বড়রাস্তা পেরিয়ে ঘাটে এসে দাঁড়াল সুদীপ। বুড়ো বটগাছটার বাঁধানো চাতালে বসার যোগ্য মোটামুটি পরিষ্কার একটা অংশ খুঁজে নিয়ে হাতঘড়ির দিকে তাকাল একবার, প্রায় ন’টা বাজতে চলেছে। কাল রোববার; বাড়ি ফেরার বিশেষ তারাও তাই নেই। আর কি এমন দেশ চালানোর গুরুদায়িত্বই বা আছে ওর কাঁধে, যে দুমিনিট বসার জন্য লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে – সেই তো গিয়ে পেট চালানোর মত দুমুঠো ভাত-ডালের ব্যবস্থা; তারপর কোনরকমে টেনে-হিঁচড়ে শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে নিজের অতীত-ভবিষ্যৎ ক্লাইম্যাক্স-অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স ঘুরে, ক্লান্তিটাকে প্রায় শরীর খারাপের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে, নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়া। সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে সম্পর্ক অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন। স্বজনহারা মরুভূমিতে বন্ধু বলতে রাত আটটার নির্জন নিস্তব্ধ এই গঙ্গার ঘাট, বাকি সবই কেমন যেন মরীচিকা মনে হয়। জল বাড়ছে হয়ত, দুহাত দূরের অভিভাবকহীন নৌকোটা স্রোতের ঠেলায় মাঝে মাঝে বেশ জোরে দুলে উঠছে। একটানা তাকিয়ে থাকলে ঘোর লাগে, মনে হয় যেন গোটা পৃথিবীটাই দুলছে। অবশ্য দুনিয়ার ঠেকা আর কেই বা নিয়েছে? ওর ছোট্ট পৃথিবীটা যে বেশ জোরেই দুলছে, এখনো, ওই নৌকোটার মত।
গঙ্গার একটানা কলকল শব্দের সাথে ভেপার ল্যাম্পের এই আপাত দৃশ্যমান আলো-আঁধারি ব্যাপারটা বেশ ভালো মানায়। দুহাত দূরের সুগভীর অন্ধকার অংশটার যেন অমরত্ব প্রাপ্তি ঘটে; ওর ওপারেও যে একটা পৃথিবী আছে, যেখানে মানুষগুলো ওর মতই একইরকমভাবে ক্ষত-বিক্ষত যেন বিশ্বাসই হয় না। আর যখনই এর ব্যাপ্তি সম্পর্কে মন এতটুকুও নিশ্চিত হতে পারে না, ছোট ছোট ভাললাগাগুলো এক একটা মহীরুহ হয়ে জন্ম নেয়, যার পাহাড়প্রমাণ উচ্চতার সামনে না চাইতেও বেড়ে ওঠা ডিপ্রেশন শব্দটা মুহূর্তে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। যদিও তার স্থায়িত্ব খুবই অল্প সময়ের, তাও। এই একটা কারণেই সপ্তাহের শনি-রোববার দুটো ওর নিয়ম করে এখানে আসা চাইই চাই। সারা সপ্তাহের না-বলা, না বলতে পারা কথাগুলো নিভৃতে বালির স্তুপের মতন জড়ো হয়; তারপর দমকা হাওয়ায় সেগুলো যখন জলে গিয়ে মেশে ভিতরটায় যুদ্ধবিরতির মত অদ্ভুত একটা শান্তি অনুভব করে ও। বাকি দিনগুলোতেও তাই আসতে ইচ্ছা করে বৈকি, যদিও কাজের চাপে আর হয়ে ওঠে না।
ছোটবেলাটাই বোধহয় ভাল ছিল। তখন ভালবাসার সব উপাদান ভরপুর ছিল, শুধু দাঁড়িয়ে দেখার সময় ছিল না আর আজ দাঁড়িয়ে দেখার সময় হয়ত আছে কিন্তু ভালবাসার জিনিসগুলোই হাতছাড়া হয়ে গেছে। অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই যে, দশ বছরের ক্ষুদ্র সংসারজীবনে শুধু রাতের বেলায় জড়িয়ে ধরে লাগামছাড়া কিছু ভালবাসার কথাবার্তা ছাড়া অরুণিমাকে সেভাবে ও সময় দিয়ে উঠতে পারেনি, অস্বীকার ও করেও না। কিন্তু কোম্পানির চাকরিতে সেটা খুব স্বাভাবিক একটা সমস্যা; সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটা তখন বড্ড ছোট। কিন্তু সুখ-দু:খের হিসাব পাষাণপ্রতিম নীরস জীবনখাতায় কতটুকুই বা আঁচড় কাটতে পেরেছে। অরুণিমা বুঝল না, অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও না। এতদিনের এত পরিশ্রমের একটু একটু করে সাজানো সংসারটা একমুহূর্তে ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে দেখে সত্যিই খুব কষ্ট লেগেছিল সেদিন। মেয়েটাকেও অরুণিমা নিয়ে যেতে চেয়েছিল, বুকে আগলে ধরে রেখেছিল সুদীপ। সম্পূর্ন অন্য একটা ঘরে, অন্যের সংসারে, শুধুমাত্র শরীর হয়ে বাঁচবে মেয়েটা? মেনে নিতে পারেনি। সবচেয়ে কষ্ট হয় ওর জন্যই, অনেক লড়াই করেছে মেয়েটা। তখন বুঝতে পারত না, মাঝেমাঝেই প্রশ্ন করত – ‘মা কোথায় গেছে? কবে ফিরবে?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ সবই বোঝে, বোঝে বলেই ওর মায়ের মত একদিন ওকেও চলে যেতে হবে ধরে নিয়েই মাঝেমধ্যে ইয়ারকি মেরে বলে – ‘আর একটা বিয়ে করে ফেল না তুমি? লোকজন দুটো তিনটে সম্পর্কে জড়ায় আর তুমি কিনা সেই এক ধুয়ো ধরে বসে আছ?’ কিছু বলে না সুদীপ, কিছু বলতে পারে না; ওর হাসিটাই হয়ত সব কথা বলে দেয়।
ছোটর থেকেই অভিনয়ের প্রতি খুব ন্যাক ছিল সৌমির। রবিবার খবরের কাগজের বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে বলিউড টলিউডের নামকরা ফিল্ম আর্টিস্টদের ছবি আসত। পছন্দের অভিনেতা অভিনেত্রীদের ছবি কেটে বইয়ের পাতার ফাঁকে রেখে দিত, এমনকি ওর পড়ার ঘরের একটা দেওয়ালও বাদ ছিল না। জিজ্ঞেস করলে বলত ফ্যাশন ডিজাইনার হবে বড় হয়ে। কোনদিন বারণ করেনি সুদীপ। হয়ত তখন এই স্বপ্নগুলো বড্ড বেশিই আকাশকুসুম মনে হত, আর পাঁচটা বাবা মার মতন জীবনের ওঠা-পড়াগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা ওরও হত বহুবার; কিন্তু অভিজ্ঞতা বলত যদি বড় হওয়ার তাগিদে বড় হওয়ার আনন্দটাই হারিয়ে যায় তাহলে আর বেঁচে থেকে লাভ কি। তারপর কত কালবৈশাখী মুহূর্তে তছনছ করে মিলিয়ে গেছে ওই আকাশটাতে, যেন কোনদিন ছিলই না; জীবনের কত রঙ নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় উদ্গ্রীব ফুলের পাঁপড়ির মতন একটার পর একটা মেলে ধরেছে নিজেকে। কিন্তু ভাগ্যের খাতায় যদি পূর্বপরিকল্পিতভাবে এই অসম যুদ্ধের জয়ী নির্দিষ্ট করা থাকে, এই বয়সে পৌঁছে সেটা যে কোনভাবেই ও হতে পারে না সেটা সুদীপ ভালভাবেই জানত। আজ মেয়েটা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে শুধু নয়, মুম্বাইয়ের মতন শহরে নিজের স্বপ্নকে মাইলস্টোনের আকার দিয়েছে। এখনো মাস গেলে টাকা পাঠানো ওর অলিখিত রুটিন আর বারণ করলে বলবে – ‘আমি খুব ভাল করেই জানি নিজের খরচ চালানোর জন্য তোমার পারিশ্রমিকই যথেষ্ট, তাই খুব ভাল হয় যদি এই টাকাকটা তোমার পছন্দের কথা মাথায় রেখে খরচ কর, তবেই হয়ত আমার লড়াইটা একটা পূর্নতা পাবে।’
জীবনে হার-জিতটাই বোধহয় সব নয়, পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব বোধহয় কোনদিনই কারোর মেলে না। হঠাৎই ফোন বেজে উঠল, সৌমি ফোন করেছে; অনেকদিন বাঁচবে। বার দুই তিন গলা খাঁকরে রিসিভ করল সুদীপ – ‘হ্যাঁ বল, এইত জাস্ট বেরোচ্ছি অফিস থেকে। কত আর রাত হয়েছে, ঠিক পৌঁছে যাব বাড়ি। অত চিন্তা করিস না।’ বেমালুম মিথ্যা কথাই বলল, না হলে এত রাতে একা গঙ্গার পাড়ে শুনলে হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। না: আর নয়, উঠতে হবে এবার। ফোনটা রাখতেই, পা ধুয়ে যাওয়া ঢেউয়ে শহরতলীর নিয়ন আলোর মত চিকচিক করে উঠল সুদীপের চোখের কোণটা। অনেক লড়াইয়ের সাক্ষী সে চোখের জল, গঙ্গার চেয়েও পবিত্র।