কাশ্মীরকে কেন ভূস্বর্গ বলা ঽয় সেটা সম্যক উপলবদ্ধি করতে হলে অন্তত একবার সেখানে যাওয়া চাই। চাকরিসূত্রে গিয়েছিলাম বার দুয়েক।

প্রথমবার যাই  ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে। ১৯৯৯ সালের মে মাসে কার্গিল যুদ্ধ শুরু হবার মাস কয়েক আগে। আমি তখন ফরাসী বহুজাতিক সংস্থা সিজেলেকের নয়ডা অফিসে। পাওয়ারগ্রীডের প্রোজেক্ট দেখছি। সেই সূত্রে কাশ্মীর আসা। সঙ্গে ছিল সহকর্মী সঞ্জয় সাকশেনা। প্যারিস হেড অফিসের নিয়ম অনুযায়ী বিশেষ বিমা করাতে হয়েছিল। দিল্লিতে মোবাইল ফোন পরিষেবা শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। কাশ্মীরে তখনও হয় নি।

শ্রীনগরের প্লেন ঘন্টা দুয়েক দেরি। পৌঁছল পড়ন্ত বিকেলে। এয়ারপোর্টে সুরক্ষা ব্যবস্থার অত্যধিক কড়াকড়ি। বেরোতে একটু সময় লাগল। কাজি সাহেব গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। সাদা এ্যামবাসাডার। কাজি সাহেব কাশ্মীরের বাসিন্দা। পাওয়ারগ্রীডের সঙ্গে ব্যবসায়িক কারণে সংযুক্ত। তখন পাওয়ারগ্রীডের হেড অফিস ছিল দিল্লির নেহেরু প্লেসে। ওখানকার কর্তারা বলেছিলেন কাশ্মীরে কাজি সাহেব আমাদের দেখাশোনা করবেন। তিনি থাকার জন্য শ্রীনগরে নিরাপদ হোটেল আর যাতয়াতের জন্য নিরাপদ গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবেন। সেই গাড়ি চড়ে এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট হোটেলে পৌঁছতে সময় লাগল প্রায় ঘন্টা খানেক। দূরত্ব অতটা নয় ,তবে রাস্তা চওড়া নয় আর প্রতি একশো বা দুশো মিটারে পুলিস কি আর্মির ব্যারিকেড। কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ তখন চরমে।

হোটেলটা ছোট হলেও বেশ বনেদি কাশ্মীরি ভাব। শক্ত কাঠের মেঝে। দেওয়ালে আর সিলিঙে কাজ করা কাঠের প্যানেল। কাশ্মীরি ওকের ভারী আসবাব। টেবিলে মৃদু সবুজ রঙের মার্বেল টপ। তবে পরিচ্ছন্নতার বড় অভাব। হোটেলের দৈন্যদশা। অতিথির সংখ্যা খুবই কম। সেদিন আমরাই একমাত্র। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কাজি সাহেব এলেন। প্রায় ছফুট লম্বা, ফর্সা রং, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। বেশ ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারা। আন্দাজ করলাম বয়স হয়ত পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি হবে । খুব অমায়িক লোক। এয়ারপোর্টে না আসতে পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। স্থানীয় পরিস্থিতি নিয়ে একটু গল্প হল। আখরোট আর পেস্তার সঙ্গে চা খাওয়াও হল।

কাজি সাহেব চলে গেলেন সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। কাছেই থাকেন। বললেন কাল সকালে এসে আমাদের নিয়ে যাবেন। আটটায় রাতের খাবার, কাশমীরি পোলাও আর মাংসের কোর্মা, লাজবাব। কাজি সাহেব আগেই বলে রেখেছিলেন।

বিদ্যুতের অবস্থা তখন দিল্লিতেও বিশেষ ভাল নয়। কাশ্মীরেতো শোচনীয়। হোটেলে জেনারেটর ছিল বলে রক্ষে। নভেম্বর মাস, সন্ধ্যের পর ঠান্ডা নামে। ইলেক্ট্রিক হীটার ছিল। তবে চালাতে হয় নি। রাতে ঘুম ভালই হয়েছিল।

পরের দিন কাজি সাহেব আমাদের সঙ্গে প্রাতঃরাশ করলেন। এক সঙ্গে বেরোলাম সকাল নটা নাগাদ। গন্তব্য ওয়াগুরা সাবস্টেশন।

ভারতে তখনও আধুনিক কম্পুটারাইজড বিদ্যুৎ প্রসারণ নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা ছিল না । ফলে বারবার গ্রীড গোলযোগে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হত। পাওয়ারগ্রীড তাই বিশ্ব ব্যাঙ্কের ঋণে এই আধুনিকীকরণ উদ্যোগ নিয়েছিল। আমাদের বহুজাগতিক সংস্থা সিজেলেক সমগ্র উত্তর ভারতের ঠিকা পেয়েছিল। তিন  মহাদেশ জুড়ে কোম্পানির তিনটে ইউনিট – ফরাসি ,আমেরিকান আর ভারতীয়, এই প্রোজেক্টে সংযুক্ত। এই কাজের জন্যই কাশ্মীর আসা। ওয়াগুরা আর উড়ি সাবস্টেশনে ফরাসি প্রযুক্তিতে নয়ডায় তৈরি তথ্য সংগ্রাহক রিমোট টার্মিনাল ইউনিট বসবে।

ওয়াগুরা সাবস্টেশন হোটেল থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার। যেতে লাগল প্রায় দুঘন্টা। পথ পাটান হয়ে। পাটান সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য কুখ্যাত। টিভি আর খবরের কাগজের দৌলতে এই স্থানের দুর্নাম অনেক। সেই পাটানে রাস্তার ধারে কাশ্মীরের কাওয়া চা খাওয়ালেন কাজি সাহেব। এরকম একটা শান্ত সুন্দর জায়গা কি করে যে সন্ত্রাসের কোন কেন্দ্র হতে পারে তা বোধগম্য হল না। সন্ত্রাস কি সন্ত্রাসবাদী না দেখলেও, দেখলাম সশস্ত্র ভারতীয় সেনার উপস্থিতি প্রায় সর্বত্র।  প্রায় প্রতি দুশো মিটারে তাদের ব্যারিকেড। গাড়ি তাই থামে বেশি চলে কম। মনে হল কাজি সাহেব আর তার গাড়ি এদের পরিচিত। তাছাড়া উইন্ড স্ক্রীণে অন পাওয়ারগ্রীড ডিউটি স্টীকারও ছিল। আমাদের প্রতি তাই উদার মনোভাব। ভোগান্তিও নেই।, নইলে বারবার গাড়ি থামাও, গাড়ির কাগজ আর পরিচয়পত্র দেখাও। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ বাসযাত্রী সাধারণ মানুষের। পুরনো ঝরঝরে প্রদূষণকে বুড়ো আঙ্গুল দেখান বাসগুলোকে সেনারা ইচ্ছে মত থামায়। মানুষগুলো বাস থেকে লাইন করে নামে, পরিচয়পত্র দেখায়, তারপর আবার বাসে ওঠে। প্রতিবাদ করে লাভ নেই, প্রতিবাদ তারা করে না, বিনাপ্রতিবাদে এই ওঠানামার অনুশীলন করে নেয়। সন্ত্রাসবাদের এই এক পরিচিতি। সেই কারণেই খোদ দিল্লিতেও যত্রতত্র ট্রাফিক ব্যারিয়ারে আমরা বাধ্য হয়ে ড্রাইভিং দক্ষতার প্রমান দিতাম। তবে দিল্লিতে ব্যারিকেডগুলোতে একটা দুটো পুলিস, আর এখানে অন্তত আধ ডজন তৎপর সেনাবাহিনীর জওয়ান। কাশ্মীর যেন অধিকৃত যুদ্ধভূমি।

ওয়াগুরা সাবস্টেশনে আমাদের নামিয়ে কাজি সাহেব চলে গেলেন। বললেন ঘন্টাখানেক বাদে আসবেন। কাজও বিশেষ কিছু নয়। আমার আসার দরকার ছিল না। উপায় কি, প্যারিসের হুকুম। কাশ্মীরে ভারতের প্রোজেক্ট ম্যানেজারকে স্বয়ং যেতে হবে। কাজি সাহেবের আসতে একটু দেরি হল। ফলস্বরূপ সাবস্টেশন ম্যানেজারের সঙ্গে চা খেতে খেতে গল্প হল। উত্তর প্রদেশের লোক। কাশ্মীরিদের খুব একটা পছন্দ করেন বলে মনে হল না। কুঁড়ে, মাথামোটা ইত্যাদি বললেন। কিছুটা হয়তো সত্যি। তবে নিশ্চয় বেশিরভাগই ভুল ধারণা। কাশ্মীরিদের বুদ্ধি কম সেটা মেনে নেওয়া কঠিন। বারানসীর কোন লোককে পরিবার ছেড়ে এই সন্ত্রাসবাদের সময় যদি কাশ্মীরে কাটাতে হয়, কাশ্মীরের মানুষ সম্পর্কে তার একটু বিরূপ মনভাব থাকতেই পারে। তবে তিনি আরও বললেন কাশ্মীরিরা ধর্মীয় কারণে পাকিস্তান ঘেঁষা হলেও আসলে এরা চায় স্বাধীন কাশ্মীর। আর্থিক সামর্থের দিক থেকে দুটো মাত্র শ্রেণি।  অল্পসংখক উচ্চবিত্ত আর বিপুল নিম্নবিত্ত। এই নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা শান্তিপ্রিয় হলেও এদের একাংশ সন্ত্রাসবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিছু বেকার আবেগপ্রবণ তরুণ সন্ত্রাসবাদে অনুপ্রানিত হয়ে হিংসার পথ বেছে নিয়েছে। প্রতিবেশী দেশের সন্ত্রাসবাদীরা এদেরই সহায়তায় সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করে। হতাহত উভয়পক্ষেই। সেনারাওতো সাধারণ মানুষ। অধিকাংশই গরীব ঘরের। এই চাপের পরিস্থিতিতে তাদেরও মাথার ঠিক থাকে না। ভুল তাদেরও হয়ে যায়। কাশ্মীরের মানুষ আর সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশ্বস্ততার অভাবই অনেক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ওয়াগুরা থেকে ফেরার পথে পাটানের এক ধাবাতে কাজি সাহেবের সৌজন্যে দুপুরের খাবার জিভে জল আসা লাহাবি কাবাব। তার পর সোজা ডাল লেক। নভেম্বর মাসের নরম রোদ। দূষণহীন ঠান্ডা হাওয়া। ঘন্টাখানেক শিকারাবিহার হল। ডাল লেক তখন বেশ অপরিষ্কার বিশেষ করে কিনারার ধারে। কাঁচের মত স্বচ্ছ জলের যে গল্প শুনেছিলাম তা কিন্তু দেখলাম না। ডাল লেকের ধারে পিরপঞ্জলের কোলে প্রসিদ্ধ মুঘল উদ্যান নিশাদবাগ। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের বেগম নূরজাহানের ভাই আসিফ স্থাপত্য শিল্পী। অসাধারণ ডিজাইন। তবে এই শীতের সময় ফুল ফোটে না, পাতাঝরা চিনার আগুন ছড়ায় না, ফোয়ারাগুলোয় জলের ঊচ্ছ্বাস কম, সামগ্রিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, সব মিলিয়ে মালিন্যের প্রতিচ্ছবি। মনটা খারাপ হয়ে গেল।

শঙ্করাচার্যের প্রাচীন শিব মন্দির ডাল লেকের ধারে এক হাজার ফুট ওপরে। এখনকার মন্দির তৈরি হয় নবম শতাব্দীতে। তবে আড়াই হাজার বছর আগে এখানে বৌদ্ধদের ধর্মস্থান ছিল। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম আমরা দুজন মানে আমি আর সঞ্জয়। কাজি সাহেব নিচেই ছিলেন। সোনালী বিকেল,ঘড়িতে পাঁচটা। মন্দিরে আমরা দুজন ছাড়া আর মাত্র একজন। তিনি পুরোহিত। খুব দুঃখ করে বললেন এই সন্ত্রাসের সময় পর্যটক প্রায় নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে যে হাতে গোনা হিন্দুরা এখনও টিকে আছে, তারাও খুব কমই আসে। আগে কিছুটা জানতাম, এই পুরোহিতের কাছে আবার শুনলাম। আশির দশকের শেষ অবধি কাশ্মীরে অনেক হিন্দু পন্ডিত ছিলেন। হিন্দু মুসলমান সৌহার্দ্য ছিল। তারপর নামল বিভেদের ধস। ১৯৮৮ র পর মাত্র দুবছরে উত্যক্ত অত্যাচারিত পন্ডিতরা উদ্বাস্তু হয়ে কাশ্মীর ছাড়লেন। এই প্রাচীন মন্দিরের রমরমার দিনও হল শেষ। তবুও হিন্দু পর্যটকরা আসত, ইদানীং প্রায় কেউ আসে না।

মন্দির দেখেছি। হজরতবালের মসজিদ দেখতে চাই শুনে কাজি সাহেব বেশ খুশি। সঞ্জয় একটু ইতস্তত করছিল। কাজি সাহেব বললেন, ভয় পাবেন না ঐ মসজিদটা এখন কাশ্মীরের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। শঙ্করাচার্য মন্দির ডাল লেকের দক্ষিণ অংশে, হজরতবাল উত্তরে। যেতে একটু সময় লাগল। দিনের আলো বিদায় নিয়েছে, সন্ধ্যে হয়েছে। ১৬৩৪ সালে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদ মুসলমানদের পবিত্র ধর্মস্থান। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদের চুল এখানে রাখা। কাজি সাহেব ভিতরে গেলেন। আমরা বাইরে থেকে দেখলাম। ডাল লেকের ধারে ইসলামিক স্থাপত্যের সুন্দর নিদর্শন। সাদা পাথর, এক গম্বুজ এক মিনার, সন্ধ্যার আলোকসজ্জায় ঝলমলে মনোরম দৃশ্য।

পরের দিন সকাল আটটায় কাজি সাহেব নিতে এলেন। যেতে হবে উড়ি। এখানে জলবিদ্যৎ কেন্দ্রের সাবস্টেশনে আমাদের আর একটা রিমোট টার্মিনাল ইউনিট বসবে।

আমাদের হোটেল থেকে গন্তব্য স্থানের দূরত্ব একশ কিলোমিটারের একটু বেশি। পথ পাটান আর বারামুলা হয়ে। পাটানের মত বারামুলাও সন্ত্রাসবাদের জন্য কুখ্যাত। দুটো নামই খবরের কাগজ আর টিভিতে বারবার আসে। আজ আবার আকাশ মেঘলা। কুয়াশা আছে। এই অবস্থায় সেনাবাহিনীর এতগুলো ব্যারিকেড পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় তাড়াতাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। উড়ি পৌঁছতে লাগল সাড়ে তিন ঘন্টা। পাটানে চা খেতে নেমেছিলাম। রাস্তার ধারে ছোট চায়ের দোকানে পৌঁছে দেখি হুড়মুড় করে চার পাশের দোকান বন্ধ হচ্ছে, চারদিকে হুড়োহুড়ি ভাব। এখানে নাকি কথায় কথায় হরতাল হয়। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে রওনা হলাম।

উড়ি যাবার রাস্তা আগেই বলেছি তৎকালীন কুখ্যাত বারামুলা হয়ে। এখানে সামরিক বাহিনীর তৎপরতা একটু বেশি। কেন উড়ি যাচ্ছি তার উত্তর দিতে হল। কাগজপত্র দেখল। গাড়িটাও ভালমত পরীক্ষা করল। আমারতো মনে হল পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক। ভীড় না হলেও রাস্তায় লোকজন। যানবাহন চলছে যদিও কড়া চেকিং। দোকানপাট খোলা। আপাতদৃষ্টিতে সন্ত্রাসের কোন চিহ্ন নেই।

ঝিলাম নদীর বাঁধে  এন এচ পি সির উড়ি-১ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।  তখন অবশ্য উড়ি-১ এ ১ সংখ্যাটার দরকার ছিল না, কেননা দ্বিতীয় কেন্দ্র উড়ি-২ তখনও হয় নি। ১২০ মেগাওয়াটের  চারটে ইউনিট , মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৪৮০ মেগাওয়াটা। পাকিস্তান বর্ডার বেশ কাছে, দুতরফে গোলা গুলি এই উড়ি সেক্টরে নিত্যনৈমিত্তিক। বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওয়ার হাউস আর কন্ট্রোল রুম মাটির নিচে গুহার মধ্যে। কন্ট্রোল রুমে জায়গা প্রায় নেই। রিমোট টার্মিনাল ইউনিট শুধু বসালেই হবে না, এর সঙ্গে অন্য প্যানেলগুলোর তারসংযোগ বা কেবল্ কানেক্সনেরর ব্যবস্থাও দেখতে হবে। মাথা ঘামিয়ে আর স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারদের সহায়তায় সমাধান পাওয়া গেল, যদিও একটু সময় লাগল। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ক্যান্টিন আছে। লাঞ্চ করে ফেরার পালা।

উড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র বারমুলা জেলাতে কিন্তু বারামুলা বসতি এলাকা থেকে বেশ কিছুটা দূরে। আসার সময় এই এলাকা পেরিয়েই  এসেছি। তখন কাশ্মীরের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দৃশ্য ছাড়া উল্লেখ করার মত আর কিছু নজরে পড়ে নি। তবে এবার ফেরার এমন কিছু দেখলাম যার উল্লেখ করা উচিত। খালি রাস্তা। সামনে কোন গাড়ি নেই। পিছনে একটা বাস একশ মিটার দূরে। ব্যারিকেড দেখে যথারীতি গাড়ি থামল। ব্যারিকেডের ওপারে অদ্ভুত ব্যাপার। একজন সিনিয়র অফিসার গোটা তিনেক সতীর্থ নিয়ে মাঝরাস্তায় টি পার্টি করছেন। একজন জওয়ানের হাতের ট্রেতে টিপট আর গোটা কয়েক কাপ. অন্যজনের চিপস আর বিস্কুট। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পর অধৈর্য হয়ে ড্রাইভারকে হর্ণ বাজাতে বলল সঞ্জয়। কাজি সাহেব মানা করলেন। বললেন কর্ণেল সাহেব অসন্তুষ্ট হবেন। আমারতো মনেই হল না হর্ণ বাজাবার কোন ইচ্ছে ড্রাইভারের ছিল। প্রায় মিনিট পনের পর আমাদের ডাক পড়ল। কর্ণেল সাহেব চা শেষ করে খালি কাপটা রেখে আমাদের পরিচয়, কাশ্মীর আসার উদ্দেশ্য, শ্রীনগরে কোথায় আছি এইসব মামুলি প্রশ্ন করলেন। আমাদের একটু প্রতীক্ষা করতে হল বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন। সৌজন্যের খাতিরে আমাদের চা অফার করলেন, আর আমরাও বিনয়ের সঙ্গে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রত্যাখান করলাম। আমার চা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না তা নয়, তবে মনে হল খেতে চাইলে কর্নেল সাহেব হয়তো আদৌ খুশি হতেন না।

ফেরার পথে পাটানে চা খাবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু হল না। দোকান পাট খোলা নেই। হরতাল শেষ হয় নি। চলে এলাম লালচকে। এখানে দোকান অনেক। অর্ধেকের বেশি বন্ধ, যে কটা খোলা তাতে খদ্দের নেই। পর্যটক নেই, তাই দোকানিরা মাছি তাড়াচ্ছে। একজন দোকানদার দুঃখ করে বললেন এই গন্ডগোলে ব্যবসার হাল খুব খারাপ। বছর তিনেক হল বিদেশি আর ভারতের পর্যটক কম। এবছর তো একেবারেই কম। দেওয়ালির পর পর্যটকের সংখ্যা কম হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু মে আর জুনেও ছিল বেশ কম। আরও কিছু সাধারণ কথাবার্তা হল। বুঝলাম কাশ্মীরিরা নিজেদের পুরোপুরি ভারতীয় নাগরিক মানেন না। কাশ্মীরের মানুষেরা নিজেদের যাই ভাবুক আর যে কারণেই ভাবুক, আদতে কাশ্মীর চলে ভারতীয় করদাতাদের অর্থে, তাই ভারতের অন্যপ্রদেশগুলো থেকে লোক বেড়াতে না এলে এরা বেহাল হয়ে যায়। কথায় কথায় হরতালে এই নড়বড়ে আর্থিক পরিস্থিতি আরও পঙ্গু হয়ে পড়ে।

বাংলা ছবিতে কমল মিত্রকে বেশ আভিজাত্যপূর্ণ গাউন পরতে দেখেছি। ভাল গুলো সিল্কের আর দামী। এখানে উলেরও পাওয়া যায়। কাপড়টা শালের আর বর্ডারে কাজ। একটা পছন্দ হল। বর্ডারের কাজটা মেসিন ওয়ার্ক মনে হল। দোকানদার বলল হাতের কাজ। দরাদরি করে ষাট পার্সেন্ট দাম কমিয়ে কিনলাম। সঞ্জয় একটা শাল কিনল অর্ধেক দাম কমিয়ে। দেবার সময় দোকানদার দুঃখ করে বলল সবাই কাশ্মীরের মানুষদের দুরাবস্থার সুযোগ নিচ্ছে।

কাশ্মীরি আপেল খুব উৎকৃষ্ট। দিল্লির বাজারে তার দেখা মেলা ভার। প্রায় সবটাই রপ্তানি হয়। শ্রীনগরের বাজারে সেপ্টেম্বরে আসে, বড়জোড় অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ অবধি থাকে। এই নভেম্বর মাসে দুর্লভ। খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করায় কাজি সাহেব খুঁজেপেতে কয়েকটা কিনলেন। খিধে পেয়েছিল। হোটেলে ফিরে তিনজনে বসলাম। আপেলগুলো আকারে বড় নয়, কাটলে ভিতরে গোলাপী আভা, রসালো আর খুব মিষ্টি। টিভি চলছিল, খবর শুরু হল।

কাশ্মীরে এসে ভয় পাবার মত কিছু নজর পড়ে নি। দিল্লিতে কাশ্মীর আসার আগে মনে যে ভয়টা ছিল এখানে বরং সেটা কেটে গেছে। কিন্তু টিভিতে খবর দেখে বেশ ভয় পেলাম। পাটানে যে জায়গায় চা খেতে নেমেছিলাম, টিভিতে তার ছবি। চায়ের দোকানটাও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। আমরা সেখান থেকে রওনা হবার কিছুক্ষণ পরেই ওখানে সেনাবাহিনী আর সন্ত্রাসবাদিদের ভয়ংকর সংঘর্ষ আর গুলিবিনিময় হয়েছে। গোটাতিনেক সন্ত্রাসবাদি আর একজন জওয়ান মারা গেছে। কোন হরতালের জন্য হঠাৎ দোকান বন্ধ হয় নি। অভিজ্ঞ কাজি সাহেব আন্দাজ করেছিলেন কিন্তু তখন আমাদের বলেননি। কাজি সাহেব জানালেন, ক্রসফায়ারে ফেঁসে গেলে কখনও কখনও নিরীহ মানুষেরও প্রাণ যায়। আমাদের ভয় পাবারই কথা।

আমাদের দিল্লি ফেরার ফ্লাইট ছিল পরের দিন দুপুরে। প্লেন ঘন্টাখানেক লেট ছিল। শ্রীনগর এয়ারপোর্টে রুটিনমাফিক সুরক্ষার অসম্ভব কড়াকড়ি। সেনাবহিনীর অনেকজন প্লেনে যাত্রী। আকাশে মেঘ নেই। টেকঅফের পর ওপর থেকে পীরপঞ্জলের মনোরম দৃশ্য। বরফের পাহাড় সোনালী রোদ ছড়াচ্ছে।

শ্রীনগরে আরও একবার গেছি। প্রায় আঠেরো বছর পর ২০১৫র এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে। তখন আমি কল্পতরু পাওয়ারে। বার্ষিক বাজেট মীটিং। সিনিয়র ম্যনেজমেন্ট টিম কোম্পানির খরচে সস্ত্রীক নিমন্ত্রিত। শ্রীনগরের তখন অন্যরূপ। এয়ারপোর্টের আশপাশ ছাড়া সেনা তো দূরের কথা পুলিসও বিরল। রাস্তায় যানজট আছে, ব্যারিকেড প্রায় নেই, ট্রাফিক আর দূষণ অনেক বেড়েছে। এই সিজনের শুরুতেই অনেক দেশি বিদেশি পর্যটক। দোকান বাজারে রমরমা ভীড়। সন্ত্রাসবাদের কালো মেঘ কেটে যাওয়ার সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত। ডাল লেকের ধারে বিলাসবহুল তাজ হোটেলে চার রাত থাকার ব্যবস্থা। সাড়ে তিন দিন ধরে দফায় দফায় পাওয়ার পয়েন্ট ও এক্সেলের কচকচি আর উত্তেজনা। সব মীটিংএ সবাইকে থাকার দরকার ছিল না। যারা ফ্রী আর সব স্পাউসদের জন্য ছিল কোম্পানি আয়োজিত ট্যুরিজিম। আমাদের মত ডিভিশন হেড দের সব মীটিংএ থাকা বাধ্যতামূলক হলেও এই নিয়ম কঠোরভাবে মানা হত না। আমিও সুযোগ বুঝে গুলমার্গে বরফ দেখে এলাম। রাত দশটার সময় ডাল লেকের ধারে আইসক্রিম খেয়েছি। ডাল লেক এখন অনেক পরিস্কার, আগের মত নোংরা নয়। আমার সহধর্মিনীতো ভীষণ খুশি। শ্রীনগরের কোনো দ্রষ্টব্য বাদ দেয় নি। ডাল লেকে বোটিং করেছে। পেহেলগাম আর গুলমার্গ তো দেখেছেই। গুলমার্গ সেই বারামুলা জেলাতেই পড়ে। তবে এখন নিরুপদ্রব। গুলমার্গ থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ একটা বিশাল বড় দোকানে পশমিনা শাল কিনলাম। দোকানদার বলল সন্ত্রাসবাদ প্রায় নেই। ব্যবসা যে ভালই চলছে তাতো দোকানে ভীড় দেখেই বোঝা যায়। দামও কমাতে চায় না। অনেক কষ্টে কিছু ডিসকাউন্ট পাওয়া গেল।

দিল্লি ফিরে সবাইকে বললাম কাশ্মীর দিল্লির চেয়ে নিরাপদ। বন্ধুদের এই সুযোগে কাশ্মীর ঘুরে আসতেও বললাম। শান্তি অবশ্য স্থায়ী হয় নি, কিছুদিনের মধ্যেই আবার গন্ডগোল শুরু।

অনেকে কাশ্মীরকে ভারতের সুইজারল্যান্ড বলে। ২০১৭ সালে স্ত্রী পুত্র সহ সপরিবারে সুইজারল্যান্ড বেড়াতে গিয়েছিলাম সাত আট দিনের জন্য। হিমালয় নবীন পর্বতমালা। তুলনায় আল্পস প্রৌঢ়। প্রাকিতিক সৌন্দর্যে হিমালয় তাই এগিয়ে। কিন্তু পর্যটন পরিকাঠামো আর পর্যটক সুবিধার বিচারে কাশ্মীর অনেক অনেক পেছিয়ে। দুঃখ এটাই।

লেখকের মন্তব্য: বাস্তব অভিজ্ঞতা অবলম্বনে যদিও কল্পনার মিশ্রণ আছে।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleThe Way To Love
Next articleবিশের আর্তি
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments