আগে যা ঘটেছে:

শুভ জয়া শঙ্করপুরে বেড়াতে এসে আলাপ গাঙ্গুলি দম্পতি মলয় অরুণার  সাথে।  ডিনারের পর চাঁদনী রাতে  চারজনে সমুদ্রতটের দিকে হাঁটে l এক আত্মীয়র বাড়ি থেকে ফেরার পথে সূর্যাস্থের সময় গলা ভেজাতে এক  চায়ের দোকানে বিরতি নেয় মলয়দা অরুণা, সেইসময় দুজনের নজরে আসে পরিত্যক্ত জীর্ণ চৌধুরীদের বাগানবাড়ি। যখন তারা ওই বাড়িটাকে সারাই করে হোটেল করার জল্পনা করছে কোথা থেকে সেখানে উপস্থিত হয় ওই গ্রামের ছেলে কালু। চৌধুরী বাড়ির ইতিহাস বর্ণনার মধ্যে কালু টেনে আনে তার লালকাকার দুঃসাহসিক আফ্রিকার গল্প, তার হীরে প্রাপ্তি দেশে ফিরে ওই চৌধুরী বাড়ি ক্রয়। কালু তার মায়ের অনেক আপত্তি সত্ত্বেও ওই বাড়িতে রাত্রি যাপন, পরদিন কালু গিয়ে আবিষ্কার করে লালকাকার  আস্বাভাবিক মৃত্যু। পালাতে গিয়ে লালু সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পরে জ্ঞান হারাবার আগে দেখতে পায় বহু দিন আগে ওই বাড়িতে মৃত পদ্মাকে।  তারপর . .. 

 

মলয়দা বলে চলেছেন, সূর্য অনেক্ষন অস্তমিত দোকানের বাইরে জমাট অন্ধকার আশপাশে ঝিঝির ডাক । দোকানের ভিতরের লম্পের আলোর একফালি বাইরে পড়েছে। বাড়ি ফেরার তাড়া, তাই কালুকে তাড়া লাগাতে বললাম “তারপর?” চারিদিক নিস্তব্ধ, কালুর কোনো সাড়া না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম “তারপর কি হল?” একটা থমথমে নীরবতা,এবারেও কালুর কোনো উত্তর না পেয়ে পকেট থেকে দেশলাই বের করে জ্বালালাম কালু যেখানে বসে ছিল সেখানটা ফাঁকা কেউ নেই।

ভাবলাম কি অদভূত ছোকরা না বলে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। গাড়ির দিকে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম বুড়ো দোকানী দোকান বন্ধে ব্যস্ত।  আমাদের দেখে “বললে এখনও আছেন আপনারা?”

“এই যাচ্ছি, আপনাদের গ্রামের ছেলে কালুর গল্প শুনছিলাম, হঠাৎ মাঝপথে সে যে কোথায় চলে গেল?”

দোকানি আমার দিকে আশ্চর্য হয়ে কয়েক মূহুর্ত্ত তাকিয়ে থেকে বলল, “কাকা -ভাইপো, লালু আর কালু অনেক বছর আগে ওই চৌধুরী বাড়িতে গিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আমাদের গ্রামে আর কোন কালু বা লালু নেই। রাম রাম রাম রাম।”

দোকানির কথায় একটা শৈত প্রবাহ শিরদাড়া দিয়ে বহে গেল। খেয়াল করলাম অরুণা আমার হাত শক্ত করে ধরেছে ভয়ে ওর মুখ ভয়ে ফেকাসে।

তাড়াতাড়ি গাড়িতে স্টার্ট দিলাম, যানহীন রাস্তায় বাড়ির পথ ধরেছি, ভয়ে অরুণার মুখে কোন কথা নেই।

খানিকটা এগিয়েছি আচমকা আমার পাশ থেকে মহিলা কণ্ঠে খিলখিল করে হাঁসির আওয়াজ। অরুণার  হঠাৎ কিসে এতো হাঁসি পেল ? আমার বাম পশে তাকাতেই  আমার শরীরের সমস্ত রক্ত জল হয়ে গেল।  কোথায় অরুণা ওর জায়গায় বসে লাল শাড়িতে বিয়ের সাজে অন্য একজন মহিলা আমারি দিকে তাকিয়ে হাসছে।  ওর মণিহীন সাদা চোখের দিকে তাকাতেই আমার সারা শরীর নিশ্চল। মুখ দিয়ে কাঁপা গলায় একটাই শব্দ বের হল, “পদ্মা।” দেখলাম গাড়ি উর্দ্ধশ্বাসে এগিয়ে চলেছে পথের ধরে একটা মস্ত গাছের গুঁড়ির দিকে। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই গাড়ির স্টিয়ারিং একটুও ঘোরাতে পারলাম না। সমস্ত শরীর অবশ, প্রচন্ড শব্দে ধাক্কা মারলাম ওই গাছের গুঁড়িটায়।  এইটুকু বলে মলয়দা থামলেন।

নির্জন নিস্তদ্ধতাকে ভঙ্গ করে সমুদ্রের স্নিগ্ধ হাওয়া শুভ আর জয়ার কানে শোঁ শোঁ শব্দ করে এক নাগাড়ে বহে যাচ্ছে । মনে হয় মলয়দা যেন গল্পর মাঝে বিরতি নিচ্ছেন।  পিছনের দিকে না তাকিয়ে শুভ বলে, “তারপর ওই আকসিডেন্টের পরে কে আপনাদের হাসপাতালে নিয়ে গেলো?”

উত্তর না পেয়ে দুজনেই পিছনে ঘুরে যা দেখে তাতে ওদের শিরদাঁড়া  কেঁপে ওঠে।  কোথাও কেউ নেই, নিশুথী সমুদ্রের জনহীন রাস্তায় একা শুধু ওরা দুজন। চাঁদের আলোয় যে ৫০ গজ দূরে দৃষ্টি যায় একটাও জনপ্রাণী নেই ।   আর কোন কথা না বলে দুজনে হোটেলের ফিরতি পথ ধরল।  সমস্ত পথ দুজনের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি চারিদিকে। কে জানে এই বুঝি কোথা থেকে আবার মলয়দা আর বৌদি বেরিয়ে আসে ।

হোটেলের লনটা পেরোবার সময় কেঁচ কেঁচ লোহার শিকলের শব্দের দিকে দুজনেই  তাকিয়ে  হতবাক।  কেউ নেই অথচ দোলনা দুটো আপন মনে কেঁচ কেঁচ শব্দে দুলে চলেছে। হতভম্ব শুভ লক্ষ্য করল জয়ার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।

জয়ার মুখ আতঙ্কে সাদা কাগজের মত ফেকাসে। হোটেলে ঘরে টলতে টলতে ফিরে জয়া শুভকে ঘরের আলো নিভোতে বারণ করল।   আলো জ্বললে শুভর ঘুম আসে না, তবুও সে কোনোই আপত্তি করল না। সারা রাত ওরা কেউই ঘুমোতে পারলো না। বার বার মনের চোখে ভেসে উঠছিল মলয়দা আর বৌদির ছবি, কানে বাজছিলো ওদের কণ্ঠস্বর। জয়া কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “শুভ কাল ভোরেই কিন্তু আমরা কলকাতায় ফিরছি।”

হোটেলে আরো দুদিনের বুকিং থাকলেও শুভ বলল, “আচ্ছা।”

“একবারই পিছনে ঘুরে ওদের দেখে অস্বাভাবিক কি যেন দেখলাম মনে হয়েছিল। তখন মাথায় আসে নি, এখন বুঝলাম চাঁদের আলোতে আমাদের ছায়া পড়লেও ওদের কোনো ছায়া দেখি নি।” জয়া বলে।

শীতকালে সাত সকালে ওদের হোটেল ছাড়তে দেখে হোটেলের ডেস্কে মাফলার জড়ানো কেরানীটি বলে, “আজ চেক আউট করলে জানেন তো আপনি দু দিনের টাকা হারাবেন? আমাদের হোটেলে কোনো রিফান্ড হয় না।”

“ঠিক আছে। বলতে পারেন এই হোটেলে কোন সময় মলয় গাঙ্গুলী ও তার স্ত্রী অরুণা এসে থাকতেন?”

কেরানীটি বলে, “আমি এই বছরেই এসেছি, একজনকে ডাকছি যিনি এই হোটেলে অনেক দিন কাজ করছেন।”

শুভ দরকার নেই বলতে যাচ্ছিল তার আগেই কেরানীটি হাঁকে, “রতনদা একবার আসবেন?”

মাঙ্কিক্যাপ ও মাফলারে আবৃত, মোটা কাঁচের চশমা পড়া রতনদা এলেন। শুভ জয়াকে দেখে বলেন “আপনারা ৮ নম্বর ঘরে না? আজি চলে যাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ। আচ্ছা মলয়-অরুণা গাঙ্গুলী বলে এক দম্পতিকে মনে পড়ে আপনার?”

“চিনি, আমাদের পুরনো কাস্টমার, ৮ নম্বর ঘরে থাকতেন প্রতিবার। অনেক বছর হলো আসেন না।  শুনেছি এক পথ দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হয়। আপনি কি চিনতেন ওনাদের ?”

শুভ সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে নিজের গাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

পাতলা কুয়াশার চাদরে ঢাকা শীতকালের সকাল তাই শুভ আস্তেই গাড়ি চালাচ্ছে, পথের দুপাশের ঘাসজমিতে কুয়াশা যেন বেশি জমাট। হঠাৎ ডানদিকের মাঠে চোখ যেতেই চমকে ওঠে শুভ । কুয়াশার জন্য কিছু অস্পষ্ট হলেও চিনতে অসুবিধে  হয় না, মলয়দা আর বৌদি হাঁটছেন, যেন প্রাতঃভ্রমণে বেড়িয়েছেন ।  জয়া দৃষ্টি আকর্ষণ ঐদিকে করার জন্য শুভ জয়ার দিকে তাকাতেই দেখে জয়ার ও দৃষ্টি ওদের দিকেই।

আচমকা জয়ার চিৎকার, “শুভ” ঠিক সেই সময় তীব্র ভোঁ ভোঁ গাড়ির হর্নের আওয়াজে শুভর সম্ভিত ফেরে।  সামনেই তার দিকেই ধেয়ে আসা বিশাল লরিটা। মুহূর্তে শুভ স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে কোনোরকমে দুর্ঘটনা এড়ায়।

“রাম রাম রাম রাম” জয়া ফিসফিস করে।

সমাপ্ত

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleরূপকথা নয়
Next articleকালের মন্দিরা
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments