কেদারনাথের দুর্গম পথে ভক্ত প্রবীণ যাত্রী,

আশ্রয় লভে গিরিকন্দরে নামে যবে তমোরাত্রি।

পরদিন প্রাতে যবে উপনীত দেবমন্দির চত্ত্বরে,

হতবাক সে হেরিনীরবতা তুষারশুভ্র প্রান্তরে।

কেদারনাথ দেবাদিদেবের জাগ্রত এক মুরতি,

তুহিন ধবল প্রকৃতির মাঝে শিবশম্ভুর বসতি।

দুর্গম পথ সর্পিল তথা গিরিখাত ইতিউতি,

কখনো বা বুঝি ঘনঘোর সেথা দিবসেও নামে রাতি।

ভয়ানক সেই পিচ্ছিল পথে মৃত্যুর হাতছানি,

তথাপি ভক্ত নির্ভীক সদাহৃদয়ে পিনাকপানি।

শতাব্দী পরে শতাব্দী চলে ভক্তের আনাগোনা,

যত দুর্গমই হউক না পথ অধরা অচিন অজানা।

মোদের কাহিনীসূত্রটি জেনো তিন শতাব্দী আগে,

ভগবান যেথা স্বয়ং হাজির ভক্তের অনুরাগে।

তখন কেবল হাঁটাপথই ছিলছিল না অশ্ব ডান্ডী,

সম্বল ছিল ভক্তের করে একটিমাত্র দন্ডী।

আমাদের সেই যাত্রীটি যবে উপনীত দেবদেউলে,

হেরিল দেউল সদর দুয়ার রুদ্ধ যে অর্গলে।

পুরোহিত যিনি কেদারনাথের দাঁড়ায়ে আছেন সমখে,

বিদায়ের তরে প্রস্তুত বুঝি প্রণমি সজল চোখে।

ত্বরাপদে সেই ভক্তটি আসি জিজ্ঞাসে পুরোহিতে,

কি হেতু আর্য, মন্দিরদ্বার বন্ধ আজিকে প্রভাতে !

এহেন প্রশ্নে বিস্মিত তথা বিরক্ত পুরোহিত,

কহেনযাত্রী,ধারণাটি তব নাহি হেরি কিন্চিত।

আজি হতে পুরা ছয় মাস ব্যাপি দেউল রবেই বন্ধ,

যুগ যুগ ব্যাপী এই রীতিনীতিআছে কি কোনই সন্দ !

ছয় মাস পরে হিমের অন্তে অর্গল উন্মুক্ত,

গ্রীষ্মকালের প্রারম্ভে পুন সমাগমে যত ভক্ত।

যাত্রীটি কহেতাহলে কিরূপে মোর হয় দরশন !

এত ক্লেশ হায় সবই বিফলভক্তের ক্রন্দন।

আমি নিরূপায়পূজক হাসেনঅহেতুক তব কষ্ট,

তব সনে আর নহে কোন কথাসময় মিছেই নষ্ট

ভক্তটি বলেআমি রব হেথামন্দির অঙ্গনে,

কেমনে যে ত্যজি এই স্থান হায় বিনা দেব দরশনে !

আসুক ঝন্ঝাতুষার বৃষ্টিতথাপি রবই হেথা,

মৃত্যু আমারে করুক বরণএই মোর শেষ কথা।

করুণার হাসি হাসেন পূজকতুমি নির্বোধ অতি,

চলিলাম এবে মোর গেহ পরেসময় লভিছে গতি।

দিবা অবসানঘনাধাঁর ছায়েহিমেল বাতাসবিণ,

তুষারঝন্ঝাতথাপি প্রবীণ হৃদয় শঙ্কাহীন।

ধীরে ধীরে হায় তুষারগুহায় প্রোথিত তাহার দেহ,

এমত সময় দণ্ডায়মান অবল সকাশে কেহ।

জটাজুটধারী অবধূত তিনি সুদীর্ঘ অবয়ব,

অঘোর পন্থী কণ্ঠে সতত শিবশম্ভুর স্তব।

উদ্ধার করিঅশক্ত প্রাণে বিভূতি মাখায়ে অঙ্গে,

পানীয় দিলেন মুখগহ্বরে অমৃত অনুষঙ্গে।

ধীরে ধীরে শিবভক্ত মোদের নিদ্রায় মোহাবিষ্ট,

অন্তর্হিত হলেন অঘোরীসুতৃপ্ত পরিতুষ্ট।

পোহাইল নিশিদুর্যোগরাশিনাহি যে কোনোই চিহ্ণ,

রূপালী প্রভাতে রবিকর সাথে প্রকৃতির রূপ ভিন্ন।

কলকোলাহোলে সেই প্রবীণের কাটে যবে ঘুমঘোর,

হতবাক হয় সৃষ্টিরে হেরিকি অপরূপ মনোহর।

স্মৃতি মাঝে ফেরে গত রাত্রের অঘোরী বাবার কথা,

অশ্রু সজল ভক্ত কপোলহৃদয়ে অসীম ব্যাথা।

এমত সময় দেউল দুয়ারে দেখে সেই পুরোহিত,

অর্গলখানি খুলিবার তরে তৈয়ার নিশ্চিত।

ত্বরাপদে যায় পূজকের সনেশুধায় প্রবীণ ভক্ত,

কিরূপে দেউল করিবেন দেব একদিনে উন্মুক্ত !

আর্য আপনি তবে গতকাল কিরূপে বলেন মোরে,

দেউল দুয়ার বন্ধ রহিবে ছয়টি মাসের তরে !

অথচ সদর খুলিছে আজিকেঅদ্ভুত অতিশয়,

এমত কর্ম আপনার দেব কভু নাহি শোভা পায়।

বিমূঢ় পূজক প্রবীণ ভক্তে চিনিতে নারেন মোটে,

তখন যাত্রী তাঁহারে বলেন সব কথা অকপটে।

এবার তাঁহার স্মৃতি জাগরণআপ্লুত পুরোহিত,

কহেনধন্য,আপনি ভক্ত, আপনি পরম ঋত।

স্বয়ং কেদার ভক্তের ডাকে আসিলেন এই ভূমে,

তাঁহার কৃপায় আপনি ছিলেন ছয়মাস ব্যাপী ঘুমে।

অভুক্ত দেহ তথাপি তাহার ছায়া নাহি অবয়বে,

আপনার ন্যায় ভক্তিমান পুরুষ বিরল ভবে।

দেবাদিদেবের আশীর্বাদেই সহনিতুষারপাত,

রবেন আজিও এমনই সতেজবীত শত দিনরাত।

হে সুধী,আপনি পুণ্য আধারকটু আচরণ কত,

দয়ানিধি প্রভু মাগিলাম ক্ষমাপূজকের শির নত।

কেদারেশ্বর পূজায় নিরত বহুবর্ষই ব্যাপী,

পরমেশ্বরে দর্শন হায় লভি নাই তদ্যপি।

মোর বিশ্বাসে আজো বুঝি হায় নাহি কোনরূপ ভীত,

নয়ন বারিতে বাণভাসি সেই কেদারের পুরোহিত।

তাই বলি সবে বিশ্বাস রাখো পরমপুরুষ প্রতি,

যাঁহার প্রসাদে দূরীভূত হয় মানবের দুর্গতি।

তিনিই সর্বশক্তিমানলহ হে তাঁহার শরণ,

অমৃত যবে মন্থন কালে গরল করেন ধারণ।

শিবশম্ভুর অপার শকতি রহিবে না আর সুপ্ত,

জীবাণুর এই ভয়াবহ বিষ অচিরে হইবে লুপ্ত।

প্রার্থনা কর তাঁহার চরণেভক্তি বিশ্বাসে,

তবেই মুক্ত নি:শ্বাস লভে মুক্তির আশ্বাসে

জগৎপিতার ভক্তের ন্যায় চিত্তকে করো পূত,

আস্থা রাখিও পরম সত্যেকভু না হইও চ্যুত।

আজ এই ঘোর দুর্দিনে মোর এইটুকু শুধু মিনতি,

তিতিক্ষা তথা শ্রদ্ধার সাথে জানাও তাঁহারে প্রণতি।

তুমিই শ্রেষ্ঠ,সার্বভৌমতোমার উপরে নাই,

রক্ষা কর হে কেদারেশ্বরজয় জগতের সাঁই।

————————————————————

————————————————————

                  স্বপন চক্রবর্তী

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকোরোনার শিক্ষা।
Next articleকোরোনা ভাইরাস ও কোভিড – ১৯ রোগ নিরাময়
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments