কোড নেম প্রমিথিউস

“ও মাঝে মাঝে প্রশ্ন করত, কিন্তু আমি উত্তর দিতে পারতাম না, কারন উত্তর দিতে গেলেই সেই রাতের স্মৃতিগুলো মাথায় এসে ভিড় করত, আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিতাম।“ স্যার কফির গ্লাসটা টেবিলে রেখে বললেন, “ও বুঝদার মেয়ে ছিল, বয়সের কারণেই হোক, কি ওর এই এনহ্যান্সড জেনেটিক মেকআপের জন্যই হোক, ও আমার কষ্টটা বুঝত।”

আমি ওকে লুকিয়ে রেখেছিলাম সবার থেকে। ওকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, নিজের কাছে রাখতে চাইনি, যাতে কেউ অতটা সন্দেহ না করে। কারণ,  এই কথাগুলো তো কোথাও প্রকাশ করার মত নয়। কেউ যদি জানতে পারে, কোন বিদেশী রাষ্ট্র যদি জানতে পারে, তারা এই ক্ষমতার অপব্যবহার করবে। তারা লুফে নেবে এই প্রযুক্তিকে। আর আমার মেয়েটাকে ওরা কাটাছেঁড়া করবে। বাপ হয়ে তো মেয়ের এই দিন দেখতে পারি না। তাই ওকে সবার থেকে লুকিয়ে রাখার জন্যই ওকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম।“

“যখন দেখলাম, ভাল্ভাবেই ও ১৮ বছর অব্দি সফলভাবে পড়াশোনা করেছে, কোনো রকম কোনো অসুবিধা হয়নি, কোনো রকম বড় দুর্ঘটনা ঘটেনি, বা ওর আসল পরিচয়টা বেরিয়ে আসেনি,  আমি ভাবলাম যে হয়তো আমি ওকে নিয়ে দেশে ফিরে আমার শেষ জীবনটা শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারব। গ্রিসে ফিরে ওকে নিয়ে, এই বাড়িটা বেচে দিয়ে পাকাপাকিভাবে ফিরে যাব। দেশের টান যে বড় টান।

কিন্তু, সুখ জিনিসটা বোধহয় কারোর কারোর কপালে লেখাই হয় না।

তোমাদের যখন কলেজে পড়াতাম তখনই  মাঝে মাঝে মনে হত, ওকে নিয়ে আসি। তোমাদের যেমন নিজের ছেলেমেয়ের মত করে পড়াই, ওকেও পড়াব। ওকেও কলকাতায় বিভিন্ন অলিগলি ঘুরিয়ে আনব। কিন্তু, একদিন খবর পেলাম, হাইনরিখ জেল ভেঙ্গে বেরিয়েছে। খবরটা জুলিয়াসই প্রথম দেয় আমাকে। বুঝে গেলাম, ও ফিরে আসবে, আমার সাথে ওর সমস্ত কাজের হিসাব মেটানোর জন্য। আর সবার আগে, ওর প্রথম টার্গেটই হবে ঝিনুক।

সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার কাজে রিজাইন দিয়ে চলে এলাম গ্রিসে। তারপর থেকে এক মুহূর্তের জন্য ঝিনুককে কাছছাড়া করিনি। ওর কিছু ক্ষতি হয়ে গেলে তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। আমার কাছে তো আমার মেয়েই সব। মেয়েকে ছাড়া তো আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন।“

“এবার তোমরাই বল আমার কি শাস্তি হওয়া উচিৎ। আমি তো তোমাদের চোখে নেমে গেছি বুঝতে পারছি। কিন্তু, নিজের মেয়ের চোখে নেমে যেতে আমার বুকে খুব বাজবে, ও ধাক্কা আমি সামলাতে পারব না।“ শেষদিকে স্যারের কণ্ঠস্বর ঝাপসা হয়ে ওঠে। মুখে হাত চাপা দিয়ে শিশুর মত কাঁদতে থাকেন উনি।

আমরা চার মূর্তি নীরব মোমের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকি। কিই বা বলব, কিইবা বলার আছে আমাদের? জুলিয়াস জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। হয়ত সেও কাঁদছে, কিন্তু আমাদের দেখতে দিতে চায় না।

দূরে কোনও এক নাম না জানা চার্চের ঘড়িতে রাত দশটার ঘণ্টা বাজে। রাতচরা পাখিগুলো চড়া কর্কশ শব্দে ডেকে উড়ে যায়।

পাঁচ

একসময় আমিই বললাম, “যা হবার, তা তো হয়ে গেছে স্যার। অতীত ঘেঁটে আর লাভ নেই। সবার আগে ঝিনুককে খুঁজে বার করা প্রয়োজন। ও যখন পালিয়েছে ক্রিমিন্যালগুলোর খপ্পর থেকে, নিশ্চয়ই ও বাড়ি চলে আসবে।“

স্যারের সম্বিৎ ফিরে আসে। ধরা গলায় জিজ্ঞেস করেন, “সেই তো। এতক্ষণে তো ওর চলে আসার কথা। থিবা তো এখান থেকে বেশি দূর নয়। তাহলে?”

এই সময় হঠাৎ করেই রেসিডেন্সিয়াল টেলিফোনটা বেজে ওঠে। স্যার ধরতে যাচ্ছিলেন। বর্ণালী স্যারকে থামাল। বলল, “না স্যার। আপনি ক্লান্ত। একটু রেস্ট নিন। আমি ধরছি।“

স্যার বিশেষ প্রতিবাদ করলেন না। চুপচাপ বসে পড়লেন আমার পাশের চেয়ারটায়। বর্ণালী গিয়ে ফোনটা ধরল।

দেখলাম, ওপাশ থেকে এমন কিছু কথা হচ্ছে, যার জন্য বর্ণালীর মুখটা ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ বর্ণালী চিৎকারই করে উঠল, “বাস্টার্ড। একবার যদি দেখা পাই…”

ততক্ষণে ফোনটা কেটে গেছে। কারন বারকয়েক হ্যালো হ্যালো করেও বর্ণালী কোনও প্রত্যুত্তর পেল না।

আমরা তাকালাম ওর দিকে। দেখলাম ও আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের ভাষাটা বোধহয় আমরা তিনজনেই পড়ার অভ্যেস করে ফেলেছিলাম, কেন না তিনজনেই প্রায় একসাথেই বলে উঠলাম “হাইনরিখ।“ আমি আর সমুদ্র প্রশ্নের সুরে, বর্ণালী হতাশায়।

স্যার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। “ কি হয়েছে? কি বলছে সে?”

বর্ণালী সবার মুখের দিকে তাকাল। তারপর চাপা গলায় বলল, “ঝিনুক বন্দী। হাইনরিখ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে স্যার। বলল, সব ঘটনার সূত্রপাত যেখানে হয়েছিল, সেখানেই চলে আসতে। চার ঘণ্টা সময় দিয়েছে আমাদের। আর সঙ্গে প্রমিথিউসের ট্যাবলেটটাও আনতে বলেছে। বলেছে, দেরি করলে আপনার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আপনার মেয়ের ওপর দিয়েই নেবে সে। পুলিশ আনলে আপনার মেয়ের বডি ও ইজিয়ান সাগরের হাঙরদের খাইয়ে দেবে, বলেছে।“

স্যার বসে পড়লেন মেঝের ওপর। মুখে হাত চাপা দিলেন উনি।

ক্রিস উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, “খবরদার, মিঃ সেন। ভুলেও যাবেন না। ওটা একটা পাতা ফাঁদ। আমরা এখনও জানি না ঝিনুক ওর হাতে কিনা। হতেই পারে, এটা ওর ব্লাফ। আমাদেরকে বন্দী করে তারপর আমাদেরকে র‍্যানসম হিসাবে দাবি করে ও ঝিনুককে নিজের কাছে টেনে আনবে। তারপর বিদেশে পাচার করে দেবে।“

আমি কথাটা ভেবে দেখলাম। খুব ভুল কিছু বলেনি ক্রিস। এই ভাবে ভেবে দেখলে, সত্যিই এটা একটা পাতা ফাঁদই বটে। কিন্তু উলটোটাও সত্যি হতে পারে। হয়ত সত্যিই হাইনরিখ ঝিনুককে বন্দী করেছে। আমি তাই বর্ণালীকে বললাম, “ফোনের ওপাশে কিছু আলাদা শব্দ শুনতে পেয়েছিস?”

বর্ণালী প্রশ্নটা শুনে কয়েক সেকেন্ড ভাবল। তারপর বলল, “ঝোড়ো হাওয়ার শব্দ, আর সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম। আর বিশেষ কিছু শুনতে পাইনি।“

আমি স্যারের দিকে তাকালাম। স্যার তখনও মুখে হাত চাপা দিয়ে বসে আছেন। বললাম, “ স্যার, দেরি করলে চলবে না। আসুন। যাওয়া যাক। ঝিনুককে বাঁচাতে যেতেই হবে।“

“কিন্তু তুমি জানো, ট্যাবলেটটা ও ফিরে পেতে চাইছে। ওটা দিয়ে ও কি কি করতে পারে, তোমার কি কিছুই ধারনা হয়নি?” স্যার উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন। “আমি মরে গেলেও ওটা হাইনরিখের হাতে তুলে দেব না।“

আমি তখন স্যারের পাশে বসলাম, তারপর সহানুভূতির স্বরে বললাম, “স্যার, আপনার কাছে বিজ্ঞান আগে না মানুষের প্রাণ আগে? আপনি কি একবারও ভাববেন না ঝিনুকের কথা? হয়ত আপনার গবেষণার দৌলতে ওর প্রা……” বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। কথাটা ঘুরিয়ে বললাম, “ওর বড় কোনও ক্ষতি ওরা করতে পারবে না। কিন্তু যে মেয়েটার জন্য আপনি মরজগতের এত বড় একটা নিয়ম একা নিজের হাতে ভেঙ্গে দিয়েছেন, তার কথা কি একবারও ভাববেন না?”

স্যার তাকালেন আমার দিকে। ওনার অবস্থা দেখে মায়া হচ্ছিল ওনার ওপর। অনেকক্ষণ দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমরা। তার পর, স্যার বললেন, “ঠিক আছে। ট্যাবলেটটা চায় তো ও। তাই পাবে।“

আমি মুচকি হাসলাম। “কিন্তু স্যার, তার আগে একটু আমাদেরকেও কিছু কাজ করে নিতে হবে। চোরের ওপর বাটপাড়িটা না করলে চলছে না।“

স্যার অবাক হয়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন, “চোরের ওপর বাটপাড়ি? মানে?”

আমি একটা রহস্যময় হাসি হাসলাম। “আমরা আছি কি করতে স্যার? একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে। চলুন বলছি।“

 

~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১৫) ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleরি-Union
Next articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১৬)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments