পশ্চিমে খুব মেঘ করেছে। কোথাও বৃষ্টি হলো মনে হচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়া বাইরের উঠানের সাদা অপরাজিতার ঠোট ছুঁয়ে ছন্দে ছন্দে সপ্তসুরের ভেলায় চড়ে খোলা জানলা পেরিয়ে আমার খোলা চুল উড়িয়ে দিয়ে পিছনের দরজায় মা এর হলুদ শাড়ির তৈরী পর্দাটা দুলিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে অন্যপথে। জানলা আর আমার মাঝখানে টেবিল এর উপরে তুমি। এই আমার দিকে অমন অবাক হয়ে তাকিয়ে মুচকি হেসে কি বোঝাতে চাইছো তুমি? চুলটা বাঁধিনি বলে ব্যাঙ্গ করে খেপি বলতে চাইছ, নাকি মনের ভালোবাসার দুস্টুমিটা ঠোঁটের কোণে জমেছে?

ভাবছো যে এখন কিভাবে কথা বলছি? বাবা বাড়িতে নেই। মা চালের কাঁকড় বাচছে বারান্দায়। আজকাল রেশনে ভালো চাল-ই দিচ্ছে না। আমিও মা-এর কাছে বসেছিলাম। তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল,কথা বলতে ইচ্ছা করছিল। আনমনে বারবার মা এর বাছা চালে কাঁকড় মিশিয়ে দিছিলাম। মা ধমকে দিলো। তাই রাগ করে উঠে এলাম তোমার কাছে নালিশ করতে। তুমি বকে দাও তো মা কে।

এই আজ 14-ই ফেব্রুয়ারি। ভ্যালেন্টাইন ডে। তুমি তো বলোই না যে ‘রঞ্জু,আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। ‘জানি খুব ব্যাস্ত তুমি। প্রথমবার ফোনে তোমার সাথে কথা বলা এখন ও মনে আছে আমার। তোমার মনে আছে? বলো না তাহলে… আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছে। কি গো? বুঝেছি, তোমার লজ্জা করছে।

সেদিন তুমি ফোন নং নিয়েছিলে লুকিয়ে, যখন আমি রিচার্জ করাতে গিয়েছিলাম। দশ বার ফোন করার পরে আমি রিসিভ করে ভারী গলায় জিগ্গেস করেছিলাম-‘হ্যালো, কে? কাকে চায়? ‘তুমি একটু থতমত খেয়ে বলেছিলে-‘আ-আ-আমি সর্বজিৎ, ওই ফোনের দোকানে…… আমি বলেছিলাম-বাঃ, আপনি তো বেশ অভদ্র। কিন্তু আমায় কেন ফোন করেছেন? আপনি সবটা জিতবেন না কিছুটা সেসব আমায় কেন শোনাচ্ছেন?’ তুমি বলেছিলে- শোনাতে আসিনি, জিততে এসেছি। সবটা জিততে পারবো কিনা জানিনা, যেটা জিতলে সব জেতার সমান হবে, সেটা তুমি। তাই একরকম নাম সার্থকের উদ্দেশেই ফোন করেছি।

তোমার নাম কি? প্লিজ সত্যি বলবে। ‘আমি বলেছিলাম- ‘রঞ্জনা। আপনি যেন সবার মতো অঞ্জন দত্তের রঞ্জনার কথা ভেবে ব্যাঙ্গ করবেন না। আমি রঞ্জনা মাহাত। আর সোনা, চাদি ছেড়ে নুড়ি জেতার ইচ্ছা কেন? তুমি বলেছিলে-‘নুড়ির মাঝেই যদি সোনা পাই তাই।’ তুমি যখন বলেছিলে তোমার বাবা ডাক্তার। তোমার বিশাল বাড়ি, কয়েকটা গাড়ি তখন মনে হয়েছিল তুমি ভুল করে আমায় জেতার দিবাস্বপ্ন দেখছো।

এটা যে অসম্ভব সেটা বোঝানোর জন্যই বলেছিলাম- ‘দেখুন, নুড়ির মাঝে সোনা থাকে না। নুড়িই থাকে। আমি গরিব ঘরের মেয়ে। বাবা একশো দিনের কাজ করে। পঞ্চাশ দিনের রোজগার মদ আর জুয়াতেই চলে যায়। বাকিটা দিয়ে বাড়ির তিন মাস চলে। মা বড়লোক উকিল ঘোষবাবুর বাড়ীর চাকরানী। আমি বি.এসসি পড়ছি।ক য়েকটা টিউশন পড়াই। S.T হবার দরুন সরকারের সাহায্য, স্কলারশিপ এ টেনেটুনে চলে যায় আমাদের। বুঝেছেন?

ভেবেছিলাম এসব শোনার পর তুমি আর কথা বলতে চাইবে না। কিন্তু জানিনা কিভাবে নিজে হেরে গিয়ে মত্ত হলে আমায় জেতার নেশায়। আমি তো খুব তুচ্ছ ছিলাম তোমার কাছে। খুব ভয় হতো মাঝে মাঝে আর তোমার ভালোবাসা বারবার আমার মনের কোণে সেটা লুকিয়ে দিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখাতো। কি শান্তি তোমার ভালোবাসায়। আচ্ছা, ভ্যালেন্টাইন ডে’র দিনে কি হয়েছিল মনে পড়ে? বলো না…… দেখো আমি একাই বকবক করছি। এরকম হলে খেলব না কিন্তু। তাড়াতড়ি বলো, এখুনি মা চলে আসবে। ও বুঝেছি তোমার সময় নেই না?

নিস্তব্ধ দুপুরবেলা। ওই দীঘির পাশের বড় বট গাছের নিচে আমি একটা লাল চুড়িদার পড়ে অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য।রুমালে সবুজ সুতোয় তোমার নাম লিখে নিয়ে এসেছিলাম তোমায় দেব বলে। সবুজ তোমার ফেভারিট। আর তুমি একটু পিছনে দাঁড়িয়ে আমায় দেখতে পেয়েও ফোন করে বলেছিলে-রঞ্জু,আমার খুব জ্বর। সরি গো। আসতে পারবো না।’

আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল এসব আমার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে হয়েছে। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কাঁদছিলাম খুব। তুমি কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে গোলাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলে- ‘হ্যাপি ভ্যালেনটাইন ডে। আমি তোমায় খুব ভালোবাসি রঞ্জু।’ আর আমি তোমার বুকে চোখের জাল লুকিয়ে ছিলাম।

আজ খুব ইচ্ছা করছে তোমার বুকে মাথা রাখতে। তোমার হৃৎস্পন্দন শুনতে। অনেক কান্না জমে আছে তোমার বুকে লুকোতে।এসোনা প্লিজ। আমায় নিয়ে যাও এখান থেকে। জানো, আমার খুব কষ্ট এখানে। মা খুব বকে আমায়। বাবার তো হাই প্রেসর।তাই রাগ সামলাতে না পেরে আমায় মারে। আমি এমন কি করেছি বলো। শুধু তোমায় চেয়েছি। ভালোবাসার মানুষ কে কাছে চাওয়া কি পাপ?

মা বলে- ‘তুমি কোনোদিন আসবে না। তুমি মারা গেছো। তুমি নাকি শুধু একটা ছবি। ‘আমি বিশ্বাস করি না।কি করেই বা করি বলো। সবসময় যে তোমার নিঃশ্বাস পরে আমার রোমকূপে। তোমার কথা যে এখন ও কানে ভাসে।তোমার গায়ের গন্ধ, তোমার উপস্থিতির অনুভুতি যে এখন ও পাই। তুমি নিয়ে যাও না আমায়। কবে আসবে? বলো না……ওই-ই-ই……বুজেছি। তুমি খুব ব্যাস্ত। সময় নেই তোমার কাছে ,না?

~ ব্যাস্ত তুমি ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleট্রাম্প ওবামার দেশে: বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা (২য় পর্ব)
Next articleপ্রথম পরিচয়
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments