গিয়েছিলাম আমেরিকার বিখ্যাত গ্রেট স্মোকি মাউন্টেন দেখতে। এখানে নাকি প্রতি বছর বহু লোকের সমাগম হয় কারন এটা আমেরিকার বিখ্যাত একটা পর্যটন কেন্দ্র। এই গ্রেট স্মোকি জায়গাটি হলো টেনেসি রাজ্য আর নর্থ ক্যারোলিনা রাজ্যের সঙ্গমে। মূলত টেনেসি রাজ্যেই আছে বেশির ভাগ অংশটা। শীতের সময় বেশ ঠান্ডা থাকে যার ফলে এখানকার গাছ গুলো প্রায় নিষ্প্রাণ অবস্থায় দাড়িয়ে থাকে। কিন্তু এখানে ফল কালারস্,বলে রাখা ভালো আমারা যাকে শরৎকাল বলি এখানে তাকে বলে ফল সেসেন।  যাই হোক এই ফল কালারস্ সময়ই হচ্ছে যথার্থ সময় যেসময় এখানে দেখা যায় চারিদিকে রঙের খেলা। যেন চারদিক থেকে কেউ  বলছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাওগো এবার যাবার  আগে।”বিরাট পাহাড় এর গা বেয়ে বিভিন্ন রংবেরঙের খেলা। যেন সে রং এসে লাগছে অন্তরে। রঙের খেলায় মেতে উঠেছে প্রকৃতি। মনে পরে গেল শান্তিনিকেতনের পলাশ ফুলের মেলা, যদিও সেটা বসন্তের সময়। কবিগুরুর কথায় আবারো বলতে হয় “রং যেন মোর মর্মে লাগে” এই পাহাড় ঢালে আবর্তিত হয় এখানকার মানুষের জীবন। ঝকঝকে রাস্তাগুলো আধুনিকতার মাত্রা আর প্রকৃতির আদলে  বাঁচার এক স্বাদ।  পাহাড়ের খাদ থেকে মেঘের ঘনঘটা  আহ! কি অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এই মেঘ গুলোকে দেখে মনে হচ্ছে  চারিদিকে ধোঁয়ার কুহেলিকা। এই ধোঁয়া দেখতে অনেকটা সিগারেটের ধোয়ার মতো। তাই এই  জায়গার নাম স্মোকি মাউন্টেন। তখন থাকতাম জর্জিয়ার আটলান্টা শহরে। আটলান্টা থেকে যখন বেরোলাম তখন বেশ সকাল, গাড়ি ছাড়ল  স্মোকি মাউন্টেন দেখার উদ্দেশ্যে। বাইরের পরিবেশটা খুবই চমৎকার। গাঢ় নীল আকাশ। ততক্ষণে সূর্যদেব খানিকটা তেজি হয়ে উঠেছে। চিকচিকে রোদ। হিম শীতল বাতাস। দূর আকাশের কোথাও মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। দূর প্রান্তরে কিছুটা কুয়াশা। ঠিক যেন শরতের ভাব! দ্রুত বেগে চলছে গাড়ি  ইন্টার স্টেট রোড দিয়ে। পথের দুই ধারে বিস্তৃত বন। সামনে অন্তহীন পথ চলে গেছে উঁচু–নিচু পাহাড়ের কোলে । আটলান্টা থেকে সেখানে পৌঁছতে প্রায় চার ঘন্টা মত গাড়িতে লাগে । আটলান্টাকে পেছনে ফেলে হাইওয়ে ধরে চলছি আমরা। পথের দুই ধারে ছোট ছোট পাহাড়ের মেলা । অন্তহীন পথে এঁকেবেঁকে ছুটে চলছে গাড়ি । পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে দিগন্তের উঁকিঝুঁকি। ঠিক যেন পাহাড়ে ঘেরা কোনো এক কল্পনার জগৎ ! আরও কিছুটা এগোতেই পথের বাঁকের পরিমাণ বেড়ে গেল। এখান থেকে স্মোকি আর শত মাইলের পথ। পাহাড়ি চরাই-উৎরাই  পথ ধরে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে থাকে গাড়ি । যতই ওপরে উঠছি ততই যেন স্মোকির স্নিগ্ধ রূপের ছোঁয়া একটু একটু করে অনুভব করছি ।আমরা গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের ধার ঘেঁষে ড্রাইভ করতে থাকলাম। মুগ্ধ চিত্তে প্রকৃতির এত অপরূপ  রূপ দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। স্মোকি মাউন্টেইনে শীত বা গ্রীষ্ম যেকোনো সময়েই কুয়াশার চাদরে মুড়িয়ে থাকে। ধোঁয়াশা ভরা সকাল পেরিয়ে ভাঙা নরম এক ফালি রোদ স্মোকি মাউন্টেইনের পাহাড়ি পথের মাটি স্পর্শ করে।  অদ্ভুত কুয়াশাই এই পাহারের মাহাত্ম্য । নামকরণ সেই জন্য স্মোকি মাউন্টেন যথার্থই সার্থক।

 পথে আমরা বেশ কিছু দর্শনীয় জায়গা দেখেছিলাম। প্রথমেই যেটা দেখি নর্থ ক্যারোলিনায় চেরোকি জায়গাটি। যেখানে চেরোকি আদিবাসী অর্থাৎ নেটিভ আমেরিকানদের বাস। আমেরিকার আদিবাসীদের নেটিভ আমেরিকান বা ইন্ডিয়ান বলা হয়। তাদের একটি উপজাতির নাম হল চেরোকি। আমরা যখন সেই জায়গাটায় পৌঁছেছিলাম তাদের একটি বিশেষ উৎসব চলছিল।  দেখলাম কয়েকজন চেরোকি বিভিন্ন গান-বাজনা করছে তাদের ভাষায়। তাদের পোশাক ছিল এক ধরনের গাছের ছাল।  কোন পালক জাতীয় পোশাক  তারা শরীরে পরিধান করে আছে আর সারা শরীরে মাথায় গলায় বিভিন্ন পাখির পালকের গয়না পড়ে আছে। তারা কথা বলছে বা গান করছে তাদের নিজেদের ভাষায় , তাদের ভাষাটি একটু অদ্ভুত ধরনের যেটা আমার একটুও বোধগম্য হলো না। কিন্তু তারা খুবই মিশুকে।টুরিস্ট যারা ছিল তাদেরকে ডেকে ডেকে তারা  ছবি তুলছিল। এই ব্যাপারটা বেশ লেগেছে।

এরপরে যে জায়গায় আমরা গেলাম সেটি হল ওকোনালুফি দক্ষিণ-পূর্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত উত্তর ক্যারোলিনার গ্রেট স্মোকি পর্বতমালার একটি নদী উপত্যকা। সেখানে  আছে একটি চেরোকি গ্রাম। এটি  অ্যাপালাচিয়ান পার্বত্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত । উপত্যকার তলদেশটি এখন গ্রেট স্মোকি পর্বতমালার জাতীয় উদ্যানের অন্তর্গত।   উত্তর ক্যারোলিনা রাজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার। স্মোকি মাউন্টেন যাওয়ার পথে ইতিহাসের এই নিদর্শনটি  দেখার জন্য আমরা কিছুক্ষন এখানে গাড়ি থামালাম । স্মোকি মাউন্টেন যাওয়ার পথে ভ্যালি দেখার জন্য এটি  দুর্দান্ত জায়গা।এখানে একটি  প্রাকৃতিক ট্রেইল এবং পুরানো বিল্ডিং রয়েছে তবে আমার প্রিয় অংশটি হল এল্ক! এরা কেবল মাঠে চরে বেড়াচ্ছে বা শুয়ে আছে। তারা দেখতে বিশাল এবং সুন্দর। আমেরিকার পার্কগুলির দর্শনার্থী কেন্দ্রগুলি সর্বদাই সুন্দর। সুন্দর মানুষ, শীতল স্মৃতিচিহ্ন, সুন্দর বিল্ডিং এবং সর্বোপরি খুব মূল্যবান এবং আকর্ষণীয় তথ্য।  ১১ মাইল কেডস কোভ লোপের মধ্যে চোখে পড়বে আঠার শতকের বাড়ী। কেউ বসবাস করে না-দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। স্মোকি পর্বতমালা জাতীয় উদ্যানের প্রতিটি দর্শনার্থী কেন্দ্র আলাদা কিছু মাত্রা বহন করে । এই দর্শনার্থী কেন্দ্রে একটি খামার বাড়ি আছে যাকে বলা হয় ফার্ম হাউস।   ঘুরে ঘুরে দেখলাম  বেশ কয়েকটি বিল্ডিং, আপেল গাছের একটি ছোট স্ট্যান্ড এবং বৃহত্তর ক্ষেত্র রয়েছে।  নদীর তীরে এমন একটি ট্রেইল রয়েছে যা চেরোকিদের  স্মৃতি বহন করে।এখানে  আছে  বসন্ত ঘর, ধোঁয়া ঘর, বড় শস্যাগার শস্য কল এবং একটি সুন্দর স্রোতের পাশেই কাঠের ফালি দিয়ে তৈরি সমস্ত বাড়ি সহ সম্পূর্ণ খামার। এল্করা  আজ প্রকাশ্যে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছিল,এতো কাছ  থেকে এল্ক কোনোদিন দেখিনি।ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়বে উন্মুক্ত স্থানে হরিণ। অবাধ ও সাবলীল হরিণের বিচরণ দেখে মনে হতে পারে এখানকার মানুষগুলি বুঝি হরিণের বন্ধু, অবলীলায় যাদের পাশাপাশি ঘুরে বেড়াচ্ছে।  আমরা বেশ কয়েকজনের কাছাকাছি এসেছি কিন্তু আমরা খুব যত্নবান ছিলাম যে খুব বেশি কাছাকাছি না যাওয়া যে পশ্চাদপসরণটি কঠিন হত। সব মিলিয়ে  গ্রেট স্মোকি মাউন্টেন ট্যুরে এটি একটি  দুর্দান্ত স্টপ। এখানে  একটু  টিফিন করে নিলাম।একটু  ফ্রেশ  হয়ে নিয়ে, ছায়াশীতল গাছের পদতলে একটু  জিরিয়ে নিলাম। 

চিয়ো, লিটল টেনেসি, নানতাহালা, ওকোনালুফি এবং টুকসেসি নদী নর্থ ক্যারোলিনা স্মোকি পর্বতমালা দিয়ে গ্রেট স্মোকি পর্বতমালার জাতীয় উদ্যানের প্রান্তে ফন্টানা হ্রদে প্রবাহিত হয়েছে। এই নদী, পথের হ্রদ এবং তাদের জলাশয়গুলি দক্ষিণ-পূর্ব আমেরিকার বৃহত্তম এবং সর্বাধিক পরিদর্শন করা বহিরঙ্গন বিনোদন অঞ্চলের “অবকাঠামো” তৈরি করতে জাতীয় বন এবং দুটি জাতীয় উদ্যান ইউনিটকে ঘিরে রেখেছে। 

আমেরিকার  ইতিহাসে অ্যাপালাচিয়ান পর্বতমালার ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং গ্রেট স্মোকি পর্বতমালা জাতীয় উদ্যান এই অংশটিও খুবই  জনপ্রিয় । এই পর্বতগুলি প্রাগৈতিহাসিক কালে  ইন্ডিয়ান্স থেকে ১৮ শতকের ইউরোপীয় জনবসতি  এবং বিংশ শতাব্দীতে সিভিলিয়ান সংরক্ষণ কর্পস থেকে হাজার বছর ধরে রয়েছে। ইতিহাস, বন্যজীবন এবং প্রকৃতির সুরক্ষা পার্কের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। পার্ক পরিদর্শন করার সময় অনেক দুর্দান্ত আকর্ষণ আছে যা আমরা ড্রাইভ পথে  দেখেছিলম । সর্বাধিক জনপ্রিয় আকর্ষণ হ’ল কেডস কোভ। অন্যগুলির মধ্যে রয়েছে:, ক্যাটালোইচি, এলকমন্ট, মাউন্টেন ফার্ম জাদুঘর এবং ওকনালুফ্টির মিঙ্গাস মিল। টেনেসি এবং স্মোকিজের সর্বোচ্চ পয়েন্ট ক্লিংম্যানস গম্বুজ। 

গ্রেট স্মোকি পর্বতমালা জাতীয় উদ্যানের সর্বোচ্চ-উচ্চতা বিশিষ্ঠ পর্বত। ৬৪৮৩ ফুট উচ্চতায় ওঠা ক্লিংম্যানস গম্বুজটিও অ্যাপালাচিয়ান পর্বতমালার মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ।আজ রোদোউজ্জ্বল পরিষ্কার দিনে  ভিউগুলি ১০০ মাইলের বেশি প্রসারিত হচ্ছে । খুবই  রোদোউজ্জ্বল দিন ছিল। পাহাড়ের বাঁকা পথে পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম স্মোকি মাউন্টেনের সর্বোচ্চ পয়েন্ট ক্লিংম্যানস ডোম। ৬৬৮৩ ফুট উঁচু চূড়ায় গাড়ি ক্লিন্সম্যানস ডোমের কাছে পার্ক করা হল । তারপর মাইলের মতো হাটতে হয়েছে। এত খাঁড়া পাহাড়- প্রায় পাঁচশ ফুট না পেরোতেই একটু  বিশ্রাম নিলম । বিশ্রামের জন্য কংক্রিটের বেঞ্চ রয়েছে। খাড়া পথ পেরিয়ে সেই প্রতীক্ষিত সর্বোচ্চ পয়েন্টের অবজারভেশন টাওয়ারে। এখান থেকে ১০০ মাইল পর্যন্ত দেখা যায়। ৩৬০ ডিগ্রিতে প্রায় ৭টি অঙ্গরাজ্য দেখা যায় বলে কথিত আছে । মেঘের দলকে ওপর থেকে দেখার এ এক অনন্য অনুভূতি। যেন ভুলিয়ে দিয়েছে মাইল খাঁড়া পথের ক্লান্তি।বাইরের দিকে নজর পড়তেই মনে হলো অপরূপ স্নিগ্ধ প্রকৃতি যেন তার অপরূপ-সাগরে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পাহাড়ের ওপর পাহাড়, মেঘের ওপরে মেঘ জমেছে। পর্বতের কোলে ঢলে পড়ছে ধোঁয়াটে মেঘের দল। পাহাড়ের বুক চিরে এঁকেবেঁকে চলে গেছে বাঁধাই করা পথ। পথের মাঝবরাবর হলুদ দাগ কাটা। ডান পাশটা উঠে গেছে খাঁড়া ওপরের দিকে। অন্যদিকে গভীর খাদ।  একটুখানি বেঁকে তাকালেই দেখা যায় কেমন করে খাঁড়া পাহাড়ের বুক চিরে ঝুলে আছে গাছের লতাপাতা। পথের বাঁ পাশটা নেমে গেছে সোজা নিচে। কী অদ্ভুত নিয়মে নিচের দিকে চলে যাওয়া খাঁড়া ঢালের বুক চিরে গজিয়েছে কয়েটা উঁচু উঁচু বৃক্ষ! যতই এগিয়ে যাচ্ছি ততই বেড়ে চলেছে আঁকাবাঁকা পথ। ডান পাশে পর্বতের খাঁড়া চূড়াটা আড়াল করে রেখেছে পশ্চিমের আকাশে হেলে পড়া সূর্যটাকে। বাঁ দিকে খানিকটা দূরে আরেকটি পাহাড়। ওই পাহাড়ের ঢালে সূর্যের আলোর চিকচিকে প্রতিফলন। আকাশ জুড়ে নীল সমুদ্রের বুকে বিকেলটা যেন একটু একটু করে ঢলে পড়ছে। একটু একটু করে ভারী স্নিগ্ধ আমেজে শিথিল হয়ে পড়ছে সূর্যের তেজটাও। পড়ন্ত বিকেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরাও ছুটে চলেছি একটু একটু করে। প্রকৃতির মাঝে এ এক অনবদ্য আয়োজন। দুই পাহাড়ের মাঝে রাজ্যের প্রান্তসীমা।  এখানে  শান্তিনিকেতনের পলাশের নামগন্ধ নেই, শুধুই সবুজ পাতার বাহার, সঙ্গে রং বেরঙের অনেক গাছ,কোনটা লাল,কোনটা হলুদ কমলা যেন নানান রঙের খেলা । নতুন পাতার সৌরভে আরও নানান বৃক্ষের সমাবেশ। সেই জঙ্গল পেরিয়ে পাথরের মাঝে ছলাৎ ছলাৎ বয়ে আসছে অবিরত শীতল জলের ধারা। মেঘভাঙা রোদে, আদুরে দুপুরে প্রকৃতি উদার-উদাস। সঙ্গে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল পাথর। শনশনে ভেজা বাতাসে, সবুজ পাতার আন্দোলন।

দুই হাজার দুশো মাইল এলাকা জুড়ে ঢলে  পড়া সর্পিল পথ ,–আপ্যালাচিয়ান  মাউন্টেন ট্রেইলের ভিতর দিয়ে ।এই প্রাকৃতিক ন্যাশনাল পার্কটি  শীত বা গ্রীষ্ম , বছরের  সব ঋতুতেই গভীর কুয়াশায় জড়িয়ে থাকে। শীতল আৰ্দ্ৰ জলবায়ু সমৃদ্ধ অনন্য আবহাওয়ার অঞ্চল।  চারিদিকে ধোঁয়াশায় ঢাকা, মনে হচ্ছে পাহাড়ের সাথে নিজেরাও  মেঘের সাগরে ডুব দিয়েছি । দুই পাহাড়ের  রাজ্যের প্রান্ত সীমা —আমেরিকার টেনেসি  ও নর্থ ক্যারোলিনা ষ্টেটের সীমান্তে অবস্থিত।স্মোকির চার দিকের জঙ্গল পাহাড়ী পরিবেশ আসন্ন বসন্তের রঙে রঙিন ।  হলদে সবুজে অথবা ধূসর মেরুন -নানা রঙের পাহাড় গুলোর গায়ে  নীলচে কালো মেঘেরা  দলে দলে ভেসে এসে চিরকালীন শান্তির বাসা বেঁধেছে ।  যেদিকে তাকাই  শুধুই মেঘে ঢাকা —মেঘেদের রাজপ্রাসাদ , মেঘের স্বপ্নপুরি, মেঘের সমুদ্র, ভেজা ধোঁয়াশায় ভরা কালচে স্লেট রঙের মেঘ এই পাহাড়ী  এলাকার সর্বত্র।  কোলাহলমুক্ত নির্জনতা, আরামদায়ক শীতল বাতাস ও সবুজের মাঝে আরও বেশি রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম যখন কিছু দূর ওঠার পর প্রকৃতি দৃশ্যমান হচ্ছিল। ধীরে ধীরে চোখের সামনে ফুটে উঠছিল আশেপাশের অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতির রূপ, যা অগ্রাহ্য করে পথ চলা সম্ভব নয়। তাই মাঝে মাঝে বিশ্রামের নামে এই প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে বসেছিলাম আমরা। দিনের বেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে শীতল হাওয়ার পরশ থাকলেও সূর্য্যাস্তের পর হীম শীতল বাতাসে ডুবে যায় সম্পূর্ণ স্মোকির পাহাড়ী অঞ্চল। সূর্যের বিদায়ী বেলা আসন্ন প্রায় , শেষ বিকেলের একমুঠো  আলো যা ছিল তাও এখন মেঘের থেকে মেঘের পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পরে গিয়ে কুয়াশায় আবৃত হয়ে গিয়েছে । ঠান্ডা শীতল ধোঁয়ায় ঢাকা এই ন্যাশনাল পার্ক  নাম পেলো  স্মোকি মাউন্টেন । সংক্ষেপে  তাকে স্মোকিসও বলা হয়।আমরা মনোরম দৃশ্যটি উপভোগ করার সাথে সাথে, পার্ক জুড়ে অনেকগুলি  প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করলাম । অসামান্য  উপত্যকাগুলির পাশাপাশি পর্বত প্রবাহ এবং জলপ্রপাতগুলির দিকে  অন্তহীন দৃষ্টিনিক্ষেপ করতে  সক্ষম হলাম ।এখানে বেশ কিছু ছবি ক্যামেরা বন্দি করলাম।  ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি পড়ছে-আবার বৃষ্টি চলে গিয়ে ঝলমলে আকাশ। ক্লিন্সম্যান ডোমের সাড়ে ছহাজার ফুট উঁচুতে মৃত্যুবিক্ষুব্ধ চক্রাকার পথ বেয়ে ভূমি থেকে উঁচুতে উঠছে গাড়ী। শুরুতে অনেকটা রাঙ্গামাটির পাহাড়ের মত। উচ্চতাভীতি থাকলে নিচে তাকালে শরীর হিম হয়ে আসবে। পাহাড়ে গায়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকালে মনে হয়-কত প্রাচীন ইতিহাস লেখা আছে শিলার গায়ে। কেবল মনের চোখই তা পড়তে পারে-কল্পনা সেই গল্প অনুভব করতে পারে। বৃষ্টি কেটে গিয়ে এখন আকাশে  রংধনুর দেখা মিললো। হ্রদয়ে এক প্রশান্তির ছোঁয়া বয়ে গেল। 

তারপর গেলাম গ্যাটলিংবার্গ শহরে। হাইকিং ট্রেলস, স্কিইং, হোয়াইটওয়াটার রাফটিং, ক্যাম্পিং, অনন্য স্থানীয় শিল্পকলা ও কারুশিল্প, কেনাকাটা, আকর্ষণীয় বিনোদন এবং সমস্ত রেস্তোরাঁ যা সব মিলিয়ে ছিল এক অত্যাকর্ষনীয় স্থান।  এটিই দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় জাতীয় উদ্যানের প্রবেশদ্বার।এখানে আছে শহরে পর্যটকদের জন্য সব দোকানপাট। দু’একটা দোকান ঘুরে দেখলাম। একটা গিফট শপে ঢুকে ঘোরাঘুরি করছি-বাইরে তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। স্থানীয় দোকানিরা জানালেন এখানে আবহাওয়ার অবস্থাও এরকমই। এই রোদ এই  বৃষ্টি।গ্যাটলিনবার্গে প্রাকৃতিক দৃশ্য ছাড়াও আরও অনেক কিছুই রয়েছে ,যেমন  স্কি রিসর্ট, প্রমোদ উদ্যান, অ্যাকোয়ারিয়াম, জল – উদ্যান, যাদুঘর সমূহ। গল্ফ খেলার মাঠ,  রাতের খাবারের দোকান বিকল্পগুলি প্রচুর। পারিবারিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ গন্তব্য, দু’জনের জন্য রোম্যান্টিক গেটওয়ে বা দৃষ্টিভঙ্গি সতেজ করার জন্য, দৃশ্যের সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য  গ্যাটলিনবার্গ শহরে অনেক কিছু রয়েছে।

গ্যাটলিংবার্গ শহরে চেম্বার অফ কমার্সের ব্যবসায়ী সদস্যদের জন্য স্থায়িত্বমূলক উদ্যোগ, যা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের স্ব-মূল্যায়ন, পদ্ধতি পরীক্ষা, লক্ষ্য নির্ধারণ এবং ক্রিয়াকলাপের ক্রমাগত উন্নতির দিকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণে ডিজাইন করা হয়েছে। শহরে তিনটি পার্ক প্রবেশদ্বার সহ, গ্যাটলিনবার্গ  প্রতি বছর ১১ মিলিয়ন  দর্শনার্থীদের অনেকের জন্য বেসক্যাম্প হিসাবে কাজ করে। দশকেরও বেশি সময় ধরে, ৩,৯০০ জন বাসিন্দার ছোট্ট এই পাহাড়ী শহরটি কয়েক মিলিয়ন পার্ক দর্শকদের উষ্ণ অ্যাপল্যাচিয়ান আতিথেয়তার জন্য স্বাগত জানায় । ছুটি কাটানো , আউটডোর অ্যাডভেঞ্চার, পারিবারিক মজা এবং স্মৃতি তৈরির জন্য বিশ্বজুড়ে এখানে  লোকেরা আসে। গ্রেট স্মোকি পর্বতমালার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে চারদিকে ঘেরা গ্যাটলিনবার্গ আমেরিকার এক অন্যতম দুর্দান্ত পর্বত অবলম্বন গন্তব্য যা হরেক রকমের স্থানীয় এবং জাতীয় রেস্তোঁরা এবং আকর্ষণীয় স্থানের জন্য গর্বিত। গ্যাটলিনবার্গ পাহাড়ী ঐতিহ্য এবং সেই ঐতিহ্যের প্রতিফলনকারী শিল্পকলা, কারুশিল্প এবং দোকানগুলির মধ্যে তার চলনযোগ্যতার জন্য নিজেকে গর্বিত করে।

বিকেল বেলায় ডাউনটাউন পার্কওয়ে দিয়ে হাঁটা খুবই সুন্দর সুযোগ গ্যাটলিনবার্গ শহরকে উপভোগ করার জন্য। এটি দেখার মতো প্রচুর পরিমাণে ভীড় জমে। বিকেলে আমরা নদীর  ধার ধরে  কিছুক্ষন হাঁটলাম।  রাস্তার  ধারে ধারে বেঞ্চগুলিতে একটু বসলাম, সাথে লিটল পায়রা, নদীর প্রফুল্ল গান উপভোগ করলাম। পূর্ব পার্কওয়ে  গ্লাডেস রোডের কোণে নোঙ্গর করা, গ্রেট স্মোকি আর্টস এবং ক্রাফ্টস সম্প্রদায়ের সূচনা খুঁজে পেলাম। আট মাইলের লুপ বরাবর কারিগর এবং শিল্পীদের বৈশিষ্ট্যযুক্ত ১০০ টিরও বেশি দোকান, এটি উত্তর আমেরিকার স্বাধীন কারিগরদের বৃহত্তম সমাবেশ। এখানে একজাতীয় কারুশিল্প, কোষাগার এবং শিল্পকর্ম আবিষ্কার করলাম। 

সূর্য অস্ত যাবার পরে, শহরতলিতে ঘুরতে খুব ভালো লাগে।  প্রচুর পরিমাণে ডাইনিং এবং বিনোদন আছে এখানে । গ্যাটলিনবার্গ স্কাইব্রিজ থেকে সিটি লাইটগুলি অসাধারন। দেখলাম সেখানে একটি অনুষ্ঠান চলছে সেদিন, টেনেসি রাজ্য আমেরিকান মিউজিকের জন্য বিখ্যাত,তাই আমরা  সন্ধ্যা  বেলাটা  সেই  গানের অনুষ্ঠানটি  উপভোগ করলাম । শেষে  একটি আইসক্রিম পার্লারে  ঢুকলাম, বেশ মজা করে  আইসক্রিম এর সাথে সেদিনের সন্ধ্যাটা  উপভোগ করলাম। 

অসাধারণ নিসর্গের আভা, শ্রাবণের ধারায় লেকের জল টইটম্বুর, পাহাড়ের কোলে সবুজেরা আরও সবুজ, এসব যেন এপথের উপচে পড়া সৌন্দর্য । মাইল এবং পাকা পর্বতারোহণের ট্রেলগুলি ছাড়াও, আমি মনে করি যে এই পার্কটি সম্পর্কে আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি তা হল অঞ্চলটির ইতিহাসের দুর্দান্ত সংরক্ষণের সাথে দর্শনীয় দৃশ্য এবং দৃশ্যের সংমিশ্রণ। প্রকৃতির নিখরচায়, ভর্তি টাটকা বায়ু – এত সুন্দর! পরদিন সারা বেলা বিভিন্ন জায়গা ঘুরলাম।  এবার বাড়ি ফেরার পালা।  আমরা বিকেলের দিকে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।আবারও পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। পাহাড়ের দৃশ্য আবার কিছুটা উপভোগ করলাম ড্রাইভে।  পথে গোধূলি যতই গাঢ় হয়ে আসছে ততই যেন কুয়াশার প্রকোপ বেড়ে চলেছে। দেখতে দেখতে একসময় দূর দিগন্তে রক্তিম সূর্যটা ঢুপ করে ডুবে গেল। একটু একটু করে সাঁঝের টানে আঁধার করে আসে চারপাশটায়। নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে চারপাশের কোলাহল। প্রকৃতির স্নিগ্ধ নীরবতাকে সঙ্গী করে ঘরে ফিরতে শুরু করে ভ্রমণপ্রেমী মানুষ। নিয়মের বেড়াজালে আমরাও ফিরছি সেই পথে। কিছুটা সময়ের মধ্যে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে পড়েছে চারপাশটা। এই ভ্রমণের একরাশ স্মৃতি মনের গভীরে গেঁথে নিয়ে ফিরছি বাড়ি।সঙ্গে আছে ক্যামেরাবন্দী করা অসাধারণ কিছু মুহূর্ত। 

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleSlaying of Bakasura
Next articleদ্বিত্ব
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments