নগরের নাম সেরিব,

ফেরিওয়ালা দুটি   বাঁধে সেথা কুটী                          

           আহারে বড়ই গরীব।

পণ্য পুরানো  সুলভেতে কেনো  একই পেশা দুজনার,

মহাজন কাছে  সেগুলিকে বেচে  তবেই জুটত আহার।

দিবাশেষে হায়  কত বা উপায়  উদর পূর্তি দায়,

কি আর করা  এই পেশা ছাড়া ছিল  না অন্য উপায়।

গ্রামগন্জ ঘুরি  বিকিকিনি করি  সেরিবা সেরিবান,

কষ্টেসৃষ্টে  দিনগুলি কাটে  কোনোমতে গুজরান,

তথাপি সুজন  সেরিবান মন  ছিল না কো তায় ক্ষোভ,

সৎ ন্যায়বান  সাধুর সমান   সেরিবান নির্লোভ।

কিন্তু সেরিবা  বলা যায় কিবা  অল্পেতে নয় খুশী,

ফন্দী কিভাবে   অসৎ প্রভাবে   হবে আয় আরও বেশী।

লোভী দুষ্ট   অন্যে রুষ্ট  সেরিবাকে অপছন্দ,

অপরপক্ষে   সবার চক্ষে   সেরিবান নহে মন্দ।

তবে স্বভাবে ফারাক  যতই না থাক  ছিল বেশ বনিবনা,

সেরিবার কানে  দিত সেরিবানে   সতত সুমন্ত্রণা।

কিন্তু কিভাবে  খলেরে ভুলাবে   সম্ভব নহে মোটে,

ভষ্মে ঘি ঢালা  কান ঝালাপালা  ভাল কথা নাহি খাটে।

দিনগুলি কাটে   হাটে মাঠে ঘাটে   বিকিকিনি হেথাহোথা,

শ্রান্ত শরীরে  বসে নদীতীরে   জুড়ায় মনের ব্যাথা।

হিসাব নিকাশ   মিটে নাকো আশ    তবু সেরিবান খুশী,

হাসি মুখ তার   হেরি সেরিবার   জ্বালা ধরে আরও বেশী।

একদিন শেষে   বললে সে হেসে – “শুন ভাই সেরিবান,

এইবার বুঝি   বন্ধই রুজি   অকালেই যাবে প্রাণ।

হেথা নয় হোথা   বিক্রেতা কোথা   ভাঁটা হায় কারোবারে,

জেনে রাখো সখা   কপালের লেখা   মৃত্যু অনাহারে।

তবে আছেই উপায়  ভেবে দেখা যায়  যদি করি নদীপার,

নতুন শহরে   হয়ত শিয়রে    খুলবে ভাগ্য দুয়ার।

শুন মোর কথা   আর নয় হেথা   ভাগ্য আবিষ্কারে,

চল যাই দূরে   নদীপথে ঘুরে   অন্ন্ধনগর দুয়ারে।

নদীর ওপারে  দূর সে শহরে   পাড়ি দেই কাল প্রাতে,

ওখানে শুনি   আছে সব ধনী   কারোবার দিনেরাতে।

সেরিবান রাজী  কহে সোজাসুজি  ভালই বলেছ কথা,

তবে হুঁশিয়ার   লোভ নয় আর   ঠাণ্ডা রাখবে মাথা।

পরদিন ভোরে    অন্ধনগরে   নদীপথে বাহি তরণী,

পৈাঁছায় এসে   নগর সকাশে   শুরু করে বিকিকিনি।

কোনোকালে সেই   নগরপরেই   ছিল যে বণিক ধনেশ,

দুর্যোগ আসি  সব দিল ভাসি  একে একে নি:শেষ।

অধুনা কেবল   গেহ সম্বল   বাকী সব কিছু নষ্ট,

আছেন ঠাকুমা  নাতনী সুরমা   কি নিদারুণ কষ্ট।

সুসময় পরে   বণিকের ঘরে   ছিল সুবর্ণ থালি,

অব্যবহারে  সেটির উপরে   এখন ময়লা ধূলি।

ঠাকুমা নাতনী   কেহ বোঝেনি   রেকাব সোনায় গড়া,

উঠানের ধারে  রয় অনাদরে  আবর্জনায় ভরা।

ফেরিওয়ালা সেই   লোভী সেরিবাই  পথে পথে শোরগোল,

খেলনা গহনা  কেহ কি চাহ না  পুরানো দ্রব্য বদল !

সেরিবার স্বরে  পিতামহী ক্রোড়ে  সুরমার ভারী বায়না,

থালার বদলে   আজ আমি গলে  পরবো নতুন গয়না।

ঠাকুমাও ভাবে  কি আর হবে  রেকাবটি করি বদল,

নেই উপকারে  রয় একধারে  স্মৃতি আনে চোখে জল।

ভাবনা কাজে  মিল পায় খুঁজে  সেরিবারে ডাকে বুড়ি,

ভাই ফিরিওলা  বিনিময়ে থালা  দাও ভাল হার চুড়ি।

সেরিবা মন্দ  কেমন সন্দ  রেকাবটি লয়ে হাতে,

পরখে সে দেখে   একপাশে রাখে   দুষ্টবুদ্ধি মাথে।

সোনার বাসন  সেরিবার মন  চন্চল হয় লোভে,

যে কোন উপায়ে   বুড়িরে ঠকায়ে   সেটি যে নিতেই হবে।

দাঁওটা মস্ত  সেরিবা ব্যাস্ত  আননে কুটিল হাসি,

শোনো বাছা বলি  আমি এবে চলি  মূল্য নয়কো বেশী,

রেকাবী বদলে  কিছু দিতে হলে  হবে সেটি লোকসান।

এই কথা শেষে  চলে যায় হেসে  ঠাকুমাটি হতমান।

মনে প্যাঁচ কষে  সে ফিরে এসে  থালিটি করবে হাত,

কড়ি কিছু দিয়ে   বুড়ীকে ভুলায়ে  অন্তিমে বাজিমাত।

কিছুক্ষণ পরে  বৃদ্ধা সদরে  হাঁক দেয় সেরিবান,

হরেক দ্রব্য  সুলভে লভ্য  কে নেবে মহতী প্রাণ !’

চিৎকার শুনে  পিতামহী সনে   ফের শিশুটির বায়না,

বেচারী কি করে   পুনই সদরে  সুরমা যে চায় গয়না।

বলেশুন ভাই   চুড়ি হার চাই   এই শিশুটির তরে,

পয়সা নাই  আছে থালি এই   ঝুলিতে রাখ হে ভরে।

দাঁড়ান দাঁড়ান  বলে সেরিবান  থালাটি ধরে সে হাতে,

দ্যাখে নেড়েচেড়ে   রাখে ধীরে ধীরে   চোখ বুঝি কপালেতে।

ঠাকুরমা একি   জানা নেই নাকি  রেকাবে কনক দ্যুতি,

সবিশেষ দামী  বলে দিনু আমি  দরিদ্র হায় অতি।

কোথায় অর্থ   আমি যে ব্যর্থ  এই রেকাবটি নিতে,

সোনার দোকানে   যারা বেচে কেনে  পারে তারা দাম দিতে

বলছ কি বাবা  কোমলস্বভাবা   বৃদ্ধাটি আনমনা,

কত দিন ধরে  আছে ওটি পড়ে  কেমনে আসবে সোনা !

একটু আগেই  তোমার মতই  অন্য আরেকজন,

অবহেলা ভরে  বাসনটি রে  দিল না একটি কাহন।

যদি সত্যই   সোনার থালাই   তবে সে তোমার পুণ্য,

ধর তুমি করে   দাম দিও পরে   আমাদের করো ধন্য।

সেরিবান কাছে  বেশী কি বা আছে   হাজার কাহন মাত্র,

ঠাকুরমা সনে   দিল খুশীমনে   সাথে সব মালপত্র।

সব দিয়ে শেষে   নদীতীরে আসে   খেয়াঘাটটির পরে,

যাব ওই পাড়ে   মাঝিভাই মোরে   দাও এবে পার করে।

কিছুক্ষন পরে    বুড়িমা দুয়ারে   সেরিবা হাজির ফের,

হাঁক দেয় জোরে  এসেছিগো ফিরে   দাও থালি তোমাদের।

নাতনীটি যবে   কাঁদছেই তবে   দিতে হবে কিছু গয়না,

রেকাবী বদলে  কিছু নাহি দিলে  ভাল কাজ সেটি হয়না।

বলছ কি ভাই   তোমার কথাই   কি ছিল খানিক আগে,

থালাটির কোনো  দাম নেই জেনো  বৃদ্ধা ক্ষিপ্ত রাগে।

সেরিবার হাসি  বল যাহা খুশী   তবে বাচ্চার বায়না,

তাই শোনো বলি  দাও মোরে থালি  রাখ নয় কিছু গয়না।

সে কি আর আছে  দেরী হয়ে গেছে  ঠাকুরমা কহে হেসে,

আরো একজন  ভারী উঁচু মন   কিনে নিল ভালবেসে।

সৎ সে মানুষ  আছে মান হুঁশ   বললে কনক রেকাব,

আমাদের দিল  যা তার ছিল  করেনি কোনই লাভ।

তাই শুনে হায়   সেরিবা প্রায়   হয় বুঝি উন্মাদ,

দিক কি বিদিক   জ্ঞান নেই ঠিক  টুটে তার সব সাধ।

খেয়াঘাট পানে   ছোটে প্রাণপণে   চিৎকারেসেরিবান,

পাজী বদমাশ   ভাঙ্গলিরে আশ   তুই মহা শয়তান।

পৈাঁছায় ঘাটে   দেখল সে বটে  সেরিবান বহুদূরে,

যাচ্ছে ওপারে   নৌকোয় চড়ে   মাঝনদী বরাবরে।

কলরব করে   গলা বুঝি চিরে   নৌকা ফেরারে দুষ্ট,

দেখে নেব তোরে   দেব প্রাণে মেরে   বলে দিনু আমি স্পষ্ট।

কিন্তু যে তার    এত চিৎকার    সেরিবান নাহি শোনে,

না হেরি উপায়   নদীতে ঝাঁপায়   সাঁতার নাহি সে জানে।

অবশেষে হিত   যা হওয়া উচিত   অতি লোভে তাঁতি নষ্ট,

সেরিবা অকালে   প্রাণ দিল জলে   সেরিবান পায় কষ্ট।

কি বা যায় করা   মান্যতা ছাড়া   বিধির অমোঘ বিধান,

স্যাকরার কাছে   বাসনটি বেচে   ধনী হয় সেরিবান।

বুড়ীমার তরে   অন্ধনগরে  দিয়ে আসে কিছু অর্থ,

বাকী বুঝেসুঝে   ব্যবসার কাজে   খাটায়ে হয় না ব্যার্থ।

করে দানধ্যান   সাধু সেরিবান  দিন কাটে সুখে তার,

সতত সততা   লালসাহীনতা   লভে সে পুরস্কার।

ধরাপরে যদি   কেহ নিরবধি    চলে সত্যের পথে,

দেবাশীষ তবে   দিবানিশি রবে   সেই মানবের সাথে।

লোভে হয় পাপ    পাপে উত্তাপ    লোভাতুরে করে দগ্ধ,

নীতি শিক্ষক    কাহিনী জাতক   পাঠে কর মন স্নিগ্ধ।

তথাগত বুদ্ধ    নাহি কভু  যুদ্ধ   সাধনা জন্মান্তর,

তিনি বোধিসত্ব    লভেন দেবত্ব   বন্দন করি ঈশ্বর।

তাঁহার জনমকথা জাতককাহিনী যথা অবহিত হওসুধীজন,

ছন্দের আভরণ   দিনু এবে আবরণ   পূত হোক তনুমন।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleSorry
Next articleপাথর
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments