নর্থসিকিম
আমরা আগের বছর জুন মাস থেকে বাইকট্রিপ শুরু করি। প্রথম ট্রিপ ছিল সিকিমের উত্তরে একটুকরো স্বর্গ গুরুদোংমার।। সিকিম (কতবার এই নিয়ে সেটা বাদ দিলাম যা হোক ভাবতে পারেন পূর্ণ স্বাধীনতা)। এবারেও আমাদের বাহন ১৬০ সিসির বাইক apache rtr 160, আমার নীলাদ্রি, সঙ্গে আমার শয়তান, থুড়ি আমার স্ত্রী, সেই এই গল্পের কথক। তোর তার বিস্তারিত ঘটনা তার মুখেই শোনা যাক, শুরু করো তবে।

প্রত্যেকটি ট্রিপে বাইকটি চালায় আমার কর্তা আর আমি pillion হিসেবে ওর পেছনে বসে যেতে পছন্দ করি যদিও সেটা কম কঠিন কাজ নয়। ওর অসম্ভব জেদ আর মনের জোরের জন্যই মাত্র 160 cc এর গাড়িতে আমরা (me and my golu cum husband) এতগুলো জায়গায় যেতে পেরেছি। আমরা যখন প্রথম বাইকট্রিপে সিকিম যাই তখন সেই group এ কোন মহিলা সদস্য ছিল না। group টির কিছু সদস্য আমাকে নিয়ে যাওয়ার বিরূদ্ধে ছিল। কিন্তু আমার বর কিন্তু আমাকে সঙ্গে নিয়েই গেছিল। আজ সেই সদস্যদের মত বদলেছে এবং তারা তাদের স্ত্রীকে নিয়েই ট্যুরে যায়। এই ট্রিপের পরে আমি একটি couple riding group #the_living_lives (কাল্পনিক গল্পের স্বার্থে) এর সাথে যুক্ত হই যেখানে আমাদের মতই অনেক couple একসাথে bike trip এ যায়। পূজোর এই ট্রিপটি এই group এর এমনই চারজন couples মানে total ৮ জন সদস্যের।

এই ট্রিপটা শুরু হয়েছিল মহালয়া থেকে আর শেষ হয়েছিল দশমীতে। সিকিম যেমন সুন্দর তেমনি ভয়ঙ্কর। বর্ষার পরে প্রকৃতি যেমন সুন্দর থেকে আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে তেমনি ধ্বস নেমে রাস্তাও আরো সুন্দর হয়ে গেছে। তাই প্রথম প্রথম এই সময়টা সিকিম ভ্রমনের অনুপোযুক্ত মনে হলেও কর্তার জেদে চলে যাই আর অনেক ভয়ঙ্কর সুন্দর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফিরি। দলের সবার সিকিমে বাইকট্রিপ প্রথম কিন্তু আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলেও এইবারের ট্রিপ মনে রাখার মত।

এই ট্রিপ নিয়ে সংশয় ছিল প্রথম থেকেই কারন হোটেল অনেককষ্টে দুইমাস আগে বুক হয়েছিল কিন্তু পূজোর জন্য দু-একটি বাদ দিয়ে সবকটিই ছিল non refundable। হোটেল যাও বা বুক হল এল ছুটির সমস্যা। কিছুতেই একজন ছুটি পেল না তাও ঢপ দিয়ে যাবে স্থির করল। আর আমি এবার ঠিক করলাম আমাদের group এর doctor couple দের সাথে ট্রেনে যাব। ওরা শিলিগুড়ি থেকে bike rent নেবে আর আমি দখল করব আমার apache এর backseat টি (নীলাদ্রি কে না নিয়ে যেতে পেরে অনেক কষ্টে ছিলো সে আসলে রক্তের টান তো যদিও মুখে প্রকাশ করেনি আমার জন্যই খুব ভালোবাসে আমাকে তাই)।

সেইমত টিকিট অবশ্য তিনমাস আগেই বুক করেছিলাম পদাতিকে। যাওয়ার ঠিক কদিন আগে সিদ্ধা নির্মিয়মান আবাসন এর পাশের লামপোস্ট হল accident। আমার আর আমার বরের পা এর আঙুল গেলো dislocate হয়ে আর আমার পায়ের গোড়ালির উপর বাইক পড়ে পা গেল বেঁকে(কাল্পনিক)। পরেরদিনই x-ray করতে ছুটলাম। যাক গে বাবা কিছু হয়নি, হলেও যেতাম। কিন্তু পায়ে অসহ্য ব্যথা আর বাইকে দেখা দিল নানা সমস্যা। যাওয়ার দিন পর্যন্ত রাত ১০ টা পর্যন্ত নীলাদ্রি আর নীলাদ্রির মালিক ছিল service centre এ। এভাবেই মহালয়ার দিন এল‌। দেবীপক্ষের ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের গলায় মহিষাসুরমর্দিনী শুনতে শুনতে ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি পূজো দিয়ে এলাম। মাগো আমাদের সঙ্গে থেকো, রক্ষা করো, সাহস দিও। এই বলে রাত্রের পদাতিকে আমরা রওনা দিলাম আর বাকিরা রাত ৩ টের সময় বাইকে।

শিলিগুড়ি শহরটা আমার খুব প্রিয়। নাম শুনলেই মনে হয় পাহাড়ের কাছাকাছি এসে গেছি। আমাদের পদাতিক indian railway কে অপমানিত করে একদম ঠিক সময়ে পৌঁছে গেল। আমি তো আরেকটু হলেই আলিপুরদুয়ার চলে যেতাম। কারন আমি ট্রেনে উঠেই ঘুম দি আবার ঘুম থেকে উঠেই নেমে পড়ি। যাইহোক এ যাত্রায় নিউ জলপাইগুড়িতেই নামি। নেমে দেখি প্রচন্ড বৃষ্টি। কোনরকমে একটা অটোতে চড়ে হোটেল পৌঁছাই।

আমাদের phoenix lodge এ বুকিং ছিল। গিয়ে একটু fresh হয়ে নিলাম। আর কোন কাজ নেই,কারন বাকিদের আসতে রাত হবে। ভাবলাম বৃষ্টি থামলে bengal safari তে যাব। কিছুক্ষন বাদে বৃষ্টির জোর কমলে lunch করতে গেলাম। মেনু ছিল ভাত, ডাল, ঝুড়ি আলুভাজা, আর মটন। এখানে দেখলাম মটনের দাম chicken এর থেকে কম। কাঁসার থালায় কলাপাতায় দুপুরের খাওয়াটা বেশ ভালোই হল। খাওয়ার পর হজমোলার ব্যবস্থাটা আমার বেশ ভালো লাগল। আমরা খাওয়া দাওয়ার পর প্রথমে টোটো আর তারপর অটো করে গেলাম বেঙ্গল সাফারি।

শিলিগুড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে শালুগাড়াতে অবস্থিত এই পার্ক (আন্দাজ হতে পারে যায়নি কোনোদিন)। হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসাই যায়। এখানে বিভিন্ন ভাগে সাফারি করানো হয়। বাচ্চাদের জন্য বেশ ভালো। আসল জঙ্গলে artificial feelings আর কি। যাইহোক ac van এ সাফারি করে অস্বাভাবিক নাদুসনুদুস কিছু পোষা জন্তু দেখে একইভাবে ফিরে গেলাম শিলিগুড়ি। এবার কিছু street food চেখে দেখলাম আর মার্কেট ঘুরে দেখলাম‌। কিন্তু বৃষ্টির জ্বালায় দুজনে এক রিক্সায় চেপে ফিরে গেলাম হোটেল। এরপর শুরু হল অপেক্ষার পালা। এদের কোন পাত্তা নেই। আমরা কখনও আড্ডা মারছি, কখনও ঝিমুচ্ছি। দুজনে আর কি করব। প্রথমে ভেবেছিলাম ওরা এলেই রাতের খাবার খাব। কিন্তু বৃষ্টির জন্য দেরী হওয়ায় ওরা রাতের খাওয়া রাস্তায় সেরে নেয়। আর আমরা swiggy তে order দি।আবার মটনের দাম কম হওয়ায় রাতের খাবারের পাতেও তিনি। খেয়ে দেয়ে আর না পেরে t.v দেখতে দেখতে কখন যে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙে সেই মাঝরাতে। ওরা মনে হয় এল।

রাত তখন ১ টা। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে যে যার ঘরে বিশ্রাম করতে চলে গেল। আমি ওদের হয়ে check in করেই রেখেছিলাম, তাই আর কোন অসুবিধা হয়নি। কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত প্রচন্ড বৃষ্টি আর রাস্তা অতিরিক্ত খারাপ হওয়ায় এত দেরী। এই গল্প অবশ্য আমার কর্তার মুখে মুখে সারা ভারতবর্ষ হয়ে গেছে। এখনও যার সাথে দেখা হয় বলে কারন ওর কাছে এই যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা সত্যিই বীভৎস। তারমধ্যে একটি বাইকের হাইরোডে accident হয়ে গেছে এবং ওরা বেশ চোট খাওয়ায় সকলেই একটু চিন্তিত। যাইহোক পতিদেব ভেজা জামাকাপড় মেলে শুয়ে পড়ল। আর আমি তো ঘুমে অচৈতন্য।

পরেরদিন ঘুম যখন ভাঙল তখনও সবার মুখে আগেরদিন রাত্রের ক্লান্তির ছাপ। বোঝাই যাচ্ছে কি গেছে কাল ওদের ওপর দিয়ে। তার ওপর বৃষ্টি থামার নাম, গন্ধ নেই। কিন্তু থেমে থেকে লাভ নেই, এগোতে হবে। Doctor দাদা গিয়ে ওদের rent নেওয়া বাইকটা নিয়ে এল। আর সবাই টুকটাক কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করে রওনা দিলাম। টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চলা শুরু হল। আমি আমার বাহনে চড়ে বসলাম‌। শিলিগুড়ির জ্যাম কাটিয়ে সেবকে গিয়ে lunch সারা হল। এবার শুরু হবে পাহাড়ী রাস্তা।

এই রাস্তাটা এলে মন আনন্দে ভরে যায়। পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা আর সঙ্গে সেই পান্নারঙা তিস্তা। আমরা সেই রাস্তা বেয়ে উপরে উঠছি। এই অনুভব বোঝানো শক্ত। মন গেয়ে উঠল

মেঘ পিওনের ব্যাগের ভেতর,
মন খারাপের দিস্তা
মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়,
ব্যাকুল হলে তিস্তা।

এই টান সত্যি ব্যকুল করে দেয়, ঘরে থাকতে দেয় না। এর টানেই তো বারবার আসা। কখনও নদী স্থির, গম্ভীর কখনও বা খরস্রোতা। আর সবুজ পাহাড়ে মেঘেদের আনাগোনা। মায়াবী পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি। আমার তো মনেহয় যদি পাহাড় টপকে টপকে যাওয়া যেত। খুব ইচ্ছে করে পাহাড়ের একচূড়া থেকে আরেক চূড়ায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে তিস্তার এই সবুজ জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে। রংপো আসতে আসতেই সন্ধ্যা নেমে এল। পাহাড়ে অন্ধকারে পথ চলতে আমার বেশ ভালোলাগে। এইসময়ের নির্জনতা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। মাঝে মাঝে প্যান্ডেল চোখে পড়ল। কিন্তু ঠাকুরের মুখ ঢাকা। কলকাতায় কিন্তু এখন থেকেই ভিড় উপছে পড়ছে। তারজন্যই অবশ্য এখানে পালিয়ে আসা। গ্যাংটক পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। দেরী হয়ে যাওয়ায় লাগেজ রুমে রেখে খেতে যাওয়া হল। রাতের আলোয় ফাঁকা mg marg বড়ই সুন্দর।

মেঘের ব্যাগের ভিতর ম্যাপ রয়েছে,
মেঘ পিওনের পাড়ি
পাকদন্ডী পথ বেয়ে তার,
বাগান ঘেরা বাড়ি।(বাড়ি আর কোথায় পাব,তাই হোটেল)।

সবাই ঘুম থেকে উঠে এক চক্কর mg marg ঘুরে এল। আমি উঠে থেকেই জানলা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। কি সুন্দর। পাহাড় যে কেন এত ভালোলাগে?

অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।

… কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।

… যদি তার দেখা পেতাম,

দামের জন্য আটকাতো না।

সুনীলবাবু আমার মনের কথাই বলেছেন। মেঘে ঢাকা পাহাড় দেখতে দেখতেই তৈরী হয়ে নিলাম। আজ যাব লাচেন। আরো উচ্চতায়। পাগল করা সৌন্দর্য্যের টানে। আমরা highway ধরলাম। বৃষ্টি চলছে। বৃষ্টি বিশেষত পাহাড়ে বৃষ্টি আমার খুব পছন্দের। বাইকে যেতে যেতে মনে হচ্ছে প্রকৃতি যেন কোলে করে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। আর এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড় যাচ্ছি।

রাস্তার সৌন্দর্য্য অদ্ভুত সুন্দর। তেমনি ভয়ঙ্কর। ধ্বস নেমে অত্যন্ত খারাপ অবস্থা। পথে পড়ল seven sister falls. আমার water crossing গুলো দারুন লাগে (আন্দাজ ঠিক নাও হতে পারে মার্জনা)। রাস্তার উপর ঝর্ণা আমার খুব পছন্দের। এই পাহাড়ী ঝোরাগুলো কত সুন্দর। কি সুন্দর পাহাড়কে ছুয়ে রয়েছে সবসময়, আপনমনে কত উঁচু থেকে নেমে আসছে। আমি যদি নিজের ইচ্ছে মত এরকম চলতে পারতাম তবে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতাম , এই ঝোরাগুলোতে স্নান করতাম, আর পাহাড়ী অরন্যে দিন কাটাতাম।

এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই। সেই পাহাড়ের পায়ের কাছে থাকবে গহন অরণ্য|

অসম্ভব খারাপ রাস্তা পেরিয়ে চুংথাং পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। তার আগে মঙ্গনে lunch করে নিয়েছি। তবে মঙ্গন পর্যন্ত আরেকটি রাস্তা আছে খুব সুন্দর। আমরা আগেরবার ওই রাস্তা ধরেই এসছিলাম। মঙ্গনেই last perol pump. তাই full tank করেও আমরা হাতে ৫ লিটার এর pot নিয়ে বাইকে বসি। বাকি চারজন পিছিয়ে পড়ায় চুংথাং এ ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এদিকে আর্মি চেক পোস্টে আমাদের একসান ক্যামেরা (gopro ক্যামেরা) জমা রেখে দিয়েছে। ফেরার দিন দেবে। আমার এসবে দুঃখ নেই। আমার মনের ক্যামেরাই যথেষ্ট। এখান থেকে জানলাম ব্রীজ ভেঙে যাওয়ায় army camp দিয়ে যেতে হবে সেটা ৫টার পর যেতে দেবে না। এদিকে ওদের সাথেও যোগাযোগ করতে পারছি না। ধূর যা হবে দেখা যাবে ওরা এলেই যাব।

কিছুক্ষন ওরা আসায় বাইক ছোটানো হল। কিন্তু রাস্তা মাঝে মাঝেই খুব খারাপ, এদিকে বৃষ্টি। একটা রাস্তা এল খুবই খারাপ। আমি jerrycan হাতে ওই রাস্তায় বাইকে বসতে পারছিলাম না বলে নেমে গেলাম। কি চড়াই রাস্তা, আর উঁচু উঁচু পাথর, হাতে ৫ লিটারের তেল। সন্ধ্যা নেমে এসছে, বৃষ্টির ঝাপটায় চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে গেছে, কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। এদিকে ও ওই খারাপ রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, ওকেও দেখতেও পাচ্ছিনা। বাকিরাও এগিয়ে গেছে। হাতে jerrycan থাকায় না পারছি চশমা মুছতে, না পারছি মোবাইলে আলো জ্বালাতে। এদিকে ওই রাস্তার পাশে বৃষ্টিস্নাতা নদীর ভয়ঙ্কর গর্জন। মনে হচ্ছিল jerrycan টা ফেলে পালাই। কোনরকমে ওকে গালি দিতে দিতে অন্ধের মত রাস্তা পেরোলাম। আমার তো জিভ বেরিয়ে গেছে। ওকে দেখতে পেয়ে আরেক প্রস্থ গালমন্দ করে আবার বাইকে উঠে পড়লাম। আবার কিছু খারাপ রাস্তা পেরিয়ে এলাম army camp. কিন্তু দেরী হয়ে যাওয়ায় অনেক অনুনয় বিনয় করেও লাভ হল না। ফেরৎ চলে যেতে বলল। এই খারাপ রাস্তা পেরিয়ে আবার যেতে হবে? কি সর্বনাশ।

ওদিকে লাচেনে হোটেল বুক করা আছে? পয়সা তো গেল। আর এখন কোথায় যাব, কোথায় থাকব? আর গুরুদোংমার পরেরদিন যাবই বা কি করে? আমাদের আর এক পা এগোতে দিল না। আবার ঐ রাস্তা দিয়ে এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ফিরতে হবে? কি আর করা যাবে? সবাই একসাথে ফেরার পথ ধরলাম। কিন্তু থাকব কোথায়? কি বিপদ রে বাবা। আবার ঐ রাস্তায় আমি নেমে গেলাম, বাকিদের ও জোর করে নামালাম। একা একা বেশ ভয় পেয়েছিলাম। তার মধ্যে নিকষ কালো অন্ধকার আর লাচেন নদীর গভীর গর্জন। আবছা চিতার মত কিছু একটাও যেন আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। কোনরকমে বাইকে উঠে আমরা পালাই। চুংথাং এ গিয়ে আমরা একটি গুরুদ্বারে স্থান পাই। কথায় আছে “When God closes a door, He always opens a window.” ওই রাত আমার মনে হয় আমাদের সেরা রাত ছিল

আমাদের প্রথমবার গুরুদ্বারে প্রবেশ। ভগবানের অশেষ কৃপা না থাকলে এই ঘটনা ঘটত না। আমরা luggage গাড়িতে রেখে শুধু রাতটুকুর জন্য যা দরকার সেইটুকু নিয়ে রুমে যাই। বড় বড় ঘর। ছেলেরা একটা রুমে, আমরা মেয়েরা আরেকটি রুমে। fresh হয়ে এসে আলোচনায় বসা হল কাল কি করা হবে। Dominar সিদ্ধান্ত নিল কাল ওরা এখান থেকে লাচুং যাবে। কারন ওদের একবার অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ায় ওরা বেশ অসুস্থ, তার উপর আজ যা ধকল গেল। আর বাকিরা ভোরে বেরব, এখান থেকে লাচেনের হোটেলে luggage রেখে গুরুদোংমার। এখানে রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি হয়ে যায়, তাই তাড়াতাড়ি ঘুমানোও যাবে। এখানের খাবার পদ্ধতি খুব সুন্দর। আগে না এলেও জানতাম। মাথায় কাপড় দিয়ে নিজেদের বাসন ধুয়ে খেতে বসলাম। দুই হাত পেতে খাবার নিলাম। আর খাবার শেষে বাসন মেজে যথাস্থানে রেখে এলাম। একটু ঘুরে দেখে শুতে গেলাম। সবাই এলার্ম দিয়ে ঘুমাব ভাবছি, কিন্তু গল্প, আড্ডাই শেষ হয় না। এদিকে বৃষ্টি একটুও থামছে না। মনে সংশয় নিয়ে অবশেষে ঘুমালাম।

ভোর ভোর রওনা দিলাম। কিন্তু army camp নাকি ৬ টার আগে খুলবে না। যাইহোক আগে গিয়ে ওখানে বসে থাকব কিন্তু আর দেরী নয়। কিছু কাগজপত্র দেখে আমাদের তাড়াতাড়িই ছেড়ে দিল। army camp এর ভেতরের রাস্তা কর্দমাক্ত, উঁচু, নীচু। কিন্তু এখান দিয়ে যাওয়ার অনুভব টাই আলাদা। বেশ গর্ব হয় এদের জন্য। কিভাবে আমাদের রক্ষা করছে। army camp এর পর থেকে রাস্তার দৃশ্যই অন্যরকম। পাইনসারি আর রডোডেনড্রন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। সাদা চূঁড়ার হাতছানি কালকের সব কষ্ট ভুলিয়ে দিল। অবশেষে লাচেন পৌঁছালাম।

প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য উত্তর সিকিমের ছোট্ট গ্রাম এই লাচেন। ‘লা’ অর্থাৎ গিরিপথ আর ‘চেন’ হচ্ছে বড় অর্থাৎ বড় গিরিপথ। এর উচ্চতা ৯৫০০ ফুট(উচ্চতা সঠিক জানা নেই)। হোটেলে পৌঁছে luggage রেখে রওনা দিতে দিতে ৭টা বেজে গেল।

সবাই গুরুদোংমার রওনা দিল। যেহেতু আমার একবার ঘোরা তাই আর গেলাম না। সময়টা কিন্তু মন্দ কাটল না। ওরা বেরিয়ে যাবার পর হোটেলে আমার breakfast আর সবার জন্য lunch এর order দিয়ে হাঁটতে বেরোলাম। ঘন্টাখানেক লাচেনের রাস্তায় পাহাড়ের কোলে বন্য পাহাড়ী বৃক্ষলতায় নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। মেঘ ছুঁয়েছে পাহাড় চূড়া বরফ গলা নদী। লাচেন নদীর স্নিগ্ধ আওয়াজ, পাখির ডাক এসব ছেড়ে আসতেই ইচ্ছে করছিল না। বৃষ্টি নামায় ফিরে এলাম। পাহাড়চূঁড়া মেঘে ঢেকে গেছে।

কুয়াশা যদি বা ফেলে পরাভবে ঘিরি
তবু নিজমহিমায় অবিচল গিরি॥

আমার জন্য বানানো maggy টা আত্মসাৎ করে ঘুমোতে গেলাম। আমার হিসেব মত ওরা তিনটের মধ্যে ফিরে আসবে। ওরা আসার আগে lunch সেরে ready হয়ে থাকলাম। আমার হিসেব মিলে গেল। ওরা তিনটের মধ্যে চলে এল। এবার যাব লাচুং। সবাই চুংথাং থেকে গুরুদোংমার করে বেশ ক্লান্ত। তারমধ্যে xpulse একবার আছাড়ও খেয়েছে। যাইহোক গুরুদোংমার থেকে ফিরে এসে সবাই এতটাই আনন্দিত যেন মাউন্ট এভারেষ্ট জয় করে এসছে। সত্যি প্রথমবার যাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, আমারও এরকম অনুভূতি হয়েছিল। আমার বর তো দ্বিতীয়বার গেল। তার উত্তেজনার কথা বাদই দিলাম। গল্প বলেই যাচ্ছে। তাড়া দিয়ে বার করতে হল। লাচুং পৌঁছাতে একটু রাত হয়ে গেল।

লাচুং এ আমাদের oyo room বুক ছিল। আপনারা ঠিকই ধরেছেন, আমারও মনে হয়েছিল oyo scam হতে চলেছে। dominar আগেই পৌঁছে গেছিল। তারা খবর দিল যথারিতী hotel বুক নেই। যাইহোক মালিক খুব ভালো তাই কিছু অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে আমাদের রুম দিয়ে দিল। make my trip আর oyo তে অনেকক্ষন চেঁচামেচি করে টাকা refund নিয়ে ক্ষান্ত হলাম। কিছুক্ষন আড্ডার পর রাতের খাওয়া সারা হল। এখানে দুশো টাকায় unlimited ভাত, ডাল, তরকারি আর chicken। আমরা খাওয়ার পর নিশ্চয় আর unlimited system রাখবে না বিশেষত chicken। এদিকে অবিরাম বৃষ্টি চলছে। তাই কাল আর কেউ yumthung যেতে চাইছে না। আমি এসছি yumthung যাব বলে আর এরা বলে যাবে না। আমি যাবই কেউ না যাক আর কর্তাকে নিয়েই যাব। যাইহোক শেষপর্যন্ত hornet কে রাজি করিয়ে শুতে গেলাম। ঠিক হল আমরা ভোরবেলা উঠে yumthung, zero point হয়ে গ্যাংটক যাব। xpulse আর dominar এখান থেকে direct গ্যাংটক যাবে। দুশ্চিন্তা একটাই বৃষ্টি থামার নাম নেই, বরং জোর বাড়ছে।

সকালে উঠে দেখি বৃষ্টি থামলেও চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন। আমরা আর hornet রওনা দিলাম yumthung, zero point। রাস্তার সৌন্দর্য্য ভাষায় প্রকাশ করা অত্যন্ত জটিল। ইয়ামথাং ভ্যালী উত্তর সিকিমে অবস্থিত এবং হিমালয় পর্বতমালা দ্বারা বেষ্টিত। এই স্থানটি সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৩,৫৬৪ মিটার উঁচুতে অবস্থিত(উচ্চতা আন্দাজ প্রবন মার্জনা করবেন ভুল হলে)। এই অপরূপ স্থানটি ‘ভ্যালী অফ ফ্লাওয়ারস’ নামেই বেশী জনপ্রিয়। March, April এ এই স্থানটি রডোডেনড্রনে ভরে থাকে। বিভিন্ন রঙের যেন গালিচা বিছানো। সিকিমের রডোডেনড্রন বিশ্ববিখ্যাত। গোটা বিশ্বের রডোডেনড্রন মানচিত্রে সিকিম দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। আর এশিয়ায় প্রথম। ইয়ামথাং যেতে পড়ে সিংবা রডোডেনড্রন অভয়ারণ্য। এখানে ২৪ প্রজাতির রডোডেনড্রন ফোটে প্রত্যেক গ্রীষ্ম ও বসন্তে। এখানে একটি hotspring ও আছে।

ইয়ামথাং ভ্যালীর সৌন্দর্য্য যে কাউকে আচ্ছন্ন করে রাখবে।সবুজরঙা লাচুং নদী,বরফাবৃত পাহাড়ে ঘেরা এর রূপে আমরা বাকরূদ্ধ হয়ে গেলাম।

দাঁড়ায়ে গিরি, শির
মেঘে তুলে,
দেখে না সরসীর
বিনতি।
অচল উদাসীর
পদমূলে
ব্যাকুল রূপসীর
মিনতি॥

আরো কিছুক্ষন গেলে জিরো পয়েন্ট।জিরো পয়েন্টের দিকে যত এগোচ্ছি কাছে এবং দূরে বিভিন্ন আকারের পাহাড়ের রঙ ধূসর থেকে বাদামী হয়ে ক্রমশ কালো হয়ে যাচ্ছে। ইয়ামথাং থেকে প্রায় ১৯ কিমি. দূরে ১৫,৩০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ইউমেসেমডং। এটি চীনা সীমান্তের একেবারে কাছেই। লাল রঙের অ্যাজালিয়া ফুলের গাছ ভর্তি এখানে। এটিই শেষ বসতি তাই একে ‘জিরো পয়েন্ট’ বলা হয়। জিরো পয়েন্টে পৌঁছানোর আগে গাড়ি ধুঁকতে শুরু করল। আর আমার ও খুব ঘুম পাচ্ছিল। সবই অক্সিজেনের অভাবে। কোনরকমে পৌঁছালাম।প্রচন্ড হাওয়া দিচ্ছিল। আমরা মোমো, maggy, ডিমসেদ্ধ দিয়ে breakfast সেরে নিলাম‌। হাওয়ার বেগ বাড়তে থাকায় বেশীক্ষন থাকলাম না। ফিরে আবার luggage নিয়ে যেতে হবে গ্যাংটক।

হোটেলে ফিরে luggage নিয়ে প্রথম এলাম মঙ্গন। এখানে গাড়ি service করা হল। এরমধ্যেই নামল প্রচন্ড বৃষ্টি। দু ঘন্টা ওখানে আটকে পড়লাম। আমরা টুকটাক কিছু খেয়ে নিলাম। সন্ধ্যা নেমে এসছে, ঘুটঘুটে অন্ধকার। বৃষ্টির পর রাস্তার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। প্রানহাতে আমরা এগোতে লাগলাম। কিছুক্ষন গিয়ে আমরা highway না ধরে gangtok-chunthang road নিলাম। তার কারন highway এর রাস্তা অত্যন্ত খারাপ। প্রথম যেবার সিকিম এসেছিলাম এই রাস্তাটাই ধরেছিলাম। এই রাস্তাটা অসম্ভব ভালো। wild life sanctuary এর মধ্যে হওয়ায় খুবই নির্জন কিন্তু ধ্বসের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু মাঝে জলের আর ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ। বাকিরা গ্যাংটক আগেই পৌঁছে গেছিল। ওরা নিজেদের আর আমাদের জন্য খাবার order দিয়ে রেখেছিল। ডিমভাত খেয়ে শুতে গেলাম। প্রচন্ড ক্লান্তিতে চোখ বুজে এল।

 

চলবে………………

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleবন্ধু
Next articleগার্ডিয়ান এঞ্জেল
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments