হঠাৎই কিসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল রমেনের । মাথার উপর ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ শব্দ করে সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে। জ্যৈষ্ঠ মাসে দিনের থেকেও রাতে বেশি গরম মনে হয়। প্রখর গরম থেকে একটু স্বস্তি পেতে আজই ফ্যানটা সারিয়ে এনেছে সে । রমেনের বয়স উনত্রিশ বছর । এম পাস করার পর তার দূর সম্পর্কের এক মামার সুপারিশে আজ প্রায় সাড়ে তিন বছর হচ্ছে সে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কোলকাতার একটি টেক্সটাইল কোম্পানিতে সুপারভাইজারের কাজ পেয়েছে , এবং উওর কোলকাতার শ্যামবাজারের কাছে একটি বাড়ির দোতলায় সে ভাড়া নিয়ে থাকে । রমেন বিছানায় শুয়ে শুয়েই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলো । ঘরের ডিম লাইটাও আজ জ্বালাতে ভুলে গেছে সে । মাথার দিকের জানালাটা খোলা রাখাছিল , সেখান দিয়েই পূর্ণিমার চাঁদের আলোর কিছু অংশ তার ঘরেও পড়েছে যা ঘরের কালো অন্ধকারকে ঢাকার জন্য যথেষ্ট । তারপর এভাবেই বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ শুয়ে থাকার পর সে বিছানা ছেড়ে নিচে নামলো । টেবিলের উপর ঢেকে রাখা জলের গ্লাসটা তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে পুরো এক গ্লাস জল এক দমে সে খেয়ে ফেললো । রমেন মনে মনে ভাবলো হয়তো জল তৃষ্ণার কারণেই তার ঘুম ভেঙে গেছে । এমনতো কতবারই হয় আমাদের সাথে , আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় আমরা ঘুমাচ্ছি , কিন্তু আমাদের মস্তিক তো আর ঘুমায় না । এই ভেবে রমেন মনে মনে একটু হাসলো তারপর আবারও খাটে শুয়ে পড়ল , এবং চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো । মিনিট দু-এক হবে আবারও সেই একই শব্দ তার কানে এলো , রমেন এবার ধড়মড় করে উঠে মাথার দিকের খোলা জানালাটার দিকে এসে দাঁড়ালো । রাত তাও কটা হবে তার জানা নেই তবে আন্দাজ মত বলতে গেলে দুটো তিনটে হবে , চারিদিক নিশ্চুপ রুপালি চাঁদের আলোয় বাইরের দৃর্শটা তখন অপূর্ব লাগছে । এরই মধ্যে আবারও সেই শব্দ কানে এলো , রমেন ভালো করে কান পেতে শব্দটা চেনার চেষ্টা করল , কিন্তু পারলোনা । এটা কোনো চেনা শব্দ না , হাওয়ার বেলুনের উপর কেউ যদি হাত দিয়ে ঘষে তাহলে যেরকম শব্দ হয়
কিছুটা সেরকমই । কিন্তু শব্দটার মধ্যে কেমন জানি করুনতা লুকিয়ে আছে । চতুর্থবার যখন শব্দটা তার কানে এলো এবার সে শব্দটার উৎস খুঁজে পেলো । সে জানালা দিয়ে দেখলো রাস্তার ফুটপাতের কোণ ঘেষে যে ল্যাম্পপোস্টটা আছে তার ঠিক নীচে একটি শুকনো পেয়ারা ডালে কোনো একটা পাখি বসে আছে , সেই এইরকম আওয়াজ করছে । তবে ল্যাম্পপোস্টের আলোটা খুব বেশি না হওয়ায় সে বুজতে পারছে না ওটা কি পাখি ! যদিও চাঁদের আলোয় পাখিটার আকৃতি কিছুটা বোঝা যাচ্ছে তবুও সেটা তার কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয় । এমন কোনো পাখির ডাক রমেন আগে কখনো শোনেনি , আর রাতের বেলায় পাখির ডাক বলতে সে তার গ্রামের বাড়িতে পেঁচার ডাক শুনেছে । কিন্তু এডাক তো পেঁচার নয় ! তবে এটা কি পাখির ডাক ? খুবই চেনা চেনা লাগছে । তারপর হঠাৎই পাখিটা উড়ে এসে তার ঠিক জানালার সামনে এসে বসলো । যেন রমেনের ওঠার অপেক্ষাই করছিল পাখিটা ; এবার রমেন বুঝতে পারলো পাখিটা আসলে কি পাখি ! আরে এটা তো ‘কাক’ ! তবে সাধারণত কাকেরা যেমন দেখতে হয় , এই কাকটি তেমনটা নয় । এই কাকের আকার বেশ বড় মাপের গায়ের রং আলকাতরার থেকেও কালো , লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে এই কাকটির দুটি চোখের মধ্যে একটি চোখ নেই । অনেক সময় এরা বিদ্যুতের তারে বসতে গিয়ে ইলেকট্রিকের সর্ক খায় হয়তো ওই কারণে তার এই অবস্থা কিংবা হয়তো কেউ কোনো কিছু দিয়ে তার চোখে আঘাত করেছে । আমরা অনেক সময় নিজের অজান্তেই এই রকম কিছু অ-কাজ কু-কাজ করে থাকি । সে যাই হোক তার এই অবস্থা কি করে হয়েছে সেটা না ভেবে বরং সে এটা ভাবুক এই রাতদুপুরে এই রকম একটি কাক এলো কোথা থেকে ? এবং কেনোই বা সে ওইভাবে ডাকছে ! কাকটি রমেনের মুখের ঠিক সামনের জানালায় দাঁড়িয়ে আছে আর রমেনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । যেন রমেনকে কিছু বলতে চায় । এইভাবে ঠিক কতক্ষণ রমেন দাঁড়িয়ে ছিল তার ঠিক খেয়াল নেই । তারপর হঠাৎই কাকটি তার চোখের সামনে থেকে কোথায় যেন উড়ে চলে গেলো । জানালাটা খুব বেশি বড় না হওয়ায় রমেন ঠিকভাবে দেখতে পেলো না । বেশ কিছুক্ষণ সে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে খোঁজা খুঁজি করতে থাকলো । অবশেষে কাকটিকে দেখতে না পেয়ে সে হতাশ হয়ে ফিরে এসে খাটে বসলো । তারপর সে গভীর মনোযোগ দিয়ে পুরো ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলো । সে মনে মনে প্রশ্ন করতে লাগলো ওটা আদো কাকই ছিল তো ? না পুরোটাই তার মনের ভুল ! আর যদি ওটা কাকই হয় তবে রাতের বেলাতে সে ডাকতে যাবে কেন ? কাকেরা তো রাতের বেলায় ডাকে না ; আর রাতের বেলায় তো ওরা ভালো করে চোখেও দেখতে পায় না , তার উপর এই কাকের তো একটা চোখই নেই । এইসব নানান চিন্তা করতে করতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো বুঝতেই পারেনি । তার ঘুম ভাঙ্গলো পরের দিন সকাল বেলায় বাড়িওয়ালার ডাকাডাকিতে । চোখ খুলতেই সবার প্রথমে তার সামনের দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়িটার দিকে চোখ পড়লো ; সর্বনাশ সাড়ে এগারোটা ! রমেন বিছানা থেকে ধড়মড় করে উঠে দরজাটা খুলে দিল । দরজার বাইরে বাড়িওয়ালা নিখিলেশ বাবু প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে । তারপর রমেনকে জিজ্ঞাসা করলো , “আপনার চোখমুখের একি অবস্থা ? আমি এতবার করে আপনাকে ডাকলাম আপনি শুনতে পাননি ? আপনার শরীর কি খারাপ নাকি ? আজ কাজে যাননি কেন ?” উনি রমেনকে কোনোরকম উওর দেওয়ার সুযোগই দিচ্ছেন না । একেবারে র্যাপিড ফ্যায়ারের মতো একটার পর একটা তাকে প্রশ্ন করতেই থাকলেন । তারপর রমেনকে একপ্রকার ঠেলেই ঘরের মধ্যে ঢুকে নিখিলেশ বাবু উত্তেজিত কন্ঠে বললেন “তাড়াতাড়ি টিভিটা চালান ; নিউজ চ্যালেনে কি দেখাচ্ছে একবার দেখুন ।” রমেন জিজ্ঞাসা করলো “নিউজ চ্যালেনে কি দেখাচ্ছে ?” রমেনের প্রশ্ন শুনে নিখিলেশ বাবু একটু বিরক্তির সরে বললেন “উঃফ চালালেই তো দেখতে পারবেন ” , রমেন আর কথা না বাড়িয়ে নিউজ চ্যালেনেটা চালিয়ে দিলো । তারপর সে যা দেখলো তা দেখার পর তার মাথা ঘুরতে লাগলো । মনে হচ্ছে এখনই সে জ্ঞান হারাবে । রমেন যে কোম্পানিতে কাজ করতো সেখানে আজ সকাল নটা বেজে চল্লিশ মিনিট নাগাদ আগুন লাগে । হুড়োহুড়ি করে বের হতে গিয়ে বেশ কিছুজন খুবই গুরুতর ভাবে আহত হয়েছে । এবং তার দুজন সহকর্মীর ঘটনাস্থলে মৃত্যু ঘটেছে । আজ যদি রমেন কাজে যেতো তাহলে সেও এই ঘটনার শিকার হতে পারতো । টিভিতে নিউজ দেখতে দেখতেই নিখিলেশ বাবু বলতে লাগলেন “ভাবুন আজ যদি আপনি কাজে যেতেন তাহলে কি কান্ডটাই না হতো ! আপনি আজ খুব বাঁচান বেঁচে গেছেন মশাই ।” ওনার কথাগুলো রমেনের কানে আসছিল ঠিকই কিন্তু তার মাথায় তখন অন্য কিছু চিন্তা ভাবনা চলছিল । রমেন একটু অন্য প্রসঙ্গ টেনে এনেই নিখিলেশ বাবুকে জিজ্ঞাসা করলো “আচ্ছা নিখিলেশ বাবু আপনি কাল রাতে কোনো কাকের ডাক শুনেছেন ?” রমেনের প্রশ্ন শুনে উনি ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে রমেনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন । উনি হয়তো ভাবছেন ‘আমি’ ওনার কথাকে কোনো গুরুত্বই দিচ্ছিনা , কিংবা এই অবস্থায় ‘আমার’ এই ধরনের প্রশ্নের কোনো প্রসঙ্গই হয়তো উনি খুঁজে পাচ্ছেন না । নিখিলেশ বাবু বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন “কাকের ডাক ! তাও আবার রাতে ; কই নাতো ” । রমেন খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো “হ্যাঁ কাকের ডাক যদিও সেটা ঠিক কাকের ডাকের মতো না তবুও রাতের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমি স্পষ্ট দেখেছি , তাছাড়া পাখিটা আমার জানালায় এসেও বসেছিল , ওটা কাক ই ছিল। রমেনের কথাগুলো শুনে নিখিলেশ বাবুর চোখ কপালে উঠেছে ; উনি বললেন “এসব কি বলছেন আপনি ! কাল সারারাত ইলেকট্রিসিটিই তো ছিল না । সকালে মিউনিসিপালিটির লোকেরা মাইকে করে হেঁকে হেঁকে সবাইকে তো জানিয়ে গিয়েছিল , যে রাস্তার কাজের জন্য সন্ধ্যের পর থেকে ইলেকট্রিসিটি থাকবে না ।” কথাটা শোনার পর রমেনের মনে পড়লো হ্যাঁ তাইতো সে নিজেও তো খবরটা জানতো । তাহলে রাস্তার লাইট , ওর নিজের ঘরের সিলিং ফ্যান কি করে চলতে পারে ! রমেনের সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যেতে লাগলো । আজকালকার দিনে বিশ্বায়নের যুগে এই ধরনের অতি আশ্চর্য ঘটনা ঘটাও কি সম্ভব । আসলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটে যার ব্যাখ্যা আজ ও বিজ্ঞানীদের কাছে নেই । অতোছো গ্রাম বাংলায় বড়ো হওয়া রমেন ছোটো বেলা থেকেই লোক প্রচলিত একটি কথা জানতো , যে কাকের ডাককে বিশেষত অশুভোর প্রতীক হিসাবেই ধরা হয় । কারুর মৃত্যু সংবাদ কিংবা কোনো কিছু খারাপ হওয়ার আগে নাকি কাকেরা একটি নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে এক নাগাড়ে ডাকতেই থাকে । যদিও রমেন এতদিন এই লোক প্রচলিত কথাকে কুসংস্কার হিসাবেই ভেবে এসেছিলো । কিন্তু নিজের সাথে ঘটে যাওয়া রাতের ওই ঘটনাকে সে কি ব্যাখ্যা দেবে ! তা আপনারাই বিচার করে দেখুন ।।
রাতের কাক
Subscribe
Login
0 Comments
Oldest