প্রথম্ অধ্য

ওইটুকু একটা বাচ্চা, ব​য়স ব​ড়জোর তিন – সাড়ে তিন হবে, ছোট ছোট পায়ে সারা প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হোঁচট খেয়ে প​ড়ছে, আবার উঠে দাড়িয়ে “মা” “মা” করে মহিলাদের আঁচল ধরে দাড়িয়ে যাচ্ছে। কেউ মজা দেখছে, কেউ বা আহা! উহু! করছে কিন্তু তার মা খোঁজার বিরাম নেই, কান্নারও বিরাম নেই। যতদুর মনে হ​য় বাচ্চাটিকে কেউ এখানে ছেড়ে চলে গেছে।তার মা যে ধারে কাছে কোথাও নেই, সেতো বোঝাই যাচ্ছে। উপস্থিত ভদ্রমহিলারা সবাই তাকে লক্ষ ঠিকই করছে কিন্তু কাছে এলেই তারা এড়িয়ে যাচ্ছিল​। দু একজন তো “আপদ বালাই” “ভিখারির বাচ্চা” এসব বলে তাকে তো গালাগালি-ই দিচ্ছিল​। তার তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই কারন সেসব বোঝার মত তার ব​য়স্, বোধ বা সম​য় নেই বলা যেতে পারে। তার যে শুধু মা চাই, প্রম ভরসার জায়গা চাই। কোথায় গেল তার মা, কে সেই হতভাগিনী যে এই নিষ্পাপ ফুলের মত শিশুটিকে এমন এক অমাতৃক পরিবেশে ফেলে গেছে। জবাব দেবার ও কেউ নেই, জবাব শোনার ও কেউ নেই।  সকলের চোখের আড়ালে কিন্তু এক্জন মনে হ​য় কেউ ছিলেন যিনি এই হতভাগ্য শিশুটির হৃদ​য়ের ব্যাথা অনুভব করেছিলেন্।

ট্রেন স্টেশনে ঢুক্ছে, সকলের হুটোপুটির মাঝে একজনের কিন্তু চোখে প​ড়ে গেল যে একটা ছোট্ট বাচ্চা কারো ধাক্কা খেয়ে প্ল্যাট্ফর্মে প​ড়ে কাঁদছে।  তিনি দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলেন্। কি যেন এক অদ্ভুত কান্ড ঘটে গেল সকলের চোখের আড়ালে। বাচ্চাটি কান্না ভুলে তার দুটি কচি কচি নোংরামাখা হাত দিয়ে মায়ের মুখে হাত বোলাতে থাকল। মায়ের স্পর্শ মনে হ​য় এমনই ম্যাজিক তৈরি করে। আধো আধো বোলে বাচ্চাটি যেই তাকে”মা” “মা” ডাক্তে লাগল​. সেই ভদ্রমহিলা তাকে বুকে চেপে ধরে চোখের জলে ভাসতে থাকলেন্। দু চার জন অতি উৎসুক ব্যাক্তি ওই সুবেশা গৃহবধূর কোলে নোংরা বাচ্চাটাকে আদর খেতে দেখে হতবাক হয়ে রইল​।  তার পাট করা শাড়ীতে বাচ্চাটির ক্লেদাক্ত শরীরের কাদার দাগ কিন্তু তার কোন অনূযোগ নেই আর বাচ্চাটির মুখেও স্বর্গীয় হাসি – সে মা পেয়ে গেছে।

“তোমার কি ব্যাপার বল তো! এই নোংরা বাচ্চাটিকে নিয়ে আদিখ্যেতা করছো। একটা ট্রেন বেরিয়ে গেল​, পরেরটা এক ঘন্টা পর আসবে, ছাড় এই নোংরা বাচ্চাটাকে, কার না কার পাপ এটা” কথাগুলি ভদ্রমহিলার স্বামীর মুখ থেকে ঝরছিল কিন্তু মহিলা মোটেও বিরক্ত নন্। তিনি হাসিমুখেই বললেন “দেখনা! এ তো আমাকেই ওর মা ভাবছে, একটু অপেক্ষাই না হ​য় করি, ওর মা এলে তার কাছে দিয়েই আমরা চলে যাব​”  ভদ্রলোক রাগে গজ গজ করতে করতে সিগারেট ফুঁকতে থাকলেন্। মহিলা নিজের রুমাল ভিজিয়ে বাচ্চাটির চোখ্, মুখ্, হাত সব মুছিয়ে দিলেন্। বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে তার চোখে জল এসে গেল ” তুই কেন আমার ছেলে হলি না বাবা” ভগবান্, আমি তো জীবনে জ্ঞানত কারো কোন ক্ষতি করিনি, তবে কেন আমার কোল শুন্য রাখলে! এমন অনেক কথাই তার মনে ঘুরপাক খেতে থাকল​। সিনেমার অদৃশ্য পরিচালক কিন্তু অন্যরকম পরিকল্পনা করেছিলেন্।

আরো দুটো ট্রেন বেরিয়ে গেল​, মহিলার কোন হুশ নেই। দোকান থেকে গরম দুধ বিস্কুট সহযোগে বাচ্চাটিকে খাওয়ালেন্, গামছা, সাবান কিনে তাকে স্নান ও করালেন আর দকান থেকে সুন্দর নরম জামা প্যান্ট কিনে তাকে পরিয়ে সারা প্ল্যাটফর্মে তাকে নিযে খেলা করলেন, বাড়ী ফেরার কথা তার মনেই প​ড়ল না। তিনি এক ঘোরের মধ্যে ছিলেন, সম্বিত ফিরল যখন তার স্বামী তার হাত ধরে টানতে টানতে তাকে এক্গাদা লোকের সামনে অভব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে দিল​।  পরিস্থিতির আঁচ মনে হয় কোলের বাচ্চাটিও টের পেয়ে গেছিল​, সে দুহাতে শক্ত করে মাকে জ​ড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিল​।  সন্ধ্যা হ​য়ে এল​, ব্যাথিত হৃদ​য় নিয়ে এক মা গেল রেলপুলিশের কাছে কোন সুব্যাবস্থার আশায়্।  তার পরিষ্কার জানিয়ে দিল যে তাদের কিছু করার নেই। তিনি যেন লোকাল থানায় বাচ্চাটিকে জমা করে আসেন, যা করার ওরাই করবে।  ভদ্রমহিলার স্বামী বিরক্ত ও উত্তেজিত হ​য়ে কিছ বলতেই তিনি তার চোখের দিকে তাকে ঠান্ডা গলায় বললেন ” তুমি বাড়ী চলে যাও, ন​য়তো আমার দিদির বাড়ীতে গিয়ে থাকতে পার​।  আমি এর কোন ব্যাবস্থা না করে বাড়ী ফিরব না” স্বামীর উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি একটা অটো ডেকে থানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন্।

থানায় অফিসারের কাছে সব কথা খুলে বললেন তিনি আর বুঝে গেলেন সবাই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চায়্। একজন তো আবার পরামর্শ দিল যে বাচ্চাটিকে কোন অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিতে।ওদিকে পুঁচকেটাতো মহা খুশি, মা পেয়ে গেছে সে, মার কোলে চ​ড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে খিল খিল করে হাসে আর মায়ের মুখে মাথায় হাত বোলায়্।  কি করে তিনি এই শিশুটির জীবন তিনি নষ্ট করেন। মন খারাপ করে তিনি থানা থেকে বেরোচ্ছিলেন, মুখোমুখি হ​য়ে গেলেন থানার ব​ড়বাবুর সাথে। তিনি তার টহল সেরে ফিরলেন, গেটে দাড়ানো কনষ্টেবলের কাছে মহিলার থানায় আসার কারন জেনে তিনি নিজেই ডাকলেন “দিদি আপনি আমার সাথে আসুন্” । একটু অন্যধারার পুলিশ অফিসার এই অর্নব সাহা। অচেনা সেই মহিলাকে দিদি দাকলেন আবার চা এনে খাওয়ালেন। মুখে তার মৃদু হাসি ” কি দিদি, বাচ্চাটিকে আপন করতে মন চাইছে তো? যাও নিয়ে যাও, বাচ্চাটার ভবিষ্যত ভাল হবে আর আপনার মনোবাঞ্ছা ও পূরন হবে। অনাথ আশ্রমের জীবন আমি জানি গো দিদি, তুমি যদি সত্যি বাচ্চাটিকে নিজের ছেলে হিসাবে মানো, নিয়ে যাও ওকে। আপনার ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে যান যদি দরকার প​ড়ে যোগাযোগ করে নেব​।” তিনি কনষ্টেবলকে ডেকে এক্টা বাচ্চা হারানোর রিপোর্ট বানাতে বললেন। মহিলা সেই অফিসারকে একান্তে ডেকে হাসলেন ” দাদা, এই ঠিকানা আর ফোন নম্বর শুধু আপনার জন্য, আর কাউকে দেবেন না কিন্তু” “সে সব আমি বুঝে গেছি দিদি, এক্দিন আমার মাকে নিয়ে আপনার বাড়ীতে যাব​, এ বাচ্চাটির মত আমিও ভাগ্যবান ছিলাম্।

ঝর্না মাইতি, স্টেট ব্যাঙ্কের কর্মচারি, আদি বাড়ী মেদিনিপুর্, বর্ত্তমানে তিনি কলকাতা এয়ারপোর্টের কাছে বাগুইহাটির এক ফ্ল্যাটে থাকেন​। বিয়ের সাত বাছর পরও তিনি নিঃসন্তান্। তার শিক্ষিত​, মার্জিত আর কর্মী হৃদ​য়ে “মা” ডাক শোনার তীব্র আকাঙ্খা। যতরকমের চিকিৎসা আছে, টেষ্ট আছে করানো হ​য়ে গেছে। কোন ডাক্তার ই বলেনি যে তার বা তার স্বামীর মধ্যে সন্তান না হবার মত কোন অসুবিধা আছে। তবুও তিনি সন্তানহীনা। সাহেব মাইতির সামান্য সমস্যা আছে সে শুধু তিনি-ই জানেন, দুঃখ পাবে বলে স্ত্রীকে কখনো জানাননি। তিনি ইনজিনিয়ার এবং ব​ড় ব্যাস্ত মানুষ তবে স্ত্রীকে প্রানাধিক ভালবাসেন্। প্রথম প্রথম অপছন্দ হলেও স্ত্রীর পছন্দকে তিনি মেনে নিলেন্।”মা” ডাক শুনে তার স্ত্রীর উচ্ছল উজ্বল মুখ দেখে তিনিও ধীরে ধীরে নিজেকে সমীর মাইতির বাবা-ই ভাব্তে থাকলেন। তার সমস্ত রাগ বিরক্তি কেটে গেল যেদিন তিনি প্রথম “বা-বা” ডাক শুনলেন্। ছ​য় মাস পর সেদিনই ছেলেকে জ​ড়িয়ে ধরে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন। সেদিন অফিস থেকে ফেরার সম​য় নানা রকম খেলনা আর একটা দোল্না নিয়ে এলেন । খুশীতে ভরে গেল তাদের সংসার্।

একটা নাটকের সব হিসাব এত তাড়াতাড়ি মিলে যাবে ভগবান ও মনে হ​য় চাইছিলেন না।  তিনি সব চরিত্রগুলিকে আরো কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে  হ​য়তো গ​ড়ে পিটে নিখাদ বানাতে চাইছিলেন্। তেত্রিশ বছর ব​য়সে ঝর্না দেবী গর্ভবতী হলেন এবং একটি ফুট্ফুটে সুস্থসবল কন্যা সন্তানের জান্ম দিলেন্। সমুর তো আনন্দের সীমা নেই, দৌড়ে মায়ের কাছে যায়্, বোনকে মাকে চুমু খায় আর বাবার কোলে গিয়ে বসে। সে এখন দাদা, ক্লাস ওয়ানে ভর্ত্তি হ​য়েছে এবছরই। সে তো অখন থেকেই চিন্তায় মগ্ন তার বোনকে নিয়ে কবে স্কুলে যাবে সে “এই বোন তাড়াতাড়ি ব​ড় হ​য়ে যাতো! তোর সাথে আমি ছাড়া খেলবে কে!” ঝর্নাদেবী তো হেসেই বাঁচেন না। তার মা এখন তার বাড়ীতে এসে র​য়েছেন, ঝর্না বেশ বোঝে যে ছেলেটাকে তার মা সেরকম সহ্য করতে পারেন না। মেয়ের বয়স একবছর হতে হতে এও বুঝে গেলেন যে তার স্বামীও কেমন যেন পাল্টে গেছে, তার সবকিছু কেমন যেন মেয়ে কেন্দ্রিক্, ছেলেটার উপস্থিতি কেমন যেন তিনি ঠিক মেনে নিতে পারছেন না।  ছেলের অসহায়তা উপলব্ধি করে তিনি আরো বেশি করে ছেলেকে আক​ড়ে ধরতে থাকলেন্। তার ছেলে অর মেয়ে তার দুচোখের তারা হ​য়েই থাকে।

সমু যত ব​ড় হতে থাকল, মা বেশ বুঝতে পারলেন  তার সমুর জীবন থেকে ধীরে ধীরে বাবার ছায়া সরে যাচ্ছে। মীরার পঞ্চম জন্মদিনের জাঁকজমকের সম​য় যখন বাবার চ​ড় খেয়ে সমু বারান্দার সিঁড়িতে বসে কাঁদ্ছিল​, ঝর্নাদেবী বুঝে গেলেন এবার তাকেই কিছু একটা করতে হবে। দশ বছরের নিষ্পাপ মনটা তো বুঝতেই পারছিল না, তার বাবা তার প্রতি কেন এত বিরুপ আর কেনই বা সে চ​ড়টা খেল​। সেতো কখনো বাবা মায়ের অবাধ্য হ​য় নি।কেক কাটার পর কুট্টি তাকে কেকের একটা টুকরো খাওয়াতে গেছিল তখনই জোর থাপ্প​ড়টা তার গালে আছ​ড়ে প​ড়ে।  সে কিছুটা শান্তি পায় যখন তার আদরের বোনটি এসে তাকে কেক খাইয়ে দেয় তার্পর তার হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে তার বন্ধুদের সাথে তার পরিচ​য় করিয়ে দেয় “আমার দাদা, আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড্”। তবুও সমুর মনটা খুবই উদাস্, সে আবার বারান্দার দিকে চলে যায়। এত লোক্জনের মাঝে তার সমুকে দেখতে না পেয়ে মায়ের বুকটা ধ​ড়াস করে উঠলো। তিনি দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখলেন তার অভিমানি ছেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, দু চোখে তার জলের ধারা। তিনি ছেলেকে জ​ড়িএ ধরে কেঁদে ফেললেন “তোর মা তো এখনো মরে যায় নি বাবা, তুই এভাবে থাকলে তোর মা কিন্তু সত্যি সত্যি মরে যাবে”  সমু সব সহ্য করতে পারে কিন্তু মায়ের কষ্ট সে মোটেও সহ্য করতে পারেনা। সে প্রকৃতিস্থ হয়ে মাকে জ​ড়িয়ে ধরল​, তার চোখের জল মুছিয়ে দিল “ইশ্! আমাকে ছেড়ে চলে যেতে দেব নাকি তোমাকে! দাড়াও ব​ড় হই আমি, কুট্টি আর তোমার সব দায়িত্ব আমার্” ঝর্নাদেবী হেসে ফেললেন ” তুই আগে ব​ড় তো হ্, মন দিয়ে প​ড়াশুনা কর  আর যা করবি একদম মন প্রান দিয়ে করবি, মা সবসম​য় তোর পাশে থাকবে”

ঝর্না বেশ বুঝে গেছে যে মেযে হবার পর থেকে তার স্বামী সমুকে মোটেও নিজের ছেলে ভাব্ছে না। তার নিজের মা আর ননদ এব্যাপারে ক্রমাগত কান ভারি করে চলেছে। সে তো ভেবেই পায় না এমন ভাল ছেলেকে কিভাঅবে তারা না ভালবেসে থাকতে পারে।তিনি গর্ভে হ​য়তো ধারন করেননি কিন্তু তার তো কখনোই মনে আসে না যে সমু তার ছেলে ন​য়্। সমুকে না দেখতে পেলে তার ভাল লাগে না, স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে তার কান্না পেয়ে যায় আর কুট্টিটা তো দাদা পাগল্। “মা দাদা ফিরছে না কেন্, আর কিন্তু খুব বকে দেবে” তারপর দাদা প​ড়ে ফিরলে চল্বে মান অভিমানের পালা। বোনকে আদর করে, কান ধরে ক্ষমা চাওয়ার পর সে পালা হবে সমাপ্ত​। ঝর্না মনে মনে হেসেই ফেলে ” ঠাকুর, এমন সম্পর্ক যেন ওদের সারাজীবন থাকে” ণিজের মায়ের সাথে সম্পর্ক খারাপ, স্বামীর সাথেও তথৈবচ কিন্তু সে খুশি যে তার এমন ছেলে অর মেয়ে র​য়েছে।  স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এখন ফর্মালিটি মাত্র​। সে বাড়ী থাকলে যতদুর সম্ভব ছেলেকে সে স্বামীর থেকে দুরেই রাখে।  মনে মনে ভাবেন যে আজ যাকে সে দুরে ঠেলছে, অবজ্ঞা করছে, একদিন আসবে যখন ছেলের জন্য সে গর্ববোধ করবে। ছেলের প্রতি তার আস্থা আর বিশ্বাস অসীম।

ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠেছে সমু ক্লাসে তৃতীয় হয়ে।  মায়ের তো খুশীর অন্ত নেই। মায়ের হাতে রেজাল্টটা দিয়ে তার কোলে মুখ গুঁজে দিল সমু “মা, সাম্নের বছর দেখবে আরো ভাল রেজাল্ট করব​, এবার ওই ইংরেজি আর ইতিহাসটা একটু খারাপ হ​য়ে গেল​” মা তাকে চুমু খেয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন ” তুই ফার্ষ্ট্, সেকেন্ড্, থার্ড যা-ই হোস না কেন বাবা, ও নিয়ে আমি ভাবি না।  অমি চাই আমার সমু এক সত্যিকারের পূরুষ মানুষ হোক্। লোকে যেন আমাকে দেখিয়ে বলে – ওই যে সমুর মা যাচ্ছে” সমু উঠে বসে মায়ের গলা জ​ড়িয়ে ধরে “ধুর! মা, তুমি শুধু উল্টপাল্টা কথা বলো, তুমি সারা জীবন ধরে শুধু সমুর মা আর কুট্টির মা”  হঠাৎ ঝর্নার মনে হল সমুর রেজাল্ট দেখলে হ​য়্ত তার বাবা খুশী হবে “এই সমু যা, বাবাকে রেজাল্ট দেখিয়ে আয়্” সমু দৌড়ে বাবার ঘরে গিয়ে দেখল তিনি কুট্টিকে চকলেট দিচ্ছেন্। সমু কাছে গিয়ে দাড়াতেও তিনি না দেখার ভান করলেন্। “বাবা, দাদাকে কিন্তু এবার একটা ভালো গিফ্ট দিতে হবে, দাদা এবার থার্ড হয়েছে। বাব্বা! কত্ত নম্বর পেয়েছে!” দুরে দাড়িয়ে ঝর্না তার স্বামীর এই অদ্ভুত আচরন লক্ষ করছিল্। সমু বাবার হাতে রেজাল্ট দিতেই তিনি সেটা দলামোচা করে ছুড়ে ফেলে দিলেন “ওই নম্বর সবাই পায়্” সমু ডুকরে কেঁদে দৌড়ে বাইরে চলে গেল​। কুট্টিও দৌড়াল দাদার পিছু পিছু, বাবার ঐ আচরন তার ও ভাল লাগে নি।  হোক না সে ক্লাস থ্রিতে প​ড়া একটা মেয়ে, বাবার থেকে দাদাই তার প্রিয়্। ঝর্নাদেবী আর সহ্য করতে পারলেন না, সোজা গিয়ে দাড়ালেন তার স্বামীর মুখোমুখি “শোনো, আমি তোমার       প​য়্সায় খাইও না আর পরোয়াও করিনা।  তুমি তো আর মানুষ নেই, একটা অনূভুতিশুন্য পশু হ​য়ে উঠেছ​। ছেলেটা পাশের খবরটা দিতে এল আর এমন ছোটলোকের মত আচরন করলে তার সাথে! মেয়েটাও সহ্য করতে পারল না। অনেক হ​য়েছে, তোমার মত মানুষের সাথে আমি আর সংসার করতে পারব না। হ​য় তুমি এ বাড়ী ছাড়​, ন​য়তো আমি ছেলে মেয়ে নিয়ে এ বাড়ী ছাড়ব​”  সাহেব মাইতি কঠিন চোখ নিয়ে উঠে দাড়াল আর ধীরে ধীরে তার শোবার ঘরে ঢুকে প​ড়ল​। ঝর্না বাইরে গিয়ে যা দেখলেন তাতে তার ভারাক্রান্ত হৃদ​য় ও প্রজাপতির মত ডানা মেলে উড়তে লাগলো। কুট্টি দাদার গলা জ​ড়িয়ে ধরে তার চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে কিন্তু তার চোখেও জল “বাবার কথা ভুলে যা দাদা, মা কত খুশী হ​য়েছে দেখেছিস্! আমি তো আমার সব বন্ধুদের বলেছি তোর কথা, কত্ত নম্বর পেয়েছিস্! কি দারুন ফুটবল খেলে আমার দাদা” ঝর্না সজল চক্ষে দুজনকে দুহাতে বুকে টেনে নিলেন ” আমার দুটো হীরের টুকরো তোরা দুটো। তোরা থাকতে আমার কিসের চিন্তা রে!”

পরদিন স্কুল থেকে ফিরে কুট্টিকে খাইয়ে ফুটবল নিয়ে মাঠে দৌড় লাগাল সমু। কুট্টির দলবল এখন ব্যাস্ত হ​য়ে প​ড়বে তাদের কমপ্লেক্সের মাঠে, ওদের হাজার রকমের খেলা।সমু নিশ্চিন্ত থাকে কারন রাধা মাসি আছে, মায়ের প্রিয় বান্ধ্ববী, বোনের পাহারাদার। সেজন্য খেলায় মন দিতে পারে।   মা ছটার সম​য় ফেরে সেজন্য সমু পৌনে ছটার মধ্যে কুট্টিকে নিয়ে বাড়ী ফেরে। আজ বাড়ী ফিরে সমুর বেশ অদ্ভুত লাগল​, এরকম দেখতে সে তো অভ্যস্ত ন​য়্। মা দরজার সামনে চুপ করে বসে আছেন্, মনে হল চোখে তার জল​। সে বলটা ছুড়ে জুতো রাখার যায়্গায় পাঠিয়ে দিল​, মায়ের কপালে হাত দিয়ে দেখল “নাঃ জ্বর তো আসেনি” “ওমা, তুমি এমন করে বসে আছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে? বাবা বকেছে?” ঝর্নাদেবী তো বুঝেই উঠতে পারছেন না কি বলবেন তার ছেলেটাকে। যদি সে জিজ্ঞাসা করে  তার বাবা কেন বাড়ী ছেড়ে চলে গেল​, মরে গেলেও সে সমুকে কারনটা বলতে পারবেন না, ছেলে যে তার প্রান্। তুচ্ছ কারনে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে, এটা খুবই দুর্ভাগ্যের্, অসন্মানের কিন্তু তার মন আরো বেশি ব্যাথিত তার ছেলে মেয়ের জন্য, বাবা থাকতেও তারা পিতৃহীন থাকবে! ছেলেকে জ​ড়িয়ে ধরে তিনি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন “তোদের বাবা আমাদের ফেলে রেখে চলে গেছে, কোথায় গেছে তাও কিছু জানিয়ে যায়নি” কুট্টি এসে তাদের কান্নার দলে যোগ দিল। ঝর্না দুহাতে ছেলে মেয়েকে জ​ড়িয়ে ধরে কাঁদতেই থাকলেন্। সমু কাঁদ্ছিল কারন তার মা কষ্ট পাচ্ছেন্, কুট্টি কাঁদছিল কারন তার দাদা খুব দুঃখি।  সমু নিজের চোখের জল মুছে নিল​, মা আর বোনের চোখের জল মুছিয়ে দিল আর জোর করে হেসে বলল “মা, দেখবে বাবা আবার ফিরে আসবে। আমি না হ​য় একটা পচা ছেলে, কত্ত সুন্দর আমার বোন আর আমার মা তো সুন্দরী, পৃথিবীর সব থেকে ভাল মা, বাবা কখনোই তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে না।  বাবা এলে আমি কান ধরে ক্ষমা চেয়ে নেব​, আর মা তুমি কিন্তু বাবাকে বকবে না। আমাকে যদি মারে মারুক্, আমি একটুও কষ্ট পাব না” ঝর্না ছেলেকে শক্ত করে জ​ড়িএ ধরলেন “তুই আমার সোনা ছেলে, তোকে কেউ মারুক না, ঠ্যাং ভেঙে দেব তার্” কিন্তু তার মন বলছিল – এতটুকু একটা বাচ্চা ছেলে সব বুঝতে পেরেছে, আর সমাধানও একটা বের করে নিয়েছে। হতভাগা লোকটি বুঝতেও চাইল না, কি জিনিষ হাতে পেয়েও সে হারাল​।  অনেক ব​ড় হবে আমার ছেলে,  আর এর জন্যই তোমার গর্ব বোধ হবে।

আজ একবছর হ​য়ে গেল লোকটার কোন খবর নেই, কোন ফোন কল ও সে করেনি। মাঝে মাঝে সন্ধেবেলায় ছেলে মেয়ে দুটোকে নিয়ে যখন বেড়াতে বেরোন্, খুব্-ই কষ্ট লাগে তার, যখন দেখেন যে মা-বাবার সাথে বাচ্চারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।  তার নিজস্ব অপ্রাপ্তির বেদনা তো আছেই কিন্তু তার সন্তানদের জন্যই তার কষ্ট বেশি হ​য়্। অবশ্য এখন স্বামীকে নিয়ে তার বসে ভাবার সম​য় নেই। সকালে তিনজনের টিফিন তৈরি করা, দুটোকে স্কুলে পাঠানো তারপর দৌড় অফিসের দিকে।  সাড়ে পাঁচটায় ছুটির পর ভাবতে ভাবতে আসা – কি করছে ছেলে মেয়ে দুটো কে জানে।তবে একটা ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্তই থাকেন , তার সমু ঘরে  আছে, কুট্টির জন্য তার চিন্তা নেই।দুদিন পর সমুর রেজাল্ট বেরবে কিন্তু তার ওসবে হুশ নেই, সে ফুটবল পেলে সব ভুলে যায়্। কুট্টির কাছ থেকে তিনি রিপোর্ট পান যে তার দাদা দারুন ফুটবল খেলে। কুট্টিটা হ​য়েছে অদ্ভুত রকমের দাদা ভক্ত​, এমন তো এখন দেখাই যায় না। ক্লাস ফাইভে উঠে চার পাঁচ জন দিদিমনি আর মাষ্টারের কাছে প​ড়ে সে বিরক্ত​, কিছুই শেখে না সে।  একদিন নিজেই মাকে জানিয়ে দিল “মা, আমি বাইরের কারো কাছে প​ড়ব না, দাদার কাছেই প​ড়ব​”  বোনের আব্দার বলে কথা, দাদা কি আর না করতে পারে! নিজের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চলে তার বোনকে প​ড়ানো।  ঝর্নাদেবীর মনে হল ছেলের উপর চাপ প​ড়ছে, তাই একদিন বলেই ফেললেন “হ্যারে সমু, তুই ক্লাস নাইনে প​ড়িস্, তোর কত প​ড়ার চাপ্, বোনকে   তুই সামলাতে পারবিতো, তুই যে আমার ভবিষ্যত বাবা!”  “কি যে বল মা, এবার দেখবে বোন খুব ভাল রেজাল্ট করবে, আর তোমার আশির্বাদ তো আমার উপর র​য়েছে, তোমার সন্মান আমি রাখবই রাখব​”

ঝর্নাদেবী দুদিন ছুটি নিয়েছেন্, তার সমু আর কুট্টির রেজাল্ট বেরবে। সমু ভাল রেজাল্ট করবে তিনি দৃঢ় বিশ্বাস করেন কিন্তু কুট্টিটা একটু কমজোরি।  সমু যদিও আশ্বাস দিয়েছে যে কুট্টিকে নিয়ে চিন্তা করার আর দরকার নেই। সমু সব বিষ​য় প​ড়িয়েছে তাকে, তবে তো বিশ্বাস রাখতেই হ​য় । কুট্টিটা তো অনেকবারই তাকে বলেছে ” ইশ্! অঙ্কটা কি কঠিন মনে হোত মা, দাদা আমার মাথার গোবর সব সাফ করে অঙ্কের বীজ পুঁতে দিয়েছে, এখন সব জল্-ভাত লাগে” ঝর্না স্কুলের অন্যান্য গার্জেনদের সাথে সেভাবে মেশেন না। তার তার স্বামীর প্রসঙ্গ তুলে তাকে বিব্রত করে। তারা তাকে অহংকারি, চাকরির গুমর এসব ভাবে। কিন্তু ওসব নিয়ে সে ভাবেই না। তার যত চিন্তা তার ছেলে মেয়ে নিয়ে।  মা বোনের সাথেও তার যোগাযোগ বন্ধ​, এক ননদ এই উল্টোডাঙায় ই থাকে, তার সাথেও সম্পর্ক নেই। এরা সবাই সমুর শত্রু, তার ও শত্রু। তবে এক্জন মিত্র আছে, পুলিশ অফিসার অর্নব সাহা। সমু আর কুট্টি তাকেই মামা হিসাবে জানে ও মানে। গতবছর  ছেলে মেয়ের রেজাল্ট বেরোনর পর তাদের মামাবাড়ী নিয়ে গেছিলেন্। তারাও দুবার ঘুরে গেছে ঝর্নার বাড়ী। ফোনে খুব কথা হ​য় তাদের সাথে, আজ সকালেও সমুর মামী ফোন করেছিল রেজাল্ট জানার জন্য্। এই দাদা বৌদি-ই শুধু জানে সমুর বিষ​য়ে। তিনিও ঠিক করে রেখেছেন সুযোগ বুঝে তিনি-ই সমুকে সব জানিয়ে দেবেন্। কিন্তু তার সর্বদা ভ​য় হ​য়্, সমু যদি তাকে ছেড়ে চলে যায়। সমু আর কুট্টি তার জীবন্, তার বর্ত্তমান্, তার ভবিষ্যত্। পুজো কর্তে বসে মাঝে মাঝেই তিনি কেঁদে ফেলেন “ঠাকুর্, তোমার দেওয়া রত্ন দুটিকে আমি যেন রক্ষা করতে পারি”

স্কুলের গেটের সামনে কুট্টি তার মায়ের সাথে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে।  মায়ের যে দাদাকে নিয়ে টেন্শন সেটা সে বুঝতে পারছে কিন্তু তার টেন্শন অন্য কারনে – কত ছেলে তো রেজাল্ট নিয়ে বেরিয়ে প​ড়েছে, তার দাদা কেন এখনো বেরচ্ছে না “ও মা, তুমি যাও না ভেতরে, সব মায়েরা তো ভেতরে র​য়েছে, দাদাটা  যে কেন এখনো আসছে না!” ঝর্না মেয়ের হাত ধরে স্কুলের ভেতরে ঢুকে প​ড়ল​। সমু ঠিক মাকে দেখতে পেয়েছে “মা, আমি এখানে” হাত তুলে সে চেঁচিয়ে বলল​।  মায়ের আগে কুট্টি দৌড়ে গেল দাদার কাছে “মা কত চিন্তা করছে, আর তুই এখানে বসে আছিস্! চল বাড়ী চল্” সমু বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পাশে বসে থাকা মহিলাকে বলল ” কাকিমা, এই হল আমার বোন কুট্টি, আমার গার্জেন্” কুট্টি লজ্জা পেয়ে মায়ের কাছে ছুট লাগাল​।  ঝর্না মাইতি দেখলেন তার সমু কত ব​ড় হয়ে গেছে। মুখ নীচু করে বসে থাকা তার ক্লাসমেটের মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে “সেকেন্ড হয়েছিস তো কি হ​য়েছে, হাল ছাড়বি না, দেখবি সামনের বছর আবার তুই-ই ফার্ষ্ট হবি। কাকিমা তুমি কিন্তু সন্দীপ কে কিছু বোলোনা। দেখ বোকা, মায়ের আশীর্বাদ থাকলে, জীবনে তুই উন্নতি করবি-ই করবি”  মা কাছে আসতেই আবার সে সেই ছোট্ট সমু হ​য়ে গেল​, মাকে জ​ড়িয়ে ধরে তার হাতে রেজাল্ট ধরিয়ে দিল​। রেজাল্ট দেখে ঝর্নার দুচোখে অশ্রুধারা। কুট্টি মার হাত থেকে রেজাল্ট নিয়ে সারা স্কুল মাত করে দিল​। ঝর্নাদেবী চোখের জল মুছে, সেই অচেনা মহিলার হাত ধরে বললেন : দেখ বোন, ফার্ষ্ট সেকেন্ড দিয়ে কিচ্ছু হ​য় না, আমার সমু যদি  সাধারন পাশও করত আমি এভাবেই থাকতাম্। ছেলেকে উৎসাহ দাও, সবসম​য় পাশে থাক​, ভাল মানুষ হতে শেখাও, ও সবাইকে ছাপিয়ে যাবে”

পরদিন কুট্টির রেজাল্ট্। সেই আগের দিনের মতই দৃশ্য, শুধু মায়ের পাশের চরিত্রটির বদল হ​য়েছে। মা গভীর টেন্শনে আচ্ছন্ন, কুট্টি বেরোচ্ছে না। সমু মায়ের হাত ধরে স্কুলের ভেতরে ঢুকে প​ড়ল​। কুট্টির ক্লাসে সে নেই, মায়ের বুকটা ধ​ড়াস করে উঠল​। তিনি ছেলেকে নিয়ে সোজা ঢুকে প​ড়লেন হেডমিস্ট্রেসের ঘরে আর কুট্টিকে দেখলেন তার পাশে বসে থাকতে। তিনি ভেবেই নিলেন তার মেয়ে নির্ঘাত ফেল করেছে। তিনি ডেকেই ফেললেন “কুট্টি….” মায়ের গলা শুনে সে সোজা দৌড়ে এসে মাকে জ​ড়িয়ে ধরল,  আর তার প্রথম প্রশ্ন “মা দাদা আসেনি?” “দাদা আছে বাইরে, তুই পাশ করেছিস তো? মেয়ের উত্তর পাবার আগেই দিদিমনি হাসতে হাসতে তার পাশে এসে রেজাল্ট তার হাতে ধরিয়ে দিল “কি এত চিন্তা করছেন্, আপ্নার মেয়ে দুর্দান্ত ফল করেছে। আপনাকে অপেক্ষা করানোর জন্য দুখিঃত আমরা। আমরা অবাক হ​য়েছি ওর ভাব দেখে – রেজাল্ট পাবার পর “দাদা” বলে যা চেঁচিয়ে উঠল আপ্নার মেয়ে তাই কৌতুহল মেটানোর জন্য মীরাকে টিচার্স রুমে নিয়ে আসি। দাদার এত ভক্ত বোন আজ পর্যন্ত দেখিনি আমরা। এতক্ষন ধরে আমার দাদা এই, আমার দাদা ওই এসব্-ই চলছিল​। ঝর্নাদেবীর মুখে হাসি ফিরে এল​। তিনি ছেলেকে ভেতরে আনার জন্য দিদিমনির অনুমতি চাইলেন “হ্যা হ্যা মীরার মাষ্টারমশাইকে ত দেখতেই হবে। ওর প্রথম তিনটে সর্ট টেষ্টের ফলাফল দেখে আমরা তো বুঝতেই পারিনি যে মীরা ফার্ষ্ট হতে পারে, এনুয়ালে সব বিষ​য়েই তো ১০০ র কাছাকাছি নম্বর পেয়েছে, অঙ্কে পুরো ১০০। মীরার মুখে শুনলাম ওর দাদাই ওর গৃহশিক্ষক্” ঝর্নাদেবী আর সামলাতে পারলেন না নিজেকে, ঝর্-ঝর করে কেঁদে ফেললেন্। তারপর নিজেকে সামলে সমুর সাথে তাদের পরিচ​য় করিয়ে দিয়ে এও জানিয়ে দিলেন তার সমুও এবার ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠেছে ফার্ষ্ট হ​য়ে।

ঝর্না মাইতি আজ এত খুশী যে সে কি করবে বুঝেই উঠতে পারছিল না। সোজা অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিল যে তার ছেলে আর মেয়ে দুজনেই ক্লাসে প্রথম হ​য়েছে, কাল এসে সবাইকে বিরিয়ানি খাওয়াবে।তার পরম আত্মীয় দাদা, বৌদি, মাসিমাকে ফোন করে গতকাল রাতেই সমুর রেজাল্টের কথা জানিয়ে রেখেছিল আর নিমন্ত্রন করে দিয়েছিল​। তারা আসছে দূপুরের মধ্যেই, মহাখুশী তারা সমু আর কুট্টির খবরে। ওদিকে দুই ভাই বোনের কোন বিকার নেই,তারা মহাফূর্তিতে ভিডিও গেম নিয়ে মত্ত্। ঝর্না একবার আড়ি পেতে তাদের কথাবার্তাও শুনল ” দাদা তোর ইতিহাসটায় কিন্তু মাত্র ৮২ উঠেছে” দাদা কোনদিকে না তাকিয়ে ভিডিও গেমের বোতাম টিপতে থাকল “ছাড় তো নম্বর এর কথা, মা খুশী হ​য়েছে ওতেই হবে, তবে তুই যদি বলিস, সামনের বছর ৯০ এর উপরেই নম্বর থাকবে। তবে মা সব থেকে খুশী হ​য়েছে তুই ফার্ষ্ট হ​য়েছিস বলে, আমি তো খুশী হবই, তোর মাষ্টার বলে কথা” দুজনেই হেসে এ ওর গায়ে ঢলে প​ড়তে থাকে। তাদের কথা শুনে ঝর্নার গর্বে বুক ফুলে ওঠে। বেলা বারটার সম​য় অর্নব সাহা সপরিবারে হাজির্। বৌদি, মাসিমা অর ঝর্না মিলে রান্নাঘর সামলাতে লাগল আর চলল নিরবিচ্ছিন্ন বকবক্। সারা ঘরে দাপিয়ে খেলতে থাকল চার ভাই বোন আর সমুর মামা।  সারাদিন বাড়ীতে উৎসবের আমেজ। সারাজীবনে এত কথাও ঝর্না বলেনি আর এত আনন্দও সে উপভোগ করে নি। যাবার সম​য় মাসিমা ঝর্নাকে প্রানভরে আশীর্বাদ করে গেলেন “প্রান দিয়ে যদি ভালবাসতে পারিস তাহলে দেখবি তোর এই সমুই তোকে সবার থেকে বেশী চাইবে, বেশী ভালবাসবে।  আমার অনুটাকে দেখ্, এত ব​ড় হ​য়েছে, ব​ড় পুলিশ অফিসার তবুও আমাকে প্রান দিয়ে ভালবাসে, কখনো আমার অবাধ্য হ​য় না, তবে আমার বৌমাও অসাধারন্, তোকে তো নিজের ননদই ভাবে। আমার তো আত্মীয় স্বজন ছিলই না, কেমন আমরা আত্মীয় হ​য়ে গেলাম্”

জীবনের পরতে পরতে পুত্র কন্যা সুখ ভোগ করতে করতে কবে যে স্বামীহীন সাত সাতটি বছর কাটিয়ে ফেলেছেন ঝর্নাদেবী বুঝতেও পারেন নি। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপ্রাপ্তির বেদনা র​য়েই গেছে আর সেটাই তার হৃদ​য়ে মাঝে মধ্যেই আঘাত করে।  মাধ্যমিকে তো সমু ভাল রেজাল্ট করেইছিল কিন্তু উচ্চ্মাধ্যমিকে সে আরো ভাল​, দুর্দান্ত রেজাল্ট করল। ওদিকে কুট্টিও পিছিয়ে নেই।এক রবিবারের দুপুরে, চুপি চুপি সাহেবের ফটো বের করে ঝর্না কিছু বলছিল অর কাঁদ্ছিল​। সমুর চোখে ধরা প​ড়ে গেল “এই ছেলেকে আপন করতে পারলে না, দেখো তোমার নাম কেমন উজ্জ্বল করছে ছেলেটা। ফিরে এস গো, খুব অভাব বোধ করছি তোমার্…….” সমু অনেকবার বোঝার বা জানার চেষ্টা করেছে যে তার বাবা তার উপর এত বিরক্ত কেন আর কেনই বা তিনি সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন্। মায়ের উজাড় করা ভালোবাসা আর স্নেহের চাপে সে প্রশ্ন চাপাই ছিল এতদিন।  আজ প্রশ্নটা তাকে ব​ড় জোর ধাক্কা দিতে থাকল​। তার আর খেলায় বা প​ড়ায় মন নেই, কেমন যেন উদাস হ​য়ে থাকে।  মায়ের চোখে ঠিক ধরা প​ড়ে গেল​। সন্ধেবেলায় সমুকে জ​ড়িয়ে ধরে তার মা ঝর্-ঝর করে কাঁদ্তে থাকল​।  কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু কিছুই যেন আওয়াজ হ​য়ে বেরোচ্ছিল না। সমু পরম যত্নে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে তার দুগালে চুমু খেতেই ঝর্না তাকে আরো শক্ত করে জ​ড়িযে ধরে শুধু বলতে পারলেন “আমাকে কোনদিন ছেড়ে যাবি নাতো বাবা!” আর আবার কান্নায় ভেঙে প​ড়লেন্। “আমি সব কিছু সহ্য করতে পারি মা, কিন্তু তোমার কষ্ট্, তোমার চোখের জল আমি সহ্য করতে পারিনা। আমি জীবনে কখনই আমার এই মিষ্টি মা-টাকে ছেড়ে  যাব না” সমু বুঝে গেল তাকে নর্মাল থাকতে হবে, নাহলে মা কষ্ট পাবে, মায়ের চোখকে সে ফাঁকি দিতে পারবে না।  জ​য়েন্টের রেজাল্ট বেরতে অখনো অনেক দেরি, ইন্টার স্কুলের ফাইনালটা ও র​য়েছে। কুট্টিটাকে ভাল করে প​ড়াতে হবে, সে না প​ড়ালে সেতো প​ড়্তেই বসবে না। সমু মনে মনে হেসেই ফেলে, তার বোনটাও       হ​য়েছে সেরকম্, সবার থেকে আলাদা, সুপার বোন্, সুপার মায়ের মত​।

এর মধ্যে এক্দিন প্র্যাক্টিস ম্যাচে টোটোনের সাথে পরিচ​য় হল সমুর্। সে তো মমুর খেলায় মুগ্ধ আর কথায় কথায় যাখন সে জানতে পারল যে সমু বাগুইহাটি থাকে, সে তার মামীর সম্ব্ন্ধে অনেক বাজে কথা বলতে থাকল​। মামী নাকি কোথা থেকে একটা বেওয়ারিশ বাচ্চা এনে পুষছে আর এজন্য মামাকে বাড়ী থেকে  তাড়িয়ে দিয়েছে। আর এই কারনেই টোটোন আর তার মা বাবা মামীর সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।সমুর চোখের জল মনে ফেটে বেরোবে, মায়ের নামে উল্টপাল্টা কথা শুনে তার মাথাও গরম হযে যাচ্ছিল​, টোটোন কে এড়িয়ে সে ধীরে ধীরে একটা নির্জন যায়গায় গিয়ে বসল​।অতীতের সমস্ত ঘটনা পরম্পরা পর পর সাজিয়ে  সে পরিষ্কার বুঝে গেল যে তার মায়ের সাথে বাবা বা অন্যান্য আত্মিয়দের কোন সম্পর্ক নেই কারন তার প্রত্যেকেই ঝর্না মাইতির ছেলেকে ঘৃনা করে। সেদিন তার মা যে তাকে জ​ড়িয়ে ধরে কাঁদ্ছিল কারন মায়ের প্রতিপদে ভ​য়্, আসল পরিচ​য় জানলে যদি তার সমু তাকে ছেড়ে চলে যায়্। সমু এবার হেসে ফেলল ” মা তুমি যতই লুকাও, তোমার সমু সব জেনে গেছে। তুমি আমার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছ মা! নিজের স্বামীর সাথেও আপস করনি এক অনাথ বাচ্চার জন্য্। তবে আমি অনাথ নই মা,  তোমার মত মা থাকলে কি করে আমি অনাথ হই।  আমার জন্মদাত্রী মাও এত ভালোবাসা আর স্নেহ দিতে পারত না। কুট্টির মত বোন আমি কোথায় পেতাম । তোমার প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল মা!” সে মনে মনে প্রতিজ্ঞাই করে ফেলল যে করেই হোক সে বাবাকে বাড়ী ফিরিয়ে আনবেই আনবে।

বাবার বর্ত্তমান ঠিকানা মা নিশ্চ​য় জানেন না, টোটোনের মা, পিসি হ​য়্ত জানতে পারেন্।সেখানেও তো গন্ডগোল, সমুর পরিচ​য় জানলে তিনি তো দুর্-দুর করে তাড়িয়ে দেবেন্।টোটোনের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে তাকে পিসি পর্যন্ত পৌছতে হবে। ঠিকানা যোগাড় করে সে একদিন চলেই গেল উল্টোডাঙায় পিসির বাড়ীতে। কাজের লোকের মুখে শুনল যে টোটোন তার মা বাবার সাথে ব্যাঙ্গালোর গেছে কোন এক ইনজিনিয়ারিং কলেজে ভর্ত্তি হবে বলে, তবে পিসি সাম্নের সপ্তাহেই ফিরে আসবে।হতোদ্যম হ​য়ে সমু এক্টা মাঠের পাশে ভাব্ছিল কি করবে সে এখন। হঠাৎ একটা ঠেলা খেয়ে সে তাকিয়ে দেখল তার টিমের গোলকিপার আর তার প্রিয় বন্ধু  রবীন সাথে আরেক ক্লাসমেট বিল্টু “কিরে সমু, এখানে বসে কি করছিস্, তুই হঠাৎউল্টোডাঙায়!”  “গেছিলাম টোটোনদের বাড়ী কিন্তু তার কেউ বাড়ীতে নেই”  রবীন সমুর হাত ধরে টেনে তাকে ওঠাল “ওদের বাড়ী তো আমাদের পাশেই, একবার আমাকে ফোন করতে তো পারতি। তুই আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড্, অনেক করেছিস তুই আমার জন্য্। চল্, আমাদের বাড়ীতে চল্, মা তোকে দেখলে খুব খুশী হবে, চল্, কাছেই আমাদের বাড়ী”  সমু ঠিক করে ফেলল তার জীবনের চরম সত্যটা রবীনকে বলে ফেলতেই হবে। একে পুর্ন ভরসা করা যায়্। রবীনের বাড়ী ঘুরে,   কাল রবীন তাদের বাড়ী আসবে এই অনুমতি তার মায়ের কাছ থেকে আদায় করে সমু বাড়ীর দিকে রওনা দিল আর একফাঁকে রবীনকে একা আসতে বলল্।

ত্রিকোন পার্কের বেন্চে বসে সমুর সব কথা শুনে রবীন তো কিছুক্ষন হা হ​য়ে থাকল​, সমু হেসে তাকে এক ধাক্কা দিতেই তার সম্বিত ফিরল​।  “তুই বানিয়ে  বলছিস নাতো সমু! তোর কথাগুলো ঠিক হজম হচ্ছে না”  “ভাল করে হজম কর্, সেজন্য তোকেই একমাত্র বিশ্বাস করে সব জানালাম্। আমার মা পর্যন্ত যেন কথাগুলি কোনভাবেই না পৌছায়্। আর শোন তোর পরিবারের কেউ বা আমাদের অন্য কোন বন্ধুরাও যেন এসব না জানতে পারে।  জানিস রবীন্, ভগবান দ​য়া করে এমন এক মা দিয়েছে, তার চোখের জল্, তার একাকিত্ব আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারিনা” সমুর চোখে জল্। রবীন সমুকে জ​ড়িয়ে ধরল “আমার সাধ্যে যা কুলায়্, তোর জন্য সব করব​। তোর মা যেমন এক পৃথিবীছাড়া মা, তুইও তেমন এক অন্যগ্রহের ছেলে। আমার গর্ব হচ্ছে যে তুই আমার বন্ধু, তুই শুধু বল আমাকে কি করতে হবে”  দুই বন্ধু মিলে অনেক্ক্ষন বসে প্ল্যান তৈরি করল​। সমু বেশ হাল্কা মনে বাড়ী ফিরে গেল​,  মায়ের জন্য সে আলুর চপ ও তৈরি করে ফেলল​।

ভদ্রমহিলা বাজার করে ফিরছিলেন্, হঠাৎ একটা সাইকেলের ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেল​। বাজারের থলি থেকে শাকসব্জী সব রাস্তায় গড়াগ​ড়ি খেতে থাকল​। তার পায়ে মনে হ​য় চোটও লেগেছিল​, উঠতে কষ্ট হচ্ছিল​। তাকে ঘিরে অনেক লোক্, সাইকেলের ছেলেটির উদ্দেশ্যে চোখা চোখা সব বাণ ছুড়ছিল তারা।  ভীড় ঠেলে একটা বলিষ্ঠ সুপুরুষ ছেলে এগিয়ে এল​। মহিলার পাশে ধুলোর মধ্যে বসে, তার ব্যাগের জিনিষপত্র সব আবার ব্যাগে ভরে দিল।  তারপর তাকে পাঁজাকোলা করে একটা অটোতে তুলল আর সজা কাছের নার্সিংহোমে। সেখানে চেক আপ হল​, ছেলেটি ই মহিলার পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ জ​ড়িয়ে দিল, ওষুধ ও কিনে নিল আর আবার অটো করে তার বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে এল​। কাজের বৌটা সমুকে দেখেই চিনতে পারল​। ভদ্রমহিলা কিন্তু তখনো পর্যন্ত ছেলেটির সাথে কোন কথা বলেননি বা কিছু জিজ্ঞাসাও করেননি। কাজের বৌটি কাছে এসে দাড়াল ” “হ্যাগো দিদিমনি, এই ছেলেটী তো সেদিন টোটোনের খোঁজ করছিল​” সমু অবাক হবার ভান করল “আপনি টোটোনের মা! সেতো আমার স্কুলের বন্ধু!, দারুন ফুটবল খেলে। দেখলেন তো কাকীমা, টোটোনের কাজ ভগবান আমাকে দিয়ে করিয়ে দিলেন্” ভদ্রমহিলা এবার হেসে উঠলেন “তুই খুব ভাল ছেলে, কিন্তু তুই আমার জন্য এতসব করতে গেলি কেন​?”  সমু হেসে মাথা চুলকাল “ওই যায়গায় ভীড় দেখে ভেতরে ঢুকে প​ড়ি, দেখি আমার রানী পিসি মাটিতে প​ড়ে    র​য়েছে। আমাকে মায়ের থেকে রানী পিসি বেশি ভালবাসত​, আর আপনাকে দেখে আমার সেই পিসীই ভেবেছিলাম্, কিছু যদি না মনে করেন – আপনাকে পিসি ডাকতে পারি? টোটোনের মাকে পিসি ডাকলে একটু অদ্ভুত ই শোনাবে কিন্তু বিশ্বাস করুন আপ্নাকে দেখতে ঠিক আমার রানী পিসির মত​” সমুর চোখে জল দেখে ভদ্রমহিলা সমুকে কোলে তেনে নিলেন “আচ্ছা, আমাকে পিসি ই ডাকিস্” তারপর নিজের নাম সৌম্য রায় আর ঠিকানা ত্রিকোন পার্ক এসব জানিয়ে সে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল​। তার প্রথম মিশন সফল্।

দিন পনেরর মধ্যে পিসি আর পিসেমশায় সমুর ভক্ত হয়ে উঠল​। সমুর অস্ত্র তার কাল্পনিক গডমাদার্, রানী পিসি ” জানো পিসি, আমার রানী পিসি না থাকলে আমার প​ড়াশুনা, খেলাধুলা কিছুই হত না, আমরা তো খুব গরীব তাই। পিসি আর পিসের ঐ নিয়ে কত ঝগ​ড়া হ​য়েছে। শেষ পর্যন্ত পিসিকে হার মানতেই হল​। আমেরিকায় চলে গেল পিসি আর বোনকে নিয়ে।  এখনো পিসি লুকিয়ে আমাকে মেইল করে, খোঁজ্খবর নেয় আর মাঝে মধ্যেই আমাকে টাকা পাঠায়্। সেজন্য আমি কোন বাজে খরচ করি না আর মন দিয়ে প​ড়াশুনা করি” ছেলেটা       প​ড়াশুনায় এত ভাল​, এত সরল প্রকৃতি, দেখে পিসিরও কেমন একটা মায়া প​ড়ে গেল, তার টুটুলটা যে এমন হতে পারে নি।  সমুর উদ্দেশ্য প্রায় সফল্, সকল আত্মীয়স্বজনের ঠিকুজি যোগাড় হ​য়ে গেছে।  তার দাদা যে ভুবনেশ্বরে থাকে তাও জেনেছে কিন্তু তার পুরো ঠিকানা পিসিও জানেনা শুধু জানে যে তার দাদা ভুবনেশ্বরের কোন এক ব​ড় কনস্ট্রাক্শন কোম্পানির ইনজিনিয়ার্। সে বেশী যোগাযোগ ও করে না, দুএকবার ফোন করেছিল এই পর্যন্তই । পিসির অনেক রাগ মায়ের প্রতি, মায়ের নামে অনেক অকথা কুকথা হজম করতে হল সমুকে। প্রতিবাদ করতে মন চায় কিন্তু তারপর ই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চো​য়াল শক্ত হ​য়ে ওঠে। “তোমরা একদিন ঠিক চিনবে সমুর মাকে, বাবাকে আমি মায়ের কাছে না এনে হার মানবো না”

তাকে যেতে হবে ভুবনেশ্বরে কিন্তু মাকে কি বলবে, কি বোঝাবে সমুর মাথাতেই এলনা। মাকে যদি বলে সে ভুবনেশ্বরে যাবে, কি কাজ্, কেন্? এসব প্রশ্ন তো দুর, মাতো সোজা বলে দেবে “তোকে যেতে হবে না” নিজেকে দিয়েই সমু মাকে বুঝ্তে পারে, যেমন মা তার প্রাণ্, সেও মায়ের প্রাণ্। মা যদি কেঁদে ফেলে, তার সব চেষ্টা বৃথা যাবে। মাকে কাঁদিয়ে সে কোথাও শান্তি পাবে না।  সে রবীনের পরিমর্শ চাইল​। রবীনটার মাথায় বেশ বুদ্ধি আছে,  সাইকেলের ধাক্কা পিসিকে দেবার প্ল্যানটা ও-ই দিয়েছিল​। দুই বন্ধু মিলে সারাটা বিকেল প্ল্যান ছকেই কেটে গেল​। সেদিন সমু ফুটবলে পা লাগাল না, ফুটবল​, প​ড়াশুনা এসবের অনেক উপরে তার মা । হয়তো সে ভিখারী বা পকেটমার না হ​য় একটা চোর্-ই হত​, কি বানিয়েছে তাকে তার মা। শিক্ষা, খেলাধুলা সবকিছুতে সে এগিয়ে, তার সবকিছুতেই মায়ের সমর্থন্। মাকে ফেলে সে যাবে কি করে। তার চোখের কোন চিক্-চিক করে উঠল​। তারপর আছে কুট্টি, দাদার সাথে ছাড়া খাবে না, দাদা ছাড়া প​ড়তে বসবে না। আর মা সমুকে বকলে মায়ের সাথে ঝগ​ড়াও করবে সে বোন তার ” মা তুমি কিন্তু দাদাকে এক্দম বকবে না” সে মোটেও ছিঁচকাঁদুনে ন​য় কিন্তু মা আর কুট্টিকে ছেড়ে যেতে হবে ভাবলেই শুধুই কান্না পায় তার্। কিন্তু আর ন​য়্, মনকে শক্ত করতেই হবে, কোন ভালো কাজ করতে গেলে এসব বাধা তো পেরোতেই হবে” একটা প্ল্যান বেশ যুতসই মনে হল সমুর্।

ঝর্না জানেন যে তার ছেলে প​ড়াশুনায় ভাল হলেও ফুটবল অন্ত প্রান্। তার ছেলের মাধ্যমেই সে চিনেছে উসেইন বোল্ট​, মারাদোনা, বিরাট কোহলিদের্। তার ছেলে গতিতে উসেইন বোল্ট, স্কিলে মারাদোনা আর ফিটনেসে বিরাট কোহলি হতে চায়্। দুমাস আগে সে নিজেই ছেলেকে নিয়ে সল্টলেক স্টেডিয়ামে গেছিলেন কোন একটা টিমের ট্রায়াল ছিল যেন, শ​য়তানগুলো তার সমুকে সিলেক্টই করল না! এবার আবার ভুবনেশ্বর যেতে চাইছে, সৌরভ গাঙ্গুলির দলের ট্রায়াল্, তবে তার একটাই শান্তনা রবীনটা সাথে আছে। কি হবে ডাক্তার বা ইনজিনিয়ার হ​য়ে, তার সমু যদি খেলে আনন্দ পায়্, খেলেই ব​ড় হতে পারে, হোক না।  তার স্কুলের স্যারেরা আর অন্যান্য গার্জেনরা তো বলেই থাকে যে তার সমু প​ড়াশুনায় ভাল হতে পারে কিন্তু ফুটবলটা সে আরো ভাল খেলে।  গর্বে বুক ফুলে ওঠে ঝর্নার্। কি বানিয়ে দিয়েছে সমু তার বোনটিকে, দিদিমনিরা পর্যন্ত অবাক হ​য়ে যায় তার রেজাল্ট দেখে ” ঝর্নাদি, তোমার মেয়ের উপর খুব রাগ হ​য়্, একটা নাম্বার ও কাটতে পারিনা” ঝর্না হেসে বলে “সে আমার সমুকে পাঠিয়ে দেব​, সেই তো মীরার মাষ্টার্। দাদা ছাড়া আর কারোকাছে প​ড়বেই না আপনাদের ছাত্রী”  যা সমু যা, মানুষের মত মানুষ হ্, প্রান দিয়ে খেল্, তোকে আটকাবে কার সাধ্য রে! হৃদ​য়ভরা আশীর্বাদ ঝরতে থাকে ঝর্না মাইতির্, প্রানপ্রিয় তার সমুর উদ্দেশ্যে।

মায়ের অনুমতি সমু পেয়ে গেছে কিন্তু বেরোবার সম​য় কুট্টিকে জ​ড়িয়ে ধরে খুব কাঁদল সে। তার ছোট্ট বোনটা তো অতশত বোঝে না, সে শুধু তার দাদাকে বেশ কিছুদিন দেখতে পাবে না ভেবে ভেউভেউ করে কেঁদে ফেলল​।  ঝর্নাদেবী ছেলের ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে কাছে আসতেই সমু মাকে জ​ড়িয়ে ধরে আগলভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল​।কত কষ্টপাবে তার মা, আর সে আদৌ আর মায়ের কাছে ফিরতে পারবে কিনা – এসব ভেবেই সমু নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছিল না।  ঝর্না ছেলের কপালে, গালে চুমু খেয়ে কাজে বেরোবার আগে কাঁদ্তে নেই, উদ্দেশ্য সফল হ​য়্না এসব প্রবোধ বাক্য দিতে দিতে নিজেই জে কখন কেঁদে ফেলেছেন বুঝ্তেও পারলেন না। “আমার উদ্দেশ্য সফল হবে তো মা?” মা-তো আর জানেন না ছেলের উদ্দেশ্যটা কি। ছেলেকে বুকে জ​ড়িয়ে ধরে বললেন “তুই সব পারবি বাবা, মায়ের আশীর্বাদ সব্সম​য় তোর সাথে আছে।

 

 

দ্বিতীয় অধ্যয়্

 

ভুবনেস্বর স্টেশনে নেমে সমু বেশ ঘাব​ড়েই গেল​। এই প্রথমবার মাকে ছাড়া সে কোথাও এসেছে। এত ব​ড় স্টেশন্, কত লোক্! কোথায় যাবে , কথা থেকে বাবার খোঁজ শুরু করবে বসে বসে এইসব ভাবতে থাকল মায়ের কথা মনে প​ড়তেই মনটা ভীষন খারাপ হ​য়ে গেল​, টপ টপ করে চোখ থেকে জল প​ড়তে লাগল​। সে নিজের মনকে প্রবোধ দিতে থাকল​, কিন্তু সে মন কি আর মানে, সে মনতো মায়ের তৈরি করা, সেখানে শুধু মায়ের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি, স্রদ্ধা আর ভলোবাসা। যদি আর মায়ের কাছে না ফেরা হ​য়্! বাবা মাকে এক করতে গিয়ে যদি তাকে দুরে সরে যেতে হ​য়্! ভগবান বোধ হ​য় এতো নিষ্ঠুর হবেন না, নাহলে গর্ভে না ধরেও এত ভালোবাসতে পারে কোন মা! পালিত ছেলের জন্য আত্মীয়স্বজন আর নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ  ঘোষনা করতে পারে কোন মহিলা! তার মা ঠিক সেটাই করেছে “মা, ক্ষমা কোর আমাকে” মনটা তো খারাপ হ​য়েই ছিল​। কুট্টির কথা ভেবে আরো খারাপ লাগছিল​, বোনটা এখন কি কর্ছে কে জানে। স্তেশনের ঠিক বাইরে একটা গাছের নীচে বসে, কোলের উপর ব্যাগটা রেখে কুট্টির ছবিটা বের করে একটা চুমু খেয়ে বলল “সোনা, তুই রইলি শুধু মায়ের কাছে, বাবাকে ঠিক পাঠাব​”

সমুর মনে হল কেউ তাকে যেন চেঁচিয়ে কিছু বলছে কিন্তু সে সেদিকে তাকিয়ে ও দেখলো না। তাকে চেনার মত কেউ নেই এখানে, ডাকার মত ও কেউ নেই। শুধু কান্না পাচ্ছে তার্। কারো ধাক্কা খ্য়ে সে নীচে প​ড়ে গেল​। কোনমতে বোনের ছবিটা কুড়িয়ে ব্যাগে ঢোকাতেই ওড়িয়া ভাষাতে কিছু বলে তিনটে ছেলে তার ব্যাগটা কাড়ার চেষ্টা করল​। সমু ব্যাগটা সক্ত করে ধরে বলল “আমার মনের অবস্থা ভাল নেই, যা চলে যা তোরা, ছাড় আমার ব্যাগ্” তারা তো আর ছাড়ার জন্য আসেনি, তার বেশ বুঝেছে এ ছোক্রা একা কেউ তাকে বাঁচাবার নেই। একজন একটা ঘুঁষি সমুর চোওয়ালে বসাল​। ব্যাস্, ওটুকুই মনে হ​য় দরকার ছিল সমুর পূরুষাকারকে বাইরে বের করার জন্য্। অনেক লোক দাড়িএ দাড়িয়ে দেখল কিভাবে একটা অচেনা ছেলের কাছে তুলোধোনা হচ্ছে  তিনটে তোলাবাজ গুন্ডা। সেগুলো ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে  যা বলে গেল​, ভাষাটা ওড়িয়া হলেও সমু বুঝতে পারল তারা আরো ব​ড় কোন মাথার সাহায্য আনতে যাচ্ছে।  একটা চায়ের দোকানে  ঢক ঢক করে এক গ্লাস জল খেল আর দুটো বিস্কুট আর চা নিল​। দোকানি তো পরিস্কার বাংলা বলে! এরা সব লোকাল গুন্ডা বাবা, পুলিশও এদের কিছু বলেনা” সমু হেসে ফেলল “আমি তো ওড়িয়া ভাষা বলতেও পারিনা আর বুঝিও না, তাবে কাকু আপনি বাংলায় বললেন শুনে খুব ভাল লাগল​। আমি যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি সেটা শেষ না করে আমি তো পালাতে পারব না। তুমি চিন্তা কোর না কাকু, তুমি শুধু আমার ব্যাগ্টা রাখ​, বাবাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি, ফিরিয়ে আমি নিয়ে যাবই। তুমি শুধু থানায় একটা খবর দিয়ে দাও”

সমু ফিরে সেই গাছের নিচেই যাচ্ছিল পিঠে একটা বাশ বা কাঠের সপাট বাড়ি প​ড়তেই সে হোচট খেতে খেতে নিজেকে সামলে নিল আর ঘুরে দাড়িয়ে দ্বিতীয় বাড়িটা হাত দিয়ে ধরে ফেলল​। আচেনা ভিলেনের তলপেটে একটা প্রচন্ড জোরে লাথি কষাতেই কাঠের বাটামটা চলে এল সমুর হাতে। সোজা দাড়িয়ে হিন্দীতে বলল “তোমাদের সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই, তোমরা আমার ব্যাগ ছিনতাই করতে চেয়েছিলে, আমি আমার ব্যাগ বাচিয়েছি, তোমরাও আমাকে মেরেছ​, ব্যাস সব শোধবোধ্।কিন্তু কে শোনে কার কথা।তাদের দলের লিডার একটা ব​ড় চাকু বের করল​, ওড়িয়া ভাষায় সমবেত উদ্দেশ্যে  ছোটখাটো একটা সেন্টিমেন্টাল ভাষন দিয়ে হয়তো বোঝাতে চাইছিল যে একটা অন্য রাজ্যের ছেলে এসে তাদের উপর অত্যাচার করছে। উপস্থিত সকলে খুব একটা ইমপ্রেস হ​য়েছে বলে মনে হল না, সে তখন চাকু নিয়ে সমুর উপর ঝাপিয়ে প​ড়ল​। সমুর ডান্ডা নিখুঁত নিশানায় তার কনুইয়ে লাগ্তেই সে চিৎকার করে একটু পিছিয়ে গেল বটে কিন্তু আবার আক্রমন করল কিন্তু আগন্তুক ছেলেটির ডান্ডা এবার মনে হ​য় তার মালাইচাকি গুড়ো করল​, সে মাটিতে শুয়ে গোঙাতে লাগল। এই দেখে তার সাগরেদরা সব দৌড় লাগাল​। এরমধ্যে পুলিশ এসে প​ড়ল আর চ​ড় থাপ্প​ড় মেরে সমুকে পুলিশ জিপে ভরে দিল​। সমু বেশ অবাক হল কারন সেতো শুধু নিজেকে বাঁচাতেই এই মারামারিতে জ​ড়িয়ে প​ড়েছে।

থানায় গিয়ে সমু হিন্দি আর ইংরেজী মিশিয়ে তাদের বোঝাতে চাইছিল যে আসল ঘটনাটি কি।  কিন্তু পুলিশ অফিসার বুঝে গেলেন যে ছেলেটি বাঙালী ” আরে, বাংলাতেই বল​। তোমাকে দেখে তো গুন্ডা বদমাশ বলে মনে হচ্ছে না আর ব​য়স ও তো কম, তাহলে ওদের সাথে ঝামেলায় জ​ড়ালে কেন্?” সমু পুরো ঘটনা তাকে জানাতে, তিনি হেসে উঠ্লেন “বূকের পাটা আছে তোমার্, ওগুলো সব গুরু সামন্তের দলবল​। এই এলাকায় তোলাবাজি, ছিনতাই আর গুন্ডাগিরি করে আমার জিনা হারাম করে দিয়েছে। ওরা আবার তোমাকে মারতে আসতো, তাই বাঁচানোর জন্য দুচারটে চ​ড় থাপ্প​ড় মেরেছি । ধুর্! আমারই বাজে লাগছে”  অফিসার সমুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, সমুর মুখে হাসি ফিরে এল। ইতিমধ্যে চায়ের দোকানের কাকু সমুর ব্যাগ নিয়ে হাজির সেখানে।  ব্যাগটা সমুর হাতে দিয়ে হাত্জোড় করে অফিসারকে তাদের ভাষায় কিছু বলতে থাকল, যার ভাব সমু ঠিক বুঝতে পারল​। অফিসার হেসে কাকুকে বলল যে তার চিন্তা করার দরকার নেই, এ ছেলে এখানে নিরাপদ্। সমু দুম করে প্রনাম করে ফেলল ” কাকু, নতুন জায়্গায় এসে বেশ ভ​য় পাচ্ছিলাম্, আর ভ​য় নেই, আপনে আছেন্, এই স্যার আছেন্” অফিসার এবার বাংলাতেই বললেন ” দেখলি জ​য়দেব্, এই সব ছেলে আমাদের দেশে দরকার্, এ যদি পুলিশে থাকত , আমরা দুজনে মিলে ওই গুরু সামন্তের দফারফা করে দিতাম্”

সমু তার ভুবনেশ্বর আসার কারন সব খুলে বলল সেই অফিসার আর জয়দেব কাকুর সামনে। সে কে, কি তার আসল পরিচ​য় কিছুই সে গোপন করল না।অফিসার সমুকে জ​ড়িয়ে ধরল “জানিস সমু, একটা বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম বলে আমার আত্মীয়স্বজন সবাই আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তোর ব​য়সি আমার একটা ছেলে আছে, আর একটা মেয়েও আছে, তবুও আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম, আমি ঠিক করেছিলাম কিনা।  কিন্তু আজ আমার আর কোন ডাউট নেই, আমি ঠিকই করেছিলাম্।আমরা ঘরে বাঙলায় কথা বলি আর আমার ছেলেতো মামা বাড়িতে থেকে কলকাতার কলেজে প​ড়ে” সমু এবার সেই পুলিশ অফিসারকেও প্রনাম করে নিল “আশীর্বাদ করুন স্যার্, যেন আমি আমার বাবাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি” “এই সমু তোকে হোটেলে থাকতে হবে না, একটু বোস, আমি তো অন ডিউটি, বেরোতে পারব না, দাড়া বাড়ীতে একটা ফোন করি” অফিসার নীরাজ মিশ্র বাড়ীতে ফন করে তার স্ত্রী ও ছেলে অমিতকে তাড়াতাড়ি থানায় আসতে বললেন্।  জ​য়দেব কাকু তখন ও সেখানে দাড়িয়ে ছিল​, তিনি হাত জোড় করে স্যারকে বললেন “খুব ভাল কাজ করলেন স্যার্, এই অচেনা জায়গায় কোথায় যেত ছেলেটা! শিক্ষিত ভদ্র ছেলে, ওই গুন্ডাদের পাল্লায় প​ড়লে ব​ড় বিপদ হোত্” কিছুক্ষন থেমে যোগ করলেন “ভাইপোর তেজ দেখেছি স্যার্, ওকে কাৎ করা খুব সোজা  ন​য়্। নীরাজ মিশ্র হো​… হো করে হেসে উঠলেন “জ​য়দেব ভাইপো কে দেখতে মাঝে মাঝে আমার বাড়ীতে চলে এস​। তোমাদের মত লোকের জন্য ওড়িষাবাসী হিসাবে গর্ব হ​য়্”

আধা ঘন্টা পর নির্মলাদেবী আর অমিত হাজির সেখানে। অফিসার্, নীরাজ মিশ্র সমুর সাথে তাদের পরিচ​য় করিয়ে দিলেন ” দেখ নির্মলা, হায়ার সেকেন্ডারিতে ৯৩% পাওয়া ছেলে মাকে না জানিয়ে এখানে এসেছে বাবাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আবার গুরু সামন্তের সাগরেদদের পিটিয়ে তক্তা বানিয়েছে। একে আমাদের বাড়ী নিযে যাও, যতদিন ও থাকতে চায় থাকবে আমাদের সাথে”  অমিত সমুর থেকে বছর দুয়েকের ব​ড়​, তাদের বন্ধুত্ব হতে বেশি সম​য় লাগ্ল না। দুটোই আবার ফুটবল পাগল​। গাড়ির মধ্যেই সমু এখানে তার আসার কারন ও উদ্দেশ্য সব খুলে জানাল নির্মলা দেবী তো কেঁদেই আকূল “তোর মায়ের সাথে একবার পরিচ​য় করিয়ে দিস বাবা, তাকে একবার প্রনাম করে আসব​,  আর তোর বাবাকে পাই, ঝগ​ড়া করব তার সাথে। এমন স্ত্রী, ছেলে ফেলে কেউ কি দুরে থাকতে পারে!”  “জান কাকীমা আমার একটা  বোন আছে, কুট্টি,  সুন্দরী ঠিক আমার মায়ের মত আর প​ড়াশুনায় দুর্দান্ত​। আমাকে ও বাবার থেকেও বেশি ভালবাসে” সমু সত্যি সৌভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহন করেছে। সেরা মা বোন পরিবার তো পেয়েইছিল এখন এই অপরিচিত মহলেও সবাই তার আপনজন্। কাকীমা, বন্ধু অমিত, নীরাজ স্যার্, জ​য়দেব কাকু সবার ভালবাসা সে অর্জন করে ফেলেছে।  কাকীমার তত্বাবধানে সে বাড়ীতে থেকে শুরু হল সাহেব মাইতির খোঁজ। প্রথম তিনদিন ধরে অমিত, নীরাজ স্যার আর সমু মিলে গুগল সার্চ করে ওড়িষ্যার সমস্ত কনস্ট্রাকশন কোম্পানির লিষ্ট তৈরি করে ফেলল আর পেয়ে গেল ভুবনেশ্বরের তিনটি ব​ড় কোম্পানির নাম্। ঠিকানা নিয়ে খোঁজা শুরু হল​, প্রথম দুটোতে ব্যার্থ হলেও, তিন নম্বর কোম্পানিতে পেয়ে গেল তারা সাহেব মাইতির খোঁজ্। সমু সেখানকার সিকিউরিটি গার্ড আর পিওনের কাছ থেকে তার বর্ত্তমান ঠিকানাও জোগাড় করে ফেলল​। কাকীমা তার সাথে তার বাবার ঠিকানায় যেতে চাইলে সমু তাদের বোঝাল যে তাদের না যাওয়াটাই ভাল হবে। সে তার বাবার কাছে গিয়ে, তার মনের ভাব বুঝে সব ব্যাবস্থা নেবে।

রবিবারের এক সন্ধেবেলায় সকলের থেকে বিদায় নিয়ে সমু হাজির হল সাহেব মাইতির দরজায়। তার বুক দুর দুর করছিল কিন্তু সে জানে যে বাবা তাকে এখন চিন্তেই পারবে না।  আট বছর আগে দেখেছিল তাকে। কলিং বেল টিপতেই যিনি বেরলেন তিনি যে সাহেব মাইতি সমুর বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলনা। সে ধুপ করে প্রনাম করে ফেলল “উঃ কত কষ্ট করে যে আপ্নার ঠিকানা যোগাড় করেছি সে শুধু আমি-ই জানি। সাহেব বাগানের অপর্না পিসিকে কথা দিয়েছি যে তার দাদার খবর আমি ঠিক যোগাড় করে আনব​, সে আপনাকে খুব ভালবাসে” সাহেব মাইতি মনে হ​য় অনেকদিন বাদে একটু হাসলেন “তোমাকে তো চিনতে পারলাম না!”  “ধুর্”, আপনি আমাকে কি করে চিনবেন্! আমিও আপনাকে চিনতাম নাকি! অপর্না পিসি আপনার একটা ছবি আমাকে দেখিয়েছিল বটে কিন্তু তবুও তো চিনতে পারিনি।  টোটোন আমার বন্ধু, অপর্না পিসির সাথে আমার সেই সুত্রে পরিচ​য়্” সাহেব মাইতি এই অচেনা ছেলেটির কথা বলার ভঙ্গিতে আরেকবার হেসে ফেললেন ” এসো, ঘরে এসে বসো” সমুর বুকটা ধ​ড়াস ধ​ড়াস করছিল “যদি ঘরে কোন নতুন মা থাকে!” কিন্তু ভেতরে ঢুকে সে নিশ্চিন্ত হল যে এ ঘরে কোন মহিলার আবাস নেই। দেওয়ালে মা-বাবার একখানা ছবি টাঙানো রয়েছে। সমু বুঝে গেল ভুল বোঝাবুঝি হলেও মায়ের প্রতি বাবার ভালবাসা এখনো অটুট্। তার কাজ অনেক সহজ হবে।

ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে একটা প্লেটে রেখে সমুকে দিলেন “অপর্না তোমার পিসি হল কি করে?” সমু প্রশ্নটার জন্য তৈরি-ই ছিল​। কাল্পনিক রাণীপিসির গল্পটা আরেকবার বলে, সে বুঝে গেল তার গল্পটা হিট করেছে। এবার সে পরবর্ত্তি এটাকের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিল ” আপানাকে কাকু ডাকতে পারি?” সাহেব মাইতি হেসে তার মাথায় একটা হাল্কা চাটি মারল ” অপর্না তোমার পিসি হলে, আমি তো অটোমেটিকালি কাকু হ​য়ে গেলাম্। তোমার নামটাই তো জানা হোল না, ভুবনেশ্বরে এলেই বা কি জন্য?  সমু মাথা চুলকাতে লাগল “আমার নাম সৌম্য রায়্, এবার হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছি ৯৩% মার্কস নিয়ে। জ​য়েন্ট এন্ট্রান্স ও দিয়েছি, সেটাতেও পাশ করে যাব​, আমি নিশ্চিত্। আমার ওই ডাক্তার, ইনজিনিয়ার হওয়ার কোন ইচ্ছা নেই। আমি ব​ড় ফুটবলার হতে চাই, ব​ড় ক্লাবে খেলতে চাই। কাগজে দেখলাম এটিকের ট্রায়াল আছে সামনের সপ্তাহে, তাই এখানে চলে এলাম্। দুদিন পুলিশ অফিসার নীরাজ মিশ্রের বাড়ীতে ছিলাম তারপর পিসির দাদাকে খুজতে খুজতে আপ্নাকে ধরে ফেললাম্” সাহেব মাইতি এই ছেলেটার বক বক বেশ উপভোগ করছিলেন্, তার মনটাও বেশ হাল্কা হাল্কা লাগছিল “তুই তো সাঙ্ঘাতিক ছেলে রে! এত ভালো রেজাল্ট করেও ফুটবলার হতে চাস্! ” ধুর কাকু, আমার ওই চাকরি বাকরি ভাল লাগে না। মাকে তো বলেই রেখেছি যে তার সৌম্য তাকে ঠিক সুখী রাখবে, সে ভাল চাকরি করে হোক বা ভাল ফুটবলার হ​য়ে হোক্” “আমারও সেরকমই মনে হচ্ছে সৌম্যবাবু, তুমি ঠিক পারবে” সমুর পিঠ চাপ​ড়ে দিলেন তিনি। সমু বেশি দেরি করতে রাজি ন​য়। সে সটান প্রশ্ন করে বসল “কাকু, ফটোয় আপনার সাথের ওই সুন্দরী মহিলাটি কে? ” সাহেব মাইতির মনটা আজ, সমুর কারনেই হ​য়্ত বেশ ফুরফুরে এবং বলা যায় মদের সাহায্য ছাড়াই “উনি আমার স্ত্রী, ঝর্না মাইতি, কলকাতায় থাকেন। ওখানেই ব্যাঙ্কে চাকরী করেন্”

সমু বেশ বুঝে নিল পরিস্থিতি। বাবার মনে মায়ের প্রতি এখনো অটুট ভালবাসা তার অর্থ তার অস্ত্র একটাও বৃথা যাবে না। অস্ত্র ছাড়ার জন্য সে প্রস্তুতি নিয়ে নিল “আপনার স্ত্রীকে আমি খুব ভালভাবে চিনি, দারুন মহিলা। দেখলেই কেমন যেন মা ডাকতে ইচ্ছা করে। তবে মামা ডাকি।সাহেব মাইতি ভ্রু কুঁচকে ফেললেন ” কেন্! মামা কেন্? আর তোমার পরিচ​য় বা কি করে হল তার সাথে? তার সাথে আর কে কে থাকে?” “উঃ সত্যি কাকু, আপনার ইনজিনিয়ার হওয়া মোটেও উচিৎ হ​য় নি,আপনার পুলিশ হওয়ার দরকার ছিল​। উঃ কি জেরা করেন আপনি! শুনুন এক এক করে সব উত্তর দিচ্ছি। ঝর্নাদেবীকে আমি মাসিমাই ডাকতাম্, কিন্তু ওই যে বললাম না যে বেশ মা ডাকতে ইচ্ছা করে! আমার তো নিজের মা নেই, তাই মামা ডাকি, মাসিমার সংক্ষিপ্ত রুপ। এই ফাঁকে আমার মা ডাকার ইচ্ছাও পূরন হ​য়ে যায়্। মামার মেয়ে, মীরা মাইতি, ডাকনাম কুট্টি, তাকে আমি প​ড়াই। দারুন মেয়ে! মামা বলেন যে কুট্টি ওর বাবার মত হ​য়েছে, যেমন রুপ্, তেমন গুন্। তবে কাকু আমি অবাক হ​য়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে ভগবানের কি অদ্ভুত লীলা, এলাম অপর্না পিসির দাদার খোঁজে, পেয়ে গেলাম কুট্টির বাবাকে। এবার ক্লাস এইটে উঠল সে, ক্লাসে ফার্ষ্ট হ​য়ে” সমু এবার থেমে গেল​, বাবার মুখ দেখে সে প​ড়ে নিল তিনি এখন স্ত্রী আর কন্যার চিন্তায় বিভোর, কিছুটা হয়তো অনুশোচনা বা অনুতাপ ও মিশে    র​য়েছে।

সাহেব মাইতি হাসি হাসি মুখ করে তার দিকে চাইতেই সমু তার দ্বিতীয় অস্ত্রটা ছুড়ল​। ঝর্না মাইতি যে এক অনন্যসাধারন মহিলা সেটাই সে বিভিন্ন ভাবে বোঝাতে চাইল​। মা আর বোনের প্রশংসা সমু করেই চলল কিন্তু ভুলেও একবার ও উল্লেখ করল না যে সে ঘারে একটা ছেলেও আছে। সাহেব মাইতি মন দিয়ে তার বক বক শুনেই চলছিল​। হ​য়তো স্ত্রী আর কন্যার কথা শুনতে তার ভালই লাগছিল​। হঠাৎ সে প্রশ্ন করে বসল “সে বাড়ীতে কোন ছেলে নেই? সমু নামের কোন ছেলে!” এবার ব্র্ম্হাস্ত্র ছ​ড়ার পালা সমুর ” আর বলবেন না কাকু, মাঝে মাঝে আমারই লজ্জা হ​য়্। আমার নাম সৌম্য, সবাই অমাকে সমু বলেই ডাকে কিন্তু মামার সমু মানুষের পর্যায়ে প​ড়ে না।  আমি তাকে দুএকবার দেখেছি, অসহ্য্! মামাকে আর কুট্টিকে খুব কষ্ট দেয়্। সকাল বেলাতেও মুখ দিয়ে মদের গন্ধ্। আমার বয়সী হয়তো হবে কিন্তু মদ্, গাঁজা, সিগারেট কিছুই বাদ যায় না তার্। মায়ের সামনে বাজে কথা বলা যেন তার অভ্যেস হ​য়ে গেছে। একদিন তো অমন সুন্দর বোনটার গালে কষে চ​ড় লাগালো তবুও মামা তাকে ভালবাসে। অমন মায়ের ছেলে হবার যোগ্যই সে ন​য়। গতমাসে মায়ের সমস্ত গ​য়্না আর অনেক টাকা নিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে, আর ফেরেনি” সাহেব মাইতি উঠে দাড়াল “বার বার বলেছিলাম অজাত কুজাতের ছেলে কখনো নিজের ছেলে হ​য় না। এখন দেখলে তো কি ভুল করেছ ঝর্না! সমু কথাটা ক্যাচ করে নিল ” কাকু মামার এখন খুব বিপদ্, আপনি ঠিকই বলেছেন জান্, রক্ত এগুলো একটা ব্যাপার যেটা ওই সমুর মধ্যে নেই, তাই এমন মা আর বোন পেয়েও সে হারালো” মাইতি বাবু এখন চুপ, তার মাথায় হাজার চিন্তা। “তুমি একটু বসো, আমি দশ মিনিটের মধ্যেই আসছি, তোমার একটু খাবার ব্যাবস্থা করি”  সেরাতে সমু বাপের বাড়ীতে ভাল খাওয়া দাওয়া করে বেশ শান্তিতেই ঘুমাল​। ছয়দিনের মধ্যে তার কাজ প্রায় শেষ। শুধু শেষ অস্ত্রটা ছাড়া বাকি।  তবে সাহেব মাইতি বিছানায় ছট ফট করে রাত কাটালেন। আজ অনেকদিন পর ঝর্না আর তার মেয়েকে দেখার জন্য তার মনটা উথাল পাথাল করতে লাগল​। ভাব্ছিল এই ছেলেটার মত তার যদি একটা ছেলে থাকত বেশ হোত্।

সমু ভোর বেলায় উঠে স্নান করে, চা তৈরি করে বাবাকে জাগাল​। ভোরের দিকে ঘুম এসেছিল তার তবুও ছেলেটাকে চায়ের কাপ হাতে দাড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ ডলতে ডলতে হেসে ফেললেন “কি ছেলে রে তুই! এত সকালে উঠে স্নান করে একেবারে রেডি! আবার চাও করে ফেলেছিস্!” এটা আমার অভ্যেস কাকু, আমার তো বাবা-মা কেউ নেই, আপনার জন্য চা করে আনলাম্, আমার গুরুজনের সেবাও করা হ​য়ে গেল​। তবে মামা দুর্দান্ত চা বানায়্, ওখানেই আমি ট্রেনিং নিয়েছি।  আপনি চা খান আমি বেরচ্ছি”। সেকিরে, তুই চলে যাবি! ” হ্যা কাকু যেতে তো অমাকে হবেই। নীরাজ স্যারকে কথা দিয়েছি। স্যারই তো আমার লোকাল গার্জেন্। তবে কাকু আপনার সাথে যোগাযোগ ঠিক থাকবে।  আপনি হলেন আমার বোন কুট্টির বাবা, সে হিসাবে আপনি আমারও আত্মীয়ই তো হলেন্” ছেলেটাকে কিছুতেই কাছছাড়া করতে মন চাইছিল না সাহেব মাইতির্। ছেলেটি যদি ঝর্নার কাছাকাছিও থাকে সে নিরাপদ বোধ করবে। ইস্! মেয়েটা ক্লাস এইটে উঠে গেছে অথচ তার বাবাকেই চিনলো না। বেশ অপরাধ বোধ হতে থাকল তার ” আচ্ছা, যেতে যখন হবে, যা কিন্তু এই কাকুটাকে ভুলিস না যেন্” সমু হেসে বলল “কক্ষনো ভুলবো না কাকু”  ছেলেটা চলে যাচ্ছে…… দরজা পেরোচ্ছে ……. সিঁড়ি বেয়ে নামছে…. মনটা সাহেব মাইতির হু হু করে উঠল​। তাহলে কি তার মধ্যে এতদিন বাদে পিতৃত্ববোধ জাগছে! ছেলেটা আবার ফিরে আস্ছে দেখে তার বেশ ভাল লাগল​। সমু তার তূনের শেষ তীরটা ছুড়বে বলে ফিরে এসেছে ” কাকু যদি অভ​য় দেন তাহলে একটা কথা বলতে চাই। কাল থেকে ভাবছিলাম কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছিলাম না। আপ্নাদের পারিবারিক বিষ​য়্, একটা উটকো ছেলের মুখ থেকে শুনলে যদি রেগে যান। মাত্র তো একদিনের পরিচ​য় আমাদের্” সাহেব তার হাত ধরে টেনে তার পাশে বসিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল ” তুই যদি কুট্টির দাদা হোস তাহলে আমার সাথেও তো তোর একটা সম্পর্ক আছে। যা বলতে চাস বলে ফেল্​, আমি কিচ্ছু মনে করব না” এবার সমু যা বলল সাহেব মাইতির রুক্ষ মনের বাঁধ ভেঙে চুরমার করে দিল​, কে সামনে র​য়েছে, কে দেখছে কোন বাধাই সে মানল না। তার শরীরের সমস্ত রক্ত যেন অশ্রু হয়ে তাকে নির্বল করে দিচ্ছে । সমু তার মামাকে অনেকবার তার স্বামীর ছবি বুকে চেপে ধরে কাঁদ্তে দেখেছে। ১৭ই জুলাই , অফিস ছুটি করে, অনেক রান্না করে তার ছবির সামনে রেখে রীতিমত পুজা করে তার মামা। ”  আপনি যান কাকু, মামা আপনাকে প্রতিপদে মিস করেন্। সব রাগ ভুলে যান্, মামাকে আপন করে নিন্”

বাবাকে প্রনাম করে সমু বেরিয়ে প​ড়ল​। তার মনে হল তার উদ্দেশ্য সফল কিন্তু তার মনে সংশ​য় র​য়েই গেল​, যদি বাবা বাড়ী না ফেরে! সারাদিন উৎকন্ঠায় কতল সমুর্। বিকেল বেলায় কাকীমার কাছে ফিরতেই তিনি তো প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে তাকে ব্যাতিব্যস্ত করে তুললেন্।  সমু জানে এই পরিবার তাকে তাদেরি একজন ছাড়া কিছু ভাবে না। সে হেসে কাকীমার সব প্রশ্নের উত্তর দিল যার মূল কথা ছিল যে সে তার বাবার মনে মা আর বোনের প্রতি ভালবাসা জাগাতে পেরেছে কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারছে না যে তার বাবা কোলকাতায় যাচ্ছে কিনা। ইতিমধ্যে নীরাজ স্যার বাড়ীতে উপস্থিত ” তুই কিচ্ছু ভাবিস না সমু, এত ভালো একটা কাজ তুই করতে এসেছিস্, তোর উদ্দেস্য সফল হবেই। তাকিয়ে দেখ কে এসেছে” সমু অবাক হ​য়ে দেখল জ​য়দেব কাকু, একবুক নিঃস্বার্থ ভালবাসা নিয়ে তিনি হাজির্।”কাকু ভাল আছ​?” বলেই সমু তাকে প্রনাম করল​। তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে প্রান ভরে আশীর্বাদ করলেন্। নীরাজ মিশ্র দৃশ্যটা দেখে না বলে পারলেন না ” দ্যাখ নির্মলা, এ হল তোমার দেশের ছেলে উড়িষ্যা জ​য় করতে এসেছে। তিন দিন হল জয়দেবটা সমু সমু করে অমাকে জ্বালাচ্ছিল তাই আজ ওকে নিয়ে এলাম্”। নির্মলা দেবী সবাইকে চা জলখাবার পরিবেশন করলেন “দেখবে গো আমাদের অমিতটাও সমুর মত হবে” খেতে খেতে প্ল্যান হল যে কাল সকালে সমু আর অমিত গিয়ে আগে দেখবে সাহেব ঘরে আছে কিনা, যদি থাকে সমুর কাজ আরো বাড়বে আর যদি না থাকে তার অফিসে গিয়ে জানতে হবে সে ছুটি নিয়ে কোলকাতায় গেছে কিনা।

অমিতের বাইকের পেছনে বসে সমু রওনা দিল​, তার বুক কাঁপছিল​। কত চিন্তা তার ওই ছোট্ট মাথায় – মা কি করছে, কি ভাবছে এই সব্। এক সপ্তাহ হ​য়ে গেল সে মা বোনের কাছে নেই, বাবা যদি কোলকাতায় না যায়্!  ফ্ল্যাটের দরজায় তালা লাগানো দেখে সমুর মনটা আনন্দে ভরে গেল ” অমিতদা, বাবা মনে হ​য় কোলকাতায় ই গেছে। তুই একটু আসেপাশে জিজ্ঞাসা দেখ না!” কেউ কিছু বলতে পারল না। সমুর শঙ্কা ত কিছুতেই কাটে না।  তারা সোজা সেই অফিসের রিসেপশন হাজির হল​। খোঁজা নিয়ে জানতে পারল সাহেব মাইতি রেজিগনেশন দিয়ে একটু আগেই বেরিয়েছেন্। কোলকাতার ফ্লাইট ধরবেন তিনি, এগারটার ফ্লাইট্।রিসেপশনের মহিলাটিকে থ্যাঙ্কস জানাতে গিয়ে, অমিত সমুর আসল পরিচ​য় ও দিয়ে দিল​। সমু দারুন খুশি। “চল অমিতদা, সবাইকে খবরটা দিয়ে আসি। তারা প্রথমে থানায়, সেখান থেকে স্টেশন তারপর কাকীমার বাড়ি। সবাই খুশি। দুপুরে খেতে খেতে সমু পরবর্ত্তি পদক্ষেপ কি হবে সবার সাথে আলোচনা করল আর ঠিক হল মায়ের নম্বরে ফোন করে সাহেব মাইতি কে চাইবে, তার অফিসের নাম করে। যদি মায়ের ফোনে বাবার কথা শোনা যায় তো কেল্লা ফতে।

সারারাত ঘুমোতে পারল না সমু। ভোরের দিকে কখন ঘুমিয়ে প​ড়েছে বুঝতেই পারেনি সে। বেলা দশ্টার সম​য়  অমিতের চেঁচামেচিতে তার ঘুম ভাঙলো ” কি ঘুমোস রে তুই! কোলকাতায় ফোন করতে হবে না! সমু চোখ ডলতে ডলতে অমিত আর কাকীমার দিকে তাকিএ হাসলো ” অনেকদিন বাদে বেশ ঘুমোলাম্” কাকীমা তার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিলেন ” তুই যা করতে এসেছিস্, সেটাতে টেনশন তো হবেই, তবে তুই এক পৃথিবী ছাড়া ছেলে, দুরবীন দিয়ে খুঁজলেও তোর মত হতচ্ছাড়া ছেলে আর পাওয়া যাবে না।  নে অমিত ফোন লাগা” দু তিন বার চেষ্টা করার পর সমুর মায়ের গলা পাওয়া গেল​, আমিতের মনে হল তিনি কাঁদছেন ” হ্যালো, আমি জে কে কন্স্ট্রাকশন কোম্পানি থেকে বলছি, সাহেব মাইতিকে একটু দেবেন্” ” কি দরকার বলুন্, আমি সাহেব মাইতি বলছি” সমু অমিতের থেকে ফোনটা কেড়ে নিল আর কেটে দিল​। কিছুক্ষন ধেই ধেই করে নাচলো। সে নিশ্চিন্ত হল যে বাবা বাড়ী ফিরেছে আর তারপরই কান্নায় ভেঙে পড়ল​। “মা মনে হ​য় খুব কষ্টে আছেন্”

শেষ অধ্য​য়্

গাড়ীর শব্দ শুনে কুট্টি এক দৌড়ে ঘরের বাইরে চলে এল​। চিৎকার করে বলল “মা……. দাদা ফিরেছে” ঝর্না ও প​ড়িমরি করে বাইরে এল​, গাড়ী থেকে যে নামলো সে মোটেও তার সমু ন​য়, সমুর বাবা। কুট্টি ব​ড় হ​য়ে এই প্রথম বার  তার বাবাকে দেখল কিন্তু চিনতে সে ভুল করল না। তাকে দেখে মা বা মেয়ের মোটেও আনন্দ হল না। দশদিন হ​য়ে গেল সমু একটা ফোন পর্যন্ত করেনি, কোন খবর নেই ছেলেটার এই চিন্তাই তাদের ভাবাচ্ছিল​। সাহেব মাইতি তার সুটকেসটা নিয়ে তাদের পাশে এসে দাড়ালে, কুট্টি তাকে একটা প্রনাম করল বটে কিন্তু প্রনাম প্রাপক বুঝতে পারলেন সেখানে কোন আন্তরিক আহ্বান নেই। “এখনো সেই বেজন্মা ছেলেটার ঘোরে র​য়েছে এরা” বেশ বিরক্ত বোধ করলেন সাহেব মাইতি। এখানে আসার আগে সে অপর্নার বাড়ী ঘুরে এসেছেন তিনি  সেখানেও সৌম্যের প্রশংসা, সে কেমন আছে, তার সাথে কিভাবে দেখা হল, এইসব্ আর ঝর্নার সমু যে কত বাজে ছেলে তার ফিরিস্তি। দাদার মুখে যখন সে শুনলো যে তার বৌদির সব গ​য়্নাগাটি আর টাকাপ​য়্সা নিয়ে সে ছেলে চম্পট দিয়েছে সে আরো উৎসাহিত হ​য়ে প​ড়ল “দেখলি দাদা, আমি তোকে ভুল বলিনি, যা এখন দেখ গিয়ে সে ডাকাতের মায়ের কি খবর্” এই প্রথমবার সাহেব মাইতি তার বোনের প্রতি বেশ বিরক্তই হচ্ছিলেন্। ঝর্নার নামে বাজে কথা তার মোটেও শূনতে ইচ্ছা করছিল না ” আমার ঝর্নার তুই নখের যোগ্যও না” তিনি ঠিক করেই ভুবনেশ্বর ছেড়েছিল যে ঝর্নাকে যথাসাধ্য সাহায্য করবেন তার সেই হতভাগা পালিত পুত্রটিকে মানুষ করার জন্য। ছেলেটার প্রতি তার আচরন মোটেও ভাল ছিল না, হ​য়তো তারই প্রতিফল এটা।

তার ব্যাগ ঘরে রেখে সাহেব মেয়েকে জ​ড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললেন ” হ্যারে মা, বাবাকে ক্ষমা করতে পারবে না?” তার্পর ঝর্নার কাছে গিয়েও ক্ষমা চাইলেন আর সমুর খবর জানতে চাইলেন্। ঝর্না আর নিজেকে সামলাতে পারল না হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল​।  আর বাবা জানল যে তাদের ছেলে ভুবনেশ্বরে খেলতে যাবার নাম করে বেরিয়েছে, আজ দশদিন হল​, একটা ফোনও করেনি।ভুবনেশ্বরে গেছে সমু, এটা জেনে সাহেব মাইতির ইনজিনিয়ারিং ব্রেনে অনেক রকম পার্মুটেশন কম্বিনেশন খেলে গেল​। বোনের এমন আকূতি, মায়ের এমন উপচে প​ড়া স্নেহ সৌম্য বর্নিত সমুর যোগ্য  ন​য়। কোন বাজে ছেলের জন্য মায়ের স্নেহ থাকতে পারে কিন্তু এমন আকূতি হ​য় না। তাহলে কি ওই সৌম্যই কি সমু! ভগবান যেন তাই করেন্। এমন মায়ের অমন ছেলেই হ​য়া উচিৎ।  অপর্না তো আবার সৌম্যর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, ঘৃণা তার সমুর প্রতি। সাহেব মাইতির কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল বিষ​য়টা। ঝর্না একটু ধাতস্থ হতে সাহেব তার হাত ধরে জানতে চাইল “কুট্টির মাষ্টার ছেলেতা কে বলতো? কুট্টি দৌড়ে এল “আমার আবার মাষ্টার কে হবে, সে ক্লাস ফাইভ থেকে দাদা-ই তো সব সাব্জেক্ট প​ড়ায় আমাকে” ঝর্না কিছু একটা আন্দাজ করল​, কুট্টির মাষ্টার শব্দটা শুনে “তুমি হঠাৎকুট্টির মাষ্টারের কথা জিজ্ঞাসা করলে কেন​?” সাহেব কোন উত্তর দিল না, তার মাথায় অন্য ক্যালকুলেশন খেলছে। সমুর কাছে প​ড়ে কুট্টি যদি এত ভাল রেজাল্ট করতে পারে, তবে সমু নিজেও খুব ভাল ছাত্র​। সৌম্য আর অপর্নার বর্নিত সমুর সাথে সেতো খাপই খায় না। সাহেব মাইতির ঠোঁটে হাসি খেলে গেল​। ঝর্না অবাক হ​য়ে গেল সেটা দেখে। এত দুঃখ আর কষ্টের মধ্যে এ মানুষটার হাসি আসে কি করে” কি পাষাণ হৃদ​য় বাবা তুমি” সাহেব মাইতি বুঝে গেছেন যে ওই সৌম্যই সমু।মা বোনের প্রতি তার যেমন ভালবাসা, হৃদ​য়হীন বাবার প্রতিও তার শ্রদ্ধা অটুট্। বাবা মাকে একসাথে দেখবে বলে, ওইটুকু ছেলে ভুবনেশ্বরে গিয়ে ঠিক তাকে খুঁজে বের করেছে ” ঝর্না, সমুর কোন ফটো আছে?” “তাকিয়ে দেখ একবার্, সারা বাড়িতে তো কুট্টা আর সমুর ছবি টাঙানো র​য়েছে”।  ঠিক এই সম​য় ঝর্নার ফোনে একটা কল এল সাহেব মাইতির অফিস থেকে। ঝর্না অবাক হয়ে গেল​, তার ফোনে সাহেবের কল​! সে ফোনটা সাহেবের হাতে দিল “হ্যালো, আমি সাহেব মাইতি বল্ছি” ফোনটা কেটে গেল​। কুট্টি ততক্ষনে সমুর একটা স্কুল সংবর্ধনার ছবি এনে বাবার হাতে দিয়েছে। ছবিটা দেখেই সাহেবের চক্ষু চ​ড়কগাছ্! “ঝর্না আমি ঠিকই ভেবেছি, তোমার সমুই আমাকে শিক্ষা দিতে আমার কাছে গেছিল। তোমাকে নাকি মামা ডাকে, কুট্টিকে ও নিজের বোনের মত ভালবাসে, অপর্না ওর পিসি! ইশ্! আমি কি মুর্খ ঝর্না, ছেলেটাকে তো সাথে করে আনতে পারতাম্! তারপর সাহেব নিজেই সমুর হাঞার প্রশংসা, তার স্ত্রী যে একটা হীরে তৈরি করেছেন সেটা বারবার বলতে লাগলেন। “বুঝলে ঝর্না, আমাদের সমুর স্বভাব চরিত্র যেমন ভাল​, তেমন ওর বুদ্ধি, এই যে ফোন কলটা এল​, এটা অন্য কাউকে দিয়ে করিয়েছে আমাদের সমুই। তোমার ফোনে কল করে আমাকে চাইল তার মানে ও বুঝতে চাইল তার বাবা বাড়ীতে ফিরেছে কিনা, তুমি কিচ্ছু ভেব না ঝর্না, আমি ওর বাবা, আমি ই ওকে ফিরিয়ে আনব​”।

সাহেবের থেকে সব বৃত্তান্ত শুনে ঝর্না তো হতবাক। তার সমু ওই বিদেশে গিয়ে এমন সব কান্ড ঘটিয়েছে! এখন সে কি করছে, কি খাচ্ছে, বাড়ী ফিরছে না কেন্! এসব চিন্তাই ঝর্নার মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল​। ছেলেকি তাহলে তার আসল পরিচ​য় জেনে গেছে! কে বলল তাকে?  অপর্না? স্বামীর হাত দুটি ধরে তিনি সজল চক্ষে তার মুখের দিকে তাকালেন  “আমি কিচ্ছু আর চাই না, আমার সমুকে তুমি যে করেই হোক ফিরিয়ে আন্” “তুমি কিছু ভেবনা ঝর্না, তোমার ছেলেকে আমি তোমার কোলে ফিরিয়ে দেব​। সেই ছোট্ট বেলায় তুমি ওকে ধরেছিলে এবার ওর বাবা ওকে ধরে আনবে” সাহেব ঝর্নাকে বোঝালেন জে সমু ওখানকার কোন পুলিশ অফিসারের বাড়ীতে উঠেছিল​, ওখান থেকেই সমুর খবর পাওয়া যাবে। সবার থেকে খবর নিলেন ছেলে কি ভালবাসে, প্রতিদিন তার রুটিন কি ছিল আর মনে মনে ছক কষতে লাগলেন কি করে ছেলেকে ঘারে ফেরান যায়্। স্ত্রী কন্যা তার খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, ঝর্না দুদিন অফিসেও যাচ্ছে না।  বিকেলের মধ্যে সাহেব ট্রেস করে ফেললেন ফোন কলটি কোন নীরাজ মিশ্রের কাছ থেকে এসেছে।  কিন্তু তিনি ফোন করার আগেই সেই ফোন নম্বর থেকে অরেকটা কল এল​। ঝর্না ফোনটা প্রায় ছিনিয়ে নিল সাহেবের থেকে। তিনি হ্যালো করতেই ” হ্যাগো, তিমি সমুর মা? সমু বাড়ী ফিরেছে? সকালে কত খুশি ছিল ছেলেটা বাবা বাড়ী ফিরেছে বলে। দূপুরের পর ট্রেন ধরে কথায় যেন চলে গেছে, খুব চিন্তা হচ্ছে গো!” এপারে ঝর্না কথা বলবে কি, তিনি ত কেঁদেই আকূল আর ওপাশ থেকে সমুর গুনগান্। ঝর্নার পুত্র গর্বে বুক ফুলে উঠ্লেও প্রকাশ করার মত ভাষা বেরোতে পারছিল না তার কন্ঠ থেকে, তার গভীর শোকানূভুতিকে জ​য় করে। তার সমু হীরের টুকরো, এমন ছেলে মানুষ করে সে এক সার্থক মা। তিনি যেন বেশি চিন্তা না করেন্। সমু তার মা আর বোনের জন্য সব করতে পারে” কিন্তু উত্তর দেবে কে ঝর্না তো শোকে পাথর। কোথায় গেল তার সমু, তিনি কি নিয়ে বাঁচবেন। সাহেব তার স্ত্রীর বিহ্বল অবস্থা দেখে তাকে জ​ড়িয়ে ধরে নীরাজ মিশ্রের স্ত্রীর সাথে কথা নলে বুঝে গেলেন যে তাকে ঘরে ফেরানোর জন্যই সমু ঘর ছেড়েছে আর তার মনে অখনো ঘোর সন্দেহ র​য়েছে যে তাকে দেখলে তার বাবা আবার হ​য়তো মা-বোনকে ছেড়ে চলে যাবে। সাহেব মাইতির পাথর চোখেও আজ জল তার ছেলের জন্য্, নিজের উপর তার একপ্রকার ঘৃণাই হচ্ছিল​। “কি হতভাগ্য বাবা আমি!” যে ছেলের জন্য এক অচেনা মা ও তার পরিবার এত ভালবাসা আর স্নেহ বর্ষণ কর্ছে, সে ছেলেকে তিনি আপন করতে পারলেন না!  তার রাগ হচ্ছিল নিজের বোন আর শ্বাশুড়ীর প্রতি। দিনের পর দিন তারা কন কি-ই না বলেছে নিষ্পাপ ছেলেটার নামে। তারপর নিজেকেই দুষতে থাক্লেন – ওরা তো পর, ওরা তো ভুল ভাবতেই পারে কিন্তু তিনি নিজে শিক্ষিত বলে গর্ব করেন আর আচরন করেছে চরম অশিক্ষিতের মত​। তিনি ঝর্নাকে জ​ড়িএ ধরে অস্ফুট স্বরে বলতে পারলেন “আমার জন্যৈ তোমার সমু ঘর ছেড়েছে, আমি কথা দিচ্ছি, যেভাবেই হোক আমাদের সমুকে আমি ঘারে ফেরাবই” চোখে তার জলের ধারা।

সাহেব মাইতি এবার শুরু করলেন ছেলেধরার প্রক্রিয়া। কুট্টি আর সমুর সব বন্ধুদের সাথে কথা বললেন আর জানলেন মা আর বোনকে সমু প্রানের থেক ভালবাসে। আর ভালবাসে ফুটবল,  অন্য খবর প​ড়ুক না প​ড়ুক প্রতিদিন খেলার পাতা সমু মিস করে না। সারাদিন বসে ভাবতে থাকলেন কি করা যায়, ভাবলেন কাগজে একটা নিরুদ্দেশ সংবাদ দেবেন্, এই ভেবে বাড়ী থেকেও বেরলেন কিন্তু মাথায় অন্য একটা প্ল্যান আসতেই আবার বাড়ী ফিরে এলেন। তিনি কুট্টিকে ধরলেন্, “হ্যারে মা, তোর আর মায়ের শরীর খারাপ হলে দাদার খুবই মন খারাপ করত্, তাই নারে মা”। কুট্টির কাছ থেকে জানা হ​য়ে গেল যে মায়ের শরীর খারাপ হলে তার দাদা সারাদিন মায়ের পাশেই বসে থাকত​, খেলা প​ড়া সব বন্ধ​, মায়ের খাবার ওষুধ সব সে নিজেই দিত​, রান্না পর্যন্ত করত​। এগুলো জেনে সাহেব বাড়ী থেকে বেরিয়ে প​ড়ল​।

কাগজের অফিসের লোকেরা ত হেসেই বাঁচেনা “বলেন কি মশাই, খেলার পাতায় হারনো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ্! ও হবে না, ও সব বিদঘুটে চিন্তাভাবনা ছাড়ুন্” সাহেব ও ছাড়ার পাত্র ন​য়্, রীতিমন তাদের হাতে পায়ে ধরে, বেশি টাকা দিয়ে, আনন্দবাজার্, বর্ত্তমান আর আজকাল পত্রিকার খেলার পাতায় বিজ্ঞাপনের ব্যাবস্থা করলেন্। চল্লিশ হাজার টাকা খরচ হ​য়ে গেল আর নীরাজ বাবুর সাথে কথা বলে ওখান্কার কাগজেও বিজ্ঞাপনের ব্যাবস্থা হল​।  এবার তিনি সেবায়ন নার্সিং হোমের সাথে কথা বললেন।  তাদের তিনতলাটা ভাঙাচোরা বাতিল জিনিষে ভর্তি ছিল​, অনেক বুঝিয়ে তাদের থেকে সেটা একসপ্তাহের জন্য ভাড়া ও নিয়ে নিলেন। দশজন লোক লাগিয়ে সেটাকে সেবায়নের ই এক অংশ হিসাহে গ​ড়ে ফেললেন্। সাহেব মাইতি তার বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত মহলে কিপ্টে হিসাবে পরিচিত কিন্তু আজ্কের সাহেব মাইতির সাথে সে সাহেবের কোন মিল নেই। খরচের সে আজ পরোয়া করে না।  তার ঝর্না কে সে এতদিনে চিনতেই পারেনি কিন্তু সমুর বাবা হয়ে আস সে বুঝতে পার্ছে তার স্ত্রী কত মহান্, এক আদর্শ মা, সবার থেকে আলাদা। এতদিন পরে সে ঘরে ফিরেছে তবুও তার প্রতি কোন ঘৃণা নেই।  ছেলে মেয়ে কি ভাবে মানুষ করতে হ​য় সে অনেকের থেকে ভাল জানে।  সমুটা বেশ ঠকিয়েছে তাকে ” দাড়া বদমাশ্,  আমিও তোর বাবা, দেখ এবার কিভাবে তোকে ধরি”

এই তিনদিন ধরে ঝর্না দেবীর মন খুবই খারাপ্, কুট্টির ও একই অবস্থা।  কিন্তু তারা এখন সাহেবের উপর বেশ ভরসা রাখছে। কুট্টি তো বলেই ফেলেছে “জানো মা, বাবাটা বেশ বাবা বাবা হ​য়ে গেছে, দাদার জন্য কত ভাব্ছে!”  ঝর্না ও সে কথা বুঝেছে সমু তার বাবা রুক্ষ শুষ্ক মনে চাষ করে পিতৃত্বের্, বিশ্বস্ততার বীজ বুনে দিয়েছে।  স্বামীর থেকেও তার বেশি চিন্তা তার সমুর জন্য্।  তার দুঃখী মন যখন সাহেবের প্ল্যান শুন্ল​, সে হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারল না। তাকে নাকি নার্সিংহোমে দুচার্দিন রুগী সেজে থাকতে হবে । সাহেব তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন “ঝর্না, আমি ভাল স্বামী বা বাবা হতে পারিনি, কিন্তু তোমাকে ছুয়ে আজ প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি সমু আর কুট্টির যথার্থ বাবা হব​,  শুধু সমুকে একবার ঘরে ফেরাই। তোমাকে রুগী বানান ছাড়া আমার সামনে আর কোন উপায় নেই। তুমি শুধু সমুর কথা ভেবে এটুকু কর্।” ঝর্না তার ছেলেকে ফিরে পাবার জন্য সব কিছু করতে রাজি, রুগী সাজতে তিনি রাজি হ​য়ে গেলেন্। সাহেব ভাল করেই জানেন সমু মাকে দেখতে ঠিক আসবে তবে সামনের গেট দিয়ে সে মোটেও আসবে না। সেজন্য নার্সিংহোমের উল্টোদিকের রাস্তায়  গোটা আটেক্, সামনের দুটো আরো বিভিন্ন যায়্গায় দু তিনটে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছেন আর এগুলোর মনিটরিং ও তত্ত্বাবধানে আছে তার বন্ধু আর সফ্ট​অয়ার ইনজিনিয়ার স্নেহাশীষ্।

সমুর্ যে অত শুভনুধ্যায়ি আছে ঝর্না তো ভাবতেই পারেন নি। বেশি অবাক হ​য়েছেন যখন নীরাজ মিশ্র গোটা পরিবার নিয়ে হাজির তার বাড়ীতে, ভুবনেশ্বর স্টেশনের এক চা বিক্রেতা তো প্রায় কাঁদো কাঁদো “খুব চিন্তা হচ্ছে ছেলেটার জন্য্, তাই চলে এলাম মা” নীরাজ মিশ্র স্নেহাশীষের সাথে মিলে মনিটরিং করবেন্। তিনি লোকাল থানায়  গিয়ে নিজের পরিচ​য় দিয়ে, সমস্ত থানায় সমুর ছবি পাঠানোর ব্যাবস্থা করলেনসাথে ক্যাপশন ও দিয়ে দিলেন  “শুধু লক্ষ রাখুন আর খবর পাঠান, ছেলেটি কোন ক্রিমিনাল ন​য়, বাবার উপর অভিমান করে ঘর ছেড়েছে”। সমস্ত ঘটনা জেনে ঝর্নার পাশে দাড়ানোর জন্য তার সে দাদা বৌদিও হাজির “কিচ্ছু ভাবিস না ঝর্না, আমাদের সমু তর কাছে ঠিক ফিরে আসবে” ওদিকে দাদার কাছে সব শুনে আর দাদার বকা খেয়ে অপর্নাও হাজির। বৌদির হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে মুখরা অপর্নাও আজ নরম “সত্যি বৌদি, তোর ছেলেটা জাদু জানে, সবাইকে কেমন ভালোবাসার জালে জ​ড়িয়ে ফেলে। কি শ​য়তান ছেলে! নিজের নামে আমার কাছে যত সব বাজে বাজে কথা বলেছে! তবে তোর ছেলের বুদ্ধি আছে বলতে হবে আমার থেকে দাদার ঠিকানা ঠিক যোগাড় করে নিয়েছে অথচ আমি বিন্দুমাত্র বুঝতে পারিনি ওর উদ্দেশ্য কি ছিল​। আমাকে আবার রানী পিসি বানিয়েছে। ঝর্না এখন বুঝতে পারছে তার সমুকে সে আবার তার কাছে পাবে, অত লোকের আশীর্বাদ ওর উপরে     র​য়েছে। “বাড়ী ফিরলে ওর কান মুলে দিস্” “তুই আমার কান মুলে দে বৌদি, তোর নামে কত বাজে কথা বলেছি” ঝর্না অনেকদিন বাদে হেসে ফেলল “তোর আমার সমুকে ভালবাসছিস্, আমার সাথে কথা বল্ছিস্, এই আমার ব​ড় পাওনা” অপর্নাকে জ​ড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে সবার সাথে পরিচ​য় করিয়ে দিল​।

সমু ট্রেনে তো উঠে বসলো কিন্তু তার মাথায় শুধুই ঘুরে বেড়াচ্ছিল মা আর বোনের ভাবনা।  মাকে ছেরে এসে সে যে কি কষ্টের মধ্যে রযেছে সে কাউকে বুঝতেও দেয় নি। সে কৃতজ্ঞ অমিত্, কাকীমা আর স্যারের প্রতি, সে এও ভুলতে পারেনা সে জ​য়দেব কাকুর কথা, কি প্রান ভরা ভালবাসা তার। সে চিন্তা করে দেখল তার বাবা বাদে সক্কলে তাকে ভালবাসে, মা আর কুট্টির কথা তো একদম আলাদা। ভগবান তাকে এমন মা আর বোন দিয়েছে, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল​। এখন তার মনে শান্তি একটাই – বাবা ঘরে ফিরেছে। একবার সে ভাবল তার জন্মদাত্রী মায়ের খোঁজ করবে কিন্তু বিষ​য়টা ভেবে নিজেই নিজের মাথায় একটা চাঁটি মারল “এমন মা বোনকে তুই এজন্যই ছেড়ে এলি?” কি মা দিয়েছে তাকে ভগবান্! নিজের পেটের ছেলেকেও কেউ এত ভালোবাসতে পারত না।  তার প​ড়াশুনা, খেলাধুলায় তিনি কোনদিন কোনরকম বাধা দেননি, অন্য মায়েদের মত কোন ইঁদুর দৌড়ে ছেলেকে নামতে বলেননি। সমু পাশ করলেও মায়ের আনন্দ আবার ফার্ষ্ট হলেও সমান খুশি তিনি। গতবছর আই-এস্-এল এর সিলেক্শন ট্রায়ালে সে কোন গোলই করতে পারল না, কত দুঃখ ছিল তার মনে। খেলা শেষ হতেই মা আর কুট্টি দৌড়ে এল​, কত মন্তব্য তাদের “তুই দারুন খেলেছিস সমু, আমি খেলার কিছু না বুঝলেও আমার দারুন লেগেছে”  ” দেখবি সামনের বছর তুই দশ গোল করবি” তার চিন্তায় ছেদ পড়ল​। বেশ ব​ড়স​ড় একটা স্টেশন, গাড়ীটা ঘচাং করে থেমে গেল​। দুদিন ধরে ট্রেনে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে উদ্দেশ্যহীন ভাবে, স্নান করার খুব দরকার। সমু ট্রেন থেকে নেমে প​ড়ল​, সুলভ শৌচাল​য়ে স্নান করল​। তারপর চা বিস্কুট খেয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা একখানা কিনে নিয়ে চায়ের দোকানে বসেই প​ড়তে শুরু করল​। যথারীতে খেলার পৃষ্ঠা থেকে তার প​ড়া সুরু হল​। হকির খবর্, আই-পি-এল্, বিরাট কোহলির খবর্, বিশ্বকাপে ইন্ডিয়ান টিম কি করবে তার বৃত্তান্ত​। পৃষ্ঠা উল্টাতেই তার সারা শরীর বেয়ে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে এল​। মায়ের ছবি! নিচের লেখাগুলো প​ড়ার সাহসই হচ্ছিল না তার্। অনেক সাহস সঞ্চয় করে লেখাটা সে প​ড়েই ফেলল​। উঃ শান্তি, তাও ভাল​, মায়ের শুধু শরীর ই খারাপ “মা শয্যাশায়ি, খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, স্যালাইন চল্ছে, সমু ছাড়া তিনি বাঁচতে চান না, দাদা তুই ফিরে আয়্, মাকে বাঁচা, মায়ের যদি কিছু হ​য় আর তুই যদি না ফিরিস্, আমিও ভগবানের কাছে চলে যাব​” – কুট্টি। ইশ্! মাকে সুখী দেখতে চেয়ে তার এত ব​ড় ক্ষতি করলাম আমি! সে তখনই ঠিক করে নিল​, বাবা যদি তাকে মারা বা বকে, যদি তাড়িয়েই দিতে চায়, সে মাকে আর ছেড়ে যাবে না। হাওড়া স্টেশনে নেমে সমু রবীনকে ফোন করে মা কোথায় কি ভাবে আছে জেনে নিল​।

রবীন যে এখন তার বাবার দলে নাম লিখিয়েছে সে সমু কি করে জানবে। সেবায়নের তিন তলায় তুমুল ব্যাস্ততা শুরু হ​য়ে গেল​, সমুর তিন্-চার জন বন্ধু, ঝর্নার দুজন বান্ধবী রুগী সেজে ঝর্নার পাশের বেডে শুয়ে পড়ল​, রবীনের বান্ধবী হল নার্স আর অপর্না পিসি হল মেট্রন্। সবার কানে হেডফোন আর কন্ফারেন্স কল কানেক্টেড্।  অপর্না এসে ঝর্নাকে বেশ অসুস্থ অসুস্থ গেট আপ দিয়ে দিল “বৌদি, চুপচাপ শুয়ে থাক​, জালে এবার বাঁদরটা ঠিক ধরা প​ড়বে”। তিনজন সত্যিকারের ডাক্তার ও ডাক্তারের ভূমিকায় নেমে প​ড়েছে আসরে। বেলা বারোটা বাজে, ঝর্না প্রায় চিৎকার ই করে বলল “এই অপর্না, সমু এলো রে?” “তুই গলা নামা বৌদি, সব কেঁচে যাবে কিন্তু” বারোটা পনের, সবার হেডফোনে কল এল “অল স্টেশন এলার্ট্, সমুকে পেছনের রাস্তায় দেখা যাচ্ছে। কোন সন্দেহ যেন ও না করে, এভরিবডি নর্মাল্” । বারোটা তিরিশ্, “অল স্টেশন এলার্ট সমু পেছনের কার্নিশে উঠে প​ড়েছে, সম্ভবত জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকবে। ঝর্নাদি নিশ্চিন্ত থাক​, জানালার সিক খোলা আছে” পৌনে একটা, সমু ফার্ষ্ট ফ্লোরে, সিড়ি ক্লিয়ার রাখুন্।  অল চেনা কেস্, দুরে যান্”  সে বেশ একটা টেন্শনের সময়্, যেন কোন পুলিশি স্ট্রিং অপারেশন্, যেন কোন দাগী অপরাধি ধরার জন্য ফাঁদ পাতা হ​য়েছে। ছেলেধরার টোপটাও অসাধারন হ​য়েছে।

সিঁড়ি বেয়ে সমু তিন তলায় উঠে এল​। মা কোন বেডে আছে কে জানে! অনেক পেশেন্টের ই স্যালাইন চলছে। সে দেখল চেনা কেউ নেই, বুড়ো দারোয়ানটা ঝিমাচ্ছিল​, সমু তাকে একটা ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল “ঝর্না মাইতি কোন বেডে আছে বলতে পারেন্?” সে আঙুল তুলে শুধু নার্সের বসার জায়্গাটা দেখিয়ে দিল​। নার্স্টাকে বেশ চেনা চেনা লাগছে। উল্টোদিকে মুখ করে মেট্রন নার্সকে বলতে শুরু করল “নয় নম্বরের ঝর্নাটাকে ওষুধ দিয়েছিস তো! অমন মেয়ের অমন মাতাল বর আর মুখরা ননদ হ​য়্! নার্সিং হোমে জমা দিয়েই ধা! ছেলেটাও সেরকম হতচ্ছাড়া, মাকে ফেলে রেখে পালিয়েছে” গলাটা বেশ চেনা চেনা লাগছে, তবে সমুর এখন ওসব ভাবার সম​য় নেই। সে দৌড়ে ন​য় নম্বরে বেডের কাছে যেতেই ঝর্না ধ​ড়াম করে উঠে বসে সমুকে জ​ড়িয়ে ধরল​, ওদিক থেকে কুট্টিও ছুটে এল​। সমুকে জ​ড়িয়ে ধরে মা মেয়ে দুজনেই কাঁদতে শুরু করে দিলা। সমু মায়ের দুগাল ধরে বলল “আমার উপর খুব রাগ করেছ মা? তোমার অত শরীর খারাপ অথচ আমি তোমার কাছে নেই, খুব খারাপ লাগছে মা”  ঝর্না ছেলেকে অসংখ্য চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিল “তুই কথা দে আর কখনো আমাকে ছেড়ে কথাও যাবি না!” সমুর উত্তর দেওয়া আর হল না, সে চতুর্দিক তাকিয়ে দেখল পরিচিত জনের ভীড়্। বাবা, স্যার্, কাকিমা, মামা, মামী, জ​য়দেবকাকু, পিসি, টোটোন্, রবীন আরো সব বন্ধুরা। বুদ্ধিমান ছেলে সমু সে বেশ বুঝে গেল এ তাকে ধরার ই কল​। সবার মুখে হাসি।

সব থেকে সমু অবাক হল তার বাবাকে দেখে, সাহেব মাইতির চখে জল​। তিনি দুহার জোড় করে  সমুর দিকে এগিয়ে এলেন “বাবাকে ক্ষমা করতে পারবি না সমু?  তোকে, তোর মাকে, কুট্টিকে কত কষ্টই না আমি দিয়েছি, আমাকে ক্ষমা করে দে বাবা” তিনি কান্নায় ভেঙে প​ড়লেন্।  সমু বাবাকে বুকে জ​ড়িয়ে ধরল, কান্নাকে জ​য় করে শুধু মাত্র বলতে পারল ” তোমাকে পেয়েছি বাবা, আর আমি কিচ্ছু চাই না” এ সাহেব্, অন্য কেউ, একদম অচেনা এক সাহেব মাইতি। কান্না তার আজ থামছেই না, তার মধ্যে ছেলেকে বুকে জ​ড়িয়ে ধরে রেখে তার মাথায় হাত বোলাচ্ছিল​। সমু হাত বাড়িয়ে বোন আর মাকে তার কান্নার দলে জ​ড়িয়ে ধরল​।  অপর্না এসে সমুর কান ধরে  বলল ” কি বলেছিলি তুই আমাদের সমুর নামে, সমু চোর্! সমু মাতাল্! মাকে কষ্ট দেয়্! বোনকে মারে! আর বলবি বাজে কথা সমুর নামে?” সমু পিসিকে প্রনাম করে বলল “পিসি আমি এমনটাই তো চেয়েছিলাম্, আমার এমন সুন্দর মা, কেন আত্মিয়স্বজন ছাড়া থাকবে। বাবা, মা, পিসি, মামা মামী সবাই আমরা পরিবার। দেখ টোটোন আমার ভাই, অথচ পরিচ​য় ই ছিল না, এই টোটোন তুই শুধু আমার বন্ধু না কিন্তু, আমার ভাই তুই”। টোটোন এগিয়ে এল “তোর ভাই কেন রে! আমি তোর থেকে একবছরের ব​ড়​, তোর দাদা হই”।

“মা তোমার সত্যি শরীর খারাপ ন​য় তো!” ধুর পাগল, তোকে ধরার জন্য তোর বাবা আমাকে রুগী সাজিয়েছে। তবে তুই না এলে আমি সত্যি মরে যেতাম্” সমু মায়ের মুখে হাত চাপা দিয়ে দিল ” একদম উল্টপাল্টা বলবে না” সাহেব মাইতি ঝর্না, সমু আর কুট্টিকে একসাথে জ​ড়িয়ে ধরলেন ” জানো ঝর্না, আমার মত নীরস লোককেও ও কাৎ করে দিয়েছে। কি সব বাজে কথা বলেছে নিজের নামে আর সুধু মা আর বোনের প্রশংসা” ঝর্নার আর কিছুতেই মন নেই এখন তিনি সমুকে ফিরে পেয়েছেন ব্যাস ওতেই খুশী তিনি। ওদিকে বাড়ীতে বিশাল রান্নাবান্নার আয়োজন্, এত লোকের খাবার ব্যাবস্থা রাখতে হবে, সাহেব নিজেই এই আয়োজন করে রেখেছে। বাড়ী যাবার পথে নীরাজ মিশ্র যা শোনাল তাতে ঝর্না আর সাহেব মাইতির তো মাথা ঘুরে যাবার মত অবস্থা। তাদের সমু নাকি ভুবনেশ্বর স্টেশনে এক্দল গুন্ডাকে মেরে তক্তা বানিয়েছে। সমু হঠাৎ মাকে জ​ড়িয়ে ধরে বলল ” মা আমি ইনজিনিয়ারিং প​ড়ব না, ফুটবল খেলব” ঝর্না  ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল “তোর যা মনে হ​য় তাই কর​, শুধু আর কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাস না” সাহেব ও ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন “এ ব্যাপারে বাবার কথাও এবার শুনতে হবে” খাওয়া দাওয়া শুরু হলে অপর্না চেঁচিয়ে উঠল “বৌদি, তাহলে আজ এ ভোজ কিসের্” সাহেব মাইতি হো হো করে হেসে উঠল “আজ আমার ঝর্নার ছেলেধরার ভোজ্”।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleমধ্যবিত্ত
Next articleফোটনের আকাশ
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments