মমি বলতে যে কি বোঝায় সেটা এখন যারা history র student নয় তারাও জেনে গেছে “The Mummy” cinema র কল্যাণে । মমি বলতেই যদিও মিশর এর কথাই প্রথমে মনে পরে তবে Mummification বা মৃতদেহ অবিকৃত অবস্থায় সমাহিত এবং সংরক্ষিত করার প্রচলন পৃথিবীর মুটামুটি সব দেশের ইতিহাসেই পাওয়া যায়।
মনটাকে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক 300 বছর। এই বাংলার ই কথা। মুর্শিদকুলি খাঁ তখন বাংলার সুবাদার বা প্রথম স্বাধীন নবাব ও বলা যায় । 1727 সনের একটা সন্ধে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে, রাস্তার আলো গেছে কমে । প্রাসাদের অধিকাংশ কক্ষ অন্ধকার, রাজপথের ধার ছাড়া বাকি রাস্তার দুপাশের আলো অনেক কম । এক মহিলার হাত ধরে একটি বাচ্ছা ছেলে হেঁটে আসছে রাজবাড়ীর রাস্তা ধরে । বোরখা পরিহিতা মহিলার পোশাকের তলায় লুকানো খঞ্জর । আসলে সে একজন খোঁজা প্রহরী । নবাব কন্যা আজিমুন্নিসার (নবাব পদের এক দাবিদার সুজা – উদ -দৌল্লার বেগম ) বিশস্ত প্রহরী। রাস্তার আলো বাচ্ছা ছেলেটার চোখে পড়লে বোঝা যাবে ছেলেটা নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে । খোঁজা প্রহরী শক্ত মুঠিতে ধরে রেখেছে তার হাত , ছাড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই । সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করে খেলে বেড়ানোর পর সবেমাত্র মা বাবা ভাই বোনদের সাথে নৈশাহার করে শুয়েছিল বেচারা । জোর করে তাকে তুলে এনেছে খোঁজা । মা বাবার অনুরোধ , ভাই বোনদের কান্না কিছুই খোঁজা কে টলাতে পারেনি। প্রহরীর ও মন ভালো নেই , তার ভালোলাগেনা এইরকম মাঝে মাঝেই বাচ্ছা ছেলে ধরে আনতে কিন্তু নবাব কন্যার হুকুম । বেশ কিছুদিন যাবৎ শুরু হয়েছে এই নতুন কাজ। বেতনভুক কর্মচারী বই তো আর কিছু নোই সে , তাই মুখ বুজেই কাজ করতে হয়। শহরে ইতিমধ্যে গুজব রটে গেছে বাচ্ছা ছেলে হারানোর খবর । আর কতদিন এরম চলবে কে জানে । নবাব প্রজাবৎসল খুব , নবাবের কানে খবর গেলে শক্ত হাতে দমন হবেই ছেলেধরা ।
রাজবাড়ীর কাছাকাছি এসে রাজপথ ছেড়ে গলির রাস্তা ধরলো খোঁজা । হুকুম সেরকমই । নিঃশব্দে আগল সরিয়ে রাজবাড়ীর মধ্যে ঢুকে পড়লো বাচ্ছা টাকে নিয়ে। খোঁজা লক্ষ করেনি গলির রাস্তা থেকেই সন্তপর্নে তার পিছু নিয়েছে একটি লোক। রাজবাড়ী অবধি তার পিছু নিয়েছে নিঃশব্দে। তারপর অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। এই লোকটি নবাবের গুপ্তচর বাহিনীর সদস্য। সারা রাজ্যের সব প্রান্তে ছড়িয়ে আছে এই গুপ্তচর বাহিনী, বর্গী দমন থেকে প্রজাদের খবর সব কিছুতেই নবাবের বড় ভরসা এই বাহিনী।
নবাব কন্যার অন্দরমহল থেকে তখন ভেসে আসছে চাপা কান্নার শব্দ। বাচ্ছা ছেলেটার কান্না। কখনো গোঙানি, কখনো ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দটা চলতেই থাকলো। বেশ খানিক্ষণ পর থেমে গেলো সব শব্দ। রাত তখন নিশুতি হয়েছে। রাত জাগা পাখিরাও ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা রাজধানী মুর্শিদাবাদের বুকে নেমে এসেছে আরেক অভিশপ্ত রাত। এই রাতের বলি 13 বছরের ছোট্ট এক কিশোর।
রাত কেটে সকাল হলে নবাব বৈদ্যর ডাক পড়লো অন্দরমহলে, নবাব কন্যা অসুস্থ। ওদিকে গঙ্গার ধারে মাছ ধরার জালে আটকা পড়েছে একটি কিশোরের মৃতদেহ। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার হলো। প্রতিবারই রাজবাড়ীর কাছাকাছি গঙ্গাতেই পাওয়া যাচ্ছে মৃতদেহ।
এরপর বছর তিনেক কেটে গেল।1730 সন এখন। ইতিমধ্যে মুর্শিদকুলি খাঁ মারা গেছেন। তার স্থানাভিষিক্ত হয়েছেন শরফরাজ খাঁ। নতুন নবাব। প্রজাবৎসল মুর্শিদকুলি কে এখনো পরম পূজনীয় পিতার স্থানে রেখেছে মুর্শিদাবাদের মানুষ। কাঠরা মসজিদে তার সমাধি স্থলে প্রতিদিন হাজার জনসমাগম হচ্ছে নামাজ পড়ার সময়।
ওদিকে বাইরে রাজধানী কিন্তু অশান্ত। নিখোঁজ এবং মৃত কিশোরের সংখ্যা একশত পার হয়ে গিয়েছে এই কয়েক বছরে । লোক মুখে গুজব রটে গিয়েছে যে রাজবাড়ীতে গিয়েই নিখোঁজ হয়েছে সব বাচ্ছারা। গুপ্তচরের মুখে সব খবরই পেয়েছেন নবাব । সিংহাসন শক্ত করতে গেলে প্রজাদের মুক্ত করতেই হবে এই বিপদ থেকে। এদিকে যা খবর পেয়েছেন গুপ্তচরের থেকে তা কিছুতেই বিশ্বাস যোগ্য মনে হয়না নবাবের । আজিমুন্নিসা বেগম বিগত কয়েক বছর ধরে অসুস্থ । বৈদ্যর বিধান নাকি শিশু – কিশোরের টাটকা কলিজা ভক্ষণে এই রোগ সারবে । তাই চলছে এই পৈশাচিক শিশু – কিশোর হত্যা । লোক মুখে খবর এতটাই ছড়িয়ে গেছে যে প্রজারা প্রকাশ্য রাজপথে নবাব কন্যার মৃত্যুদণ্ড কামনা করছে। রাজবাড়ীর ভিতরে এইরকম নৃশংশ ঘটনা বরদাস্ত করা শক্ত । কিন্তু বৈদ্য যদি সত্যি সত্যি রোগের পাথেয় এরম অদ্ভুত দিয়ে থাকে , তাহলে ?
পরিবারের সবাইকে নিয়ে বৈঠকে বসলেন নবাব । ডাক পড়লো সেই খোঁজা প্রহরীর , যে এই পৈশাচিক কর্মকলাপের সাক্ষি । বৈঠকে উঠে এলো বিস্ফোরক তথ্য । নবাব কন্যা বিকৃত কাম মনোভাবাপন্ন । প্রায়শই সন্ধ্যায় নাবালক কিশোর শিশুকে দিয়ে তিনি নিজের কাম পিপাসা মেটান । অবিশাস্য হলেও এটাই সত্য । সাখ্যাত প্রত্যক্ষ দর্শী খোঁজা প্রহরী । আজিমুন্নিসার ভয় দেখানো , লোভ দেখানো কিছুই আজ তার মুখে লাগাম টানতে পারেনি । ছেলেধরা আজ নিজের মুখেই স্বীকার করেছে তার কৃতকর্ম । নিজের হাতে যে এতগুলো শিশু কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে অকপট স্বীকারোক্তি করেই সে পাপের প্রায়াশ্চিত্ব করতে চায় । নীরবে শুধু খোঁজার মৃত্যু দণ্ড ঘোষণা করেন নবাব । নিজের দিদির এই বিকৃত মানষিকতার পরিচয় পেয়ে নির্বাক হওয়া ছাড়া আর কিছু উপায় থাকেনা তার ।
সমাজের চোখে pedophilic আজিমুন্নিসা সাখ্যাত শয়তানের প্রতিরূপ । রাজ্যের সব মানুষের সামনে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজদ্রোহ ছড়িয়ে পড়া আশ্চর্য নয় । আল্লাহ র বিধানে এরম পিশাচের বাঁচবার অধিকার নেই । নিজের পরিবারেই এরম পিশাচকে পালন করা শুধু পাপ ই নয় , ভবিষ্যৎ এবং পরজন্মের জন্য ও সমান ক্ষতিকারক । প্রজাদের কাছে নবাব পরিবারের এই অভিশাপের খবর কোনোভাবেই পৌঁছানো চলবেনা । প্রজারা ইতিমধ্যে জেনে গেছে অসুস্থ বেগমের চিকিৎসার বলি হতে হয়েছে নিষ্পাপ শিশুদের । বৈদ্যকেও প্রাণ দণ্ড দিতে হবে সত্য গোপনের অজুহাতে । প্রজারা বরং যা গুজব তাই নিয়েই থাকুক, বেগমের এই বিকৃতি বাইরে যেন কোনোভাবে প্রকাশ না হয় । কিন্তু নবাব কন্যার এই অভিশাপ থেকে কি করে মুক্তি পাওয়া যায় ? দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দিয়ে প্রজাদের মন শান্ত করা যায় , কিন্তু তাতে তো আর পরিবারের অভিশাপ দূর হবেনা । পীড় দেড় নিয়ে গোপনে সভা ডাকলেন নবাব, প্রজাদের থেকেও তার বড়ো চিন্তা পরিবার থেকে এই অভিশাপ দূর করা নিয়ে।
January মাসের রাত । যেমন ঠান্ডা তেমনি নিশুতি হয়ে রয়েছে । গৃহবন্দী আজিমুন্নিসা ঘুমিয়ে রয়েছেন তার নিভৃত কক্ষে । ছায়া মূর্তির রূপ ধরে তার ঘরে প্রবেশ করলো একদল নবাবী সৈন্য । নিঃশব্দে সরে গেলো বেগমের পাহাড়াদারেরা । ঘুমন্ত বেগম কোনো অন্তরায় তৈরির আগেই বন্দি হয়ে গেলেন সৈন্যদের হাতে । শব্দ করার আগেই তার মুখে ঢেলে দেওয়া হলো কড়া সূরা । অল্পক্ষনেই জ্ঞান হারালেন বেগম । সন্তপর্নে অভিশপ্ত বেগমের দেহ নিয়ে আসা হলো বধ্য ভূমিতে । নবাবের হুকুম পীরের কথামতো শরীরটা অবিকৃত রাখতে হবে মৃত্যুর পরেও যতদিন সম্ভব । কবর দেয়ার আগে অবধি প্রাণ থাকতে হবে শরীরে । জীবন্ত সমাধিই একমাত্র শক্ত বিধান এই অভিশপ্ত বেগমের ।
বিবস্ত্র করে কাদামাটি আর সূরায় লেপে দেয়া হলো বাহ্য জ্ঞান লুপ্ত বেগমের দেহ । তারপর সর্বাঙ্গে পবিত্র কোরানের বাণী লেখা কাপড়ে মুড়ে দেয়া হলো । মমি বানানো শরীর টা এরপর রাখা হলো প্রমান মাপের আধারে (মিশরীয় মমির ক্ষেত্রে যাকে বলে sarcophagus ) । বৈদ্য আগুন ছুঁইয়ে দেখে নিলেন, হ্যাঁ শরীরে প্রাণের লক্ষণ রয়েছে । Sarcophagus টা এরপর নিয়ে যাওয়া হলো কাঠরা মসজিদের সামনে।
মুর্শিদকুলির সমাধির প্রবেশপথের ঠিক নিচে জীবন্ত কবর দেওয়া হলো বেগমকে। কবরের উপর দিয়ে মসজিদের নতুন প্রবেশ পথ তৈরী করে ফেলতে হবে রাত্রি ফুরোবার আগেই । সকাল থেকে পুর্ণাথীরা নামাজ পড়তে আসবে । মসজিদে ঢোকার সময় পা মুছবে বেগমের কবরে। পুর্ণাথী দের পায়ের ধুলোয় মুর্শিদাবাদের মমির পাপস্খলন হবে।
প্রসঙ্গতঃ গল্পের সূত্র স্থানীয় guide দের মুখে শোনা কথা । 20, 30 টাকা বখশিশের বিনিময়ে মন্দ লাগেনা এরম গল্প শুনতে । ঐতিহাসিক সত্যতা তর্কের বিষয় ।
অভিধান :
খোঁজা : Transgenders , নবাবী আমলে প্রধানত বেগম দের দেহরক্ষি
বৈদ্য : Doctor