সেদিন হঠাৎ মহেশ্বরের উদরে যাতনা ভীষণ,
অসুস্থ হায় কৈলাসপতি–একি হল অঘটন !
বিশ্বাস বুঝি হচ্ছে না কারো–বলি শোনো তবে ঘটনা,
ছিটেফোঁটা নেই মিথ্যেভাষণ–নয় এটি কোনো রটনা।
মর্ত্যে যাবেন কদিনই বা দেরী–কেবল একটি পক্ষ,
কানপাশা ছোট হারায়াছে তায়–মেজাজ হবেই রুক্ষ।
অস্থির তাই দেবী পার্বতী–বিনিদ্র রাত কাটে,
এমত সময় কাতর শব্দ–পাশের ঘরের খাটে।
দেবাদিদেব ত’ নিদ্রামগ্ন–অবয়বে কোনো কষ্ট !
ত্বরাপদে দেবী ছোটেন ও ঘরে সময় না করি’ নষ্ট।
দেখেন সেথায় মহেশ্বরের মুখখানি বিকৃত,
উদরের দশা বড়ই করুণ–স্ফীত হতে আরও স্ফীত।
ডাকেন সবারে মহেশ মহিষী–বিহ্বল ছেলেমেয়ে,
নন্দী, ভৃঙ্গী সাথে আরো কত অনুচর আসে ধেয়ে।
আদেশ করেন দেবী দশভুজা-“ডাক এবে কবিরাজ,
কৈলাসপতি অসুস্থ আজি”-বিনা মেঘে পড়ে বাজ।
স্বর্গরাজ্যে সেই সন্দেশ নিমেষেই যায় রটি’,
দেবকবিরাজ অশ্বিনীদ্বয় কৈলাসে যান ছুটি।
শত প্রচেষ্টা বিফল তাঁদের–যাতনার নয় হ্রাস,
স্বর্গবৈদ্য অসফল হায়–টুটে বুঝি বিশ্বাস।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, বরুণ–সবার মনেই শঙ্কা,
বন্ধ কি তবে এইবার হবে পিনাকপাণির ডঙ্কা !
মা মহামায়া নীরবে করেন শুধুই অশ্রুপাত,
নীলকন্ঠের কণ্ঠ রুদ্ধ–এ কি এলো কালরাত !
তখন নন্দী বলে মা জননী-“অভয় দাও ত’ বলি,
আমি ও ভৃঙ্গী এইক্ষণে মোরা কলকাতা যাই চলি।
সেথায় আছে ত’ বড় ডাক্তার সদাশিব মল্লিক,
উদরের রোগে তাঁর হাতযশ ছড়ায়েছে দশ দিক।
শুধু তাই নয় তোমার গণেশও তাঁর ওষুধ যে খায়,
ফি বছর যবে তোমার সাথে সে বংগদেশেতে যায়।”
“বলবি ত’ আগে”-শুনি তার কথা ধমকি’ জগন্মাতা,
“বাবার বিশেষ পুষ্পক রথে যারে এবে কোলকাতা।”
মায়ের আদেশে নন্দী ভৃঙ্গী আসে ত্বরা উটালিকা,
থাকেন যেথায় ডাক্তার শিব–করে তাঁর সাথে দেখা।
তারপর তাঁরে অনেক বুঝিয়ে নিয়ে চলে কৈলাসে,
তারকার দল মিটমিট করে তখনো রাতের আকাশে।
কৈলাসে আসি’ সবকিছু হেরি’ ঘোষণা করেন সদা,
“বাবার উদরে অস্ত্রোপচার করতে হবে যে দাদা।
মনে হয় কিছু বাবার অন্ত্রে কোনভাবে গেছে ঢুকে,
পেট কেটে সেটি করে দিলে বার মহেশ যাবেন টিঁকে।”
“এত ভিড় হেথা চলবে না মোটে–ঘর করে দিন ফাঁকা,
তবে অগ্রিম ‘ফিস্’ আগে চাই হাতে–ত্রিশটি হাজার টাকা।
বাকী সত্তর পরে দিলে হবে যদি হই সার্থক,”
ডাক্তার খুবই চালাক চতুর–ঝোপ বুঝে মারে কোপ।
কি আর করা–তিরিশ হাজার দিতে হল গুণেগুণে,
বাকী টাকাটার বন্দোবস্ত হয় ‘মোবাইল ফোনে’।
বড়বাজারের বড় কারবারী শ্রীমান আগরওয়াল,
গণেশের সাথে আগরবাতির ব্যবসায় মালামাল।
টাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে সদার কাজটি শুরু,
বন্ধ দরজা–কি হয়, কি হয়–বুক কাঁপে দুরুদুরু।
‘ইন্জেকশানে’ শিবকে করেন সদাশিব অজ্ঞান,
প্রস্তুত তিনি–ছুরি হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে আগুয়ান।
উদর যেথায় ছিল খুব স্ফীত–অস্ত্রোপচার সেথা,
মায়ের কপোলে অশ্রুর বাণ–হৃদয়ে অসীম ব্যাথা।
এদিকে তখন ঘরের মধ্যে সদাশিব ডাক্তার,
বাবার উদর খোলা মাত্রই চোখ ছানাবড়া তাঁর।
বাবার অন্ত্রে আটকে আছে যে মায়ের ছোট্ট পাশা,
ভাবেন বদ্যি বাবা মায়ে আজো এতটাই ভালবাসা !
মা কে কাছ ছাড়া না করার হেতু ছিল কি বাবার ছল !
বোধ করি তিনি ভাবেন নি দেহ হবে এত দুর্বল।
বাহিরেতে আনি মায়ের পাশাটি বাবার উদর কেটে,
রাখেন গহনা সদা সাবধানে শিব ঠাকুরের খাটে ।
ধীরে ধীরে শেষে করেন সেলাই–উদরটি যায় জুড়ে,
জ্ঞান ফিরে আসে দেবেশ্বরের–যাতনা গিয়েছে ছেড়ে।
স্বস্তীর শ্বাস–দরজা খোলেন সদাশিব ডাক্তার,
আসেন ছুটেই দেবী দশভুজা–আলুথালু বেশ তাঁর।
পালঙ্ক পরে শয়ান মহেশ–দুনয়নে স্মিত হাসি,
জড়ায়ে ধরেন পার্বতী মাতে–আঁখিজলে যান ভাসি।
ব্রহ্মা বিষ্ণু দেবগণ সবে ফেলেন স্বস্তী–শ্বাস,
নন্দী ভৃঙ্গী অনুচর জনে আনন্দে করে রাস।
ছেলেমেয়েদের করেন আদর শিবাণীরে আনি পাশে,
ঘটনা কেমনে ঘটল পিনাকী কহেন সবার সকাশে।
ঠিকমত ঘুম হয়নাত’ রাতে–নেন যে ঘুমের বড়ি,
জগন্মাতার এ ব্যাপারে আছে ভালমত কড়াকড়ি।
নিজের হাতেই দ্যান সেই বড়ি দেবাদিদেবের হাতে,
কিন্তু কি করে ভুললেন দেবী হায় রে সেদিন রাতে !
নেশাটা বুঝি বা রাতের বেলায় হয়েছিল তাঁর বেশী,
কানপাশা আর ঘুমের বড়ি রাখা ছিল পাশাপাশি।
ভুল করে বাবা বড়ি ভেবে ওই অতি ছোট পাশাটিরে,
ফেললেন গিলে–অন্ত্রে বেদনা শুরু হয় ধীরে ধীরে।
পরের ঘটনা সবাকার জানা–দুর্গেশ লজ্জিত,
চিকিৎসকের গুণকীর্তন–কৈলাস মুখরিত।
কৈলাস হতে দেবাদিদেবের পুষ্পক রথ চড়ি,
ভোরের আগেই ফেরেন ঘরেতে সদা ধন্বন্তরী।
দেবাদিদেবের চিকিৎসা যবে উদ্বেগ ছিল বেশ,
এক রাত্রেই গজিয়েছে তাঁর অনেক পক্ককেশ।
পরদিন তিনি পেয়ে যান হাতে ফিসের’ পাওনা টাকা
সেই সাথে আসে উপঢৌকন পারিজাতও এক থোকা।
বৈঠকখানা আমোদিত তাঁর পারিজাত মধুবাসে,
আলো হয়ে থাকা স্বর্গপুষ্প যেন সর্বদা হাসে ।
শুকায় না সেই পারিজাত ফুল, কখনো পড়ে না ঝরে,
উটালিকা গেলে নিশ্চিত আমি যাবেই মনটা ভরে।
ভাবছ বুঝি বা কেমন করে ঘটনাটি হল জানা,
সদাশিব মোর পরম মিত্র–নাই মিথ্যার কণা।
তাও যদি করো অবিশ্বাস–জিজ্ঞাসা কোরো মাকে,
এবছর যবে আসবেন তিনি ধরাধামে কার্তিকে।
আর জগন্মাতারও পরদিন রাতে স্বপ্নে লভেছি দেখা,
তাঁর প্রেরণাতে পুরো ঘটনাটি মনের কলমে লেখা।
চুপিচুপি আমি জানালাম সবে দেবাদিদেবের কাণ্ড,
দেবীর আদেশ–অমান্যে মোর নিশ্চিত হতো দণ্ড।