ছোটবেলার পুজো বলতেই মনে পড়ে যায় মামার বাড়ি গ্রামের পুজো। প্রতিবছর পুজোতে আমরা মামার বাড়ি যেতাম। খুব মনে পড়ে, বাস থেকে নামতেই দেখতাম দাদু দাঁড়িয়ে থাকতো আমাদের জন্য। অপেক্ষা করতো কখন নাতি-নাতনিরা আসবে। দাদু গত হয়েছেন প্রায় চার বছরেরও বেশি হয়ে গেল। তারপর থেকে সেইভাবে পুজোর সময় গ্রামে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

আমার মাতুলালয় হল পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার অন্তর্গত খাটুন্দি নামে একটি গ্রামে। এখানে আমার মায়ের ছোটবেলা কেটেছে । দেশে থাকাকালীন আমারও ছোটবেলার বেশ কিছু সময় এই গ্রামে কেটেছে। মামার বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের কোলাহলে একটা আনন্দের বাতাবরণ তৈরি হতো পুজোর সময়। বাড়ির সামনে পাড়ার পুজো হতো বড় করে। এছাড়া গ্রামে আরো অনেক দুর্গাপুজো হয় এখনও ধূমধাম করে। খাটুন্দি গ্রামের একটি বিখ্যাত দুর্গাপুজো হল সাত বাড়ির দুর্গাপুজো। সেই গল্পই বলব আজ।

সাতবাড়ির দুর্গাপুজো হল বিখ্যাত বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো। ছোট থেকেই আমার মনে প্রশ্ন জাগতো কেনইবা এই পুজোর নাম সাতবাড়ির দুর্গাপুজো । আবার এই সাতবাড়িকে কেষ্ট রায় উঠোন বলা হয়। এটাও একটি আশ্চর্য বিষয় একই সঙ্গে যেখানে দুর্গাপুজো হয় সেখানে আবার কি করে কৃষ্ণ পূজা হয়। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেশ কিছুদিন গবেষণা করার পর এর ইতিহাস সম্পর্কে আমি অবগত হয়েছি। এখন আমি সেই ইতিহাসের গল্প বলব আপনাদের। এই সাত বাড়ির একজন শরিক দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য থাকেন কাটোয়া শহরে। কাল ক্রমে তিনি ছিলেন আমার অঙ্কের মাস্টার মশাই। সে যাই হোক এখন আসি সাতবাড়ির দুর্গাপুজোর কথায়।

এই সাতবাড়ির দুর্গাপুজোর পিছনে রয়েছে একটি বিশাল ইতিহাস। সে প্রায় আজ থেকে আনুমানিক ৬৫৮ বছর আগের কথা। কেশব ভট্টাচার্য পরবর্তীতে তিনি হন কেশব ভারতী। কেশবের পূর্বাশ্রমের নাম ছিল কেশব ভট্টাচার্য, পরবর্তীতে ভারতী পদবি নেন তিনি। আমরা জানি নবদ্বীপের শচী মাতার গর্ভে চৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেছিলেন।এই চৈতন্য মহাপ্রভুর সন্ন্যাস দীক্ষাগুরু হলেন কেশব ভারতী। প্রায় ৬৫৮ বছর আগে এখন যেখানে কেতুগ্রাম থানার খাটুন্দি গ্রাম, সেই গ্রামের দক্ষিণে বয়ে যাওয়া কাঁদর নামে একটি নদীখাতের ধারে ছিল ঠাকরুণপুকুরের মাঠ। এই মাঠেই দুর্গা পুজোর সূচনা করেন এই কেশব ভারতীর বাবা রামগোপাল ভট্টাচার্য। শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাস দীক্ষাগুরু কেশব ভারতীর বাবা ছিলেন এই রামগোপাল ভট্টাচার্য। কেশব ভারতী তাঁর এক ছেলে উমাপতি ঘোষ সম্প্রদায়কে দীক্ষা দেওয়ায় অপর ছেলে নিশাপতি ওই জায়গা ছেড়ে খাটুন্দিগ্রামের বিদ্যাভূষণ পটিতে কৃষ্ণমন্দির তৈরি করেন। তাঁর পাশেই দুর্গাপুজো শুরু করেন তিনি।তবে শুরুর সময় একটি প্রতিমাতেই পুজো শুরু করেছিলেন ভট্টাচার্য পরিবারের পূর্বপুরুষরা। সময়ের সঙ্গে পারিবারিক ভাগাভাগির সঙ্গে ভাগ হয়ে যায় পুজোও। বর্তমানে পরিবারের সাত বংশধর সাতটি পৃথক দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন।

কথিত আছে নিশাপতির তিন নাতি তিনটি পুজো শুরু করেন। দৌহিত্র সূত্রে আরও চারটিপুজো শুরু হয়। প্রায় একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে সাতটি পুজো হচ্ছে এখানে। তবে এর মধ্যে একটি পুজোয় প্রতিমা পুজো করা হয় না। ঘট বসিয়ে পুজো করা হয়। ছটি পুজো গাঁয়ে হলেও এক দৌহিত্র রাখহরি বন্দ্যোপাধ্যায়ের বংশধররা কাটোয়ায় এসে পাকাপাকিভাবে থাকায় , তাদের পুজোটি আজও কাটোয়ার চাউল পট্টিতে অনুষ্ঠিত হয়।

বাড়ির উঠোনে কৃষ্ণের পাশেই শাক্ত মতে ষোড়শ উপাচারে পূজিত হন দেবী। কৃষ্ণের পুজোর পর শুরু হয় দেবীর পুজো। কেতুগ্রামের খাটুন্দি গ্রামে ভট্টাচার্য পরিবারের এই পুজো ‘সাত বাড়ির পুজো’ নামে পরিচিত। শতাধিক বছরের প্রাচীন পুজোটিতে এ ভাবেই মেলবন্ধন বৈষ্ণব ও শাক্ত মতের। শ্রীকৃষ্ণকে ভোগ দেওয়ার পরেই ভোগ পান দেবী। ভট্টাচার্য পরিবারের একজন সদস্যের থেকে জানা যায় শাস্ত্র মতে দুর্গা পুজো না করলে দেবীকে সম্পূর্ণ তুষ্ট করা যায় না। তাই এখানে ষোড়শ উপাচারে দেবীর পুজো করা হয়। বিসর্জনের আগে ছয় প্রতিমাকে নিয়ে আসা হয় শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরের সামনে। মন্দির থেকে বের করে আনা হয় শ্রীকৃষ্ণকেও। আরতি শেষ হলে হরিনাম সংকীর্তনের পরে স্থানীয় পুকুরে হয় প্রতিমা বিসর্জন । গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের পুজোয় এটাই সব থেকে বড় আকর্ষণ।

খাটুন্দির এই পুজোয় বাড়ির উঠোনে মাত্র ২০ মিটারের মধ্যে হয় ছ’টি দুর্গা প্রতিমা। পাকা মন্দির রয়েছে কিছু। বাকি গুলো টিনের চাল ও মাটির দেওয়াল। পরিবার বড় হওয়ায় পুজো ভাগ হয়ে গেলেও ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গাপুজোয় পারস্পরিক সম্প্রীতির কোনও অভাব নেই। প্রত্যেকে মিলেমিশেই আয়োজন করেন পারিবারিক দুর্গাপুজো। আর নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য হল, একটাই মণ্ডপে পাশাপাশি ছটি দুর্গাপুজো আয়োজিত হচ্ছে বছরের পর বছর। এখন যেখানে পাশাপাশি ছটি পুজো সম্পন্ন হচ্ছে, তার পাশেই রয়েছে কৃষ্ণরায়ের মন্দির। তাই এই সাতবাড়িকে কেষ্টরাই উঠোন বলা হয়।

এই ভট্টাচার্য পরিবারের সদস্যরা শুধু পশ্চিমবাংলাতেই নয়, ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন রাজ্যে । দুর্গা মূর্তিগুলি গড়েন বংশপরম্পরায় নেউল মিস্ত্রির পরিবার। বলিদানের কাজটিও একইভাবে করে আসছেন সহদেব কর্মকারের পরিবারের সদস্যরা। পুজো উপলক্ষ্যে গ্রামের বাসিন্দাদের খাওয়ানো, বস্ত্রদানের রীতিটাও বজায় রেখেছেন বর্তমান শরিকরা। খাটুন্দির ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গাপুজো তৎ সংলগ্ন বাকি পুজোর থেকে আলাদা। পুরোনো যে প্রথা আছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেই এই পুজো করা হয়। খাটুন্দির ভট্টাচার্য বাড়ির পুজোয় পরিবারের সঙ্গে মেতে ওঠে গোটা গ্রামও। পুজোর ক’দিন উৎসব মুখরিত হয়ে ওঠে ভট্টাচার্য পরিবার।

আমি যখনই গ্রামে গিয়েছি একবার হলেও কৃষ্ণরাইকে দর্শন করতে সাতবাড়িতে গিয়েছি। এখনো আমি সেখানে যেতে খুবই ভালোবাসি। দুর্গাপুজোর সময় অনেকবার গিয়েছি দাদুর বাড়ি। বিশেষ করে নবমীর দিন সাতবাড়ির দেবী প্রতিমা দর্শন না করলে আমার পুজো যেন সম্পূর্ণ হতো না। তাই আজও সেসব দিনের কথা স্মৃতিপটে অম্লান হয়ে আছে। বুক ভর্তি একরাশ আশা নিয়ে এগিয়ে চলেছি জীবনের পথে। আশা রাখি নিশ্চই সেদিন আসবে খুব তাড়াতাড়ি যেদিন এক ছুটে চলে যাব গ্রামের সেই সবুজে। আজ খুব মনে হয়, যদি দাদু থাকত আমার লেখা দেখে খুব খুশি হত। প্রবাসে বসে গ্রামেরবাড়ির পুজোর স্মৃতিচারণ করতে করতে আমি কখন পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই অতিতের স্মরণীয় দিন গুলোয় টেরই পাইনি।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleTrumped-up wars
Next articleকৈছে রখলুঁ লাজ তোহার
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments