আমার নাম অমিয় সরকার। ইতিহাসের প্রফেসর। গত দুদিন ধরে একটা ঘরে একপ্রকার বন্দী হয়ে আছি। অথচ খাওয়া দাওয়ার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ঘরের মধ্যে একটা বিশাল বুকশেল্ফ। ইতিহাস জীববিজ্ঞান আর রসায়নের ব ই এ ভর্তি প্রত্যেকটি তাক। পড়াশোনার ও কোনো অসুবিধা নেই। আশ্চর্যের বিষয় হল আমাকে যে কাজের জন্য মি.স্টিফেন এখানে ডেকেছেন সেই কাজের কথা এখনো আমি জানতে পারলাম না।
একজন চাকর আমার খেয়াল রাখছে দিবারাত্র। যখন যা দরকার চাইতে না চাইতেই এনে দিচ্ছে ভৃত্যটি। তাকে মি.স্টিফেনের কথা জিজ্ঞাসা করতেই সে কেমন যেন চুপ করে যাচ্ছে। পরক্ষণেই অন্য একটা কথা বলে কথা ঘোরানোর চেষ্টাও করছে না এমন নয়। কিন্তু প্রতিবার এক চাল সে চালতে পারবে না। আমি আসল কথা ঠিক তার থেকে বার করে নেব।
এই জায়গাটি একটি উপত্যকার পাদদেশ। তাই একটু তাড়াতাড়ি এখানে সন্ধ্যে নামে। সেই সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা। সব সময় একটা পশমের চাদর গায়ে জড়িয়ে থাকি।
ভাবলাম একবার ছাদ থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়। উপত্যকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা চাকরটার মুখ থেকে শুনেছি। দুর্ভাগ্য এই যে দিনের বেলা আমায় ছাদে যেতে দেয় না। আমি কিছু বলতে গেলে বলে মালিকের বারণ আছে।
হঠাৎ দরজার বাইরে চাকরটার পায়ের আওয়াজ পেলাম। চাকরটিকে দেখে আমি একটু রেগে যাই বলি তোমার মালিক কোন জাহান্নামে গেছে। কালকের মধ্যে যদি না আসে তো আমি এখানে আর থাকবো না। নেহাৎ অগ্রিম কিছু টাকা দিয়েছেন তাই। তাছাড়া ভদ্রলোকের ব্যবহারটা ভালো। ফোনে আমার সাথে বেশ মিষ্ট গলায় কথা বলেছিলেন। কিন্তু ওনার এভাবে অতিথি সৎকারের কথা জানলে আমি আসতাম না।
চাকরটি তার বিভৎস দাঁত বের করে একটু লজ্জার হাসি হাসল মনে হল। আমতা আমতা করে বলল, বাবুর কি কোনো কষ্ট হচ্ছে, মানে যদি কোন অসুবিধা হয় তো বলুন না আমাকে।
ছায়ান্ধকার ঘরে তার বিভৎস কুৎসিত মুখটা দেখে ভয় করলো। চাকরটার গলাটা যেন একটু বেশিই লম্বা। যেন আফ্রিকার কোনো উপজাতি, গলায় স্প্রিং লাগিয়ে গলাটা অস্বাভাবিক লম্বা করেছে। আমি একটু হালকা স্বরে বললাম, তোমার মালিককে দেখা করার জন্য এই আমার শেষ বলা।
সেই কথার প্রত্যুত্তরে চাকরটি বলল, মালিক আজ রাত্রিবেলা আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। এই বলে সে চলে যেতে যাচ্ছিল। ঠিক তখনি আমি বললাম, এখন একটু ছাদে নিয়ে যেতে পারবে?
সে আমার দিকে তাকাল। বলল, ছাদে কি করবেন?
তেমন কিছু না, একটু পায়চারি করে আসতাম। এই ঘরে বসে বসে বিরক্তি ধরে যাচ্ছে। সে দেখলাম জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। তারপর বলল, আর একটু পর যাবেন। ততক্ষণে আমি আপনার জন্য একটু স্যুপ নিয়ে আসি। এই বলে সে চলে গেল।
আমি তার ব্যবহারে অবাকের চেয়ে রেগে গেলাম বেশি। আমার নিজের ইচ্ছার ওপর ওই চাকরের প্রতিনিধিত্ব কেন সহ্য করব। আমি বাইরে বেড়িয়ে এসে দেখি, চাকরটি আর সেখানে নেই। সে নীচে চলে গেছে মনে হল। তখন ও বাইরে একটু আলো আছে। গোধূলি বলা ভালো। তবু উপত্যকা বলে চারপাশ তেমন পরিস্কার দেখা যাবে না। দেখলাম আমার ঠিক পাশ দিয়ে একটি লম্বা সিঁড়ি উপরদিকে উঠে গেছে। জায়গাটা একটু অন্ধকার। একটি ইলেকট্রিক টর্চ সর্বদাই পকেটে রাখি। সেটা বের করলাম। টর্চের আলো ফেলে উঠতে লাগলাম সিড়ি দিয়ে। একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম সেই সঙ্গে। এই জিনিস আগে খেয়াল করি নি। পুরো সিড়িময় ধুলোর পুরু আস্তরণ পড়ে আছে। মনে মনে চাকরটির ওপর অশ্রদ্ধা জন্মাল। মালিকের অনুপস্থিতিতে কাজের ফাঁকি। একটু ভালো করে দেখতে চোখে পড়ল আমার জুতোর পাশে পাশে উঠে গেছে আর একটা করে জুতোর ছাপ। মনে হয় বুটের। আমার ই মতন সাইজ হবে বুটটার। মনে হল এ ছাপ মি.স্টিফেনের ই হবে। দশ পনেরোটা সিঁড়ি ওঠার পর সেই ছাপ একটি নির্দিষ্ট সিঁড়িতে এসে শেষ হয়ে গেছে। আমার সামনের সিঁড়িতে বুটের শেষ ছাপটার দিকে আলো ফেললাম। মাথায় কিছু ঢুকল না। যদি এতটা এসে নীচে নেমে যান তাহলেও তো বোঝা যাবে। আশ্চর্যের ব্যাপার আমি যেখান থেকে ওঠা শুরু করেছি প্রত্যেকটি সিঁড়িতে একটি করে বুটের ছাপ। এত ভাবতে ভাবতে সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।
এটা বলতে পারেন আমার অবচেতন মনের খেয়াল। আমার মনে একটা সম্ভাবনার কথা জেগে উঠল। একবার উপর দিকে তাকালাম। দেখলাম উপরের সবকিছু অন্ধকার। টর্চের আলো ফেলব কিনা ভাবছি। একটা অজানা ভয় বাসা বাঁধতে লাগল। নিজেকে শক্ত করলাম। নিজের মনকে বুঝিয়ে উপরের দিকে আলো ফেলতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম একটা লম্বা দড়ি বা তার জাতীয় কিছুর সাথে একটা তেমুখো আঁকশির মতো কি একটা ঝুলছে। নীচে থেকে কিছু একটা ওপরে তুলে নেওয়ার জন্য। সেটা ঠিক আমার মাথার একটু সামনে থেকে হাত পাঁচেক ওপর পর্যন্ত নেমে এসেছে।
ঠিক যে সিঁড়িতে পায়ের ছাপ শেষবারের মতো পড়েছে, সেটিকে অতিক্রম করে আমি উপরে উঠে গেলাম। আর ও কয়েকটি সিঁড়ি উঠতেই একটি দরজা চোখে পড়লো।
দরজা খুলে ছাদে এলাম। চারপাশ প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। দুপাশে পাথরের উঁচু ঢাল। উপত্যকার নীচেটা অন্ধকার হলেও উপরের আলো প্রতিফলিত হয়ে চারপাশের গাছপালা দৃষ্টিগোচর করে তুলেছে। বেশ বড় ছাদ। মুক্ত প্রকৃতির বাতাস শরীরে যেতেই সব ঘটনার কথা ভুলে গেলাম। চারিদিক বড় ফাঁকা ফাঁকা। দূরে বিরাট বিরাট গাছপালার ভিতর থেকে বন্যপাখিদের কলতান ভেসে আসছে। মনে হল এমন পরিবেশে এরকম একটা বাড়ি যে বানিয়েছে তার প্রকৃতি প্রেম যে আছে তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।
হঠাৎ ই একটা কালো মতন পাখি পেছন দিকের জঙ্গলাকীর্ণ গাছপালার ভিতর থেকে উড়ে এসে সামনে বহুদূরে গিয়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারের বুকে। আমি সেই পাখিটার আগমনের উৎসের দিকে তাকাতেই অবাক হতে হল। পেছনের ছায়ান্ধকার পরিবেশে আবিস্কার করলাম একটা বাড়ি। ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না কতটা দূরে। এখান থেকেই সেটা দেখা সম্ভব। একটা বিশাল খাড়া পাথর উঠে গেছে এই বাড়ির পেছন দিক দিয়ে। নীচে থেকে দেখলে সেটাকে দিগন্তরেখা ছাড়া অন্য কিছু মনে হবে না।
এই নির্জনপুরীতে একটি বাড়ির অস্তিত্বের কথাই মি.স্টিফেন আমায় জানিয়েছিলেন। তবে তিনি কি কিছু গোপন করার চেস্টা করছেন। পেছন থেকে একটা আওয়াজ আমার খুব পরিচিত মনে হল। তাকাতেই দেখলাম চাকরটি দাঁড়িয়ে আছে। আর নিজের ক্রুদ্ধ চোখে আমায় দেখছে। ওর চোখদুটো দেখে ভয় হতে লাগলো। এমন নির্জন স্থানে ওর বিভৎস চেহারা দানবের মতো দেখাচ্ছে। কোনোমতে তাকে এড়িয়ে নীচে চলে এলাম।
রাত্রির খাবার খেয়ে বিছানায় উঠে বসে একটা সিগরেট ধরালাম। চাকরটিকে বললাম কোথায় গেল তোমার মনিব, আসবে বললে যে। সে বলল, আজ্ঞে, এই এল বলে।
কিছুক্ষণ পর একজন ভদ্রলোকের চেহারা নজরে পড়ল। বেশ দোহারা গঠন শরীরের। মাংশপেশীযুক্ত কসরৎ করা শরীর। আমি বিছানা থেকে উঠে তাকে সম্ভাষণ জানালাম। আরে বসুন বসুন, আমি খুব ই দুঃখিত আপনাকে এই দুদিন সঙ্গ দিতে না পারায়। আশা করি আমার পরিচারক আপনার সম্পূর্ণ খেয়াল রেখেছে?
মি.স্টিফেনের ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হলাম। ওনার সামনে আর কোনো কথা তুললাম না। যদি আমার মুখ থেকে নিজের ভৃত্যর অকৃতকার্যের খবর শোনে তাহলে হয়তো ভদ্রলোক দুঃখ পাবেন। তিনি আমায় বললেন, আজ আপনি বিশ্রাম করুন। কাল আপনাকে সব বুঝিয়ে বলব।
মি.স্টিফেনরা চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে দিলাম। না, ভদ্রলোক বড় ই অমায়িক মানুষ। নিজের ব্যস্ততার জন্য লজ্জা পেলাম। চাকরটি আবার আমার অধৈর্য্যের কথা মনিবকে বলে না দেন। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।
পরদিন সকাল সকাল ঘুম ভাঙল। দেখি ভৃত্য মহাশয় দরজার বাইরে দাড়িয়ে আছে। সে বলল, মনিব আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন ছাদে। আমি ফ্রেশ হয়ে ওপরে গিয়ে দেখলাম রীতিমতো এলাহি ব্যাপার। একটি ছোট টেবিল ও তিনটি চেয়ার পাতা রয়েছে। সঙ্গে সুখাদ্যের সমাবেশ।
আমি ভৃত্যটির দিকে তাকিয়ে বললাম, মাপ করবে, তোমার নামটা এখনো জানা হয়নি।
মি.স্টিফেন সহাস্যে বলে উঠল ওর নাম রজার। আমার খুব ই বিশ্বস্ত। আপনাকে আর ধোঁয়াশার মধ্যে রাখতে চাই না। বসুন এখানে। প্রাতঃরাশ সারতে সারতে কাজের কথাটা হয়ে যাক।
আমরা তিনজন গোল হয়ে বসলাম। মি.স্টিফেন আমাকে অফার করে একটা সিগরেট ধরালেন। তিনি বলতে আরম্ভ করলেন।
প্রথমেই বললেন, আপনি হিস্ট্রির প্রফেসর। আপনাকে নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু জানেন তো, আমরা যত ই রাজা রাজরা সম্রাট নিয়ে মাতামাতি করিনা কেন, আসল ইতিহাস কিন্তু সাধারন মানুষদের নিয়ে রচিত হয়। সেসব মানুষদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণাও হয় না, আর কেউ তাদের নিয়ে মাথাও ঘামায় না।
ঘটনা প্রথম মহাযুদ্ধের সময়। ততদিনে এই বাড়ি তৈরী হয়ে গেছে। শুধু এই বাড়ি নয়, দিগন্তের ওপারে যে বাড়িটি দেখছেন ওটিও। এই দুটি বড়ি তৈরী করেছিলেন আমার প্রপিতামহ। বিশিষ্ট গুণী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর জ্ঞানের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। কত রকম বিষয়ে যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তার ঠিক নেই। আর্কিটেকচার আর্ট এসবে কি যে দূর্দান্ত হাত ছিল কি বলব মশাই। এখনো বেশ কয়েকটি হ্যান্ডস্কেচ ও অয়েল পেন্টিইং আছে আমার সংগ্রহে। যদিও এসব কথা আমি কিছু জেনেছি আমার বাবার মুখ থেকে, আর আমার প্রপিতামহের লেখা একটা ডায়েরি থেকে।
এই চারপাশের মনোরম প্রকৃতি দেখছেন। আমার প্রপিতামহ এই জায়গায় বাড়ি বানিয়েছিলেন এমন নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য। আর কি বিচিত্র জায়গায় এই বাড়ি বলুন তো। দুটি বাড়ি দুটি আলাদা দেশে। মাঝে পাঁচশো মিটারের ব্যবধান। আপনি হয়তো জানলে অবাক হবেন এই দুই বাড়ির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করার জন্য প্রপিতামহ একটা লম্বা সুরঙ্গ বানিয়েছিলেন।
আমার হাতের সিগরেট হাতেই শেষ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছি।
আমরা এখন যে বাড়িতে বসে আছি তা বেলজিয়ামে অবস্থিত। আর দিগন্তের ওপারের বাড়িটা জার্মানিতে। কি সুপরিকল্পিত ব্যাপার ভাবুন। দুই দেশের সীমানা এমন জায়গায় এসে মিলিত হয়েছে, সেটি সম্পূর্ণরূপে জনবসতিহীন এবং অনেক জায়গা দুর্গম। সেই মহাযুদ্ধের সময় থেকে এখন অব্দি সকলেই এই বাড়ি দুটিকে পৃথক দেশের সম্পত্তি হিসেবেই বিবেচনা করে আসছেন। কিন্তু একটি গোপন অজ্ঞাত সুরঙ্গ যে এই দুই বাড়ির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছে তা বাহ্যিক দুনিয়ার কল্পনার ও অতীত।
কিন্তু মি.স্টিফেন আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
দেখুন আপনার মতো আমার এক ইন্ডিয়ান বন্ধু ছিল। বলতে পারেন আমরা এক ভাইয়ের মতোই ছিলাম, খুব ই অন্তরঙ্গ। ওর নাম ছিল অবিনাশ। ও আমার সাথে এই মিশনে সঙ্গী হত। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য এমন বিশ্বস্ত সুহৃদকে হারাতে হল। এক গাড়ি এক্সিডেন্টে মাস ছয়েক আগে তার অকাল মৃত্যু হয়। মনে মনে ভেবেছিলাম এমন বিশ্বস্ত বন্ধু কি আর পাবো!
তারপরের ঘটনা আপনি জানেন। এই দুদিন আপনার সঙ্গে যা যা ধকল গেছে, তা আর কিছুই নয়, আপনার বিশ্বস্ততার পরীক্ষা ছিল, আপনি খুব ভালোভাবেই তা উত্তীর্ণ করেছেন।
আমি বললাম, কিন্তু আগের দিন সিঁড়ির ঘটনা আর আমায় ছাদে যেতে বারণ করার কি কারণ জানতে আমি কৌতুহলী।
তিনি একটু হেসে বললেন, আপনি সিঁড়িতে বুটের ছাপ দেখে একটু ঘাভড়ে গিয়েছিলেন হয়তো। ওটা আর কিছুই না। নীচে থেকে একটা লাঠির দুমুখে একজোড়া বুট বেঁধে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধুমাত্র ছাপ দেওয়া হয়েছিল। আর পুরু ধুলোর আস্তরণে সেই ছাপ খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছিল। যে কোনো মানুষের তা দেখে ভ্রম হওয়া স্বাভাবিক। আর আমার ভৃত্য আপনাকে ছাদে যেতে বারণ করার পেছনে দুটো কারণ আছে। প্রথমত, আপনার মনে একটা সন্দেহের উদ্রেক করা। দ্বিতীয়ত, ছাদে না উঠলে আপনি বুঝতে পারতেন না যে এই বাড়ি দুই দেশের সীমানার কাছাকাছি অবস্থান করছে। আপনি প্রফেসর মানুষ। কোনো সীমান্তবর্তী এলাকায় যেকোনো কাজেই বিপদ ও নৈতিকতার প্রশ্ন উঠে আসে। আপনি যদি বুঝতে পারেন যে এটা একটা সীমান্তবর্তী অঞ্চল, হয়তো এই মিশন থেকে আপনি মুখ ফিরিয়ে নিতেও পারতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো নৈতিকতার প্রশ্ন ই ওঠে না। করণটা আপনাকে আশা করি বলতে হবে না। আর তাছাড়া এই সম্পত্তি আমার প্রপিতামহের। তাই বংসানুক্রমে তা আমার প্রাপ্য।
আপনি অবগত যদিও তবুও আমি বলছি। জার্মানির নাৎসি বাহিনী প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ফ্রান্স আক্রমণে উদ্যত হল। কিন্তু জানা গেল জার্মানি ও ফ্রান্সের সীমানায় বন্ধুর প্রকৃতির অঞ্চলে বহু দুর্গ প্রাচীর নির্মান করে রেখেছে ফ্রান্স। তাই ঠিক হল ফ্রান্সের উত্তর পূর্বদিকে বেলজিয়াম হয়ে নাৎসি বাহিনী ঢুকবে ফ্রান্সে। বেলজিয়াম তাতে সায় না দিলেও নাৎসি বাহিনী প্রবেশ করে। অত্যাচার চালায় বেলজিয়াম নাগরিকদের ওপর। আমাদের পুরো পরিবার বরাত জোড়ে বেঁচে গিয়েছিল। দীর্ঘ দশদিন আমাদের পরিবার ঐ সুরঙ্গের মধ্যে বেঁচেবর্তে ছিল।
তারপর একদল সেনা আমাদের বাড়িতে লুঠতরাজের সোনাদানা বহুমূল্য জিনিস জমা করতে লাগলো ঐ বাড়িতে। মনে করেছিল হয়তো ফেরার পথে বেঁচে থাকলে নিয়ে ফিরবে। এই ঘটনা হয়তো খুব কমসংখ্যক নাৎসি সেনাই জানত। যুদ্ধের পর ঐ দলটি আর ফিরে আসে নি। হয়তো সকলে মারা গিয়েছিল।
আমি বললাম, অর্থাৎ সমস্ত সম্পত্তি বেলজিয়াম বাসীর। এখন জার্মানীর সীমানায় ঐ বাড়িতে আছে।
একদম ই তাই। তাছাড়া ঐ বাড়ি এখন পরিত্যক্ত। এত সম্পত্তি হিসেব মতো এখানকার বাসিন্দাদের প্রাপ্য। সবথেকে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার যেটা, তা হল, ঐ বাড়ি আমার প্রপিতামহের। ওতে অন্য কারোর হস্তক্ষেপ নেই।
কিন্তু একটা বিষয় আমার মাথায় ঢুকছে না। আপনার প্রপিতামহ মশাই বেলজিয়ামের বাসিন্দা হয়ে অন্য দেশে বাড়ি বানালো কেন এবং সেটা সম্ভব হল কি করে?
এখানেই আসল ব্যাপার। আমার প্রপিতামহের এক জার্মান বন্ধু ছিল। ওটা ওর ই বাড়ি। দুজনে একসঙ্গে সলা করেই বাড়ি দুটো বানিয়েছিল। ঐ বন্ধুর কোনো পরিবার ছিল না। তাই ও আমাদের একপ্রকার পরিবারের অংশ হয়ে গিয়েছিল। সেদিন ও প্রপিতামহের সেই বন্ধু আমাদের পরিবারের সঙ্গেই ছিলেন। কারণ একটাই সমস্ত লুন্ঠিত ধন সংরক্ষিত হচ্ছিল তার তার ঐ বাড়িটিতেই।
দীর্ঘক্ষণ পর মি.স্টিফেন মৌন হলেন। রজার দুটো হাত টেবিলে রেখে তার দৃষ্টি হাতের দিকে সেদিকে নিবদ্ধ করে রেখে কথা শুনছিল। আমি দিগন্তের ওপারের বাড়িটির দিকে নিষ্পলক চোখে চেয়েছিলাম। দূর থেকে সেটাকে কালো ঘুড়ির মতো দেখাচ্ছিল। নীল আকাশের পটে কালো ঘুড়ি।
কিছুক্ষণ পর মি.স্টিফেন সামনে রাখা চায়ের কাপ তুলে চুমুক দিলেন। বললেন, আপনি আমার সঙ্গে ঐ রক্ষিত ধনসম্পদ উদ্ধার করতে যেতে চান। আমি আপনাকে কথা দিলাম এর আশি শতাংশ আমি সরকারকে দিয়ে্ দেব যাতে এর থেকে প্রাপ্য অর্থ কিছু ভালো কাজে লাগে। বাকিটার মধ্যে থেকে পাঁচ শতাংশ আপনার। তাছাড়া এই সম্পদের মধ্যে আমার প্রপিতামহের নিজ অর্জিত ধন ও কম নয়। বলতে পারেন সেই কুড়ি শতাংশ ধনসম্পদ আমার ই প্রাপ্য।
কিন্তু আপনি আমাকে শুধু বিশ্বস্ততার খাতিরেই এই কাজের জন্য নির্বাচন করেছেন কি?
আপনি ঠিক কথাই তুলেছেন মিস্টার। আসলে আমার ইন্ডিয়ান বন্ধুর অকাল মৃত্যু আমায় বিমর্ষ করে দিয়েছে। আমার পরিবার বলতে শুধু রজার। আর আপনার মধ্যে আমি আমার মৃত বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি।
আমি আর কোনো প্রশ্ন করলাম না। দেখলাম মি.স্টিফেনের চোখ সিক্ত হয়ে এসেছে। ভদ্রলোক সত্যিই শোকাহত। আমি মি.স্টিফেনের কাঁধে হাত দিয়ে তাকে শান্তনা দিয়ে বললাম আমি অনেকদিন পর আপনার মতো বন্ধু পেয়েছি। আমি এই কাজে আপনার সঙ্গ দিতে রাজি। ভদ্রলোক দেখলাম বেশ খুশি হয়েছেন।

( 2 )

খাওয়া দাওয়া করে দুপুরে শুয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখি উপত্যকা অঞ্চলে রাত্রি নেমে এসেছে। দেখলাম মি.স্টিফেন ও রজার একসাথে ঘরে ঢুকলেন। বললেন, ঘুম ঠিকঠাক হয়েছে তো? সারাটা রাত্রি আমাদের জাগতে হতে পারে।
আমি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললাম, আপনাদের প্রকৃতির কোলে বাড়ি। এমন সুন্দর আবহাওয়া। ঘুম ভালো না হয়ে যায় কোথায়!
আমরা তিনজনে বসে সন্ধ্যার খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর মি.স্টিফেন আমার হাতে একটা লোহার রড আর একগোছা দড়ি দিয়ে বললেন, মশাই এটুকু আপনাকে সঙ্গে নিতে হবে।
আমি সানন্দে দড়ির গোছা আর লোহার রড হাতে নিলাম। দেখলাম রজারের এক হাতে একটা ইলেকট্রিক টর্চ আর অন্য হাতে একটা মশাল। আমরা তিনজনে নীচের তলায় নামলাম। তারপর প্যাসেজ পেড়িয়ে একটা অন্ধকার জায়গায় এসে পৌঁছলাম। রজার টর্চ জ্বালতেই উজ্জ্বল আলোয় জায়গাটা দৃষ্টিগোচর হল। এদিকটা আগে আসি নি। বুঝতে পারলাম এটা বাড়ির পেছনের দিকটা, যেদিকে দিগন্তের ওপারের বাড়িটা আছে। দেখলাম মি.স্টিফেন পকেট থেকে একটা লম্বা চাবি বের করে একটা দেওয়ালের কোনো একটি জায়গায় সেটিকে রেখে ঘোরাতেই দেওয়ালটা একটু ফাঁক হয়ে গেল। এখন বুঝলাম ওটা একটা দরজা, যার রং দেওয়ালের চুনকামের সঙ্গে মিশে দরজাটিকে আপাত অদৃশ্য করে রেখেছিল।
দরজা খুলতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এল। অনেকদিন পর কোনো জায়গা খোলা হলে যেমন গন্ধ আসে ঠিক তেমন। রজারের হাত থেকে মশালটা নিয়ে আগুন দিলেন তাতে। তারপর মি.স্টিফেন চলতে লাগলেন আগে আগে। মাঝে মাঝে চলেছি আমি। পেছনে আসছে রজার। তার টর্চের আলোয় দশ পনেরো গজ ভেতর অব্দি দেখা যাচ্ছে। সুরঙ্গটা বেশ বড় না হলেও মানুষ অনায়াসেই হেটে চলতে পারে। অনেকদিনের পরিত্যক্ত বলে ধুলো আর মাকড়সার জালে ভর্তি হয়ে গেছে। মি.স্টিফেনের মশালের আগুনে সেই জাল পুড়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
অনেকক্ষন সকলে চুপচাপ। রাত্রির অভিসার। মি.স্টিফেন বললেন, এ এক রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চার, কি বলেন?
আমি বললাম, তা আর বলতে। আমি ভাবছিলাম কি দক্ষ হাত প্রয়োজন এমন সুরঙ্গ তৈরী করতে। কি অভিনব পরিকল্পনা।
আগেকার দিনে প্রায় সব দূর্গ থেকেই এমন একটা গুপ্ত সুরঙ্গ করা হত।
সম্মতি সূচক ঘাড় নেড়ে মি.স্টিফেন বললেন, আমরা এখন দুই দেশের সীমানার মাঝামাঝি এসে পড়েছি। এখান থেকে মোটামুটি আর দুশো কি আড়াইশো মিটার গেলেই আমাদের গন্তব্যস্থান।

এমনভাবে চলতে চলতে আমরা অবশেষে আর একটা দরজার কাছে পৌঁছলাম। এই দরজাটা গোল মতন, কাঠের ই মনে হল। মি.স্টিফেন অন্য আর একটা চাবি দিয়ে এই দরজাটা খুললেন। আমরা তিনজনে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। এই বাড়িটার চেহারা আর ও ছন্নছাড়া। জায়গায় জায়গায় কাঠ ভেঙে পড়েছে। কাঠের মেঝেতে ধুলোর পুরু আস্তরণ। চারপাশ নিস্তব্ধ।
মি.স্টিফেন বললেন, ডায়েরী অনুযায়ী সমস্ত সম্পদ একটি সিন্দুকে আছে। আর সেটা আমাদের খুঁজতে হবে। আচ্ছা রজার এই আস্তরণ সরিয়ে দেখো যে কোনো কালো রঙের কাঠ দেখতে পাও কিনা। মনিবের কথা শুনে রজার টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগলো পুরো মেঝে। আমিও ওর সঙ্গ দিলাম। মিনিট দশেক এদিক ওদিক খোঁজার পর আমার চোখে পড়ল একটা লম্বা কাঠের পাত, যার রং কালো। আমি বললাম, এটা একবার দেখুন মি.স্টিফেন।
হ্যা ওটাই। লোহার রডটা দিয়ে ওটা তোলার চেষ্টা করুন। আমি আর রজার একসাথে রডের শেষ প্রান্তটা দিয়ে চাপ দিতেই উঠে এল কাঠের পাতটা। এরপর দেখলাম পাশের বাকি কাঠের পাতগুলো আলগা হয়ে গেল। ওগুলো সরিয়ে দেখতেই নীচে একটা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মি.স্টিফেন টর্চের আলো ফেলতেই দেখলাম একটা ঘর। রজার নীচে লাফিয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। খুব নীচু নয়। আমরাও লাফালাম। মশাল আর টর্চের আলোয় প্রায় পুরো ঘর আলোকিত হয়ে গেছে। পুরো ঘর ফাঁকা।
আমি বললাম এ যে পুরো ঘর ফাঁকা। সিন্দুকের তো কোনো চিহ্ন ই নেই।
মি.স্টিফেন দেখলাম নির্বিকার। বললেন, এত মূল্যবান জিনিস এত সহজেই পাওয়া তো যাবে না।
তা আপনার ডায়েরী কি বলছে এ ব্যাপারে।
পকেটে হাত দিয়ে একটা ছোট ডায়েরী বার করলেন মি.স্টিফেন। কয়েকটি পাতা উল্টাতে থাকলেন দ্রুত। মনে হল তার হাত কাঁপছে। আমি বললাম আপনার কিছু অসুবিধা হচ্ছে মি.স্টিফেন?
না না। আমি ঠিক আছি।
আমার মনে হল মি.স্টিফেন খুব উদ্বেগে আছেন। তিনি ডায়েরীর মধ্যে থেকে একটা প্যাঁচানো চাবি বের করে আনলেন। সেটা ডান হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে একটা দেওয়ালের কাছে। একবার পেছন ফিরে আমাদের দিকে তাকালেন, তারপর চাবিটা কোন অদৃশ্য জায়গায় বসিয়ে কয়েক পাক ঘোরাতেই মি.স্টিফেন আর আমাদের মধ্যবর্তী জায়গা অনেকটা ফাঁক হয়ে গেল। আমি কিছু একটা বলতে যাবো, মি.স্টিফেন আমার উদ্দেশ্যে বললেন, মশাই দড়ির গোছাটা খুলে রজারের হাতে দিন। আর একটা প্রান্ত আপনি শক্ত করে ধরুন। আকস্মিক আদেশে কিছুটা খেই হারিয়ে ফেললাম। কোনোমতে দড়ির গোছাটা কাঁধ থেকে খুলে এক প্রান্ত রজারের হাতে দিতে না দিতেই সে ঝাঁপ দিলো নীচে। আমি মি.স্টিফেনের দিকে তাকাতেই দেখি তিনি ওপ্রান্ত থেকে লাফিয়ে এসে আমার সাথে দড়ির ওপর প্রান্ত টেনে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা নীচে জলের মধ্যে কিছু পড়ার শব্দ পেলাম। তবে কি রজার নীচে ঝাঁপ দিয়ে জলে পড়ল। উদ্বেগে আমি এগিয়ে গিয়ে দেখতে যাবো, মি.স্টিফেন বাধা দিলেন। বললেন পিছিয়ে আসুন। দড়ির টানে নাহলে বিশ ফুট নীচে জলে গিয়ে পড়বেন।
হঠাৎ একটা মানুষের আর্ত চিৎকার শুনতে পেলাম। মনে হল এ তো রজারের চিৎকার। তবে সে কি কোন বিপদে পড়ল। মর্মভেদী চিৎকার বেড়েই চলল। বললাম মি.স্টিফেন রজার নিশ্চয় ই কোন বিপদে পড়েছে।
পড়তে দিন বিপদে। ওকে বিপদে না ফেললে আমরা সিন্দুক কোনোদিন পাবো না।
কিন্তু সিন্দুক ই বা কোথায়। আর রজারের কি বিপদ, মি.স্টিফেন আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
নীচে থেকে মর্ম চিৎকার সমানে বেড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে কোনো কিছু থেকে বাঁচার জন্য রজার জলে হাত-পা ছুঁড়ছে আর শব্দ করছে।
মশালের আলোটা দেওয়ালে অনেকটা দূরে রাখা রয়েছে। টর্চের আলোটা আমার পাশেই ছিল। সেটাকে এক হাতে নিতেই যা দেখলাম তাতে আমার রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। টর্চটা হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। দেখলাম অনেকগুলো কুমির একসাথে রজারের শরীরের মাংস খুবলে খুবলে টেনে নিচ্ছে। ওর রক্তে জল লাল হয়ে গেছে। আর কোনো একটা বস্তুতে রজার নিজেকে আটকে রেখেছে। কিছুক্ষণ এমনভাবে চলল। তারপর চারিদিক নিস্তব্ধ। রজারের মর্মভেদী চিৎকার আর শোনা গেল না। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম এই ঘটনায়। মি.স্টিফেনের রুক্ষ গলার আওয়াজ শোনা গেল। দড়িতে টান দিন।
আমি আর মি.স্টিফেন একসাথে টান দিতেই একটা ভারী কিছু অনুভব করলাম। ধীরে ধীরে সেটাকে ওপরে তুলে আনতেই দেখলাম একটা সিন্দুক। খুব বড়ো নয় তবে লোহার সিন্দুক।

আধঘন্টা মতো হবে, আমরা দুজন নিরব বসে। ইলেকট্রিক টর্চটা মেঝেতে পড়ে। তার তির্যক আলো ঘরময় একটা ছায়াচ্ছন্ন বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। সেই আলোয় মি.স্টিফেনের বিষন্ন মুখটা দেখতে পেলাম। আমিও রীতিমতো শোকস্তব্ধ।
মি.স্টিফেন নিরবতা ভেঙে বললেন, রজারের ইতিহাস আপনি জানেন না। ও ওর পরিবার নিয়ে খুব চিন্তায় ছিল।
আমি বললাম ওর পরিবার ও আছে নাকি?
হ্যাঁ। আর সেই জন্যেই এই বলিদান। বছর দেড়েক আগে ও জেল থেকে পালিয়ে আসে এবং আমার কাছে আশ্রয় চায়। যেহেতু পুলিশ ওকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল তাই ও নিজের বাড়ি যেতে পারে নি। আমাকে বলেছিল ওর এক স্ত্রী ও এক ছেলে আছে। আমি যেন তাদের সারাজীবন খাওয়া পড়ার মতো অর্থ পাঠিয়ে দিই। তার বদলে ও প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে। এমনিতেই ও খুনের দায়ে জেল গিয়েছিল। ওর ফাঁসিই হত। ও দেখলো ওর পরিবার তাহলে না খেয়ে মরবে। তাই আমার কাছে সমস্ত কথা শুনে ও রাজি হয়ে গেল। আর যাই হোক ওর এই মৃত্যুতে যে ওর পরিবার অনাহারে মরণের হাত থেকে বাঁচবে, এতেই সে চোখ বুজে আমার কাজ করতে রাজি হয়ে গেল। রজারের আমার ওপর বিশ্বাস ছিল অটুট‌। আর তাছাড়া এই সিন্দুক ও ছাড়া আর কেউ উদ্ধার করতে পারতো না। ওর ক্ষমতা ছিল আমাদের মতো চারজন মানুষের সমান। নাহলে বলুন এই ভয়ঙ্কর কাজ করার মতো বুকের পাটা কজনের থাকে!
মি.স্টিফেন উঠে দাড়ালেন। সিন্দুকটার সামনে গিয়ে বসে বললেন, দেখুন এই দড়ির বাঁধনটা দেখুন। এমন বজ্রমুষ্টি করে বেঁধেছে যে কার ক্ষমতা এটা আর খোলে। ভাবুন চারপাশে এতগুলো রাক্ষুসে কুমির তার শরীর একটু একটু করে ছিঁড়ে খাচ্ছিল, সেই অবস্থায় এই বজ্রবাঁধন ও বেঁধেছে। হতে পারে ও আসামী। কিন্তু পরিবার ও মনিবের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছিল অসীম।
একটা অন্য চাবি দিয়ে সিন্দুকটা খুললেন। তার ভিতরের সোনা হীরে মুক্তোতে ঝলমলিয়ে উঠল সারা ঘর। তারপর বন্ধ করে দিলেন আবার সিন্দুকটি।
মেঝেতে সিন্দুকের উৎসস্থলটি যেন গিলে খেতে আসছে আমাদের। কি ভয়ঙ্কর একটা ফাঁদ। যে জানবে না তার ইহলোক পরলোকের মাঝে ব্যবধান খুব বেশি থাকবে না। মি.স্টিফেন উঠে দেওয়ালের কাছে গেলেন। প্যাঁচানো চাবিটা উল্টোদিকে ঘোরাতেই কাঠের মেঝে আগের মতো হয়ে গেল। চিরদিনের জন্য বন্ধ।
আমার সঙ্গে ঘড়ি নেই। তাই সময় জানা গেল না। তবু মনে হল মধ্যরাত্রি হয়ে গেছে। আমরা দরজা আটকে সুরঙ্গের মুখের কাছে এসে দাঁড়ালাম। দরজা বন্ধ করা হল। তারপর ফেরার যাত্রা শুরু হল। মি.স্টিফেন একহাতে সিন্দুকের একটা হাতল ও আর এক হাতে মশাল ধরেছেন। তিনি চলেছেন আগে আগে। আমি পেছনে, এক হাতে সিন্দুকের অপর হাতল আর অন্য হাতে টর্চ।
যখন মি.স্টিফেনের বাড়ি ফিরলাম তখন আর ও ঘন্টা দেড়েক অতিক্রান্ত হয়েছে। রজারের জন্য খারাপ লাগছিল।
পরদিন সকালে মি.স্টিফেন নিজেই কফি সার্ভ করলেন। বললেন, আপনার ইন্ডিয়ার টিকিট আমি বুক করে রেখেছি। সন্ধ্যের ফ্লাইট। আপনি তৈরী হয়ে যাবেন। আপনি ইন্ডিয়া পৌছানোর সঙ্গে সঙ্গে আপনার রূপিও পৌঁছে যাবে। আমি বললাম, রজারের পরিবারের খোঁজ আপনি জানেন?
হ্যাঁ। আমি জানি। আপনাকে পাঠানোর পর ওদের ও পাঠিয়ে দেবো। কথামতো বাকি ইউরো সরকারের তহবিলে যাবে।
আমি সমস্ত জিনিসপত্র গোছানো হলে পর ছাদে গেলাম একবার। এখানকার রোদটা বেশ মনোরম। চারপাশের সুন্দর প্রকৃতি। তারপর সেই দিগন্তের ওপারে বাড়িটার দিকে চোখ পড়ল। রাত্রির ভয়াবহতার সাথে দিনের এই রূপ মেলানো যাচ্ছিল না। সত্যিই মি.স্টিফেন ঠিক ই বলেন। আসল ইতিহাস রাজা রাজরা সম্রাটদের নয়, আসল ইতিহাস সাধারণ মানুষের ইতিহাস। আসল বিপদের ঝুঁকি রজারের মতো মানুষরাই নিতে পারে।
ব্রুসেলস এয়ারপোর্টে সময়মতো পৌঁছে গেলাম। মি.স্টিফেন সঙ্গে করে এসেছেন। যাওয়ার সময় আর একবার প্রতিশ্রুতির কথা বললেন। আর বললেন আবার আসবেন। এরপর আসলে কোনো রহস্য নয়, আপনাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো।
আপনিও ইন্ডিয়া আসতে ভুলবেন না। আপনাকে কলকাতাও ঘোরাবো।
মি.স্টিফেন আমার হাতদুটো ধরে বললেন, অবশ্যই যাবো।

দীর্ঘ দশ ঘন্টার জার্নি হল। জেট ল্যাগে একটু অসুবিধা হয় আমার।
বাড়ি ফিরেছি। দুদিন বিশ্রামের পর বেশ লাগছে আজকে। মি.স্টিফেনের পাঠানো পাঁচ লক্ষ টাকাই ঠিক করেছি কোনো এন.জি.ও তে পাঠিয়ে দেবো। রজারের পরিবারকে ও সরকারকে অর্থ পাঠিয়ে দিয়েছেন মি.স্টিফেন। আমার যাতায়াতের খরচ বহন করেছিল সরকার। world history conference থেকে একটা প্রশংসা পত্র পেয়েছি। সঙ্গে একটা বিরল অভিজ্ঞতা।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleভূতেরাও ভয় পায়।
Next articleআগমনীর ছন্দ।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments