রাত তখন দশটা, চারজনে রাস্তায়, পরিষ্কার আকাশে একফালি চাঁদ একটা আলো আঁধারির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সামনে ছোট্ট টর্চ হাতে শুভ আর জয়া পিছনে মলয়দা ও বৌদি। সমুদ্র রাস্তা থেকে দেখা না গেলেও সমুদ্রের স্নিগ্ধ হাওয়ার পরশ সকলে অনুভব করছে ।
“এতক্ষন তোমরা অরুণার গল্প শুনলে এবারে আমি একটা গল্প বলি?”
“তোমারতো যত আজগুবে গল্প,” বৌদি মলয়দাকে বলেন।
“শোনোই না। যে গল্প বলছি তাতে আমি-তুমি হিরো হিরোইন,”
“আচ্ছা মলয়দা বলুন শুনছি,” শুভ হেসে বলে।
“সবে পুরনো মারুতি বেচে ঝাঁচকচকে সান্ত্রো গাড়ি কিনেছি। একটা বিহারি ড্রাইভার রেখেছিলাম তার পেট্রল চুরির বহর দেখে তাড়িয়েছি, নিজেই ড্রাইভ করি। এই সময় কলকাতা বাইরে এক আত্মীয়ের বাড়ি বিয়ের নেমন্তন্ন। দিব্বি ট্রেনে যাওয়া যেত কিন্তু আমাদের মানে বাঙালিদের, নিজেদের পদোন্নতি অন্যদের দেখতে না পারলে শান্তিই নেই। অরুণার বারণ সত্ত্বেও আমি গাড়ি চালিয়েই গেলাম।”
“আমার কোন কথাটা শোন তুমি?” মলয়দাকে মাঝপথে থামিয়ে অরুণা বৌদির অভিযোগ।
মলয়দা বলেন, “ওই একবারই শুনিনি তার জন্য আজও পস্তাই । গাড়ি নিয়ে যাওয়াতে অতিরিক্ত খাতিরও পেয়েছি। আরো কদিন থাকবার অনুরোধ উপেক্ষা করে দুপুরে বাড়ির পথ ধরলাম। একটানা ঘন্টা তিনেক গাড়ি চালিয়ে কোমড় ধরে গেছে, রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানে গাড়ি থামালাম। উদ্দেশ্য একটু হাত পা ছড়িয়ে নেওয়া। দোকান বলতে একটা ছোট্ট মাটির কুঁড়ে ঘর, বাইরে বাঁশের দুটো বেঞ্চি। দোকানের ভেতরটা অন্ধকার বিকেলেই লম্প জ্বালাতে হয়েছে। দোকানি পাকা দাড়িওলা এক বুড়ো অলোয়ান জড়িয়ে বসে। দুটো চা বানাতে বলে আমি আর জয়া খানিক পায়চারি করে নিলাম। দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম খদ্দের নেই কেন ? সে জানাল গ্রামের লোকেরা বিকেলে আর ঘর থেকে বেরোয় না আজকাল রাস্তার গাড়িও বিশেষ এখানে থামে না, তাই সূর্য ডোবার সাথে সেও দোকান বন্ধ করে দেয়। চায়ের গ্লাস নিয়ে আমি আর অরুণা বেঞ্চে বসেছি। শীতকালের বিকেল সূর্য অস্ত যাচ্ছে তার শেষ গোলাপী রশ্মি টুকু ছড়িয়ে। পাখিদের বাসায় ফেরার কলতান। হঠাৎ চোখ পড়লো রাস্তার উল্টোদিকের এক ফালি জঙ্গলের পিছনে বেশ বড়ো জীর্ণ একটা বাংলো বাড়ি। জঙ্গলের জন্য দোতলার যতটা দেখা যায় তার অতি করুণ অবস্থা । ছাদ ভেঙে পড়ছে, কার্নিসে গজানো লতা গুল্মো প্রায় ছাদ ছুঁইছুঁই, জানালার অর্ধেক শার্শিই ভাঙ্গা। দেখে মনে হয় ব্রিটিশ জমানার স্থাপত্য বাহন করছে। অরুণাকে বললাম, এরাস্তায় একটাও হোটেল নেই এই বাড়িটাকে পেলে মেরামত করে দারুন একটা হোটেল বানাতে পারতাম। দুটো কাগজে বিজ্ঞাপন আর কজন ভ্রমণ লেখকের দু কলম লেখা, আর দেখতে হবে না পুরো ছুটির মরশুম হাউসফুল।”
“বাঃ দারুন প্ল্যান, বাড়িটাকে কি হোটেল বানিয়ে ছাড়লেন?” শুভ জিজ্ঞেস করে।
“আগে পুরোটা শোনো। ওটা রায়চৌধুরীদের বাগান বাড়ি, আচমকা এক অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে আমি অরুণা দুজনেই চমকে দেখি আমাদের পাশে কখন রোগা পেটকা ২০-২২ বছরের একটা ছেলে এসে বসেছে, আমরা খেয়ালই করি নি। পরিচয় জিজ্ঞেস করতে, বলে তার নাম কালু এই গ্রামেই থাকে।
এতো ফেকাসে ফর্সা যার গায়ের রঙ তার বাবা-মা কালু নাম কেন রাখলো জানি না। একমাথা ঝাঁকড়া চুল মুখভর্তি দাড়ি, কালুর চোখগুলো গোধুলির আলোতে কেমন ঘোলাটে লাগলো। পরনে শুধু শার্ট প্যান্ট, ভাবলাম ওর কি ঠান্ডা লাগছে না? আমি জ্যাকেট আর অরুণা শাল গাড়ি থেকে নেমেই চাপিয়েছি।
কালু বলে, রায়চৌধুরীরা ছিল এখানকার জমিদার, ওই জঙ্গল, এককালে সাজানো ফুলের বাগান ছিল, রাস্তা পর্যন্ত ছিল বাড়ির পাঁচিল, বিশজন লেঠেল সবসময় বাড়ি পাহারায় থাকতো। আজ এই দশা কেন ? উত্তরে কালু বলে, হারান পদ্মার ভূত। আমার ভাই ভূত ফুতে বিশ্বাস নেই মুচকী হেসে বল্লাম হারান পদ্মা কে?
কালু যে গল্প শোনালো তা এরকম, জমিদার ছিলেন অহংকারী, মদ্যপ ও চরিত্রহীন। কলকাতায় তার তিন স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বাঈজী নিয়ে আসতেন ফূৰ্ত্তি করতে। মধ্যরাত্রী পর্যন্ত চলত নাচ গানের আসর। গ্রামের মেয়ে বৌদের ওপরেও ছিল কুদৃষ্টি, অনেকের সাথে করেছেন অত্যাচার। শুধু জমিদারের লেঠেল আর করের ভয়ে গরিব গ্রামবাসীরা সব সহ্য করত। হারান জমিদার বাড়ির ভৃত্য, বিয়ে করে বৌ নিয়ে আসে মনিবের আশীর্ব্বাদ নিতে। এই অবধি সকলে জানে, তারপরে কি হয়েছিল কারোর জানা নেই। দু দিন পরে পদ্মার উলঙ্গ মৃতদেহ পাওয়া যায় বাড়ির কুয়োতে, হারানকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় ওই কাঁঠাল গাছে পাওয়া যায়। গ্রামবাসীরা জানতো এসবের পিছনে জমিদারের হাত আছে কিন্তু কেউ ভয়ে টু শব্দও করে নি।
এই ঘটনার ঠিক তিন দিন পর জমিদার ও তিন লেঠেলকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। জমিদার দোতলায় তার নিজের ঘরের মেঝেতে। লেঠেলদের একজন সিঁড়িতে, দুজন ওই কাঁঠাল গাছের গোড়ায়। কারুর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, চোখ খোলা, মুখ বিভীষিকাময়। ওই দেখে বাড়ির বাকি লোকজন ভয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। গ্রামের লোকেরা ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় যায় না। লোকে বলে রাতে নাকি লাল শাড়িতে পদ্মাকে ওই বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরতে দেখা যায়। ”
চলবে……….