কোড নেম প্রমিথিউস
রাত বারোটা। ইজিয়ান সাগরের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে স্পিডবোট। বোটে পাঁচজন বসে। আমি, বর্ণালী, সমুদ্র, ক্রিস আর স্যার। স্পিডবোটের ব্যবস্থা ক্রিস করে দিয়েছিল। স্যারের বাড়ি থেকে দু কিমি দূরে যেখানে মাঝিদের বস্তি, সেখানে তার বন্ধু পলকে বলে তার স্পিডবোটটা চেয়ে নিয়েছে। ক্রিস নৌকা চালাতে জানে, সেই চালাচ্ছে বোটটা। আর ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই “লাইফলাইন”, মানে আমাদের বোটটা পৌঁছে যাবে সেই দ্বীপে।
চারিদিক দিয়ে ঝড়ের বেগে সমুদ্রের নোনা বাতাস চলে যাচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে ভরসা স্পিডবোটের সার্চলাইটের আলো আর রাডার। সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে ডেকের ওপর। স্যারের কোলে রাখা একটা বড় সুটকেস। পাথরের ট্যাবলেটটা সেই সুটকেসের মধ্যেই কায়দা করে রাখা, যাতে জলে না ভিজে যায়।
স্পিডবোটের ওপর বসে থেকে দেখছিলাম, চারদিক। সমুদ্রের ঢেউ আর গর্জনে স্পিডবোটটা পুরো দুলছিল, কিন্তু তার মধ্যেও তিরবেগে এগিয়ে চলেছে সেটা। অন্ধকারের মধ্যে শুধু সামনেটুকু বাদ দিয়ে চারদিকই শুধু কালোয় ঢাকা লাগছিল। এতটাই কালো, যে দেওয়াল বললেও অত্যুক্তি হবে না।
সঙ্গে অস্ত্র বলতে শুধু দুটো পিস্তল জোগাড় করা গেছে। ক্রিস আর সমুদ্র সে দুটো নিয়েছে। দুজনেই নবিশ এই গুলি চালানোর ব্যাপারে, আর কেই না জানে, অনভ্যস্ত হাতে বন্দুক চালানো নিজের পক্ষের লোকেদের কাছেও বিপদজনক। তাই বলে দেওয়া হয়েছে, একমাত্র ক্লোজ রেঞ্জ ছাড়া যেন কেউ গুলি না করে।
সবার চোখে মুখেই উৎকণ্ঠা। উত্তেজনার পারদ প্রতি মুহূর্তেই চড়ছে।
হাইনরিখের ফোনের পর আমরা সবাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্রিসের গাড়িতে বেরিয়ে পড়ি। প্রায় বলার কারন, স্যারের কাছ থেকে পাথরের ট্যাবলেটটা নিয়ে একটা কালো স্যুটকেসে বিশেষভাবে ঢোকানো যাতে জল লেগে নষ্ট না হয়ে যায়। তার সাথে আরও কিছু ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি।
গাড়িতে উঠে যখন আমরা মাঝিদের বস্তিদের দিকে চলেছি, তখন একবার যেন মনে হয়েছিল, কেউ আমাদের ফলো করছে। একটা এক্সপ্রেসওয়েতে ক্রিস যখন গাড়ি তুলল, দেখলাম, একটা সাদা ট্যাক্সি আমাদের ঠিক পেছন পেছনই আসছে। তবে মিনিট চল্লিশ পরেই ট্যাক্সিটা রাস্তা বদলে আমরা যেদিকে যাচ্ছি, তার উল্টোদিকে চলে যায়। আমি ক্রিসকে ইঙ্গিত করে গাড়িটা স্লো করতে বলেছিলাম, যাতে অনুসরণকারীদের মুখটা দেখা যায়। গাড়িটা আমাদের পাশ দিয়েই দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল, কিন্তু ডার্ক টিণ্টের কাঁচ হবার জন্য ভালো বুঝতে পারলাম না কে ফলো করছিল আমাদের।
বর্ণালী চাপা গলায় বলেছিল, “হাইনরিখের লোক কি? তাহলে ওদের পাল্টা ফলো করব।”
আমি বললাম, “হতেও পারে। কিন্তু, এখন সময় নেই। দেরি করে লাভ নেই।“
এইসব বসে বসে যখন ভাবছিলাম, তখন খেয়ালও করিনি যে দ্বীপ কাছেই এসে গেছে। হুঁশ ফিরল যখন স্পিডবোটটা একটা হ্যাঁচকা টানে থেমে গেল।
আমরা জল ভেঙ্গে ভেঙ্গে নামলাম। হাতে টর্চ প্রত্যেকের। ক্রিস দড়ি দিয়ে বেশ করে বাঁধল স্পিডবোটটার সাথে কাছের একটা বড় পাথরের সাথে। জিজ্ঞেস করাতে বলল, “শুধু নোঙরে ভরসা পাচ্ছি না। যা ঝড় আসছে, শুধু নোঙরে নৌকা থাকবে না।“
চারদিকে ঘন অন্ধকার। ঝোপজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শুধু নিস্তব্ধতাই ভেসে আসছে। শুধু দূরে একটা লাইট হাউসের তীব্র আলো দেখা যাচ্ছে।
স্যার বললেন, “চল। ওরা খুব সম্ভবত দ্বীপের ধারেই যে লাইটহাউসটা রয়েছে, সেখানে রয়েছে।“
সমুদ্র বলল, “ কি করে বুঝলেন স্যার?”
স্যার দেখালেন টর্চের আলোয়, “ঐ দেখ। লাইট হাউসের জোরালো আলোর নিচে, মাটিতে কতগুলো আলোর বিন্দু দেখতে পাচ্ছ? ঐগুলো খুব ভুল না হলে টর্চের আলো। ওখানেই ওরা অপেক্ষা করছে আমাদের। ওরা জানে, আমরা এসেছি। কারন স্পিডবোটটার আলো ওরা দূর থেকেই দেখতে পেয়েছে।“
অস্বীকার করব না, স্যারের কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য হলেও, বুকটা কেঁপে ওঠে। যাদের সামনাসামনি হতে চলেছি, তাদের মানুষ খুন করতে একটুও যে হাত কাঁপে না, তা এই কয়েকদিনে ভালই হৃদয়ঙ্গম করেছি। তবু তাদের মোকাবিলা করতে চলেছি আমরা।
নিজের দেশের মাটিতে পা রেখে, নিঃশ্বাসটা ফেলার মত ভাগ্য হবে তো আমাদের সকলের? প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব তো? নাকি আমাদের অভিযানের এখানেই ইতি হবে? এমনই এক নাম না জানা দ্বীপে পড়ে থাকবে আমাদের বুলেটবিদ্ধ শরীরগুলো, প্রকৃতির নিয়মে যা আবার মিশে যাবে মাটিতে?
নাহ, মনটা শক্ত করা দরকার। হাইনরিখের মত একটা পিশাচের হাতে যদি এই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্লু প্রিন্ট চলে যায়, পৃথিবীতে তৃতীয় মহাযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। এমনকি লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রানহানিও হতে পারে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড সুপারসোলজারগুলোর হাতে। এ হতে দেওয়া যায় না। যেকোনো মূল্যেই হোক, এই বিপদকে রুখতেই হবে।
আমি অবশেষে বললাম, “চলুন, যাওয়া যাক।“
সবাই আমরা মুখ বুজে এগোতে লাগলাম লাইট হাউসের দিকে। বলা হয়নি, এতক্ষণে বেশ একটা ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। খুব সম্ভবত বৃষ্টিও নামবে এখানে। একটু একটু শীতও যেন লাগছে।
পুরো রাস্তাটাই পাথর আর জঙ্গলে ঢাকা। পাথরগুলোর ওপর শ্যাওলা স্তরে স্তরে জমেছে। মাঝে মাঝেই পিছলে যাচ্ছিলামও। জঙ্গল ঘন নয় সেরকম, কিন্তু সাপখোপের ভয় তো আছেই। তাই সাবধানে এগোচ্ছিলাম। সামনে বর্ণালী, সমুদ্র, মাঝখানে স্যার আর পেছনে ক্রিস আর আমি। আমি একটা ভাঙা ডাল কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। হাতের কাছে কিছু না পেলে এটাই আত্মরক্ষার কাজে লাগবে।
মাঝে মাঝেই বড় বড় ঢেউ ভাঙ্গার শব্দ পাচ্ছিলাম। লাইট হাউসের আলো ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। একটা চাপা উত্তেজনায় নিজের বুকের হৃৎস্পন্দনই শুনতে পাচ্ছিলাম, হাপরের মত ওঠানামা করছে যেন।
হঠাৎ করেই পেছনে একটা খসখসে শব্দ। কেউ যেন পাতা মাড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের পাশ দিয়েই। ভয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো ফেললাম। কিন্তু, ঝোপঝাড় ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না।
ক্রিস জিজ্ঞেস করল, “কি? কিছু দেখতে পেলে?”
আমি মাথা নাড়লাম। এই সময়ে সবাইকে মিথ্যে একটা প্যানিকের মধ্যে ফেলে লাভ নেই, বিশেষত যেখানে কিছুই দেখতে পাইনি আমি। এখন এটা নিয়ে মাথা ঘামালে যে উদ্দেশ্যে এসেছি, সেটাই ব্যর্থ হবে। হাতে সময়ও কম। তাই দ্রুত পা চালালাম।
লাইটহাউসের আলোয় ধীরে ধীরে সামনের জায়গাটা স্পষ্ট হল। এমনিতে লাইটহাউসের বড় আলোটা বাদ দিয়েও সামনে দু-তিনটে আলো জ্বলছে, জেনারেটরের ঘটঘট শব্দ হচ্ছে। দশ বারো জন মূর্তিমান সশস্ত্র লোক দাঁড়িয়ে আছে সারি দিয়ে। আর যে ব্যক্তি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে গাঢ় কালো সাফারি স্যুট পড়ে, তাকে একবার দেখলেই খল প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হয়। লম্বা, চওড়া মানুষটা কম করে হলেও সাড়ে ছয় ফুট লম্বা। গালের বাঁদিকে একটা কাটা দাগ। চোখগুলো সরু, কিন্তু ক্রূরতায় ভর্তি। হাতে একটা বড় পিস্তল ধরা, আর অন্য হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট।
স্যার তাকে দেখেই চমকে উঠলেন। কিন্তু সেই ধাক্কাটা সাময়িক, তার পরেই তাঁর চোখগুলো রাগে লাল হয়ে যেতে থাকল। রগের দুটো শিরা ফুলে উঠল কয়েক মুহূর্তেই।
“চিনতে পারছ, সেন?” ইংরাজিতে চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কথাগুলো বেরিয়ে এল লোকটার মুখ থেকে।
ছয়
“পারব না?”, স্যার যেন স্থান কাল পাত্র ভুলে গেলেন, উন্মত্তের মত চিৎকার করে উঠলেন, “যার জন্য আমাকে আমার স্ত্রী, কন্যা দুজনকেই হারাতে হয়েছে, যার জন্য আমি এতগুলো বছর মানসিকভাবে শান্তি পাইনি কোনোদিনই, তাকে চিনব না? হাইনরিখ, তোমার সাহস হয় কি করে আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করার?”
~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১৬) ~