পাঁচমিনিটের মধ্যেই লাইক প্রায় তিনশো ছুঁই ছুঁই শেয়ার ও 42 এর উপর। দেখেই আনন্দে একবার ঘুরপাক দিয়ে নিল কঙ্কনা। ঠিক এমনটাই তো চেয়েছিল ও, এবার দেখিয়ে দেবে সবাইকে সেও লেখায় কোনো অংশে কম যায়না।

কঙ্কনা একজন লেখিকা, বলা ভালো ফেসবুক লেখিকা। ইতিহাসে M.A ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী ও। লেখালিখির শুরু করেছে বেশ কয়েকবছর হলো, কিন্তু তেমন সুবিধা করে উঠতে পারছিল না। ফেসবুক খ্যাত সব কবি সাহিত্যিকদের ভিড়ে একচিলতে কুটোর মতো ভাসছিল। কদাচিৎ পাঁচ দশটা লাইক জুটে যেত। আর কমেন্ট এ “নাইস হয়েছে”, “প্রেম করবে”, “এত দুঃখ কেন” এই বিজাতীয় স্তুতিতে ভরে উঠত। শুরুর দিকে ভালো লাগলেও ভারী বিরক্ত বোধ হতে লাগলো ওর কিছুদিন পর থেকে। ওর ক্লাসমেট বিদিশা কি সব ছাইপাশ গল্প লেখে তাতে তো যেন লাইক কমেন্ট করার জন্য যেন রেশনের দোকানের মতো হুড়োহুড়ি লেগে যায়। ইউনিভার্সিটিতেও এর জন্য বেশ দেমাক নিয়ে চলে। ছেলের দল তার সঙ্গ লাভের জন্য যেন হা পিত্যেস করে থাকে, দীপ্তও তো এই জন্যই……

‘মানুষের রুচিবোধ বোধহয় সব মরে কাঠ হয়ে গেছে’, মনে মনে বলে। এদিকে কঙ্কনা যে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুনীল, শক্তি, জয় গোস্বামী ঘেঁটে কত মাথা খাটিয়ে একটার পর একটা কবিতা লেখে তার বেলায় জোটে কেবল ফক্কা। ভবিষ্যতে একজন নামজাদা কবি হবে, খান দশেক কাব্য গ্রন্থ হবে, বইমেলায় তার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য আদেখলে জনতার ভিড়, এইটুকু তো মাত্র স্বপ্ন কঙ্কনার। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে সে স্বপ্ন কেবল স্বপ্নেই থেকে যাবে মনে হচ্ছে। আজ দুপুর বেলা শুয়ে শুয়ে এসবই আকাশ পাতাল ভাবছিল, এমন সময় ঘটনাটা ঘটল । আমারো পরাণ যাহা চায় তুমি তাই……. সুর তুলে ভাইব্রেট হচ্ছে ফোনটা।  মাথার পাশের টেবিলের দিকে আলস্য ভরে হাত বাড়িয়ে দেয়, স্ক্রিনে ভেসে আছে এক অচেনা নম্বর। একটু ইতস্তত করে কলটা রিসিভ করতেই অপর দিক থেকে ভেসে এলো একটা ফ্যাসফ্যাসে গলার স্বর,

– হাই মিস কঙ্কনা মজুমদার! আপনি একটি গত রবিবারের ‘কবিতার ছন্দ’ কনটেস্ট এর ফার্ষ্ট প্রাইজটি জিতে নিয়েছেন। অনেক অভিনন্দন।

মনে পড়ে গেল কঙ্কনার, কিছুদিন আগে নিউজ ফিড স্ক্রল করতে করতে চোখ আটকায় ‘কবিতার ছন্দ’ নামের একটা পেজের  announcement এর উপর। কবিতা পাঠাতে হবে একুশ শব্দের মধ্যে। সব থেকে মজা পেয়েছিল পুরস্কারটা দেখে। প্রথম পুরস্কার প্রাপককে নাকি তারা তার যেকোনো একটি ইচ্ছে পূরণ করে দেবে। সেটি জাগতিক হোক কিংবা অপার্থিব। একচোট খুব হেসেছিল, সব ইচ্ছে পূরণ করে দেবে নাকি! ভগবান আজকাল ফেসবুকে পেজ চালাচ্ছে নাকি! যত সব গিমিক, সব ফলোয়ার বাড়ানোর ধান্দা। এতই যদি ক্ষমতা তবে নিজেদের পেজের এই দশা কেন, মাত্র 666 লাইক পেজে। আর সাতপাঁচ না ভেবে ডায়েরী ঘেঁটে একটা পুরোনো কবিতা বের করে, টাইপ করে পাঠিয়ে দেয় পেজের মেসেজ বক্সে।  তারপর এতদিন আর মনেও ছিলনা ব্যাপারটা। এই সব যখন ভাবছে, লোকটি আবার বলল

– কী ম্যাডাম কী ভাবছেন, সব ভাঁওতাবাজি কিনা? বলুন আপনার মনের গোপন  ইচ্ছেটা।

মনে মনে একটু হেসে নিয়ে কঙ্কনা বলল

-সব রকম ইচ্ছেই তো আপনারা পূরণ করবেন!? বলেছেন।

– হ্যাঁ ম্যাডাম, যেকোনো একটি।

– বেশ তবে আমার ফেসবুক ওয়ালে এবার থেকে যা লিখব তার সব গুলোই যেন নিমেষে ভাইরাল হয়ে যায়। আমার এই উইশটি ফুলফিল করুন দেখি। কেমন ক্ষমতা আপনার , না হলে কিন্তু আপনাদের পেজে রিপোর্ট করবো আর আমাদের বন্ধুদের দিয়েও করাবো। সব ভণ্ডামি বেরিযে যাবে।

– ওপাশের লোকটা খসখস করে অদ্ভুত শব্দে হাসলো যেন। যা চাইছেন ভালো করে ভেবে চাইছেন তো?!

– হ্যাঁ, কেন? এটা কি আপনার ক্ষমতার বাইরে!

– আবার সেই হাসির শব্দ। তবে আপনার এই ইচ্ছে পূরণ হোক, নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল লোকটা। এবার আপনার স্ক্রিনে একটা terms and conditions এর একটা পেজ আসবে, সেটায় I agree তে ক্লিক করলেই আপনার উইস গ্রান্টেড।

কঙ্কনাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই “Have a nice life” বলে কেটে যায় কলটা। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা পেজ ওপেন হয় ওর ফোনে। পুরো পেজ জুড়ে  বিশাল সবুজ রঙের পিরামিডের মতো একটা শেপ আঁকা, পিরামিডের ঠিক মধ্যিখানে জ্বলজ্বল করছে একটা হালকা লাল চোখ। মণিটা সাপের চোখের মতো সরু। ভারী জীবন্ত চোখ দুটো, কী একটা যেন একটা সর্বগ্রাসী ক্ষিদে আছে ওদের মধ্যে। দারুণ গ্রাফিক্স এর কাজ করেছে তো। মনে মনে ভাবল ও। পেজের তলার দিকে খুঁজতেই পেয়ে গেল অপশানটা। i agree বাটনে ক্লিক করতেই, ভীষণ ভাবে ভাইব্রেট করে উঠল ফোনটা । হাত ফসকে সোজা এসে পড়ল ঠোঁটের উপর। কঙ্কনার পাতলা ঠোঁট, ফোন আর দাঁতের মাঝে পরে পিষে গেল। ঠোঁট চিরে রক্ত বেরিয়ে এল খানিকটা। রক্তের নোনতা স্বাদ গিলে নিয়ে যখন ফোনটা আবার হাতে নিল, খেয়াল করল এক ফোঁটা রক্ত লেগে আছে স্ক্রিনে।

দ্রুত হাতে সেটা মুছে ফেসবুক ওপেন করল। একটু ভেবে নিয়ে দুলাইন লিখে ফেলল-

আমার পথের ধারে নতুন গাছের চারা-
তার ছায়ায় প্রাণ জুড়োক শহরের।

অপেক্ষা করতে লাগল, এক মিনিট দু মিনিট। ঠিক তিন মিনিটের মাথায় এলো প্রথম লাইক, তারপরেই যেন লাইক কমেন্টের ঝড় বয়ে যেতে লাগল পোস্টে, পাঁচ মিনিটে প্রায় তিনশো ছুঁই ছুঁই। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আরো চার লাইন লিখল, এটাতেও আগেরটার থেকেও বেশি রেসপন্স, প্রশংসায় কমেন্ট বক্স উপচে পড়ছে। সবাইকে রিপ্লাই দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে, একসময় রণে ভঙ্গ দিল যখন, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। সূর্যের ম্লান কমলা রঙ ধীরে ধীরে আরো মনিন হয়ে আসে। রাতের কলকাতা নিয়নের আলোতে এবার জাগতে শুরু করছে।

মায়ের অফিসের কোন কলিগের ছেলের বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে মা-বাবা কেউই আজ বাড়ি নেই। ফিরতে রাত হবে । খাবার ফ্রিজেই আছে গরম করে নিতে হবে শুধু।

সন্ধ্যায় স্নান পর্ব সেরে আবার ফোনটা নিয়ে বসে পড়ে। পড়াই মন নেই আজ আর তার। ফেসবুক ওপেন করে সার্চ করে কবিতার ছন্দ নামটা। আশ্চর্য! অনেক খুঁজেও আর পেলনা পেজটা। খটকা লাগে তার। কিন্তু এবিষয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে নতুন কি লেখা যায় ভাবতে শুরু করে। আগের পোস্টে আরো নতুন কিছু কমেন্ট জমেছে। সূচনার বড়সড়  কমেন্টটা দেখে বেশ বিরক্তিই লাগে ওর। ইউনিভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই মেয়েটার অতিরিক্ত গায়ে পড়া ভাব পছন্দ হয়নি কঙ্কনার। সবসময় যেন আঠার মতো সেঁটে থাকতে চায় ওর সাথে।

কঙ্কনার অন্য কোনো বন্ধুদের দেখতে পারেনা ও। অন্য কোনো কারো সাথে কথা বল্লেই সেখানে গিয়ে কোননা কোনো ভাবে একটা সিন ক্রিয়েট করতো। এই তো সেদিন, মাস দুয়েক আগে দীপ্ত এর সাথে বেশ গল্প জমিয়ে ফেলেছিল, আশেপাশে বিদিশাও ছিলনা সেদিন। এমন সময় সূচনা এসে হাজির। আজ ওর নাকি একা বাড়ি যেতে ভয় করছে, কঙ্কনাকে নাকি ওর সাথে বাড়ি পর্যন্ত যেতে হবে। যত্তসব ন্যাকামো! বলে আরো বেশ কয়েকটা কড়া  কথা শুনিয়ে দিয়েছিল সবার সামনে। চোখে জল নিয়ে চলে গিয়েছিল সূচনা। তারপর থেকে আর বিশেষ সামনে আসেনি ওর। কিন্তু কঙ্কনার ফেসবুক ইনস্টাগ্রামের প্রায় প্রতিটা পোস্টে বিরক্তিকর বড়সর কমেন্ট দেখা যেতে লাগল সূচনার। সে সাথে মেসেঞ্জার এ মেসেজের পাহাড়। একটারও রিপ্লাই পেত না ঠিকই, কিন্তু ওর উৎসাহ যেন অফুরান।

টুং শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়ল। মেসেঞ্জারে মেসেজ এবার, নোটিফিকেশন বারে দেখা গেল  সূচনার মেসেজ, ‘তোর সাথে জরুরী কিছু কথা আছে’। পাত্তা না দিয়ে ফেসবুক লাইভ স্টার্ট করে দেয়।

আচ্ছা গান করলে কেমন হয়, বেশ নতুন কিছু হবে ভিউয়ারদের ভিড়ও জমতে শুরু হয়েছে। সবাই বলছে গান হোক, গান হোক। উৎসাহ পেয়ে একটা হিন্দী গানের গাইতে লাগল….এ নাদান পারিন্দে ঘর আ যা…

সবে দুলাইন গেয়েছে… এমন সময় দরজায় বাড়ির কলিং বেলটা একটা বিশ্ৰী শব্দে বেজে উঠলো। কিছু ভাবার আগেই আবার, আবার। ঘড়িতে দেখল সাড়ে সাতটা বাজছে। মা-বাবা কোন কারণে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে ভেবে দরজা খুলতে তাড়াতাড়ি চলে গেল কঙ্কনা। ভুলে গেল লাইভ স্ট্রিমিং অফ করার কথা। ওদিকে দরজার ঠিক ওপারে যে এসে দাঁড়িয়েছে তার মুঠো করা হাতের ভিতর থেকে নেমে এসেছে একটা তীক্ষ কাঁচির ফলা। কব্জির শিরাটা ফুলে উঠেছে। ঘাম  চুঁইয়ে পড়ছে কাঁচি বেয়ে। দরজা খুলতেই চমকে ওঠে কঙ্কনা, বিদিশা দাঁড়িয়ে। ঘামে ভিজে আছে পরনের জামাটা, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। গেটের হলদে আলো এসে পড়েছে শরীরে, সেই আলোয় যেন এক হিংস্রতা ফুটে উঠেছে ওর ওই সুন্দর মুখখানায়।

একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে -কী রে আজ আমার বাড়ি হঠাৎ।

-আসলে একটা হিস্ট্রির একটা নোট নেওয়ার ছিল তোর থেকে, মৃদু হেসে বলে বিদিশা।

-ওহ ঘরে আয় তবে । এক মিনিট কী ভেবে কঙ্কনার পিছু পিছু ওর ঘরে এসে ঢোকে বিদিশা। জল ভর্তি কাঁচের গ্লাসটা এগিয়ে দেয় কঙ্কনা । কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে আচমকাই কাঁচিটা আমূল বসিয়ে দেয় কঙ্কনার গলায়। হাতের গ্লাস ছিটকে পড়ে মেঝেতে, টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত স্রোত বেরিয়ে আসে গলা থেকে। ছটপট করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কঙ্কনা। ওর যন্ত্রনা কাতর মুখের দিকে ঝুঁকে বিদিশা সাপের মতো হিসহিসে গলায় বলে কবিতার ছন্দ এর গত সপ্তাহের কনটেস্টে আমি সেকেন্ড হই… কিন্তু আমার তো ফার্স্ট হবার কথা ছিল, যেমন গত বছর হয়েছিলাম। তুই মাঝে পরে সব বিগড়ে দিলি…

ওরা ফোন করে বলেছে তোকে সরাতে পারলেই আবার সব স্পটলাইট আমার দিকে চলে আসবে। কেউ আমার সমান হতে পারবে না। কঙ্কনার নিস্তেজ শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। পুওর  গার্ল, কাঁচিটা টেনে বের করে নেয় বিদিশা। আরো খানিকটা  রক্ত বেরিয়ে আসে হাঁ হয়ে যাওয়া ক্ষতটা থেকে। এত সহজে কাজটা হয়ে যাবে ভাবেনি ও। এবার এখন থেকে দ্রুত বেরোনো দরকার। খেয়াল করলোনা, লাইভে পুরো ব্যাপারটাই  সামনে থেকে ঘটতে দেখল গোটা দুনিয়া। ভাইরাল হয়ে গেছে ভিডিওটা। প্রচুর শেয়ার হচ্ছে।  হঠাৎ বাইরে কিছুর গোলমাল আর পুলিশের সাইরেন শোনা যায়। খানিকটা চমকে ওঠে, তাড়াতাড়ি ডেস্ক থেকে একটা বই তুলে নিয়ে উঠে দরজার দিকে দৌড়ে যায় বিদিশা। অসাবধানতায় পায়ে বিঁধে যায় কাঁচের ভাঙা টুকরো। অসম্ভব যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনোরকমে দরজায় কাছে পৌঁছে যায়। অসম্ভব ভারী লাগে ওর হাত দুটো। হাতলটা সমস্ত শক্তি দিয়ে টানতে থাকে। ততক্ষনে একদল পুলিশ বাড়িটাকে ঘিরে ফেলেছে।

 

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleপথিক কবি
Next articleবসন্তের অন্ধকার
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments