নিক এবং টনি, দুজনেই একই স্কুলে পড়ে এবং খুব ভালো বন্ধু | আগে তারা একসাথে প্রচুর সময় কাটাতো । করোনাকালে সারা পৃথিবীর থমকে যাওয়া তাদের স্বাভাবিক জীবনকেও থমকে দেয় | আগে প্রায় রোজই তারা বিকেলে পার্কে খেলতে যেত, এখন তাদের যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে হোয়াটসআপের ভিডিও কল। ধীরেধীরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। একদিন নিকের মা সারা, টনির মা ক্যারেনকে বলেছিলেন যে তিনি নিককে তার বাবা-মায়ের বাড়িতে নিয়ে যেতে চান কারণ লকডাউনের জন্যে সারা বেশ কিছুদিন তাদের সাথে দেখা করতে পারে নি | সারা আরো বলে যেহেতু জায়গাটা গাড়িতে মাত্র ঘন্টা দেড়েক লাগবে তাই টনিও ওদের সাথে যেতে পারে – সেও তো অনেকদিন গৃহবন্দী তাই তার এই ছোট্ট ট্রিপটা ভালোই লাগবে | কারেন একটু দ্বিধায় পড়েছিলেন কারণ তিনি বলেছিলেন যে এই বাচ্চাগুলি ভারী দুষ্ট, তাই সারার পক্ষে একা দুজনকে দেখা বেশ কঠিন কাজ। তাছাড়া, সারার বাবা-মা বয়স্ক, সুতরাং এই দু’জনের হুটোপুটি হৈচৈ ওনাদের পছন্দ নাও হতে পারে। সারা হেসে উত্তর দিল – “আসলে ওরা এতো হৈচৈ করবেই না : বরং ওরা আমার মার কাছ থেকে উঠবেই না ! আমার মা দারুন গল্প বলেন যা বাচ্চাদের একেবারে মন্ত্রমুগ্ধের মত বসিয়ে রাখে ! ” শেষ পর্যন্ত ক্যারেন রাজি হলেও টনিকে অনেকবার করে বলে দিলেন সে যেন ওখানে বেশি দুষটুমি না করে |
এক মেঘলা শনিবার তারা সারা দুজনকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলো | লকডাউনের বিধিনিষেধের কারণে, রাস্তা তুলনামূলকভাবে ফাঁকা ছিল এবং তারা এক ঘন্টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে গেলো । সারার বাবা মা তাদের দেখে ভীষণ খুশি হলেন – বিশেষত অনেকদিন বাদে নাতিকে দেখতে পেয়ে তাদের আর আনন্দের সীমাপরিসীমা রইলো না ! টনিকেও তারা খুব আদর করলেন | । নিক এবং টনি লনে ব্যাডমিন্টন খেলতে শুরু দিলো । সারা তাদের সাবধানে খেলতে বলেছিল যেহেতু লনে, তার বাবার কিছু বিরল প্রজাতির অর্কিড রয়েছে | যাইহোক, সারার বাবা বললেন ওদের ইচ্ছেমতো খেলতে দে !
পুরো সন্ধ্যা খেলার পর ডিনারের জন্য সারার মা সবাইকে ডাকলেন | নিক এবং টনি ডিনারের পরে, সারার মাকে পীড়াপীড়ি করতে থাকে তাদের একটি গল্প বলার জন্য তিনি মুচকি হেসে তাদের বলেছিলেন “আমি বরং একটি আকর্ষণীয় ঘটনা বলব যা আমি আমার দাদুর কাছ থেকে শুনেছি।” সারা’র বাবা তাকে বলেছিলেন ” ডিয়ার ওটা না – বাচ্চা ছেলেগুলো ভয় পাবে! ” যাইহোক, নিক এবং টনি প্রতিবাদ করে তাকে বলে ওঠে যে তারা যথেষ্ট সাহসী!
সারার মা বলতে শুরু করেন -“আমি যখন আমার কৈশোরে ছিলাম তখন আমার গ্রান্ডপার কাছ থেকে এটি শুনেছিলাম। যদিও এর পরে ষাট বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে, তবু আজও আমার এটা স্পষ্ট মনে আছে । আমার গ্রান্ডপা একজন ডাক্তার ছিলেন আর কাজের সুবাদে তিনি প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ভ্রমণ করেছিলেন! তিনি পূর্ব আফ্রিকা, মেক্সিকো, লাতিন আমেরিকা ,এমনকি ব্রিটিশ ভারত ও সিঙ্গাপুরেও গিয়েছিলেন । এখন আমরা সবাই কেভিড সম্পর্কে ভীত কিন্তু ভেবে দেখো যে সে সময়ের মানুষরা দুটি বিশ্বযুদ্ধ, বিউবনিক প্লেগ এবং আরো কত দুর্যোগ দেখেছিল ! তার পরেও তারা জীবন সম্পর্কে আশা হারান নি !আমার গ্রান্ডপা কেবল বেঁচে থাকার জন্য একটি অজানা দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করতে বাধ্য হন । একটানা এতোগুলো কথা বলার পরে বৃদ্ধা কিছুক্ষণ থামলেন | সম্ভবত তিনি তার ভুলে যাওয়া দিনগুলির কথা মনে করে নিচ্ছিলেন |নিক কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠল। সে বলে উঠলো ” গল্পটা বলো !” “হ্যাঁ!” বৃদ্ধা বলতে শুরু করেন …আমি আসলে আমার পুরোনো দিনের স্মৃতিতে হারিয়ে গেছিলাম ! – দুঃখিত!” তিনি বলা শুরু করেন – “একবার আমার গ্রান্ডপাকে ভারতে পাঠানো হয়েছিল। তিনি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের একটা শহর, মাইসোরের স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দায়িত্ব পেয়েছিলেন | ধীরে ধীরে তিনি তার দক্ষ চিকিত্সার মাধ্যমে সেখানে প্রচুর মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সেখানে রবার্ট বলে একজনের সাথে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে যাকে তিনি রব নামে ডাকতেন। রব সেনাবাহিনীতে ছিলেন | এছাড়াও রব একজন দক্ষ শিকারী ছিলেন – যাকে বলে ক্র্যাক শট”। টনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন – ” ঠাম্মা ক্র্যাক শট এর অর্থ কী?” তিনি একটু জল পান করে নিয়ে বললেন: “এর অর্থ এমন ব্যক্তি, যে বন্দুক / পিস্তল দিয়ে গুলি করার সময় তার লক্ষবস্তুটিকে খুব কমই মিস করে। রবের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখার আগ্রহ ছিল এবং তোমরা জানো যে ভারত একটা বিরাট দেশ | ইস্টারের ছুটির সময় তিনি আমার গ্রান্ডপাকে বলেছিলেন সপ্তাহান্তে – একটু দূরের একটি গ্রাম কুর্চি ভ্রমণ করার পরিকল্পনা করুন। ” টনি জোরে হেসে উঠে বলল “কুর্চি – কি মজার নাম! এর মানে কী?” তার ঠাকুমা জবাব দিয়েছিলেন – “আমি জানি না রে! তবে একটা জিনিস মনে রেখো আমি যে সময়টির কথা উল্লেখ করছি সেটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরে ; মানে আজ থেকে প্রায় একশো বছরেরও একটু আগে । আমি যদিও ওখানে কোনোদিন যাইনি তবে অনুমান করতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে ঐসময় ঐসমস্ত জায়গা প্রায় জনহীন ছিল |
শনিবার মধ্যাহ্নভোজন শেষে, রোগী দেখে বেরোতে বেরোতে বেশ খানিকটা দেরিই হয়ে গেছিলো সেদিন ওদের | ওরা যখন কুর্চি পৌঁছেছিল তখন সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে । সেই গ্রামের কাছেই ইরুপ্পু (IRUPPU) নামে একটি সুন্দর জলপ্রপাত ছিল তবে এটি দেখতে একটি পাহাড়ের উপরে উঠতে হবে যা উচ্চতায় 1000 ফুট এরও বেশি। গ্রান্ডপা আমাকে বলেছিলেন যে আসল চ্যালেঞ্জটি উচ্চতা নয়, চ্যালেঞ্জটি ছিল পাহাড়ের চারপাশের ঘন বন | সেই সময় – এমনকি স্থানীয় লোকজনও এই বনেরপথটি সন্ধের দিকে এড়িয়ে যেত। রব স্থানীয় থানার অফিসার ইনচার্জকে চেনে, যা কুর্চি গ্রামের ভিতরে ছিল। অফিসারের নাম ছিল বেন – ভারী আমুদে লোক | তিনি কিন্তু এখন নয়, আগামীকাল সকালে জলপ্রপাত দেখতে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন | বেন তাদের সেই ক্রান্তীয় জঙ্গলের নানা বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন; চিতা ,পাশাপাশি বন্য ভাল্লুক রয়েছে, যা অত্যন্ত হিংস্র তদুপরি, অরণ্যে বহু প্রজাতির বিষাক্ত সাপ এবং পোকামাকড় ছিল। রব জানিয়েছিল যে নিজের শুটিংয়ের সামর্থ্যের উপর তার পূর্ণ আস্থা আছে। রব আরো বলেছিলো যে সূর্য অস্ত যাবার সময় যে কোনো অরণ্যের একটা অদ্ভুত আদিম সৌন্দর্য ফুটে বের হয় ! যেহেতু উভয়ের হাঁটুর উচ্চতা পর্যন্ত বুট ছিল তাই তারা সাপ এবং পোকামাকড় থেকে নিরাপদ। হটাৎ বেনের অফিসের এক পিওন বেনকে বলেছিল – “স্যার, স্নেক গডের ব্যাপারটা আপনার বন্ধুদের জানিয়েছেন?” রব চিৎকার করে বলল – “কি?” বেন বলেছিলেন, “আসলে, এখানে সত্যিই কয়েকটি বড় সাপ আছে |আমি জানি না যে আপনি কিং কোবরা সম্পর্কে শুনেছেন কিনা? যা এমনকি 20 ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর তারা অন্য সাপের মত মানুষকে ভয় পায় না ! ” এখন নিক জিজ্ঞাসা করল, “দাদী কিং কোবরা কী?” তিনি একটু থেমে বললেন, “আমি আমার গ্রান্ডপার কাছ থেকে এই সাপের কথা শুনেছি। এগুলি খুব বিপজ্জনক সাপ এবং এমনকি একটি হাতিকেও যদি এই সাপ কামড়ায় হাতিটিও মারা যেতে পারে ! তারা কতটা সুন্দর দেখতে তা তোমরা গুগলে সার্চ করে দেখতে পারো | ভয়ঙ্কর সুন্দর বোধহয় একেই বলে ! পরে আমি অ্যানিমাল প্ল্যানেট চ্যানেলে দেখেছি। এখনও কিছু ভারতীয় সাপকে স্নেক গড হিসাবে পূজা করে। যাইহোক, এই সমস্ত কথা শুনে আমার গ্রান্ডপা তখন ঔসময় ওরকম ঘন জঙ্গলে যেতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তবে, রব অনড় ছিল এবং ঘোষণা করল যে কেউ যেতে না চাইলে সে একা যাবে। তখন কোনও বিকল্প ছাড়াই আমার গ্রান্ডপা তাঁর সাথে যেতে রাজি হয়েছিল, কারণ আমার গ্রান্ডপা বা বেন দুজনেই রবকে একা ছেড়ে যেতে চাননি। বেন জয় নামে এক স্থানীয় লোককে ওদের সাথে দিয়েছিলেন, যিনি জলপ্রপাতটিতে পৌঁছাবার পথে তাদের গাইড করতে পারেন।
======================================================
রোদ্দুর পড়ে আসা শেষ বিকেলে তিনজন বনের মধ্যে পায়ে চলা পথের রেখা ধরে জলপ্রপাতটির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে | অবশেষে তারা জলপ্রপাতটি খুঁজে পেয়েছিল। জয়কে ছাড়া বনের পথ ধরে স্পটটি খুঁজে পাওয়া সত্যি কঠিন হতো ! জলপ্রপাতটি অত্যন্ত সুন্দর ছিল। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল। জায়গাটির নিস্তব্ধতা তাদের মনে একটি শান্তির ভাব ছড়িয়ে দিয়েছে। তারা পাথরের উপর বসেই থাকে যতক্ষণ না জয় তাদের ফেরার তাড়া দেয় । জয় বলেছিল, “স্যার, সূর্য অস্ত যাচ্ছে। হিংস্র প্রাণীদের শিকারের ওপর আক্রমণ করার জন্য সময়টি আদর্শ।“ রব ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে হেসে উঠল; কিন্তু আমার গ্রান্ডপা তাকে ফিরে চলার জন্য বাধ্য করেছিলেন। অর্ধেক পথ চলার পরে, তারা একটি তীক্ষ্ণ হিস্ হিস্ শব্দ পান | জয় তাদের বলেছিল যে মনে হচ্ছে কাছাকাছি কিং কোবরা রয়েছে এবং সাধারণত যখন তারা সঙ্গম করে তখন এই ধরণের তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা যায় | হঠাৎ রব একটি ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করে | জয় যেন শিউরে উঠেছিল | এমনকি আমার গ্রান্ডপা অপ্রয়োজনীয় নীরবতার সৌন্দর্যকে ছিন্ন করে দেওয়ায় বিরক্ত হয়েছিলেন। হটাৎ তারা দেখতে পেল পাশের জঙ্গল থেকে একটি বড় সাপ ফণা তুলে পায়ে চলা পথের মাঝখানে হাজির হয়েছিল – ফণাটি প্রায় মাটি থেকে একজন মানুষের উচ্চতায় দাঁড়িয়ে ছিল! রব আবার গুলি চালিয়েছিল | কিন্তু গুলি লাগা সত্ত্বেও সাপটি তাদের দিকে ধেয়ে আসে | রব কয়েকবার গুলি চালিয়ে শেষ পর্যন্ত সাপটিকে মেরে ফেলেন। এরপর তাদেরকে চমকে দিয়ে বোন থেকে এক গেরুয়া পোশাক পড়া এক ব্যক্তি উপস্থিত হল। তার করমচার মত লাল চোখগুলো যেন আগুনের মত ধকধক করছিলো ! তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন – ভাষা না বুঝতে পারলেও গ্রান্ডপা বোঝে তিনি ওদের তিরস্কার করছেন কঠোর ভাবে | রব তার রাইফেলটি তুলতেই গ্রান্ডপা একটি সম্ভাব্য হত্যা এড়াতে শক্তভাবে তাঁর হাত ধরেছিল। পরে তারা জয়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছিল যে লোকটি একটি তান্ত্রিক । জয় ওনার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল | পরে তান্ত্রিক মৃত সাপটিকে ধরে নিঃশব্দে ঘন জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল। রব জয়কে জিজ্ঞাসা করলেন তান্ত্রিক কী বলেছিল। জয় নিচু স্বরে বলেছিল – “তিনি অভিশাপ দিয়েছিলেন যে যে ব্যক্তি বিনা কারণে সাপের জীবন শেষ করেছিল, তাকেও প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে | সাপগুলি তাদের জায়গায় সঙ্গম করছিল। একজন অনুপ্রবেশকারী, যিনি অকারণে হত্যা করলেন, তিনি নিজের জীবন দিয়ে এই মূল্য পরিশোধ করবেন। ” রব হাসল। গ্রান্ডপা সবাইকে পাহাড়ের নীচে গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাড়া দিয়েছিলেন। ” পুরো ঘটনাটি শোনার পরে স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বেন তাদের আগামীকাল-সকালের দিকে চলে যাওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি বলেছিলেন যে এই ঘটনাটি স্থানীয় আবেগকে আঘাত করতে পারে এবং তার ফলে স্থানীয় লোকদের মধ্যে কিছুটা অশান্তি হতে পারে।
এই পর্যন্ত বলে নিকের ঠাকুরমা চুপ করে রইলেন কিছুক্ষন |এমনকি টনি এবং নিক কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর নিক জিজ্ঞাসা করল, ” শেষ?” ঠাকুরমা আস্তে আস্তে নিকের দিকে মাথা ঘুরিয়ে খুব নীচু কণ্ঠে জবাব দিলেন, “না- এখনও কিছুটা বাকি আছে। অবশেষে, গ্রান্ডপা ইংল্যান্ডে ফিরে এসে চিকিত্সক হিসাবে সেটেল করে গেলেন | | ধীরে ধীরে পুরোন দিনের স্মৃতি তার মনে আবছা হতে থাকে । একবার তিনি একটি মেডিকেল কনফারেন্সে লন্ডনে গিয়েছিলেন। যখন তিনি তার ফেরার ট্রেনটির জন্য কিংস ক্রস স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন, হঠাৎ তিনি বুঝতে পারলেন যে কেউ তার বাম কাঁধে খোঁচা দিচ্ছে | উনি ঘুরে দাঁড়িয়ে যাকে দেখলেন তাকে ঠিক চিনতে পারলেন না ! ব্যক্তিটি হাসিতে ফেটে পড়ে বলে “কি চিনতে পারছো না তো ?” তাঁর হাসি এবং কথা বলার ধরণ দেখে উনি সহজেই সনাক্ত করেছিলেন যে এটি রব। “ওহে রব।! তোমার চেহারাটি এতটাই পরিবর্তিত হয়েছে এবং আমরা কুড়ি বছরের পরে দেখা করেছি! তাহলে আমি তোমাকে কীভাবে চিনতে পারি? ” রব উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ওঠে ” তোমার কিন্তু চেহারার খুব একটা পরিবর্তন হয় নি ” বলে রব আবার জোরে হেসেছিলেন।
রব বন্ধুর সাথে কুড়ি বছর পর দেখা হবার আনন্দ উদযাপন করার জন্য একটি ট্রিপের প্রস্তাব দেন | আমার দাদা শেষ ট্রিপের অভিজ্ঞতাটি স্মরণ করে কিঞ্চিৎ দ্বিধায় পড়েছিলেন । রব তখন একটু নিচু স্বরে বলেছিলেন – “গত শীতকালে একটি ভাইরাল ফিভারের কারণে মেগ, আমার স্ত্রী মারা গেছেন। মনে করি না , একজন সিঙ্গেল ফাদার হিসাবে আমার ছেলেকে আমি ঠিকভাবে মানুষ করতে পারবো – তাই আমি আমার ছেলেকে তার দাদা-দাদির বাড়িতে রেখেছি | আমি এখন বড় একা ! ” গ্রান্ডপা তাই রবকে কিছুটা সান্তনা দেবার জন্যই এই ট্রিপে রাজি হয়ে গেছিলেন |
যে কারণেই হোক না কেন আমার গ্রান্ডমা তাদের সাথে ওই ট্রিপে যাননি। তারা ওয়েলসের সমুদ্রের ধারের একটা শহর ল্যান্ডুডনো (Llandudno) গিয়েছিল। তোমরা চেনো জায়গাটা ? ” নিকের দাদী তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন।
নিক বলেছিল – “হ্যাঁ আমি জানি”
তিনি বলে চলেন – “তারা অ্যাঞ্জেল বে এর নিকটে একটি গেস্ট হাউসে ছিল – সত্যিই খুব সুন্দর জায়গা। এমনকি আমি পরে নিজেও কয়েকবার সেখানে গিয়েছিলাম। তারা ল্যান্ডুডনো পৌঁছে অ্যাঞ্জেল বের (Bay)কাছে এদিক সেদিক উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল | ডিনার করার পর রবকে শুভরাত্রি জানিয়ে গ্রান্ডপা শুয়ে পড়েছিল । এবং ক্লান্ত থাকায় দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছিল |মধ্যরাতে হটাৎ ঘুম ভেঙে যায় – তাঁর কেমন যেন অসোয়াস্তি লাগছিল | এবং তিনি জেগে উঠলেন। জানালা দিয়ে দেখলেন রব বাইরের দিকে এগিয়ে চলেছে। তিনি “রব” চেঁচিয়েছিলেন কিন্তু কোনও উত্তর পেলেন না |
===========================================================
এতো রাত্রে রব কোথায় যাচ্ছে ?
অতঃপর তিনি দ্রুত পোশাক পেলেন এবং তাঁর অনুসরণ করলেন। এদিকে রব আমার দাদুর থেকে প্রায় 200 ফুট এগিয়ে রয়েছে। তিনি আবার চেঁচিয়ে উঠলেন কিন্তু আবারও কোনও উত্তর পেলেন না । কিন্তু রব যেভাবে চলছিল তা দেখে মনে হচ্ছে সে মাতাল। তবুও রব খুব দ্রুত হাঁটছিলো | গ্রান্ডপা তাকে একই গতিতে অনুসরণ করতে অক্ষম ছিল। অতএব, তাদের মধ্যে ব্যবধান ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করা হয়েছিল। রব অ্যাঞ্জেল বের নিকটে পৌঁছে এক চূড়ায় উঠে গেল। হঠাৎ গ্রান্ডপা শুনতে পেল এক তীক্ষ্ণ হিস্ হিস্ শব্দ যা তাকে এক পুরানো ভুলে যাওয়া ঘটনাকে আবার মনে করিয়ে দেয়। তিনি ভাবছিলেন যে এই শব্দটি এখানে কীভাবে হতে পারে। তারপরে তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখতে পেলেন যে একটি বড় স্যাপ দ্রুততার সাথে রবের দিকে এগিয়ে আসছিলো। সাপটি রবের কাছে একটা প্রচন্ড ছোবল দিল। রব চিৎকার করে ওপর থেকে অনেকটা নিচে হুমড়ি খেয়ে পড়লো হঠাৎ আমার দাদা শুনতে পেল তীব্র হাসির শব্দ, যা রাতের নীরবতা ভেঙে খানখান করে দিয়েছিলো এবং গ্রান্ডপা সভয়ে দেখতে পেলো যে যে সাপটি তার কাছে এগিয়ে আসছে। তিনি জ্ঞান হারিয়েছিল এবং কিন্তু জ্ঞান হারাতে হারাতেও আবার তিনি সেই পৈশাচিক অট্টহাসি শুনতে পেয়েছিলেন !
পরের দিন সকালে স্থানীয় কিছু বাসিন্দা তার মুখে জল ছিটিয়ে দিলে তিনি তার চেতনা ফিরে পান। তার প্রথম বক্তব্য ছিল “রবকে বাঁচান !” উদ্ধারকারী দল নিচের পাথরের উপর রবের ঘাড় দুমড়ে যাওয়া মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছিল এবং তারা জানায় যে সে খাড়া থেকে নেমে পড়েছে এবং তাই তার মৃত্যু হয়েছিল। যদিও লোকেরা অবাক হয়েছিল কেন সে সময় তিনি সেখানে গেলেন? এমনকি ময়না তদন্তের রিপোর্টও বলেছিলো যে ওপর থেকে পড়ার জন্যই তার মৃত্যু হয়েছে – যদিও রবের কপালে তারা দুটি তীক্ষ্ণ ছিদ্র দেখে। সেদুটি কিসের জন্য হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট দিতে পারে না। এবং তারা আরো জানায় রব সেদিন যথেষ্ট পরিমানে মদ্যপ ছিল প্রতিবেদনে, রবের দেহে কোনও বিষ পাওয়া যায়নি। সাপ সম্পর্কে আমার গ্রান্ডপার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি | তোমরা জানো যে ওয়েলস বা এমনকি পুরো যুক্তরাজ্যেও, কিং কোবরার মতো এত বড় আকারের বিষাক্ত সাপ নেই! স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছিলেন আমার গ্রান্ডপাও মাতাল ছিল এবং এমনকি আমার দাদা রবকে ধাক্কা দিয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে পুলিশ তদন্তও করা হয়েছিল! ভাগ্যক্রমে সেই রাতে বৃষ্টি হয়েছিল এবং যেখান থেকে রব পড়ে গিয়েছিলেন তার পঞ্চাশ ফুটের মধ্যে পুলিশ কেবল একটি পায়ের ছাপ পেয়েছিল, তা রবের বুটের চিহ্ন। ”
নিকের ঠাকুমা চুপ হয়ে গেলেন। টনি এবং নিক দুজনেই এক সাথে জিজ্ঞাসা করছে – “তাহলে?” তিনি তার হাত হেলান দিয়ে বললেন “কিছুই নয় – এটিই হ’ল একটি দুঃখজনক ঘটনার সমাপ্তি |” হঠাৎ দেখে যে সারাও ওখানে গল্প শুনতে কখন এসে গেছে । সারা বলেছিল – “মা গ্রান্ডপার সম্ভবতঃ হ্যালুসিনেশন হয়েছিল”। তিনি অল্প হেসে সারাকে জবাব দিয়েছিলেন – ” তুমি কি শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট পড় নি যা বলে There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy! “