রাত তখন প্রায় আড়াইটে হবে। রিনির বাড়ির কলিং বেলটা টিং টং শব্দ করে বেজে উঠল। সারা বাড়ির নিস্তব্ধতাটা এক মূহুর্তে খান খান হয়ে বাড়িটা ঝনঝন করে উঠলো। রিনি চমকে উঠে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল দুটো পঁয়ত্রিশ। পাশে শুয়ে থাকা বছর দুইয়ের মেয়েকে একটু চাপড়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে একপ্রকার ভয় ভয়েই নিচে এল।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে একবার ভাবল খুলবে না দরজা। কে না কে আছে। এত রাতে। আর তাছাড়া আজ আবার অনীকও নেই। একা মহিলা। বেলটা যদিও আর বাজে নি। ওই একবার বেজেই থেমে গেছে। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। একটা গুমোট পরিবেশ। রিনি এখনও দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ।
মিনিট পাঁচেক নিজের মন আর মগজের সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে রিনি। তারপর যখন আর কলিং বেলটা বাজল না। তখন উপরে উঠতে যাবে বলে সবে পিছন ঘুরল রিনি। টিং টং শব্দে আবার বেলটা বেজে উঠল। বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠলো রিনির। ধমকে দাঁড়িয়ে গেল সে। আবার দোটানা,আবার মন আর মগজের লড়াই। মন বলছে খুলে দিতে মগজ বলছে যেই হোক এত রাতে দরজা খোলাটা নিরাপদ নয়। উফফ এ কি বিরম্বনার শিকার আজ রিনি।
হঠাৎ একদম মৃদু স্বরে দরজার ওপার থেকে আওয়াজ এল ” আরে রিনি খোলনা। আমি অনীক।”
রিনি এবার দরজাটা খুলল। সামনে অনীক দাঁড়িয়ে।
“উফফ কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টিতে ভিজেই যেতাম। ” অনীক বিরক্ত হয়ে বলে ঘরে ঢুকল।
রিনি বেশ অবাক হল অনীককে দেখে । তার দিকে দেখে বলল ” বললে দীঘা যাচ্ছ,তাই আসবে না আজ। আবার চলে এলে?”
অনীক বেশ গম্ভীর স্বরে বলল ” তাহলে আবার চলে যাই,নাকি? নিজের ঘরে কখন আসবো সেটাও বলে আসতে হবে?”
রিনি বেশ রাগের সাথেই বলল ” তোমার এই টেরা টেরা কথার জন্য তোমার সাথে কথা বলতে আর ইচ্ছে করেনা আমার।”
অনীক আর কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রিনির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মিনিট দুয়েক।তারপর শান্ত স্বরে বলল ” সরি রিনি। ভুল হয়ে গেছে। আর হবেনা।”
রিনির রাগ মুখের কোন পরিবর্তন হলনা। সে মুখটা ঘুরিয়ে বসে রইল খাটের উপর। পাশে শুয়ে থাকা মেয়ের গায়ে হাত বোলাতে লাগল।
রিনি আড় চোখে লক্ষ্য করছিল অনীক ওর দিকে তখনও তাকিয়েই আছে।
ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে অনীক প্রশ্ন করল ” ভালোবাসো রিনি আমায়?”
রিনি চুপ। মুখটা ঘুরিয়ে মেয়ের গায়ে তখনও হাত বোলাচ্ছে।
অনীক আবার বলল ” আমারা কত ভালো সময় কাটিয়েছি একসময় রিনি। প্রতি সপ্তাহে একবার করে ঘুরতে যেতাম। কখনো দীঘা কঠনও মন্দারমণি আবার কখন তাজপুর। সমুদ্র যেন আমাদের ঘর হয়ে উঠেছিল। আমাদের ভালোবাসার স্বাক্ষী হয়ে উঠেছিল।সেসব দিনগুলো আজ ভীষণ মনে পড়ছে।”
রিনি মুখটা অনীকের দিকে করে বলল ” তোমার দীঘা যাওয়া ক্যানসিল হয়েছে বুঝি? তাই সেসব কথা মনে পড়ছে। নাকি ড্রিঙ্ক করেছো অনীক?”
অনীক কৌতুকের মুচকি হেসে বলল ” একটুতো করেছি। তবে তুমি কি বলতে চাও। ড্রিঙ্ক করলেই তবে আমার পুরানো কথা মনে পড়ে?”
রিনি একেবারে কনফিডেন্স এর সাথে অনীকের দিকে তাকিয়ে বলে ” অবশ্যই। মদ পেটে না পড়লে তোমার আমাদের ভালোবাসার কথা মনে পড়ে না অনীক।”
অনীক চুপ। কিছুক্ষণ পর আবার অনীক একটা “সরি” দিয়ে শুরু করে।
“সরি রিনি। ভুলটা আমরো হয়েছিল। সন্ধ্যাবেলা ওভাবে চেঁচানোটা উচিত হয়নি তোমার উপর।” কথাটা বলে অনীক খাটে বসা রিনির দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে দেখে আবার বলল “ইসস। কালসিটে দাগ বসে গেছে। আমি খুব বাজে রিনি।”
রিনি একটা ঢোক গিলে বলে ” তুমি ছাড়া আমাদের কেউ নেই এখানে অনীক। আমার এত ছোট বাচ্চাকে একা ফেলে কি করে ঘুরতে যেতে চাও তুমি বন্ধুদের সাথে? হঠাৎ যদি রাত বিরেতে কোন দূর্ঘটনা ঘটে আমি কার কাছে যাব, কাকে ডাকব। তাই তোমায় যেতে বারণ করেছিলাম। বিশ্বাস কর, এতে একটুও আমার হিংসা ছিলনা।”
অনীক রিনির নীচের দিকে করা চোখের দিকে তাকিয়ে। রিনির চোখের কোনদুটো চিকচিক করছে।
আর একবার “সরি” ভেসে এল অনীকের মুখ দিয়ে।
বাইরে ঝমঝম বৃষ্টিটা তখন তান্ডব রুপ ধারন করেছে। মাঝে মাঝেই কড় কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ছে দূরে।
মিনিট দুই চুপ থেকে রিনি মুখটা তুলে অনীকের দিকে তাকাল। অনীকের চোখের জল তার গাল বেয়ে নীচে পড়ছিল। রিনি উঠে গিয়ে অনীকের বুকে মাথাটা রাখল। চমকে উঠল রিনি। অনীকের বুকটা এত ঠান্ডা কেন?এই শরীরের গরম একসময় তার রাতের ঘুম কাড়ত।তাও বুকে মাথা রেখে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল রিনি অনীককে।
“তোমার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কি হবে অনীক। আর তোমরা বন্ধুরা মিলে যাচ্ছ মানেই মদের ফোয়ারা উড়বে। বারন করার জন্য সেখানে আমিও থাকব না। খুব ভালোবাসি তোমাকে আমি। ”
অনীকের চোখের জল রিনির মাথার চুলে মিশে যাচ্ছিল।
অনীক আবার বলল ” সরি রিনি। আর ভুল হবেনা। অবকাশও নেই।ক্ষমা করো আমায়। সরি।”
ঘড়িতে তখন ভোর চারটে দশ। রিনির ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন । রিনি অনীকের বাহু বন্ধন ছাড়িয়ে ফোনটা ধরার জন্য যেতে গেল। অনীক ছাড়ছে না তাকে চেপে ধরে রেখেছে। রিনি বলল ” ছাড়ো ।কার ফোন এত সকালে দেখি।”
অনীক বলল ” না, আর একটু প্লিজ আর একটু আমায় থাকতে দাও রিনি।”
– তোমার বাড়ি তুমি থাকবে। কোথায় আর যাবে আমাদের ছেড়ে? লক্ষীটি ফোনটা বেজেই চলেছে। ছাড়োনা গো।
– ছাড়লেই সব শেষ রিনি। সব শেষ। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি রিনি। সরি আই এম ভেরি সরি।
ছেড়ে দিল অনীক রিনিকে।
রিনি ফোনটা ধরে বলল ” হ্যালো।”
অনীক তখনও রিনির দিকে তাকিয়ে।
ফোনের ওপার থেকে একজন বলল ” রিনি চক্রবর্তী বলছেন?”
– হ্যা বলছি। আপনি?
– আমি রামনগর থানা থেকে বলছি। বুকটা কেঁপে উঠলো রিনির।
– বববলুন।
– আপনার স্বামীরা যে গাড়িটায় আসছিল সেটি একটা দূর্ঘটনার কবলে পড়েছে ও আপনার স্বামী অনীক চক্রবর্তীর মৃত্যু হয়েছে রাত একটা নাগাদ।
রিনি মুখটা তুলে তাকিয়ে দেখে। কই, তার সামনে কেউ নেইতো। কোথায় অনীক। ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায় রিনির। সে মেঝেতে থপ করে বসে পড়ে। এতক্ষণ কে তাকে এতবার “সরি” বলল। কার বুকের উপর মাথা রেখেছিল সে।
তবে কি অনীক নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাকে “সরি” বলতে ফিরে এসেছিল?