সাদা কালো–তৃতীয় পর্ব : click here

।৪।

“অনেক রাত হয়েছে বাবা, এবারে শুয়ে পর,” ঘরে এসে উঁকি দিল মা। রাত এখন একটা। সামনের মাস থেকে পদার মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু। সে অনেক রাত জেগে পড়ে। রাত জাগার যে খুব প্রয়োজন তা নয়। আসলে পদার রাত জাগতে ভাল লাগে। গোটা শহরটা যখন ঘুমিয়ে পরে, তখন রাতের আকাশটাকে কেমন যেন মায়াবী লাগে। তারা গুলোর দিকে তাকালে মনে হয় যেন ওরা কিছু বলতে চায়। আবার মাঝেমাঝে মনে হয় যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পদা মাঝেমাঝে ছাদে চলে যায়। খোলা আকাশের নিচে পায়চারি করতে করতে তার সদ্যপ্রাপ্ত ভরাট গলায় গায় “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে…” পদার গানের গলা খুব সুন্দর, যদিও সে কারো সামনে কখনো গান গায় না। মাঝেমাঝে পায়চারি থামিয়ে সোনালিদের বাড়ির দিকের ছাদের কোনটায় দাঁড়ায়। অন্যমনষ্ক হয়ে যায়। সোনালি কি এখন…? নিজেকে জোর করে থামায়। অবশ্য রাত জাগার আরো একটা কারণ আছে পদার। ইদানিং পদা মাঝেমধ্যে এক আধটা সিগারেট খায়। মা শুয়ে পরার আগে খাওয়া যায় না। কেন যে খায় সে নিজেই জানে না, তবে লক্ষ্য করেছে যে খেলে মন্দ লাগে না। “তুমি শুয়ে পরো মা, আমি আর আধ ঘন্টায় শুয়ে পরবো”। মা চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকলো। পদার কাঁধে হাত রেখে খানিক্ষন দাঁড়িয়ে রইল। তারপর যেন হঠাত মনে পরেছে সেই ভাবে বলল “হ্যারে, পাশের বাড়ির মানুদি বলছিলেন যে সোনালি নাকি সামনের বছর থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স এ কমার্স পরবে”। পদা অবাক হোলো। মা হঠাত এই কথাটা কেন এত রাতে বলতে এলো? তাহলে কি মা কিছু আঁচ করেছে? কিন্তু আঁচ করবেই বা কি করে? পুরোটাই তো পদার মনের কল্পনা। কে জানে? হয়ত বা মা’রা নিজেদের সন্তানের কল্পনাটারও হদিস পেয়ে যায়। পদা অবশ্যি জানে যে সোনালি এক বছর ড্রপ দিয়েছে। কেন তা জানেনা। খবরটা শুনে সে খুশিই হোলো। যদিও তার বয়স মোটে ষোলো, তবু এই গত দু বছরে পদা খুব ভালো করেই বুঝে গেছে যে মস্তিষ্কটাকে কাজে ব্যাস্ত রাখাটা খুব জরুরী। তাতে মনের কষ্ট কমে। মাকে সে আলিঙ্গনে আবধ্য করলো “তুমি খুব ভালো, মা। যাও শুয়ে পরো। আমি এক্ষুনি শুয়ে পরবো”।

 

মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরলো। পদা স্টার পেলো। সে যে পরিমান খেটেছিল, তাতে অস্বাভাবিক কিছু নয়। যদিও তার স্কুলে সে প্রথম স্থান পায়নি, তবুও তার রেজাল্ট উল্লেখযোগ্যই বলা চলে। অঙ্কে সে স্কুলের সকলের চেয়ে বেশী নম্বর পেয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সে সাইন্স নিয়েই পরাশুনা করবে। ইলেভেন টুয়েল্ভ কোন স্কুলে পরবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। পদার ইচ্ছা কোনো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ঢোকার। ইংরিজি সে ভালোই জানে, তবে বলতে গেলে একটু জড়তা। সে জানে যে আজকাল ইংরিজি ভাল করে জানাটা চাকরি বাকরির ক্ষেত্রে আবশ্যক। পদা ঠিক করলো যে বাবার কাছে কথাটা পাড়বে। রেজাল্ট ভালো হওয়াতে বাবার মেজাজ এখন ফুরফুরে। একদিন সুযোগ বুঝে বলল “বাবা, আমি ভাবছি স্কুল চেঞ্জ করবো”। বাবা রাগ করলেন না। ভাল লক্ষন। “কেন রে?” “না মানে আমাদের স্কুলের সব স্ট্যান্ড করা ছেলেমেয়েরা তো অন্যান্য আরো ভালো স্কুলে চলে যাচ্ছে, তাই”। “তা, কোথায় পড়বি ভাবছিস?” “সেন্ট জেভিয়ার্স”। বাবা এবারে গম্ভীর। “না না, ওটা তো স্কুল নয়, ওটা কলেজ। ওখানে ছেলেপিলেরা খুব তাড়াতাড়ি বখে যায়। জত্ত ট্যাঁশ দের আড্ডা ওখানে”। “কিন্তু বাবা, পাশের বাড়ির…” বলতে গিয়েও পদা থেমে গেলো। এ কি বলতে যাচ্ছিলো সে! “তাহলে আমি কি করবো?” “কেন? ভাল স্কুলে পরতে চাস, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি হয়ে যা। হোস্টেলে থাকলে স্বাবলম্বী হওয়াটাও শিখবি”। “কিন্তু আমি যে ভেবেছিলাম ইংলিশ মিডিয়ামে…” “আরে ধুর! ইংরিজি শেখার বয়েস কি পেরিয়ে যাচ্ছে নাকি? কলেজে যখন পড়বি এমনিতেই ইংরিজি শিখে যাবি”। পদা আর কিছু বলল না। বাবার সাথে তর্ক করে লাভ নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলো। সঙ্গে তার একরাশ চিন্তা। অনেকটা হাঁটলো। অবশেষে হেদুয়ার পাশে একটা বেঞ্ছএ শান্ত হয়ে বসলো। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াটা মন্দ হবে না। আর কথাটা বাবা ভুল বলেনি। ইংরিজি সে ঠিকই শিখে যাবে। নিজেকে বোঝালো যে যে কারণে সে সেন্ট জেভিয়ার্সএ পড়তে চাইছিলো সেই কারণটা তো পুরোপুরিই তার মনগড়া, কল্পনার শিশিরে মোড়া। রোদ উঠলেই সব উবে যাবে। সময় এসেছে হয়ত সেই কল্পনার বাঁধন থেকে মুক্তি পাওয়ার। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে—এই পাড়া থেকে দূরে সরে যাওয়াটাই এখন কাম্য। মা অবশ্যি মন খারাপ করবে। পদারও মা’র জন্য মন খারাপ লাগবে। তবে বাড়িতে তো মাঝেমাঝেই আসবে। এ তো দিল্লি বোম্বাই নয়। অনেকদিন পরে পদার নিজেকে কেমন যেন হঠাত স্বাধীন লাগছে। হেদুয়ার জলে ভেসে বেরানো হাঁস গুলোকে সে অনেক্ষন মনোযোগ দিয়ে দেখলো। “আমি তোদের মত হতে চাই; সম্পূর্ণ বাঁধনছাড়া”। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেঞ্ছ থেকে উঠলো। বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালো। “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…” মনে মনে গুনগুন করছে সে। আকাশের রঙটা আজ গাড় নীল। মেঘের লেশমাত্র নেই তাতে।

To be continued…

 

 

~ সাদা কালো-চতুর্থ পর্ব ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleMeaningless
Next articleএটা আমার কান্না
Sandip Mazumder
I can't write but I try. What else do you want to know? লিখতে পারি না কিন্তু চেষ্টা করি। আর কি জানতে চান? To contact me, please E-mail me at sandip23m [at] yahoo.com. Your feedback is what inspires me to write. So, please leave a comment.
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments