।সাত।
এই সব পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে গৌরী কি ঘুমিয়ে পরেছিল? হয়তো একটু ঝিমুনি এসেছিল হঠাৎ কাঁধে একটা টোকা পরতেই ঝোলা মাথাটা সোজা হয়ে গেল। পাশে আর্দালি সুরেশ দাঁড়িয়ে – সাব, আপকো অন্দর বুলায়া।
আরে অন্দর-টা আবার কি? এই মাঝ দুপুরে আবার কি ফৈজত রে ভাই। গৌরীর মাথাটা সাফ হয়ে এসেছে, সে একটু গলাটা ঝেড়ে জিজ্ঞাসা করলো – সে আবার কি? কোন অন্দরের কথা বলছো সুরেশ? সুরেশ তার ভাঙা বাংলায় বললো – বড়া সাহেবের ঘরমে, স্যার।
মরেচে … গৌরী প্রমাদ গুনলো। সেই কখন সকাল এগারটার সময় একবার সাহেব দেখে ফেলেছিল তার লেট এন্ট্রি। সে তো কখন মিটে গেছে, মানে দুটো কড়া কথা শোনানোর হোলে তো তখনই ভেতরে ডেকে পাঠাত, এখন কি? ঘড়িতে প্রায় একটা চল্লিশ, মানে আর একটু পরেই লাঞ্চ শেষ হবে। এদের নিয়ে তো মহা বিপদ, গৌরী নেহাতই অপ্রশন্ন মুখে নিজের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। প্যান্টের ফাঁকে ফাঁকে সকালের থিন অ্যারারুট বিস্কুটের গুড়ো পরেছিল, সেগুলো একটু হাত দিয়ে ঝেড়ে নিল। হাত দিয়ে একবার মাথায় সামান্য যা এলো মেলো চুল রয়েছে সেটা একটু পাটে পাট করে নিল। একবার সাহেবের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলো, দরজা ভেজান। ছোট্ট করে আর চোখে একবার সেই আলমারীর কাঁচের মধ্যে নিজের মুখটা দেখলো … বহু যুদ্ধে পরাজিত হওয়া একজন মধ্য পঞ্চাশের মানুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে ভেংচি কাটছে। কাটুক, ওর তো আর বিপদ নয়, বিপদ গৌরীর। সে আর দেরি না করে ঘরের মধ্যে নানান ভাবে সেট হয়ে থাকা চেয়ার আর টেবিলের জঙ্গল কাটিয়ে প্রদীপ বটব্যালের ঘরের দিকে এগিয়ে চললো।
ঘরের দরজায় একটা টোকা দিয়ে নিজের গলাটা একটু ঝেড়ে গৌরী দরজাটা একটু ঠেললো … স্মুদলি কোন শব্দ না করে স্যুয়িং ডোরটা একটু ফাঁক হয়ে গেল। তার পেছনেও একটা ঘষা কাঁচের দরজা। গৌরী সেটাও ঠেলে তার মুখটা বাড়াল … ভেতরটা একটু অন্ধকার, গোটা দু-তিন অল্প পাওয়ারের লাইট ঘরে জ্বলছে আর প্রদীপ বটব্যালের টেবিলের ওপর একটা টেবিল ল্যাম্প। এমনিতেই ঘরে এ.সি. আছে বলে জানলা টাললা সব বন্ধ। সেই আধো অন্ধকারেই গৌরী চোখ কুঁচকে দেখলেন যে প্রদীপ তার টেবিলেই বসে কি একটা ফাইল গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে আর পাশে একটা সোফায় বসে অমল ত্রিপাঠি একটা চিঠি দেখছে … দুজনার কেউই তাকে লক্ষ্য করেনি। গলা ঝাড়ার মতো করে একবার একটু কেশে গৌরী দরজায় দাঁড়িয়েই বললো …
গৌরী। স্যার, আসব …।
ফাইল থেকে প্রদীপ বটব্যাল মুখ তুলে তাকালেন – ও হ্যাঁ, গৌরীবাবু, আসুন।
অমল ত্রিপাঠিও চোখের সামনে থেকে চিঠিটা নামাল – আরে গৌরী, এসো ভেতরে এসো।
হঠাৎ বাইরে ফ্লোরের আলো থেকে এই আধো অন্ধকার ঘরের মধ্যে এসে গৌরীর কেমন যেন অন্ধ অন্ধ লাগছে, কিছুই ভালো করে চোখে পড়ছে না। টেবিল চেয়ার সোফা সব যেন কেমন চাপ চাপ অন্ধকার। সামনের দুটো লোকও যেন জঙ্গলের আধো অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা দুজন বিপদজনক শ্বাপদ। একজনের তো মুখে বিশাল গোঁফ, চোখ দুটো বড় রসগোল্লার মতো। অন্ধকারে চোখের কালো মনির থেকে সাদাটা বেশী চোখে পরে। আর ত্রিপাঠি আবার আজকে কালো স্যুট পরে এসেছে, হঠাৎ ভেতরে ঢুকে কেবল ভিতরের সাদা জামা আর চশমাটা চোখে পড়ছে। কিন্তু সম্ভাষণটা তো সেরকম খারাপ লাগলো না। গৌরী ধরেই নিয়েছে যে আজ দেরি করে এসে বসের চোখে পরে যাওয়ায় তুমুল ঝাড় কিছু একটা হবে। তার অপর প্রায় বছর নয়েক তার কোন উন্নতি হয়নি, কাজেই এই ফ্লোরে তার খুব একটা দরকারও নেই হয়তো … কি জানি অন্য কোথাও আবার পাঠিয়ে না দেয়। আর কত বছরই বা আছে রিটায়ার করতে, এখন আর মেলা ঝড় ঝাপটা ভালো লাগে না।
গৌরী আবার একটু খুক খুক করে কেশে বললো – স্যার, আমায় ডেকেছিলেন।
অমল ত্রিপাঠি উঠে তাকে নিয়ে তার পাশে বসিয়ে দিল – আরে বস তো আগে, ব্যাস্ত হয়ো না। কথা তো হবেই, একটু সময় লাগবে।
এই সময় প্রদীপ বটব্যালও গম্ভীর গলায় বললো – আজকে সকালে যা হন হন করে ঢুকলেন, ডাকার আর ফুরসৎ পেলাম না। তাও আবার যা ঘেমে গিয়েছিলেন, ভাবলাম একেবারে লাঞ্চের সময়ই ডাকবো। আর অমলদাও লাঞ্চের আগে ফ্রি নয়। যাক, আগে কফি আর স্ন্যাকসটা করে নেওয়া যাক, তারপর কথা হবে।
এই বলে বটব্যাল ইন্টারকমে তিনজনের জন্য কফি, প্যাটিস আর কেকের অর্ডার দিলেন। এ ফ্লোরের অম্বুর সাত দিনের বাসি মাল নয়, সোজা কাফেটেরিয়া থেকেই আসবে।
ততক্ষণে গৌরীর চোখ অনেকটা ধাতস্থ হয়ে এসেছে, আসে পাসের জিনিস ভালো নজরে আসছে। তাও কয়েকবার চোখ পিট পিট করে একবার বটব্যালের দিকে আর চোখে তাকালেন … কই, রাগ কোথায়? আশুতোষ মার্কা বিশাল গোঁফের তলা দিয়ে হাসি মুখের কয়েকটা সাদা দাঁতও চোখে পরলো। এ আবার কি? টর্চারের কোন নতুন ট্যাকটিকস নাকি? ভালো করে খাইয়ে দাইয়ে একেবারে অন্য বাড়ীতে বিদায় নয়তো? টেনশানেই বেচারা গৌরী এই ঠান্ডা ঘরের ভেতরেও কেমন ঘেমে গেল। যাচ্চলে, গৌরী মনে মনে একগাদা গালাগাল খাবার জন্য রেডি হয়ে এসেছিল, এতো দেখি কেক প্যাটিস আসছে। নাঃ, হিসাব একদমই মিলছে না আজকে। কিন্তু দুম করে ঝড়টা এলো ঠিক তখনই যখন গৌরী একটু ধাতস্থ হচ্ছিলেন।
প্রদীপ বটব্যাল তার গলাটাকে বেশ দেবব্রত বিশ্বাস মার্কা গম্ভীর করে হঠাৎ বললেন – আপনার সাথে কিন্তু খুব সিরিয়াস কিছু কথা আছে যা আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। আজ আপনাকে দেরী করে ঢুকতে দেখেই মনে পড়ে গেল। কি অমলদা, এখনই বলবো নাকি পরে?
অমল ত্রিপাঠি কি একটা ভাবলো, তারপর একটু গলাটা পরিস্কার করে বললেন – গৌরীকে তো কথাটা বলতেই হবে, আজকেই ব্যাপারটা ক্লিয়ার করতে হবে … তবে … দাঁড়াও কফিটা হয়ে যাক তারপরই না হয় …।
।আট।
ঘরের মধ্যে যে কজন নিজের ডেস্কে বসে লাঞ্চ সারছিল তারা বড় বড় চোখ করে বস প্রদীপ বটব্যালের ঘরের দিকে তাকিয়ে। ব্যাস, আজ গেলো … বুড়োর ধড়ে আজ মাথা থাকে কিনা কে জানে। দেরি করে ঢোকার সময়ে পরবি তো পর একেবারে বসের সামনে। অন্য কোন ডিপার্ট্মেন্টে পাঠিয়ে না দেয়। তাছাড়া বেচারার বয়স হয়েছে, অন্তত আট কি নয় বছর কোন প্রোমোশান হয়নি … এই ডিপার্টমেন্টের ওকে সেরকম দরকারও নেই বোধহয়, কাজেই অন্য কোথাও সরিয়ে দিতেও পারে, মানে স্রেফ ঝেরে ফেলা আর কি। আর তো কয়েকটা বছর, তার পরেই রিটায়ার করে ঘরে বসে থাকা, এই অবস্থায় একে নতুন দায়িত্বই বা কি আর দেওয়া যায়।
আস্তে আস্তে ঘড়ির কাটা দুটো পেরিয়েছে, ফ্লোরের লোকেরাও একজন দুজন করে ক্যাফেটেরিয়া থেকে ফিরে আসছে …। লাঞ্চের পরে আবার কাজ প্রায় শুরু। কিন্তু এই ঘরের মধ্যে একটা বিশেষ উত্তেজনা … সমীর, রমেন, বিশাখ, আর্য সবাই চেয়ারগুলো কাছাকাছি টেনে নিয়ে বসে আছে। গৌরীদা সেই যে প্রদীপ বটব্যালের ঘরে ঢুকেছেন … তাও তো প্রায় মিনিট পঁচিশেক হয়ে গেল, কিন্তু বেরোচ্ছেন কই? আরে বাবা, একটু দেরি করে আসার জন্য বসের ঘরে একটু ঝাড় খাচ্ছে … এই তো। তার জন্য প্রায় আধ ঘণ্টা? মাই গড, সত্যি সত্যিই মারছে না তো? নাকি বেচারার বয়স হয়েছে, ঘাবরে গিয়ে ফেন্ট করলো? এর মধ্যে সমীর, রমেন, আর্য … ওরা আবার একটু বেশী ফাজিল, ওরা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছিল। বিশাখ, নড়েন, গৌতম আবার কিছুটা হলেও সিমপ্যাথেটিক, ওরা একটু ঘাবরে গিয়ে বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। গৌরীদাকে ওরা কিছু না হোক বারো চোদ্দ বছর ধরে চেনে … আজকালকার মতো ওভার স্মার্ট না হোলেও গৌরীদা অডিটিং আর ফাইন্যান্সের কাজ ভালোই জানেন, শুধু নিজের ঢোলটা ভালো বাজাতে পারেন না। আর যেটা পারেন না সেটা হোল বসের মন রক্ষা করা মিস্টি মিস্টি কথা বলতে যেটায় সমীর বা রমেনরা ডাবল এম. এ.।
বিশাখ নড়েনের কানে কানে একবার বললো – যাঃ … ওরা ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেললো। বুড়ো মানুষ, না হয় একটু দেরীই হয়েছে তাই বলে এইরকম যাচ্ছেতাই করে অপমান করবে। প্রদীপদা তো এরকম ছিল না।
নড়েন। আরে তার অপর আবার ওপরের ফ্লোরের বস অমল ত্রিপাঠিও আছেন। বাপ, এক সাথে দুই বাঘ এক ঘরে। গৌরীদা একা কি করছে কি জানে।
এর পরের খবর আরো কনফিউসিং। ফ্লোরে যখন জল্পনা একটু থিতিয়ে এসেছে, সবাই ধরেই নিয়েছে প্রদীপ বটব্যালের ঘরে কোন সাঙ্ঘাতিক কান্ড চলছে ঠিক তখন কোথা থেকে অম্বু তার চপ্পল ফট ফট করতে করতে এসে হাজির। অম্বু হচ্ছে এই বাড়ীর অঘোষিত স্পাই। এই ফ্লোর বা অন্য ফ্লোরের অনেক গোপনীয় খবর তার কাছে অনেক আগে চলে আসে। কার প্রোমোশান অর্ডার এসেছে, কে আজ বসের ঘরে ঝাড় খেলো, কার মেয়ে প্রেম বিয়ে করে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেছে … এসব তার নখদর্পনে। সে কিছু না বলে এ টেবিল ও টেবিল ঘোরা ঘুরি করছিল। রমেন এসব খুব তাড়াতাড়ি বোঝে, সে হাঁক পারলো …
রমেন। এই অম্বু, কি ঘুর ঘুর করছিস, অ্যাঁ? কিছু খবর আছে নাকি?
অম্বু তৎক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়াল – আরে রমেনদা, কি বলবো, … খানিক আগে কাফেটের পিকলুর সাথে দেখা হোল। বসের ঘরে নাকি তিন ডিস খাবার অর্ডার ছিল। কফি, প্যাটিস … এই সব। খাবার অবশ্য ভিতরে চলেও গেছে।
অম্বু কথাটা বলেই হাওয়া। সে মাঝে মাঝে ক্যাফেটেরিয়াকে সংক্ষেপে ক্যাফেট বলে, রমেন এই নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাল না। সে সমীর আর আর্যর দিকে ফিরে বললো …
রমেন। সে কি রে ভাই। কোথায় আমি ভাবছি গৌরীদাকে ঘরে ডেকে ঝাড়ছে, এ যে দেখছি আদর করে খাওয়াচ্ছে।
বিশাখ ওধার থেকে খ্যাঁক করে উঠলো – তোমার এতো কি তাতে খারাপ লাগছে রমেনদা? বসেরা যদি এতদিন বাদে একটা লোককে তার সম্মানটা দতেই চায়, তাতে তোমার আপত্তিটা কি বলতো?
রমেন কেমন যেন থিতিয়ে গেলো, ঝট করে উত্তর দিতে পারলো না। তারপর নেতিয়ে পরা গলায় বললো – আরে ঠিক তা নয়। আমার খারাপ লাগবে কেন, তবে গৌরীদাকে তো কেউ সেরকম পাত্তা দেয় না, তাই। মানে আমি তো প্রায় এখানে তেরো বছর আছি, কোনদিন দেখিনি।
সমীর রমেনের পিঠে একটা খোঁচা দিল – মেলা কথা বারাস না। কখন দরজা ঠেলে বসেরা বেরিয়ে আসবে আর তুই ধাপ্পা খাবি। টেবিলে বসে কাজের ভান কর।
রমেন কথা না বারিয়ে চেয়ারটা একটু বেঁকিয়ে বসে পরলো যাতে দরজাটা খুললেই সে দেখতে পায়।
(To continue …)