জয়ার আবদারে অরুণা বৌদি বলতে থাকেন, “আমি অনেক ভালো ছিলাম, আজকালকার মেয়েদের যেমন দেখি কলেজের নাম করে বিশ্ব ব্রম্মান্ড ঘুরে বেড়ায়, কলেজ কাট মারা কি জানতামই না।  সব শিখেছি মলয়ের দৌলতে। আমার সকালে ক্লাস, কলেজে ঢোকার মুখে একদিন আমাকে প্রায় কিডন্যাপ করে সোজা ভিক্টোরিয়ায় উপস্থিত, ওনার খুব প্রেমালাপ করতে ইচ্ছে হয়েছে তাই ।  চারিদিকে শুধু বয়স্ক লোকেরা   প্রাতঃভ্রমনে ব্যস্ত ।  কেউ কেউ আর চোক আমাদের দেখছে।  আমার কি ভয় এই বুঝি মেসোর কোনো পরিচিত আমাকে দেখে ফেল্লো। এখন ভাবলে হাসি পায় তখন কি ভীতু আর বোকা ছিলাম।”

“তোমার সাহস বাড়িয়ে কত এডভান্স করেছি তোমায় বল?” মলয়দার হাসি মুখে বড়াই।

“বেশি সাহস ভালো নয় তাতো একদিন বুঝেছো?” অরুণা বৌদি বলেন।

হোটেলের লনে টেবিল পেতে গার্ডেনে ডাইনিং এর ব্যবস্থা। সব টেবিলে একটা করে মৃদু বাতি জ্বলছে , শুধু মলয়দাদের টেবিলে কোনো আলো নেই।

“মলয়দা আপনাদের এখনো খাবার দিয়ে যাই নি? টেবিলের আলোটাও নেভানো, বেয়ারাটাকে একটা আওয়াজ দিই ।” শুভ হঠাৎ খেয়াল করে ।

“তার দরকার নেই। তোমরা আসার আগেই আমাদের ডিনার হয়ে গেছে। অন্ধকারে বেশ  রোমান্টিকই  লাগছে ।”

জয়া হেসে বলে, “বৌদি মলয়দা আজও কি রোমান্টিক। ”

“আমাদের কি অনেক বয়স হয়ে গেছে ?” মলয়দা হেসে বলে।

বৌদি বলেন, “জান জয়া যাদের সদ্য  বিয়ে হয়েছে  তাদের গল্প শুনতে খুব ভালো লাগে। মনে পরে যায় ফেলে আসা আমাদের সেই দিনগুলোর কথা।  ছোট বেলা থেকে দেখেছি খুব গম্ভীর, তাই বেশ ভয়ই পেতাম বাবাকে। যা কিছু আবদার মার কাছে, উনি বাবাকে সবেতে রাজি করাতেন। একমাসের গরমের ছুটি ইচ্ছে না থাকলেও বাবা-মার কাছে কাটেনিতে  যেতে হবে। বাবা টেলিগ্রামে জানিয়েছেন দুদিনের মধ্যে আসছেন আমাকে নিয়ে যেতে । আমার আরেক ভয় মলয়ের চিঠি বাবার হাতে পড়লেই নির্ঘাত কলকাতায় পড়াশোনার পাঠ  বন্ধ হয়ে যাবে। মলয়ের শতধিক অনুরোধ সত্ত্বেও কাটনির ঠিকানা ওকে দিইনি। অবশ্য পৌঁছেই মলয়কে চিঠি দিলাম, তোমার জন্য ভীষণ মন খারাপ, ইত্যাদি, শুধু দিলাম না কাটনির ঠিকানা ।

একদিন সন্ধ্যেবেলা মায়ের সাথে কলকাতার গল্প করছি, ভাবছিলাম মলয়ের কথা বলবো নাকি মাকে? ইতিমধ্যে বাবা অপিস থেকে ফিরে সোজা এসে আমাকে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন, মলয় বলে কাউকে চিনি নাকি? আমার মাথায় বজ্রপাত, হাত পা ঠান্ডা হয়ে কাঁপতে শুরু করেছে, হ্যাঁ বা না কিছুই মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। ভাবছি বাবা মলয়ের কথা কি করে জানল?  মা তো আরও অবাক, মলয়টা কে? অবস্থা দেখে বাবা মুচকি হেসে বললেন অত আমতা আমতা করার কি আছে? চেনতো ভালোই, ছেলেটির সাহস আছে, আমার বেশ লেগেছে, তোমার জন্য এতো দূরে দৌড়ে এসেছে, যাও দেখা করে এসো বাইরের ঘরে বসিয়েছি। আমার নিজের কানে শোনা কথাগুলো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল  না, আবার মলয়কে দেখার আনন্দে বুকের ধুকধুক বেড়ে গেছে দৌড়ে গেলাম, বসার ঘরে দেখি হাসি মুখে বসে আছেন।  জিজ্ঞেস করলাম কি করে ঠিকানা পেলে ? উত্তর পেলাম, ‘জোগাড় করতে জানতে হয়’। পরে জেনেছিলাম মাসতুতো দাদার সাথে আলাপ জমিয়ে ঠিকানা হাতিয়েছিলো। ওর বাবার এক বন্ধু ডালমিয়া রিফ্র্যাক্টরীতে চাকরি করতেন তার ওখানেই উঠেছিল । যে ৩/৪ দিন মলয় কাটনিতে ছিল রোজ রাতেই আমাদের বাড়িতে ভুরিভোজের ব্যবস্থা। বিদায় নেবার সময় বাবা শুধু বললেন, মলয় আমার একটা অনুরোধ, অরুণার এবছরই  ফাইনাল ইয়ার ওর পড়ায় যেন কোন বিঘ্ন না ঘটে, ওকে ভালো করে পাস করতে দিও। পরীক্ষার হয়ে গেলে, আমি ওর মা নিয়ে  অবশ্যই  যাবো তোমাদের বাড়িতে বাকি সব কিছু পাকা করতে ।  ব্যাস, দেখতে দেখতে পরীক্ষা দিলাম, স্নাতক হলাম বিয়েও হল।  বিয়ের কমাস আগে মলয়ের বদলি হয় জলপাইগুড়িতে, তাই  মাত্র ১০ দিনের ছুটি নিয়ে এলো কলকাতায় বিয়ে করতে।  চটজলদি মধুচন্দ্রিমা শঙ্করপুরে, প্রথমবার এসেই ভীষণ ভালো লেগে গেল। সেই থেকে যখনি সুযোগ পাই দুজনে চলে আসি এখানে।”

“এই প্রথমবার হলেও বেশ লাগছে শঙ্করপুরের শান্ত সুন্দর সমুদ্র সৈকত।” শুভ বলে।

“আমারও। পাশে দীঘাতে যা গ্যাঞ্জাম, বেড়াতে এসেও  লোকের ভিড়, মোটেই  ভালো লাগে না, ” জয়া সায় দেয়।

“ঠিক বলেছ!  আগে দার্জিলিং ভাল লাগলেও এখন মনে হয় যেন সোমবার সকালের শিয়ালদহ স্টেশন।” মলয়দা বলেন।

সকলে হেসে উঠে।

“এই চলোনা হেঁটে সমুদ্রের দিকটা একটু ঘুরে আসি?” অরুণা বৌদি বলেন।

“ওদের যদি অন্ধকারে হাঁটতে ইচ্ছে না করে? এখানকার রাস্তায় তো কলকাতার মত আলো নেই , ”  মলয়দা বলেন।

“আমার হাঁটায় অসুবিধে নেই,” শুভ বলে।

জয়া বৌদির দিকে তাকিয়ে বলে, “যেতে পারি যদি আপনার গল্প চালু থাকে।”

“আমাদের ষ্টকে অনেক গল্প, আমি তো এখনো শুরুই করি নি,” মলয়দা বলে।

শুভ পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট্ট টর্চ বের করে, “মলয়দা আপনার সঙ্গে টর্চ আছে তো?”

“এখানকার রাস্তা আমাদের মুখস্থ, চোখ বন্ধ করেও হাঁটতে পারবো, তাছাড়া চাঁদের আলোতো  রয়েছে, তোমরা বরং টর্চ জেলে সামনে চলো আমরা তোমাদের পিছনে আছি ,” মলয়দা বলে।

“দেখ এতো তারা কলকাতার আকাশে কখনো দেখা যাই না,” জয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে।

“তাইতো প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে যখনই ইচ্ছে হয় এখানে চলে আসি,” অরুণা বলেন।

“গাড়ির রাস্তাটা আর একটু চওড়া করলে ভালো হয়” শুভ বলে।

“সরু রাস্তার কথায় আমার মনে পরে গেল, ” অরুণা বৌদি বলেন, “কাশি বেড়াতে গেছি, জানোই তো কাশির রাস্তা কেমন সরু। সকালে  বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দিয়ে হেঁটে হোটেলে ফিরছি।  পাশাপাশি হাঁটার তো জো নেই, আগে আমি, পিছনে মলয়। হঠাৎ আমার আত্মারাম খাঁচা হবার জোগাড়। দেখি গলির উল্টো দিক থেকে প্রকান্ড এক ষাঁড়, মস্ত তার সিং নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।  আমি আঁতকে চেঁচিয়ে উঠলাম ‘মলয় বাঁচাও’ পিছন থেকে উনি গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলেন ‘ফার্স্ট লেডিস দেন জেন্টস’ ”

সকলে হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে।

.

চলবে…………

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleভক্তির লক্ষণ (স্বামীজীর ভক্তিযোগ অবলম্বনে পুঁথি)
Next articleThe Painful Desires of an Unborn Girl Child
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments