পবিত্র নবদ্বীপধাম পার্শ্বস্থ শ্রীখণ্ড গ্রাম
অখ্যাত প্রাচীন পল্লী বটে,
পাঁচশত বর্ষ অতীত যুগটি চৈতন্য প্রতীত
অলৌকিক ঘটনা এক ঘটে।
কবিরাজ মুকুন্দ রায় বসত করেন সেথায়
সদাচারী বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ,
কুটীতে প্রতিষ্ঠিত কষ্টিপাথর কৃত
গৃহদেব গোপীনাথ নারায়ণ।
প্রতিদিন প্রত্যুষে পবিত্র স্নানশেষে
করিতেন পূজা গোপীনাথে,
অত:পর রুগী সেবা ব্যাপিয়া সমস্ত দিবা
ঈশ্বর কৃপা ছিল সাথে।
অদ্ভুত হাতযশ ব্যাধিও হইত বশ
অনায়াসে রোগ নিরাময়,
চৌদিকে তাঁহার খ্যাতি লাভ করে বিস্তৃতি
কবিরাজ শ্রী মুকুন্দ রায়।
তনয় একটি মাত্র রঘুনাথ শিশুপুত্র
পন্চমবর্ষীয় সন্তান,
গোপীনাথ সনে ভক্তি না মানিত কোন যুক্তি
তবে শিশুটি অতীব বুদ্ধিমান।
একদিন বৈদ্য আর্য সমাপনে স্নানকার্য
গোপীনাথ আরাধনে ব্যাস্ত,
একটি বালক আসি’ ক্রন্দনে যায় ভাসি’
ভাবখানি অতিশয় ত্রস্ত।
কোথা হায় কবিরাজ মোর পিতারে আজ
আক্রমণ করিয়াছে ব্যাধি,
তাঁহার পুত্র আমি গুরুচরণ নামী
মোর সাথে চলুন হে সুধী।
পাশের গ্রামেতে বাস বিলম্বে সর্বনাশ
কণ্ঠে তাহার ঝরে আকুতি,
কহেন মুকুন্দ রায় এখন সম্ভব নয়
গোপীনাথে করিব আরতি।
বালক নাছোড় ভারী তাহার আর্তি হেরি
বৈদ্যের ক্লিষ্ট অন্ত:সার,
পুত্র শ্রী রঘুনাথে আদর করিয়া মাথে
দিলেন পূজার্চনা ভার।
বলিলেন পুত্রটিরে রুগীর চিকিৎসা তরে
চলিনু পার্শ্ববর্তী গ্রামে,
স্নানান্তে গোপীদেবে করিও সেবাটি এবে
ফিরিব বোধ করি ত্রিযামে।
রঘুনাথ অতীব হৃষ্ট লভিয়াছে বুঝি ইস্ট
তাহাকে স্পর্শ করে কে বা,
যাও পিতা নিশ্চিন্তে আজিকে স্নানের অন্তে
গোপীনাথে দিব আমি সেবা।
স্নানান্তে পরণে ধুতি মাতাকে করিল মিনতি
লাড্ডু কিছু দিও শুদ্ধ পাত্রে,
গোপীনাথে করি সেবা দায়িত্ব দিলেন বাবা
পালন করিব হৃষ্ট চিত্তে।
পাত্রে লাড্ডু ভরি’ মাতাটি আদর করি,
কহিলেন পুত্রটিরে তিনি,
সেবা দিবি গোপীনাথে একাগ্র তদ্গত চিতে
জিনিবি তাঁহার হৃদিখানি।
সরল শিশুর মনে ভগবান নারায়ণে
ভক্তিরস বহে অনুক্ষণ,
ভাবিল শ্রী গোপীনাথ বাড়ায়ে তাঁহার হাত
করিবেন লাড্ডু সবে গ্রহণ।
রুদ্ধ কক্ষে গোপীনাথে বলে–মা আপন হাতে
প্রস্তুত করিয়াছে লাড্ডু সবে,
জানি ত’ ক্ষুধার্ত তুমি দিলেম তোমায় আমি
আহার কর হে প্রভু এবে।
কিন্তু অনড় মূর্তি করে না উদরপূর্তি
শিশুটিরও একরোখা মন,
গাত্রে লেপে চন্দন মূরতিরে করে ব্যজন
কিন্তু নীরব নারায়ণ।
রঘুনাথ অবিরত অনুনয় বিনয় শত
তথাপি বিগ্রহে নাহি সাড়া,
অধৈর্য্য অবশেষে করে গোপী পদে সে
মস্তকে আঘাত–রক্তধারা।
সহসা সহস্র জ্যোতি আহা কি অপূর্ব দ্যুতি
আলোকে ঘরটি যায় ভাসি’,
গোপীনাথ চিণ্ময় অপরূপ রূপময়
আননে তাঁহার মধুহাসি।
রঘুনাথ পুলকিত নয়ন বিস্ফুরিত
হেরি সেই অনন্ত রূপ,
লোপ বুঝি বাকশক্তি উছল তাহার ভক্তি
বিহ্বল শিশু নিশ্চুপ।
বিগ্রহ গোপীনাথ বাডায়ে দুইটি হাত
মাগিলেন লাড্ডু রঘুনাথে,
সম্বিত আসিল ফিরি’ লাড্ডু পাত্র ধরি’
অর্পণ করিল সেই হাতে।
কি অপূর্ব রূপ প্রভু এমন হেরিনি কভু
লাড্ডু তুমি লহ যত খুশী,
একে একে লাড্ডু প্রায় নিমেষেই শেষ হয়
নাই মাত্র দুইটির বেশী।
অবশেষে গোপীনাথ সরায়ে রাখেন হাত
কহিলেন শিশুটিরে তিনি,
বাকী দুটি তোর তরে রাখিলাম পাত্র পরে
সেইসাথে দিনু হিয়াখানি।
এই বলি’ নারায়ণ পূর্বরূপে বর্তন
বিগ্রহ কষ্টিপাথর,
কবিরাজ এতক্ষণে ফিরিলেন গৃহাঙ্গণে
মূরতিও পুনরায় নিথর।
ঊদ্বেগে হৃদয় অতি কি করে চপলমতি
ডাকিলেন পুত্র রঘুনাথে,
পিতার ডাকেতে সাড়া বাহিরে আসিল ত্বরা
দুটি মাত্র লাড্ডু শিশুহাতে।
বিষ্মিত মাতাপিতা বাকী লাড্ডু আছে কোথা
শুধান পুত্রে দুইজনে,
সরল হাস্যমুখে বলে সে অতীব সুখে
খাইলেন সবই নারায়ণে।
অবিশ্বাসী দুইজন সন্দেহগ্রস্ত মন
শিশুটির অসত্য কথন,
কহিলেন–পুত্র মম গোপীনাথ ঈষ্টসম
অনুচিত মিথ্যার সৃজন।
“না পিতা মিথ্যা নহে” পুত্র রঘুনাথ কহে
করিল সে ঘটনার উদ্ভাস,
কিন্তু কবিরাজ হায় সন্দেহ অতিশয়
শিশু বাক্যে নারিতে বিশ্বাস।
অত:পর ভাবেন মনে করিবেন শিশুসনে
কল্যই একটি পরীক্ষা,
ধরিবেন হাতেনাতে পুত্র শ্রী রঘুনাথে
দিবেনই উচিত শিক্ষা।
পরদিন প্রাত:কালে জরুরী কাজের ছলে
যাইলেন পিতাটি বাহিরে,
দেবসেবার দায় পুত্রটির পুনরায়
পুলকিত শিশুটি অন্তরে।
লাড্ডু লইয়া হাতে সেবা করে গোপীনাথে
বন্ধকক্ষে সাধ্যসাধনা,
পিতাটি আসেন ফিরি’ জায়ারে সঙ্গী করি’
বাহিরে দাঁড়ায়ে দুইজনা।
শুনিয়া শিশুর কথা মাতৃদেবী চমকিতা
পিতাটির সন্দিগ্ধ মন,
সহসা নীরব কক্ষ মুকুন্দ ভাবেন লক্ষ্য
এইক্ষণে হইবেই পূরণ।
ধরিবেন লাড্ডুহাতে শিশুপুত্র রঘুনাথে
সেইক্ষণ আসিয়াছে এবে,
নি:শব্দে ধীরে ধীরে আঘাত দুয়ার পরে
চিত্ত বুঝি হৃষ্ট মোক্ষলাভে।
খুলিল দুয়ারখানি কিন্তু কি হেরেন তিনি
উদ্বেল মুকুন্দ হৃদয়,
অত্যাশ্চর্য্য এক জ্যোতি দেবকক্ষে ছিল স্থিতি
সহসাই অন্তর্হিত হায়।
আর বিগ্রহ গোপীনাথে বংশী ত’ নাহি হাতে
অর্ধ লাড্ডু সেথা শীলাকার,
ঘটনা অকষ্মাৎ হতভম্ব রঘুনাথ
বাক্য স্ফুর্তি হয়না তাহার।
পুত্রের নিকটে আসি আঁখিজলে যান ভাসি
জড়ায়ে ধরেন কবিরাজ,
ধন্য ধন্য পুত্র মোর আস্থা ও ভক্তি জোড়
নারায়ণে লভিলি তুই আজ।
মনেপ্রাণে তাঁহারে পূজি নিয়ত স্বরূপ খুঁজি
তথাপি ত’ লভি নাই আমি,
পুত্র তোর ভকতিমতি নাহি সেথা বিচ্যুতি
তাই তোরে দিল ধরা স্বামী।
তোরে মিথ্যাবাদী হায় ভাবিল মুকুন্দ রায়
ধিক্ মোরে শতধিক ওরে,
আমি অতি ভাগ্যবান এমত ঈশ্বর দান
পুত্র তোরে লভিলাম ক্রোড়ে।
আজিও শ্রীখণ্ড গ্রামে মানুষের ঢল নামে
হেরিতে অর্ধলাড্ডুশ্বর মূরতি,
বংশী নাহি গোপী করে অর্ধলাড্ডু তাহাপরে
ইতিহাস–নহে কিংবদন্তী।
—————————————