আকাশটা কালো হয়ে রয়েছে সকাল থেকেই, বৃষ্টিটা শুরু হলো বলে।
“ইশ, বৃষ্টিটা পড়লে কোচিং ক্লাসটায় আর যেতে হতো না। প্রবীর স্যার কে ভালোই লাগে, কিন্তু রোববার ছুটির দিনে খেলার পর আড্ডাটা মাটি হয় এই ক্লাস টার জন্য, তার উপর বাংলা কোচিং, এক আধদিন না গেলেও চলে। খুব যে দরকার ছিল এই কোচিং টার তাও নয়, বাংলায় সোম এমনিতেই ভাল। কিন্তু ওই আরকি, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ভর্তি হয়েছিল।
এইদিক টা বেশ ফাঁকা, সাইকেল এর প্যাডেল এ চাপ দিতে দিতে সোম ভাবলো, “এহহ, গোড়ালিতে লেগেছে, মাঠে বোঝা যায়নি, কিন্তু এখন মালুম দিচ্ছে।
এবার বর্ষা টা দেরি করে এসেছে। আষাঢ়, শ্রাবণ পেরিয়ে ভাদ্র মাসের শেষে বৃষ্টি ঠিকঠাকমত শুরু হলো। বর্ষা এমনিতে বেশ ভালোই লাগে, ঝমঝম বৃষ্টিতে বাড়িতে খিচুড়ি, বিকেলে কাদা মাঠে খেলা, আহা এই তো জীবন। গাছপালা গুলোও সবুজ হয়ে মনটা ভালো করে দেয়। তবে বৃষ্টি পড়লেই জল জমার ভয়। আর এই প্রবীর স্যার এর বাড়ির গলিতে ঢোকার মুখটায় তো দেখতে দেখতে এক হাঁটু জল জমে যায়।
এই প্রবীর স্যার এর কোচিং টায় ঢুকেছিল সোম বেশ কটা বন্ধুর সঙ্গে একসঙ্গে, কিন্তু তারা সবাই কিছুদিন পরেই তুষার স্যার এর কাছে চলে গেলো। স্কুল এর স্যার এর কাছে পড়বে বলে। সোম কেও নিয়ে যেতে ছেয়েছিল, কিন্তু সোম যায়নি। বোধোয় দেবলীনার জন্য।ব্যাপারটা কেউ জানেনা বটে।
“জানতে পারলে আর রেহাই নেই, আওয়াজ দিয়ে ষষ্ঠী পুজো করে দেবে।”
লাভ খুব একটা হয়নি যদিও, ভালো করে কথাই হয়না, মনের কথা বলা তো দুরস্ত।
ভারী মিষ্টি মেয়েটা। প্রথম কোচিং এর দিন থেকেই ভালো লেগে গ্যাছে সোম এর। তবে সোম এর পাত্তা পাওয়ার সুযোগ নেই। কোচিং এর বাকি ছেলেগুলোর মত বাইক ও নেই সোম এর। তার উপর আবীর আর রূপক দুজনেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা নিজেদের মধ্যে আলোচনাও করে রেখেছে, দেবলীনা যাকে পছন্দ করবে অন্যজন সরে যাবে। এদের দুজনকে পেরিয়ে এমনিতেই কথা বলার সুযোগ ই পায়না সোম।ভাবতে ভাবতে কখন স্যার এর বাড়ি এসে গ্যাছে খেয়াল ই হয়নি সোম এর।
“উফ্, একটু আগে আসতে পারলিনা বৃষ্টিটা!” ঠিক গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই শুরু হলো বৃষ্টি।
“আরে আবির, রূপক কারুর বাইক দেখছি না বাইরে!” মনটা একটু খুশী হয়ে গেলো সোম এর।
“আজ তাহলে দেবলীনার সঙ্গে একটু কথা হলেও হতে পারে।”
দরজা ঠেলে ঢুকেই সোম এর চোখ দেবলীনা কে খুঁজে নিল।
“যাক এসেছে তাহলে।” আজ মোটে পাঁচজন এসেছে, অর্ধেকও না। চোখাচোখি হতে, একটু হেসে উল্টো দিকে বসে পরলো সোম।
“একটুর জন্য বেঁচে গেলাম, বৃষ্টি টা থেকে, আজ না আসলেই হতো” রণর দিকে তাকিয়ে বলল সোম।
“কাল ম্যাচ দেখলি?” রণ জিজ্ঞেস করলো।
“একদম ভাই, এ ম্যাচ ছাড়া যায়!”
প্রবীর স্যার এর বয়স হয়েছে, প্রায় পঁয়েশ্ষটটি হবে। অবসর নিয়েছেন স্কুল থেকে, কিন্তু ছাত্র পড়ানো ছাড়েননি। ছাত্রদের সাথে বেশ বন্ধুর মতই কথা বলেন, তাই ছাত্ররাও ভালোবাসে স্যারকে। ঘরে ঢুকেই বললেন, “কিরে, বাকিগুলো গেলো কই? একটু বৃষ্টি পড়ল কি পড়লো না, ছুটি মেরে দিল! ভাবলাম আজ কোনি গল্পটা শুরু করবো। যাক যে কজন আছে তাতেই শুরু করি। কি বল?”
কোনি পড়াতে পড়াতে হঠাৎ বলে উঠলেন স্যার, “এই বৃষ্টির মধ্যে একটু মুড়ি পেয়াজি হলে জমে যেত কি বল?”
সবাই হই হই করে বলে উঠলো “হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার!”
ডাক পড়লো কাজের মেয়ে অনিতার। কোনির বদলে জমে উঠলো আসর। মুড়ি, পেঁয়াজি আর প্রবীর স্যার এর বলা ভূতের গল্পো।
সোমের চোখ বারবার দেবলীনার দিকে যাচ্ছে, মাঝেমাঝে চোখাচোখি হলেই আলতো হেসে চোখ সরিয়ে নেয় দেবলীনা। আর তাতেই সোমের মনে আকাশ কুসুম ভাবনা ভীড় করে। আহা কি ভালোই না হতো প্রেমটা করতে পারলে। সামনে পুজো এক মাস ও নেই, বেশ একসাথে ঘোরা যেত। বন্ধুদের সবারই মোটামুটি গার্লফ্রেন্ড আছে। সোমের দাড়াই কিছু হলনা আজ অব্দি।
ঘন্টা দুই কোথা থেকে কেটে গেলো বোঝাই গেলো না, স্যার এর গল্পো শুনতে শুনতে। বাইরে বৃষ্টিটা ও ধরে এসেছে।
“পরের দিন কিন্তু বেশিক্ষন পড়তে হবে, আজ অনেক আড্ডা হলো। বাড়ি যা আজ।”
একে একে সবাই বেড়িয়ে পড়লো। বাইরে দাড়িয়ে রণর সঙ্গে খানিক কথা বলে সোম সাইকেল এ উঠে পড়লো। রণ র বাড়ি উল্টো দিকে। বাইক স্টার্ট দিল রণ।
“কতটা জল জমলো গলির মুখটায় কে জানে।” ভাবতে ভাবতে মোড় ঘুরেই, “ঠিক যেমন ভাবা”। বেশ পায়ের পাতা ডোবা জল জমেছে, আরেকটু বেশিই হবে হয়ত।
“তবে সাইকেল এ আধা প্যাডেল করলে মনে হচ্ছে ভিজবে না।”
“আরে রাস্তার কোনায় দেবলীনা ও দাঁড়িয়ে যে। পা ভেজাবে কিনা ঠিক করছে হয়তো বা রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, যদি একটা আসে।”
“কিরে পা ভেজাবি কিনা ভাবছিস?” – দেবলীনার সঙ্গে কথা বলার সময় কেমন বুকটা ঢিপ ঢিপ করে। আনন্দ না দুঃখ না বুঝে ফেলার ভয়, কে জানে।
“হ্যাঁ রে, দ্যাখনা কতটা জল জমে গেলো।”
“জলটা পার করে দেবো? সাইকেলে বসতে পারবি?” সাহস করে বলেই ফেলল সোম। বুক ঢিপঢিপ টা বাড়ছে। “যদি না বলে দেয়!”
“দারুন হয়, থ্যাংকস রে।”
“পা টা একটু উঠিয়ে রাখিস।” উফ্ আনন্দ আর ধরছে না। দুহাতে শক্ত করে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে প্যাডেল এ চাপ দিল। “নিজের পা ভিজলে ভিজুক আজ, দেবলীনার পা যেন না ভেজে।” কি সুন্দর গন্ধ দেবলীনার। আরো কতকি ভেবে ফেলল সোম। পুজোর চারদিনের প্ল্যানটা ও করে নিল বোধয়। ভাবতে ভাবতেই জল জমা রাস্তাটা পেরিয়ে এলো দুজনে। পাশ করে সাইকেল থামালো সোম। আবার ছোট্ট থ্যাংকস জানিয়ে, রাস্তা পেরিয়ে হাঁটতে থাকলো দেবলীনা।
“ধুর, কিসসু হবে না আমায় দিয়ে, একটু সাইকেল চড়িয়েই, কত কি ভেবে নিলাম।” নিজেকে আরো কিছু গাল দিল সোম। “আবির, রূপকের বাইক এ তো কতবার চড়েছে।” একটু আগের আনন্দটা কেমন মন খারাপে বদলে গেলো।
আজ স্যার এর ক্লাস ফুল হাউস। আবির, রূপক দেবলীনার পাশে বসে ছুতো খুঁজছে, কথা বলার, স্যারের পোড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে। আজ কোনি শেষ না করে ছাড়বেন না স্যার। আকাশটা আজও কালো করে এসেছিল। দু এক পশলা পড়েছে, এখনও টিপটিপ পড়ছে বোধয়। সোম ভাবছে, “আজও যদি দেবলীনা কে লিফ্ট দেওয়া যায়। আরেকটু জোরে পড় না বৃষ্টিটা। ওহ, আজ তো আবির রূপক ও আছে। ধুর!” আবার দমে গেলো সোম।
ক্লাস শেষে রনর সঙ্গে পাঁচ দশ মিনিট কম করে হলেও আড্ডা দেয় সোম। কথা বলতে বলতে আড় চোখে দেখে নিল, দেবলীনা বোধয় বাইক এ যেতে রাজি হলনা। মিনিট দশ পর আবির, রূপক বেড়িয়ে গেলো বাইক চালিয়ে। দেবলীনা ও হাঁটা লাগলো। একটু যেন খুশিই হলো সোম। তারপরেই ভাবলো “ধুর, এত আনন্দের কি আছে এতে, আমার সঙ্গে তো আর গেলো না।” বৃষ্টি পড়ছে ছিটেফোঁটা। দারুন লাগে সোম এর বৃষ্টির গন্ধ। রণোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বুক ভরে বৃষ্টির গন্ধ নিল সোম।
সাইকেলের প্যাডেল এ চাপ দিয়েই আবার ভাবলো, “ইশ, মনে হয় না আজ জল জমার মত বৃষ্টি হয়ে ছে, যদি…. উফ্” মনটাকে আবার বকা দিল সোম। “কত যদি ভাববি তুই।” গাল দিল আবার নিজেকে।
“সোম”, দেবলীনার গলা শুনে ব্রেক কষল সোম। মোড়ে র ঠিক আগেই দাড়িয়ে দেবলীনা।
“হ্যাঁ রে বল।”
“দ্যাখনা আজও রাস্তায় জল জমেছে, তোকে দেখলাম রণ র সঙ্গে কথা বলছিলি, তাই ভাবলাম দাড়িয়েই যাই। ছেড়ে দে না জলটা পার করে।”
“একদম, একদম, আয়” – আনন্দে সোম এর গলাটা যেন আটকে এলো।
সাইকেলে বসিয়ে, মোড় ঘুরতেই সোম অবাক। ” আরে রাস্তায় জল কোথায়!!”
সাইকেল এর সামনে বসে দেবলীনা ফিক ফিক করে হাসছে। আজ আর থামবে না সাইকেল।