিন সকালে থানাতে যায়, কিন্তু কি আজব প্রমাণ হওয়ার আগে সবাই আসামি বলে ওনার সাথে খারাপ ব্যবহার করছিল। রঞ্জন দেখেছিল, নির্দোষ হয়ে অপরাধের বোঝা নিয়ে তার বাবা কুমড়ো গাছের মতো নুইয়ে পড়েছে, চোখ দুটো লাল টকটকে, মুখটা শুকিয়ে আমশি হয়ে গেছিল, ওদিকে আর তাকানো যাচ্ছিল না- যা সে কখনো ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না। শুধু তাই নয়, তার বোন সকলের পায়ে পড়তেও দ্বিধা বোধ করে নি। কিন্তু কেই বা কার কথা শোনে, ভগবানও হয়তো তখন অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তাই তাদের কান্নার ডাক তাঁর কাছে পৌঁছায়নি। মামা হাজার ফোন করে একজন উকিলের সাথে কথা বলায় তিনি পুনরায় শান্তনা দিয়ে বলেছিলেন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হওয়া তো দূরের কথা, ব্যাপারটা বরং জটীল আকার ধারণ করেছিল। উকিল এসেছিলেন বার্তালাপ হয়েছিল কিন্তু তার বাবাকে কোর্টেই তোলা হয়নি সেদিন। মহিলাটি ফোন করে প্রচণ্ড ভয় দেখালেন। রঞ্জন বুঝতে পেরেছিল যে, তিনি নির্ঘাত পু-লিশওয়ালাদের কিছু বকসিস্‌ দিয়ে প্রসন্ন করেছেন। যার কারণে তারা প্রমাণের অভাবেও অভিযুক্তকে মুক্ত করেনি। তবে জানি না রঞ্জনের বাবা কখনো তার যোগ্য সন্মান পেয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবে কিনা।

আজকের ভারতবর্ষে কত রঞ্জনের বাবারা আছে যারা বিনা দোষে অপরাধের বোঝা বহন করে চলছে। আর যারা সত্যিই অপরাধী তারা মাথা উঁচু করে উচ্চবাচ্য করে চলেছে। এ কেমন সাম্য, এ কেমন বিচার? যে দেশে বিনা প্রমাণে কাউকে কয়েদী বলা হচ্ছে, এদিকে যাদের উপর মানুষের নিরাপত্তার দায় দেওয়া হচ্ছে, তারাই আরো মানুষের জনজীবনে জটীলতার সৃষ্টি করছে- কখনো বা অর্থের লোভে, আবার কখনো বা স্বার্থ চরিতার্থ করতে। আসলে মনে হয় আমরাই এমন হয়ে গেছি যে, সমস্যা নিয়েই মাতামাতি করতে ভালোবাসি, তার সমাধানে নয়। এই তো কদিন আগে কোন রাজ্যে বেশ কয়েকটি ব্রিজ ভেঙে গেছে, কত মানুষ, কত সম্পদ নষ্ট হয়েছে। আমরা ব্রিজের দ্রুত সংস্করণ সম্পর্কে না ভেবে, কেন হয়েছে, কিভাবে হয়েছে, কখন হয়েছে ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে সময় অপব্যয় করে চলেছি। এর ফলে আমাদের নির্বুদ্ধিতা বেশি করে প্রকট হচ্ছে। এর পিছনে দায়ী কে? – আমরা নিজেই। কিছু লোক আছে যারা জনগণকে নিজের আয়ত্তে আনার জন্য করুণ বাস্তবকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে তার কোনো সমাধান ছাড়াই। আর কিছু লোক আছে যারা নিজেদের ‘ভুরি’ অর্থকে ‘ভুরিভুরি’ অর্থে পরিবর্তন করতে যখন পারছে যেভাবে সেভাবে ধ্রুব সত্যকে বিকৃত করছে। ধিক্কার জানাই তাদের। আসলে আমরা ভাবিনা যে আমরা কি করে চলেছি- সঠিক না বেঠিক। যখনই আমরা আমাদের নিজেদের কর্ম ও তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভাববো তখনই হয়তো আমরা কিছুটা হলেও ঠিক পথে এগোবো।

বিঃ দ্রঃ- সব চরিত্র কাল্পনিক ও মতামত নিজস্ব্ ব্যক্তিগত। বাস্তবের সঙ্গে সাদৃশ্য নিতান্ত কাকতালীয় বলে গণ্য হবে।

 

~ গরিবের কি আর সন্মান আছে? ~
Print Friendly, PDF & Email
Previous articlePress Release of AETM International Conference 2018
Next articleপরিণতি
BIDYUT MONDAL
I made a few quotes of which the following is one of them. I don`t care who thinks whatever.
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments