( ১ )
অলীকের আর্তনাদ

রাত ঘনায়মান । চারপাশে অন্ধকার নেমেছে ঝুপ করে । রাস্তার লাইটপোস্টের টিমটিমে আলোগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাওয়ারে স্নান করছে । কেউ যেন গোটা আকাশ জুড়ে একটা বিশাল কালচে জাল ছড়িয়ে দিয়েছে । সারা কোলকাতা শহর তখন মরণ ঘুমে আচ্ছন্ন । সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন মৃতবৎ নির্জন পথের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে কালো কোট আর কালো টুপি পরা একজন । বনের মধ্যে দিয়ে লোকে যেমন করে পথ চলে , সেও সেইভাবে অতি সন্তর্পণে রাস্তা গুনে গুনে এগিয়ে চলেছে স্কটিশ চার্চ কলেজের পেছনে হোস্টেলের দিকে । একটা কুকুর দূরে চিৎকার করে উঠতেই খানিকটা পেছনে ফিরে তাকায় সে ।
হোস্টেলের একতলার একটা রুমে তখনও আলো জ্বলছিল । জানাল দিয়ে দেখা যাচ্ছিল বিবর্ণ ভাবলেশহীন একটা মুখ বালিশে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে একমনে ফ্লুয়িড মেকানিক্সের একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছে । বিছানার ওপর একটা ছোট্ট ওয়াগম্যান আর তার থেকে একটা সরু কালো হেড ফোনের তার সেই ছাত্রের কানে গোঁজা । গান শুনতে খুব ভালবাসে অলীক । ফিজিক্সের জটিল ডেরিভেশন গুলো রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে একাই সমাধান করতে ভালবাসে সে ।
আমাদের জিপটা তখন সাঁ সাঁ করে পূর্ণ গতিতে ছুটে চলেছে অন্ধকারের বুক চিরে । পেছনে আর একটা টাটা সুমো আমাদের অনুসরন করে চলেছে । একটা জিপে আমি , ইন্দ্রজিৎ সান্যাল আর ইন্সপেক্টর কালীচরণ সমাদ্দার ও অন্যটাতে দশ বারো জন পুলিশ । আমাদের শরীর দুলছে , দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে নতুন এক অ্যাডভেঞ্চার এর আস্বাদনের আশায় ।
ডিটেকটিভ ইন্দ্রজিৎ সান্যাল যাকে আমি ইন্দ্রদা বলেই ডাকি বলতে শুরু করল …
“ আচ্ছা কালীবাবু আপনি তো আমাকে রাত এগারোটায় ফোন করে ডাকলেন , ব্যাপারটা সিরিয়াস তো ? মানে বলতে চাইছি কোনো প্র্যাকটিকাল জোক নয় তো ? ”

“ দেখুন ইন্দ্রজিৎ বাবু , আপনাকে ডিটেলেই বলি । রাতে আমার অফিসের ল্যান্ডফোনে একজন ফোন করেছিল । নাম বলল না । গলাটা একটা মেয়ের । শুধু বলল আজ মাঝরাতে হেদুয়া পার্কের কাছে স্কটিশ চার্চ কলেজের বিপরীতে যে হোস্টেলটা আছে সেখানে এক ছাত্র খুন হবে । প্রথমে ভেবেছিলাম কেউ ইয়ার্কি করে পুলিশ স্টেশনে ফোন করছে , সেটা অবশ্য সাইবার সেলে জানিয়েও দিয়েছি , দুদিনের মধ্যে নম্বর ট্রেস হয়ে যাবে । কিন্তু আবার মনে হল এত রাতে নিশ্চয় কেউ পুলিশের সঙ্গে রসিকতা করতে ফোন করবে না । মেয়েটি ফোন কেটে দেবার আগে আর একটা কথাও জানাল যে আমাদের দুজনের কথোপকথন পুরোটায় ওর ফোনে রেকর্ড হচ্ছে । তাই সত্যিই যদি তেমন কিছু ঘটনা ঘটে থাকে সেটা পুলিশ ডিপার্টমেন্টের জন্যও একটা বড় রিস্ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে । ”
“ হুম বুঝলাম । তবে ফোন নম্বর ট্রেস করে যে সেরকম কোনো সুফল পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না । আজকাল বাজারে অনেক বেনামি সিম বেরিয়েছে । যে ফোন করেছে সে নিশ্চয় বোকার মত তার মোবাইল থেকে কল করবে না । ”
“ ও আর একটা কথা , হোস্টেল সুপারের সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম । ফোনে পাইনি । কি মুস্কিল বলুন তো ? ”
গোলগাল , ফর্সা , চ্যাপ্টা নাকওয়ালা , দীর্ঘকায় কালীচরণ বাবু বেশ টেনশনে রয়েছেন বোঝা গেল । ইন্দ্রদার চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি আর মুখের রেখার হেরফের দেখে ওর মনের ভেতরটা বোঝার কোনো উপায় নেই । ইন্দ্রদাকে আমি না মেলাতে পারি ফেলুদার সাথে , না পারি কিরীটীর সাথে , ব্যোমকেশ তো নয়ই , আর কারোর সাথে তুলনা করা ইন্দ্রদার ঘোর অপছন্দের , তাই আমার কোনো গল্পে ওর বর্ণনা দেওয়া খুবই সমস্যার । দীর্ঘকায় যুবা ইন্দ্রজিৎ সান্যাল । গায়ের রং মাজা মাজা , মুখের ভাব মোলায়েম বা তেলতেলে নয় , বরং বেশ ব্যাক্তিত্বপূর্ণ । এক এক জনের কণ্ঠস্বর শুনলে যেমন বোঝা যায় লোকটি বেশ দৃঢ় , ইন্দ্রদাও ঠিক সেরকমই । ব্যাস এইটুকুই , হিজিবিজি বর্ণনার বেড়াজালে আমার ডিটেকটিভ কে না রাঙিয়ে আসল গল্পে যাই ।
কিছুক্ষণ আগে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছিল । এখন তা থেমে গেছে । চতুর্দিকে জ্যোৎস্নার পিন ফুটেছে । আমাদের গাড়িটা হেদুয়া পার্কের কাছে এসে থামল , সেই সঙ্গে পেছনের টাটা সুমোটাও । উত্তর দিকে একটা রাস্তা , এই রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই আছে কলেজ হোস্টেলটা । চাঁদের আলোতে পার্কের গাছগুলোর পাতায় তুলোর মত আবরণ পড়েছে যেন । ইলেকট্রিক বাল্বগুলো দেখে মনে হয় ওরা যেন চাঁদের ডিম , জ্যোৎস্নায় তাদের আলো ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে । ওপরে তাকিয়ে দেখি ফ্ল্যাটের ছাদগুলোর মাঝে দিয়ে খণ্ডখণ্ড নক্ষত্রভরা আকাশ দেখা যাচ্ছে । অন্ধকারের টানে তারা স্রোতে ভাসছে ডুবছে । আমরা হেঁটে চলেছি বাঁদিকে Blossom Restaurant ক্রস করে । এইসব রাস্তা আমার খুব চেনা । ইন্দ্রদার তো চেনা অবশ্যই কারন হেদুয়া পার্কের কাছেই ইন্দ্রদা আর ওর গার্লফ্রেন্ড ঝিলিকদি মিট করতো । নিজের অজান্তেই আবার সেই গোয়েন্দা দাদার প্রেমপর্ব লেখনীতে এসে যাচ্ছে । ওর পারসোনাল ব্যাপারটা চাপা রেখেই আমাকে গল্প লিখতে বলেছিল ইন্দ্রদা , অগত্যা মিস ঝিলিক সেনগুপ্তের ইতি এখানেই ।

হোস্টেলের কাছাকাছি আসতেই নজরে পড়ল একজন নাইট গার্ডের ওপর , সিমেন্টের একটা উঁচু জায়গায় বসে ঘুমোচ্ছে , লিকপিকে চেহারার সাথে হাতে চওড়া একটা মোটা লাঠি বড়ই বেমানান ।
ইন্সপেক্টর সমাদ্দার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন … “ দেখছো তো কোলকাতা শহরের নাইট গার্ডের কি অবস্থা । ”
ইন্দ্রদা তখন হোস্টেলের আশপাশটা চোখ চিরে চিরে দেখছে । ঘড়িতে দেখলাম পুরো বারোটা বাজে । হোস্টেলটার মেনগেট রয়েছে ঠিকই কিন্তু তাতে তালা দেওয়া নেই । একটা সরু মোরাম ফেলা রাস্তা চলে গেছে চওড়া হোস্টেলটার দিকে । দূর থেকেই বোঝা যায় রুম রয়েছে অনেকগুলো । একটা রুমে তখনও আলো জ্বলছিল । চারপাশে রহস্যময় নিস্তব্ধতা । কালীচরণ সমাদ্দারের মুখে পান চেবানোর শব্দও শোনা যাচ্ছে । উনি নাইট গার্ডটার দিকে এগিয়ে গিয়ে গায়ে ঠেলা মেরে বললেন …
“ আরে ও ভাই , আলালের ঘরের দুলাল , বালিশ লাগবে ? বালিশ এনে দেবো ? ”
কিন্তু ততক্ষণে নাইট গার্ডটা মাটিতে পড়ে গেছে । আমি আর ইন্দ্রদা এগিয়ে গেলাম । ইন্দ্রদা লিকপিকে লোকটার হাত ধরে পালস্ দেখতে শুরু করলো তারপর বলল …
“ কেউ মনে হয় একে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে এমনভাবে বসিয়ে দিয়েছে । ”
রাস্তার কাদার মধ্যে কতকগুলো পায়ের ছাপ লক্ষ্য করলাম । কিছু যে একটা হতে চলেছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না । বাকি পুলিশগুলো ইন্সপেক্টরের নির্দেশে হোস্টেল চত্বর থেকে দূরে ছিল । ইন্দ্রদা কাদার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল …
“ দেখুন ইন্সপেক্টর সমাদ্দার , কাদায় দুরকম পায়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছেন ? ”
“ ইয়েস ইন্দ্রজিৎ বাবু , একটা ছাপ এই নাইট গার্ডের আর অন্যটা … ”
“ তাছাড়া দেখুন কাদার মধ্যে একটা লম্বা দাগ তার মানে এখানে এই নাইট গার্ডের লাঠিটা পড়েছিল । লাঠিটার গায়ে কাদাও লেগে রয়েছে । ”
ইন্দ্রদা বলল … “ তার মানে এই নাইট গার্ডকে অজ্ঞান করে সিমেন্টের ঐ উঁচু জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে আর লাঠিটা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে । ”
আমি বললাম … “ তাহলে লোকটার ফিঙ্গার প্রিন্ট নিশ্চয় ঐ লাঠিটাতে থাকবে । ”
“ অফকোর্স কালীচরণবাবু , এই লাঠিতে দুরকম ফিঙ্গার প্রিন্ট পাবেন , একটা এই নাইট গার্ডের আর অন্যটা যে অজ্ঞান করেছে তার । আপনি এই ফিঙ্গার প্রিন্টগুলো সনাক্ত করবার ব্যবস্থা করুন । কিছু তো একটা হতে চলেছেই এই হোস্টেলে । ”

হোস্টেলে যে রুম থেকে আলোর ছটা আসছিল সে রুমে ঘুমোয়নি তখনও অলীক । কালো কোট টুপি পরা কেউ একজন সেই রুমের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল , হাতে গ্লাভস পরা আর ডান হাতে একটা রিভলবার ধরা । হঠাৎ অলীকের চোখ চলে গেল জানলার দিকে । উত্তেজনায় মুখের চামড়া যেন ফেটে পড়ছিল তার ।
“ কে , কে ? কে ওখানে ? দেখো তোমাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি , ভয় দেখিয়ে আমাকে তোমাদের দলে টেনে নিতে পারবে না । আমি আমার ইউনিয়নকে শ্রদ্ধা করি । সেখানে তোমাদের ঐ জঘন্য কাজকর্ম করা দলে আমি কোনোদিন যাবো না । তুমি কি ভাবছো আমাকে খুন করলে পুলিশ তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে ? পুলিশের হাতে ধরা তোমাকে পড়তেই হবে । সাহস থাকে তো সামনে এসো । ”

এবার কালো কোট টুপি পরা সেই আগন্তুক এবার ঘরে ঢুকল । মুখে বাঁধা কালো কাপড়টা বাঁ হাতে করে খুলে ফেলল সে । ডান হাতের রিভলবারটা অলীকের দিকে তাক করা ।
“ একি ! তুমি … সুমি ………… আঃ আঃ আঃ আঃ । ”
কথাটা শেষ হলনা অলীকের । একটা গুলি এসে লাগলো বুকে । আগন্তুক দরজা দিয়ে দ্রুত সরে পড়ল ।
আমরা যখন নাইট গার্ডের অজ্ঞান হওয়া দেহটা নিয়ে তদন্তে ব্যস্ত ছিলাম তখন হোস্টেলের ভেতরে একটা গুলির আওয়াজ আর আর্ত চিৎকার শুনতে পেলাম । ইন্দ্রদা তড়িৎ বেগে ওইদিকে ছুটে গেল , পেছনে আমি ও ইন্সপেক্টর । ভেতরে উত্তেজনায় তখন মনে হচ্ছিল উন্মাদ হয়ে যাবো । দেখি আমাদের দিকে একটা লোক ছুটতে ছুটতে আসছে ‘ খুন খুন ’ বলে চিৎকার করতে করতে । পরনে ময়লা ধুতি আর হাতকাটা গেঞ্জি ।
“ আমাকে বাঁচান , আমাকে বাঁচান আপনারা । একজন কালো কোট আর টুপি পরা লোক অলীককে গুলি করে বাথরুমের পেছনে গলিটা দিয়ে পালিয়ে গেল । ”
ইন্সপেক্টর সমাদ্দার জিজ্ঞেস করলেন … “ ঐ পথ দিয়ে কি মেনরোডে যাওয়া যায় ? ”
“ হ্যাঁ । ”

এক মুহূর্ত দেরি না করে কালীচরণবাবু পুরো ফোর্স ছড়িয়ে দিলেন চারপাশে । আমি আর ইন্দ্রদা ঐ লোকটার সঙ্গে আলো জ্বলা রুমটার কাছে এলাম । দেখি বাইরে জানলার কাছে এক যুবক মেঝেতে পড়ে আছে , হাতে একটা রিভলবার ধরা । ইন্দ্রদা যুবকটার নাকের কাছে আঙ্গুল নিয়ে গিয়ে বলল … “ একে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জিপে নিয়ে গিয়ে তুলতে হবে , একেও ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করা হয়েছে । কালীচরণবাবু শিগগিরি অ্যামবুলেন্সের ব্যবস্থা করুন । রিভলবারটা কালেক্ট করে নিন । ”
আমরা এবার সেই রুমে ঢুকলাম । নজর গেল তক্তপোষের উপর । এক কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে , রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা বিছানা । কানে ওয়াগম্যানের হেডফোনটা গোঁজা । ততক্ষনে খবর চলে এসেছে গলিপথে কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি । হোস্টেল ক্যাম্পাসে তখন অনেকের ভিড় জমে গেছে । পুলিশের নির্দেশে কাউকে ভেতরে আসতে দেওয়া হয়নি । দশ মিনিটের মধ্যে ডাক্তার এসে কনফার্ম করল অলীক স্পট ডেড ।
ইন্দ্রদার কপালে টিপটিপ ঘাম জমেছে । ও বলে উঠল … “ এই রাতে আর সার্চের প্রয়োজন নেই কালীচরণবাবু । ডেড বডি পোস্টমরটেমের ব্যবস্থা করুন । আপাতত এই ওয়াগম্যান টেপটা নিয়ে থানায় চলুন , রুমটা সিল করে দিন । কাল এখানে আসবো । হোস্টেলে প্রত্যেকের জবানবন্দি নেবার ব্যবস্থা করুন , কেউ কোথাও যেন না যায় , নো এক্সকিউজ । ইটস্ আ কেস অফ মার্ডার , মাইন্ড ইট । সন্দেহজনক কিছু দেখলে তাদের আইডেনটিফাই করুন , থানায় কাল তাদের সঙ্গে আমি আলাদা কথা বলবো । ”
আমরা বাড়ি ফিরলাম প্রায় ভোরের দিকে । ইন্দ্রদা এসে থেকেই গুম হয়ে আছে । আসলে অলীকের খুনের জন্য ও একটু হলেও নিজেদের সিরিয়াসনেসের অভাববোধকেই দায়ী করছে , নইলে একদম নাকের ডগা দিয়ে খুনি খুন করে পালিয়ে যায় কি করে ? শরীরে এত ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুম আসছিল না অলীকের ঐ নিষ্পাপ মুখটার কথা ভেবে । বেড সুইচ অফ করতেই ঝুপ করে অন্ধকার নামলো ।

( ২ )
জবানবন্দি

অন্ধকারে বসে আছি আমি আর ইন্দ্রদা একটা চেয়ারে , অন্য একটাতে ইন্সপেক্টর কালীচরণ সমাদ্দার ।
“ হাবিলদার … জেনারেটরটা চালিয়ে দাও । আপনারা চা কফি কিছু নেবেন ? ”
“ নো থ্যাঙ্কস । ”
পরের দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ থানায় এসে পৌঁছেছি আমি ও ইন্দ্রদা । বাইরে আলোর আভা থাকলেও থানার ভেতরটা অন্ধকার । ইন্সপেক্টরের নির্দেশে হাবিলদার জেনারেটর চালিয়ে দিল ।
“ তারপর বলুন সমাদ্দারবাবু , ইনভেস্টিগেশন কতদূর এগোলো ? ”
“ আপনাকে বলেছিলাম না , মার্ডার যে করেছে সে যথেষ্ট চতুর । হোস্টেল সার্চ করে মনের মত কিছু পাওয়া যায়নি । তবে আমার কি মনে হয় জানেন যে মেয়েটা আমাকে ফোন করেছিল সে খুন করেনি । ওটা একটা ট্রিকস মাত্র । ”
“ খুন করা আর খুন করানো ভাড়াতে গুন্ডা দিয়ে একই ব্যাপার । মেয়েটি সম্পর্কে কিছু উদ্ধার করতে পারলেন ? ”
“ মোবাইল নম্বর ট্রেস করে কোনো লাভ হয়নি । ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিপোর্ট আর আধ ঘণ্টার মধ্যে পেয়ে যাবো । তার আগে চলুন একবার অকুস্থলটা দেখে আসি । ”
ছটার মধ্যে স্কটিশ চার্চ কলেজের কাছাকাছি জিপ এসে থামল । আকাশে তখনও যথেষ্ট আলো । যে ঘরটায় খুন হয়েছে সেই ঘরটার তালা খুলতে খুলতে ইন্সপেক্টর সমাদ্দার বললেন …
“ অলীক সেন বি এস সি থার্ড ইয়ার , ফিজিক্স অনার্স নিয়ে পড়তো । বাড়ি মেদিনীপুরের তমলুক । আসলে কলেজে দশদিনের টানা ছুটি ছিল , তাই সব স্টুডেন্টরা বাড়ি চলে যায় । হোস্টেলে প্রায় কেউ ছিল না । সুযোগটা চমৎকার কাজে লাগিয়েছে খুনি । যে চারজন ছাত্র সেদিন রাতে উপস্থিত ছিল তাদের জেরা করা হয়েছে , সুফল কিছু পাওয়া যায়নি । ”

আমরা সেই ঘরটায় ঢুকলাম । হিমহিম স্যাঁতসেঁতে সোঁদা গন্ধ । টিউবলাইটের আলোতে ছোট্ট অগোছালো ঘরটির দিকে এবার চোখ গেল । বিছানার উপর কোনো বেডকভার নেই ,তার উপর মাদুর পাতা । এখানেই লাশটা ছিল তাই মাদুরে লাল রক্তের দাগ স্পষ্ট । রয়েছে বালিশ যার উপর বেশ গভীর একটা দাগ পড়েছে , দেখলেই মনে হয় আগে কেউ যেন কনুইয়ে ভর দিয়ে শুয়েছিল । চেয়ারগুলো ছড়ানো এদিক ওদিক । একটা টেবিলের উপর খাতাপত্র , কিছু ফিজিক্সের বই আর দু চারটে বাংলা উপন্যাস । ইন্দ্রদা ড্রয়ারটা টেনে খুলল । কতকগুলো greetings card পাওয়া গেল । দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে । একটা জায়গায় চকের লেখা ‘ অলীক ’ তার চারপাশে হিজিবিজি ডিজাইন করা । ইন্দ্রদার প্রখর দৃষ্টি রুমটার মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত চক্রের মত ঘুরছে । প্রায় পনেরো মিনিট পর আমরা রুম থেকে বেরিয়ে এলাম । পাশের যে ঘরে রাঁধুনি শবর থাকতো সেই ঘরটা দেখতে আরো দশ মিনিট লাগলো । হোস্টেল সুপার সৌমেন চক্রবর্তীকে ডাকা হল ।
“ নমস্কার আমি ইন্সপেক্টর কালীচরণ সমাদ্দার । ইনি স্বনামধন্য ডিটেকটিভ ইন্দ্রজিৎ সান্যাল এবং ওনার সহকর্মী সৌমাভ । ”
“ বলুন আমার দিক থেকে যতটুকু সাহায্য করার আমি করবো । ”
ইন্দ্রদা বলল … “ প্রথমত হোস্টেলের মেনগেট রাতে বন্ধ ছিল না সেদিন , দ্বিতীয়ত বাথরুমের পেছনে গলিটা দিয়েও তো বাইরের লোক ভেতরে আসা যাওয়া করতে পারে । এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন ? ”
“ আমি হায়ার অথোরিটিকে অনেকবার জানিয়েছি । কোনো লাভ হয়নি । আর মেনগেটে নাইট গার্ড থাকে । হয়তো নাইট গার্ডকে অজ্ঞান করে … ”
“ আপনাদের গেট কিপার ? ”
“ ছিল না । ছুটিতে বাড়ি গেছে । ”
“ আপনি কাল কোথায় ছিলেন ? ”
“ সাধারণত এখানেই থাকি , তবে কাল বাড়িতে ছিলাম । ছেলের জন্মদিন ছিল । ”
ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা থানায় এলাম সাড়ে সাতটায় । প্রথমে ডাকা হল নাইট গার্ড ভীমুকে । লিকপিকে লম্বা পুরু গোঁফওয়ালা ভীমু এসে বসল ইন্দ্রদার সামনের চেয়ারে ।
“ কাল রাতে ঠিক কি কি ঘটেছিল প্রথম থেকে বলো , কিচ্ছু বাদ দেবে না । ”
ইন্দ্রদা টেবিলের উপর অলীক সেনের ফাইলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল । ভীমু বলতে শুরু করল … “ আমি হেঁটে হেঁটেই পাহারা দিচ্ছিলাম । চারদিক খুব নিস্তব্ধ ছিল , হঠাৎ একটা অস্পষ্ট খসখস শব্দ আমার কানে এল , শব্দটা ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগলো । দেখি একটা কালো কোট আর টুপি পরা লোক এদিকে আসছে । হাত দুটো তার কোটের পকেটে ভরা । সোজা আমার কাছে এল লোকটা । অন্ধকারে মুখ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম না । তবে কালো গোঁফ আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল মুখে । আমি জোরে বলে উঠলাম … ‘ এত রাতে কাকে চাই ? ’ কথাটা শেষ হল না আমার । লোকটা একটা রুমাল আমার নাকে চেপে ধরল । আমার হাতের লাঠিটা পড়ে গেল । তারপর আর কিচ্ছু জানি না । ”
“ লোকটার হাতে কি গ্লাভস ছিল ? ”
“ না । ”
“ লোকটা তোমার সাথে কোনো কথা বলেনি ? ”
“ না । ”
“ তুমি এখন যেতে পারো । ”
ইনস্পেক্টর সমাদ্দার বলে উঠলেন … “ এইমাত্র খবর এল ইন্দ্রজিৎবাবু । আপনার ধারনাই ঠিক । লাঠিতে দুরকম ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেছে । একটা ভীমুর , আর অন্যটা কারোর সাথে ম্যাচ করেনি । ওটা নিশ্চয় ঐ কালো কোট টুপি পরা লোকটার । আরো একটা খবর , যে রিভলবার থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে সেটিতে একটি গুলিই ফাঁকা এবং ঐ রিভলবারের গুলিই অলীকের শরীরে পাওয়া গেছে পোস্টমরটেম বলছে । কিন্তু একটা হিসেব মিলছে কই ? ঐ রিভলবারে তো কালো কোট টুপি পরা লোকটার ফিঙ্গার প্রিন্ট থাকা উচিত , তাই না ? ”
“ তাহলে কি ঐ লাঠির ফিঙ্গার প্রিন্টের সাথে রিভলবারের ফিঙ্গার প্রিন্ট ম্যাচ করেনি ? ” … আমি বললাম ।
“ না । আর রিভলবারে শুধু হীরার ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেছে । ”
ইন্দ্রদা বলল … “ আচ্ছা ঐ হীরাকে একবার ডাকুন । ”
এক যুবক আমাদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল । লম্বা পেশল চেহারা , পরনে নীল গেঞ্জি আর জিন্সের প্যান্ট । যুবকটি টেবিলের উপর হাতদুটো রেখে বলল …
“ আপনারা আমাকে শুধু শুধু ধরে রেখেছেন কেন বলুন তো ? আমি তো বলছি আমি অলীকের খুনের ব্যাপারে কিচ্ছু জানি না । ”

ইন্দ্রদা বলল … “ বসুন মিস্টার … আপনার নামটা ? ”
যুবকটি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল … “ আমি হিরণ্ময় রায় । শর্টে হীরা । কিন্তু আপনারা আমাকে নিয়ে যা শুরু করেছেন … ”
“ আপনি অত রাতে হোস্টেলে কি করতে গিয়েছিলেন ? ”
“ অলীকের সাথে দেখা করতে । ” … হীরার মুখে বিরক্তির ছাপ ।
“ বন্ধুর সাথে দেখা করতে কেউ অত রাতে হোস্টেলে যায় না । ”
“ আমি যাই , এনি প্রবলেম ? ”
“ আপনি তো অলীকের সিনিয়ার ব্যাচ ? ”
“ কেন সিনিয়াররা বন্ধু হয় না নাকি ? আপনারা তো যা তা শুরু করছেন এবার …”
“ তুমি কি জানো রিভলবারে তোমার ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেছে ? ” … ইনস্পেক্টর বললেন ।
“ আমার জানার প্রয়োজন নেই । ”
“ প্রয়োজন আছে বইকি , বেশি চালাকি না করে যতটুকু জানিস উগড়ে দে , নাহলে কপালে খুব দুঃখ আছে । ” … ইন্দ্রদার গলার স্বর ধারালো হয়ে গেছে । ও সোজা আপনি থেকে তুই তে নেমে এল ।
“ দেখুন । আমি যতটুকু জানি বলছি । আমি রাতে অলীকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম । কারণটা পারসোন্যাল । ”
“ চাবকে তোর পারসোন্যাল বের করে দেবো , কেন গিয়েছিলি ? ”
“ একটা বইয়ের দরকারে । ”
“ বাথরুমের পেছনে গলিটা দিয়ে ? ”
“ হ্যাঁ । আমি অলীকের রুমের দরজার কাছে আসতেই মনে হল কেউ আমার পেছনে আসছে । আমি পেছন ঘুরতে যাবো ঠিক তখনই একটা গ্লাভস পরা লোক পেছন থেকে রুমাল দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরল । তারপর অজ্ঞান হয়ে যাই । জ্ঞান ফিরে দেখলাম পুলিশ স্টেশনে । ঐ টাইমের মধ্যে হয়তো সে খুন করে আমার হাতে রিভলবারটা ধরিয়ে পালায় । ”
“ বিশ্বাস করলাম । তবে সত্য মিথ্যা যাচাই করতে বেশি সময় লাগবে না । তোর ফোন নম্বর টা লিখে দিয়ে বাড়ি যা , দরকার পড়লে আবার ডাকবো । ”
হীরা নম্বরটা একটা ছোট্ট চিরকুটে লিখে সোজা গটগট করে বেরিয়ে গেল । লক্ষ্য করলাম হীরা বাঁ হাতে লেখে । এবার ঘরে ঢুকল গেঞ্জি ধুতি পরা কালো রাঁধুনি শবর ।
শবর শুরু করলো তার দেখা রাতের ঘটনা কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ভয়ের প্রকাশ ঘটাচ্ছে … “ আমি তখন পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছি । গুলির আওয়াজ শুনে প্রথম ঘুম ভাঙ্গে । বাইরে দরজা খুলে বেরিয়ে দেখি কালো কোট টুপি পরা একটা লোক ছুটে পালাচ্ছে । আমি খুন খুন বলে চিৎকার করতে করতে বাইরে ছুটে যাই । এর বেশি আমি কিছু জানি না বিশ্বাস করুন । ”
ইন্দ্রদার নির্দেশেই ইন্সপেক্টর ওকে ছেড়ে দিলেন । তার আগে ওর বাড়ির ঠিকানাটা জেনে নিল ইন্দ্রদা । কালীচরণবাবু সেই ছোট্ট ওয়াগম্যান টেপটা বের করে ইন্দ্রদাকে দিলেন আর বললেন …
“ এটা বাড়ি নিয়ে গিয়ে শুনুন , দেখুন যদি কিছু আন্দাজ করতে পারেন । ক্যাসেটটা এর ভেতরেই আছে । ”
“ সিওর । আচ্ছা আপনি ঐ হীরা ছেলেটা যেন শহরের বাইরে যেতে না পারে একটু ওয়াচ করবেন তো ? ”

( ৩ )
সত্যি কোনটা ?

“ এত মন দিয়ে কি ওয়াচ করছিলে ইন্দ্রদা ? ”
“ আয় বোস , সৌম্য । একটা ফিঙ্গার প্রিন্টের ওপর লেখা ব্রিটিশ লেখকের বই দেখছিলাম । ”
এটা পরের দিন সকালের ঘটনা , ইন্দ্রদা তখন টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ঐ বইটা পড়ছিল । টেবিলের উপর একটা ক্যাসেট রাখা ছিল । ইন্দ্রদা আমাকে ডেকে সোফায় বসতে বলল । ওয়াগম্যানে ক্যাসেটটা ভরতে ভরতে ও শুরু করলো …
“ এবার মন দিয়ে শোন মৃত অলীক সেনের মৃত্যুর ঠিক আগের কথাগুলো । অলীক প্রথমে গান শুনছিল ঠিকই কিন্তু মৃত্যুর ঠিক আগে সে বুঝতে পেরেছিল যে খুনি তাকে খুন করতে এসেছে । তাই বুদ্ধিমান অলীক ওয়াগম্যানের রেকর্ডিং সুইচ অন করে দিয়েছিল । কিন্তু মুশকিল হল খুনি একটা কথাও বলেনি যাতে করে তার গলার স্বর চেনা যায় । স্রেফ গুলি করে পালায় । নে এবার নিজের কানেই শোন । ”
ইন্দ্রদা ক্যাসেটটা রিওয়াইণ্ড করে প্লে করে দিল । রেকর্ডিং এর শব্দ ভেসে এল … ‘ দেখো তোমাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি , ভয় দেখিয়ে আমাকে তোমাদের দলে টেনে নিতে পারবে না । আমি আমার ইউনিয়নকে শ্রদ্ধা করি । সেখানে তোমাদের ঐ জঘন্য কাজকর্ম করা দলে আমি কোনোদিন যাবো না । তুমি কি ভাবছো আমাকে খুন করলে পুলিশ তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে ? পুলিশের হাতে ধরা তোমাকে পড়তেই হবে । সাহস থাকে তো সামনে এসো । ’ তারপর কিছুক্ষণ কোনো শব্দ নেই । এবার অলীকের গলা শোনা গেল আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গুলির আওয়াজ …
‘ একি ! তু … তুমি … সুমি … আঃ আঃ আঃ আঃ । ’ ইন্দ্রদা স্টপ করলো ।
আমি প্রশ্ন করলাম … “ সুমি কি তাহলে কারোর নাম ? তোমার কি মনে হয় ? ”
“ হ্যাঁ , তবে অলীক আসলে যে নামটা বলতে চেয়েছিল সেটা সম্পূর্ণ হয়নি । ”
“ মানে ? ”
“ সুমিলি । সুমিলি বলতে গিয়ে অলীক সুমি বলে আটকে যায় । ”
“ সুমিলি ? ”
“ হ্যাঁ সৌম্য । আমি যখন হোস্টেলে অলীকের ড্রয়ারটা খুলি তখন ওখানে কতকগুলো গ্রিটিংস কার্ড পাই । তার মধ্যে একটাতে সুমিলি লেখা ছিল । ”
“ সুমিলি অলীক সেনের কলেজ ফ্রেন্ড হতে পারে । ”
“ একবার অলীকদের বাড়ি তমলুক যাবো ভাবছি । ইন্সপেক্টর সমাদ্দার কি বলেন দেখি । আচ্ছা রেকর্ডিং শুনে তোর কি কমেন্ট সৌম্য ? ”
“ একটা জিনিস তো জলের মত পরিষ্কার , ইন্দ্রদা । অলীকের কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে যখন অলীক খুনিকে প্রথম দেখল তখন অন্য কাউকে এক্সপেক্ট করেছিল । আবার কিছুক্ষণ পর যেহেতু ‘ একি সুমি ! ’ বলল তাই বলা যেতে পারে , পর মুহূর্তে সে দেখতে পেয়েছিল আনএক্সপেক্তেড কাউকে । মানে বলতে চাইছি অলীক সেন প্রথমে খুনিকে চিনতে ভুল করেছিল । কাছে আসতেই সে বুঝতে পেরেছিল এ লোক অন্য । ”
“ গুড । আর একটা কথা শবরের কথা শুনে কিছু বুঝলি ? ”
“ সবটা বিশ্বাস হল না । ”
“ আমারও সিক্সথ সেন্স তাই বলছে ও পুরোটা বলছে না । ”
“ হুম , তাই মনে হয় , নাহলে অলীক সেন গুলি লাগার আগে এতগুলো কথা বলল অথচ পাশের ঘরে শুয়ে থাকা শবর কিছুই শুনতে পেল না । ”
“ রাইট সমু । ”
“ আচ্ছা সুমি মানে কি সুমিলিই হতে হবে ইন্দ্রদা ? ”
“ তার আগে জানতে হবে সুমিলি মেয়েটা কে ? তবে সুমি মানে আর একজনও হতে পারে … কিন্তু … ”
ইন্দ্রদাকে থামতে হল কারন ওর মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে ।
“ হ্যালো … ”
“ হ্যালো ইন্দ্রবাবু । নতুন খবর দেবার আছে । আপনি আমাদের বাড়িতে চলে আসুন , গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি । আমার ছেলে এই খুনের ব্যাপারে কিছু ইনফরমেশন দেবে । ”
“ আপনার ছেলে ? ”
“ হ্যাঁ ও তো একই ডিপার্টমেন্টে অলীকের সাথে স্কটিশচার্চে পড়তো । ”
“ আগে বলেন নি তো কালীচরণবাবু । বাই দা বাই বিকেলে গেলে হয় না ? ”
“ না ইন্দ্রজিৎবাবু আপনারা এখনই আসুন । এখানেই লাঞ্চ করবেন । বিকেলে একজনের বাড়ি যাবার প্ল্যান আছে । ”
“ আবার খাওয়া দাওয়ার ঝামেলা কেন ? আমরা … ”
“ ঝামেলার প্রশ্নই নেই । বরং আপনারা না এলেই আমার ওয়াইফ অসন্তুষ্ট হবে । আমার স্ত্রী সুচিত্রা আপনার আর সৌমাভর চরম ভক্ত । বীরভূমের ব্লু ডায়মন্ড কেসটা শোনার পর আপনাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য অনেক আশা করে আছে । ”
“ অল রাইট সমাদ্দার বাবু । আমরা রেডি হয়ে নিচ্ছি । উই মাস্ট কাম । ”

সাড়ে ছটা নাগাদ কালীচরণ সমাদ্দারের ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেলাম । সুন্দর সুবিশাল ঘর । সুন্দর কারুকার্যের আরাম কেদারা আর দামি আসবাব । মেঝেতে মখমল কার্পেট বেছানো । জানলা থেকে ভেসে আসছে রজনীগন্ধার সৌরভ । ওনার স্ত্রী সুচিত্রাদেবীর সঙ্গে পরিচয়ে বুঝলাম ভদ্রমহিলা যথেষ্ট সাদাসিধে , সরল , মিশুকে । ওনার চোখদুটো ভীষণ প্রাণবন্ত , হাসলে গালে টোল পড়ে , চিবুকের নিচে পড়ে ভাঁজ ।
কালীচরণবাবু বাইরে বাজারে বেরিয়েছিলেন । ওনার ছেলের সঙ্গে আলাপ হল । বাইরে থেকে এল বলে পরনে ছিল হলুদ রঙের একটা শার্ট , ডেনিম জিন্স , চোখে ফাসট্র্যাকের সানগ্লাস । সুন্দর করে ঘন চুলগুলো ছোট কপালের উপর সাজানো । মুখের মধ্যে উদাসীন ভাবটা দুচোখের আগ্রাসনে চাপা পড়ে গেছে । জিম করা পেটাই চেহারা ।
“ আপনারা কতক্ষণ এলেন ? আমি একটু বাইরে বেরিয়েছিলাম বাবার সাথে , বাবার আসতে একটু দেরি হবে বলে আমাকে তাড়াহুড়ো করে পাঠিয়ে দিল । ডোন্ট মাইন্ড । ”
“ ইটস ওকে , আপনার মায়ের রাজকীয় আপ্যায়নের পর মাইন্ড করার কোনো জায়গাই নেই । আপনিই তাহলে অলীকের ক্লাসমেট ? ”
“ হ্যাঁ আমি রজক সমাদ্দার । আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন ইন্দ্রজিৎ বাবু । ”
“ থ্যাঙ্ক ইউ । ” … ইন্দ্রদা টেবিলের উপর রাখা একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে বলতে শুরু করলো … “ আচ্ছা রজক , অলীকের ব্যাপারে তুমি কিছু বলবে শুনলাম । ”
শান্ত পরিষ্কার দৃঢ় কণ্ঠে রজক বলতে লাগলো … “ অলীক আর আমি একই ব্যাচের । ও আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল । অলীকও আমায় খুব ভালোবাসতো । খুব ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিল অলীক । কোনোরকম অন্যায় যেমন করতো না সেরকম কোনোরকম অন্যায়কে প্রশ্রয় দিত না । ”
“ সুমিলি বলে কাউকে চেনো তুমি , রজক ? ”
“ হ্যাঁ সুমিলিও ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের , তবে সেকেন্ড ইয়ার । আমরা চারজন , আমি , অলীক , সুমিলি , সুমিত অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলাম । কলেজ থেকে আমাদের বাড়ি একই দিকে মানে ডানলপের দিকে হওয়ায় আমরা একসঙ্গে ফিরতাম । অলীক অবশ্য কলেজ হোস্টেল পেয়েছিল , ওখানেই থাকতো । ওর বাড়ি তমলুকে । ”
“ আচ্ছা রজক , সুমিলির সঙ্গে কোনোদিন অলীকের ঝগড়া হয়েছিল ? ”
“ সে যেমন বন্ধুদের মধ্যে হয় , আপনি কি সুমিলিকে সন্দেহ করছেন ? ”
“ না সেটা নয় , নাউ ডোন্ট মাইন্ড , আই উইল ডিসকাস অল ওপেনলি , সুমিলি আর অলীক কি শুধুই বন্ধু ছিল ? আই মিন টু সে , এনি উইকনেস ? ”
“ নো নো নাথিং ইন্দ্রজিৎ বাবু , দে ওয়ের অনলি ফ্রেন্ডস , নট মোর দ্যান দ্যাট । তবে সুমিত আর সুমিলির মধ্যে …… ”
“ এনি লাভ অ্যাফেয়ার ? বলে ফেলো , মাইন্ড ইট ইটস আ কেস অফ মার্ডার । ”
“ বলতে পারবো না । ওদের দুজনের মধ্যে কোনো কিছু চললেও সেটা আমি আর অলীক কোনোদিন জানতে পারিনি । ”

“ সুমিতের ফোন নম্বরটা আমাকে একটু দাও । আর কোনো ছবি থাকলে আমাকে একটু দেখাও । ”
রজক ওর মোবাইল থেকে সুমিতের নম্বরটা ইন্দ্রদাকে দিল । মোবাইলে ওদের চার বন্ধুর একটা গ্রুপ ফটো আমাদের দেখালো । ইন্দ্রদার ভ্রু কুঁচকে গেছে সুমিতের ছবি দেখে ।
দুজনে একসঙ্গে বলে উঠলাম … “ চেনা চেনা লাগছে । ” কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে পারলাম না ।
“ আচ্ছা এতক্ষন তো আমিই তোমাকে প্রশ্ন করতে থাকলাম , খুনের ব্যাপারে তুমি কিছু বলবে বলছিলে ? ”
“ হ্যাঁ সেজন্যই তো বাবা আপনাদের ডেকেছে । ”
“ কাউকে সন্দেহ হয় তোমার ? ”
“ সেটাই আপনাদের বলবো ইন্দ্রজিৎবাবু । অলীকের প্রধান বন্ধু বলতে আমরা তিনজনই ছিলাম । আমি , সুমিত আর সুমিলি । সুমিত একটু স্বার্থপর টাইপের , সম্পূর্ণ নিজস্ব মতামত আমার । খুন সুমিত করতেই পারে না কারন ঐদিন রাতে সুমিত মামার বাড়ি বর্ধমান চলে যায় । আমাকে সন্দেহ করা না করাটা আপনাদের ব্যাপার । সুমিলি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি , এক ক্লাস জুনিয়ার আমাদের থেকে , সকলের প্রতি ওর যেমন সিমপ্যাথি আছে তেমনি সকলের ওর প্রতি । সুমিলি অলীককে খুন করবে স্বপ্নেও ভাবতে পারি না । খুন যদি কেউ করতে পারে , সে একজনই , সে হল হীরা । ”
“ হীরা ? মানে হিরণ্ময় রায় ? ” … আমি বললাম ।
“ হ্যাঁ হিরণ্ময় রায় । একই কলেজে পড়ে । আমাদের থেকে দু বছরের সিনিয়ার । ফেল করতে করতে আমাদের ব্যাচে । প্রোফেসাররা পর্যন্ত হীরাকে ভয় করে । জুনিয়ার টু সিনিয়ার কলেজের সবাই হীরাকে চেনে । একবার কি একটা যেন হয়েছিল যাতে কলেজ থেকে হীরাকে প্রায় টি সি দিয়ে দিত প্রিন্সিপ্যাল । কিন্তু শেষপর্যন্ত তা দেওয়া হয়নি । হীরার ঐ অবস্থার জন্য দায়ী ছিল অলীক , ঐ প্রিন্সিপ্যালের কাছে কমপ্লেন করে । যাইহোক ঐ হিরণ্ময় রায় আর কয়েকজন ছেলে অলীককে শাসাচ্ছিল । অলীক তাতে একটুও দমে যায়নি । কিছুদিন আগে থেকে ওরা অলীককে হুমকি দিতে থাকে এই বলে যে ওদের দলে যোগ দিতে হবে । কিন্তু অলীক ঐ নোংরা দলে ঢুকে নোংরা কাজকর্ম করার দিকে এতটুকু উৎসাহ দেখায় নি । ”
“ কিন্তু তুমি এতসব জানলে কি করে ? ”
“ আমরা যখন কলেজ ছুটির পর একসঙ্গে বাড়ি ফিরতাম তখন প্রায়দিনই হীরা দলবল নিয়ে অলীককে শাসাতো । অলীক পড়াশুনোতে ভাল ছিল , চেহারাতেও বেশ হিরোইজম ছিল । তাই ওরা অলীককে ওদের দলে টেনে নিতে চাইছিল । ঘটনাটা ইদানিং দশ বারোদিন থেকে চলছিল । ”
“ তোমরা কমপ্লেন করোনি ? ”
“ বাধা দিতে গেলেও কি ওরা শুনবে ? আর অলীকও ছিল একরোখা । হীরার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও বেশ আনন্দই পেত । অলীক যেদিন রাতে খুন হল সেদিন অর্থাৎ পরশু বিকেলের ঘটনা … আমি সুমিলি অলীক হেদুয়া পার্কে দাঁড়িয়ে ছিলাম , সুমিত সেদিন ছিল না । দেখি একটা রিক্সা করে পঁইত্রিশ ছত্রিশ বছরের বিবাহিত ভদ্রমহিলা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল । ”
অলীক বলে উঠল … ‘ একি বৌদি , তুমি এখানে ? ’
‘ হ্যাঁ রে অনেকদিন বাবার এখানে আসা হয়নি তাই এসেছি । ’
‘ দাদা এসেছে নাকি ? আমাকে একবারও জানালে না বৌদি … ’
‘ না আমি একাই এলাম , হঠাৎ করেই । এখনই তমলুক ফিরবো । তোদের তো আজই ছুটি পড়ল । একসঙ্গে চল যাই , আমি ওয়েট করছি । ’
‘ না বৌদি , আমাকে হোস্টেলে ফিরে কতকগুলো নোটস লিখতে হবে , মাকে বোলো কাল সকালে আমি যাচ্ছি । ’
‘ কিন্তু কলেজে ছুটি পড়ে গেলে তো তোদের হোস্টেলে কেউ থাকে না । ’
‘ তাতে কি ! হোস্টেলে রাতে রাঁধুনি থাকে । ’
“ তারপর শুনুন ইন্দ্রজিৎ বাবু , অলীক তখন আমার আর সুমিলির সঙ্গে বৌদির পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে , এমন সময় হীরা ও তার চারজন বন্ধু এসে অলীককে হুমকি দিতে লাগলো যে ওদের দলে না এলে ওরা অলীককে শেষ করে দেবে । বৌদি তখন পাশেই ছিল । হীরাকে আমি ভালোভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম । আমার কথা তো শুনলই না উল্টে বৌদিকে যা নয় তাই বলে অপমান করতে লাগলো । অলীক আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না , বৌদিকে ও মায়ের মতই ভালোবাসতো । হীরার সঙ্গে মারপিঠ শুরু করে দিল । আমি , সুমিলি , পাশাপাশি দোকানের কয়েকজন মিলে ওদের কোনোমতে আলাদা করলাম । হীরার নাক দিয়ে তখন গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে । ও অলীককে শাসিয়ে গেল যে সেদিন রাতেই ওকে দেখে নেবে । ঠিক হলও তাই । সেই রাতেই অলীক খুন হল । ” … রজক মাথা নিচু করল ।

ইন্দ্রদা টেবিলের ওপর হাতে ধরা ম্যাগাজিনটা ফেলে বললো … “ তারপর ? ”
“ তারপর আর কি । বৌদি অত করে বলল যে রাতে আর হোস্টেলে থেকে কাজ নেই । বৌদির সঙ্গে অলীক ঘর চলুক । কিন্তু অলীক গেল না । আমি আর সুমিলি কত বোঝালাম । আসলে একরোখা অলীকের মৃত্যুটা ভাগ্যে লেখা ছিল ইন্দ্রজিৎবাবু । আমার তরফ থেকে যতটুকু জানানোর আমি বললাম ইন্দ্রজিৎ বাবু । আমরা সবাই চাই অলীকের খুনি তাড়াতাড়ি ধরা পড়ুক । ”
“ থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ রজক , তোমার ইনফরমেশন আমার ভাবনার নতুন দিক খুলে দিয়েছে । ”
আমাদের কথাবার্তার ফাঁকে সুচিত্রাদেবী দুবার ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ দিয়ে গেছে । দুপুরে বিশাল একটা ভুঁড়িভোজের পর হালকা ঘুম দরকার ছিল । সেটা অবশ্য দমিয়ে রাখতে হয়েছিল বাড়িতে ছিলাম না বলে । বিকেলে কালীচরণবাবুর প্ল্যানই ছিল সুমিলির বাড়ি যাওয়া । ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল রজক । রজক অবশ্য আমাদের সাথে আসে নি ।
ইনস্পেক্টর সমাদ্দার কলিংবেল টিপতেই এক সুবেশী অল্পবয়স্কা তরুণী দরজা খুলে দিল আর সেই যে সুমিলি বুঝতে অসুবিধে হল না । কোমর অব্দি এক ঢাল চুল , আঙ্গুলের স্পর্শে বেরিয়ে আসা চুলে ঢাকা কান , পাকা গমের মত গায়ের রং , নাক আর ঠোট যেন কেউ যত্ন করে এঁকে দিয়েছে , পরনে কুসুম কালারের সালোয়ার , হাতে ব্রেসলেট ।
আমরা ঘরে ঢুকলাম । আমি আর ইনস্পেক্টর একটা সোফায় আর ইন্দ্রদা অন্য একটা সোফায় উপবেশন করল , সামনে চেয়ারে বসল সুমিলি । কালীচরণবাবুই প্রথম শুরু করলেন …

“ তোমার বাবা মা … ”
“ ওনারা আমার মামার বাড়ি গেছেন । ”
“ তুমি তাহলে একাই আছো ? ”
“ হ্যাঁ । ”
“ কদিন থেকে ? ”
“ পাঁচদিন হল । কিন্তু আপনারা এসব প্রশ্ন আমাকে … ”
“ আমরা অলীক সেনের খুনের তদন্ত করছি । আমার পাশে ইনি প্রখ্যাত ডিটেকটিভ ইন্দ্রজিৎ সান্যাল আর সৌমাভ , ওনার সহকর্মী । ”
“ আপনার পুরো নাম ? ” … ইন্দ্রদা প্রশ্ন করলো ।
“ সুমিলি দত্ত । ”
“ অলীকের মৃত্যুর খবরটা আপনি কখন শুনলেন মিস সুমিলি ? ”
“ কাল সকালের নিউজপেপারে । দেখেই আমি চমকে যাই । যা ভেবেছিলাম তাই হল । রাতে এত করে বারণ করা সত্ত্বেও অলীক একাই থেকে গেল হোস্টেলে । ”
“ আমরা রজকের কাছে শুনেছি সব । ”
ইন্দ্রদা কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সারা ঘরটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে । জানলার পর্দাগুলো এসির হাওয়াতে কেঁপে কেঁপে উঠছে । পর্দার ফাঁকে পড়ন্ত বিকেলের লালিমা । কালীচরণবাবু দেখলাম কিছু একটা ভাবতে ভাবতে আঙ্গুল মটকাচ্ছে ।
এবার ইনস্পেক্টর প্রশ্ন করলেন … “ অলীক যে রাতে খুন হয় , সেইসময় তুমি কোথায় ছিলে ? ”
“ কেন ? আমার ঘরে । ”
“ তুমি তখন জেগেছিলে , তাই না ? ”
“ হোয়াট ? কি বলছেন আপনি ইনস্পেক্টর ? ”
“ খুনের ঠিক আগে থানায় একটা ফোন এসেছিল , আর সেই ফোনটা করেছিল একটা মেয়ে । ”
“ হোয়াট ডু ইউ মিন ? ” … এসির হাওয়ার মধ্যে থেকেও সুমিলির কপালে টিপটিপ ঘাম জমে গেছে ।
“ আর সেই মহিলার গলা যে তোমার তাতে কোনো সন্দেহ নেই । ”
“ আর ইউ ম্যাড ? আপনারা কি ভাবছেন আমিই অলীককে খুন করেছি । ”
“ তা তো উনি বলেননি , মিস সুমিলি । এমনও তো হতে পারে খুনটা আপনি করেননি , কিন্তু করিয়েছেন । ” … ইন্দ্রদা মুখ খুলল ।
“ হোয়াট ননসেন্স … আমি ? ”
“ মে বি সুমিলি … ইটস নট ইম্পসিবল । ”
“ হাউ ইস ইট পসিবল ? আমি কেন ? আপনারা আমাকে কিসের ভিত্তিতেই বা সন্দেহ করছেন ? ”
“ আপনার ফেবারিট টপিক ফ্লুয়িড মেকানিক্স তাই না ? ”
সুমিলি অবাক দৃষ্টিতে তাকালো ।
“ অলীকের বিছানা থেকে একটা ফ্লুয়িড মেকানিক্সের বই পাওয়া গেছে , সেকেন্ড ইয়ার । অলীকের তো থার্ড ইয়ার তাই না মিস সুমিলি ? ”

“ হ্যাঁ বইটা আমার । অলীক নিয়েছিল আমার কাছে । আমাদের দুজনেরই খুব পছন্দের । ”
“ অলীককে কে খুন করতে পারে বলে আপনার মনে হয় ? ”
“ আমি জানি না , আমি কিছু জানি না । আমি খুন করিনি ইন্দ্রজিৎবাবু । আই লাভড হিম , রিয়েলি লাভড হিম । ও জানতো না আমি ওকে কতটা … ”
সুমিলি কেঁদে ফেলল । ওর কানের লতি , নাকের দুপাশ , লাল হয়ে গেছে ।
“ রিল্যাক্স , জাস্ট রিল্যাক্স মিস সুমিলি । আমরা আর আপনাকে বিরক্ত করবো না । তবে আপনি আমাদের কাছে কিছু লুকোচ্ছেন । সব খুলে বললে হয়তো ভাল করতেন । ”
সুমিলি দু হাতে মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে বলল … “ আমি কিছু জানি না , কিছু না । ” চোখ দিয়ে ওর টপটপ করে জল পড়ছে ।
“ মিস সুমিলি আপনার ব্রেসলেটে এস সি লেখাটার অর্থটা ঠিক বুঝলাম না । এস ডি হলেও সুমিলি দত্ত ধরে নেওয়া যেত । চলুন , ইনস্পেক্টর সমাদ্দার , তবে আপনি ডিসাইড করুন আমাদের সব খুলে বলবেন কিনা মিস সুমিলি ? ”

( ৪ )
অলীকের বাড়িতে

“ আমি তো যা জানি সব খুলে বলেছি স্যার , তবে আমাকে আবার থানায় ডেকেছেন কেন ? ” … শবর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল ।
পরদিন ইন্দ্রদা আর আমি থানায় ইনস্পেক্টর সমাদ্দারের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম । শবরকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল ।
ইন্দ্রদা বলল … “ বোসো শবর , এবার ঠিক করে বলো সেদিন রাতে কি হয়েছিল । ”
“ আমি তো … ”
“ তুমি সত্যি বলছো না । ”
“ আমি আর কিছু জানি না । ”
“ হাজতবাস করলে তোমার বাড়ির লোকেদের কি হবে সেই ধারনা আছে ? ”
কালীচরণবাবু বলে উঠলেন … “ ভালই ভালই সব কিছু বলে দে , নাহলে তোর কপালে অসীম দুঃখ আছে । ”
শবরের কালো মুখটা আরো বিবর্ণ হতে থাকে । ও ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে ওঠে …
“ আমাকে মেরে ফেলবে । আমি বাঁচতে চাই , আমার পরিবারের জন্য বাঁচতে চাই । আমি রাতে অলীকের পাশের ঘরে ঘুমুচ্ছিলাম । ঘুম যখন ভাঙলো তখন পাশের ঘর থেকে অলীকের গলার স্বর শোনা যাচ্ছিল । মনে হল অলীক এত রাতে আবার কার সাথে কথা বলছে ? আমি বারান্দার আলোটা জ্বেলে বাইরে এলাম । দেখলাম অলীকের ঘরের দরজাটা খোলা , ভেতরে লাইট জ্বলছে । দরজার চৌকাঠের ঠিক বাইরে হীরা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে । আমার কিছুটা গোলমাল ঠেকল । ”

“ এক মিনিট , তুমি হীরাকে চিনতে ? ”
“ হ্যাঁ , মাঝে মাঝে অলীকের কাছে আসতো । ”
“ আচ্ছা , বলো তারপর । ”
“ তারপর আমি অলীকের দরজার সামনে গিয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগলাম । সেই কালো কোট টুপি পরা লোকটার হাতে বন্দুক । আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না । দেখলাম আমার চোখের সামনে লোকটা অলীকের বুকে গুলি করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে । আমি চিৎকার করার আগেই আমার মুখ চেপে ধরল । ”
“ লোকটার হাতে গ্লাভস ছিল ? ”
“ হ্যাঁ ছিল স্যার । তারপর আমাকে হঠাৎ জোরে মেঝেতে ঠেলে ফেলে দিল । আমি মাটি থেকে উঠে চিৎকার করার আগেই লোকটা বন্দুকটা ঐ অজ্ঞান হওয়া হীরার হাতে গুঁজে দিয়ে পালিয়ে গেল । ”
“ তারপর তুমি ‘ খুন খুন ’ বলে চিৎকার করতে করতে বাইরে বেরিয়ে এলে । ”
“ হ্যাঁ , বিশ্বাস করুন । এর বেশি আমি কিছু জানি না । ”
“ তবে মিথ্যে বলছিলে কেন ? ”
“ ভয়ে , ঐ লোকটা যদি আবার আমাকে খুন করে বসে । ”
“ শবর , লোকটার মুখ দেখেছিলে ? ”
“ না অন্ধকারে তেমন … তবে গোঁফ দাড়ি ছিল আর একটা কালো চশমা পড়েছিল । ”
“ তোমার কথাগুলো সত্যি হলে ভালো , আর যদি পরে প্রমানিত হয় যে , তুমি তোমার কথাগুলো না বলে অন্যের শেখানো বুলি আওরাচ্ছো তাহলে এবার তোমাকে ডেকে পাঠানো হবে না , সোজা বাড়ি থেকে তুলে এনে লকাপে ঢোকানো হবে । তুমি এখন যেতে পারো । ”
শবর ধীর পদক্ষেপে চলে যেতেই ইনস্পেক্টর ইন্দ্রদাকে বলল … “ ইন্দ্রজিৎ বাবু হীরা তাহলে সত্যিই বলছে ? ”
“ সত্যি বললেও হীরা সেই রাতে অলীকের কাছে কেন গিয়েছিল ? কেনই বা হীরাকে অজ্ঞান করলো খুনি ? নাকি হীরারই সব এ কারসাজি ? খুনটা অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নিজেকে অজ্ঞান করতে বলা … নাকি শবর এখনও কিছু লুকোচ্ছে ? আচ্ছা ইনস্পেক্টর সেই রাতে আপনাকে যে ফোন করেছিল সেই মেয়েটা কি সুমিলিই ? ”
“ আই অ্যাম কনফিডেণ্টলি সিওর অ্যাবাউট ইট । ”

“ আপনি একবার হীরার মোবাইল নম্বরে ফোন করে ওকে থানায় ডাকবেন আর জিজ্ঞেস করবেন কেন ও অলীককে শাসাতো ? আমার মনে হচ্ছে রিভলবারটা হীরারই । ”
“ তার মানে হীরাই ? ”
“ খুন করতে সে রাতে হীরা ওখানে উপস্থিত হলেও খুন যে হীরা করেনি প্রথম দিনই ওকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে বুঝেছিলাম । তৃতীয় কোনো ব্যক্তি হীরাকে ফলো করছিল । খুনটা হীরা করতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল তার , তাই নিজের হাতেই গুলি করে প্ল্যানমাফিক হীরার ডান হাতে রিভলবারটা গুঁজে দিয়ে সে চলে যায় , যাতে হীরা ফেঁসে যায় । লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয় হীরা সব কাজ বাঁ হাতে করে । তাহলে গুলি চালাতে হলে ওকে ঐ হাতেই চালাতে হবে । কিন্তু ওর ডান হাতে রিভলবার পাওয়া যায় । মানেটা হচ্ছে , খুনি ঐ কালো কোট টুপি পরা লোকটাই । হীরাকে অজ্ঞান করে রিভলবার নিয়ে অলীককে খুন করে আবার রিভলবারটা হীরার ডান হাতে গুঁজে দিয়ে পালিয়ে যায় । ”
“ কিন্তু কে হতে পারে ঐ ব্যক্তি ? ”
“ আমরা কাল সকালে ভাবছি একবার তমলুক যাবো , অলীকের বাড়ি । অলীকের ফ্যামিলি মেম্বারদের সাথে কথা বলে যদি কিছু জানা যায় । আপনি এদিকে হীরাকে গ্রেফতার করুন । ”
“ কিন্তু কি অপরাধে ? কোনো প্রমান তো নেই । ”
“ আপাতত লাইসেন্স বিহীন রিভলবার রাখার অপরাধে ও অলীককে মেনটালি টর্চার করার জন্য । আমি সিওর ঐ রিভলবারটি যদি হীরার হয় তাহলে ওটার লাইসেন্স হীরার কাছে পাবেন না । ”
ইনস্পেক্টরকে বিদায় জানিয়ে আমরা একটা ট্যাক্সি বুক করে বাড়ি ফিরছিলাম । চাঁদের আলোতে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো ভেসে যাচ্ছিল এদিক থেকে ওদিকে । স্টার থিয়েটারে নতুন শো এসেছে বলে হলের সামনেটা লোকে লোকারণ্য । শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ের কাছে আসতেই বেশ জ্যামে পড়লাম । ইন্দ্রদা দেখলাম ওর মোবাইল থেকে একটা নম্বর ডায়াল করছে । এইসময় আবার কাকে ফোন করছে কে জানে ? পরে বুঝলাম ফোনটা করেছে অলীকের বাড়িতে । অলীকের বৌদি ধরেছিলেন । উনি বললেন ওখানে থেকেই আমরা খুনের ব্যাপারে তদন্ত করতে পারি । ওনারা যেকোনো মূল্যেই অলীকের খুনি ধরা পড়ুক সেটা চান ।
পরের দিন সকালে বেরোতে একটু দেরি হলেও আমি আর ইন্দ্রদা একদম রাইট টাইমে তমলুক স্টেশন পৌঁছলাম । ওখান থেকে অলীকদের সুসজ্জিত ফ্ল্যাটের সামনে আসতে প্রায় আধ ঘণ্টা লেগে গেল । সরু পালিশ করা সিমেন্টের রাস্তা চলে গেছে বিশাল ফ্ল্যাটের হলুদ দরজা পর্যন্ত । আমরা এগিয়ে চললাম । দুধারে গোল ছাতার মত সমান মাপের ঝাউগাছগুলো সমান দুরত্ব নিয়ে একে অপরের দিকে চেয়ে আছে । ডানপাশে অর্ধবৃত্তাকারে সবুজ কার্পেটের মত নরম স্নিগ্ধ ঘাস পাতা । মাঝখানে সুদৃশ্য ফোয়ারা , ফোয়ারার পাশে শ্বেতপাথরের আয়তকার ব্লকগুলো থেকে রোদ্দুর ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ।
কলিংবেল বাজাতেই একজন চাকরানী দরজা খুলে দিল । ডাইনিংটা বিশাল । ড্রয়িংরুমের জানলায় ঝুলছে অপূর্ব সব পর্দা । সূর্যের আলো রঙ্গিন হয়ে আছড়ে পড়ছে ঘরের মেঝেতে । বাড়িতে লোকজন বলতে অলীকের দাদা বৌদি , অলীকের মা ও এক চাকরানী । দুঃখী পরিবারটি আমাদের আপ্যায়নের একটু ত্রুটি মাত্র করলো না । আমাদের জন্য একটা দোতলার ঘর ঠিক ছিল । অলীক হোস্টেল থেকে এলে ঐ ঘরেই থাকতো । অলীকের দাদা বৌদি , মা , চাকরানী একতলাতেই থাকে । একতলার তিনটে রুম আর দোতলার দুটো । দোতলার একটা রুম আমাদের জন্য খোলা হল আর অন্যটা তালাবন্ধ ছিল ।
স্নানের আগে ইন্দ্রদা অলীকের মায়ের ঘরে গেল । বয়স ষাটের কাছাকাছি , পরনে সাদা থান , শিথিল চামড়ায় অসংখ্য কুঞ্চন , বলিরেখা সুস্পষ্ট , কাঁচাপাকা ভ্রু চোখের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ।
ইন্দ্রদা বলল … “ কিছু মনে করবেন না মাসীমা , আপনাকে একটু বিরক্ত করতে এলাম । ”
অলীকের মা অবাক হয়ে ইন্দ্রদার দিকে চেয়ে আছে । হয়তো ওনাকে ইন্দ্রজিৎ সান্যাল মাসীমা বলবে ভাবতে পারেন নি ।
“ অলীকের সাথে আপনার শেষ কবে কথা হয় ? ”
“ যেদিন অলীক পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল সেদিনই সন্ধ্যায় অলীক ফোন করেছিল । ”
“ ওর কথায় সন্দেহজনক কিছু আভাস পান কি ? ”
“ না , বাবা । ও বলেছিল পরদিন সকালেই চলে আসবে । কিন্তু … ”
“ মনকে শক্ত করুন মাসীমা । জানি এসময় আপনি একদম কথা বলার মত পরিস্থিতিতে নেই তবু অলীকের খুনিকে ধরতে আপনাদের কিছু প্রশ্ন আমাকে করতেই হবে । ”
“ সবই বুঝি বাবা । তবু মন মানতে চাই না । আমার সোনার টুকরো ছেলে ছিল অলীক । ”
“ আচ্ছা , অলীকের বাবা কতদিন হল মারা গেছেন ? ”
“ পাঁচ বছর প্রায় । ”
“ আচ্ছা কিছু মনে করবেন না । আপনার অবর্তমানে সম্পত্তির কিরকম ভাগাভাগি হবে সেটা যদি একটু বলেন , অবশ্য এটা বলা না বলাটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার । ”
উনি কিছুক্ষণ থামলেন । তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করলেন … “ সম্পত্তির ব্যাপারে অলীকের বাবা কিছু ঠিক করে দিয়ে যান নি । তবে আমি ঠিক করেছিলাম আমার সম্পত্তির পঞ্চাশ শতাংশ এখানে অনাথ আশ্রমে দান করবো । চল্লিশ শতাংশ পাবে অলীক । আর বাকি দশ শতাংশ আমার বড় ছেলে সমীরণের জন্য । ঐ মাতাল সমীরণটাকে আমি ইচ্ছে করেই আমার সম্পত্তির বৃহত্তর অংশ থেকে বঞ্চিত করেছি । ”
“ আচ্ছা উইল তৈরি হয়ে গেছে ? ”
“ না , তবে অলীক না থাকলেও আমার সম্পত্তির ওইটুকু ভাগ ছাড়া সমীরণ কিছু পাবেনা । ”
“ আপনার শরীর বুঝে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উইলটা তৈরি করে নেওয়াই ভালো মাসীমা । ”
আমরা এবার অলীকের বৌদির ঘরে এলাম । ঘরে ঢুকতেই মিষ্টি ল্যাভেন্ডারের গন্ধে মনটা ভরে গেল । অলীকের বৌদি দুহাত দিয়ে ভর করে বিছানা থেকে নিজেকে টেনে নিয়ে গিয়ে তুলল সোফার ওপর । দাঁতে দাঁত চেপে মনের কষ্টটা লুকানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি । মেদহীন শরীর , মসৃণ চুলে কোনো পাক নেই , পরনে সুতির ছাপা একটা শ্যাওলা কালারের শাড়ি , চকচকে টানা টানা চোখদুটো যেন বহুদিনের রাত্রি জাগরণের কারণে ঢুলুঢুলু । সমীরণবাবু ছিলেন না । এসে থেকেই ওনাকে ঘরে দেখিনি । আমরা একটা সোফায় উপবেশন করে কথোপকথন শুরু করলাম ।

“ আপনার নামটা ? ”
“ মিসেস সীমন্তিনী সেন । ”
“ আপনার বাবার বাড়ি কোলকাতায় , তাই না ? ”
“ হ্যাঁ , কিন্তু … ”
“ অলীকের বন্ধুরা সেদিন বিকেলের সেই ঘটনা সব আমাকে বলেছে । ”
“ কিন্তু কেন , কেন খুন করলো হীরা আমাদের অলীককে ? শত্রুতা কি এমন পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারে ? ”
“ হীরা খুন করেনি । ”
“ মানে ? ”
“ ইয়েস ইটস ট্রু । আচ্ছা আপনি সুমিলিকে চিনতেন ? ”
“ না । সেদিনই বিকেলে প্রথম দেখেছিলাম । ”
“ সুমিলি অলীককে ভালোবাসতো এ ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন ? ”
“ হোয়াট রাবিশ ? অলীককে ওর কথা অনেক বলতে শুনেছি তবে অলীক সুমিলিকে ভালবাসবে এটা ভাবা আমার পক্ষে কঠিন । ”
“ সুমিলি নিজের অজান্তেই আমাদের কাছে সেটা স্বীকার করেছে । ”
“ কিন্তু সেরকম কিছু হলে অলীক আমাকে নিশ্চয় বলতো । আমার কাছে ও কোনোকিছুই লুকোয় না বলে আমার ধারনা । ”
“ আর সুমিত ? ”
“ হ্যাঁ ওর কথাও প্রায় বলতো অলীক , একবার আমাদের বাড়িতেও এসেছিল অলীকের জন্মদিনে । ”
“ সুমিলি আসে নি ? ”
“ না , ইন্দ্রজিৎ বাবু । তবে সুমিতকে আমার ওদের তুলনায় একটু ম্যাচিওর মনে হত । একটু হলেও ওদের থেকে আইসোলেটেড থাকতো , সবই অলীকের কাছে শোনা । ”
“ অলীক কোনোদিন ওর বন্ধুদের বাড়ি যায় নি ? ”
“ জানি না , হয়তো গেছে । তবে সুমিতের বাড়ি যায় নি কারন সুমিতের বাবা সৌমেন চক্রবর্তী এসব পছন্দ করতেন না । ”
“ সৌমেন চক্রবর্তী ? মানে হোস্টেল সুপার ? ও মাই গড । এটা তো আগে জানতাম না । ”
“ হ্যাঁ সুমিতের তো স্কটিশে অ্যাডমিশনটা ওর বাবার জন্যেই হয়েছে । নাহলে মেরিটের ভিত্তিতে ওর চান্স পাবার কথা নয় । ”
বিদ্যুতের মত মাথায় একটা জিনিস খেলে গেল । এইজন্যই সুমিত চক্রবর্তীর মুখটা খুব চেনা চেনা লেগেছিল ছবিতে । সুমিত প্রায় অনেকটা দেখতে ওর বাবা সৌমেন বাবুর মত । তাহলে সুমিলির ব্রেসলেটে এস সি লেখা মানেটা কি সুমিত চক্রবর্তী ? সুমিতই কি সুমিলিকে ব্রেসলেটটা গিফট হিসেবে দিয়েছিল ? কিন্তু এর সাথে খুনের কি যোগাযোগ থাকতে পারে ? কারোর মুখ দেখে তার মনের ভেতরটা পড়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ইন্দ্রদার । আমি বিড়বিড় করছি দেখে ও থাকতে না পেরে বলে উঠল …
“ এস সি মানে সিডিউল কাস্ট তো হতে পারে সৌম্য , তাতেও যদি সন্দেহ থাকে তবে স্কটিশ চার্চ ও ভাবতে পারিস । আপাতত ব্রেসলেটের রহস্যটা মন থেকে খুলে রাখ । ”
কথাবার্তার অপ্রাসঙ্গিকতায় অলীকের বৌদি হকচকিয়ে গেলেন ।
“ আপনারা ঠিক কি নিয়ে কথা বলছেন বলুন তো ? ”
ইন্দ্রদাই ব্যাপারটাকে সামাল দিল … “ আরে না না । ও কিছু না । মিসেস সীমন্তিনী সেন , আপনার স্বামী সমীরণবাবুকে তো দেখছি না ? ”
“ ওকে কি আপনি পাবেন ? সারাটা দিন জুয়া খেলছে কোথাও হয়তো । কোনোদিন দুপুরে খেতে আসে , আবার কোনোদিন আসে না । রাতে এসে আবার মদ খায় । ”
“ আচ্ছা গতবছর আপনি অলীকের হোস্টেলে নিউ ইয়ারে একটা গ্রিটিংস কার্ড পাঠিয়েছিলেন , তাই না ? ”
“ হ্যাঁ অলীকও প্রতি বছর পাঠাতো , আরচিস থেকে কিনে , আমাকে খুব ভালোবাসতো জানেন ইন্দ্রজিৎবাবু । ”
“ সুমিলিও ওকে কার্ড পাঠিয়েছিল , তাতে যা কিছু লেখা ছিল সেটা দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সুমিলি অলীককে ভালোবাসতো । এ ব্যাপারে আপনি কিছু জানতেন ? ”
“ নাথিং , নট অ্যাট অল । অলীকের তরফ থেকে সেরকম কিছু ছিল কিনা সে ব্যাপারে আপনি এত নিশ্চিত কি করে হচ্ছেন ইন্দ্রজিৎ বাবু । ”
“ হুম , আচ্ছা সীমন্তিনী দেবী কোলকাতায় আপনার বাবার বাড়ির ফোন নম্বরটা একটু দিন । ”
“ হ্যাঁ এখনই লিখে দিচ্ছি । ”
“ আপনার বাবার নামটা পাশে লিখে দেবেন প্লিজ । ”
সীমন্তিনী সেনের সাথে আর কোনো কথা হয়নি । অলীকের বাড়ির সব মানুষজনদের মধ্যে আলাদা হলেন সমীরণবাবু , বিকেলে ওনার সাথে আলাপ হতেই টের পেলাম ।

“ আপনি সমীরণ সেন ? অলীকের দাদা ? ”
“ হ্যাঁ । কি জানতে চান তাড়াতাড়ি বলুন । আমার সময়ের অনেক দাম । ”
আমি এক ফাঁকে সমীরণ সেনের চেহারাটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম । থলথলে ভারী চেহারা , মুখে গোঁফ দাড়ির লেশ মাত্র নেই , নাক কান থেকে গোছা গোছা চুল বেরিয়েছে , গোল গোল ঘোলাটে চোখ , কম পাওয়ারের সরু সোনালি ফ্রেমের চশমাটা বুক পকেট থেকে ঝুলছে , জানি না চোখের ঘুমন্ত ভাবটা সত্যি কিনা ।
“ সারাদিন ড্রিঙ্ক করে অসংযত জীবনযাপন করে আপনার কি লাভ হয় সমীরণবাবু ? ”
“ সেটা আমার পারসোন্যাল ব্যাপার গোয়েন্দা বাবু । ”
“ আপনি কি জানেন আপনার মা আপনাকে সম্পত্তির বৃহত্তর অংশ থেকে বঞ্চিত করেছেন ? ”
“ জানি , আর এও জানি অলীকই প্রায় সবকিছু পাবে । ”
“ তাহলে খুনের মোটিভটা আপনার না বোঝার কথা নয় । ”
“ মানে ? কি বলতে চাইছেন ? আমিই সম্পত্তির লোভে ভাইকে খুন করেছি । ”
“ ইটস নট ইম্পসিবল । ”
“ দেখুন আমার বাড়িতে এসে টিকটিকিগিরি করছেন করুন , কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করলে … ”
“ বাড়াবাড়ি করলে আপনাকেও লকাপে ঢোকাতে পারি । ”
“ আমারই বাড়িতে এসে আবার আমাকেই শাসাচ্ছেন ? আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি । ”
“ ইউ আর রং সমীরণবাবু , বাড়িটা আপনার নয় । এখনও পর্যন্ত আপনার মায়ের । ”
সমীরণবাবু হঠাৎ বাতাস বেরিয়ে যাওয়া বেলুনের মত চুপসে গেলেন । ইন্দ্রদার মোবাইলটা তখনই পকেটে বেজে উঠল ।
“ বলুন ইনস্পেক্টর সমাদ্দার ? ”
“ ইন্দ্রজিৎ বাবু , হীরা যে মোবাইল নম্বরটা দিয়েছিল ওটা অন্য একজনের । সারা কোলকাতায় এখনো পর্যন্ত হীরার খোঁজ পাওয়া যায় নি । ”
“ হীরাকে অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল খুঁজে বের করুন । ”
“ ওদিকের খবর কি ইন্দ্রজিৎবাবু ? ”
“ এখনো পর্যন্ত ব্লাইণ্ড । কিছু জানা গেলে ফোন করবো । ”
সন্ধ্যেবেলায় দোতলার ঘরে আমি আর ইন্দ্রদা চাকরানীর সঙ্গে কথা বলছিলাম । পরনে সাদা কালো মেশানো আঁশের মত বুটিক দেওয়া জীর্ণ সুতির শাড়ি , প্রায় সমস্ত মুখটাকে ঢেকে ঘোমটা দিয়ে থাকলেও বোঝা যায় মুখশ্রী বেশ সুন্দর । মুখ নিচু করে কথা বললেও ঘোমটার ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম ফাটা ঠোঁটটা বারবারই ভয়ে দাঁত দিয়ে চেপে ধরছিল ।
“ তোমার নাম ? ”
“ আজ্ঞে প্রমিলা । ”
“ অনেকদিন কাজ করছো তাই না ? ”
“ না , কবছর মোটে হল । অলীক দাদাবাবু যেদিন কোলকাতা গেলেন … ”
“ তুমি একতলায় সমীরণবাবুর পাশের রুমটাতে থাকো ? ”
“ হ্যাঁ । ”
“ তুমি অলীকের খুনের ব্যাপারে কিছু বলবে ? ”
“ খুন ? অলীক দাদাবাবু খুন হয়েছেন ? ”
“ তুমি জানো না ? ”
“ তবে যে বৌদিমণি বললে অলীক দাদাবাবুর কি একটা রোগ হয়েছে , হাসপাতালে ভর্তি আছে । ”

হঠাৎ করে লোডশেডিং হয়ে গেল । প্রমিলা নিচে আলো আনতে গেল । অন্ধকারেই বসে আছি প্রায় কয়েক মিনিট । ইন্দ্রদার অবশ্য টর্চ ছিল , সেটা ব্যাগে আছে । এবার মনে হল জানলার কাছে অন্ধকারের বুকে একটা ছায়া । অন্ধকারেও বুঝতে পারলাম , চোখ কুঁচকে ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে আমাকে ইশারায় থামিয়ে ইন্দ্রদা সরীসৃপের মত এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল টর্চটা আনতে । কিন্তু টর্চ জ্বালবার আগেই ছায়ামূর্তিটা আমাদের দিকে একটা দলা পাকানো কাগজ ছুঁড়ে দিয়ে ছুটে চলে গেল । আমরাও ছুটে গেলাম । একতলায় তখন সীমন্তিনী দেবীর গলা শোনা যাচ্ছে …
“ কে , কে ? প্রমিলা রে , চোর , চোর ঢুকেছে । ”
আমরা একতলায় নেমে আসতেই কারেন্ট চলে এল ।
“ একটা লোক , একটা , কালো কোট পরা একটা লোক দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল ইন্দ্রজিৎ বাবু । ”
ঠিক তখনই মদ্যপ অবস্থায় ঘরে ঢুকলেন সমীরণ সেন ।
ইন্দ্রদা জিজ্ঞেস করল … “ আপনি কাউকে বাইরে পালিয়ে যেতে দেখলেন ? ”
উনি জানি না বলে টলতে টলতে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন । ইন্দ্রদা আর আমি বাইরে এসে অনেক খুঁজেও কাউকে দেখতে পেলাম না । প্রমিলা বলল ও পাশের ঘরে আলো জ্বালছিল । বৌদির চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে ।
“ ডোন্ট ওরি মিসেস সেন । ভয়টা আপনাদের পাবার কোনো কারন নেই । কারন ভয়টা আমাকে দেখানো হয়েছে যাতে আমি এখান থেকে চলে যাই । তবে রাত্রে একটু সাবধানে থাকবেন । মেনগেট ভালো করে তালা দিয়ে দেবেন । ”
আমরা দোতলায় নিজেদের রুমে এলাম । দলাপাকানো কাগজটা সোজা করার চেষ্টা করল ইন্দ্রদা । একটা চিঠি ।

টিকটিকি ,
একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে । কাল সকালে কোলকাতা ফিরে আরাম করুন নিজের বাসায় গিয়ে । তা না হলে ফল ভাল হবে না । জানি আপনাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানো যাবে না । আপনি যদি কেটে না পড়েন তাহলে অলীকের মত এ বাড়িতে আর একজনকে খুন করবো আমি । আপনি কিস্যু করতে পারবেন না । আর তার জন্য দায়ী থাকবেন আপনি ।
ইতি
হীরা

ইন্দ্রদা চিঠিটা বারবার পড়ছে , তাই আমার কথা কানে গেল না ।
“ হিরণ্ময় রায় তাহলে আমাদের কাছে কাছেই ঘুরছে ? ”
“ একটা আবছা ক্লু দেখতে পাচ্ছি । ”
“ কোথায় , চিঠির মধ্যে ? ”
“ একবার সীমন্তিনী সেনের কোলকাতার বাবার বাড়ির ফোন নম্বরটা আনতো ? ”
“ এত রাত্রে ওদের ডিস্টার্ব করবে ? ”

( ৫ )
ফাঁদ

“ তাতে কি হয়েছে ? তোমার যা ভাল লাগবে তাই করবে ইন্দ্রজিৎ । ”
“ আমি এখানে থাকলেও আপনাদের উপর হামলা হবে , না থাকলেও হবে মাসীমা । তাই আজকের দিনটা থেকে কাল সকালে যাবো । ”
পরের দিন সকালেই কথা হচ্ছিল অলীকের মায়ের সঙ্গে । ইন্দ্রদাকে ঐ একদিনেই আপন মনে হয়েছিল ওনার । বেশ সাবলীল ভাবেই কথা বলছিলেন ইন্দ্রদার সাথে ।
সারাটা দিন আর উল্লেখ করার মত তেমন কিছু ঘটে নি । রাত এগারোটা পর্যন্ত দোতলার ঘরে জেগে ছিলাম , তারপর ঘুমিয়ে গেছি । আকাশে চাঁদের আলো থাকা সত্ত্বেও খাবলা খাবলা অন্ধকারে ছেয়ে গেছে অলীকদের ফ্ল্যাটের সামনেটা । অন্ধকারে ছেয়ে গেছে ঘাসের লন , নিস্তব্ধ ফোয়ারা । গাছগুলো অন্ধকারে ভুতের মত দাঁড়িয়ে আছে । তবে ভোরের আলো ফুটতে আর বেশি দেরি নেই । একতলার ঘরে একটা দরজা খুলে গেল । সাদা কাপড়ের ঘোমটা দেওয়া অলীকের মা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন । অন্ধকারের মধ্যে চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নিলেন । কিছুক্ষণ পর সমীরণবাবুর ঘরের দরজাটা খুলে গেল অদ্ভুত ক্যাচ শব্দ করে । ভেতর থেকে কালো চাদরে আপাদমস্তক আবৃত হয়ে বেরিয়ে এল কেউ একজন । চারপাশে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল সে । এবার খুলে গেল তৃতীয় ঘরের দরজাটাও । দরজার কাছে পর্দাটা দিয়ে উঁকি মারছে প্রমিলা । চোখদুটো ভয়ে তার গোল গোল হয়ে গিয়েছে ।
বাইরে ভোরের আলো তখনও ঠিকভাবে ফোটেনি । তবে চাঁদের আলো আবছা হয়ে গেছে । চারপাশে পিন পরা নিস্তব্ধতা । হঠাৎ একটা আর্ত চিৎকার …
“ বাঁচাও , বাঁচাও কে আছো … বাঁচাও আমাকে । ”
আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে । ইন্দ্রদা অবশ্য তার আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে ।
“ সীমন্তিনী দেবীর গলা না ? ”
“ হ্যাঁ , তাই তো মনে হচ্ছে । তাড়াতাড়ি চল , কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে । ”
সিঁড়ি দিয়ে নিমেষের মধ্যে নিচে একতলায় নেমে এলাম আমি ও ইন্দ্রদা । দেখলাম একতলার তিনটে রুমেরই দরজা খোলা । আমার ত্বকের ভেতর দিয়ে একটা অস্বস্তিকর কনকনে শিহরন বয়ে গেল । দেখলাম সমীরণবাবু ঘরের ভেতর থেকে ছুটতে ছুটতে এসে বলছেন …
“ কি হয়েছে ইন্দ্রজিৎ বাবু , আমার স্ত্রী কোথায় ? ”
“ ওনার চিৎকার শুনেই তো আমরা নিচে নেমে এলাম । ”

দরজা দিয়ে বাইরে এসে দেখলাম এক ভয়ানক দৃশ্য । একটা আরামকেদারায় অলীকের বয়স্কা মা পড়ে আছেন , চোখদুটো বন্ধ , মাথাটা একদিকে হেলানো । তার পাশে মাটিতে দুজন দুদিকে পড়ে আছে । একদিকে চাকরানী প্রমিলা , চোখদুটো যেন তার ঠেলে বেরিয়ে আসছে , মুখ দিয়ে জিভ বেরিয়ে পড়েছে । আর এক পাশে সীমন্তিনী সেন , মুখের উপর একটা সাদা রুমাল । সমীরণবাবু ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে আমাকে ধরে ফেলেছে ।
দেখলাম সীমন্তিনী দেবী এবং অলীকের মায়ের তখনও পালস চলছে । কিন্তু প্রমিলা যে মারা গেছে সেটা বুঝতে এতটুকু দেরি হল না । ঘড়িতে তখন চারটে বেজেছে । আকাশে আস্তে আস্তে ভোরের আলো স্পষ্ট হচ্ছে । সকাল ছটা নাগাদ অলীকের মায়ের জ্ঞান ফিরল । সীমন্তিনী দেবী তখনও সেন্সলেস অবস্থায় বিছানায় । অলীকের বৃদ্ধা মা বিছানাতে উঠে বসলেন । পাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি , ইন্দ্রদা , তমলুক থানার ওসি , একজন ফ্যামিলি ডক্টর । অলীকের মা বলতে শুরু করলেন …
“ আমি বুড়ি মানুষ বাবা , রাতে ভাল ঘুম হয় না । ভোর ভোরই আমি উঠে পড়ি । তারপর বাইরের ঐ আরামকেদারায় বসে ভোরের সূর্য ওঠা দেখি । ”
সমীরণবাবু বললেন … “ হ্যাঁ ইন্দ্রজিৎ বাবু , মায়ের ওটা দীর্ঘদিনের অভ্যেস । এত করে বলি অত সকাল সকাল উঠে তুমি কি করবে ? অলীকের কথা যদি বা শুনতো , আমাকে তো পাত্তাই দেয় না । প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ মা উঠে পড়ে । তারপর টেবিলের উপর রাখা এক গ্লাস জল খেয়ে বাইরে ঐ আরামকেদারায় গিয়ে বসে থাকে সকাল না হওয়া পর্যন্ত । ”
অলীকের মা একটু খুকখুক করে কেশে আবার বলতে শুরু করলেন … “ প্রত্যেকদিনের মতই আমি ঐ আরামকেদারাটায় বসে আছি সামনের দিকে তাকিয়ে , এমন সময় মনে হল পেছনে কেউ আসছে । দেখি কালো চাদরে ঢাকা অবস্থায় কেউ একজন আমার দিকে এগিয়ে আসছে । পেছন দিকে অন্ধকারে ঐ অবস্থায় ওরকম একজন মানুষকে দেখে আমি ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি । ”
তমলুক থানার ওসি বললেন … “ আমাকে তো এবার উঠতে হবে ইন্দ্রজিৎবাবু । প্রমিলার ডেডবডিটা পোস্টমর্টেমের ব্যবস্থা করতে হবে । আপনি এদিকটা সামলে নিয়ে কাইন্ডলি আমাকে একটু জানিয়ে দেবেন ফোনে । ”
“ অল রাইট , তবে মনে হয় শ্বাসরোধ করেই খুন করা হয়েছে কারন গলায় একটা কালো দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে । ”
আরো অনেকক্ষণ পর সীমন্তিনী সেনের জ্ঞান ফিরল । সমীরণবাবু বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন । এখনো সঠিক কি ঘটেছিল জানা যায়নি । এখানে সীমন্তিনী দেবীর বক্তব্য শুনবো বলে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি ।
“ মা কোথায় ? মা ভাল আছে তো ? ”
“ প্লিজ কুল ইওরসেলফ মিসেস সেন । আপনার মা পাশের ঘরে আসেন , সুস্থই আছেন । আচ্ছা এবার বলুন তো ঠিক কি হয়েছিল ? ”

“ সে এক ভয়ংকর দৃশ্য , ভাবলেও আমার গা শিউরে উঠছে । আমি ঘুমোচ্ছিলাম । চাদরমুড়ি দেওয়া কেউ একজন বারান্দায় পায়চারি করছিল । একটা আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় । জানলার দিকে তাকিয়ে দেখি অন্ধকারে কেউ একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে । পাশে সমীরণকে ডাকার চেষ্টা করিনি , কারন তাতে সময় নষ্ট হত অনেক । কিন্তু পরে বুঝলাম , কি ভুলটাই না করেছি । বাইরে বারান্দায় এলাম , দরজা খুললাম । প্রথমেই চোখ পড়ল আরামকেদারার দিকে । মায়ের দেহটা চেয়ারের একপাশে এলিয়ে আছে । পাশে সেই চাদরমুড়ি দেওয়া লোকটা ততক্ষণে একটা সরু নাইলন দড়ি দিয়ে প্রমিলার গলা চেপে ধরেছে । আমাকে দেখেই ছুটে পালিয়ে গেল । দেখেছেন তো আমাদের বাড়ির চারপাশে কোনো পাঁচিল বা বেড়া নেই , তাই পালানোটা খুব সহজ । আমি প্রমিলার নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে দেখলাম নিঃশ্বাস চলছে না । আরামকেদারাটার দিকে এগিয়ে যেতেই বুঝলাম সেই চাদরমুড়ি দেওয়া মানুষটা তখনও পালায় নি । পেছন থেকে আমার নাকে রুমাল চেপে ধরল । আমি জ্ঞান হারালাম । ” … একটানা এতগুলো কথা বলে উনি দুবার বেশ জোরে জোরে দম নিলেন ।

ইন্দ্রদা বলল … “ এই দুরবস্থার জন্য আমি দায়ী ভেবে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে । কাল রাতে হীরা আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিল । হুমকি চিঠিতে লেখা ছিল , এখান থেকে চলে না গেলে কিছু একটা ঘটাবে , এই দেখুন । ” … ইন্দ্রদা লেখাটা বের করে সবাইকে দেখাল ।
ইন্দ্রদা বলল … “ সমীরণবাবু আজ এখনই আমরা চলে যাচ্ছি । তবে একটা কথা বলে রাখি , খুনিকে আমরা ধরবোই । আপনারা একটু সাবধানে থাকবেন । আমি তমলুক থানার ওসির সঙ্গে কথা বলে আপনাদের সিকিউরিটির ব্যবস্থা করছি । আপনার মায়ের সঙ্গে একটু পারসোনালি কথা বলতে চাই । ”
শুধু আমি আর ইন্দ্রদা অলীকের মায়ের কাছে এলাম ।
“ আমরা আসছি মাসীমা । আপনার ভালোর জন্যই বলছি , উইলটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তৈরি করে নেওয়ায় ভালো । ”
“ ঠিকই তো বাবা । আমি আজ আছি , কাল নেই । আজই দেখি উকিল বাবুকে ফোন করবো । কাল সকালের মধ্যে সব ব্যবস্থা করেই আমার শান্তি । ”
আমরা ফিরে যাবার জন্য তৈরি হলাম । সিমেন্টের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় ইন্দ্রদা একজায়গায় থমকে দাঁড়াল । দেখলাম ঝাউগাছগুলোর একটার নিচে মাঝারি সাইজের একটা শিশি পড়ে রয়েছে । আমি ঝুঁকে হাত দিয়ে তুলতে যেতেই ইন্দ্রদা আমাকে বাধা দিল । পকেট থেকে রুমাল বের করে ইন্দ্রদা শিশিটা রুমালে মুড়ে পকেটে ঢুকিয়ে নিল ।
কোলকাতায় এসে ইন্দ্রদাকে দেখলাম বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে । মনে হয় সবকিছু জানতে পেরে গেছে । দুপুরে কালীচরণ সমাদ্দারের ফোন এল ।
“ হ্যালো ইন্দ্রজিৎ সান্যাল বলছি । ”
“ শুনলাম কোলকাতায় ফিরে এসেছেন । কোনো তথ্য পাওয়া গেল ? ”
“ হ্যাঁ । আপনার সাথে কথা ছিল । বিকেলে আপনাদের বাড়ি যাবো , রজকের সাথে একটু দরকার আছে । ”
“ আসুন না । হ্যাঁ শুনুন ভালো খবর , হীরা ধরা পড়েছে , লকাপে রেখেছি । ”
“ জানতাম । ”
“ আপনি জানতেন ? ”
“ মানে বলতে চাইছি কতদিন আর এইভাবে পালিয়ে বেড়াবে । ”
“ শুনুন ইন্দ্রজিৎ বাবু , প্রথমে কিছু বলছিল না । দু ঘা লাগাতেই বলে ফেলল যে রিভলবারটা ওরই । খুন করতেই হীরা হোস্টেলে গিয়েছিল । কিন্তু হীরা বলছে যে , সে খুন করে নি । ”
“ হুম । আপনি একটা কাজ করুন , সুমিলির মোবাইলে একটা কল করে বলুন , বিকেলে থানায় দেখা করতে । ওর সাথে জরুরী কথা আছে । ”
ফোনটা রেখে ইন্দ্রদা আমাকে বলল … “ দুপুরে ঘুমিয়ে নে , আজ রাত জাগার প্ল্যান আছে । ”
ইন্দ্রদা আমার মুখ থেকে কেন প্রশ্নটা আশা করছিল । আমি জানতাম ওকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করলেও বলবে না । তাই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম । যাইহোক দুপুরে ঘণ্টাখানেক ভালই ঘুম দিলাম । বিকেলে সময়মত ইনস্পেক্টর সমাদ্দারের বাড়ি পৌঁছে গেলাম ।
উনি একটা নতুন খবর দিলেন । সুমিলি বাবা মায়ের সাথে তমলুকে কোনো এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছে । উনি অবশ্য ফোনে সুমিলিরা যেখানে আছে তার ঠিকানা জেনে নিয়েছেন । ইন্দ্রদা ঠিকানাটা নোট করে পাশের ঘরে একা রজকের সঙ্গে কিছু কথা বলল । প্রায় কুড়ি মিনিট পর ইন্দ্রদা বেরিয়ে এসে সমাদ্দারবাবুকে বলল …
“ আজ রাতেই অলীকদের বাড়ি যেতে হবে , ওখানেই খুনি আসবে । ”
“ বলেন কি মশাই ? আমি তো এখনো অথই জলে । ”
“ মোটামুটি রাত আড়াইতে নাগাদ পৌছাতে হবে আমাদের । আমি কিন্তু আগেই চলে যাবো । আপনি সৌমাভকে নিয়ে ঐ টাইমে পৌঁছে যাবেন । ”
“ কিন্তু … ”
“ আপনাদের কাজ হল ঝোপের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকা । সন্দেহজনক কাউকে দেখতে পেলে ফলো করবেন । আমি ঠিক সময়েই পৌঁছে যাবো । একটা সুন্দর নাটকের প্ল্যান আছে । বেস্ট অফ লাক । ”
সন্ধ্যে সাতটা । অলীকদের বাড়িতে দেওয়ালঘড়ির সাতটা ঘণ্টা বাজা শেষ হতে না হতেই কলিংবেল বাজলো । সীমন্তিনী সেন দরজা খুলে দিলেন ।

“ এই সময়ে তুমি ? ”
“ হ্যাঁ একটু দরকারেই … ভেতরে আসতে পারি কি ? ”
“ এসো , কিন্তু এত দূর থেকে … ”
“ বৌদি , অলীকের কাছে আমার একটা ডায়রি রয়ে গেছে , সেটা হোস্টেলে নেই । এখানে হয়তো থাকতে পারে তাই এলাম , খুবই জরুরী । ”
“ কেউ কি বাড়ি নেই বৌদি ? ”
“ না । তোমার দাদা এখনো বাড়ি আসে নি , আর মা ঐ ঘরে শুয়ে পড়েছেন । ভোর ভোর ওঠেন তো তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন । ”
“ আমাকে একটু জল দেবেন বৌদি ? ”
“ বোসো সরবত করে আনছি । ”
রজক সমাদ্দার এবার সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে অলীকের মায়ের ঘরের দিকে মুখ বাড়ালো । সীমন্তিনী সেন জল খাবার নিয়ে আসার আগেই আবার সোফায় এসে বসে টেবিলের উপর পড়ে থাকা একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে লাগলো । সীমন্তিনী সেন এলেন ।
“ তুমি খাও । আমি দোতলার পড়ার ঘরে দেখে আসি ডায়রিটা আছে কিনা ? কি রঙের ডায়রি ? ”
“ লাল রঙের , ওপরে আমার নাম লেখা আছে । ”
বৌদি চলে যেতেই রজক সমাদ্দারের চোখের চাহনিটা কেমন রহস্যময় হতে লাগলো । সে সন্তর্পণে অলীকের মায়ের ঘরে পা টিপে টিপে ঢুকে পড়ল । উনি তখন খাটে নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে শুয়ে আছেন । পাশে টেবিলে এক গ্লাস জল রাখা । দুপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে রজক একটা সাদা বড়ি গ্লাসে মিশিয়ে দিল । তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । ওদিকে সীমন্তিনী সেন অলীকের ঘরে কোনো ডায়রি না পেয়ে নিচে নেমে এলেন ।
“ রজক , রজক … ভাই রজক , কিছুই তো পেলাম না । আমার মনে হয় … রজক , রজক কোথায় গেলে ? ”
রজকের আকস্মিক আগমন এবং রহস্যজনক পলায়ন সীমন্তিনী সেনকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিল । ওদিকে ঘড়িতে তখন রাত দশটা । তমলুকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে সুমিলির বাবা মা , সুমিলি ও আরও কয়েকজন গল্প করছিল । হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ । সুমিলির বাবা দরজা খুললেন ।
“ কে আপনি ? আপনাকে তো ঠিক … ”
গম্ভীর গলায় সিগারেট মুখে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আগন্তুক বলল … “ আমাকে আপনি চিনবেন না , দরকারটা সুমিলির সাথে । ”

“ কে বলুন তো আপনি , এত রাতে … ”
“ সুমিলির সাথে কথা বলব … মে আই কাম ইন ? ”
আমি আর ইনস্পেকটর কালীচরণ সমাদ্দার অলীকদের ফ্ল্যাটের কাছে পৌঁছলাম ঠিক দুটো বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিটে । চারদিক অন্ধকার নিস্তব্ধ । শহরের উপর লাইটপোস্টের আলোগুলো কেমন টিমটিম করছে । বন্ধ রেস্তোরা ও দোকানগুলো চকচক করছে চাঁদের আলোতে । অলীকদের বাড়ির ঝাউগাছের চারপাশে অন্ধকার আরও বেশি করে জমাট বেঁধেছে । আমরা একটা ঝাউগাছের আড়ালে এসে দাঁড়ালাম । ইন্দ্রদা এখন কোথায় কে জানে ? ইনস্পেকটর বারবার ঘড়ি দেখছেন । দেখতে দেখতে তিনটে বাজলো । আমার খুব ঘুম আসছিল । ইনস্পেকটর হাই তুলতে তুলতে বললেন …
“ হায় , কোথায় তোমার খুনি ? কোথায় বা তোমার ইন্দ্রদা ? কোনো বিপদ হল না তো আবার ? ”
ইন্সপেক্টরের মুখ দেখে মনে হল এত রাতে এই ঝোপঝাড়ে ইন্দ্রদার কথায় আসতে হয়েছে বলে খুব খুশি হন নি । অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে পা কনকন করছিল বলে আমরা রুমাল পেতে মাটিতে বসে রইলাম ।
আমি বলে উঠলাম … “ কই চারিদিকে তো কাউকেই দেখছি না । ”
দূরে অতর্কিতে জ্যোৎস্নার নির্জনতর সিমেন্টের রাস্তার ওপর দিয়ে একটা কালো বেড়াল মিয়াঁই ম্যাও … ম্যায় হু না করতে করতে চলে গেল । হঠাৎ ইন্সপেক্টরের মোবাইল বেজে উঠল । ইন্দ্রদা ফোন করেছে ।

( ৬ )
ছদ্মবেশী খুনি

“ হ্যালো কাজটা এবার ফিনিস করে দেওয়া যেতে পারে সুমিলি । ”
“ আর ইউ রেডি ? ”
“ হ্যাঁ । তবে সাবধানে । ”
“ যেমন কথা হয়েছে তেমনই কাজ হবে । আমার ছদ্মবেশ চিনতে পারার কথা নয় । ”
“ তুমি ছাড়া এ কাজটা অন্য কেউ করতে পারত না সুমিলি । ওকে , জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ । ”
এদিকে ইন্দ্রদা আমাদের ফোনে বলল সচেতন থাকতে । ও ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে । হাত কয়েক দূরে অন্ধকারে মনে হল কেউ যেন নড়ে উঠলো । আমার কান খাঁড়া হয়ে গেছে । ইন্সপেক্টরের চোখদুটো সজাগ । ঘড়ি বলছে সাড়ে তিনটে । আমরা ঝাউগাছের আরো আড়ালে চলে গেলাম । কালো কোট টুপি পরা একটা লোক ছুটতে ছুটতে খুব সাবধানে অলীকদের ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে গেল । আমরাও খুব সাবধানে ওকে ফলো করতে থাকলাম । কিন্তু লোকটা আমাদের মতই আর একটা ঝাউগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে চারপাশে কি যেন লক্ষ্য করছে । আমরা পা টিপে টিপে ওর পেছনে এসে দাঁড়ালাম । ইনস্পেকটর সমাদ্দার লোকটার কাঁধে হাত রাখতেই লোকটা চমকে ঘুরে দাঁড়াল । আমার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে এল …
“ একি তুমি ! রজকদা তুমি এখানে ? ”

রজক সমাদ্দার কথাটা শোনামাত্রই আমাদের থেকে হাত কয়েক দূরে চলে গেল । অন্ধকারে আর ওকে দেখা গেল না । কালীচরণবাবু যে অতল রহস্যে তলিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে তা ভালই টের পেলাম । এখানে রজক সমাদ্দারের উপস্থিতি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি । সত্যি বলতে কি , রজকদার চোখের চাহনিতে আমি আজ বিন্দুমাত্র নিরীহতার লেশ খুঁজে পেলাম না ।

আমরা ফ্ল্যাটের দরজার সবচেয়ে কাছের ঝাউগাছটায় আত্মগোপন করে রইলাম । এবার হলুদ রঙের দরজার মাথার ওপর একটা আলো জ্বলতেই দেখতে পেলাম বাইরে একটা আরামকেদারা । দরজাটা খুলে গেল । দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন অলীকের মা । দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে সাদা কাপড়ের ঘোমটা কপাল পর্যন্ত নেমে এসেছে । অলীকের মা আরামকেদারাটাতে বসল । তখনও ভোরের আলো ফোটেনি । নিস্তব্ধ প্রতীক্ষায় সময় পেরোচ্ছে । অন্ধকারে হঠাৎ লক্ষ্য করলে মনে হচ্ছিল , অশরীরীর মত বসে আছে বৃদ্ধা অলীকের মা । এইসময় ইন্দ্রদা কোথায় কে জানে ? হয়তো আমাদেরই মত কোনো একটা গাছের আড়ালে আত্মগোপন করে আছে । অলীকের মাকেই খুন করতে খুনি আসবে এটুকু আন্দাজ করতে পারছিলাম ।
এবার লক্ষ্য করলাম দরজা দিয়ে মুখ বাড়াচ্ছেন সীমন্তিনী সেন । উনি বেড়িয়ে এসে আস্তে আস্তে আরামকেদারার দিকে এগোতে শুরু করলেন । অলীকের মা ওনাকে দেখতে পান নি । আমি ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে দেখি কোমর থেকে রিভলবারটা ওনার হাতে চলে এসেছে ? তার মানে সীমন্তিনী দেবীই কি অলীকের মাকে … কিন্তু ওনার হাতে তো কোনো অস্ত্র নেই । সেই মুহূর্তে এতকিছু ভাববার অবকাশ ছিল না । এবার আরো অবাক হলাম দরজা দিয়ে কালো কোট টুপি পরা , চোখে কালো চশমা আর মুখে কালো রুমাল বাঁধা একজনকে বেরোতে দেখে । সে যে রজক সমাদ্দার নয় সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত , কারন রজক অলীকের ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকবে কি করে ? ঢোকার তো এই একটাই দরজা । ঢুকলে অবশ্যই আমাদের নজর এড়াতো না । তবে কে সে ? সে যে শয়তান তা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেল । সীমন্তিনী সেন লোকটাকে খেয়াল করেনি । লোকটা একটা রুমালে ক্লোরোফর্ম ঢেলে পেছন থেকে সীমন্তিনী সেনকে অজ্ঞান করতে চাইল । ইনস্পেক্টর সমাদ্দার এবার রিভলবার হাতে আড়াল থেকে বেড়িয়ে গর্জে উঠলেন …
“ ইওর গেম ইজ আপ । ছেড়ে দিন সীমন্তিনী দেবীকে । আর একটু চালাকির চেষ্টা করলে গুলি চালিয়ে দেবো । ”
আমিও আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসেছি । ঐ মুহূর্তে সীমন্তিনী দেবী আমাদের দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন । উনি ছুটে এলেন ।
“ আমাকে বাঁচান , আমাকে প্লিজ বাঁচান ইনস্পেকটর । ঐ লোকটা … ঐ লোকটা আমাকে মেরে ফেলতে চায় । ”
অলীকের মা দেখলাম একপাশে দাঁড়িয়ে । কোনো কথা বলছে না । ইন্দ্রদাই বা কোথায় ভগবান জানে ? ইনস্পেকটর আবার হুঙ্কার ছাড়লেন কালো কোট টুপি পরা লোকটার দিকে তাকিয়ে ।
“ হ্যান্ডস আপ । একদম নড়ার চেষ্টা করবেন না । ”
গোলমাল শুনে দেখলাম সমীরণ সেনও বাইরে বেড়িয়ে এসেছেন । এবার ইন্দ্রদার গলা শোনা গেল …
“ কালীচরণবাবু , টুপি আর মুখের রুমাল আর চশমাটা খুললেই দেখতে পাবেন লোকটা কে ? ”
ইন্দ্রদার গলা হঠাৎ কোথা থেকে ভেসে এল বুঝতে পারলাম না । অলীকের মায়ের ঘোমটাটা তখন খুলে গেছে । তার মানে ইন্দ্রদাই এতক্ষন বুড়ি সেজে অভিনয় করে যাচ্ছিল । সবাই অবাক দৃষ্টিতে ইন্দ্রদার দিকে তাকিয়ে আছে ।
“ অবাক হবার কিছুই নেই । খুনিকে ধরতে এটুকু অ্যাকটিং এর প্রয়োজন ছিল আমার । ” … সাদা কাপড়টা খুলতে খুলতে ইন্দ্রদা বলল … “ চিন্তার কোনো কারন নেই সীমন্তিনী দেবী , আপনার মা এখন ঘরে ঘুমোচ্ছেন । আমি ড্রেস চেঞ্জ করে আসছি । ইনস্পেকটর সমাদ্দার এই ছদ্মবেশীর ছদ্মবেশ উন্মোচনের ব্যবস্থা করুন । ”
ইনস্পেকটর লোকটার কালো চশমা আর রুমালটা মুখ থেকে খুলে দিল । মুখটা চেনা চেনা লাগছে । এবার টুপিটা খুলে দিতেই একরাশ কালো ঘন চুল কাঁধের ওপর লুটিয়ে পড়ল ।
অবাক বিস্ময়ে সীমন্তিনী সেন বলে উঠলেন … “ একি সুমিলি তুমি ! তুমিই তাহলে … কিন্তু কেন ? ”
সুমিলি মাথা নিচু করে আছে । বিস্ময়ে ইন্সপেক্টরের গলার স্বর আস্তে হয়ে গেছে … “ সুমিলি , তুমিই তাহলে অলীককে আর প্রমিলাকে …ওহ মাই গড , আই কান্ট বিলিভ দিস । ”

ইন্দ্রদা চলে এসেছে … “ আর দেরি কেন , এবার গ্রেফতার করুন অলীক আর প্রমিলার হত্যাকারীকে , হাতকড়া নিয়ে এসেছেন তো ? ”
“ সুমিলি আমি তোমাকে প্রথম দিন থেকেই সন্দেহ করেছিলাম । তোমার এই নিষ্পাপ মুখটার আড়ালে যে এতটা পৈশাচিক চেহারা রয়েছে তা আমার কল্পনাতীত । তুমিই আমাকে সেই রাতে ফোন করে বলেছিলে স্কটিশ চার্চ হোস্টেলে একটা খুন হবে , তাই না ? ”
“ হ্যাঁ । ” … সুমিলি ঘাড় না তুলেই জবাব দিল ।
“ তোমাকে দু দুটো খুনের অপরাধে আমি গ্রেফতার করতে বাধ্য হচ্ছি । হাবিলদার হাতকড়াটা দাও … ”
ইন্দ্রদা হাসতে হাসতে বলল … “ একি ! কি ভুল করতে চলেছেন সমাদ্দার মশাই । সুমিলি খুনি আপনাকে কে বলল ? ও তো জাস্ট ছদ্মবেশী । আপনার ছেলেকে একবার ডাকুন সমাদ্দারবাবু । আচ্ছা ওয়েট , আমিই ডাকছি । রজক … রজক এদিকে এসো । ”
রজক সমাদ্দার সেই কালো কোট টুপি পরা অবস্থায় এগিয়ে এল । ততক্ষনে কোলকাতা থেকে হোস্টেল সুপার সৌমেন চক্রবর্তী ও তার ছেলে সুমিতও এসে হাজির হয়েছে । ইন্দ্রদা আবার শুরু করল …
“ খুনির বিরুদ্ধে প্রমানের অভাব ছিল না । কিন্তু এমনই এক নাটকীয় পরিস্থিতির মাধ্যমে নাটকটা শেষ করতে চেয়েছিলাম আমি । তারজন্য অবশ্য ধন্যবাদ প্রাপ্য সুমিলি আর রজকের । অসাধারন ড্রামাটিক পারফরমেন্স । ”
ইনস্পেক্টরের আর আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছিল … “ কি বলতে চাইছেন বলুন তো ইন্দ্রজিৎ বাবু । আসল খুনি কই ? ”
“ অলীক সেন ও প্রমিলাকে হত্যার অপরাধে আপনি অ্যারেস্ট করুন আপনার পাশে ভদ্রবেশে নিঃসংকোচে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ ওকে … ”
ইন্দ্রদার শেষ কথাটা বলার সাথে সাথেই বিস্ময়ে কেঁপে উঠলাম ।
“ কি বলছেন আপনি ? আমি খুন করেছি ? আপনি কি ভুল বকছেন ? ”
“ ইন্দ্রজিৎ সান্যাল যেমন ভুল কথা বলে না , তেমনই প্রমান ছাড়া এক পা এগোয় না । গল্পটা এবার আপনিই বলবেন তো নাকি ? ”
“ হোয়াট ননসেন্স ! নিজের মত একটা গাল গল্প বানিয়ে নিলেই হল নাকি ? ”
“ তাহলে গাল গল্পটা একটু শুনেই দেখা যাক । কি বলেন ইনস্পেক্টর সমাদ্দারবাবু ? অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় বুদ্ধি খেলে অলীককে খুন করা হয়েছিল যাতে খুনির ওপর এতটুকু সন্দেহ না পড়ে । তবে সেই রাত্রে হোস্টেলে খুন হবে এই বলে কালীচরণবাবুকে ফোন করেছিল সুমিলিই । ”
ইনস্পেকটর বললেন … “ তার মানে শোনার ভুল হয়নি আমার ? ”
“ একদমই না । আমি কাল রাতে তমলুকে সুমিলির আত্মীয়ের বাড়িতে যাই । সুমিলি আমাকে সব খুলে বলে । খুনিকে ধরতে ওকে অভিনয় আমিই করতে বলেছিলাম । সুমিলি আপনাকে ফোন করার আগে খুনির কাছ থেকে একটি বেনামি হুমকি চিঠি পেয়েছিল যেখানে সুমিলিকে জোর করে আপনাকে ফোন করতে বলা হয় । কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে সুমিলিকে দিয়ে ফোন করিয়ে নিজে খুন করার উদ্দেশ্যটা কি ? কারন হীরা সাসপেক্তের বাইরে থাকলেও যাতে খুনির ওপর কোনোরকম সন্দেহ না পড়তে পারে , সমস্ত সন্দেহ যাতে সুমিলির ওপর গিয়ে পড়ে । সুমিলি অবশ্য তখনও জানতো না চিঠিটা কে ওকে পাঠিয়েছে , প্রাণ সংশয়ের ভয়ে সুমিলি পুলিশকে কিছু জানাতে পারে নি । ”
দাঁত খিঁচিয়ে ভদ্রবেশী খুনি বলে উঠল … “ আপনারা সবাই কি এখানে ডিটেকটিভ গল্প শুনতে এসেছেন ? ইন্দ্রজিৎ বাবু আপনি কিন্তু সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছেন । ”

সুমিলি ইন্দ্রদার পাশে চলে এসেছে । ইন্দ্রদার চাবুকের মত রিপ্লাই এল … “ সাট আপ । গল্পটা যখন আমি শুরু করেছি সেটা আমিই শেষ করবো , সেটা গালগল্প হলেও শুনতে হবে । বাই দা বাই , খুনি কিন্তু খুব ভালো করে জানতো ঐদিন রাতে হোস্টেলে তেমন কোনো স্টুডেন্ট থাকবে না । হীরার সঙ্গে ঝগড়ার কথাটাও খুনির অজানা ছিল না । খুনি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল হীরা ঐ রাতে অলীকের হোস্টেলে অলীককে ভয় দেখাতে যাবে । কিন্তু সিওর ছিল না হীরা অলীককে খুন করতে পারবে কিনা । এদিকে অলীককে সেই রাতে খুন করার মত সুযোগ আর কোনোদিন আসবে না । তাই কি হয়েছিল সবাই মন দিয়ে শুনুন । হীরা রিভলবার নিয়ে অলীকের হোস্টেলের দিকে যাচ্ছিল , আর খুনি হীরাকে ফলো করছিল । পরনে ছিল কালো কোট টুপি , মুখে নকল গোঁফ দাড়ি । হীরা কতদুর কি করতে পারবে সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকায় খুনি নিজে অলীককে খুন করে হীরাকে ফাঁসাতে চেয়েছিল । বৃষ্টি পড়ছিল সেই রাতে । নাইটগার্ড ভীমুও হোস্টেলের বাইরে পাহারায় ছিল । খুনির হাতে তখন গ্লাভস ছিল না , কারন গ্লাভস পড়লে রাস্তায় যে কেউ খুনিকে সন্দেহ করতো । তাই ভীমুর লাঠিটার ফিঙ্গার প্রিন্টের সাথে খুনির হাতের ফিঙ্গার প্রিন্ট মিলে গেছে । এরপর খুনি যখন হোস্টেলে ঢোকে তখন হীরা অলীকের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল । হীরাকে কৌশলে পেছন দিক থেকে অজ্ঞান করে হীরারই রিভলবার দিয়ে অলীককে খুন করে আবার হীরারই হাতে রিভলবার গুঁজে চলে যায় খুনি । সেই মুহূর্তে গ্লাভস পড়েছিল বলে রিভলবারে কোনো ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া যায়নি খুনির । কাল রাতে সুমিলিদের বাড়ি গিয়েই নাটকের প্ল্যানটা করেছিলাম । কথা হয়েছিল আমি ছদ্মবেশে অলীকের মা সেজে বসে থাকবো আরামকেদারায় । আর খুনি যখন অলীকের মাকে খুন করতে আসবে তখন সুমিলি কালো কোট টুপি পরে রেডি থাকবে ও খুনিকে অজ্ঞান করে দেবে পেছন থেকে । তার আগেই অবশ্য ইনস্পেকটর সমাদ্দার রিভলবার নিয়ে এগিয়ে আসেন । উনি ভেবেছিলেন সুমিলিই খুনি , কিন্তু প্রত্যেক খুনেরই তো কিছু একটা মোটিভ থাকবে । সুমিলি রিয়েলি লাভড অলীক , সেটা বারবার ও আমাকে বলেছে । সো প্যাথেটিক । ”

সুমিলির নিস্পলক চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে । খুনির দিকে অগ্নিচক্ষে তাকিয়ে থাকে সে । তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে খুনি বলে ওঠে …
“ আপনি কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন ইন্দ্রজিৎবাবু আমি অলীকের … ”
“ আপনি অলীকের বৌদি নন মিসেস সীমন্তিনী সেন । একজন অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথার , চরম চালবাজ , লোভী হত্যাকারী । সম্পত্তির লোভে অলীককে রাস্তা থেকে সরিয়ে মাকে উইল তৈরি করার আগেই আজ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সীমন্তিনী সেন ওরফে সুমি বৌদি । অলীক আপনাকে সুমি বৌদি বলেই ডাকতো , তাই না ? অলীক মৃত্যুর আগে সুমি মানে ওর বৌদিকেই বোঝাতে চেয়েছিল । আমি অলীকের হোস্টেলের রুমে গ্রিটিংস কার্ডগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখি একটা কার্ড আপনি অলীককে পাঠিয়েছিলেন , তাতে লেখা ছিল সুমি বৌদি । এরপরেও আপনি কোনো কথা বলবেন মিসেস সেন ? ”
“ আপনি কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন আমি ঐদিন তমলুক ফিরে এসেছিলাম … রজককে জিজ্ঞেস করুন … সুমিলিকে জিজ্ঞেস করুন , তাহলে আমি হোস্টেলে গিয়ে খুনটা করলাম কখন ? আপনাদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে । ” … সীমন্তিনী সেনের গলা কেঁপে উঠেছে ।
“ কোথাও ভুল হচ্ছে না মিসেস সেন । আপনি কোলকাতাতেই ছিলেন , আপনার বাবার বাড়িতে । আপনার বাবার বাড়িতে ফোন করে সেটা ইন্দ্রজিৎ সান্যাল জানতে পারে তা আশা করেননি তো ? ”
সমীরণ সেন একপাশে কাঠের মত দাঁড়িয়ে রয়েছেন । ইনস্পেকটর ওনার উদ্দেশ্যে বললেন … “ সরি মিস্টার সমীরণ সেন , আপনার মুখোশধারী স্ত্রীটিকে আপনি চিনতে পারেন নি । মিসেস সেনকে অলীক সেন এবং প্রমিলা হত্যার অপরাধে আমি গ্রেফতার করলাম । ”
সীমন্তিনী সেন আবার চেঁচিয়ে উঠলেন … “ এক মিনিট ইনস্পেক্টর । আমি ইন্দ্রজিৎবাবুর কাছে জানতে চাই প্রমিলাকে যদি আমিই খুন করে থাকি তাহলে আমাকে অজ্ঞান করলো কে ? জবাব দিন মিস্টার সান্যাল ? ”

“ এই গল্পটাও আমার কাছে শুনবেন ? নাকি আমার বুদ্ধির পরীক্ষা নিচ্ছেন মিসেস সেন ? আমি তো জানতাম আপনি শুধু বানিয়ে ভালো গল্প বলতে পারেন , গল্প শুনতে ভালোবাসেন জানা ছিল না তো । একটা কথা আছে জানেন তো , কোনো মার্ডার কখনও পারফেক্ট মার্ডার হয় না । খুনি কিছু না কিছু ক্লু ফেলেই যায় । তাহলে সেদিন ভোরের গল্পটাই বলি । রোজগার নিয়ম মত অলীকের বৃদ্ধা মা আরামকেদারায় এসে বসেছেন । সীমন্তিনী সেন তখনই ওনাকে খুন করতে আসেন । কিন্তু সেটা দেখে নিয়েছিল বা বুঝে গিয়েছিল প্রমিলা । সীমন্তিনী সেনই কালো চাদর জড়িয়ে অলীকের মায়ের কাছে এসে দাঁড়ান । অলীকের মা ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যান । প্রমিলা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল । সেই মুহূর্তে সীমন্তিনী সেন নিজের গলার মোটা রুপোর হারটা দিয়ে প্রমিলার গলা চেপে শ্বাসরোধ করে খুন করেন । তারপর খুব সাবধানে ক্লোরোফর্ম শিশি থেকে রুমালে ক্লোরোফর্ম ঢালেন । শিশিটা দূরে ছুঁড়ে ফেলেন ঝাউগাছের দিকে । তারপর নিজেই রুমাল নাকে চেপে ধরে অজ্ঞান হয়ে যান । অবশ্য সেটা করার আগে উনি দুবার ‘ বাঁচাও বাঁচাও ’ বলে চিৎকার করে ওঠেন ।

তারপর জ্ঞান ফিরলে খুব সুন্দর ভাবে একটা মিথ্যে গল্প বলেন আমাদের । আমি যেদিন কোলকাতা ফিরবো বলে অলীকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছি , তখন ঝাউগাছের কাছে ক্লোরোফর্মের শিশিটা পড়ে থাকতে দেখেছিলাম । সন্দেহ তখনই হয়েছিল যখন মিসেস সেনের মুখের উপর সাদা রুমালটা পড়ে থাকতে দেখেছিলাম । খুনি কি ওনাকে অজ্ঞান করার পর বোকার মত রুমালটা ফেলে চলে যাবে ? অভিনয়টা হালকা হালকা অনুমান করতে পেরেছিলাম । তাই কোলকাতায় এসে ক্লোরোফর্ম শিশির গায়ের ফিঙ্গার প্রিন্ট চেক করে দেখি সেটা ভীমুর লাঠির ফিঙ্গার প্রিন্টের সাথে হুবহু মিলে গেছে । বুঝতে বাকি ছিল না অলীককে যে খুন করেছে সেই তমলুকে অলীকের বাড়িতে প্রমিলাকে খুন করেছে । তখনও সিওর ছিলাম না খুনি মিসেস সেন কিনা । কিন্তু কাল রাতে রজক আমার কথা অনুযায়ী অলীকদের বাড়ি যায় নিজের ডায়রি নেবার নাম করে । মিসেস সেন রজককে কাঁচের গ্লাসে জল এনে দিয়েছিলেন । তারপর ওনার অলক্ষ্যে জলটা অন্য কাঁচের গ্লাসে ভরে টেবিলে রেখে সেই গ্লাসটা নিয়ে রজক পালিয়ে আসে । আর তাতেই মিসেস সেনের ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া যায় । শুধু তাই নয় , রজক মিসেস সেনের অলক্ষ্যে অলীকের মায়ের ঘরে ঢুকে ওনার জল খাবার গ্লাসে ঘুমের বড়ি মিশিয়ে দিয়ে চলে আসে , যাতে আজ ভোরে জল খাবার পর অলীকের মা ঘুম থেকে না উঠে আবার শুয়ে পড়েন । আর বাকি কাজটা করতে আমার কোনো অসুবিধেই ছিল না । আশা করি গালগল্পটা বোঝাতে পেরেছি আপনাকে মিসেস সীমন্তিনী সেন ? ”
সীমন্তিনী সেনের রাগটা অনেকটা প্রশমিত হয়ে গেছে ইন্দ্রদার বুদ্ধিমত্তার আড়ালে ।

“ আপনার ওপর আমার সন্দেহটা প্রকট হয় আপনাদের বাড়ি তমলুক গিয়েই । সেখানে রাতে আমাদের দোতলার ঘরে কেউ হুমকি চিঠি ছুঁড়েছিল । তাতে নিচে হীরা নাম লেখা ছিল ঠিকই কিন্তু চিঠিটা আপনিই লিখেছিলেন সে বিষয়েও আমি নিশ্চিত । মনে আছে , আপনি আপনার বাবার বাড়ির নম্বর , নাম , ঠিকানা একটা কাগজে লিখে দিয়েছিলেন ? সেই হাতের লেখার সাথে চিঠির লেখার মিল ছিল স্পষ্ট । সেটা অবশ্য হ্যান্ডরাইটার এক্সপার্টের কাছে পাঠানো হয়েছে , উনি আরো ভাল এক্সপ্লেন করতে পারবেন । কালীচরণবাবু এবার আপনার যা করণীয় করে ফেলুন । আমাকে সৌম্যকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে । ধন্যবাদ সকলকে । ”
ফেরার সময় ইন্দ্রদার মুখে সেই অতি পরিচিত তৃপ্তির হাসিটা দেখে আমার মনটা খুশিতে ভরে গেল । সেই হাসির মধ্যে নেই কোনো ওভার কনফিডেন্সের ছোঁয়া , আছে শুধু অলীক সেন মৃত্যু রহস্যের যবনিকা পতন করে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ।
“ সৌম্য তুই বাড়ি যা , আমাকে একবার হেদুয়ায় নামতে হবে । ”
“ আবার স্কটিশ চার্চের হোস্টেলে ? ”
“ না , পার্কে । এবার অলীক নয় , ঝিলিক । মিস ঝিলিক সেনগুপ্ত । ”

শান্তনু দাস
১ লা মে , ২০০৬

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleদিন বদলের পালা
Next articleপ্রবাসীর স্মৃতিচারণায় দেশের পুজো
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments