মধু – মিতা সংবাদ (প্রথম পর্ব) – click here
পাঁচ
আবার বাস্তবে। মধুমন্তী বা মিতালীর সেই উনিশ কুড়ি বছর বয়সের স্মৃতি ছেড়ে এই প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই জীবনে। ট্রেন মাঝে মাঝে কর্কশ শব্দে হর্ন দিতে দিতে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে সামনের দিকে ছুটে চলেছে… অনেকটা মানুষের জীবন যেমন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যায়… সেই রকম। জানলার বাইরে শুধু অন্ধকার… মাঝে মাঝে রেলওয়ের পোস্ট থেকে আলোর তীর এসে কামড়ার মধ্যে ঢুকছে আবার মুহুর্তে ট্রেন সেই আলোর রেখাকে পিছনে ফেলে রেখে অন্ধকারে ঢুকে পরছে। ওরা দুজনে চুপচাপ পাশাপাশি বসে আছে… কিন্তু দুজনার মন আজ হঠাৎ যেন কোন ফেলে আসা অতীতে হারিয়ে গেছে… এ যেন বস্তবে থেকেও সময়ের নদীতে উজান বেয়ে চলা…।
আরো কত স্মৃতি। ওরা দুজনে এবার আস্তে করে দুজনার দিকে ফিরলো … দুজনার চোখে এক অদ্ভুত দুতি … ।
মিতালী। আচ্ছা মধু, তোর সেই সব দিনের কথা মনে পরে …?
মধুমন্তী। এখন বড়ই পরছে জানিস … কিন্তু বাড়ীতে এতো ব্যাস্ত থাকি যে এসব কথা ভাবার মতো সময় বার করতে পারি না… তোর সাথে আমাদের পুরনো কারোর যোগাযোগ আছে?
মিতালী। না …সেই যে বিয়ে হয়ে কোলকাতার বাইরে চলে গেলাম … ব্যাস …হয়ে গেল। শ্রীপর্না বলেছিল যে রেগুলার ফোন করবে… কিন্তু কোথায়… বোধহয় বার দুয়েক করেছিল সেই সময়। তারপর আর কি হোল … কোন ফোন পাই নি। আর তখন তো মোবাইলের যুগ ছিল না …। পাশের বাড়ী থেকে ফোন করতাম বা রিসিভ করতাম। ওকে ফোন করার ইচ্ছা থাকতো… কিন্তু লজ্জায় আর পাশের বাড়ীতে গিয়ে করা হয়ে ওঠে নি। তাছাড়া তখন প্রথম বিয়ে হয়েছে … একটু মানিয়ে চলার ব্যাপারও ছিল। তারপর যখন একটু গিন্নি হোলাম… ততদিনে পর্নার ফোন নম্বর কোথায় হারিয়ে গেছে। তোর কি অবস্থা …?
মধুমন্তী। ওই একই অবস্থা। তখন তো চিঠির যুগ… বাড়ীতেও চিঠিই লিখতাম। তোদের সবার অ্যাডড্রেস তো ছিল না। হঠাৎ বিয়ে ঠিক হোল… তাড়াতাড়িতে যাদের কাছে পেয়েছিলাম তা সঙ্গে ছিল … তোর ও তো প্রায় আমার একমাসের মধ্যেই ঠিক হোল। তুই তো আবার ওই সময় ম্যালেরিয়ায় ভুগছিলি… তোর সাথে কোলকাতা ছেড়ে যাবার আগে আর দেখাই হোল না। ঝুমুরকে কয়েকটা চিঠি দিয়েছিলাম … ও উত্তরও দিয়েছিল। ওর চিঠিতেই শুনেছিলাম যে পর্না আর অভিষেকের মধ্যে একটা সিরিয়াস প্রেম চলছে… ওরা বিয়ের জন্যও রেডি… কিন্তু পর্নার বাবার নাকি ভীষন আপত্তি। তারপর কি হোল জানি না… কারণ গোটা তিনেক চিঠির পর ঝুমুর উত্তর দেওয়া বন্ধ করে দিল, বোধহয় ওর ও বিয়ের কথা চলছিল কোন এক এন. আর. আই. ফ্যামিলির সাথে… ও বোধহয় বিয়ের পর আমেরিকা চলে গিয়েছিল। আর কারোর কথা জানি না…।
মিতালী। তোর ওই উল্কিটা দেখে মনে পরলো… আমাদের সেই পুরী ট্রিপটার কথা মনে আছে…? ওখানেই তো তুই ওটা করালি… তারপর তোর সে কি ভয়… বাবা রেগে যাবে…!
মধুমন্তী একটু হাসলো – বাবাঃ … মনে থাকবে না। আমরা বোধহয় পাঁচ কি ছয়জন মেয়ে আর প্রায় সাতজন ছেলে একসাথে… ট্রেনে সে কি হল্লা…। পাশের কামড়ার লোকজন তো রেগে অস্থির। তোর মনে আছে হোটেলে গিয়ে রাত্রে ওরা কি করেছিল…?
মিতালী। তা আর থাকবে না…। রাত্রে সমুদ্রের ধারে বসে ড্রিঙ্ক করার ফন্দিটা তো অজয়ের ছিল। তা এতো খেলো যে পুলক আর অত্রীকে তো পাঁজাকোলা করে হোটেলে নিয়ে আসতে হয়েছিল। তাও একটা গার্ড সমুদ্রের ধারে এসে না পরলে ওরা তো ওই অবস্থায় জলে চান করতে নাবতো… আমার যা ভয় করছিল…ওই অবস্থায় নাবলে নিশ্চয়ই পুলকটা ডুবে যেতো…।
মধুমন্তী। হু… আর একটা ব্যাপার কিন্তু বাদ দিয়ে গেলি…। বিমলের প্রেম নিবেদন…?
মিতালী। ওর কথা ছাড়… ওটা একটা পাগল ছিল… বলে তুমি বললেই কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো। বাবার কাছে যাবার সাহস নেই কারণ ডিগ্রি পেতে অনেক দেরী… চাকরিই বা কে দেবে…। বাবা তো এক কথায় হাঁকিয়ে দিত… তাই কথায় কথায় কালীঘাট… দক্ষিণেশ্বর… এই সব।
মধুমন্তী। সে তুই যাই বল… ও কিন্তু তোকে সত্যিই ভালবাসত …।
মিতালী। হতে পারে… কিন্তু ভেবে দ্যাখ তখন আমাদের সবে সেকেন্ড ইয়ার…অত তাড়াতাড়ি কোন ডিসিশান নেওয়া যায় না… সবে তো তখন কলেজে ঢুকেছি…। আর বাবা আগেকার দিনের রাশভারী লোক …তার ওপর স্কুল টিচার… পড়াশুনো শেষ না করে বিয়ের কথায় কান দিতেন না…।
মধুমন্তী। সে তো ঠিকই … বাদ দে ওসব কথা… কবে চুকে গেছে। আচ্ছা তোর সেই স্প্রিং ফেস্টটার কথা মনে আছে… সেটাও তো বোধহয় সেকেন্ড ইয়ারেই… সেকেন্ড সেমেস্টার। যেবার স্টুডেন্টস ইউনিয়ন থেকে আমাদের ভলান্টিয়ার করেছিল…?
মিতালী। ওঃ মাই গড …! দারুণ মনে আছে… কি এনজয়ই না করেছিলাম…। লেডিস হস্টেলে সারারাত জেগে নানা পোস্টার লেখা…। আর ঘন্টায় ঘন্টায় বাইরে এসে ওই ছেলেদের গ্রুপে বসে চা খাওয়া আর আড্ডা… । ওরা তো ইউনিয়ান রুমে রিতিমতো পার্টি করছিল… কিশোর কুমারের গান আর নাচ। অবশ্য কাজও ছিল অনেক … ওই পোস্টার গুলো টাঙানো সারা ইউনিভার্সিটি জুরে… কোথায় কি অনুশঠান হবে তার সুচি লিখে সেঁটে দেওয়া… তাও আবার সারা ক্যাম্পাস জুড়ে… আর্টস, সায়েন্স আর ইঞ্জিনীয়ারিং … সব প্রমিনেন্ট যায়গায় …। তারপরের দিন যখন গেলাম তখন বাবা ভয়ঙ্কর রেগে গিয়েছিল…।
মধুমন্তী। আমার বাবা তো দুদিন কথাই বলে নি… তবে মা সামলে দিয়েছিল।
মিতালী। আর যূথীর জন্মদিনের পার্টি…? মনে আছে…? বাপ সে কি নাচ… সৈকত আর প্রশান্ত তো টেবিলের ওপর উঠে নাচতে শুরু করলো… তাও সেদিন শনিবার… কোন ক্লাস নেই। আমরা ভেবেছিলাম কোন প্রফ ডিপার্টমেন্টে আসে নি…ও বাবা স্বয়ং হেড এসে হাজির… । মঞ্জুলীকাদি কিন্তু একদম রাগেন নি … সব দেখে একটু হেসে চলে গেলেন, শুধু বলেছিলেন – শব্দটা একটু কম করিস।
মধুমন্তী। ভীষন ভালো টীচার ছিলেন মঞ্জুলীকাদি, আর কি ভালো মানুষ। ওনারা নিশ্চয়ই কবেই মারা গেছেন।
মিতালী মধুমন্তীর দিকে তাকিয়ে একটু মাথা নারল, তারপর নিজের স্যুটকেসের বাইরের ফ্ল্যাপটা খুলে একটা ছোট্ট টিফিন বক্স বার করলো।
মিতালী। আয় মধু, সেই কলেজের মতো… আমরা খাবারটা ভাগ করে খাই।
এই বলে মিতালী বক্সটা খুললো… ভিতরে খুব সাধারন কিছু খাবার … গোটা তিনেক পরোটা আর আলু পেঁয়াজের তরকারি।
মধুমন্তী একটু হাসলো – তোর সেই পরোটা ভালোবাসা আর গেলো না … । তোর মনে আছে … সেই যে যাদবপুরের সায়েন্স ফ্যাকাল্টীতে ঢোকার গেটের ঠিক অপোসিটে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান ছিল, সেখানে আরো অনেক কিছুই পাওয়া যেতো …
মিতালী। হ্যাঁ হ্যাঁ … জানি … কেস্টদার দোকান… আমরা মজা করে কেস্টদার কেবিন বলতাম… ওখানে সেই পরোটা আর একটু ঝোল ঝোল আলুর তরকারি… ওঃ … এখন মুখে লেগে আছে।
মধুমন্তী। সেই … কতবার যে খেয়েছি … বসার তো জায়গা ছিল না, ছোট্ট দোকান কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়েই মেরে দিতাম। বিকাল পাঁচটার পর গরম পরোটা ভাজতো … ওখানে দাঁড়াবার যায়গা থাকতো না।
মিতালী এক টুকরো পরোটা ছিঁড়ে তরকারির সাথে মুখে দিল, তারপর বেশ তারিয়ে তারিয়ে চিবতে চিবতে মুখের ফাঁক দিয়ে বললো – তবে এই পরোটা কিন্তু একদম ঠান্ডা … আয় আর দেরি করিস না। হাত লাগা… ভালোই লাগবে… আজ দুপুরে নিজেই বসে বসে রান্না করেছি।
মধুমন্তীর একটু অসুবিধে হচ্ছিল, ট্রেনে হাত ধোবার অসুবিধা থেকে বলে সে খুব কিছু খায় না, খেলেও শুকনো কিছু সঙ্গে রাখে। এখন আবার ওয়াশ রুমে যেতে তার ভালো লাগছিল না, সে বোতলের জলে হাতটা একটু ভিজিয়ে নিল।
মধুমন্তী। মিতু, আমার কিন্তু একটুও খিদে নেই, বাড়ী থেকে প্রচুর কিছু খেয়ে এসেছি, তাই সামান্যই খাব… শুধু তোর অনারে, তোর হাতের রান্না বলে।
মধুমন্তী খানিকটা পরোটা ছিঁড়ে তরকারির সাথে মুখে দিল। বেশ ভালো স্বাদ… পরোটাটা ময়েন দেওয়া, বেশ ঝুরঝুরে, খানিকটা নিমকির মত… তরকারিটায় টক, ঝাল আর মিস্টির সুন্দর ব্যালান্স, তার ওপর ধনে পাতার গন্ধটা দারুণ ম্যাচ করছে।
মিতু গোগ্রাসে কিছুক্ষণ খেল, তারপর মধুর দিকে তাকিয়ে বললো – কিরে …আর নিলি না যে? ভালো লাগলো না?
মধু চুপচাপ জানলার বাইরে গাঢ় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। তার বার বার মনে পড়ছিল যাদবপুরে ও আর মিতু কতবার এই পরোটা বা ভেজিটেবিল চপ এক প্লেট থেকে ভাগ করে খেয়েছে। মিতুর কথায় সে ঘার ফেরাল, তারপর আর এক টুকরো পরোটা আর তরকারি নিয়ে মুখে পুরলো… সত্যিই দারুণ রেঁধেছে মেয়েটা… ওর নিজের হাতের রান্না অতটা ভালো নয়। পরোটাটা আরামে পেটোস্থ করে মধু মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো – আর নয় মিতু, আমার পেটে আর জায়গা নেই, তুই বাকিটা শেষ কর। আমি হাতটা ধুয়ে আসি।
মধুমন্তী ওয়াস রুমের দিকে চলে গেল। মিনিট দশেক পড়ে মিতালীরও খাওয়া শেষ… সে বাথরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে এসে আবার সিটে বসলো। আবার দুই বন্ধু মুখোমুখি দুই চেয়ারে…।
মিতালী। এসব তো অনেক হোল… আচ্ছা এবার তোর কথা কিছু বল। আমি তো তোর খবর কিছুই জানি না। কোথায় আছিস… কেমন বর … কেমন সংসার…!
মধুমন্তী খানিক্ষন চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। যাদবপুরের জীবন শেষ হবার পর তার জীবন অনেকটা বয়ে গেছে। স্বচ্ছল ফ্যামিলির জয়ন্তর সাথে বিয়ে হবার পর তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরু… তারপর নানা চড়াই উৎরাই পার হতে হয়েছে। এখানে, এই ট্রেনের কামড়ায় সমস্ত কিছু উজাড় করে বলা হয়তো সম্ভব নয়।
মধুমন্তী। আর কি, সবার যেমন যায়… বিয়ে হোল, তুই তো এলি না, মানে তোর তো আসার মত শরীরের অবস্থা ছিল না। তারপর পরীক্ষা … যদিও তোর সাথে ঐ সময় কয়েকবার দ্যাখা হয়েছিল কিন্তু তখন তো আমরা সবাই এম. এ. ফাইনালের জন্য দারুণ ব্যাস্ত…। পরীক্ষা যেই শেষ হোল … ব্যাস… ওর সাথে সোজা দিল্লী, মানে ওর কর্মক্ষেত্রে। ওদের ফ্যামিলির ফার্ম, সারা ভারতে নানা ফার্মে অডিট করে বেড়ায়, ওটাই ওদের বিসনেস। সেই রকম এখনো চলছে, এখন অবশ্য আমরা কয়েক বছর বোম্বেতেই আছি।
মিতালী। আর অন্য সব … বাচ্চা কটা?
মধুমন্তী। একটা ছেলে, একটা মেয়ে… মেয়েই বড়।
মিতালী একটু মুচকি হাসলো, তারপর বললো — বাঃ … বেশ গুছিয়ে নিয়েছিস তাহলে। খুব ভাল। আমি কিন্তু পরে তোর বিয়ের সব খবর শুনেছিলাম … ঝুমুর, শ্রীপর্না ওদের কাছ থেকে। দারুণ হিংসে হয়েছিল জানিস … হ্যান্ডসাম বর, স্বচ্ছল শ্বশুরবাড়ি … একটা মেয়ে আর কি চায়।
মধুমন্তী একটু হাসলো, মিতু ব্যাপার গুলো একটু বেশী সরল করে নিচ্ছে। এটা ঠিকই যে তার বিবাহিত জীবনের শুরুটা হয়েছিল বেশ ভালোভাবে … ঐ যে বাংলায় যাকে বলে সোনায় সোহাগা, মুখে কানে মধু দেওয়ার পর যেন সব কিছুই মিস্টি। কিন্তু আজ জীবনের এই জায়গায় এসে সে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না যে তার জীবনের সব কিছুই হিংসে করার মতো। একটু থেমে সে বললো –
মধুমন্তী। আচ্ছা আমারটা তো শুনলি, এবার তোর কথা কিছু বল, তোরও তো আমার বিয়ের একমাসের মধ্যেই বিয়ে হোল … যদিও আমি নতুন বিয়ে হওয়ায় যেতে পারিনি…।
মিতালী এবার একটু বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। একদিকে মধু, যার জীবন ফুলে ফলে ভরান… স্বামী, সন্তান, হাই সোসাইটিতে ঘোরাফেরা … তাছাড়া গাড়ী বাড়ী তো বহুদিন থেকেই আছে। তার নিজের ফ্যামিলি যদিও মোটের ওপর স্বচ্ছল … বাবা নিজে খোঁজ খবর নিয়েই বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটাও ঠিকঠাক গেলো না … জীবনটা শুরু তাও মন্দ হয়নি… কিন্তু মাঝ বয়সে আসার আগেই কেমন ওলট পালট হয়ে গেছে।
মিতালী। আমার ব্যাপারটাও প্রায় তোরই মতো। বাবা সব ঠিক ঠাক করলো, দুম করে বিয়েটা হয়ে গেলো, আমার তো নিজের কোন মতামত ছিল না। আমাদের ফ্যামিলি একটু সেকেলে, মেয়েদের মতামত খুব একটা নেওয়া হয় না।
মধুমন্তী। ওই পরীক্ষার ব্যাস্ততায় তোকে তো কিছু জিজ্ঞাসা করা হয় নি, কিন্তু রিক্তা, শম্পা … এদের তো জানিস, মোটামুটি গেজেট। ওদের কাছ থেকেই শুনেছিলাম যে তোর বরও বেশ বড় ইঞ্জিনীয়ার, বেশ বড় ফার্মে চাকরী করে … কিছু তো বল।
মিতালী। বড় ফার্ম আর কি… সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং ডিসিপ্লিনে গ্র্যাজুয়েট করে কোলকাতায় মোটামুটি একটা চাকরী করছিল। কয়েক বছর এক্সপেরিয়েন্স হয়ে গেলে কোলকাতার বাইরে চলে যায়। ততদিনে অবশ্য আমার সাথে বিয়ে হয়েছে, তাই আমিও ওর সাথে চলে গেলাম।
মধুমন্তী। তারপর … আর কি? ইস্যু কটা ?
মিতালী। একটাই … মেয়ে… শর্বরী। এই তো হায়ার সেকেন্ডারী পাস করে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে।
এই সব কথা বলতে বলতে ওরা খেয়াল করে নি যে ট্রেনের গতি কমে আসছিলো… গাড়ী ক্রমশ আরো স্লো হয়ে এলো। খড়গপুর জাংশান। গাড়ী খড়গপুরের বিশাল লম্বা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে আস্তে আস্তে স্থির হয়ে দাঁড়াল। রাত বেশ হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্ল্যাটফর্মে বেশ কিছু যাত্রী রয়েছে, গাড়ী ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো…প্রত্যেক কামড়ার এনট্র্যান্সের সামনে ছোটখাট একটা করে লাইন তৈরী হোল… একই সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে নানা ভেন্ডার নানা রকম জিনিস বিক্রির জন্য কামড়ার মধ্যে ঢুকে এলো। সেই সঙ্গে সেই মধুর ডাক – চায় গরম।
মিতালী আর মধুমন্তী এর জন্যই বসেছিল, ওরা কামড়ার দরজা খুলে করিডোরে উঁকি মারলো। মিতালীই প্রথমে ডাক দিল – এই চা, এদিকে এসো … এই যে এদিকে …।
দুজনে দু কাপ চা নিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে বসলো। এই সব স্টেশানের চায়ের একটা বেশ আমেজ আছে যেটা বাড়ীর চায়ে পাওয়া যায় না … বেশ গাঢ় এবং একটু কষা, বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাওয়ার মতো।
এর মধ্যে আবার গাড়ী ছেড়ে দিয়েছে … আস্তে আস্তে খড়গপুর স্টেশান পিছনে পরে রইল … ট্রেন আবার তার গতি বারিয়ে অন্ধকারের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পরলো।
তারপর আর বেশী কথা হোল না, দুজনাই একটু ক্লান্ত বোধ করছিল, তাছাড়া আবার কালকে সকালে উঠতে হবে। চা খাওয়া হয়ে গেলে ওরা আরো কিছুক্ষণ সেই যাদবপুরের স্মৃতি চারণ করে একবার করে টয়লেটে গেলো … তারপর কালকে আরো কথা বলার প্রতিজ্ঞা করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পরলো।
ছয়
শুয়ে পড়ে মধুমন্তীর তখনই ঘুম এলো না। একে তো তার ঘুমের একটা প্রবলেম আছেই, তার ওপর আবার কোন অষুধ খাওয়া হয়নি। ট্রেনে সে এমনিই অষুধ খায় না যদি সকালে উঠতে কোন অসুবিধা হয়। আজ আবার মনের মধ্যেও হাজার জোনাকির ওড়াওড়ি। আজ এতোদিন পড়ে সেই কলেজ জীবনের এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর দেখা … তার কতো খুশী হওয়ার কথা … কিন্তু বাস্তবে কেমন যেন সব পানসে লাগছে, কেমন যেন একটা হেরো হেরো ভাব। মিতালী বোধহয় তার দামি শাড়ী, মোটা সোনার চেন দেখে তাকে দারুণ হ্যাপী ভেবেছে। তার ফ্যামিলিতে বড় গাড়ী, টাকার কোন অভাব নেই কিন্তু সেটা বড় চাদর, তার তলায় ঢাকা অনেক ময়লা।
প্রথম যখন তার বিয়ে হোল তখন বড়ই ভালো লেগেছিল … বড় লোক শ্বশুরবাড়ী… গাড়ী, বাড়ী … সারা ভারতের নানা জায়গায় ফ্যামিলি বিসনেস ছড়ানো। প্রথম প্রথম স্বপ্নের মত দিন কাটছিল। বিয়ের পরে অবশ্য মাত্র দিন দশেক শ্বশুরবাড়ীতে ছিল, তারপর আবার কলেজে যাতায়াত কারণ পরীক্ষা সামনে… এম. এ. ফাইনাল। সে যাই হোক, মাস চারেকের মধ্যে সব মিটে গেল আর তারপর সে তার স্বামী জয়ন্তর সাথে দিল্লী … তখন সেটাই তার কর্মস্থল। বিয়ের প্রথম কয়েকটা বছর কিন্তু কেটেছিল চমৎকার … হাসিখুশি স্বাস্থবান স্বামী … অঢেল ফ্যামিলি ইনকাম … দিল্লীর বাঙালী সারকেলে এই ফ্যামিলির বেশ সুনাম। উইক এন্ড হলেই গাড়ীতে কোথাও ঘুরতে যাওয়া … মাসে একটা দুটো গেট টুগেদার বা পার্টি তো লেগেই থাকতো … এছাড়া কারো জন্মদিন বা কারো ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি … এসব ইনভাইটেশান প্রায়ই আসতো। কিন্তু সম্ভারের সাথে সাথে এলো আরো অনেক কিছু। সেই হ্যান্ডসাম স্বাস্থবান জয়ন্ত একটু একটু করে পালটে যেতে লাগলো। আগে যেমন অফিসের কাজ হয়ে গেলেই গাড়ী চালিয়ে সোজা বাড়ী আসতো … তা আস্তে আস্তে তা পালটে গেলো। অফিসের পর কোথাও আড্ডা মেরে জয়ন্ত ফিরতো। মাঝে মাঝে সেটা রাত দশটা পেরিয়ে যেতে লাগলো। তখন মধুমন্তীর ছোট্ট দুটো বাচ্চাও হয়ে গেছে … বড় মেয়ে পার্বতী আর তার থেকে বছর দেরেকের ছোট ছেলে বিশ্বজিৎ। যতদিন যেতে লাগলো ততই কিন্তু জয়ন্ত বেপরোয়া হয়ে যেতে লাগলো … প্রথমে শুধু বন্ধুদের সাথে আড্ডা, তারপর তাস আর মদ। ফিরতে ফিরতে মাঝরাত পেরিয়ে যেতে লাগলো … বাবা মা সবাই কোলকাতায়, কাজেই লাগাম দেওয়ার কেউ নেই। মধুমন্তীর শাসন, বকুনি, চোখের জল কিছুই কোন কাজে এলো না। অ্যাকাইন্টস আর অডিটিং এর ব্যবসা যতই ফেঁপে উঠছিলো ততই জয়ন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগলো। বাচ্চাদের খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পারিয়ে ক্লান্ত দুটি চোখে রাত জাগা আর অন্ধকারে চোখের জল ফেলা, এটাই তখন মধুমন্তীর রোজকার কাজ… আর মাঝ রাত্রে নেশায় সম্পূর্ন মাতাল হয়ে তার ভেরী সাকসেসফুল স্বামীর টলতে টলতে অ্যাপার্টমেন্টের সিড়ি দিয়ে অপরে ওঠায় সাহায্য করা যাতে বেশী শব্দে পড়শীদের ঘুম না ভাঙে। এটাও না হয় মানা যেতো … কিন্তু জয়ন্তর নিচে নামার আরো বাঁকি ছিল …। সেটাও ঘটলো … তার নামে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার কথা দিল্লীর বাঙালী মহলে ছড়িয়ে পড়লো। তাও আবার নিজের অফিসের সেক্রেটারির সাথে …অবাঙালী মিস্টি একটা মেয়ে, নাম প্রিয়াঙ্কা। মিস্টি কিন্তু বোধহয় একটু বেশী মিস্টি, বড় বেশী উজ্জ্বল আর ডেয়ারিং। মাঝে মাঝে অফিসের কাজে দিল্লীর বাইরে তো যেতেই হোত … কাজের এক্সকিউস দিয়ে সেক্রেটারিও যেত … সেখানেই সম্পর্কটা খুব কাছের হয়ে দাঁড়িয়েছিল … শারীরিক হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের ফ্যামিলির ফার্ম কাজেই কারুর কোন বাধা দেওয়ার ব্যাপার ছিল না। মধুমিতা প্রথম প্রথম খুব একটা পাত্তা দেয় নি … ওরকম তো কতই শোনা যায়, তার ওপর হাই ফ্লাইং কনসাল্ট্যান্ট … লোকের জেলাসি তো থাকবেই। কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হোল না … যখন একটা ট্যুরে গিয়ে তিন দিনের কাজের শেষে ওরা দুজন সিমপ্লি ভ্যানিস করে গেলো একটা উইক এন্ডে। সোমবার জয়ন্ত ফিরেও এলো … মুখে সেই এক কথা – আরে কাজের ব্যাপারে কি আর অত দিন মেপে চলা যায়, এক দু দিন এক্সট্রা লাগতেই পারে। কিন্তু ততদিনে মধুমন্তীও অনেক সেয়ানা হয়ে গেছে, দুই বাচ্চার মা, তার ওপর বয়স প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই। জয়ন্তর গালের, গলার আর ঠোঁটের ছোট কাটা দাগ, জামা কাপড়ে লেগে থাকা মেয়েদের লম্বা চুল… সব কিছুই এক দিকেই ইঙ্গিত করছে। মধুমন্তী সেই দিনই কোলকাতায় তার শ্বশুর শাশুড়ির সাথে যোগাযোগ করলো … ওনারা অবশ্য কিছুই জানতেন না। পনের দিনের মধ্যে ওনারা কোলকাতা থেকে দিল্লী এলেন… অফিসের অন্যান্য এক্সিকিউটিভদের সাথে ডিসকাস করে ওনারা জয়ন্তকে ইমিডিয়েটলি মুম্বাইতে পাঠিয়ে দিলেন, ওখানেও একটা অপেক্ষাকৃ্ত ছোট অফিস ছিল। সেটা মধুমন্তীর জীবনে একটা বিশাল দিগদর্শন … সমস্ত জীবনটা ওলট পালট করে দেবার মতো। সেই থেকে মধুমন্তী এবং জয়ন্ত সঠিক অর্থে আর স্বামী স্ত্রী রইল না, কিন্তু তারা এক ছাদের তলায় বাস করতে লাগলো… সংসারটা ভাঙল না শুধুমাত্র বাচ্চা দুটোর জন্য, তাদের বয়স তখন প্রায় চোদ্দ আর বারো বছর। অবশ্য এতো ঘটনার পরেও জয়ন্ত খুব একটা পালটাল না, অফিসের পড়ে তার তাস আর ড্রিঙ্কসের আসর চলতেই থাকল, মুম্বাই তো নাইট লাইফের জন্য বিখ্যাত যদি পকেটে টাকা থাকে আর ঐ একটা জিনিস জয়ন্তর পকেটে প্রভূত পরিমানেই ছিল।
আজকে মিতালীকে দেখে মধুমন্তীর বড় ভাল লাগলো … কি সুন্দর মাথায় বড় করে সিঁদুর দিয়েছে, মুখের মধ্যে এখনও কেমন একটা খুশীর জ্যোতি … সেই কথায় কথায় এক মুখ হাঁসি … সাদা দাঁত গুলো এত সুন্দর যেন বাঁধানো … নিশ্চয় স্বামী সংসার নিয়ে দারুণ সুখী মিতালী। এতদিন পরে প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা হওয়া সত্ত্বেও মধুমন্তীর মনে কিসের যেন একটা শুন্যতা … কোথাও একটা হেরে যাবার বেদনা … আজ সত্যি সত্যিই তার ঘুম এলো না।
সাত
ঘর অন্ধকার … ট্রেন সমানে কোন অন্ধকারের হাতছানিতে এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলেছে … এই রকম সময় মিতালীর দারুণ একটা আমেজ আসে… তাকে ঘুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না … ঘুম নিজেই এসে তার চোখে ঝাঁপিয়ে পরে। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম। মিতালী চোখ বুজে অনেকক্ষণ ধরে ঘুমের আরাধনা করে গেলো কিন্তু আজ আর ঘুমের দেখা নেই। মাথাটা যেন একটু দপ দপ করছে, প্রেসারটা বেড়ে গেল কিনা কে যানে …।
আজ এতোদিন পড়ে মধুমন্তীকে দেখে এতো ভালো লাগল… সে আর মধু যাদবপুরে ভীষণ ক্লোস ফ্রেন্ড ছিল। মধুর বিয়ের সময় সে অসুস্থ ছিল তাই যেতে পারে নি, কিন্তু বিয়ের পর যখন মধু ফিরলো তখন জোর একটা আড্ডা মারার ইচ্ছে ছিল কিন্তু এম.এ. ফাইনাল ঘাড়ের ওপর এসে যাওয়ায় সেরকম কোন সুযোগ পাওয়া যায় নি। তা সে পরীক্ষাও শেষ হোল … । কিন্তু ও হরি, পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই মধু হাওয়া … প্রথমে কয়েকদিন শ্বশুরবাড়ী তারপর সোজা দিল্লী … একবার জানিয়েও গেল না, ঠিকানা তো নয়ই। এই শেষের দু সপ্তাহের কথা তো সে ওই শ্রীপর্না, ঝুমুর এদের কাছ থেকে শোনা অথচ মধু তার কত কাছের বন্ধু। ভীষণ অভিমান হয়েছিল… আর রাগ…। ভেবেছিল আর সারাজীবন ওর সাথে কোন রকম যোগাযোগ রাখবে না… মধুর শ্বশুরবাড়ীর আর দিল্লীর ঠিকানা সে শ্রীপর্নার কাছ থেকে জোগার করেছিল কিন্তু কোন চিঠি লেখেনি। আজ অবশ্য এই ঠিকানার কথা সে মধুকে বলেনি, সে সব অনেক দিনের কথা… এখন এইসব রাগ অভিমানের কথা এখন এই বয়সে আর তুলতে ইচ্ছে করে না।
আর তার জীবনও তো অনেক ওঠা পরার মধ্যে দিয়ে গেছে।
বাবা বিয়ে ঠিক করেছিলেন … অনেক দেখে শুনে … ছেলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনীয়ার। মোটামুটি ভালো অবস্থা, কোলকাতায় একটা ছোট বাড়ী, একটা চাকরী। এই রকম পাত্র মিতালীদের বাড়ীর যা অবস্থা তাতে ভালোই বলতে হবে কারণ মিতালীর বাবা একজন স্কুল টীচার, তাঁর পক্ষে এর থেকে বেশী সম্ভ্রান্ত কোন ফ্যামিলির সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করা সম্ভব ছিল না। মিতালী কোন আপত্তি করে নি, সেটা তার স্বভাবও না। বিয়ের প্রথম বছরগুলো বেশ ভালোই কাটছিল … প্রবীর কোলকাতার বিড়লা টেকনিক্যাল সার্ভিসেস – এ জয়েন করেছিল। মল্লিক বাজারের মোরে অফিস, প্রথম কয়েক মাস সেখানেই ছিল, তারপর তাকে দূর্গাপুরে সাইটে পাঠিয়ে দিল। এই সময় তার সবে বিয়ে হয়েছে। মিতালী প্রথম প্রথম তার কোলকাতার শ্বশুরবাড়ীতেই রয়ে গেল, প্রতি শুক্রবার প্রবীর বাড়ী আসতো আবার সোমবার সকাল পাঁচটায় সোজা হাওড়া হয়ে দূর্গাপুর। এই ভাবে মাস পাঁচেক যাওয়ার পর প্রবীর দূর্গাপুরেই একটা ছোট্ট বাড়ী ঠিক করলো আর মিতালী খুশির ভেলায় ভাসতে ভাসতে প্রবীরের সাথে থাকতে ওখানে সিফট করে গেলো। শুরুটা ভালোই হোল … ওখানে প্রবীরের নানা কলীগের সাথে আলাপ … তাদের ফ্যামিলির সাথে জানাশোনা … প্রায় প্রতি উইক এন্ডেই কোথাও না কোথাও পার্টি, খাওয়া দাওয়া … ওয়েদার ভালো থাকলে কারো বাগানে বা পার্কে গ্রিল এন্ড স্টেক পার্টি। দিন গুলো যেন স্বপ্নের মতো … যাদবপুরের কলেজ লাইফ থেকে আলাদা কিন্তু তাও দারুণ। মিতালী নিজেকে সত্যিই বড় সুখী ভাবতে শুরু করেছিল। কিন্তু এত শুখ কি আর সয় … । প্রবীর সাইট ইঞ্জিনীয়ার ছিল … সেটাই তার অফিসিয়াল ডেসিগনেশান … কিন্তু কেমন করে যেন তার ইনকাম বারতে লাগলো। মাইনে তো আছেই সেই সঙ্গে মাসের নানা সময়ে টাকার বাণ্ডিল বাড়ীতে আসতে শুরু করলো। সেই সঙ্গে জীবনে এলো লাক্সারি আর অন্যান্য অনুসংগ। প্রবীর টাকার বাণ্ডিল এনে যে সব সময় ব্যাঙ্কে রাখতো তাও তো নয় … আলমারির ভিতরে ঠেসে বা কোন স্যুটকেসের মধ্যে রেখে দিত। মিতালী অতশত বোঝেনি প্রথম দিকে, তার প্রশ্নের উত্তরে প্রবীর বলেছিল যে সে কিছু প্রাইভেট কনসালটেন্সি করে, এটা তারই টাকা। মিতালী তাতেই খুশি ছিল … ছ মাসের মধ্যে তারা বড় বাড়ীতে উঠে গেল … বাড়ীতে এলো দামি টেলিভিশান, ভি. সি. আর., ওয়াসিং মেশিন ইত্যাদি… দামি সেন্ট, সোনার গয়না, বছরে তিন চারটে দামি শাড়ি এগুলোও বাড়ীতে ঢুকে পড়লো। সুখী গৃহিনী হিসাবে মিতালী প্রায়ই বাড়ীতে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতো … বেশীর ভাগ সময়ই প্রবীরের কলীগদের, সেই সঙ্গে পাড়া প্রতিবেশী। এই ভাবে বেশ কিছুদিন গড়িয়ে গেলো … এলো তাদের প্রথম সন্তান … শর্বরী। ঘটা করে অন্নপ্রাশন হোল … বাচ্চা সুস্থ্য ভাবে বেড়ে উঠছিল কিন্তু হঠাৎ ঝড় এলো … তাতে মিতালীর শুখে আর গর্বে সাজান সংসার ভেসে গেল।
সেদিন সকালে প্রবীর যেমন অফিসে যায় বেরিয়ে গেল … মিতালী দুপুরে শর্বরীকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে খাটে শুয়েছিল। এই সময় ফোনটা এলো, প্রবীর জানাল যে তার অফিসে আজ একটু কাজ বেশী আছে তাই ফিরতে একটু দেরি হবে। এরকম প্রায়ই হয়, সাইটে অনেক সময়ই কাজ সন্ধ্যের পরও চলে কাজেই মিতালী খুব বেশী চিন্তিত হয়নি। প্রায় সাড়ে পাঁচটার সময় প্রবীরের এক কলীগ এসে খবরটা জানাল … সাইটে ধুন্ধুমার কান্ড, একটা ট্রেসেল পুরো ভেঙে পড়েছে সেই সঙ্গে কনভেয়ার বেল্টের একটা বিরাট সেকশান … দুজন ওয়ার্কার স্পট ডেড, আরো পাঁচ জন জখম তার মধ্যে তিনজন মারাত্মক ভাবে। পুলিশ এসেছে দুপুরের দিকেই … প্রবীর ছাড়াও আরো পাঁচজন সাইট ইঞ্জিনীয়ারের অ্যাকটিভিটির ওপর ইনটারোগেশান চলছে, প্রবীর আজ রাতে নাও ফিরতে পারে। ছেলেটা চলে গেল, মিতালী একা ঘরের মধ্যে থম মেরে বসে রইল, বাচ্চা শর্বরী কিছুই না বুঝে তার রঙিন বলটা নিয়ে সারা ঘর দাপিয়ে খেলে যেতে লাগলো।
তার পরের দিন সকালেও প্রবীর এলো না … দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে যাচ্ছিল। প্রায় চারটের সময় প্রবীর ঢুকলো, সেই সঙ্গে আরো অনেকে। পুলিশের লোক অনেকেই ছিল, কেউ প্রপার পুলিশের বেশে কেউবা প্লেন ড্রেসে। সারা বাড়ী সার্চ হোল … । সারা বাড়ী মানে বাথরুম, কিচেন, সমস্ত ড্রয়ার, আলমারি , বুক সেলফ, বাক্স, ট্রাঙ্ক, বিছানার তোষকের তলা ইত্যাদি তন্ন তন্ন করে খোঁজা। পাওয়াও গেলো … প্রবীরের আনা সেই সব টাকার বান্ডীল অনেক কটাই পুলিশের হাতে পরলো। পুলিশ আবার প্রবীরকে নিয়ে চলে গেলো। যাবার আগে প্রবীর কি অসহায় ভাবে একবার মিতালীর দিকে তাকাল … চোখ দুটো কেমন ছল ছল করছে অপমানে … বাচ্চাটার দিকে একবার তাকিয়ে সে চলে গেলো… তখন প্রায় সন্ধ্যা সাতটা … অন্ধকারে পুলিশের গাড়ীর লাল আলোটা দূরে মিলিয়ে গেলো। মিতালী আগের দিনের মত আবার বাচ্চাটাকে নিয়ে একা বাড়ীতে বসে রইল।
তারপর কয়েকদিন যেন মিতালীর ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলো। প্রবীর পুলিশের কাস্টডিতেই রইল, সেই সঙ্গে তার আরো তিন চার জন কলীগ। তবে অফিসের অন্যন্য কলীগেরা মিতালীর খোঁজ খবর রাখছিল, তাদের কাছ থেকেই মিতালী জানতে পারলো সব … ওই কন্সাল্ট্যান্সির ব্যাপারটা সব বাজে কথা, প্রবীর ঘুষ খেতো, তবে সে একা নয়, তার একটা দল ছিল। তারা কন্ট্র্যাকটারদের কাছ থেকে বাজে কোয়ালিটির মাল পাস করে দিত এবং তার জন্য মোটা টাকা পেতো, সেই সব টাকা চার জন কলীগের মধ্যে ভাগ হোত আর মিতালী ওই সব টাকাই প্রবীরকে বাড়ীতে আনতে দেখেছে। বিড়লা টেকনিক্যাল সার্ভিসেস ব্যাপারটা খুব সিরিয়াসলি নিল… পুলিশ তাদের ইনভেস্টিগেশান খুব প্রম্পটলি এগিয়ে নিয়ে গেল … স্টীল সাপ্লায়ারদের লগ আর মেটেরিয়াল মিলিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ব্যাপার গুলো পরিস্কার হয়ে গেল কারা ব্যাপারটার মধ্যে জড়িত ছিল। কত টাকা কার কার কাছে গিয়েছে এবং কোন সাপ্লায়ার কোম্পানির কোন কোন অফিসার এর মধ্যে জড়িত তাও জানা গেলো। মূল ঘটনার মাস খানেক পরে মামলা কোলকাতায় চলে গেলো… মিতালীও তার বাচ্চা এবং কিছু জিনিস পত্র নিয়ে বাড়ী ছেড়ে দিয়ে কোলকাতায় শ্বশুরবাড়ী চলে গেলো। মামলা প্রায় একবছর চলল … যারা অপরাধী তাদের অবশ্য কোন ডিফেন্স নেই কারণ সবারই বাড়ী থেকে আন-একাউন্টেড টাকা পাওয়া গেছে, অপরাধ স্বীকারও করেছে ওরা সবাই। এই অবস্থায় একটা পারডন পাওয়া গেলো … বিড়লা কোম্পানি জেল টার্ম ডিম্যান্ড করলো না কিন্তু যারা এই চক্রে জড়িত তাদের চাকরী গেলো। প্রবীর আবার বেকার এবং এবার গায়ে একগাদা ময়লা নিয়ে। প্রবীর প্রায় দুবছর কোন চাকরী পায় নি… তারপর পাড়ার একজন রিটায়ার্ড অফিসারের ইঞ্জিনীয়ার ছেলের দয়ায় একটা ওভারসিয়ারের চাকরী পেলো … তাও এই ধ্যারধ্যারে সাইটে … নাগপুর থেকে আরো দেড়শ কিলোমিটার ইন্টিরিয়ারে … দুবার বাস পালটে যেতে হয়। স্কুল কলেজের প্রচন্ড অসুবিধা … কোনক্রমে হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করার পরই শর্বরীকে কোলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে কলেজে পড়ার জন্য। এখানে সে একটা ছোট্ট কোয়ার্টারে প্রবীরের সাথে থাকে … একবার ধাক্কা খেয়ে প্রবীর কিছুদিন সোজা পথে ছিল … এখানে আসার প্রায় বছর দুই অবধি সব ঠিকঠাক। কিন্তু তারপর আবার কিছু ধরিবাজ অবাঙালি লো লেভেল কলীগের সাথে মেশা শুরু করলো… সন্ধ্যাবেলা গুলো ওদের সাথেই কাটায়, কি করে কে জানে … শোনা যায় একটা সোসাল ক্লাবের মত আছে, সেখানে তাস টাস খেলা হয়, মাঝে মাঝে মদটদও চলে। বাড়ীতে আর টাকা আনে নি এটাই মিতালীর কাছে একটা শান্তি, অন্য যা কিছু করে মিতালী বিশেষ জিজ্ঞাসা করে না… ওরা শুধু এখন এক বাড়ীতে থাকে, এই পর্যন্ত।
এই হচ্ছে মিতালীর এখন পর্যন্ত জীবন চড়িত… কিন্তু একথা কি আর মধুমন্তীকে বলা যায়। মেয়েটা কি হ্যাপী… পাশের বাঙ্কে কেমন শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে, এতদিন পড়ে হঠাৎ দেখা, ওকে এসব একদম বলা যাবে না। আর তাছাড়া … এতদিন পরে যাদবপুরের সেই ক্লোস ফ্রেন্ডশিপও যেন কোথায় ফিকে হয়ে গেছে … সময় সব কেড়ে নিয়েছে। এপাস ওপাস করতে করতে মিতালী কখন যেন ঘুমিয়ে পরলো। পাশের বাঙ্কে চোখ বুজে জেগে থাকা মধুমন্তীর একটা দীর্ঘ্যশ্বাস পরলো।
আট
সকাল এলো। মধুমন্তী একটু চোখ পিটপিট করে একবার চোখ খুললো … ঠিকই তো … সকাল হয়ে গেছে … ট্রেনের একঘেয়ে দোলানি অবশ্য রয়েইছে। ওপাশের বাঙ্কে অবশ্য মিতালী এখন পা গুটিয়ে দলা পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আর চোখে একবার ঘড়ি দেখল… প্রায় আটটা কুরি … তার মানে ভাটপারা জাস্ট পেরিয়েছে… তাই ট্রেনটা বোধহয় একটু আস্তেও চলছে। একবার আড়মোড়া ভেঙে মধুমন্তী উঠে পরলো… নাঃ, একবার বাথরুমে যেতেই হবে। রাতে তাকে মাঝে মাঝে উঠতেই হয় কিন্তু কাল রাতে যাওয়া হয়নি।
বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে বেশ করে মুখে চোখে জল দিয়ে ফিরে এসে মধু দেখলো যে মিতালীও উঠে বসে আছে … চোখে এখনো একটু ঘুম ঘুম ভাব, চোখ মুখ ঘুমের জন্য একটু ফোলা। মধুকে দেখে একটু হাসলো, —
মিতালী। কি… বাথরুম কি ফাঁকা?
মধুমন্তী। ও … তুই আগেই উঠে পড়েছিস … মটকা মেরে পড়ে ছিলি। যা, বাথরুম এখনও ফাঁকা …।
মিতালী আবার তার ট্রেডমার্ক হাসিটা দিয়ে বাইরে চলে গেলো।
মধুমন্তী ভালোভাবে বসতে না বসতেই মিতালী ফিরে এলো, মুখে চোখে জলের ছাপ, কপালের ঠিক ওপরের চুলটাও একটু ভিজে রয়েছে। ফিরে এসেই ধপাস করে সিটে বসে বলল –
মিতালী। এইবার জমিয়ে একটু চা দরকার।
মধুমন্তী। তোর সেই চা চা বাতিক আর গেলো না, সেই যাদবপুর থেকে দেখে আসছি। আগে তো কিছু মুখে দিবি। দাঁড়া, আগে কিছু ব্রেকফাস্ট অর্ডার দিই।
ওরা কামড়ার দরজাটা খুলে একটু উঁকি ঝুঁকি মারতেই একজন উর্দ্দি পরা ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, ওরা ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিল – ডাবল ডিমের ওমলেট, ব্রেড বাটার আর কফি।
তারপর ওরা আবার দুজনে গল্পে ডুবে গেল কারণ খাবার আস্তে অন্তত মিনিট পনের লাগবে।
মিতালী। প্রায় সাড়ে আটটা বাজে, তার মানে একটু পরেই বোধহয় রায়পুর আসবে।
মধুমন্তী। তা তো আসবে, কিন্তু দুপুর এসে গেলেই তো তুই নেবে যাবি। আমার এতো খারাপ লাগছে না, এতো দিন পড়ে দেখা অথচ তোকে যে বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে বেশ আরাম করে একটু গল্প করবো তার উপায় নেই।
তারপর দুই বন্ধু আবার সেই পুরাণ দিনের গল্পে মেতে উঠল। ওরা দুজনে যেন সেই পুরাণ যাদবপুরের দিনে ফিরে গেছে … আরতীদির সেই লিটারেচারের ক্লাস করতে করতে হঠাৎ হঠাৎ লেকচার টপিক ভুলে যাওয়া … স্প্রিং ফেস্টের সময় ব্রাত্যর নাটকের পাঠ ভুলে হঠাৎ স্টেজ থেকে পালিয়ে যাওয়া … নীলেশ আর জয়তীর ঢাকুরিয়া লেকে প্রেম করতে গিয়ে সোজা বাবার সামনে পরে যাওয়া এবং তারপর না চেনার ভান করে চলে যেতে গিয়ে রাস্তার মাঝখানে চড় খাওয়া … এই সব কথা মনে করে দুজন যেন আবার কলেজ পড়ুয়া তরুণী হয়ে গেছে … অমলিন হাসির মাঝে দুজনাই যেন কোথায় বর্তমানকে ভোলার নাটক করে যাচ্ছে।
এর মধ্যে সকালের ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছে, অমলেট, ব্রেড আর কফি খাওয়া চলেছে সেই সঙ্গে গল্প। বেশীর ভাগ বন্ধু বান্ধব আজ কোথায় ছড়িয়ে ছিটকে গেছে … তাদের খবর আর পাওয়া বোধহয় সম্ভব নয়, তাছাড়া তাদের দুজনার বয়সও প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, কাজেই নিজের সংসার ছেড়ে নতুন করে পুরাণ সহপাঠিদের খোঁজার সময় নেই। সময় বোধহয় এই রকমই … জীবনে নতুন অনেক কিছু দেয় কিন্তু পুরাণ অনেক কিছু ভাসিয়ে নিয়েও যায়। কাবেরীর কথাটা অবশ্য ওরা দুজনেই কোথাও শুনেছে … ওর বোধহয় ওদের ব্যাচে সব থেকে ভালো বিয়ে হয়েছে … স্বামী হলিউডের মুভি প্রোডাকশান লাইনে আছে … দেদার পয়সা … এল. এ.-তে বেশ বড় বাংলোতে থাকে। কিন্তু কোলকাতায় এলেই পুরনো যাদের সাথে যোগাযোগ আছে তাদের সবার সাথে কোলকাতায় দেখা করতে যায় , ভীষণ সাধাসিধে স্বভাবের, একদম যাদবপুরের মতোই রয়ে গেলো, আর হাসব্যান্ড ভাস্করও ভীষণ মজার লোক ।
কথার কোন শেষ নেই, বিশেষ করে দুই বন্ধুর যখন প্রায় বাইশ বছর পড়ে দেখা। কিন্তু ট্রেন বেগে সামনের দিকে চলেছে, ঘড়ির কাঁটাও ঘুরে চলেছে।
সময় কখনও থেমে থাকে না … কারো ভালো লাগালাগির ধার ধারে না … সময়ের কোন বন্ধু নেই, হয়তো কোন শত্রুও নেই। একটা সময় ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘরে পৌঁছাল। ওদের দুজনার হুঁশ ছিল না, কিন্তু গার্ড এসে লাঞ্চের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলো … ওদের মন আবার বাস্তবে ফিরে এলো। আর মাত্র দুটি ঘণ্টা … তারপর মিতালী তার গন্তব্যস্থল নাগপুরে নেমে যাবে। ওদের দুজনের মনেই কোথায় একটা সুর বেজে উঠল, প্রায় একই সঙ্গে। লাঞ্চ আসার আগেই ওরা যা করার করলো। সঙ্গে তো লেখার মত কিছু নেই … মিতালী একটা পুরনো সাদা খাম বার করল আর মধুমন্তী একটা শাড়ীর ব্রাউন পেপারের প্যাকেট … এই মুহুর্তে এর থেকে ভালো কিছু পাওয়া গেলো না। একটা লেখার পেন অবশ্য দুজনার কাছেই ছিল, তাড়াতাড়ি করে দুজনে তাদের ঠিকানা আর মোবাইল নাম্বার এক্সচেঞ্জ করলো … আবার কবে দেখা হয় কে জানে … আর দেখা নাও হতে পারে। এর মধ্যেই লাঞ্চ এসে গেলো … ডিমের ঝোল আর ভাত।
খাওয়ার মধ্যেও কথার ছুটি নেই … ভাত আর তরকারি চিবুতে চিবুতেও সেই পুরনো হারিয়ে যাওয়া দিন গুলোর মধ্যে ওরা ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু খানিক পরেই গার্ড এসে জানিয়ে গেলো যে গাড়ী রাইট টাইমেই আছে এবং আর আধ ঘন্টা বাদে নাগপুর এসে যাবে।
ব্যাস, দুজনার সব কথাই হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো। আর মাত্র তিরিশ মিনিট … ব্যাস, তারপর আবার দুজনে দুজনার ছোট্ট বৃত্তের মধ্যে হারিয়ে যাবে, সেই বর, বাচ্চা, শ্বশুর শাশুরী আর কিছু কাছের লোক … আর কেউ নেই। পুরনো দিনের কলেজের বন্ধু বান্ধবরা সেই বৃত্তের মধ্যে নেই … তারা যেন অন্য কোন প্ল্যানেটে বাস করে … এটা অনেকটা কসমিক তত্তের মতো … তাদের অস্তিত্ব জানা আছে কিন্তু বাস্তব জীবনে দেখাশোনার কোন উপায় নেই।
ট্রেন প্রায় ঠিক টাইমেই নাগপুর স্টেশানে পৌঁছাল। ওরা দুজনেই তার আগেই পাশাপাশি বসেছিল … সেই যাদবপুরেরই মতো … আরতীদির ক্লাস করার সময় যেমন বসতো। দুজনেরই মনে বরষার ঘন কাল মেঘ … চোখের কোন গুলোও যেন একটু ভিজে। গাড়ী থামার একটু আগেই মিতালী নামার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল, পাশে তার প্রিয় বন্ধু মধুমন্তী। গাড়ী থামলে মধু ওর স্যুটকেস গুলো নামাতে সাহায্য করলো … মিতালীর হাঁটুর অবস্থা এমনিতেই ভালো না। প্ল্যাটফর্মে নেমে মিতালী একটু সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, দরজার সামনে মধুমন্তী। ওরা দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসার চেস্টা করছিল যদিও ওদের মুখগুলো বড়ই করুণ দেখাচ্ছিল… চোখ দুতো ছলছল করছে।
মিনিট কয়েক পরে ট্রেনের বাইরে গার্ড সিটি দিল, মধুমন্তী হাত নেড়ে চিৎকার করলো –
মধুমন্তী। মিতু, চিঠি দিস মিন্তু … মাঝে মাঝে ফোন করিস।
মিতালী। দেব দেব … তুইও ফোন করিস … নাম্বার আর ঠিকানাটা হারাস না যেন।
মধুমন্তী। না না … আমার হ্যান্ড ব্যাগে রেখে দেব… ।
গাড়ী আস্তে আস্তে প্ল্যাট ফর্ম ছাড়িয়ে এগিয়ে এলো … মিতালী চিৎকার করে কি একটা বললো কিন্তু মধুমন্তী শুনতে পেল না … সে শুধু হাত নাড়লো … দূর থেকে মিতালীও হাত তুললো … তারপর গাড়ীটা একটা বাঁকে এসে গেলো আর মিতালী আর স্টেশানটা কিছু বড় গাছ আর ঝোপের আড়ালে হারিয়ে গেলো।
নয়
আনমনে মধুমন্তী নিজের সিটে এসে বসলো … ট্রেন তখন আবার ফুল স্পীডে দৌড়চ্ছে। মিতালীর দেওয়া অ্যাড্রেস আর মোবাইল নাম্বার এখনো তার হাতে ধরা। সে আস্তে করে সেটা তার নিজস্ব হ্যান্ডব্যাগে ভড়ে রাখলো।
তার মনটা একটা বিতৃষনায় ভরে আছে … নিজের ওপরই একটা রাগ। এতোদিন পরে তার কলেজের বন্ধু মিতালীর সাথে দেখা, কতো ভালো লাগার কথা … । ভালো তো লাগছিলও, কতো কথা হোল … কতো পুরনো স্মৃতি … সেই সঙ্গে আবার সারা জীবনের যোগাযোগ রাখার সুযোগ … যে বন্ধুত্ব জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকে যায়। কিন্তু যখন ওরা অ্যাড্রেস লিখে দিল তখন মধুমন্তী তার কোয়ার্টার নাম্বারটা ভুল লিখলো , তার মুম্বাইয়ের পুরনো কোয়ার্টার নাম্বার যা তার এখনকার বাড়ী থেকে অনেক দূরে, মুম্বাইয়ের সম্পূর্ন অন্য এরিয়ায়, ফোন নাম্বারটা দুটো নাম্বার ভুল লিখলো যাতে মিতালী তাকে কোনদিন ফোন করতে না পারে। কিন্তু তার কি বা করার ছিল? তার জীবনে স্বাচ্ছন্দ এসেছে, তার বাড়ীতে দুটো গাড়ী, বেশ বড় সি ভিউ অ্যাপার্টমেন্ট … সেটাই কি সব? মদ্যপ হাসব্যান্ড, ছেলে মেয়ে দুটোর হাতে পয়সা থাকায় তারা উদ্দাম জীবনে অভ্যস্ত। বাড়ীতে সন্ধ্যার দিকে ঝগড়া প্রায় লেগেই থাকে … এর মধ্যে হঠাৎ মিতালী এসে পরলে সে কি দেখবে? মধুমন্তী জানে তার বিয়ে নিয়ে বহু বন্ধুর মধ্যেই একটু জেলাসি ছিল কিন্তু এই তার পরিণতি? না, এটা তার পরাজয় আর মধুমন্তী তার জীবনের ট্র্যাজেডি সবার সামনে উজার করতে চায় না। মিতালী বড় মিস্টি আর স্বচ্ছ মেয়ে, তাকে সব কিছু বলা যায় না। তার থেকে মিতালীর অ্যাড্রেস আর নাম্বারটা থাক, হয়তো কোনদিন সে ফোন করবে দুপুরের দিকে যখন বাড়ীটা একটু ফাঁকা থাকে।
স্টেশান থেকে বার হয়ে মিতালী একটা বাস স্টপে এসে দাঁড়াল, তার জার্নি এখনো অনেক দূর, বেশ কয়েক ঘন্টার। বাসে লাইনটা একটু বড় কিন্তু তাও মিনিট পাচেকের মধ্যে বাসে উঠে একটা জানলার পাশের সিট পেয়ে গেলো। স্যুটকেস দুটো সিটের ওপরের লফটে তুলে দিয়ে বেশ হাত পা ছড়িয়ে বসলো। বাইরের দিকে তাকালো, এখনো বেশ লম্বা লাইন, বাস ছাড়তে আরো মিনিট কুরি বাঁকি, তবে এই পথ তার ভীষণ চেনা কাজেই চিন্তার কিছু নেই। তার মধুমন্তীর কথা মনে পরলো , কত সুখী মেয়ে, তার বহুদিনের প্রিয় বন্ধু। সেই বন্ধুকে সে তার জীবনের সব কিছু বলতে পারেনি। তার স্বামী ঘুষ খেয়ে ধরা পরেছিল, চাকরী চলে যায় … কোনক্রমে জেলে যেতে হয়নি। নতুন চাকরীতে গিয়েও তার স্বভাব পালটায় নি, অত্যন্ত নিম্ন মানের সন্দেহ জনক বন্ধুদের গ্রুপে থাকে … তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে মিতালীর কোন শ্রদ্ধা নেই , কোথাও না কোথাও বাজে কাজকর্ম চলছে … টাকার কারবারও হয়ত আছে, সাইটে এই ব্যাপার গুলো থেকেই যায়। মিতালী মনে মনে জানে যে সে জীবনে হেরো … মধুমন্তীর কি সুন্দর পবিত্র মুখটার দিকে চেয়ে সে নিজের জীবনের সত্যি কথাগুলো বলতে পারে নি। সে মিস্টি হেসে ঠিকানা আর ফোন নাম্বার লিখে দিয়েছিল … কিন্তু সেটাও সঠিক ছিল না … ঠিকানাটা পুরনো কোয়ার্টারের যেটা মিতালীরা প্রায় দের বছর আগে ছেড়ে নতুন সাইটে চলে এসেছে, মোবাইল নাম্বারটাও পুরনো সিমের যেটা ওরা আর ইউস করে না। কাজেই মধুমন্তী সত্যি সত্যি চেস্টা করলেও তার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারবে না। মিতালী পুরনো বন্ধুর সাথে ছাত্র জীবনের গল্প করতে পারে কিন্তু মধুমন্তী যদি হঠাৎ এসে পরে আর তার জীবনের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে সেটা সে সহ্য করতে পারবে না। আর মধুমন্তীরা পয়সাওয়ালা লোক, হঠাৎ এদিক সেদিক কোথাও বেড়াতে যাবার পথে চলেও আসতে পারে, সঙ্গে ফ্যামিলী কার তো থাকেই। তাই মিতালী সে পথ চিরদিনের মত বন্ধ করে দিয়েছে। এতক্ষনে ট্রেনটা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে মধুমন্তীকে নিয়ে… সেই সঙ্গে বোধহয় এ জীবনের মত মিতালীর জীবন থেকে মধুমন্তী হারিয়েও গেলো।
জানলার কাচের ফাঁক দিয়ে একটু একটু হাওয়া মিতালীর গালে মুখে এসে লাগছিল, মুখের ঘামে সেই হাওয়া লেগে বেশ একটু ঠান্ডা লাগছিল, বেশ আরাম দায়ক অনুভূতি… কিন্তু তার মনের মধ্যে আগুণ থামবার নয়।
মানুষ মাঝে মাঝে দ্বিতীয়বার সুযোগ পায়। মধুমন্তী আর মিতালীও কলেজ ছাড়ার বাইশ বছর পর একবার সুযোগ পেয়েছিল দুজনের জীবনকে কাছাকাছি আনার … বন্ধুত্বের শিকল দৃঢ় করার। কিন্তু জীবনের অদ্ভুত কিছু খেলায় দুজনেই মানসিক ভাবে হেরে যাওয়ায় ওরা আবার যা যার নিজের বৃত্তে ফিরে গেলো … আবার কোনদিন দেখা হওয়ার কোন সুযোগ আসবে কিনা জানা নেই। ওরা যেন দুটো জীবন্ত ধূমকেতু, কোন দৈবিক নিয়মে কিছুক্ষণের জন্য কাছাকাছি এসেছিল … আবার যে যার নিজের পথে চলে গেলো। দুজনের কাছেই রয়ে গেলো নতুন কিছু স্মৃতি … যাকে আমরা বলি সংবাদ।
— ০ –সমাপ্ত– ০ —