কিরীটীর মনে দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল একবার অন্তত কেদারনাথ দর্শন করার। এমনিতে ঠাকুর দেবতার প্রতি কিরীটীর ভক্তি কিংবা বিশ্বাস আছে, কি নেই, সেই বিষয়ে কিরীটীর নিজের মনেই বিস্তর ধন্ধ আছে। মন্দিরের বিগ্রহর সামনে হাত জোর করে সময় কাটানো, প্রতীমার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বকা কিংবা সস্ঠাঙ্গে প্রনাম করা এই জাতীয় ব্যাপার স্যাপার কিরীটীর কাছে বড়ই অদ্ভুত লাগে। মনে মনে সে ভাবে এত ভক্তি এই মানুষগুলো কোথা থেকে আর কিভাবে পেলো । পাড়ার ঠকবাজ ব্যাবসায়ি, কিংবা গলাকাটা ডাক্তারটিকে যখন দূর্গা পুজোর আঞ্জলী দেবার সময় দেবী প্রতীমার সামনে নুয়ে পড়ে পেন্নাম করতে দেখে, তখন কিরীটী মনে মনে ভাবে ভগবান হয়তো এই ভক্তিটাই দেখতে চায়, তাইতো এদের এত অর্থের বোলবলা। কই কিরীটীতো পারে না এত ভক্তি প্রকাশ করতে — কেন পারেনা তা সে নিজেই জানেনা। কিরীটী বড় জোর লুকিয়ে টুক করে একবার কপালে হাতটি ছুইয়েই অধ্যয়টা শেষ করে। কে জানে, হয়তো ভয়ংকর পাপি বলেই কিনা, তাই ভগবান নিজেই কিরীটীর কাছে এর থেকে আর বেশি কিছু চান না।
ছোট বেলায় কিরীটী তার মাকেও এইরকমই দেখেছে। কিরীটীদের ঘরে কখনো কোন পুজো হয়নি এমনকি ঘরে লক্ষীর আসনটুকু পযর্ন্ত ছিল না। কোনদিন সন্ধ্যায় এমনকি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পর্যন্ত ঘরে প্রদীপ জ্বলানো বা শাঁখ বাজানো কিছুই হোতো না। বাবা কিংবা মা কাউকেই কোন পূজার অঞ্জলি দিতে দেখেনি কিরীটী । সে নিজেও শেষ কবে, কোন পূজোর অঞ্জলি দিয়েছিল মনে করতে পারেনা। কারোর ঠাকুর দেবতার উপর ভক্তি করা দেখে সেটাকে নিয়ে উপহাস করা বা কটাক্ষ করতে কিরীটী তার বাবা কিংবা মাকে কোনদিনও দেখেনি। কিরীটী নিজেও কারো ভক্তি বা বিশ্বাস নিয়ে কখোনই উপহাস বা কটাক্ষ করেনা। মনেপ্রানে বিশ্বাস করে ভক্তি ভাব বা বিশ্বাস যার যার নিজস্ব অধিকার। সেই চেতনা থেকেই সে কাউকে কখনো প্রশ্ন করেনি যে ঘটা করে দেখানো ভক্তি কি করলে পাওয়া যায়। কারোর ভক্তি বা বিশ্বাসের অধিকারের বিষয়ে কনা মাত্র অশ্রদ্ধা না দেখালে কি হবে, অনেক ভক্ত বন্ধুবান্ধব বা নিকটজন কিন্তু অতি উৎসাহে তাকে তাদের ঢঙে প্রনাম ট্রনাম করার জন্য কিরীটীকে বেশ চাপ দিয়েছে। দুনিয়ায় এইরকমই মনে হয় ঘটে থাকে, কোন মানুষ অন্য কোন মানুষের নিজস্ব বিশ্বাসকে আঘাত না করলেও সামনের মানুষটি অতি উৎসাহে অন্যজনকে নিজের বিশ্বাসে সামিল করার জন্য প্রয়াস করে। মনে হয় মানুষের এটাই প্রকৃতিগত স্বভাব। প্রনামের জন্য চাপ দিতে চাওয়া মানুষটির উপর কখনো হয়তো তখন বিরক্ত হয়ে বড়জোর কিরীটী বলেছে অত ভক্তি আমার নেই, তোমার ভগবান, তোমার ভক্তি, তুমি তোমার কাছেই রাখো। কিরীটীর বিরক্তি প্রকাশ দেখে চাপ দেওয়া সেই মানুষজনের অনেককেই কিন্তু তখন তাকে উপহাস করতে কুন্ঠা বোধ করেনি। উচ্চকীত ভক্তি — ভক্তর মনের জানালাগুলো বন্ধ করে দেয় নাকি জ্ঞানের জানালাগুলো খুলে দেয় সেটা কিরীটীর বোধগম্য হয় না।
কিরীটীর ঘরে কোন পূজার পাট না থাকলেও তার মা ছোট বেলায় তাকে নানা ঠাকুরের গল্প শোনাতো। কামাক্ষ্যা, কেদার, কাশী কিংবা মহাভারতের গল্প শুনতে শুনতে চরিত্রগুলোকে জীবন্ত অনুভব করতে পারতো সে । হিন্দু মাইথোলজির উপর মার শোনানো গল্পের ঝুলি, ছোটবেলা থেকেই মাইথোলজির সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। মাইথোলজির সব চরিত্রগুলো সে জীবন্ত অনুভব করতে পারে, তাদের চরিত্রের কাটাছেড়া করতে ভালো লাগে। মার মুখে কেদারের গল্গ শুনে কেদারনাথ যাবার ইচ্ছেটা সেই ছোট বেলা থেকেই কিরীটীর মনের মধ্যে ছিল। কেদারনাথ যাবো বললেই তো যাওয়া হয় না। অর্থ চাই, সময় ও সুযোগ চাই সবচেয়ে বড় কথা পাহাড়ে চড়ার পরিশ্রম করার ক্ষমতা আর সাহস চাই। বিয়ে হবার পর কিরীটী একা একা সিনেমা দেখা বন্ধ করে দিয়েছে। যখনই সিনেমা গিয়েছে, স্ত্রী আর মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই গিয়েছে । ২০১৯ সালের কোন এক মাসে, সকাল নটার শোতে, অন লাইনে টিকিট কেটে কিরীটীর মেয়ে তার বাবা ও মাকে নিয়ে সুশান্ত সিং রাজপুত আর সারা আলী খান অভিনীত নূতন রিলিজ হওয়া “কেদারনাথ” সিনেমাটা দেখতে নিয়ে গেল। ছবিটি দেখতে দেখতে হলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কিরীটী, বয়স তো চৌষট্টি হোল, না জানি কবে শরীর ভেঙে যায়, তাই এবার নইলে নেভার, সপরিবারে কেদারনাথ দর্শনে যাবোই যাবো। হাঁটার ধকল সইতে পারবে কিনা ভেবে হেলিকপ্টারে যাবার পরিকল্পনা করলো।
যেমনটি ভাবা তেমনটি কাজ। দূর্গাপুজো ছাড়া মেয়ে ছুটি পাবেনা, সেই বুঝে ২০১৯ সালের দূর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন ঋষিকেশ থেকে কেদারনাথ যাত্রার জন্য কলকাতার গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের চক্রবেড়িয়া রোডের অফিসে গিয়ে ঋষিকেশ থেকে কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ যাত্রার প্যাকেজ ট্যুর বুক করে ফেললো। ঋষিকেশে প্রথম রাতে ঋষিলোক ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সে কাটিয়ে পরের দিন সকাল আটটায় টু সিটার নন এসি বাসে রওনা দিয়ে রামপুরে রাত্রি বাস, পরেরদিন ভোরে নিজ ব্যাবস্থায় হেঁটে কিংবা ডুলি বা ঘোড়ায় চেপে কেদারনাথ যাত্রা ও কেদারনাথে ডরমেটরিতে রাত্রি বাস। পরের দিন রামগড় ফিরে এসে তিলওয়াড়া ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সে রাতের ঠাঁই। সেখান থেকে বদ্রীনাথে একরাত ও ষোশীমঠে একরাত কাটিয়ে ঋষিকেশ ফিরে যাত্রা শেষ। সমগ্র যাত্রা পথের বাস, গাইড আর গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সে বা বাংলোতে থাকা ও কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট নিগমের দায়িত্ব। লাঞ্চ, ডিনার কিংবা অন্য খাবার আর পূজোর খরচ যার যার নিজের নিজের । এই যাত্রার জন্য কিরীটীকে নিজের আর স্ত্রীর খরচ হিসাবে নিগমকে ১১৬৮০ টাকা জনপ্রতি আর মেয়ের জন্য ১২২২০ টাকা দিতে হোল। মেয়ে সপ্তমীর দিন রুদ্রপ্রয়াগ জেলার ফাটা হেলিপ্যাড থেকে কেদারনাথ যাবার জন্য থাম্বী এ্যাভিয়েশন হেলিকপ্টার সার্ভিসের যাতায়াত সমেত তিনটে সিট বুক করে ফেললো। জনপ্রতি হেলিকপ্টারে যাতায়াতের খরচ সাড়ে তিন হাজার টাকা।
চতুর্থীর রাতে এগারোটার পুরুষোত্তম এক্সপ্রেসে এসি টু টায়ারে সপরিবারে চড়ে বসল কিরীটী । তিন মাস আগে থেকে আসন সংরক্ষণ করা ছিল বলে বাঁচোয়া, নাহলে কে জানতো ভুবনেশ্বর থেকে দূর্গা পূজার সময় দিল্লিতে যাবার জন্য ট্রেনে এত ভীড় হয়। পঞ্চমীর পুরো দিনটা ট্রেনে কাটিয়ে ষষ্ঠীর কাক ভোরে দিল্লি পৌঁছে ওখান থেকে সকাল সাড়ে ছটায় দেরাদুন শতাব্দী এক্সপ্রেস ধরে এগারোটার সময় হরিদ্বার পৌঁছনোর কথা। পাটনার পর থেকে ওদের ট্রেন লেট করা শুরু করলো। ষষ্ঠীর সকালে ঘুম থেকে উঠে কিরীটীরা দেখল পুরুষোত্তম এক্সপ্রেস যে পরিমাণ লেটে চলছে, তাতে তারা দিল্লিতে পৌঁছনোর আগেই দেরাদুন শতাব্দী এক্সপ্রেস দিল্লি ছেড়ে দেবে। সবাই তুকলঘাবাদে নেমে গিয়ে সেখান থেকে সকালে দিল্লি ছেড়ে আসা সেই দেরাদুন শতাব্দী এক্সপ্রেস ধরেই আর কোনরকম দেরী ছাড়াই সঠিক সময়ে হরিদ্বার পৌঁছে গেলো সপরিবারে । পাঁচশো টাকায় গোটা অটো বুক করে সাড়ে বারোটার সময় ঋষিকেষে ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সের ঘরে ঢুকে স্নান করে ভাত খেয়ে দুপুরে বেড়িয়ে পড়লো ঋষিকেশ ঘুরে দেখতে। শেয়ার অটো করে রামঝুলা দেখে, সন্ধ্যায় গীতাভবনের গঙ্গার ঘাটে গঙ্গার আরতি দেখে রাতে কমপ্লেক্সে ফিরে এলো। ডিনার শেষে ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সের বিরাট চত্বরে খানিকটা পায়চারি করে শুতে গেল সবাই ।
সপ্তমীর সকালে ব্রেকফাস্ট করার পর সাড়ে সাতটায় মালপত্র নিয়ে রিসর্টের লাউঞ্জে এসে দেখলো সহযাত্রীরা যে যার ব্যাগ নিয়ে ভিড় জমিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিগমের বাসের প্রতীক্ষায়। আগামী দিনগুলোতে কি অপরূপ অভিজ্ঞতা হবে সেটা ভেবে সবাই মনে মনে উত্তেজিত। ঠিক আটটাতে বাস এসে দাঁড়ালো ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সের সামনে। তারপরেই একপ্রস্ত নাটক অপেক্ষা করেছিল। যে যার মতোন বাসে উঠে বসে পড়তেই ঝামেলা শুরু হয়ে গেল। একটি তেরোজনের কলকাতার দল দুজন মহিলার নেতৃত্বে ঝগড়া শুরু করল। ইংরেজির ছড়ড়া ছুটতে লাগলো। ঝামেলার চোটে গাইড এসে জানালো গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের নিয়মানুযায়ী বুকিং সিরিয়াল অনুযায়ী বাসের সিটে বসতে হবে। অর্থাৎ যারা আগে বুক করেছে তাদেরকে বুকিং সিরিয়াল অনুযায়ী বাসের সামনে থেকে বসতে হবে। তেরো জনের দল হৈহৈ করে সামনের দিকের সিটে বসে পড়লো। কিরীটীদের বুকিং নম্বর ছিল দশ থেকে বারো। তারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় রো মিলিয়ে, মানে মোটামুটি সামনের দিকেই সিট পেয়ে গেল। বাস ছেড়ে দিল কিন্তু সিটের ঝামেলা থামলো না। এদিকে গাইড যে বাস থেকে নেমে কখোন কেটে পড়েছে ঝগড়ার চোটে কেউ টের পায়নি। বাস ছেড়ে দেবার পর আবিষ্কার হোল তেরো জনের দলটার বুকিং নম্বর এক থেকে নয় আর পনেরো থেকে আঠারো। তেরো আর চোদ্দ নম্বরের দুজন বাঙালি যাত্রীকে ফাঁকি দিয়ে ঝগরুটে মহিলা দুজন তাদেরকে পিছনে পাঠিয়ে দিয়েছে। ধরা পড়ে যাবার পরে আর একপ্রস্থ ঝগড়ার শেষে যে যার নম্বরের সিটে বসলো, কিন্তু ততক্ষণে বাস সমতল ছেড়ে গঙ্গার ধারে ধারে পাহাড়ে চড়তে শুরু করে দিয়েছে। সেই তেরো জনের দলের সঙ্গে বাকি সবার সদ্ভাবের সূরটা তখনই কেটে গেল।
বাস ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের উপরে উঠছে, হৈ হট্টগোল থামিয়ে সবাই জানালা দিয়ে নীচে বয়ে চলা অপরিসর গঙ্গার রূপে মজেছে। এই সেই পুণ্যতোয়া গঙ্গা — যাকে নিয়ে হাজারো পৌরাণীক কাহিনী রয়েছে। কোন কাহিনী বলে শ্রীবিষ্ণুর তিন তিনজন পত্নী — লক্ষী, গঙ্গা ও সরস্বতী । তিন দেবীর কলহের কারনে শ্রীবিষ্ণু গঙ্গাকে মহাদেব আর সরস্বতীকে ব্রহ্মাকে দিয়ে দেন। কোনও একদিন কলহের সময় দেবী সরস্বতীর অভিশাপে সতীন গঙ্গা, নদী হয়ে ধরনীতে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছেন — আবার কোন পৌরাণিক কাহিনী বলে শিবের তেজ সহ্য করতে না পেরে ব্রহ্মার শরণ নিলে ব্রহ্মা গঙ্গাকে জল রুপে নিজের কমন্ডুলে আশ্রয় দেন। ব্রহ্মা একদিন শ্রীবিষ্ণুকে গান শোনানোর সময় সঙ্গীতে অভিভূত শ্রীবিষ্ণুর চোখের জল তার নিজের পায়ে পড়ে। ব্রহ্মা তার কমন্ডলুর জল দিয়ে শ্রীবিষ্ণুর চরণ ধুয়ে দিলে সেই জল শ্রীবিষ্ণুর চরণ ছুঁয়ে ধরণীতে গঙ্গা নদী হয়ে নেমে এসেছে — কোন পৌরাণিক কাহিনী বলে যে পার্বতীর দেহমল থেকে উৎপন্ন গনেশের প্রানহীন শরীরে গঙ্গাই প্রান প্রতিষ্ঠা করেন, সেই অর্থে ইনি শ্রীগনেশের মা। এই সেই মকরবাহিনী গঙ্গা — যিনি অষ্টবসু কে শাপমুক্ত করতে মহারাজ শান্তনুকে বিবাহ করেছিলেন। নিজ গর্ভে অষ্টবসুদের ধারন করে একে একে শান্তনুর সাতপুত্র মানে সাতটি বসুকে জন্মের সাথে সাথে নিজের শরীরে আশ্রয় দিয়ে মুক্তি দিতে পারলেও শান্তনুর বাধাদানে অষ্টম বসু অর্থাৎ মহামহিম ভীষ্মকে মানব রুপে জন্মানোর অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারেন নি। এই সেই গঙ্গা — যিনি কপিল মুনীর অভিশাপ থেকে সাগর রাজার সহস্রপুত্রকে উদ্ধার করতে ধরনীর বুকে নেমে এসেছিলেন ভাগীরথের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে। সাগর রাজার সহস্রপুত্র উদ্ধার করেছিলেন গঙ্গাসাগরে মিশে। এই সেই গঙ্গা — যিনি মর্ত্যে ভগীরথকে অনুসরণ করার সময় শঙ্খের ধ্বনীতে আকর্ষিত হয়ে ঋষি জহ্নুর আশ্রম প্লাবিত করেন। ক্রদ্ধ জহ্নু গঙ্গার সমস্ত জল পান করে ফেলেন। ভগীরথ ও অন্যান্য দেবতারা গঙ্গার মুক্তির জন্য ঋষির কাছে প্রার্থনা করতে থাকলে নিজের জঙ্ঘা বা জানু চিরে গঙ্গাকে মুক্তি দেন। এইরূপে গঙ্গা জহ্নু ঋষির কন্যা রূপে জাহ্নবী নামে পরিচিতা হন। — অনাদিকাল থেকে মানুষ বলে চলেছে — পতিত পাবনি গঙ্গে – হরহর গঙ্গে – সর্ব পাপ বিনাশিনী গঙ্গে — ঁগঙ্গাপ্রাপ্তি তাই মুক্তি বলে বিশ্বাস করে মানুষ। এই সেই গঙ্গা — ধরনীর বুকে নামার জন্য স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব জটায় তাকে ধারন করে ধরণীকে প্রলয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। গতকাল সপরিবারে ঋষিকেশে গীতাভবনের ঘাটে সন্ধ্যায় গঙ্গার আরতি দেখার সময় বিদেশীদের গঙ্গা প্রনামের ঘটার বহর দেখে আর ভারতীয় দর্শকদের বিদেশীদের সেই ঘটা দেখে আদিখ্যেতা করা দেখে কিরীটীর মনটাকে খিঁচিয়ে দিয়েছিল। আজ দুদিকে পাহাড়ের মাঝে কখনো ডানদিকে আবার কখনো বাঁদিকে তীব্র গতিতে বয়ে চলা এই নির্মল গঙ্গার দিক থেকে চোখ ফেরাবে কার সাধ্যি।
বাসের মধ্যে গাইড নিয়ে মোট সাতাশ জন বসতে পারে। ছাব্বিশ জন যাত্রীর মধ্যে একুশ জন বাঙালি, বয়স্ক দক্ষিণ ভারতীয় দম্পতি আর তিনজন হিন্দিভাষী। একজন সুঠাম চেহারার সত্তর বয়সের বয়স্ক বাঙালি যাত্রী গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের কর্তাদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন গাইডের ব্যাবস্থার জন্য। অনেক চেষ্টার পর যোগাযোগ করার পরে কথা বলে জানালেন বাসের ড্রাইভার নাকি খুবই অভিজ্ঞ এবং গাইডের কাজ করে দেবেন। সত্যি বলতে ড্রাইভারটি ভিষন পেশাদার ও ভালোই ছিল, তাই গাইডের দরকার পড়েনি। সাড়ে নটা নাগাদ এক জায়গায় বাস দাঁড় করালো কেউ যদি চা বা কিছু খায়। কেউই চা ছাড়া কিছু খেল না। মিনিট পনেরো পর আবার বাস চালু হোল। দেবপ্রয়াগে রাস্তার ধারে বাস দাঁড় করালো ড্রাইভার। রাস্তার ধারে বেশ উচু একটা যায়গায়। নীচে ভাগীরথি আর অলকনন্দার সঙ্গম পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। খরশ্রোতা পীত বর্ণের ভাগীরথীর মধ্যে শান্ত সবুজ অলকনন্দা মিলিয়ে যাচ্ছে। অপুর্ব দৃশ্য। এখান থেকেই গঙ্গা নাম নিয়ে সমতলে নেমে এসেছে গঙ্গানদী। লঙ্কাপতি রাবণ উচ্চমার্গের ব্রাহ্মণ ছিলেন। রাবণ হত্যার কারনে শ্রীরামচন্দ্রর উপর ব্রহ্ম হত্যার পাপ লাগে। কথিত আছে এই দেবপ্রয়াগে নির্জনে বসে মহাদেবের কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্ম হত্যার গুরুতর পাপ থেকে শ্রীরামচন্দ্র মুক্তি পান। বতর্মানে দেবপ্রয়াগ ইট পাথরে গড়া ঝকঝকে একটা শহর। গাড়ির ধুলো আর কোলাহলে শ্রীরামচন্দ্র দুরঅস্ত — এখানে আজকের দিনে কারোরই তপস্যা করার কথা ভাবাই যায় না। দশ মিনিটের বেশি দাঁড়ানো গেল না কারন আরো আনেক কিছু দেখার বাকি। দেবপ্রয়াগ ছাড়ার পর গঙ্গার বদলে এবার পথের সঙ্গী হোল হালকা সবুজ বর্ণের অলকানন্দা। যাত্রাপথে দুপুর নাগাদ পড়লো ধারাদেবী মন্দির। কেউ কেউ বলেন ইনি কেদারনাথের ভৈরবী, একে দর্শন না করলে কেদারনাথ দর্শন সমাপ্ত হয়না। কেদারনাথ যাত্রী সমস্ত ভক্তদের ইনি নিরাপত্তা প্রদান করেন। অলকানন্দা নদীর ঠিক মাঝে মন্দির, দুপাশ দিয়ে অলকনন্দা বয়ে চলেছে। সেতু বেয়ে সিড়ি দিয়ে অনেকটা নীচে গিয়ে দর্শন হয় দেবীকে। এখানকার মানুষজনের বিশ্বাস ধারা দেবী মন্দিরকে সরানোর কারনেই ২০১৩ সালে কেদারনাথে ভয়ংকর বিপর্যয় নেমে এসেছিল।
দু চার জনের মতোন কিরীটীরাও ধারা দেবী দর্শনে নীচে নামলো না। তেরো জনের দলটি নীচে নেমে পুজো দিতে গিয়ে এত সময় নিল যে সবার ক্ষিদে লেগে গেল। বাসের ড্রাইভার বললো আগে গিয়ে হোটেল পাবেন। পেটে ছুঁচো ডন মারতে লেগেছে তবু খাবার হোটেলের দেখা নেই। সবাই বলাতে ড্রাইভার একটা হোটেলের সামনে বাস দাঁড় করালো বটে, কিন্তু হোটেলের মান দেখে কেউ খেতে রাজি হোল না। আবার চলেছে বাস কখন ভালো হোটেল আসবে কে জানে? অবশেষে সাড়ে তিনটে নাগাদ একটা ঠিকঠাক খাবার হোটেলের সামনে বাস দাড় করালো। হোটেলে ভীষন ভীড়, প্রায় সব টেবিলে লোক ভর্তি, অর্ডার দিলে খাবার পেতে চারটে বেজে যাবে। কিরীটীরা একশো টাকা প্রতি প্লেট দরে তিন প্লেট খিচুড়ি অর্ডার করাতে সাথে সাথে দিয়ে দিল। খিচুড়ি নাতো যেন অমৃত। খিচুড়ি কে সঙ্গত দিতে হটাৎ কালো মেঘ করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। খিচুড়ি কিরিটী ভালোই খায় তবে তার মেয়ের আবার খিচুড়ি একেবারেই পছন্দ নয়। সেই মেয়েও সেদিনের সেই খিচুড়ির স্বাদটুকু এখোনো ভুলতে পারেনি। সাউথ ইন্ডিয়ান বয়স্ক দম্পতিও খিচুড়ি নিলেন। অনেকেই খাবার অর্ডার করলো। অর্ডার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে অনেকেই বলতে লাগলো খিচুড়ি নিলেই ভালো হোত। খাওয়া শেষ করে হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে পাহাড়ে ঝমঝমিয়ে হয়ে চলা বৃষ্টি তাড়িয়ে উপভোগ করতে লাগলো খিচুড়ি খানেওয়ালা লোকজন। সবার খাওয়া মিটতে মিটতে সাড়ে চারটে বেজে গেল। তখনো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু চারিদিকে ঝলমলে রোদ্দুরের মধ্যেই । একেই বলে প্রকৃতির খেলা। বাস আবার চলতে লাগলো, বৃষ্টি কখনো জোরে কখনো টিপটিপ করে পড়েই চলেছে। একটা যায়গায় বাস দাড় করিয়ে ড্রাইভার বললো নীচে রূদ্রপ্রয়াগ কা সঙ্গম দেখিয়ে। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে পরিস্কার দেখা গেল মন্দকিনী আর অলকানন্দার সঙ্গম। দেবপ্রয়াগের সেই শান্ত অলকানন্দা এখানে খরশ্রোতা আর মন্দাকিনী ধীর স্থীর। নির্ঘন্ট অনুযায়ী এই মন্দাকিনী নদীর অববাহিকা ধরে বাস এখন চলতে থাকবে গুপ্তকাশীর দিকে। ২০১৩ সালে কেদারনাথে বিপর্যয়ের সময় এই মন্দকিনী রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় তাবাহি মাচিয়েছে। এখান থেকে যাত্রা করার সময় সন্ধা নামছে।
বাস এগিয়ে চলেছে গুপ্তকাশীর পথে। অত্যন্ত খারাপ রাস্তা, তার উপর এখন ভালোই বৃষ্টি পড়েছে। কখনো ডাঁয়ে আবার কখনো বাঁয়ে স্বচ্ছ মন্দকিনী দৌড়ে চলেছে পাশে পাশে। ক্রমশ তার চন্ডাল রূপ নজরে পড়েছে। ২০১৩ র কেদারনাথ বিপর্যয়ের সময় মন্দকিনীর ভয়ংকর রোষের চিহ্ন ছয় বছর পার করেও এখনো মুছে যায় নি। বাসের দোলাতে চোখটা লেগে গিয়েছিল সবার। বাস থামিয়ে ড্রাইভার বললো আসুন গুপ্তকাশীর অর্ধনারীশ্বর দর্শন করে আসুন। বৃষ্টিটা ধরেছে, এবার বেশ ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে, অনেকটা উচু সিড়ি ভাঙার ব্যাপার, মনটা চা চা করছে। অর্ধনারীশ্বর না দেখে বাস ড্রাইভারকে ডেকে নিয়ে একটা দোকানে বসে জম্পেশ করে চা আর পাকোড়া ভাজা খেতে বসে গেল কিরীটীর পরিবার । তের জনের দলটি হৈহৈ করতে করতে চলল অর্ধনারীশ্বর দর্শনে। চা খেতে খেতে বাস ড্রাইভার জানালো রামপুর পৌঁছতে এখোনো অনেকটা সময় নেবে। যাত্রীরা অর্ধনারীশ্বর দর্শন সেরে ফিরে এলে বাস ছাড়লো। আবার জোরে বৃষ্টি শুরু হোল। অতীব বাজে রাস্তা, কাদাতে ভর্তি। যে কোন সময় চাকা পিছলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অত্যন্ত ধীর গতিতে বাস এগিয়ে চলেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তা, বাসের হেড লাইটের আলো ছাড়া কিছু নজরে পড়েছে না। সারা দিনের বাস যাত্রার ধকলে সবাই কেমন চুপ মেরে গেছে , যেন মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে চলেছে বাসটা । এত ধৈর্য্য আর মনোসংযোগ কোথা থেকে পায় এই পাহাড়ি পথের ড্রাইভাররা কে জানে।
রাত পৌনে নটা নাগাদ বাস এসে দাঁড়ালো গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের রামপুর বাংলোর লনে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে রিসেপশন আর ডাইনিং আর ক্লোক রুম। নীচের তলায় সারিবদ্ধ ঘর। রিসেপশন থেকে রুমের চাবি দিল সবাইকে। নীচে একতলার একদম শেষ ঘরটি দিল কিরিটীদের। ঘরে ঢুকে মালপত্র রেখে হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং হলে দৌড় দিল সবাই। ভাত, ডাল, জিরা আলু আর সেঁকা পাপড়। সামনে অনিশ্চিত যাত্রা তাই হালকা খাবার নেওয়াই ভালো। পেটে ভাত পড়তেই আবার সবাই চাঙ্গা। বৃষ্টি পড়েই চলেছে, এরকম বৃষ্টি হতে থাকলে কাল সকালবেলায় কেদারযাত্রা কিভাবে হবে, হেলিকপ্টার চলবে তো, সেই ভাবনাতে সবাই মনে মনে টেনশন নিয়ে যে যার ঘরে ঢুকে গেল।
অষ্টমীর সকালে কিরীটীর স্ত্রী তাকে আর মেয়েকে উত্তেজিত ভাবে তুলে দিল। আসলে ঘুম ভেঙে খাটের মাথার দিকে চওড়া কাচের জালানার ভারী পর্দাটা সরিয়ে দেখতে গিয়েছিল বৃষ্টি থেমেছে কিনা, আর তখনই ঝটকাটা খেয়েছে। আকাশে মেঘের লেশ মাত্র নেই। জালানার কাচের ওপাশে সবুজ পাহাড়ের পিছনে নাম না জানা বরফের চুড়া সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের মাথায় রুপোর মুকুট থেকে রঙ ঠিকরে পড়ছে দেখে সে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। কিরীটীরা সপরিবারে যেখানেই যায় সঙ্গে ছোট ইলেকট্রিক কেটলি থাকে। সকালে চা না খেয়ে বিছানা ছাড়া যায়? চা বানিয়ে খেয়ে প্রাকৃতিক কাজকর্ম সেরে ফিট হয়ে ডাইনিং হলে চলে এলো সবাই নিগমের দেওয়া কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট করতে। সকাল থেকেই মাথার উপর দিয়ে হেলিকপ্টারের যাতায়াত করার প্রচন্ড শব্দ মাঝেমাঝেই পাওয়া যাচ্ছে। ওরা জানতে পারলো তাদের বাসের দুটি অল্প বয়স্ক বাঙালি ছেলে সাথে হিন্দিভাষী তিনজন ও সুঠাম চেহারার বয়স্ক বাঙালি ভদ্রলোকটি ভোর চারটের সময় বেড়িয়ে পড়েছেন হেঁটে কেদারনাথ যাবে বলে। বাসের বাকি সবার হেলিকপ্টার বুক করা ছিল। বাসের এক মধ্যবয়সি দম্পতি মেয়েকে কলকাতা রেখে স্বামী ও স্ত্রী মিলে কেদারদর্শন করতে চলেছেন। কিরীটীদের মতোন ওদেরও থাম্বির হেলিকপ্টার বুক করা আর ওদেরও ফাটা হেলিপ্যাডে রিপোর্টিংয়ের সময় সকাল দশটায়।
রামপুরের বাংলোতে ক্লোক রুমে সব ব্যাগ সুটকেস জমা দিয়ে ওনারা দুজন আর কিরীটীরা তিনজন মিলে ছশো টাকায় একটা গাড়ি ভাড়া করে, মাঝ রাস্তায় একজায়গায় কেদারনাথ যাত্রার জন্য বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশন করে, এক কাপ করে কফি খেয়ে ফাটার হেলিপ্যাডে পৌছে গেল। দেখা গেল ওদের বাসের সমস্ত যাত্রীদেরই ফাটা থেকে থাম্বির টিকিট। তারাও সবাই এসে পৌঁছেছেন। ফাটাতে এসে জানতে পারলো পবনহংসের হেলিকপ্টার চালু হয়ে গেলেও থাম্বির সার্ভিস এখোনো চালু হয়নি। হেলিকপ্টারের রিপেয়ার চলছে তাই কখন চালু হবে কেউ বলতে পারছেনা। রিপোর্টিং হয়ে গেল, প্রত্যেকর ওজন করা হোল। সত্তর কিলোর উপর ওজন হলে কিলোপ্রতি একশো টাকা অতিরিক্ত চার্জ দিতে হবে। এক বেচারা তিরাশী কিলোগ্রাম হয়ে গেল। তেরোশো টাকা অতিরিক্ত দেবার সময় মুখের কি করুণ অবস্থা। ফাটা থেকে কেদারনাথ মাত্র সাত মিনিটে পৌঁছে দেয় হেলিকপ্টার। প্রতি ট্রীপে পাঁচজন যাত্রী আর চার ট্রীপের পর হেলিকপ্টারের দশ মিনিটের বিশ্রাম। যারা সেদিনই দর্শন করে ফিরে আসবে তারা আগে যাবে আর যারা কেদারনাথে রাত্রিবাস করবে তারা পরে যাবে। বেলা এগারোটা থেকে থাম্বির আকাশ যাত্রা শুরু হোল। কিরীটীদের নম্বর হোল সত্তর থেকে বাহাত্তর। বেলা দুটো হয়ে যাবে হেলিকপ্টার পেতে পেতে। আগের দিনের দুপুরের অভিজ্ঞতা মনে করতেই একশো টাকা প্লেট হিসেবে ভাত, ডাল ও দুরকম তরকারি দিয়ে ফাটাতেই একটা হোটেলে লাঞ্চ সেরে নিল। তরকারি নামেই, ছোলা আলুর ঝোল আর বাঁধাকপির ঝোল।
হেলিকপ্টাররে চড়ে বসলো সবাই। মেয়ে সিট পেলো পাইলটের পাশে। সাথে দুজন মহিলা হিন্দিভাষি যাত্রী। তারা ভয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। হেলিকপ্টারের আওয়াজে কানে তালা লেগে গেল। বিকেল সাড়ে তিনটের পর সপরিবারে কিরীটী নামলো কেদারনাথ হেলিপ্যাডে। নামতেই টের পাওয়া গেল ঠান্ডা কারে কয়। সাথে হাওয়ার দাপট। বাতাস হালকা হয়ে গেছে। দুচার ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে গেল। শিবের থান আর ষাঁড় থাকবেনা তা হয় নাকি , ঠাণ্ডায় মানুষের মতোন ষাঁড়ের নিশ্বাস থেকেও ভুরভুর করে বাস্পের ধোঁয়া বেরোচ্ছে। মন্দিরের থেকে হেলিপ্যাড মাত্র আধা কিলোমিটার এরিয়াল দূরত্ব। হেলিপ্যাড থেকেই মন্দিরের চুড়ো দেখা যাচ্ছে। হেঁটে এক কিলোমিটার মতোন সিড়ি ভাঙা হালকা চড়াই পথ। যদিও আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে মন্দিরের সামনে আলাদা ভাবে ঘর ভাড়া নিয়ে রাতে থাকা হবে, তবুও মন্দিরের দিকে না গিয়ে বিপরীত দিকে আরো এক কিলোমিটার দূরে গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের নির্দিষ্ট টেন্টের দিকে ওরা হাঁটা লাগালো সিটের দখল নিতে। টেন্টের ভিতরের অবস্থা খুব খারাপ। এক একটা ঘরে পাঁচ ছটা করে দোতলা খাট, অপরিসর যায়গা, নোংরা বাথরুম, নোংরা বিছানা ও কম্বল। মালপত্র রেখে সপরিবারে কিরীটীরা চললো কেদারনাথ মন্দিরের দিকে। টেন্ট থেকে প্রায় দূই কিলোমিটার এবরোখেবড়ো পথে হালকা চড়াই। বরফে ঢাকা কেদারচুড়ায় আসা থেকেই মেঘ আর বরফের লুকোচুরি খেলা সমানে চলেছে। কিছুদুর চলার পর কিরীটীর স্ত্রীর হাঁটু দুটো লক হয়ে গেল। আড়াইশো টাকায় একটি ছেলের ঢুলিতে বসিয়ে ওকে মন্দিরের চাতাল অবধি পৌঁছে দিল। বাপ বেটি হেঁটেই চলে গেল পথটা। মন্দিরের চাতালে পৌঁছে দেখে স্ত্রী চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ঢুলির ছেলেটি খুব যত্ন করে পৌঁছে দিয়েছে ওকে। মন্দিরের সমতল চাতালে পৌঁছে ওর হাঁটু ব্যাথা কমে গেছে। কমতে তো হবেই, কারন কেদারডোমে তখন রঙের ছোঁয়া লেগে গেছে। নানা রঙ নিয়ে মেঘ রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলার মধ্যে হাতের মুঠোয় ধরা দিচ্ছে কেদারডোম। মন্দিরে মাইকে ভক্তিগীতি বাজছে। লাইনে দাঁড়িয়ে প্রথমেই কেদারনাথ দর্শন করলো সবাই । দর্শন শেষে হোটেলের খোঁজে বেড়িয়ে পড়লো । মন্দির চাতালে দুটো ঠিকঠাক হোটেল নজরে পড়লো। হোটেলে ঠিক না, ধর্মশালাই বলা চলে। একটাতে জায়গা পাওয়া গেল না। অন্যটা খুব ছোট হলেও এর অবস্থানটা আগেরটার তুলনায় খুব ভালো জায়গায়। সাধুর পোশাকে কিছু লোকজন এটার দেখভাল করছে। এরা বললো একটা তিন বেডের ঘর দেবে ৩০০০ টাকা ভাড়ায়। এর সাথে গরম জল এক বালতি একশো টাকা আর রাতের খাবার জনপ্রতি একশো টাকা করে। অতি ছোট ঘর তবে তিনটে বিছানায় পরিস্কার কাচা চাদর, কাচা বালিশের কভার , লেপের আর কম্বল দুটোই একসঙ্গে দিয়েছে। পরিস্কার করে কাচা লেপ আর কম্বলের কভার, পরিস্কার মেঝে আর বাথরুম। রেজিস্ট্রারে সই করে তিন হাজার টাকা দিয়ে দোতলায় ঘর নেওয়া হোল। ঘরের দরোজা দিয়ে বেরোলেই লম্বা বারান্দা। সামনে যেদিকে তাকাও কেদারশৃঙ্গ ছাড়া আর কিছু নেই। হোটেলের দরোজা দিয়ে বেড়োন মাত্র মন্দিরের চাতালে প্রবেশ। মাত্র ষাট ফুট দুরে উন্মুক্ত মন্দির। গেরুয়াধারী জানালেন রাতের খাবার সাড়ে আটটার মধ্যে শেষ না করলে ওদের ওখানে খাবার পাওয়া যাবেনা।
মিসেসকে ঘরে রেখে বাপ বেটি দু কিলোমিটার নীচে গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের ডরমেটরিতে রাখা জিনিসপত্র আনতে ছুট লাগালো। সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার হয়ে গেছে তখোন। মালপত্র নিয়ে জনশুন্য রাস্তা ধরে গল্গ করতে করতে — দুর্দান্ত গতি ও আওয়াজ করে বয়ে চলা মন্দাকিনী আর সরস্বতী নদীর সঙ্গম পার করে — রাস্তার দুপাশে ২০১৩ মন্দাকিনীর বিপর্যয়ের কোপে পড়া ভাঙা ঘর গুলো দেখতে দেখতে — আর চড়াই চড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে রাস্তায় রাখা চেয়ারে বসে একটু করে চকোলেট খায় — গল্প করে আর বিশ্রাম নিতে নিতে যখন হোটেলে ফিরে এলো দুজনে ততক্ষণে মন্দিরের দরোজা বন্ধ হয়ে গেছে। রাতে খিচুড়ি খেতে বসে সাধুর পোশাকে লোকজনদের সাথে গল্প হোল। ২০১৩ সেই বিপর্যয়ের কথা শোনালেন ওরা। ভয়ংকর বৃষ্টি চলেছে দুদিন ধরে, দেওরিয়া তাল ঙাঙার বিকট আওয়াজ তারপর এই হোটেলের আর্ধেকটা জলের তোড়ে ভেঙে ভেসে গিয়েছিল। অবশিষ্ট অংশটুকু সারিয়ে ছোট করে আবার হোটেল চালূ করেছে। হোটেলের ভেঙে ভেসে যাওয়া অংশ সরকার ফেরত দেয়নি। সেটা এখন মন্দিরের বর্ধিত চাতাল। রাস্তায় ও মন্দিরের ভিতর কাদার মধ্যে মৃতদেহের স্থুপ ওরা জীবনে ভুলবেন না।
খাবার পরে তিন জনে মিলে ওরা মন্দিরের চাতালে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। মাইকে ভক্তিগান বন্ধ, জনমানব হীন মন্দির চাতালের একপ্রান্তে কয়েকজন ছাই মাখা সাধু আগুন আর ধুনী জ্বালিয়ে বসে আছে। এই সেই দেবাদিদেব মহাদেব — যিনি দেবতাদের আকুল আবেদনে সাড়া দিয়ে সমুদ্রমন্থনের সময় উৎসরিত ভীষন সেই কালকুট বিষ নিজের গলায় ধারন করেছিলেন শৃষ্টীকে রক্ষা করতে — নীলকন্ঠ মহাদেব — যখনই যখনই দেবতারা ফাঁপড়ে পড়েছেন তখনই তখনই ছুটে দারস্থ হয়েছেন এর কাছে। কাহিনী বলে — মহাভারতের কুরু পান্ডবের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে — শত ভ্রাতা, গুরু ও জ্ঞাতিহত্যার মহাপাপে পান্ডবরা জর্জরিত ও অনুতপ্ত — ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পান্ডবদের উপদেশ দিলেন এই সঙ্কটে মহাদেবের শরণাপন্ন হতে — মহাদেবের অর্শীবাদ ও করুনা লাভ করলে ভাতৃ ও গুরুজন হত্যার পাপ ও গ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে — পান্ডবদের মহাদেবের আর্শীবাদ লাভ করার জন্য সাধনা করতে বললেন। এদিকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর পান্ডবদের প্রতি মহাদেব ভিষন রুষ্ট হয়েছিলেন — পান্ডবরা মহাদেবের খোঁজে কাশী এলে রুষ্ট মহাদেব কাশী ছেড়ে হিমালয়ে উত্তরকাশী তে চলে এলেন — নাছোড়বান্দা পঞ্চপান্ডবরা মহাদেবের খোঁজে সেখানেও হাজির হলেন — মহিষের রূপ ধারন করে মহাদেব কেদার পর্বতে এসে বিচরণ করতে লাগলেন। পান্ডবরা এখানেও হাজির হলেন — মহিষরপী মহাদেবকে ভীম চিনতে পেরে গেলেন — পান্ডবদের হাত থেকে ছুটকারা পেতে মহিষ রূপী মহাদেব মাটিতে প্রবেশ করত লাগলেন — ভীম তাঁকে জাপটে ধরে ফেললে মহিষের পিঠের কুঁজ টুকু মাটিতে প্রবেশ করতে পারলো না। সেখানে তপস্যা করে পান্ডবরা মহাদেবকে তুষ্ট করে ভাতৃ ও গুরুজন হত্যার পাপ থেকে মুক্তি পেলেন। ইনি কেদারনাথ — মহিষের অন্য অঙ্গগুলীও কেদার, মদমহেশ্বর, তুঙ্গনাথ, কেদারনাথ, রুদ্রনাথ ও কল্পেশ্বর, সব মিলিয়ে এরাই হোলেন পঞ্চকেদার।
কেদারনাথের একটা গল্প মায়ের মুখ থেকে অবাক হয়ে শুনতো কিরীটী। কোন এক দরিদ্র শিব ভক্ত অতি কষ্টে ভাতৃদ্বিতীয়ার সন্ধ্যায় কেদারনাথ পৌছে দেখলেন মন্দিরের পুজারী মন্দিরের দরজা বন্ধ করে নীচে নেমে আসছেন। অনেক অনুনয় বিনয় করা সত্বেও পুজারী মন্দিরের দরজা খুললেন না। ভক্তকে বললেন ছয় মাস পরে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন এসো আর তখন দর্শন কোরো। চারিদিকে জনশুন্য হয়ে গেল। হতাশ ভক্ত কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন হে মহাদেব — দেখ আমি কত পাপী — তোমার দরজায় এসেও তোমার দর্শন পেলাম না। সেই সময় হটাৎ করে এক সুদর্শন সাধু উপস্থিত হয়ে ক্রন্দনরত ভক্তকে জিজ্ঞাসা করলেন কি হয়েছে? ভক্তর সব কথা শুনে বললেন কোন চিন্তা করো না কাল সকালেই মন্দির খুলবে তখন প্রানভরে দর্শন করে নিও। সাধু আগুন জ্বালালেন — রুটি বানিয়ে ভক্তকে খেতে দিলেন — খাবার পর বললেন এসো পাশা খেলে আজকের রাতটুকু কাটিয়ে দি কাল সকাল অবধি — সকালবেলায় মন্দির খুললে দর্শণ করে বাড়ি ফিরে যেও। সারারাত পাশা খেলার পর সকাল দিকে ভক্তর ঝিমুনি এল। ঝিমুনি কাটলে দেখে সাধু কোথাও নেই, সাধুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না, ওদিকে পুজারী তখন মন্দিরের দরজা খুলছেন। ভক্ত পুজারীকে বললে “কাল সন্ধ্যায় যে বললেন ছয় মাসের আগে দরজা খুলবেন না আর আজ সকালবেলায় মন্দির খুলছেন” ? পুজারী তো শুনে হতভম্ব, বলে কি লোকটা — কাল কোথায় — তিনি তো ছয় মাস পরেই মন্দির খুলছেন। লোকটার দিকে তাকিয়ে পুজারী তাকে চিনতে পারলেন। তার কাছ থেকে কি ঘটেছিলো জানতে পেরে পুজারী কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন — হে মহাদেব — আমি সারা জীবন তোমাকে পুজো করার পরেও দর্শন পেলাম না। ভক্তটিকে বললেন তুমি ধন্য যে ভগবান নিজে তোমার সাথে এই বরফে ছয়মাস সানিধ্য দিলেন।
দুদিন পরে বাসে করে বদ্রীনাথের পথে যাবার সময় কিরীটী দেখে সাউথ ইন্ডিয়ান বৃদ্ধাটি পিছনের সিটে বসে যারা কেদারনাথ হেঁটে চড়েছিল তাদের এই ভক্তের গল্পটা শোনাচ্ছেন। পাঁচ দশক পরেও মায়ের শোনানো সেই গল্পটা ওনার মুখে শুনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হোয়েছিল কিরীটীর। আজ মা দূর্গার নবমী পুজোর দিন। কনকনে ঠাণ্ডায় পরের দিন ভোরে উঠে দরজার ঠিক বাইরে হোটেলের বারান্দায় দাঁড়াতেই সবার মনে হোল এ যেনো স্বয়ং মহাদেব দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। আকাশে এক টুকরো মেঘ নেই। নীল আকাশের সামনে পুরো কেদারশৃঙ্গ তার সাথীদের সাথে উন্মুক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সোনালী বর্ণের ছটা সারা শরীরে। ডান দিকে ষাট ফুটের মধ্যে কেদারনাথ মন্দির। সোনার মুকুট ধীরে ধীরে রুপোর মুকুটে বদলে গেল। তাড়াতাড়ি পরিস্কার হয়ে মন্দিরের চাতালে চলে এলো সবাই। ঠান্ডায় শরীর জমে যাচ্ছে। খালি পা ঠাণ্ডায় অসাড়। পুজো দেবার লাইন পড়ে গেছে। পুজোর ডালা কিনে লাইন দিয়ে মন্দিরের দিকে চলল সবাই। দূর্গা নবমীর পূণ্য সকালে, আজ সবার উপর মহাদেবের আর্শীবাদ ঝড়ে পড়েছে। কোথাও মেঘের কনামাত্র নেই। মন্দিরের বাইরে নন্দী আর ভিতরে নাটমন্দিরে পাঁচ পান্ডবের পাথরের মুর্তি। দেড় হাজার টাকা নিয়ে দর্শণার্থীদের পাশের দরোজা দিয়ে নাট মন্দিরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একেইতো মন্দিরের ভিতরে পরিসর বলতে সামান্য — তার মধ্যেই দলে দলে দেড় হাজারি ভি আই পি ঠেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে — অফ সিজিনেও সেকি ভিষন ঠেলাঠেলি — সিজিনে এখানে না জানি কি হয়। মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকে শিব লিঙ্গের কাছে আর পৌছাতে পারছে না কিরীটীরা কেউ। ভীড় ঠেকিয়ে এককোণে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হটাৎ একজন পুরোহিত ওদেরকে ঠেলে শিব লিঙ্গের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। এ যেন ম্যাজিকের মতোন। শিব লিঙ্গের আকার এখানে অনেকটা ত্রীকোন প্রীজমের মতোন, মহিষের পিঠের আকৃতি। লিঙ্গ স্পর্শ করতেই হাতে তেল, ঘি আর ফুলে মাখামাখি। সেই পুরোহিতই আবার ওদের ওখান থেকে টেনে উঠিয়ে আনলো। হাতের ডালাটা নিয়ে দু চারটে মন্ত্র বলে শিবের স্পর্শ করিয়ে ডালাতে ফুল দিয়ে ফিরিয়ে দিল। একশোটা টাকা হাতে দিতেই আবার অন্য লোককে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। দর্শন ও পুজো শেষ করে মন্দির প্রদক্ষীণ করার সময় মন্দিরের ঠিক পিছনে থাকা সিঁদুর মাখানো বড় পাথরের সামনে দাঁড়ালো। ২০১৩ সালে দেওরিয়া তাল ভেঙে মহারোষে মন্দাকিনী যখন সব ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন এই বিশাল পাথরটা নিজে থেকে গড়িয়ে এসে এখানে পড়ে। জল পাথরে বাধা পেয়ে দুপাশ দিয়ে বয়ে গেলে কেদারনাথ মন্দির ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায়। লোকে এর নাম দিয়েছে ভীম শীলা। এরও পুজো করছে মানুষজন। ভীম নাকি শীলা রূপে বুক পেতে দাঁড়িয়ে মন্দির রক্ষা করেছেন।
শোনা যাচ্ছে সম্প্রতি ওখানে শঙ্করাচার্য্যের বিরাট পাথরের মূর্তি বসানোর অনুমতি দিয়েছেন সরকার বাহাদুর। আচ্ছা — শ্রী শঙ্করাচার্য্য, যিনি আঠারোশো বছর আগে এই অতি দূর্গম স্থানে কেদারনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি চাইলে কি নিজের মূর্তি বানাতে পারতেন না। মাইথোলজির সাথে সামন্জস্য রেখে শিব লিঙ্গের আকার শ্রী শঙ্করাচার্য্য সর্বপ্রথম এখানে খুঁজে পেয়েছিলেন। কোন আকারের বিকৃতি হোক তিনি চান নি। আঠারোশো বছর বাদে হটাৎ করে কেন মানুষ ক্ষেপে উঠলো সেই নীরব কর্মযোগী সাধকের মূর্তি বানানোর জন্য সেকথা কিরীটীর বোধগম্যর বাইরে। দেড়হাজার টাকার বিনিময়ে ভি আই পি নাম নিয়ে লাইনে দীর্ঘ অপেক্ষারত ভক্তদের টপকে — আগে দেবতার দরবারে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব — এটা তো চাক্ষুস করেছে — এছাড়াও এই দেবস্থানে আসা মানুষজনের কাছে মোদিজির ধ্যানের ভাইরাল হওয়া গুহাটাও দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে। কিরীটীর ভাবনা অনেকর সাথে যায়না বলেই সে ভাবলো কি দরকার এইসব দেবস্থানকে আধুনিকতায় মুড়ে ফেলার? থাকনা সেগুলো অনাদিকাল একইরকম আদীম চেহারা আর ভক্তি নিয়ে।
পুজো, দর্শণ শেষ করে একটা ছোট দোকানে হাতে গড়া রুটি আর ছোলার ঝোল দিয়ে টিফিন হোল। আলুর পরোটা আর আচার সর্বত্র দারুণ চলে পুরো গাড়োয়ালে। টিফিন শেষ হতে না হতেই হেলিকপ্টার কোম্পানির ফোন হাজির। চলে এসো হেলিপ্যাডে, ফিরে যেতে হবে এবার। নবমীর পরিস্কার আকাশ, উন্মুক্ত কেদারশৃঙ্গকে পিছনে ফেলে ফিরে আসতে হচ্ছে। মন না চাইলেও, কি করা যাবে এটাতো প্যাকেজ ট্যুর, তাই সব কিছুরই সময় পূর্বনির্দিষ্ট। হাতের নাগালে বরফের শৃঙ্গ, এমন গাম্ভীর্যময় পরিবেশ, পৌরাণিক ঘটনাবহল আর এত পুরোনো মন্দির আর কোথায় পাওয়া যাবে। একটাই প্রার্থনা — হে দেবাদিদেব — আধুনিক ভারতের মানুষের হাত থেকে নিজেকে আগের মতোন ধরে রাখতে নিজেকে নিজেই রক্ষা করো।
কেদার ক্ষেত্রে আর একটা মন্দিরকে এই সুযোগে দেখা হয়ে গেল কিরীটীদের। সাত মিনিটের মধ্যে হেলিকপ্টার কেদারনাথ থেকে ফাটায় ফিরিয়ে নিয়ে এল। যে পরিবারটি আসার সময়ে তাদের সাথে শেয়ার গাড়িতে এসেছিল তারা আগের হেলিকপ্টারে এসে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। এবার ছশো টাকার রফাতে একটা গাড়ি সবাইকে রামপুরে নিয়ে এল। রামপুর বাংলোতে তখনও কেউ ফিরে আসেনি। ঐ ড্রাইভার হাজার টাকায় ত্রীযুগীনারায়ন মন্দির দেখিয়ে ফিরে আসতে রাজি হয়ে গেল। পৌরাণিক কথা বলে এই ত্রীযুগীনারায়ন মন্দিরেই নাকি নারায়নের উপস্থিতিতে এবং ব্রহ্মার পৌরোহিত্যে শিব ও পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল। শিব ও পার্বতীর বিয়ের সেই যজ্ঞের আগুন অনাদিকাল থেকে আজও জ্বলছে। কিরীটীরা ভেবে ছিল কোন পাহাড়ের ভিতরে কোন প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎস থেকে মনে হয় আগুন জ্বলে, কিন্তু দেখা গেল সেটা নয়। জঙ্গলের মধ্যে জনশুন্য রাস্তা। শোনপ্রয়গের পাশ কাটিয়ে গাড়ি জোরে চালিয়ে আধা ঘন্টায় সেখানে পৌঁছে গেল সবাই। কেদারক্ষেত্রে সব মন্দিরের গঠনশৈলী মোটামুটি একই রকমের। উঁচু রাস্তায় চড়ে গেলে মন্দির নীচে। মানুষজনের ভিড় বিশেষ থাকেনা। মন্দিরের বাইরের থেকে ডালি কিনে কোন দম্পতি মন্দিরে ঢুকলে পুরোহিতরা ছেঁকে ধরে আবার বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন। ব্যাপারটা না জানা থাকায় ওনারা ও কিরীটিরা বাইরে থেকে ডালা নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই পুরোহিতরা ছেঁকে ধরলেন। পুরুষরা আপত্তি জানালেও মেয়েদের চাপে বাধ্য হয়ে বসতেই হয়। মেয়ের সামনে তার বাবা আর মার আবার বিয়ে দিয়েই ছাড়লো। সঙ্গী ভদ্রলোকের একই দশা হোল। তবে মাত্র একশো টাকা দক্ষিণায় পুরোহিতদের ব্যাপারটা শেষ হওয়াতে ব্যাপারটা অন্তত তিক্ততা অবধি গড়ালো না। মন্দিররে শিব ও পার্বতীর বিবাহ মঞ্চে কাঠের আগুন জ্বলছে। যেই দর্শন করতে যায় সেই দশ টাকা মূল্যের কাঠ ঐ আগুনে উৎসর্গ করে যায়। সবাই এক টুকরো কাঠ ঐ আগুনে দিল। এখানেও সব স্বামী ও স্ত্রীকে জোড়ায় এই আগুনকে একবার পাক দিয়ে যেতে বলে। শীতের সময় চারিদিকে বরফ ঢেকে গেলেও পুরোহিতরা এই আগুনটা নিভতে দেন না।
আগামীকাল সকালে মন্দাকিনীর অববাহিকা ছেড়ে এবার সবাই বাসে করে অলকনন্দার অববাহিকা পথ বেয়ে বদ্রীনাথের পথে যাত্রা শুরু করবে।কেদারক্ষেত্রে মানুষজন এখনো সরল বলেই মনে হোল। বেশীরভাগ লোক বছরের ছ মাস এখানে রোজগারের জন্য থাকেন, আর বাকি ছ মাস সমতলে অন্য পেশায় থাকেন। কিরীটী ভাবলো কেদারনাথ কিংবা চারধাম ট্রেন কিংবা এলিভেটেড রোড দিয়ে জুড়ে দিলে সভ্যতার ছোঁয়ায় আর পয়সার জোরে কথা বলা ভি আই পি ভক্তদের ভীড়ে কি দশা আর হোতে পারে — শহর আর শহরতলী থেকে মানুষের ভয়ে ভুতেদের পালিয়ে যেতে হয়েছে — ঠিক ভুতেদের মতোন ভগবানকেও এইসব দেবস্থানগুলো থেকে পালাতে হবে হয়তো। মানুষের ভয়ে ভগবান পালানোর আগেই তার এই দরবারে পৌঁছনোটাই কিরীটীদের মতোন লোকেদের কাছে পরম সৌভাগ্য হয়ে রইল।