নেপালে ধুনছের হোটেলে এক প্রচন্ড শীতের রাতে ডিনার টেবিলে আমার সঙ্গে আলোচনারত মার্কিন ললনা সারা।
হাত ঘড়িতে দেখলাম রাত সাড়ে দশটা, পাহাড়ের ছোট জনপদে অতি গভীর রাত্রি। আগামীকাল সক্কালবেলা ফিরতি পথ ধরবো অথচ সারার গপ্পো পুরোটা না শুনলে ঘুমও আসবে না। স্মৃতিচারন করার সময় মানুষের মন পুরনো প্রিয় মুহুর্ত্তে অজান্তেই আটকে যায় । কিছুক্ষনের জন্য সারারও তেমনই হয়েছিল। সেই সময় আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা দেবার কোনো ইচ্ছে নেই। বলে ফেল্লাম, “তারপর।”
“বললাম, আজ আমরা ডিনার করবো কোনো রেস্তোরাঁয় । পলের আপত্তি, এমাসে কোন রেস্তোরাঁ নয়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন? নিচু গলায় সে বল্লে, মাইনের প্রায় সবটাই খরচ হয়ে গেছে এটা কিনতে, ডিনারের খরচে কন্ট্রিবিউট করতে পারবো না । পলের হাতে ধরা একটা ছোট্ট লাল বাক্স, সেটা খুলে দেখার পর অনেক্ষন ওকে জড়িয়ে ধরেই বসেছিলাম। অজান্তে দুচোখ জলে ভিজে যাচ্ছিলো , দাদু-দিদার কথা খুব মনে পড়ছিল।
ভ্যালেনটাইনের কিছুদিন আগে, পল জিজ্ঞেস করেছিল, আমার মতে কিরকম ভাবে একটা মেয়েকে প্রপোজ করা উচিত। মজা করে ম্যাগাজিনে দেখা একটা শৌখিন দামী আংটির বর্ণনা করে বলেছিলাম ওই আংটি যে ছেলে আমার আঙুলে পরাবে, আমি তার বাগদত্তা হব। পল যে গম্ভীরভাবে এটাকে নেবে তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। পরে জানতে পেরেছিলাম সেমাসে ওর কাছে যা অর্থ অবশিষ্ট ছিল তাতে মাসের শেষ পর্যন্ত সস্তার ফাস্ট ফুড খেয়েই ওকে কাটাতে হত।”
ছেলেদের পর্যবেক্ষণ শক্তি এমনিতেই ভীষণ কম, আমারতো সাধারণের তিন ধাপ নীচে। এতক্ষণে খেয়াল করলাম সারার বাম হাতের অনামিকায় সাদা সোনার আংটিটা, তাতে বসানো ছোট্ট পাথরগুলো দিয়ে যেন আলোর জ্যোতি ঠিকরে বেরোচ্ছে। “এই কি সেই আংটি ?”
আংটিটাতে আলতো চুমু দিয়ে সে বললে, “হ্যাঁ! আমার সারা জীবনের সঙ্গী।”
আংটির কথাতে কিছুদিন আগেকার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। মার্কিনের এক হাসপাতালে ইমেজিং টেকনিসিয়ান অল্পবয়স্ক মেয়েটি যেমন প্রাণোচ্ছল তেমনই হাসিখুশি। হাঁসপাতালের নীল পোশাকে একমাথা বাদামী চুল হওয়াতে উড়িয়ে সে যখন দ্রুত হাঁটে মনে হয় একটা নীল পাখি উড়ছে । ওর অনামিকায় সুন্দর আংটিটা দেখে মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো, “আংটিটা তো ভারী সুন্দর। ”
ভেবেছিলাম বলবে বিয়ের বা এনগেজমেন্ট রিং । আমার কথায় আংটিটার দিকে একবার তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে বললে, “আংটিটা আমারও খুব পছন্দের তাই এখনো রয়েছে।”
“কিসের আংটি এটা?” আমার প্রশ্নে এক প্রস্থ মুচকি হেসে সে বলে, “একজন তিন বছর আগে দিয়েছিলো, প্রমিস রিং।”
ওয়েডিং রিং, এনগেজমেন্ট রিং, আমার জ্ঞানের দৌড় এই অবধি। প্রমিস রিং কি? না জানলেও না দমে জিজ্ঞেস করলাম, “উপহার দাতার কি খবর?” মুচি হেসে বললো, “ওই একটা গাছের চারাকে এখনো মেরে ফেলিনি, আছে ওর মতন, সোফাতে।”
রাতে ডিনারের টেবিলে আমার সেদিনের শোনা মার্কিন আংটির গপ্পের কথা বললাম, গপ্পের হেঁয়ালী যে বুঝি নি তা টেবিলে বসা সকলের মুচকী হাসির ধরনেই বুজলাম। সকলের একপ্রস্থ হাসা শেষ হলে গিন্নীকে জিজ্ঞেস করলাম প্রমিস রিং আবার কি? গিন্নিই বুঝিয়ে দিলো প্রমিস রিংয়ের অর্থ, আমি এই আংটি দিয়ে শপথ করছি কোনো একদিন তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব করবো। মোদ্দা কথা বিয়ে বিয়ে করে ঘ্যান ঘ্যান কোরো না কানের কাছে। সোফাতে র অর্থ এখনো তার অবস্থান বসার ঘরেই সীমাবদ্ধ, শোবারঘরের চৌখাট এখনো ডিঙোতে পারে নি।’ব্যাখ্যা সোনার পরে এবারে আমার হাসার পালা।
যাই হোক সারার কথায় ফিরে আসি। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলে, “জানেন! পলের অনেক কথাই একসাথে ভিড় জমায়, তার কিছু কথা অন্তরকে স্পর্শ করে যেত । একদিন বললো সাধারণ মানুষের দুটো স্বাভাবিক দোষ কি জান? না জেনেই অন্য একজনের সম্মন্ধে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা আর সুযোগ পেলেই জ্ঞান দেওয়া। কেউ ভাবে না প্রত্যেকেই প্রতিদিন নিজেদের জীবনের লড়াই লড়ে চলেছে। তাদের সংগ্রামকে সন্মান করে তাদের পশে দাঁড়ানোর লোকের বড় অভাব সমাজে।
একদিন হঠাৎ প্রশ্ন করে, সারা বলতো বন্ধু আর একটা বড় গাছের কি সম্পর্ক? আমাকে নির্বাক দেখে সেই বলতে থাকে, গাছের পাতার জন্য গাছ সবুজ, সুন্দর, গ্রীষ্মে ছায়া দেয় কিন্তু বর্ষাকে আটকাতে পারে না, শীত আসলেই সব সবুজ পাতা ঝরেই যায়। তেমনই আমাদের জীবনে কিছু চকিতে বন্ধু আসে গাছের পাতার মত, ঋতু পরিবর্তনের সাথে তারা হারিয়েও যায়।
কিছু বন্ধু উই ধরা গাছের ডালের মত, দেখে বোঝা যায় না আসলে তাদের ওপর কতটা নির্ভর করা যায়, যেই বিশ্বাস করে নিজের ভার রেখেছো অমনি মটাস করে ভেঙে পড়ে। গাছের শিকড়ের মত বন্ধু পাওয়া সবথেকে কঠিন, কারণ এরা মাটির তলায় লুকিয়ে থাকে অনেক খোঁজার পরে দেখা মেলে। একবার পেলে সারা জীবন গাছের কান্ডের মত মাথায় করে রাখে, সারা জীবন আহারের রসদ জুগিয়ে যায়।”
রাত্রি গভীর, শরীরের ধকল, আমার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে, গল্পকে ত্বরান্বিত করতে বললাম, “পলের সঙ্গে এখানে আসার কথা ছিল?”
সারা বলতে থাকে, “নার্সিং হোম ছেড়ে একটা হাসপাতালে চাকরী নিলাম কারণ ওটা পলের স্কুলের কাছে। পল গাড়ি চালাতে পারতো না, আমার ডিউটির পরে পলকে বাড়ি পৌঁছে আমি ফিরতাম। আমরা শীঘ্র বিয়েও করব ঠিক করলাম, উইকেন্ডে করতাম আমাদের বিয়ের কেনাকাটা। সেদিন একটা জটিল অস্ত্ৰোপচার ছিল। পলকে মেসেজ করলাম আমার দেরি হবে ও যেন বাসে ফিরে যায়।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে পলকে ফোন করলাম, ওর মোবাইল সুইচ অফ, ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছে।পরের দিন হাসপাতালে আই সি ইউ তে ডিউটি ছিল। শুনলাম গতকাল রাত্রের পথ দুর্ঘটনায় আক্রান্ত পেশেন্টটি মারা গেছে। গুরুতর আহত অবস্থায় রাস্তায় অনেক্ষন পড়েছিল অশনাক্ত লোকটির দেহ, মৃত্যুর কারণ মাথায় আঘাত ও অত্যাধিক রক্তপাত। পুলিশ এসেছে ময়নাতদন্তে মৃতদেহ পাঠাবার ব্যবস্থা করতে।
আমাদের ওয়ার্কস্টেশনের ফোন বেজে উঠলো আমার এক কর্মীবন্ধু ফোনটা ধরে ইঙ্গিতে বললো আমার ফোন। ভাবলাম নিশ্চই পল, সরি কাল রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতে ফোন করেছে। ফোন ধরলাম, ভারী অচেনা কণ্ঠস্বর, আপনি সারা? পল বলে কাউকে চেনেন?”
সারা থামলো, দীর্ঘ নিঃস্বাস নিয়ে একটা সিগারেট ধারালো। নিঃস্বব্দে কেটে গেল কয়েকটা মুহূর্ত্ত।
“কে ফোন করেছিল?” জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই সে বলতে থাকে।
“এক্ষুনি আসছি বলে ছুটলাম। আই সি ইউর বাইরে একটা বেডে পল ঘুমোচ্ছে, মাথায় ব্যান্ডেজ। পল কি হয়েছে তোমার? কি করে হলো এসব? পল! পল! আমার ডাকেতে পলের ঘুম কিছুতেই ভাঙলো না। মনে হলো সারা পৃথিবী যেন কেঁপে উঠলো। কাছে থাকা মহিলা পুলিশ অফিসারটি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? আমিই সারা বলে কান্নায় ভেঙে পড়লাম ।
অফিসারটি আমার পিঠে অনুশোচনার হাত বুলিয়ে বলেন , দুর্ঘটনার জন্য দুঃখিত। গতকাল রাতে ওনার প্যান্টের পকেটে এই চিঠিটা ছাড়া আর কিছুই পাই নি ওনাকে সনাক্ত করার মত। চিঠির থেকে উনি যে স্কুলে পড়াতেন সেখানকার ঠিকানা পাওয়া যায় কিন্তু রাতে স্কুল বন্ধ থাকায় আজ সকালেই আমার সহকর্মী ওখানে পৌঁছে ওনার মোবাইল থেকে আপনার নম্বর পেয়ে আপনাকে খবর দেয়।”
দীর্ঘ কয়েকটা শ্বাস নিয়ে সারা বলে, “জানেন কি ছিল ওই চিঠিতে? স্কুলে পলের চাকরি পাকা হওয়ার খবর, সঙ্গে অন্য সুবিধে ও মেইনে বাড়ার খবর। দিনের শেষে চিঠিটা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা পল খবরটা আমাকে প্রথম দেবে বলে, ফোন, ছড়ি, মানিব্যাগ ছাড়াই রাস্তায় নেমে আসে। সেইসময় গাড়িটা ….. ”
“ছড়ি কেন? পলের কি পায়ে চোট ছিল?”
“না পল অন্ধ ছিল। পনেরো বছর বয়সে মাথায় একটা আঘাত থেকে ওর রেটিনা ডিটাচমেন্ট হয়। একটা চোখে সম্পূর্ণ অন্ধকার, অন্যটায় ২৫% দেখতে পেত। ”
আমার মাথা কেমন ভোঁ ভোঁ করে উঠলো।
“গত চার বছর ধরে এসময়টা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্গতদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। একটা তৃপ্তি পাই সমাজের সেবা করে। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ঝাপাতে ভুটানের শরণার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনা করার কর্মশালায় যোগ দিতেই এখানে আসা। একবন্ধুর পরামর্শে কদিন আরো যোগ করে এই পাহাড়ে ঘোরা।”
আমরা সবেতেই স্বার্থ দেখি, আগেই মূল্যায়ন করি কত পাচ্ছি, আর পরের ঘাড়ে কাঁঠাল ভাঙতে পারলে আমাদের পাই কে? জিজ্ঞেস করলাম, “কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিশ্চই আপনার যাতায়াতের খরচ যোগাচ্ছে?”
“না না আমি কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় চাকরি করি না, আমার এখানে আসা সম্পূর্ণ নিজের খরচে, স্বইচ্ছায়।”
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললাম, “আমাদের দেশে আপনার মত কেউ করলে আন্তীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু সকলে বলবে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে?”
মুচকি হেসে সে বলে, “সমাজসেবার ইচ্ছেটা সমাজ সচেতনতা থেকে আসে, আমাদের স্কুলেই সেখানো হয়েছে একে অন্যের সাথে যৌথ ভাবে কাজ করা, ভাগ করে নেওয়া, অন্যকে সাহাজ্য করা।”
মনে মনে ভাবলাম আমাদের স্কুলে সেখান হয় প্রাইভেট শিক্ষকের কোচিনে শৈশবের বেশীরভাগটা অতিবাহিত করে শুধু নম্বর বাড়ানো । এরপরে যখনই কোনও বাবা বা মা বড়াই করবে তাদের সন্তানের সাফল্য নিয়ে, তাকে জিজ্ঞেস করবো, “আপনার বিদ্বান সন্তান পকেট কত ভরছে জেনে লাভ নেই। সমাজের জন্য কি করছে তাই বলুন।”
******