সাদা কালো (Episode 2) : click here

।৩।

 

বেশ কিছুদিন যাবত পদার একদম ঘুম হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ঘুরেফিরে ঘুমের মধ্যে সেই সিনেমার নায়িকা আর সোনালির মুখটা মিলেমিশে এক অদ্ভুত মুখ দেখা দেয়। এমন এক মুখ যার চোখে কোনো ভাসা নেই, কিন্তু ঠোটের কোনে এক বক্র হাসি। যেন পদাকে ব্যাঙ্গ করছে। সেদিনের সেই সিনেমা হলের সোনালির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেদিন সিনেমা থেকে তিনজনে ফিরেছিল ট্রামে করে। পদা আর সোনালি পাশাপাশি বসেছিল। সোনালি আর কোন কথা বলেনি বিশেষ। হয়ত পদা কিছু বলবে সেই অপেক্ষায় ছিল। আর পদা? সে কথা বলতে চেয়েছিল। অনেক কথা। অনেক্ষন ধরে। কিন্তু তার হৃৎপিণ্ড এত জোরে দৌড়াচ্ছিল যে সে মুখ খুলতে সাহস পায়নি। পাছে বেফাঁশ কিছু বলে ভাল লাগার আবেশটাকে নষ্ট করে দেয়। তাছাড়া বাবলুদার সামনে সে কিই বা বলবে? পুরো রাস্তা বাবলুদা এন্তার বকবক করে গেল। বেশির ভাগটাই সোনালিকে উদ্দেশ্য করে। পদা লক্ষ্য করেছে সোনালি ভাল করে বাবলুদার কথা শুনছিল না। তার দৃষ্টি ছিল দূরে, অন্যমনষ্ক। ট্রাম থেকে শুকিয়া স্ট্রিটের মোড়ে নেমে, বাবলুদা আর রাস্তা পার হোলো না। পদাকে এক পাশে টেনে কানে কানে বলল “ওকে তুই একটু বাড়ি যাওয়ার পথে ছেড়ে দে তো! ওর মা আমাকে দেখলে আবার ক্যাঁচাল করবে”। পদা খুশি হয়েছিল। অন্তত কয়েকটা মিনিট সোনালির সান্নিধ্যটা একা পাওয়া যাবে। সারকুলার রোড পার হয়ে দুজনে রামমোহন রায় রোড ধরে হাঁটতে লাগলো। ফেব্রুয়ারী মাস, কিন্তু পদার কপালে ঘাম। সে আড় চোখে একবার সোনালিকে দেখলো। সোনালি মাথা নিচু করে দ্রুতপদে হেঁটে চলেছে। পদা খুব চাইছিল যে সোনালি আরও কিছু বলুক। কিন্তু সোনালি তার ধারে কাছ দিয়ে যায়নি। কেবল নিজের বাড়ীর ভেতর ঢুকে যাওয়ার আগে হাত নেড়ে পদাকে “বাই” বলেছিল।

কেন ও আর কিছু বলল না? পদা কি কিছু দোষ করে ফেলেছে? কিন্তু কই? সেরকম তো কিছু মনে পরছে না! পদা তো কোন কথাই বলে নি। তাহলে দোষই বা হবে কি ভাবে? তবে কি সেটাই পদার ভুল? তার কি নিজে থেকে কিছু বলা উচিত ছিল? সোনালিই বা এত চুপচাপ ছিল কেন? হয়ত বা চিন্তিত ছিল বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে বলে। সিনেমাটা তো বেশ লম্বা ছিল; হিন্দি সিনেমার থেকেও বড়। মাকে হয়ত বলে এসেছিল যে ছটার আগে ফিরবে। কোন বান্ধবীকে হয়ত বলে রেখেছিল যে মা জিগ্যেশ করলে বলবি যে ছটা অব্ধি তোর বাড়িতে ছিলাম। হয়ত বা সে চায়নি যে পাড়ার লোকে দেখুক যে সে পদার সাথে সন্ধ্যেবেলা কোথাও থেকে ফিরছে। কেন? কেন? কেন? এই সমস্ত ভেবে ভেবে পদা প্রতি রাতে খালি এপাশ ওপাশ করে। ভোরের দিকে ক্লান্ত চোখে যখন ঘুম নামে, তখন আবির্ভাব হয় সেই মুখের। কি যে করবে ভেবে কূল কিনারা পায় না পদা। জীবনটার হঠাত এ কি হল? দিব্বি তো ছিল!

এই ভাবে কয়েক মাস কেটে গেল। ঘুমের সেই একই দশা। না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শরীরটা সব সময় ক্লান্ত লাগে। চোখের কোলে কালি। মা বারবার জিগ্যেশ করে “তোর কি হয়েছে?” পদা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে মার চোখ এড়িয়ে যায়; বলে “কই, কিছু না তো”। এদিকে সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। পড়াশুনা তো লাটে উঠেছে। এতকাল পদা খুব ভালো রেজাল্ট করে এসেছে। পরীক্ষায় খারাপ হলে নির্ঘাত ধরা পরে যাবে মা’র কাছে। আর বাবা তো চটে তেলেবেগুনে হয়ে যাবে। রেজাল্ট ভাল করে বলে বাবা পদাকে বিশেষ ঘাঁটায় না। কিন্তু এবারে কি হবে? কারো সাথে যে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচোনা করবে তারও উপায় নেই।

সোনালিকেও আজকাল আর বিশেষ দেখা যায় না। আগে মোটামুটি প্রতিদিন বিকেলবেলা দেখা যেতো সোনালি ওর কুকুর নিয়ে ছাদে খেলা করছে বা পায়চারি করছে। ঘটনার পর প্রথম প্রথম পদা ছাদে উঠে খুব মাউথ অরগান বাজাতো। ভেবেছিল কৃষ্ণের বাঁশীর মত তার মাউথ অরগান রাধাকে কাছে এনে দেবে। বাঁশী অনেকদিন বাজলো, কিন্তু রাধা এলো না। এখন আর পদা মাউথ অরগান বাজায় না। কি লাভ? মাসিমা, অর্থাৎ সোনালির মা, মাঝেসাজে ওদের বাড়িতে আসে মা’র সাথে গল্প করতে। পদা আরি পেতে ওদের কথা শোনে, যদি সোনালি সঙ্ক্রান্ত কোন খবর পাওয়া যায়। কিন্তু কোন উল্লেখযোগ্য খবর এই ভাবে সে উদ্ধার করতে পারেনি। এরই মধ্যে এক ছুটির দিন পদা বেরিয়ে সারকুলার রোডের দিকে যাচ্ছিলো, হঠাত তার নজরে পরলো সোনালি উলটো দিক থেকে আসছে। তার পরনে একটা সাদা আর কালো মেশানো সালওয়ার কামিজ। আরো সুন্দরী হয়েছে। পদার হৃৎপিণ্ড যেন ধাক্কা মেরে ওকে ফেলে দেবে। কোনোরকমে সে এগিয়ে চলল। ঠিক যেই মুহূর্তে পদা আর সোনালি একে অপরকে পার হবে, সে মুহূর্তে সোনালি তার গভীর চোখ তুলে চাইলো। পদাকে হঠাত সামনে দেখে একটু হকচকিয়ে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু হেসে বলল “ভাল আছো তো অনীক?” কতকাল পরে পদা আবার সেই কন্ঠস্বর শুনলো! আবার অনীক! পদা কি উত্তর দেবে ভাবছে, কিন্তু উত্তর দেবার আগেই দেখলো সোনালি তাকে পার হয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। একবার ভাবল পেছন থেকে ডাকে; ডেকে বলে “সোনালি তুমি যে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছো গো, ভাল কি করে থাকবো বল?” কিন্তু এ কথা যে কাউকে বলার নয়; সোনালিকেও নয়।

এমনি করে দেখতে দেখতে দু বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। বাবলুদাকে আজকাল আর এ পাড়ায় দেখা যায় না। গত বছর পুজোর সময় একবার প্যান্ডেলে দেখা হয়েছিল। বলল যে ও নাকি এখন বজবজ লাইনে ট্রেনে হকার। ওর মা এ চত্তরে থাকে বলে পুজোতে এসেছে। সোনালির কথা ও কিছু জিগ্যেশ করেনি। পদাও কোন উচ্চবাচ্চ্য করেনি। বাবলুদাকে দেখে পদার ওই দিন খুব ভাল লেগেছিল। বাবা যাই বলুক, ছেলেটার মনটা খুব বড়। পদা এখন ক্লাস টেন এ পরে। প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা। ছিপছিপে সুন্দর চেহারা। স্কুলের অনেক মেয়েরাই এখন পদার প্রেমে হাবুদুবু খাচ্ছে। কিন্তু পদার তাতে কোনো উৎসাহ নেই। সে পড়াশুনা করে খুব মন দিয়ে। ক্লাস এইটের রেজাল্ট টা খারাপ হবার পর পদা খানিকটা সামলে নিয়েছে। ঘুম এখনো তার কম হয়, তবে সেই মুখ স্বপ্নে আর দেখা দেয় না। সোনালি কিন্তু এখনও মনের আনাচে কানাচে ঘোরে। মাঝে মধ্যে তার সাথে রাস্তাঘাটে দেখাও হয়ে যায়। তবে সে দেখা আর পাঁচটা মেয়ের সাথে রাস্তায় দেখা হওয়ার মতই। জেম সিনেমার সেই ঘনিষ্ট মুহূর্তটা আজ যেন কত দূরে। মাঝেমাঝে পদা ভাবে সত্যই কি সেই ঘটনা ঘটেছিল? নাকি তার মনের ভুল? সত্যি হোক বা না হোক পদার এখন বোঝবার বয়েস হয়েছে যে সোনালি হয়তো কিছু না ভেবেই কথার কথায় তাকে একদিন মাউথ অরগান শোনাতে বলেছিল। তারপর যে ব্যাপারটা আর এগোয়নি তার জন্য সে আর সোনালিকে দায়ি করে না। আর করবেই বা কোন অধিকারে?

To be continued…

 

 

~ সাদা কালো–তৃতীয় পর্ব ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleমধু – মিতা সংবাদ (দ্বিতীয় (অন্তিম) পর্ব)
Next articleBatari
Sandip Mazumder
I can't write but I try. What else do you want to know? লিখতে পারি না কিন্তু চেষ্টা করি। আর কি জানতে চান? To contact me, please E-mail me at sandip23m [at] yahoo.com. Your feedback is what inspires me to write. So, please leave a comment.
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments